মহান লেনিনের মৃত্যু শতবার্ষিকী

আজ বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের নেতা মহান লেনিনের শততম মৃত্যুবার্ষিকী। লেনিন জন্মেছিলেন ১৮৭০ সালের ২২শে এপ্রিল রাশিয়ার সিমবির্স্ক শহরে।

“রাশিয়ায় সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি গঠিত হয় ১৮৯৮ সালে। ১৯০৩ সালে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটিতে লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, কর্মসূচিগত প্রশ্নেও তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন কিন্তু পার্টির গঠনতন্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মার্তভের নেতৃত্বে সুবিধাবাদীরা লেনিনের বিপ্লবী সূত্রের বিপরীতে এক সুবিধাবাদী সূত্র পাশ করালেন। এই পার্টি প্রশ্নেই রুশ সমাজগণতন্ত্রী শ্রমিক পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়ঃ লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা অধিকাংশ প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে তাদের নাম হয় বলশেভিক (সংখ্যাগরিষ্ঠ) আর মার্তভের নেতৃত্বে সুবিধাবাদীরা

বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের নেতা লেনিন

বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের নেতা লেনিন

সংখ্যালঘিষ্ঠ বলে নাম হয় মেনশেভিক (সংখ্যালঘিষ্ঠ)। লেনিনই বলা চলে মার্কসবাদী পার্টির প্রকৃত গোড়াপত্তন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন এই পার্টি হচ্ছে একটি বাহিনীর মত সুশৃংখল, যার নেতারা হবেন পেশাদার বিপ্লবী যাদের বিপ্লব ছাড়া অন্য কোন পেশা নেই। এই পার্টি হচ্ছে কেন্দ্রীভূত। এর থাকবে বিপ্লবী তত্ত্ব, যা ছাড়া কোন বিপ্লবী আন্দোলন হতে পারেনা।” 

[সিপিএমএলএম এর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ কর্তৃক প্রকাশিত জ ভ স্তালিন রচিত সর্বহারা শ্রেণী ও সর্বহারা পার্টি রচনার ৪ঠা জুন ২০২৩  বাংলা সংস্করণের ভূমিকা]

রুশদেশে সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি লেনিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে এর নাম ছিল রুশ সমাজ গণতন্ত্রী পার্টি। জারতন্ত্র অবসানের জন্য ১৯০৫ সালের বিপ্লবে তা ভূমিকা রাখে। এই পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে জারতন্ত্রের অবসান ঘটানো হয় এবং আট মাস পরে অক্টোবরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। মানব ইতিহাসে এই প্রথম সর্বহারা শ্রেণী পূর্ণাঙ্গভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। বিশ্ব ইতিহাসে তা নতুন যুগের সূচনা করে।

“মহান মার্কস ও এঙ্গেলস যে দিশা মানব জাতিকে দিয়েছেন তা হচ্ছে কমিউনিজমের দিশা। মার্কসবাদের মধ্যে মূর্ত এই মতবাদকে মহামতি লেনিন বলেন সর্বশক্তিমান, কারণ তা সত্য। আজকের যে শোষণমূলক সমাজে আমরা বাস করছি তা একসময় অস্তিত্বমান ছিলনা। আদিম সাম্যবাদী সমাজে কোন শোষণ ছিলনা। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই ছিল সমান। যৌথভাবে সবাই কাজ করতো আর কাজের ফল সমভাবে তা সবার মধ্যে বন্টিত হতো। পরবর্তীতে যখন মুষ্টিমেয় কিছু লোক যারা ছিল গোত্রপতি, বিভিন্ন সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিপত্তি ও সম্পদের মালিকানা অর্জন করে ব্যাপক অধিকাংশ মানুষকে দাস বানিয়ে ফেলল তখন থেকেই শ্রেণী সমাজের উদ্ভব ঘটলো। শোষণের এ ধারা বজায় থাকে দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও বর্তমান পুঁজিবাদী স্তরে। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস সর্বপ্রথম দেখান যে সমাজের শোষিত শ্রেণী সর্বহারা শ্রেনী এই পুঁজিবাদী সমাজকে ভেঙে ফেলবে আর গড়ে তুলবে সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজ। মহান লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় পুঁজিবাদী সমাজকে উৎখাতের মাধ্যমে গড়ে ওঠে প্রথম সমাজতান্ত্রিক সমাজ। স্তালিনের নেতৃত্বে এ সমাজ সংগ্রাম করে টিকে থাকে। মাওয়ের নেতৃত্বে চীনে সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাতের মাধ্যমে নয়াগণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের ধারা সূচিত হয়।

