সিরাজ সিকদার রচনাঃ কমরেড কবীরের পত্রাবলীর জবাব

 

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্র লাল ঝাণ্ডায় প্রকাশ জুলাই ১৯৭২পার্টি কর্তৃক “নির্বাচিত মতাদর্শগত রচনাবলী”তে এর প্রকাশ ১৯৭৪

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১২ আগস্ট ২০১৪


পিডিএফ

সভাপতি মাও আমাদের শিখিয়েছেন, কমরেডদের বলতে দেওয়া উচিত। তারপর তাদের ভুল থাকলে তা উল্লেখ করা উচিত, যাতে তারা সংশোধিত হয়।

কমরেড কবীরকে কেন্দ্রীয় কমিটি তার বক্তব্য পেশের সুযোগ দিয়েছে। তার ভুলসমূহ, যা এ  সকল বক্তব্য এবং তার কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তার সমালোচনা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ ভুল জমা হতে হতে এক পর্যায়ে তা মারাত্মক পরিণতির সৃষ্টি করতে পারে।

এই সমালোচনা গ্রহণের ক্ষেত্রে দুটো মনোভাব রয়েছে। একটা হচ্ছে এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং ভুল সংশোধন করা, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানোর মনোভাব। ইহা হচ্ছে সৎ কমরেড, ভাল কমরেড, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমরেডদের মনোভাব।

পক্ষান্তরে সমালোচনা আন্তরিকভাবে গ্রহণ না করা, ফজলু চক্রের মত বাইরে দেখানো ও ভাল মানুষ সাজার জন্য আত্মসমালোচনা করা, নিজের ভুল লাইন বাস্তবায়নের জন্য ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করা, গুজব-অপবাদ রটনা করা, উপদল গঠন করা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের চরে পরিণত হয়ে গুপ্ত হত্যা, ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা প্রভৃতি হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবীদের  মনোভাব।

কেন্দ্রীয় কমিটি আশা করে কমরেড কবীর প্রথমোক্ত মনোভাব গ্রহণ করবেন এবং শেষোক্ত বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব গ্রহণ করবেন না।

শেষোক্ত মনোভাব গ্রহণের পরিণতি হচ্ছে ফজলু চক্রের ইতিহাসের পরিণতি।

পেয়ারাবাগানে নিয়োগের পর থেকেই কমরেড কবীরের মধ্যে গোড়ামীবাদ ধরা পড়ে। বিভিন্ন রিপোর্ট ও অনুশীলনের মাধ্যমে এগুলো প্রকাশ পায়।

আওয়ামী লীগ ও পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের দ্বিমুখী প্রচণ্ড চাপের মুখে এ গোড়ামীবাদ হতাশাবাদ হিসেবে প্রকাশ পায়।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে প্রদত্ত তার বক্তব্যে এই হতাশাবাদ ও দক্ষিণপন্থী মনোভাব প্রকাশ পায়, “পার্টির বিরাট ব্যর্থতা, আগাগোড়া পার্টি বামপন্থী বিচ্যুতি করেছে” প্রভৃতি বক্তব্যের মাধ্যমে। সামরিক ও অন্যান্য লাইনের গোড়ামীবাদী বিশ্লেষণের ফলেই তিনি এই উপসংহারে পৌঁছেন। কংগ্রেসে তাকে সমালোচনা করা হয়, গোড়ামীবাদকে পার্টির প্রধান বিপদ হিসেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কমরেড কবীরকে গোড়ামীবাদ পরিহার করার উদ্দেশ্যে কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়, লেবাস পরিবর্তন করার জন্য নয়, গোড়ামীবাদী চিন্তাধারা পরিহার করার জন্য।

গোড়ামীবাদ কী?

গোড়ামীবাদ হচ্ছে চিন্তাধারার পদ্ধতি যা তত্ত্ব থেকে শুরু করে এবং তত্ত্বেই রয়ে যায়। গোড়ামীবাদীরা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে। গোড়ামীবাদীরা বস্তু থেকে শুরু না করে, বিশেষ অবস্থা থেকে শুরু না করে, তত্ত্ব থেকে বিদেশী অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে, বিদেশের বিশেষ অবস্থার সমাধান নিজ দেশের সমস্যার উপর অন্ধভাবে চাপিয়ে দেয়।

দার্শনিকভাবে গোড়ামীবাদীরা কি? বস্তুর সংস্পর্শে গেলে অর্থাৎ অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তু মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়। প্রথমে ইহা হচ্ছে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান।

কাজেই সকল জ্ঞানের উৎস হচ্ছে বস্তু, ইহা হচ্ছে জ্ঞানের বস্তুবাদ।

প্রতিটি বস্তুর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ কারণেই সেগুলোর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে। যেমন—করিম, রহিম, আবুল প্রত্যেকেরই পৃথক অস্তিত্ব রয়েছে, এ কারণে তাদের চেনা যায়। কোন পার্থক্য না থাকলে চেনা সম্ভব হতো না।

তেমনি বিভিন্ন দেশ, সে সকল দেশসমূহের বিপ্লবের সমস্যাবলী, দেশসমূহের পার্টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ কারণেই তাদের প্রত্যেকের পৃথক অস্তিত্ব রয়েছে। অর্থাৎ পূর্ব বাংলা পূর্ব বাংলাই, ভারত নয়; পূর্ব বাংলার বিপ্লব ও সর্বহারা পার্টি, ভারতীয় বিপ্লব ও পার্টি এক নয়।

