লেখকঃ হোসেন নীল
রোহিঙ্গাদের উপর মায়ানমারের রাষ্ট্র সরকার প্রতিক্রিয়াশীলরা বৌদ্ধ ধর্মবাদের ভিত্তিতে যে ধারাবাহিক জাতিগত নিপীড়ণ চালিয়ে আসছে তার সর্বশেষ চিত্র দেখে বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা দুনিয়ার জনগণ মর্মাহত হয়েছেন। রোহিঙ্গা না্রী পুরূষ শিশু বৃদ্ধ মানুষের আহাজারিতে
আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। শত শত রোহিঙ্গা মানুষ মিয়ানমার রাষ্ট্র ও বৌদ্ধবাদীদের হাতে গণহত্যার স্বীকার হয়েছেন। এবার বর্মী রাষ্ট্র হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে পর্যন্ত গুলি চালিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে, বহু গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, শত শত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, শত শত শিশুকে আগুণে পুড়িয়ে ও বিভিন্নভাবে হত্যা করা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেষ্টা করছেন, বাংলাদেশ প্রতিক্রিয়াশীল সরকার রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দিচ্ছেনা—যারা বাঙালীদেরই জাতি ভাই—পিছন থেকে বর্মী বাহিনী গুলি করে—নাফ নদী লাল হয়ে উঠল রক্তে, রোহিঙ্গা শিশুদের লাশ ভেসে আসল, এর দায়িত্ব কার? তথাকথিত নোবেল সুকির যে সমগ্র জাতিগত নিপীড়ণকেই
অস্বীকার করেছে, নাকি হাসিনার যে রোহিঙ্গাদের বোঝা মনে করে অথবা সন্ত্রাসী মনে করে? আর এই হাসিনারা বাঙালী জাতিয়াতাবাদী দাবি করে। সুতরাং সুকির ‘গণতন্ত্র’ আর হাসিনার ‘জাতীয়তাবাদ’ মানে হচ্ছে বাঙালীদের জাতিভাই রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ণ। একটা নিপীড়িত জাতিকে যারা সন্ত্রাসী মনে করে তারা সমগ্র মানব জাতির শত্রু। রোহিঙ্গাদেরকে বর্তমান দুনিয়ার সর্বাধিক নিপীড়িত জাতি হিসেবে জাতিসংঘ নিজেই ঘোষণা করেছে, যদিও এর প্রতিনিধি দুইবার আরাকান পরিদর্শন
করার পরও রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত গণহত্যাকে অস্বীকার করে। ইতিমধ্যে উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে পরিষ্কারভাবে গ্রামে গ্রামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ও রাষ্ট্রের শত বাঁধা সত্ত্বেও কয়েক সপ্তাহে কমপক্ষে ২০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, পর্বতসংকুল বাঁধা পেড়িয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন।
রোহিঙ্গা-বাঙালী
যে কারণে রোহিঙ্গারা মায়ানমারের প্রতিক্রিয়াশীল বামার আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র ও বৌদ্ধবাদীদের জাতিগত নিপীড়ণের শিকার হয়েছেন তা হচ্ছে রোহিঙ্গা জাতির সাথে বাঙালী বিশেষত চাটগাঁইয়া (চট্রগ্রামীয়) জনগণের জাতিগত মিল এবং ধর্মগতভাবে তাদের মুসলমান হওয়া। যে বামার জাতির জাতিগত আধিপত্য রাখাইন বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক সংঘাতে ঠেলে দিয়ে আসছে সেই বর্মী আক্রমনে অষ্টাদশ শতকে
রাখাইন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গারা শত শত সংখায় বাংলায় চলে এসেছিল। এখনো দুই লক্ষাধিক রাখাইন বা মগ বা মারমা বাংলাদেশে আছে। রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের পালটা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস ঘটেছিল ধারণা করা যায়।
এক হাজার বছর ধরে আরাকানের অধিবাসীগণ একত্রিতভাবে বাস করেছেন। প্রায় তিনশত বছর বৌদ্ধ শাসকদের উপর বাংলার মুসলিম শাসকদের প্রভাব ছিল। আরাকানের রাজসভায় আলাওলের মত বিখ্যাত বাংলা কবি ছিলেন। এখানে মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবাধীন জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেখা যায়নি। ধর্মের প্রতিপালন সাধারণত রাজা রাজড়ারা করত। যখন দুই ধর্মের রাজাদের মধ্যে সংঘাত না ঘটে বরং আপোষ ঘটে তখন জনগণের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটেনা। তবে ধর্মের অনুশীলনের মধ্যে বিদ্বেষের বীজ থেকে যায়। ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করে ঐক্যবদ্ধ করেনা। বামার আধিপত্য একশ বছরের মত ছিল, এইসময় অবশ্যই বামার কর্তৃক
