ফোকো মতবাদের অন্যতম উদগ্রাতা ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যু

লেখকঃ হাসন লাল

ফোকো মতবাদের অন্যতম উদগ্রাতা ফিদেল কাস্ত্রো ২৫ নভেম্বর ২০১৬ মারা গেছেন। তিনি ছিলেন কিউবান জাতীয়তাবাদী ও সেদেশের রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের প্রতিনিধি। চে গুয়েভারাকে

ফিদেল কাস্ত্রো

ফিদেল কাস্ত্রো

সাথে নিয়ে অল্প লোকবল নিয়ে তিনি মার্কিন পুতুল বাতিস্তার স্বৈরাচারী সরকারকে ১ জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে উৎখাত করে বিপ্লবের ঘোষণা দেন। ফ্রান্সের কুটনীতিক রেগিস দেব্রে কাস্ত্রো ও চের সাথে মিলে ফোকো মতবাদের উদ্ভাবন করেন। এই মতবাদে ফোকাস থাকে ছোট একটি গেরিলা ইউনিট দ্বারা অতর্কিত ক্ষমতা করায়ত্ব করার দিকে। এখানে সর্বহারার অগ্রগামী পার্টির কোন প্রয়োজন নেই, গেরিলাবাদী সামরিক সংগঠন থাকলেই হবে। এটা সমরবাদী কারণ তা রাজনীতির ঊর্ধ্বে যুদ্ধকে স্থান দিয়ে থাকে। অন্যদিকে এই মতানুসারে আধা উপনিবেশিক আধা সামন্ততান্ত্রিক একটি সমাজ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর ছাড়াই সমাজতন্ত্রে প্রবেশ করতে পারবে। এটা ট্রটস্কীবাদী লাইনের সাথে মিলে। তাই বাংলাদেশে সভাপতি সিরাজ সিকদার অব্যাহতভাবে আন্দোলনে বিদ্যমান সংশোধনবাদ নয়াসংশোধনবাদের পাশাপাশি  ট্রটস্কীবাদ-চেবাদকেও সংগ্রাম করেছেন ক্ষমাহীনভাবে।

ক্ষমতা দখলের পর ফিদেলের নেতৃত্বে ফোকোবাদীরা কিউবাকে সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশে পরিণত করে, আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হয়ে দেশকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘাঁটিতে পরিণত করে। দেশে সমরবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তোলে। কিউবা আফ্রিকার এঙ্গোলায় রুশপন্থী পপুলার আন্দোলনের সমর্থনে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ

ছবিতে কাস্ত্রো ও ক্রুশ্চেভ ঐক্যবদ্ধ। কিউবা সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল

ছবিতে কাস্ত্রো ও ক্রুশ্চেভ ঐক্যবদ্ধ। কিউবা সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল।

সৈন্য পাঠিয়েছে। আলজেরিয়ায় সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের অস্ত্র সরবরাহের মধ্যস্ততা করেছে, কঙ্গো, জায়ারে, গিনি বিসাও, বেনিনে অস্ত্র ও বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছে, ইথিওপিয়ায় তার সৈন্যরা হস্তক্ষেপ করেছে, নিকারাগুয়ায় সান্দানিস্তা গেরিলা আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছে। লাতিন আমেরিকায় নিকারাগুয়া, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন দেশসমেত তারা একটি পপুলিস্ট বলয় তৈরি করেছে। এগুলো মূলতঃ জাতীয়তাবাদী বলয়। এর মূল বক্তব্য হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। এটা বিভিন্ন পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার প্রতিযোগিতামূলক গ্রুপিং ছাড়া আর কিছুই নয়। এরা এক সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার নামে আরেক সাম্রাজ্যবাদের সেবায় নিয়োযিত হয়।