একে বলে দ্বন্দ্বের বিশেষত্ব।

গোড়ামীবাদীরা বস্তুকে তার এই বিশেষত্বসহ প্রতিফলিত করে না, বস্তু থেকে ইন্দ্রয়লব্ধ জ্ঞান অর্জন করে না। এ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে সারসংকলন করে ধারণাত্মক জ্ঞান-তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা-সাধারণ লাইন রচনা করে না অর্থাৎ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে উন্নত স্তরে উন্নীত করে না, জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতাকে [১] অনুসরণ করে না। গোড়ামীবাদীরা তত্ত্ব, ধারণা অর্থাৎ পূর্ব থেকে তৈরী ধারণা, তত্ত্ব থেকে শুরু করে, সে অনুযায়ী বস্তুকে দেখে এবং বস্তুর রূপান্তরের সমস্যার সমাধান দিতে যায়।

অর্থাৎ চেতনাকে তারা দেয় প্রাধান্য, চেতনাকে বস্তু হিসেবে দেখে ঐ বস্তু সম্পর্কিত নয় এরূপ  চেতনা দিয়ে বস্তুর রূপান্তরের সমাধান দিতে চায়। ইহা ভাববাদ। [২]

এভাবে গোড়ামীবাদীরা বস্তু থেকে চেতনায় না যেয়ে তারা চেতনা থেকে বস্তুতে যায়, চেতনা অনুযায়ী বস্তুকে দেখে। তাদের মতে বস্তু হচ্ছে কতগুলি চেতনার সমষ্টি (Complex of senses)।

ইহা হচ্ছে ভাববাদ, এ কারণে গোড়ামীবাদীরা ভাববাদী। বস্তু-চেতনা-বস্তু অর্থাৎ অনুশীলন-জ্ঞান-অনুশীলনের পরিবর্তে তারা চেতনা-(বস্তু থেকে না নিয়ে ফর্মূলা, উদ্ধৃতি থেকে নেওয়া) বস্তু এই পথ অনুসরণ করে।

এভাবে তারা নদীকে উৎসহীণ, গাছকে শিকড়হীন ভাবার অনুরূপ চেতনার উৎস বস্তু একথা অস্বীকার করে।

এভাবে গোড়ামীবাদীরা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে পরিপূর্ণ বিসর্জন দেয়, ভাববাদী ও অধিবিদ্যক হয়।

গোড়ামীবাদীরা কতগুলো তত্ত্ব, ফর্মূলা মুখস্থ করে তা আওড়ায়, নিজেদেরকে মস্ত পণ্ডিত মনে করে, লেজ ফুলিয়ে আকাশে তুলে, তত্ত্ব না জানা কমরেডদের বুলি আউড়ে তাক লাগিয়ে দেয়।

ফলে তাদের মধ্যে নেতৃত্ব লোভ, সবজান্তা পণ্ডিত মনোভাবের সৃষ্টি হয়। চীনা পার্টি এ ধরনের গোড়ামীবাদীদের দ্বারা বহুবার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পূর্ববাংলার ও ভারতের বিপ্লবের মারাত্মক ক্ষতি করেছে সকল গোড়ামীবাদীরা।

সভাপতি মাও বলেছেন, “তত্ত্ব অনুশীলন সমন্বয় সাধন করতে না পেরে (গোড়ামীবাদী হয়ে—লেখক) চীনের বহু কমিউনিস্ট সংশোধনবাদী হয়ে গেছে।”

কমরেড কবীরকে পেয়ারাবাগানে নিয়োগের সময় একটি গাইড লাইন দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রিপোর্ট প্রদানের সময় গাইড লাইন প্রয়োগের কোন উল্লেখ না করে তিনি কতগুলো উদ্ধৃতি ভরে রিপোর্ট পাঠান।

পরবর্তীকালে পেয়ারাবাগান থেকে ২নং ফ্রন্টের পশ্চাদপসরণের সময়কালীন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে রিপোর্টে বিশদভাবে উল্লেখ না করে সমস্ত রিপোর্ট কমরেড আসাদকে নিয়ে লেখেন।

এ সময় বস্তুগত অবস্থা অর্থাৎ আমাদের অবস্থা, জনগণের অবস্থা, শত্রুর অবস্থা, উত্থাপিত সমস্যাবলী, তার সমাধান, কেন্দ্র প্রদত্ত নির্দেশ প্রয়োগের ফল প্রভৃতি মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে কতগুলো উদ্ধৃতি, গৌণ বিষয় দ্বারা রিপোর্ট পূর্ণ করে পাঠান।

এভাবে তার মধ্যকার গোড়ামীবাদ ধরা পড়ে।

গোড়ামীবাদীরা সামগ্রিক পরিস্থিতি অর্থাৎ বস্তুর মধ্যকার দ্বন্দ্বসমুহ, প্রধান দ্বন্দ্ব, দ্বন্দ্বের প্রধান দিক, বাইরের শর্ত অর্থাৎ অন্য বস্তুর সাথে এর সম্পর্ক, তার অবস্থান মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করে না। ফলে তারা হয় একতরফাবাদী এবং হতাশাগ্রস্ত।

পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের ও ছয় পাহাড়ের দালালদের প্রচণ্ড চাপে কমরেড মাসুমের নিকট থাকাকালীন কমরেড কবীর হতাশ হয়ে পড়েন, “চীন-বার্মা-ভারতের বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করে অস্ত্র আনা এবং তার সাহায্যে কৃষকদের সশস্ত্র করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই” এমনি কথা বলেন।

তাকে মাথা ঠান্ডা রেখে বস্তুকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করা ও গোড়ামীবাদ পরিহার করার পরামর্শ দিয়ে কমরেড সিরাজ সিকদার পত্র দেন।

