ভ ই লেনিনঃ ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস

লেনিনঃ ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস। পড়ার জন্য পিডিএফ

লেনিনঃ ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস। মুদ্রণের জন্য পিডিএফ

লিখিতঃ ১৮৯৫ সালের শরতে। প্রথম প্রকাশিত হয় শ্রমিকদের সংকলন (মিশেলানি রেবতনিক)-এ ১৮৯৬ সালে।। সংখ্যা ১ ও ২

ভই লেনিন সংগৃহীত রচনাবলী। চতুর্থ রুশ সংস্করন। ২য় খন্ড

মূল রুশ রচনাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্যবাদী পার্টির মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ইন্সটিটিউট কর্তৃক ভ ই লেনিন সংগৃহীত রচনাবলী ২য় খন্ডতে। সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত ইংরেজী সংগৃহীত রচনাবলী থেকে চীনের বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয় পিকিঙ ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে এই রচনাটির ইংরেজী সংস্করণ প্রকাশ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনী ১৯৭১ সালে রচনাটির ৫ম রুশ সংস্করণ থেকে বাংলায় ভাষান্তর করে প্রকাশ করে। সিপিএমএলএম বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ উক্ত বাংলা সংস্করণটিতে অনুবাদের কিছু সংশোধন ও ভাষাগত পরিমার্জন সাধন করে ২০শে মার্চ, ২০২৪ প্রকাশ করে। এর জন্য বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয় পিকিঙ রক্ষিত ইংরেজী ভাষান্তরের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। সর্বহারা পথ ওয়েবসাইট থেকে নতুন সংস্করণটি পড়া ও প্রিন্ট নেয়া যাবে।

প্রুশীয় রাজ্যের রাইন প্রদেশের বার্মেন শহরে ১৮২০ সালে এঙ্গেলস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন কারখানা মালিক। ১৮৩৮ সালে

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন

সাংসারিক কারনে এঙ্গেলস উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ না করেই ব্রেমেনের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসেবে ঢুকতে বাধ্য হন। বাণিজ্যের কাজের মধ্যেও নিজের বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক শিক্ষার কাজ চালিয়ে যেতে এঙ্গেলসের বাধা হয়না। ছাত্র হিসেবেই তিনি স্বৈরাচার ও আমলাদের স্বেচ্ছাচারিতা ঘৃণা করতে শুরু করেন। দর্শনের চর্চা মারফত তিনি আরো অগ্রসর হন। মার্কস ও এঙ্গেলস দুজনই হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ গ্রহণ করেন তার ভাববাদী খোলস বর্জন করে। আর ফয়েরবাখের অদ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ থেকে গ্রহণ করেন বস্তুবাদ। এঙ্গেলসের আগে অনেকেই সর্বহারশ্রেণীর দুঃখদুর্দশা বর্ণনা করে তাদের সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা দেখিয়েছেন। কিন্তু এঙ্গেলস বলেন যে সর্বহারাশ্রেণী শুধু একটি ক্লেশভোগী শ্রেণী নয়; যে অপমানজনক অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সে রয়েছে, সেই অবস্থাটাই তাকে অপ্রতিরোধ্যরূপে সামনে ঠেলে দিচ্ছে ও নিজেদের চূড়ান্ত মুক্তির জন্যে সংগ্রামে বাধ্য করছে। আর সংগ্রামী সর্বহারা নিজেই সাহায্য করবে নিজেকে। শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলন অনিবার্যভাবেই শ্রমিকদের এই চেতনায় উপনীত করাবে যে সমাজতন্ত্র ছাড়া তাদের কোন উপায় নেই। অন্যদিক থেকে, সমাজতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হবে যখন তা হয়ে উঠবে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য।

শ্রমিকশ্রেণীর জন্যে মার্কস ও এঙ্গেলসের যা অবদান সেটা অল্প কথায় এইভাবে বলা যায়ঃ শ্রমিকশ্রেণীকে তাঁরা আত্মজ্ঞান ও আত্মচেতনার শিক্ষা দেন এবং স্বপ্নদর্শনের স্থানে স্থাপন করেন বিজ্ঞান। এইজন্যেই এঙ্গেলসের নাম ও জীবনের কথা প্রতিটি শ্রমিকের জানতে হবে। সর্বহারাশ্রেণী এ কথা বলতে পারে যে তাদের বিজ্ঞান গড়ে দিয়ে গেছেন এমন দুই মনীষী ও যোদ্ধা, যাঁদের পরস্পর সম্পর্ক মানবিক বন্ধুত্বের সর্বাধিক মর্মস্পর্শী সমস্ত প্রাচীন কাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায়।।