মহামতি লেনিন

মহামতি লেনিন

এই মহান আদর্শিক সংগ্রাম শুরু হয়ে হয়েছিল ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও!’ ঘোষণা করার সাথে সাথে, তারপর মানব জাতি প্রত্যক্ষ করেছে অপরিমেয় আত্মদান ও মহান সংগ্রামসমূহ। ১৮৭১ সালে প্যারী কমিউন, ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্ল­ব, ১৯৪৯ সালে চীন বিপ্ল­ব আর ১৯৬৬-১৯৭৬ সালের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্ল­ব ছিল সর্বহারা নেতৃত্বে এই লক্ষ্যে মহান সব বিপ্ল­বসমূহ। তারপর পেরু, নেপাল, বাংলাদেশ, ভারত, ফিলিপাইন, তুরস্কসহ সারা দুনিয়ায় গণযুদ্ধের নতুনসব উত্থানসমূহ আজকে বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে সেই লক্ষ্যের দিকে। কমিউনিজমের মতবাদ মার্কস-এঙ্গেলস কর্তৃক মার্কসবাদে. লেনিন-স্তালিন কর্তৃক লেনিনবাদে আর মাও-চারু মজুমদার-সিরাজ সিকদার-গনসালো-ইব্রাহীম কাপাক্কায়া প্রমুখ কর্তৃক মাওবাদে রূপ নিয়েছে। আজকে এই মতবাদ অব্যাহতভাবেই বিকশিত হয়ে চলেছে।”

[২০১২ সালের ১ মে সিপিএমএল এম বাংলাদেশ এর ঘোষণা]

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর মতবাদ, যা হচ্ছে অবিচ্ছিন্ন। এর দ্বিতীয় স্তর ছিল লেনিনবাদ অর্থাৎ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। এর সম্পর্কে জানতে বুঝতে হলে মালেমার অবিচ্ছিন্ন ধারা হিসেবে একে বুঝতে হবে।

সিপিএমএলএম-এর ঘোষণাও আরো বলা হয়েছেঃ

“লেনিনবাদ
রাশিয়ায় বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় লেনিন মার্কসবাদকে সম্পূর্ন এক নতুন স্তরে উন্নীত করেন তা হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। লেনিন দেখান যে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের স্তরে উন্নীত হয়েছে যেখানে শিল্প পুঁজি ও বনিক পুঁজির মিলনের ফলে লগ্নি পুঁজির উদ্ভব ঘটেছে এবং পুঁজি রপ্তানীই এই পর্যায়ের প্রধান ধারা। সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে একচেটিয়া পুঁজিবাদ আর এটা হচ্ছে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত পর্যায়। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের গোষ্ঠিগুলি বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত আর এই বন্টন ও পুনর্বন্টনের সংঘাতে পর্যায়ক্রমে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। লেনিন দেখান যে বর্তমান যুগ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগ। গোটা বিশ্ব একদিকে সাম্রাজ্যবাদ অপরদিকে নিপীড়িত জাতিসমূহের মাঝে বিভক্ত হয়ে গেছে। এ থেকেই তিনি সর্বহারা বিপ্লবের রণনীতি ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রণনীতির সম্মিলনের ধারণা তুলে ধরেন। লেনিন সর্বহারা শ্রেণীর এক নতুন ধরণের পার্টির ধারণা তুলে ধরেন যা হচ্ছে বিপ্লবী জনগণের ক্ষমতা দখলে নেতৃত্ব দেওয়ার এক অপরিহার্য হাতিয়ার। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাশিয়ায় সর্বহারা শ্রেণীর বিজয়ী ক্ষমতা দখলে ও এর বিপ্লবী একনায়কত্বের সুসংহতকরণে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়ায় লেনিন সর্বহারা বিপ্লবের তত্ত্ব ও অনুশীলনকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করেন। লেনিন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে জীবন মরণ সংগ্রাম পরিচালনা করেন যারা সর্বহারা বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীকে নসিহত করেছিল নিজ সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে। অক্টোবর বিপ্লবের বিজয় এবং লেনিনের সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রাম কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়, সারা দুনিয়ার নিপীড়িতদের আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং এভাবে তৃতিয় আন্তর্জাতিক অর্থাৎ কমিন্টার্ণ গঠিত হয়। সবর্হারা মতাদর্শে লেনিনের কৃত সার্বিক ও সামগ্রিক বিকাশ সর্বহারা মতাদর্শের বিকাশে দ্বিতীয় মহান মাইলফলককে প্রতিনিধিত্ব করে। লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন আভ্যন্তরীণ শত্রুদের হাত থেকে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার ফ্যাসিবাদী হানাদারদের হাত থেকে সর্বহারা একনায়কত্বকে রক্ষা করেন এবং সমাজতন্ত্রিক মতাদর্শ, গঠনকার্য ও রূপান্তরকে এগিয়ে নেন। সর্বহারা মতাদর্শের বিকাশে দ্বিতীয় মহান মাইলফলক হিসেবে লেনিনবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে স্তালিন সংগ্রাম চালান। লেনিনবাদের সূত্রায়ণ স্তালিনই করেছিলেন।”