পরবর্তীকালে কমরেড কবীর কংগ্রেস রিপোর্টে আমাদের বিরাট সফলতাকে বিরাট ব্যর্থতা, পার্টির সঠিক সামরিক, রাজনৈতিক লাইনকে আগাগোড়া বামপন্থী হঠকারী লাইন বলে উল্লেখ করেন, ২ নং ফ্রন্টের অবস্থার বিশেষত্ব মাথায় প্রতিফলিত না করে চিং কিয়াং পর্বতমালায় সভাপতি মাও যে রণনীতি গ্রহণ করেছেন তা প্রয়োগ না করার কারণে সকল ভুল হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। [৩]

কংগ্রেসে কমরেড কবীরের বড় বড় তত্ত্ব ও কথা তত্ত্ব না জানা কমরেডদের তাক লাগিয়ে দেয়, না বুঝে তারা কেউ কেউ একে সমর্থন করেন। এভাবে তত্ত্ব না জানা কমরেডরা গোড়ামীবাদের লেজুড়বৃত্তি করেন।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে চেন তাও শিউ এ ধরণের গোড়ামীবাদী ছিল, শেষ পর্যন্ত ১৯২৭ সালে চিয়াং কাইশেকের প্রচণ্ড হামলায় সে বিপ্লবের প্রতি হতাশ হয়ে যায় এবং দক্ষিণপন্থী হিসেবে প্রকাশ পায়। ট্রটস্কিবাদী হয়ে চিয়াংয়ের এজেন্টে পরিণত হয়।

এ ধরণের গোড়ামীবাদী লিলিশান ও অন্যান্যরা চীনা পার্টির নেতৃত্বে একাধিকার অধিষ্ঠিত হয় এবং বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটায়, চিংকিয়াং ঘাঁটি এলাকা হাতছাড়া হয়, লক্ষ লক্ষ কমরেড প্রাণ হারায়, লংমার্চ করতে হয়।

কমরেড কবীরের রিপোর্ট কংগ্রেসে গ্রহণ করার অর্থ হতো পার্টি দক্ষিণপন্থী ও হতাশাবাদী পার্টিতে পরিণত হওয়া। এবং পার্টি অনিবার্যভাবেই বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত হতো।।

এ কারণে গোড়ামীবাদীদের কেন্দ্রীয় বা আঞ্চলিক কোন স্তরের নেতৃত্বেই রাখা উচিত নয়। তারা বিপ্লবের জটিল অবস্থায় হতাশ হয়ে দক্ষিণপন্থী হন বা বামপন্থী হঠকারিতা করে বিপ্লবের চরম ক্ষতি সাধন করেন।

এ কারণেই ৪নং জেলা আহবায়ক কমিটি গঠনের দায়িত্ব কমরেড সিরাজ সিকদারের নিকট এলে তিনি কমরেড কবীরকে আহবায়ক নিযুক্ত করেননি।

কমরেড কবীর প্রথমে তার এলাকা ও কমরেড ঝিনুকের এলাকা নিয়ে যুক্ত এলাকা গঠনের জন্য খুবই উৎসাহ প্রদর্শন করেন। কমরেড সিরাজ সিকদার তাদেরকে আহবায়ক কমিটি গঠন করে রিপোর্ট করতে বলেন। কিন্তু কমরেড কবীর কমরেড সিরাজ সিকদারকে আহবায়ক কমিটি গঠন করে দিতে বলেন। কমরেড সিরাজ সিকদার কমরেড কবীরকে সদস্য এবং অন্য এক কমরেডকে আহবায়ক করে কমিটি গঠন করে দেন।

কিন্তু কমরেড কবীর এ কমিটি গঠনের পর তার এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে সরাসরি কেন্দ্রের অধীন আনতে বলেন। কমরেড ঝিনুকের কেডার ইতিহাস ঠিক নয় এ অভিযোগ আনেন, কমরেড সিরাজ সিকদার অন্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন, অর্থাৎ কমরেড সিরাজ সিকদারের ঘনিষ্ঠ কাউকে কমরেড কবীর সমালোচনা করেছে এ কারণে কমরেড সিরাজ সিকদার প্রতিশোধবাদী হয়ে কমরেড কবীরকে আহবায়ক করেননি এ ধরণের মনোভাবের প্রকাশ করেন।

আহবায়ক কমিটির মধ্যে থাকলেও যার যার এলাকায় স্বতন্ত্র কাজ হবে এ মনোভাব (যা দূর্গ গঠনের মনোভাব), বিভিন্ন কাজে আহবায়কের অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করা, গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাচ্ছিল্য, অসহযোগ প্রদর্শন করেন।

কমরেড কবীর প্রায়ই বলেন অনেকের তাত্ত্বিকমান নীচু, অর্থাৎ তার তুলনায় নীচু, এতএব তাকে উচু পদে নিয়োগ করা উচিত; এমনভাব তার মাঝে প্রকাশ পায়।

সম্প্রতি কমরেড কবীর কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন বিভিন্ন দলিল লেখার জন্য একটি লেখক বোর্ড [৪] গঠনের প্রস্তাব দেন এবং সিনিয়র কমরেডদের তাতে নিতে বলেন। অর্থাৎ তাকেও যাতে নেওয়া হয় ইহা প্রচ্ছন্ন ভাবে বলা হয়েছে।

এভাবে দেখা যায় কমরেড কবীরের মাঝে পদের, নেতৃত্বের লোভ বর্তমান।

ফজলু চক্র চেয়েছিল কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বকে পুরোপুরি প্রতিক্রিয়াশীল বলে তাকে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের মাধ্যমে উৎখাত করা।

কমরেড কবীরের লেখক সংঘ গঠনের কথা বলার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে কমরেড সিরাজ সিকদারের ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ করা, খর্ব করা অথবা কমরেড সিরাজ সিকদারের ভূমিককে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া। তার এ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তার লেখায় “আপনার (সিরাজ সিকদার) পক্ষে এত কিছু লেখা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়তঃ পার্টির পক্ষে একব্যক্তি নির্ভরশীল ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া ঠিক নয়”। কেন্দ্রীয় কমিটির ভুমিকাকেও তিনি এ কথার মাধ্যমে অস্বীকার করেছেন। ক্রুশ্চোভ যৌথ নেতৃত্বের কথা এবং স্ট্যালিনের তথাকথিত ব্যক্তিতাবাদ বিরোধিতার কথা বলে স্ট্যালিনকে উৎখাত করেছে।