বৌদ্ধবাদী ধর্মবাদ একটি ঘৃণার ভাব নিয়ে অগ্রসর হয় যা ব্রিটিশের উপনিবেশিক কালে পুর্ণরূপ পরিগ্রহ করে। বৃটিশ উপনিবশিক কালে আরাকানে শুধু নয় সমগ্র মায়ানমারে ভারতীয় প্রবেশ ঘটে, চাকুরী, বনায়ন ও খনি শ্রমিক হিসেবে তাদের বসতি স্থাপন বেড়ে চলে। রেঙ্গুন অভিবাসী শহর হিসেবে নিউইয়র্ককে অতিক্রম করে। এটা শুধু বাঙালী নয় ভারতীয় সমস্ত জাতিসত্ত্বাই, পরবর্তীতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে জাপানী আগ্রাসনে বার্মা জাপান কর্তৃক অধিকৃত হলে বৃটিশ পশ্চাদপসারণের ফলে অভিবাসীরা বিরাট সংখ্যায় ভারত তথা বাংলায় ফিরে আসে ও পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে জেনারেল নেউইনের খেদাও অভিযানে লক্ষ লক্ষ ভারতীয়, বাঙালী ও চীনা যথাক্রমে ভারত, বাংলাদেশ ও চীনে আশ্রয় নেয়। বৃটিশরা যে বাঙালী শ্রমিকদের সেটলার হিসেবে আরাকানে নিয়ে এসেছিল তা রোহিঙ্গা জাতি গঠনে অবদান রাখলেও তা একটি অংশ মাত্র, প্রাচীন ভারতীয় সমাজের জনজাতিসমূহ থেকে রোহিঙ্গা জাতি বহু শত বছর ধরে গড়ে উঠেছে প্রথমে আরাকানে মারুক উ রাজত্বের তিনশত বছর বছরে, তারপর বৃটিশ শাসনে, তারপর মিয়ানমারের নিবর্তনমূলক সমাজে।
রোহিঙ্গারা বৃটিশদের কর্তৃক সশস্ত্র হলে জাপানকে সহায়তাকারী রাখাইন ও বর্মীদের সাথে তাদের ভয়াবহ সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয় যাতে উভয় পক্ষের সহস্র সহস্র জনগণ নিহত হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন অবসানের পর ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলে রোহিঙ্গারা পাকিস্তানে যোগ দিতে চায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হতে চায়, মুজাহিদ পার্টি গঠন করে ও সশস্ত্র সংগ্রাম চালায়,
১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতায় এসে ব্যাপক দমনাভিযান গণহত্যা গণনির্যাতন চালিয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়, সামরিক স্বৈরতন্ত্রী নে উইন আর হাসিনা-খালেদার মত বর্তমান সুকির কথিত ভেকধারী গণতন্ত্রীরা রোহিঙ্গাদের জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়না, তাদের নাগরিকত্ব দেয়না, লেখাপড়া, চিকিৎসা বা কোন অধিকার দেয়না, তারা বহু রোহিংগাকে ঘেটো ধরণের ক্যাম্পে আটকে রেখেছে যার বাইরে তারা যেতে পারেনা। ১৯৬২র পর একইভাবে ১৯৭৮
সালের দমনে দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়, একইভাবে ১৯৯২ সালের দমনে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা, ২০১২ সালের দমনে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় আর বর্তমান দমনে এ পর্যন্ত দুই সপ্তাহে ২০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। জাতিগত মিল থাকায় রোহিঙ্গারা চট্রগ্রামের জনগণের মধ্যে অতি সহজেই মিশে যায়। চট্রগ্রাম অঞ্চলের মানুষ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় খাদ্য সহযোগিতা সবই দিচ্ছেন। একইভাবে প্রায় এককোটি বাঙালী ১৯৭১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল, ভারতের বাঙালীরা জাতিগত মিল থাকায় তাদের আশ্রয় খাদ্য সবই দিয়েছেন। ভারত সরকারও সহযোগিতা করেছে। সুতরাং হাসিনার অত্যাচার বাঙলাদেশের বাঙালীদের দমিয়ে রাখতে পারবেনা। হাসিনাদের প্রতিরোধ করেই তাদের সহযোগিতা করতে হবে।
মুসলিম ও বাঙালী হিসেবে নিপীড়িত হওয়ার কারণে দুই চেতনা রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিকশিত হবেঃ একটা ধর্মীয় আরেকটা জাতীয়। পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যেও একসময় হিন্দু জমিদার শ্রেণীর নির্যাতন শোষণের ফল হিসেবে মুসলিম ধর্মীয় চেতনা জাগে, কিন্তু দ্রুতই পাকিস্তানী শাসকদের বাঙালীবিরোধী জাতিগত নিপীড়ণ শোষণের ফল হিসেবে বাঙালী জাতীয় চেতনা বিকশিত হয়। রোহিঙ্গাদের মধ্যেও তেমনটা ঘটতে বাধ্য। রোহিঙ্গা জনগণের মধ্যে ইসলাম ধর্মবাদীরা কাজ
করছে, তাদেরকে তারা ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদের দিকে চালিত করার চেষ্টা করবে, প্রগতিশীলদেরকে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বর্বর চরিত্র তুলে ধরতে হবে আর তার বিপরীতে প্রগতিশীল ভাবধারা জাগিয়ে তুলতে হবে, সাম্যবাদের ভাবধারা—যাতে তারা শিক্ষিত হলে জানতে পারবেন পৃথিবী কীভাবে বিকশিত হয়েছে, কীভাবে এগিয়ে যাবে, সুকি বা হাসিনারা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল গণতন্ত্রের প্রতিনিধি যা হচ্ছে একটি ভাওতা, আসলে তারা হচ্ছে শ্রমিক, কৃষক জনগনের উপর বুর্জোয়া-সামন্ত ও বিদেশী শোষকদের একনায়কত্ব চালানোর প্রতিনিধি। বিপরীতে আরেক ধরণের গণতন্ত্র রয়েছে যা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে নিয়ে যাবে—যা হচ্ছে নয়া গণতন্ত্র যা কেবল সাম্যবাদীদের নেতৃত্ব অর্জিত হবে সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদী সমাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।■