১৯১৮ সালে রুশ সমাজ গণতন্ত্রী শ্রমিক পার্টির নাম পরিবর্তন করে রাশিয়ার সাম্যবাদী পার্টি রাখা হয়। রুশ বিপ্লবের প্রভাবে পার্শবর্তী অনেকগুলো দেশে বিপ্লব সংঘটিত হয়।এই দেশগুলি মিলে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়। ১৯২৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল পার্টি মিলে অল ইউনিয়ন সাম্যবাদী পার্টি গঠিত হয়। ১৯৫২ সালে এর নাম হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্যবাদী পার্টি। ১৯১৯ সালে লেনিনের নেতৃত্বে বিশ্ব সাম্যবাদীদের তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠিত হয়। তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

বিপ্লবী তৎপরতার সাথে যুক্ত থাকার কারণে বড় ভাই উইলিয়ানভকে জার সরকার ১৮৮৭ সালে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। সম্ভবত এ ঘটনা লেনিনকে বিপ্লবী তৎপরতায় জড়িত হতে অনুপ্রাণিত করেছিল, কিন্তু লেনিন মার্কসবাদের বিপ্লবী তত্ত্ব গড়ে তোলায় মনোযোগ দেন এবং একইসাথে তিনি বিপ্লবী তৎপরতায়ও যুক্ত হন, কিন্ত এক বিপ্লবী তত্ত্বের ভিত্তিতে। শীঘ্রই তাকে এজন্য কারাবরণ ও নির্বাসনে যেতে হয়। ১৮৯৮ সালে তিনি রুশ মার্কসবাদী নাদেজদা ক্রপ্সকায়াকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন তাঁর সহকর্মী। রুশদেশে বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। শোষক শ্রেণীর প্রতিবিপ্লবীরা রাশিয়াসহ সোভিয়েত দেশগুলোতে ক্ষমতা পুনর্দখলের প্রচেষ্টায় যুদ্ধ শুরু করে। দীর্ঘ চারবছর সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্যবাদীরা প্রতিবিপ্লবী শ্বেত বাহিনীকে যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে ক্ষমতা সংহত  করতে সক্ষম হন। প্রতিবিপ্লবীরা বহুবার লেনিনের উপর আক্রমণ করে। এসব আক্রমণে শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি রোগ ভুগে লেনিন ১৮২৪ সালের ২১শে জানুয়ারী রাশিয়ার গোর্কিতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর দেহাবশেষ এখনো মস্কোর মিউজিয়ামের সামনে সংরক্ষিত আছে। বিপ্লবী জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত লেনিনকে সংগ্রামরত হয়ে থাকতে হয়েছে। তাঁর বিপ্লবী জীবন তাঁর পূর্বসুরী মহান মার্কস ও এঙ্গেলসের সাথে তুলনীয়। লেনিন বিশ্ব সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ও বিশ্ব সর্বহার বিপ্লবে অবিস্মরণীয় ভূমিকার কারণে বিশ্ব সাম্যবাদীদের কাছে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।।

পড়ুনঃ

Sarbaharapath | সুকান্ত ভট্রাচার্যের অমর কবিতাঃ লেনিন

Sarbaharapath | ভ ই লেনিন। মার্কসবাদের তিনটি উৎস ও তিনটি অঙ্গ