লিউ শাউচী সভাপতি মাওয়ের রচনাবলীর ব্যাপক প্রচার এবং তার চিন্তাধারার প্রচার ও প্রয়োগের এক হাজার একটি বাধা সৃষ্টি করে, যাতে জনগণ সভাপতি মাওয়ের চিন্তাধারার সাথে পরিচিত না হন, তিনি যাতে ব্যাপক পার্টি কমরেড ও জনগণের আস্থা ও তাদের জনপ্রিয়তা অর্জন না করেন। এর কারণ, তাহলে তাকে উৎখাত করে নেতৃত্ব দখল করা সহজ হবে।

কমরেড কবীরও এ সকল কথা বলে কি নিজের অজ্ঞাতে লিউ শাউচীর মনোভাব প্রকাশ করছেন না? অর্থাৎ কমরেড সিরাজ সিকদারের ভূমিকা যত কম জানানো যায়, তার জনপ্রিয়তা যাতে কম হয়, তার উপর কর্মীদের আস্থা কম হয় এবং তাকে যাতে সহজেই উৎখাত করে নেতৃত্ব দখল করা যায়, এ মনোভাব প্রকাশ কি হয়নি কমরেড কবীরের বক্তব্যে?

সভাপতি মাও বলেছেন, “বিপ্লবী আর প্রতিবিপ্লবী হোক ক্ষমতা দখলের পূর্বে প্রয়োজন জনমত সৃষ্টি করা।”

কমরেড সিরাজ সিকদারের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার অর্থ হচ্ছে বিপ্লবী নেতৃত্বের পক্ষে, পার্টির বিপ্লবী নেতৃত্বের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পক্ষে এবং প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবী ও খারাপ লোককের বিপক্ষে জনমত সৃষ্টি করা।

ক্রুশ্চোভ-লিউশাউচী তাদের শিষ্য ফজলু এ কারণেই বিপ্লবী নেতৃত্বের জনপ্রিয়তার বিপক্ষে, তাকে হ্রাস করতে, তাকে খর্ব করতে সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালায়। বিপ্লবী নেতৃত্বের জনপ্রিয়তায় প্রতিক্রিয়াশীলদের গা জ্বালা করে। কমরেড কবীরের কথার মধ্যে এ মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে।

আমাদের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে এবং সভাপতি মাও বলেছেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও যৌথ নেতৃত্ব দুটোই বজায় রাখতে হবে।

একটাকে অতিরিক্ত জোর দিয়ে অন্যটাকে খর্ব করা ঠিক নয়।

বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীরা ও প্রতিক্রিয়াশীলরা বিপ্লবী নেতৃত্বের ব্যক্তিগত উদ্যোগকে বিরোধিতা করে এবং যৌথ নেতৃত্বের উপর জোর দেওয়ার নামে প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবী নেতৃত্বকে উৎখাত করে প্রতিবিপ্লবী ক্ষমতা দখল করে। সেখানে পুনরায় তারা প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপে ‘ব্যক্তি বিশেষের’ প্রধান ভূমিকা ও স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে, গণতন্ত্র ও যৌথ নেতৃত্বকে বিসর্জন দেয়।

ক্রুশ্চোভ যৌথ নেতৃত্বের কথা বলে প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র ও যৌথ নেতৃত্বকে বিসর্জন দেয়, স্বৈরতন্ত্র  কায়েম করে। ফজলু চক্রও তাই চেয়েছিল।

পক্ষান্তরে বিপ্লবী নেতৃত্ব ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগের পূর্ণ বিকাশের সুযোগ দেয়, যৌথ নেতৃত্ব ও গণতন্ত্র বজায় রাখে।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে কমরেড সিরাজ সিকদারের ব্যক্তিগত উদ্যোগের পরিপূর্ণ সুযোগ প্রদান করা হচ্ছে, একই সাথে কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার নির্দেশ, প্রস্তাব পেশ, আলোচনা, পর্যলোচনা, সংশোধন ও সংযোজন ও অন্যান্যদের প্রস্তাব পেশ ও বিবেচনা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুমোদনের মাধ্যমে যৌথ নেতৃত্ব ও গণতন্ত্র কার্যকরী হচ্ছে।

কমরেড কবীর কমরেড সিরাজ সিকদারের ও তার সাথে যুক্ত কমরেডদের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও মতাদর্শগত ভূল–ভ্রান্তির বিষয় উল্লেখ না করে ফজলু চক্রের অনুরূপ ব্যক্তিগত বিষয়, অন্যের মুখে শোনা, বিশেষ করে চক্রের ও ব্যক্তিগত কারণে, ব্যক্তি স্বার্থে (কঃ বিপ্লব) পার্টি নেতৃত্বের প্রতি অসন্তুষ্টদের গুজব-অপবাদ, কুৎসাকে আঁকড়ে ধরেছেন।

কমরেড কবীর বলেছেন, “ফজলু–সুলতান চক্রের অপবাদ, গুজব, কুসা, অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

ফজলু-সুলতানের গুজব-অপবাদ, কুৎসা যদি সত্য হতো তবে তারা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করতো না, গুজব-অপবাদ রটাতো না, কুৎসা প্রচার করতো না, তারা উপদল গঠন করতো না, হত্যা ও ধরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করতো না।

তারা পার্টির মাঝে থাকতো। গণতান্ত্রিক উপায়ে সংগ্রাম করতো।

তারা সামনাসামনি সত্যের সামনে টিকবে না বলেই ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে; গুপ্তহত্যা ও ধরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে।

চক্রের গুজব, অপবাদ, কুৎসা উড়িয়ে দেয়া যায় না অর্থাৎ তা সত্য! তাহলে কেন ফজলু-সুলতান চক্র করলো? এর উত্তর কমরেড কবীর দেবেন কি?

“উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’’ এ কথা বলে কমরেড কবীর প্রমাণ করেছেন তার নিকট এ গুজব গুজব নয়, অপবাদ অপবাদ নয়, কুৎসা কুৎসা নয়, ইহা তারও মনের কথা। এর অর্থ এই নয় কি তিনি চক্রের ম্যানিফেস্টো মানেন, যদিও সাংগঠনিক ভাবে চক্রে যোগদান  করননি? অর্থাৎ মতাদর্শগতভাবে চক্রের সাথে একমত কিন্তু সাংগঠনিকভাবে যুক্ত নয়!

মতাদর্শগতভাবে একমত হয়ে সাংগঠনিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার অর্থ হচ্ছে নেতা হওয়া যাবে না এ কারণে, ব্যক্তিস্বার্থের কারণে যোগদান না করা। দেবেন-বাসার আরো অনেকে আমাদেরকে মতদর্শগত ও রাজনৈতিকভাবে ঠিক বলেও সাংগঠনিকভাবে যোগ দেয় না নেতা হওয়া যাবে না এই কারণে। কমরেড কবীরও নেতা হওয়া যাবে না বা ফজলু চক্রের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া যায় না (তত্ত্ব জানে না এ কারণে হয়তো) এ কারণে চক্রে যোগদান করেননি এ কথাই কি তার বক্তব্যে প্রমাণ করে না?

অন্যের মুখ থেকে গুজব-অপবাদ শুনে তা বিশ্বাস করা হচ্ছে ভাববাদ। গোড়ামীবাদীরা ভাববাদী। অন্যের মুখ থেকে সমালোচনা শুনে তা বিশ্বাস করে কমরেড কবীর ভাববাদের পরিচয় দিয়েছেন।

কমরেড কবীর পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির বর্তমান অবস্থা, পূর্ববাংলার সমাজের বর্তমান অবস্থা মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে চীনা পার্টির অন্ধ অনুকরণে বড় বড় অপ্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ রচনার প্রস্তাব দিয়ে তার গোড়ামীবাদের পরিচয় দিয়েছেন।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির বর্তমান প্রধান সমস্যা হচ্ছে চক্র বিরোধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা ও তা সফল করা। এ শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ায় কর্মীরা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী কর্মপদ্ধতি রপ্ত করবেন।

পূর্ববাংলার সমাজের বর্তমানে পর্যায়ে আমাদের করণীয়, আমাদের লক্ষ্য, বিভিন্ন শ্রেণীর ভুমিকা প্রসঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক দলিলসমুহে, বিশেষ করে ‘অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন  করুন’ দলিলে স্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে। ইহা সঠিক বলে অনুশীলনে প্রমাণিত।

বর্তমানে প্রয়োজন চক্র বিরোধী সংগ্রাম, শুদ্ধি অভিযান ও ‘সমাজতন্ত্র’ প্রসঙ্গে দলিল প্রণয়ন। প্রতিক্রিয়াশীলদের তথাকথিত সমাজতন্ত্রের ভাওতা উদঘাতটিত করা।

এ সকল বাস্তব অবস্থাকে বাদ দিয়ে কমরেড কবীর কতগুলো মন্ত্রের মত দলিল প্রণয়নের কথা বলে সংগঠনের ও সমাজের বাস্তবতাকে বাদ দিয়েছেন।

কমরেড কবীর লিখেছেন, “তারা (অর্থা সাধারণ কমরেডরা) জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে মুজিববাদের মত কমরেড সিরাজ সিকদারের মস্তিষ্কপ্রসূত বলে মনে করে।’’

আমাদের সকল কমরেড, এমনকি জনগণও জানেন, মুজিববাদ মুজিবের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, ইহা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সৃষ্টি। ইহা জাতীয় বিস্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ।

পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রণনীতি ও রণকৌশল (বর্তমান পর্যন্ত) কমরেড সিরাজ সিকদারের মস্তিষ্কপ্রসূত (বস্তু থেকে চেতনা, চেতনা থেকে বস্তুতে প্রয়োগের ভিত্তিতে)। কমরেডরা যদি এই চিন্তা করেন, ইহা নেতৃত্বের প্রতি আস্থার পরিচায়ক এবং ইহা সত্যের প্রতিফলন। এর মধ্যে অন্ধ ক্রিয়াবাদের প্রকাশ কোথায়?

প্রকৃতপক্ষে কঃ কবীর বোঝাতে চেয়েছেন, যে সকল কমরেড কঃ সিরাজ সিকদারকে জিন্দাবাদ দেন, কমরেড সিরাজ সিকদারের প্রতি আস্থাশীল তারা অন্ধক্রিয়াবাদী। তারা অন্ধভাবে কাজ করে ইত্যাদি। অর্থাৎ কমরেড সিরাজ সিকদারকে জনপ্রিয় করা উচিত নয়।

এ সকল কথা ফজলু চক্রের কথারই প্রতিধ্বনি মাত্র। কমরেড কবীর এক স্থানে লিখেছেন আমাদের তত্ত্বগত সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির তত্ত্বগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে কি?

পূর্ব বাংলার বিপ্লবের প্রশ্নে, পার্টির বিকাশের প্রশ্নে এমন কোন সমস্যা উত্থাপিত হয়েছে কি যার তত্ত্বগত সমাধান পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি দিতে পারেনি?