                                                                          বাংলা ভাষান্তরের ভূমিকা

এ রচনায় লেনিন এঙ্গেলসের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও মার্কসবাদের বর্ণনা করেছেন। তাকে আরো সংক্ষিপ্তভাবে আমরা এখানে এই ভূমিকায় উপস্থিত করব। মার্কস ও এঙ্গেলস আগে থেকেই ধরে নেয়া ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গী বর্জন করেন; জীবনের দিকে ফিরে তাঁরা দেখলেন যে মনের বিকাশ দিয়ে প্রকৃতির বিকাশ ব্যাখ্যা তো হয়ইনা বরং উল্টো, বস্তু দিয়েই ব্যাখ্যা করা উচিত মনের… হেগেল ও অন্যান্য হেগেলপন্থীদের বিপরীতে মার্কস ও এঙ্গেলস ছিলেন বস্তুবাদী। বিশ্ব ও মানব সমাজের উপর বস্তুবাদী দৃষ্টিপাত করে তাঁরা দেখলেন যে প্রকৃতির সমস্ত ঘটনার পেছনে যেমন আছে বস্তুগত কারণ, মানব সমাজের বিকাশও তেমনি বস্তুগত, উৎপাদনশক্তির বিকাশের শর্তাধীন। মানব চাহিদা মেটানোর জন্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনে লোকে পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্ক স্থাপন করে তা নির্ভর করে উৎপাদিকা-শক্তির বিকাশের উপর। আর এই পরস্পর সম্পর্ক দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় সামাজিক জীবনের সমস্ত ঘটনা, মানবিক প্রচেষ্টা, ভাবনাধারণা ও আইনের। উৎপাদিকা-শক্তির বিকাশ থেকে সৃষ্টি হয় ব্যক্তি মালিকানার উপর স্থাপিত সামাজিক সম্পর্ক, কিন্তু আবার দেখি যে উৎপাদিকা-শক্তির ঐ বিকাশেই ফের অধিকাংশের সম্পত্তি লোপ পায় আর তা কেন্দ্রীভূত হয় নগণ্য সংখ্যালঘুর হাতে। বর্তমান সমাজব্যবস্থার যা ভিত্তি সেই মালিকানাই লুপ্ত হয় তাতে, তার বিকাশ হয় সেই লক্ষ্যের দিকে যা গ্রহণ করেছে সমাজতন্ত্রীরা। সমাজতন্ত্রীদের শুধু এইটুকু বুঝতে হবে কোন সামাজিক শক্তি বর্তমান সমাজে তার নিজ অবস্থানের কারণেই সমাজতন্ত্র স্থাপনে আগ্রহী, এবং আপন স্বার্থ ও ঐতিহাসিক কর্তব্যের চেতনা সে শক্তিকে দিতে হবে। এ শক্তি হল সর্বহারাশ্রেণী। এ শক্তির সঙ্গে এঙ্গেলসের পরিচয় হয় ইংল্যান্ডে, ব্রিটিশ শিল্পের কেন্দ্র ম্যাঞ্চেস্টারে, ১৮৪২ সালে তিনি এখানে এসে পারিবারিক অংশীদারিত্বের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসেবে ঢুকেন। এঙ্গেলস এখানে কেবল কারখানার দপ্তরে বসে থাকেননি, শ্রমিকেরা যেখানে গাদাগাদি করে থাকত সেইসব বস্তির মধ্যে ঘুরে বেড়ান তিনি, নিজের চোখে তাদের নিঃস্বতা ও দারিদ্র্য দেখেন। ১৮৪৪ সালে এঙ্গেলস লেখেন ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা বইটি। বুর্শোয়া সমাজের প্রতি এটি ছিল এক ভয়ংকর অভিযোগপত্র। এঙ্গেলস বলেন যে সর্বহারাশ্রেণী শুধু একটি ক্লেশভোগী শ্রেণী নয়; যে অপমানজনক অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সে রয়েছে, সেই অবস্থাটাই তাকে অপ্রতিরোধ্যরূপে সামনে ঠেলে দিচ্ছে ও নিজেদের চূড়ান্ত মুক্তির জন্যে সংগ্রামে বাধ্য করছে। আর সংগ্রামী সর্বহারা নিজেই সাহায্য করবে নিজেকে। শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলন অনিবার্যভাবেই শ্রমিকদের এই চেতনায় উপনীত করাবে যে সমাজতন্ত্র ছাড়া তাদের কোন উপায় নেই। অন্যদিক থেকে, সমাজতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হবে যখন তা হয়ে উঠবে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য। এঙ্গেলস সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠেন কেবল