সিরাজ সিকদার রচনাঃ বর্তমান পরিস্থিতির উপর একটি সমীক্ষা (সেপ্টেম্বর ১৯৭৪) [ স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত]

সিরাজ সিকদার রচনা

বর্তমান পরিস্থিতির উপর একটি সমীক্ষা

(সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

[ স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত]

sikder

আওয়ামী সরকার হৈ চৈ করে প্রচার করেছে বিরাট পরিবর্তন আসন্ন, দুর্নীতির অবসান হবে, জনগণের দুঃখ-দুর্দশার অবসান হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র রেখে বা প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার গঠন করে জনগণের কোন উপকার সাধন করতে পারে কি?
আওয়ামী লীগ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক পার্টি, যা পূর্ববাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ বা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও মার্কিন-সোভিয়েতের স্বার্থ রক্ষা করে।
কাজেই পার্লামেন্টারী বা প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার যা-ই হোক না কেন — আওয়ামী লীগ যতক্ষণ ক্ষমতায় আছে ততক্ষণ প্রতিক্রিয়াশীল আমলা পুঁজি, সামন্তবাদ, ভারত এবং সোভিয়েট-মার্কিনের স্বার্থ রক্ষা পাবে, জনগণের অবস্থার কোন পরিবর্তনই সাধিত হবে না।
উপরন্তু পার্লামেন্টারী হোক বা প্রেসিডেন্সিয়াল হোক পূর্ববাংলার গণতন্ত্র রয়েছে মুষ্টিমেয় আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ও তাদের চরদের জন্য এবং ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপর চলছে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব।
কাজেই কি পদ্ধতির সরকার হলো তাতে জনগণের কোন কিছু আসে যায় না, সবচাইতে বড় প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রক্ষমতা অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতা, শ্রেণী নিপীড়ণের ক্ষমতা (রাষ্ট্রযন্ত্র) কোন শ্রেণীর হাতে।
যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে সেহেতু যে পদ্ধতির সরকারই হোক না কেন আওয়ামী লীগের স্বার্থ রক্ষা করবে, জনগণের উপর নির্যাতন চলবে।
উপরন্তু একনায়কত্ব কোন নিয়ম দ্বারা বাঁধা নয়। কাজেই যে পদ্ধতির সরকার হোক আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকরা জনগণের উপর প্রয়োজনীয় ফ্যাসিবাদী একনায়ত্ব চালাবে।
সম্প্রতি ফায়ারিং স্কোয়াড গঠন, সংক্ষিপ্ত বিচারে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এটা জনগণের উপর নির্যাতন জোরদার করার একটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়।
কারণ সকল প্রকৃত অপরাধী, দুষ্কৃতিকারী হলো আওয়ামী লীগাররা। কিন্তু ফায়ারিং স্কোয়াড তাদের গা স্পর্শ করবেনা।
তবে ফায়ারিং স্কোয়াড কাদের গা স্পর্শ করবে?
স্বাভাবিকভাবেই ফায়ারিং স্কোয়াডের শিকার হবে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা, যারা জনগণের মুক্তি, তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকুরী, বাসস্থান, শান্তি, নিরাপত্তা, প্রাণপ্রিয় মাতৃভুমির স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্য লড়ছে।
বিপ্লবী ও জনগণের উপর নির্যাতনের এ নবতর পর্যায় বিপ্লবকে আরো ত্বরান্বিত করবে, ব্যাপক জনগণকে বিপ্লবে শরীক করবে।
মাও বলেছিলেন, “জাপান নির্যাতন চালিয়েছিল বলে চীনে বিপ্লব ত্বরান্বিত হয়েছে।”
পূর্ববাংলার ক্ষেত্রেও ইহা প্রযোজ্য।
ব্যাপকতর নির্যাতন ব্যাপকতর প্রতিরোধের জন্ম দেবে, শেষ পর্যন্ত যা আওয়ামী লীগকে কবরস্থ করবে।
সামরিক বাহিনী ‘কুদেতা’র মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হতে পারে কি?
সামরিক বাহিনী নিজস্ব শক্তিতে ক্ষমতায় যেতে সাহস করবে না ভারতের হস্তক্ষেপের ভয়ে।
কারণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের সেনাবাহিনীর সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী লড়ে বিজয় লাভ করতে সক্ষম হবেনা।
সামরিক বাহিনী কোন উপায়ে ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী দালালরা ব্যাপকভাবে মার খাবে এবং তাদের অস্তিত্ব ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।
দ্বিতীয়তঃ সামরিক বাহিনীকে ভারতীয় হস্তক্ষেপের মোকাবেলা করতে হবে। ফলে দেশময় যুদ্ধের অবস্থা, ২৫শে মার্চ, ১৯৭১এর পরবর্তী অবস্থার উদ্ভব হতে পারে।
ভারতকে মোকাবেলা এবং আভ্যন্তরীণ আমলাদেরকে মোকাবেলা করা সামরিক বাহিনীর দ্বারা সম্ভব হবে না, এটা চমৎকার অবস্থার সৃষ্টি করবে।
বৈদেশিক হস্তক্ষেপের সাহায্যে (মার্কিন) সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় টিকে গেলেও জনগণের কোন পরিবর্তন হবে না। কারণ সামরিক বাহিনীর উচ্চ আমলারা (অফিসাররা) আমলা পুঁজি ও সামন্তদের সাথে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুক্ত।
ফলে সামরিক বাহিনীর দ্বারাও ‘বাংলাদেশের’ জনগণের কোন উপকার হবে না।
পাকিস্তানের আয়ুব-ইয়াহিয়া আমল, বার্মার নেউইন সরকারের (তথাকথিত সমাজতন্ত্র কায়েমের দাবীদার) ব্যর্থতা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক একনায়কদের ব্যর্থতা…প্রমাণ।
কাজেই পূর্ববাংলার মুক্তি, জনগণের উপকার সম্ভব একমাত্র সর্বহারার শ্রেণী কর্তৃক পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে।
আর এ সর্বহারা শ্রেণীকে পরিচালিত হতে হবে মার্কস-লেনিন-মাওসেতুঙ নির্দেশিত বৈজ্ঞানিক পথে।