পার্টি প্রতিটি উত্থাপিত সমস্যার সমাধান দিয়েছে। কমরেড কবীর চোখ বুজে রয়েছেন, পার্টির বিকাশের পর্যায়ে উত্থাপিত সমস্যাবলীর সমাধান দেখতে পান না, তাই একথা বলেছেন। এ মনগড়া সীমাবদ্ধতা আবিষ্কারের অর্থ হচ্ছে নেতৃত্ব ও কেন্দ্রীয় কমিটির অক্ষমতা ও অযোগ্যতা প্রমাণ করা।

নেতৃত্বের শূন্যতা ও নেতৃত্বের উত্তরাধীকারী সম্পর্কে কমরেড কবীর পুরোপুরী গোড়ামীবাদী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নেতৃত্বের শূন্যতা দূর করা, উত্তরাধিকারী তৈরির জন্য “Board of Writers গঠন এবং তত্ত্বগত গবেষণা, লেখা পড়া, বিপ্লবের বিভিন্ন প্রশ্নে তাত্ত্বিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখা,” প্রভৃতি পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন।

তিনি আরো বলেছেন, শুধু অনুশীলনই যথেষ্ট নয়, মূল প্রশ্ন হচ্ছে অনুশীলনের অভিজ্ঞতার সার সংকলন করে তাকে তাত্ত্বিক পর্যায়ে উন্নীত করা।

তার এ সকল উক্তি লিউশাউচির ‘ঘরের মধ্যে বই পড়ে ভাল কমিউনিস্ট হওয়ার অনুরূপ।’

জ্ঞানের মৌলিক প্রশ্ন অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে তাত্ত্বিক পর্যায়ে উন্নীত করা নয়, ইহা জ্ঞানের প্রক্রিয়ার অর্ধেক এবং কম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জ্ঞানের মূল সমস্যা হল তত্ত্বকে অনুশীলনে প্রয়োগ করা, তত্ত্বকে বস্তু পরিবর্তনে প্রয়োগ করা, সে অনুযায়ী বস্তুকে রূপান্তরিত করে যাচাই করা। এ প্রয়োগের প্রক্রিয়া হচ্ছে জ্ঞানের প্রক্রিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্তর, মূল সমস্যা জ্ঞান ভূল কি নির্ভুল তা নির্ণয় হয় এ স্তরে। কাজেই মূল প্রশ্ন প্রয়োগ, অনুশীলনে তত্ত্বকে যাচাই করা, বস্তুকে রূপান্তর করা। কঃ কবীর এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানতত্ত্বকে উল্টে ফেলেছেন।

মার্কস বলেছেন, “দার্শনিকরা এতদিন শুধু দুনিয়াকে বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু প্রধান সমস্যা হচ্ছে দুনিয়াকে রূপান্তর করা।” কাজেই তত্ত্ব প্রণয়নের জন্য বিপ্লব করা হয় না, ইহা বিপ্লবের মূল প্রশ্ন নয়। দুনিয়াকে পরিবর্তন করাই হচ্ছে বিপ্লবের মূল প্রশ্ন। সর্বহারারা তত্ত্ব সৃষ্টির জন্য বিপ্লব করেনা, সমাজ ও দুনিয়াকে পরিবর্তন করার জন্য বিপ্লব করে।

কঃ কবীরের কথায় প্রকাশ পায় বিপ্লব করা হচ্ছে অনুশীলনকে তাত্ত্বিক পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য। তার এ কথা সম্পূর্ণ মার্কসবাদ বিরোধী। ইহা গোড়ামীবাদ।

কমরেডদের ট্রেনিং ও উত্তরাধিকারীদের লালন পালনের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি গবেষণা নয় (যা প্রতিক্রিয়াশীল একাডেমিশিয়ান, বিশেষজ্ঞ, সংশোধনবাদী তৈরী করে)। শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হচ্ছে প্রত্যেককে বিপ্লবী অনুশীলনের মহান গণসংগ্রামে নিয়োগ করা, অনুশীলনে সৃজনশীলতার বিকাশের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া। এখান থেকে বেরিয়ে আসবে কমরেড, যারা তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে সমন্বিত করতে সক্ষম। সৃজনশীলভাবে মার্কসবাদ প্রয়োগ করে বিপ্লবের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম।

কমরেড কবীর লিখেছেন, “পার্টি বিয়োগ সিরাজ সিকদার = প্রায় ০”। এ সমীকরণ ঠিক নয়, আমাদের ভাবা উচিত নয়, “কাউকে ব্যতীত পৃথিবী ঘোরা বন্ধ হয়ে যাবে।” অর্থাৎ কমরেড সিরাজ সিকদার ব্যতিত পূর্ব বাংলার বিপ্লব বন্ধ হয়ে যাবে, পার্টি ধ্বংস হয়ে যাবে এ ধারণা সম্পূর্ণ মার্কসবাদ বিরোধী।

পূর্ব বাংলার সমাজের গতিধারার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বিপ্লবী পার্টি ও নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। কমরেড সিরাজ সিকদারের অনুপস্থিতিতে আন্তরিক বিপ্লবীরা দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তাদের যোগ্যতা মত পার্টি ও বিপ্লব পরিচালনা করবেন।

কঃ কবীর নেতৃত্ব ও উত্তরাধিকারীর প্রশ্নে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পরিবর্তে ঐতিহাসিক ভাববাদ অর্থাৎ ব্যক্তি বিশেষ ব্যতীত সামাজিক পরিবর্তন ও বিপ্লব হবেনা, শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রাম থেকে নয়, ‘লেখক বোর্ড’ ও চার দেওয়ালের মাঝ থেকে বেরিয়ে আসবে উত্তরাধিকারীরা—এ সকল তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন।