ইংল্যান্ডেই। ম্যাঞ্চেস্টারে তিনি ইংরেজ শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ও ইংরেজ সমাজতন্ত্রী প্রকাশনাগুলিতে লিখতে শুরু করেন। ১৮৪৪ সালে জার্মানিতে ফেরার পথে প্যারিসে মার্কসের সাথে তাঁর সাক্ষাত পরিচয় হয়, চিঠিপত্রের যোগাযোগ আগেই ঘটেছিল। মার্কসও প্যারিসে ফরাসী সমাজতন্ত্রী ও ফরাসী জীবনের প্রভাবে সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন। দুই বন্ধু এখানে একত্রে লেখেন ‘পবিত্র পরিবার অথবা সমালোচনামূলক সমালোচনার সমালোচনা’। বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৪৩ সালে এবং তার বেশির ভাগটাই মার্কসের লেখা; বিপ্লবী বস্তুবাদী সমাজতন্ত্রের প্রধান কথাগুলির ভিত্তি  স্থাপন করা হয় এই বইয়ে। দার্শনিক বাউয়ের ভ্রাতারা ও তাদের অনুসারীরা এমন সমালোচনার প্রচার করতেন, যা সবকিছু বাস্তবতার ঊর্ধ্বে, পার্টি ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে, সমস্ত ব্যবহারিক কার্যকলাপ তা বর্জন করে পরিপার্শ্বের জগত ও তার ঘটনাবলী নিয়ে কেবল ‘সমালোচনামূলক’ ভাবনায় ব্যাপৃত। জনাব বাউয়েররা অসমালোচক জনগণ মনে করে সর্বহারাশ্রেণীকে তুচ্ছ করতেন। এই কান্ডজ্ঞানহীন ও ক্ষতিকর ধারার বিরুদ্ধে মার্কস ও এঙ্গেলস দৃঢ়চিত্তে দাঁড়ান। এদিকে অর্থনীতি বিষয়ে মার্কসের রচনায় এঙ্গেলস সহযোগিতা করেন। পুঁজি রচনার কাজ মার্কস শেষ করে যেতে পারেননি। মার্কসের পান্ডুলিপির ভিত্তিতে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন এঙ্গেলস। ১৮৪৫ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত সময়টা এঙ্গেলস ব্রাসেলস ও প্যারিসে কাটান এবং তাঁর বৈজ্ঞানিক চর্চার সাথে সাথে ব্রাসেলস ও প্যারিসের জার্মান শ্রমিকদের মধ্যে ব্যবহারিক কাজকে মিলিয়ে নেন। এইখানেই গুপ্ত জার্মান সমিতি ‘সাম্যবাদী লীগ’-এর সঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলসের যোগাযোগ হয়, এ সংঘ তাঁদের উপর ভার দেয় তাঁদের রচিত সমাজতন্ত্রের মূলনীতি উপস্থিত করার জন্য। এভাবেই জন্ম নেয় ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত মার্কস ও এঙ্গেলসের সুবিখ্যাত ‘সাম্যবাদী পার্টির ইশতেহার’। ছোট্র এই পুস্তিকাখানি বহু বৃহৎ গ্রন্থের মূল্য ধরেঃ সভ্য জগতের সমস্ত সংগঠিত ও সংগ্রামী সর্বহারা আজো তার প্রেরণায় সজীব ও সচল। ১৮৪৮ সালে ফ্রান্স থেকে পশ্চিম ইউরোপে বিপ্লব শুরু হলে মার্কস এঙ্গেলস দুই জনই জার্মানীতে গিয়ে তাতে নেতৃত্ব দেন, এঙ্গেলস নিজে সম্মুখ লড়াইয়ে অংশ নেন। বিপ্লব পরাজিত হলে এঙ্গেলস লন্ডনে পালিয়ে আসেন। মার্কসও সেখানে বসত পাতেন। ১৮৬৪ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সঙ্ঘ বা প্রথম আন্তর্জাতিক গঠিত হয়। এক দশক মার্কস এতে নেতৃত্ব করেন। মার্কসের পর এতে নেতৃত্ব করেন এঙ্গেলস, ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব করেন। অগ্রসর দেশগুলি শুধু নয়, স্পেন, রুমানিয়া ও রাশিয়ার মত পশ্চাদপদ দেশগুলির বিপ্লবীরা এঙ্গেলসের পরামর্শ নিয়ে কাজ করেছেন, সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে গেছেন। এঙ্গেলসের প্রধান প্রধান রচনাগুলি হচ্ছেঃ দ্যুরিঙের বক্তব্য খণ্ডন, পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব, ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ ও ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের অবসান ইত্যাদি।।