ফিদেলের মৃত্যুতে বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া ও সংশোধনবাদীরা ক্রন্দন করছে। অনেক সাধারণ মানুষও এতে সামিল হয়েছেন। অনেক মাওবাদী নামের সংগঠনও এতে আছে। যেমনঃ ইতালির মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, ফিলিপাইনের কমিউনিস্ট পার্টি ও মনিপুরের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি। ইতালিয় পার্টির বক্তব্য ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী কর্তৃক খন্ডিত হয়েছে। যে পিসিএম ইতালি বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন (রিম)-এর সদস্য ছিল সেই রিমের ঘোষণায় ১৯৮৪ সালে পরিষ্কারভাবে ফোকোবাদকে বাম তরফের সংশোধনবাদী মতবাদ হিসেবে কঠোরভাবে সংগ্রাম করা হয়েছে। পেরুতে কমরেড গনসালোও মাওবাদ বিরোধী মতবাদ ক্যাস্ত্রোবাদ ও তার আরেক রকমফের চেবাদকে গভীর বিশ্লেষণ সহকারে খণ্ডন ও সংগ্রাম করেছেন, যদিও চেবাদ তার স্বেচ্ছাসেবার জন্য ক্যাস্ত্রোবাদের তুলনায় ছিল তুলনামূলক দ্ব্যার্থতাবোধক। সুতরাং পিসিএম ইতালীর বক্তব্য পুরোপুরি সংশোধনবাদী। অপরদিকে ফিলিপাইনের কমিউনিস্ট পার্টির বিভ্রান্তি নতুন নয়, মনিপুরের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি একটি জাতীয়তাবাদী ভাবধারা থেকে আগত নতুন পার্টি, তারা মতাদর্শিক ভিত্তি এখোনো বোঝেনা প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশের পুরোনো সংশোধনবাদী যারা দেশের প্রতিটা প্রতিক্রিয়াশীল সরকারকে

মুজিবের সাথে ফিদেলের দেখা হয় ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে। মুজিবকে দেখে নাকি তার হিমালয় দেখা হয়েছে এমন কথা দেশের বাজারে চালু করেছে প্রতিক্রিয়াশীলরা। কাস্ত্রো ছিল সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দালাল, আর শেখ ছিল কমরেড সিরাজ সিকদারের ভাষায় ছয় পাহাড়ের দালাল। সুতরাং কাস্ত্রোর জ্ঞানের বাইরে এটা

মুজিবের সাথে ফিদেলের দেখা হয় ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে। মুজিবকে দেখে নাকি তার হিমালয় দেখা হয়েছে এমন কথা দেশের বাজারে চালু করেছে প্রতিক্রিয়াশীলরা। কাস্ত্রো ছিল সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দালাল, আর শেখ ছিল কমরেড সিরাজ সিকদারের ভাষায় ছয় পাহাড়ের দালাল। সুতরাং কাস্ত্রোর জ্ঞানের বাইরে এটা।

সমর্থন দিয়েছে—তারা তো আছেই, মাওবাদী নাম নেয়া বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলন ও বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ক্যাস্ত্রোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে কিছু সমালোচনা জুড়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য তালগোল পাঁকিয়ে দিয়েছে—যা সংশোধনবাদী রীতি। তাদের বক্তব্য পড়ে যেকেউ ক্যাস্ত্রোকে বড় কমিউনিস্টের সার্টিফিকেট দেয়ার দাবি জানাবে।

কিউবার সমাজ হচ্ছে একটি আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা উপনিবেশিক সমাজ। সেখানে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়াদের একনায়কতান্ত্রিক শাসনে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ বিদ্যমান। যেকোন শোষণমূলক সমাজের মতই জনগণ সেখানে নাটবল্টু। খোদ বুর্জোয়ারাই বলে যে জনগণ সেখানে ‘উন্নত’ জীবনযাপন করছে। তার মানে অন্যান্য অধিক বিকশিত পুঁজিবাদী সমাজে জনগণ আরো ‘উন্নত’ জীবনযাপন করছে। বাস্তবে জনগণ সেসব জায়গায় বিভীষিকাময় জীবন যাপন করছে। রাতদিন অল্প কিছু মুদ্রার বিনিময়ে বুর্জোয়াদের জন্য খেটে মরা ছাড়া তাদের কোন বিকল্প নেই। সাম্যবাদের মতধারার বিপ্লবের লড়াইয়ে অগ্রসর হওয়া ছাড়া তাদের বাঁচার আর কোন পথ নেই। এই সাম্যবাদের মতবাদ মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন ও মাওসেতুঙ কর্তৃক মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ পর্যন্ত বিকশিত হয়েছে। এই মতবাদ একটি সামগ্রিক মতবাদ। এতে বিভ্রান্তির কোন অবকাশ নেই। ফোকোবাদের মত আর সব সংশোধনবাদী মতবাদকে সংগ্রাম করেই এই মতবাদ গড়ে উঠেছে। সিরাজ সিকদার, চারু মজুমদার-কানাই চ্যাটার্জি, ইব্রাহিম কায়পাক্কায়া, গনসালো, আকরাম ইয়ারির মত নেতারা আমাদের আদর্শ যারা ফোকোবাদের মত সকল সংশোধনবাদকে ক্ষমাহীনভাবে সংগ্রাম করেছেন।■