প্রথমে তিনি কমরেড সিরাজ সিকদারের অবদান সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে চেয়েছেন, পরে সিরাজ সিকদার ব্যতীত পার্টি শূন্য বলে নিজ বক্তব্যকে নিজেই খণ্ডন করেছেন।

তার এই পরস্পর বিরোধী দুটো বক্তব্যই ভুল।

তিনি লিউশাওচির মত প্রবন্ধ রচনা, গবেষণাগারের চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে ভাল কমিউনিস্ট হওয়ার মনোভাব প্রকাশ করেছেন।

কমরেড সিরাজ সিকদারের উত্তরাধকারী বেরিয়ে আসবে গণসংগ্রামের প্রক্রিয়ায়, লেখক বোর্ডের মাধ্যমে নয়। লেনিন, স্ট্যালিন, মাওসেতুঙ এরা লেখক বোর্ড থেকে বেরিয়ে আসেননি।

কমরেড সিরাজ সিকদারও কোন লেখক বোর্ড থেকে বেরিয়ে আসেননি।

এরা সকলেই শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের ঝড়তরঙ্গের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছেন।

লেখক বোর্ড থেকে বেরিয়ে আসে কাউটস্কি, বার্নেস্টাইন, ক্রুশ্চোভ, লিউশাউচি, হক-তোয়াহা, দেবেন-মতিন, কাজী-রনো ও অন্য্যন্য সংশোধনবাদীরা।

কাজেই কমরেডদের সৃজনশীলতা বিকাশের ক্ষেত্রে কমরেড সিরাজ সিকদারের উদ্যোগের অভাব রয়েছে, কমরেড কবীরের এ অভিযোগ সম্পূর্ন ভুল। তবে গোড়ামীবাদী উদ্যোগ বিকাশের ক্ষেত্রে কমরেড সিরাজ সিকদারের প্রকৃতই বিরোধীতা রয়েছে।

সভাপতি মাও বলেছেন, “একটি সত্যিকার তত্ত্ব রয়েছে যা অনুশীলন থেকে আসে এবং অনুশীলনে পরীক্ষিত।” এ ধরনের তত্ত্ব সম্বলিত দলিল যে কেউ প্রণয়ন করলে পার্টি তা গ্রহণ করবে। কাজেই দলিল প্রকাশের ক্ষেত্রে গনতন্ত্র নেই এ অভিযোগের অর্থ হচ্ছে কেন কঃ কবীরের দলিল প্রকাশ করা হয় না।

কঃ কবীর দুটো দলিল লিখেছিলেন যা তত্ত্ব থেকে তত্ত্বেই রয়ে যায়। অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করা, তার সারসংকলন করে সাধারন নিয়ম রচনা করে এবং তা প্রয়োগ করে যাচাই না করেই তিনি দলিল লেখেন।

তাকে বলা হয়েছিল, “তুমি নিজেই এ তত্ত্বগুলি প্রয়োগের মাধ্যমে যাচাই করে পাঠাও।’’

বিভিন্ন দলিল প্রকাশ সম্পর্কে কঃ কবীর গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটাবার কথা বলেছেন অর্থাৎ তাকেও কেন সুযোগ দেওয়া হয়না এ কথাই তিনি বলতে চেয়েছেন। এ অভিযোগ তিনি কমরেড তাহের ও কমরেড শহীদের বরাত দিয়েও করেছেন।

পার্টির পক্ষে দলিল কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত, লালঝাণ্ডার জন্য লালঝাণ্ডার সম্পাদক মণ্ডলীর অনুমোদিত হতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ দলিল প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু পার্টির নামে নয়। কমরেড কবীর গোড়ামীবাদী দলিল না ছাপানোয় বিক্ষুব্ধ।

দলিল প্রকাশের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র দাবী করেন, লেখক বোর্ড গঠন করতে চান ইত্যাদি।

কমরেড কবীর সম্প্রতি কাজের রিপোর্ট করতে যেয়ে কৃষকের মাঝে কৃষক হয়ে কাজের পার্টি লাইনের সঠিকতা, জাতীয় শত্রু খতমের লাইনের সঠিকতা উল্লেখ করেও পুলিশ ফাঁড়ি (৭/৮ জনের) আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। জাতীয় শত্রু খতম না করে এ ধরনের হামলায় যাওয়া হচ্ছে হঠকারিতাবাদ।

এভাবে গোড়ামীবাদীরা সহজে বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটায় ও হঠকারিতা করে।

এর পরিনতি হিসেবে হতাশা ও পলায়নবাদের আশ্রয় নেয়, শেষ পর্যন্ত তারা দক্ষিণপন্থী হয়ে যায়। গোড়ামীবাদীরা তত্ত্ব না জানা কমরেডদের বড় বড় তত্ত্ব বলে তাক লাগিয়ে দেয়। এর ফলে তত্ত্ব না জানা কমরেডরা তাদের লেজুড়বৃত্তি করে। এভাবে ইহা পার্টির মাঝে মারাত্মক বিপদ হিসেবে দেখা দেয়।

পেয়ারাবাগানের পর কঃ কবীর বিপ্লবের প্রতি পলায়নবাদের আশ্রয় নেন, হতাশ হয়ে পড়েন, শেষ পর্যন্ত দক্ষিণপন্থী হন এবং পার্টির সফলতাকে চরম বিফলতা বলেন, পার্টির সঠিক লাইনকে বামপন্থী হঠকারিতা বলে আক্রমন করেন।

বামপন্থী হঠকারীতাবাদ–পলায়নবাদ-দক্ষিণপন্থী হতাশাবাদ এই গোড়ামীবাদী সাইকেলে পুনরাবৃত্তির সম্ভবনা রয়েছে কঃ কবীরের মাঝে। সম্প্রতি সামরিক ক্ষেত্রে পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণে তার বামপন্থী হঠকারীতা প্রকাশ পেয়েছে।

প্রতিটি লেখা-কথা-কাজের মাধ্যমে একজনের বিশ্ব দৃষ্টিকোণের প্রতিফলন ঘটে। কাজেই নিজের প্রকৃত স্বরূপ গোপন রাখা সম্ভব নয়।

কঃ কবীর তার লেখা, কথা-কাজের মাধ্যমে তার বিশ্ব দৃষ্টিকোণ প্রকাশ করেছেন। তিনি গোড়ামীবাদী তাই ভাববাদী, অধিবিদ্যক। এ থেকে এসেছে নিজেকে তত্ত্ববাগীশ মনে করার মনোভাব এবং নেতৃত্বের যোগ্য মনে করা, নেতৃত্বের, পদের লোভ।

উপসংহার আসে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, জ্ঞাতে হোক অজ্ঞাতে হোক বিশ্লেষন হয় বিশ্ব দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে। পৃথিবীতে মৌলিক ভাবে সর্বহারা ও বুর্জোয়া এ দুটি বিশ্ব দৃষ্টিকোণ রয়েছে।

কাজেই উপসংহারের অভিন্নতা অর্থাৎ একই উপসংহার প্রমাণ করে বিশ্ব দৃষ্টিকোণের অভিন্নতা।

বিভিন্ন প্রশ্নে ফজলু চক্রের উপসংহারের সাথে কঃ কবীরের উপসংহারের মিল প্রমাণ করছে তাদের বিশ্ব দৃষ্টিকোণের অভিন্নতাকে। অর্থাৎ তাদের উভয়েরই বিশ্ব দৃষ্টিকোণ হচ্ছে ভাববাদ ও অধিবিদ্যা যা ব্যক্তি স্বার্থকে (নেতৃত্ব, পদ, নাম-যশের লোভ ও অন্যান্য ব্যক্তি স্বার্থ) কেন্দ্র করে আবর্তিত।

কমরেড কবীরের অতীতের প্রতিক্রিয়াশীল ভ্রষ্ট জীবন এবং ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী ভিত্তি এবং উপরোক্ত ত্রুটিসমূহ এক্ষেত্রে খুবই  মারাত্মক।

কাজেই বিপ্লব, পার্টি ও জনগণের স্বার্থে কমরেড কবীরকে নিজের সম্পর্কে এবং কমরেডদের তার সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। অন্যথায় বিপ্লবের যে কোন চরম ক্ষতিসাধন তিনি করতে পারেন।

(অসমাপ্ত)

নোটঃ

১। জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতা হচ্ছে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে ধারণাত্মক জ্ঞানে উন্নীত করা এবং ধারণাত্মক জ্ঞানকে বিপ্লবী অনুশীলনে প্রয়োগ করা। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে ধারণাত্মক জ্ঞানে উন্নীত করা হচ্ছে গোটা জ্ঞানের প্রথম স্তর এবং কম গুরুত্বপূর্ণ স্তর। ধারণাত্মক জ্ঞানকে বিপ্লবী অনুশীলনে প্রয়োগ করা, এ দ্বারা বস্তুকে রূপান্তর করতে লেগে থাকার মাধ্যমে এ জ্ঞানকে যাচাই করা হচ্ছে গোটা জ্ঞানের প্রক্রিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্তর।

২। ভাববাদীরা চেতনাকে দেয় প্রথম স্থান। চেতনাকে বস্তু হিসেবে দেখে। একটি গাছ মনের মধ্যে চিন্তা হলো তাই বাইরে গাছটি দেখলাম। পক্ষান্তরে বস্তুবাদীরা বস্তুকে দেয় প্রথম স্থান, আর চেতনা হচ্ছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তুর মস্তিষ্কে প্রতিফলন। চেতনায় থাক বা না থাক বস্তু বিরাজ করছে। এর অর্থ হচ্ছে মানুষ চিন্তা করুক বা না করুক গাছ রয়েছে, গাছ সম্পর্কিত চিন্তা বা ধারণা গাছ দেখার পর হয়, অর্থাৎ চোখ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গাছ মস্তিষ্কে প্রতিফলন হয় তখন গাছ দেখা হয়, গাছ সম্পর্কিত ধারণা বা চেতনা হয়।

৩। প্রচণ্ড চাপের মুখে আমাদের গেরিলাদের বিভক্ত করা, ছড়িয়ে দেয়া এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে বহু গেরিলা ও কর্মী বেঁচে যায়। পক্ষান্তরে কমরেড কবীরের তত্ত্ব প্রয়োগ করার অর্থ হতো আমাদের দুর্বল গেরিলাদের একত্রিত করা, ছয় পাহাড়ের দালালদের মোকাবেলা করা, শেষ পর্যন্ত খতম হয়ে যাওয়া।

৪। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যকার ব্যক্তি বিশেষের দলিল প্রণয়ন সম্ভব না হলে তখন লেখক বোর্ড গঠন করা হবে। যেমন History of the CPSU (B) প্রণয়নের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল।

চীনে বর্তমানে অনেক কারখানা ও বিপ্লবী কমিটির অধীন লেখক গ্রুপ রয়েছে। এদের কাজ সম্পাদকমণ্ডলীর মত বহু তথ্য সংগ্রহ করা, গবেষণা করা। ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে অসম্ভব বলে এগুলো করা হয়েছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির বর্তমান স্তরে কেন্দ্রীয় কমিটির এমন কোন সমস্যা নেই, দ্বিতীয়তঃ উদ্বৃত্ত কর্মী নেই যে লেখক বোর্ড গঠন করা যায়। বর্তমানে এ প্রস্তাব সম্পূর্ণ অবাস্তব।