২০শে মার্চ, ২০২৪

কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ, বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী

ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস

নিভে গেল মনীষার কীবা দীপশীখা

কীবা সে হৃদয় হায় থামাল স্পন্দন!

     (রুশ কবি নিকোলাই আলেক্সেয়েভিচ নেক্রাসভের ‘দব্রলিউভ স্মরণে’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত)

১৮৯৫ সালের ৫ই আগস্ট লন্ডনে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের মৃত্যু হয়েছে। নিজ বন্ধু কার্ল মার্কসের (১৮৮৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়) পর এঙ্গেলসই ছিলেন গোটা সভ্য দুনিয়ায় আধুনিক সর্বহারা শ্রেণীর সবচেয়ে বিখ্যাত মনীষী ও শিক্ষক। ভাগ্যচক্রে কার্ল মার্কসের সঙ্গে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের পরিচয়ের পর থেকে দুই বন্ধুর জীবনকর্ম হয়ে উঠে তাঁদের সাধারণ আদর্শ। তাই সর্বহারাশ্রেণীর জন্য ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস কী করেছেন সেটা বুঝতে হলে আধুনিক শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশে মার্কসের মতবাদ ও কার্যকলাপের তাৎপর্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। মার্কস ও এঙ্গেলসই সর্বপ্রথম দেখান যে, শ্রমিকশ্রেণী ও তার দাবিদাওয়া হল বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আবশ্যিক সৃষ্টি, এ ব্যবস্থা ও তার বুর্শোয়ারা অনিবার্যভাবেই সর্বহারাশ্রেণীকে সৃষ্ট ও সংগঠিত করে। তাঁরা দেখান যে মানবজাতি বর্তমানে যে দুর্দশায় নিপীড়িত তা থেকে তার পরিত্রাণ ঘটায় বিভিন্ন সহৃদয় ব্যক্তির শুভ প্রচেষ্টা নয়, বরং সংগঠিত সর্বহারার শ্রেণীসংগ্রাম। মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের বৈজ্ঞানিক রচনায় প্রথম ব্যাখ্যা করেন যে সমাজতন্ত্র স্বপ্নদ্রষ্টার কল্পনা নয়, আধুনিক সমাজের উৎপাদিকা শক্তিগুলির বিকাশের চরম লক্ষ্য ও অপরিহার্য পরিণাম। এযাবতকালের সমস্ত লিখিত ইতিহাস হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস, কতগুলি সামাজিক শ্রেণীর উপর অন্য কতগুলি শ্রেণীর শাসন ও বিজয়ের পালাবদলের ইতিহাস। আর তা চলতে থাকবে যতদিন না লোপ পাচ্ছে শ্রেণীসংগ্রাম ও শ্রেণীআধিপত্যের ভিত্তিঃ ব্যক্তিগত মালিকানা ও বিশৃংখল সামাজিক উৎপাদন। সর্বহারাশ্রেণীর স্বার্থের    দাবি হল এইসব ভিত্তির বিলোপ, তাই সংগঠিত শ্রমিকদের সচেতন শ্রেণীসংগ্রাম চালিত হওয়া চাই এদের বিরুদ্ধে। আর প্রতিটি শ্রেণীসংগ্রামই হল রাজনৈতিক সংগ্রাম।

মার্কস ও এঙ্গেলসের এই দৃষ্টিভঙ্গী আজকে মুক্তির জন্য সংগ্রামরত সমগ্র সর্বহারাশ্রেণী আয়ত্ত করেছে, কিন্তু ৪০ দশকে যখন দুই বন্ধু তৎকালের সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য ও সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিলেন, তখন এ দৃষ্টিভঙ্গী ছিল একেবারেই অভিনব। প্রতিভাবান ও প্রতিভাহীন, সৎ ও অসৎ এমন বহু লোক ছিলেন যাঁরা রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে, রাজা, পুলিশ ও যাজকদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আচ্ছন্ন হয়ে বুর্শোয়া ও সর্বহারাশ্রেণীর স্বার্থবিরোধ দেখতেন না। শ্রমিকেরা স্বাধীন সামাজিক শক্তি হিসাবে অবতীর্ণ হবে এ ভাবনাটাকে তাঁরা আমলই দিতেননা। অন্যদিকে ছিলেন বহু স্বপ্নদর্শী, কখনো কখনো আবার প্রতিভাবান, তাঁরা ভাবতেন যে শাসক ও সরকারী শ্রেণীগুলিকে সমকালীন শাসনের অন্যায় সম্পর্কে বুঝিয়েই কেবল পৃথিবীতে শান্তি ও সার্বজনীন কল্যাণ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। বিনা সংগ্রামে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা। শেষত, তৎকালীন সমাজতন্ত্রীদের প্রায় সবাই এবং সাধারণভাবে শ্রমিকশ্রেণীর বন্ধুরা সর্বহারাশ্রেণীকে মনে করতেন একটা দুষ্টক্ষত আর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দেখতেন শিল্পের বিকাশের সাথে কীকরে এই দুষ্টক্ষত বেড়ে উঠেছে। তারা একটা উপায় খুজতে লাগলেন কীভাবে শিল্প ও সর্বহারাশ্রেণীর বৃদ্ধি রোধ করা যায়, থামানো যায় ‘ইতিহাসের চাকা’। সর্বহারার বৃদ্ধিতে এই সাধারণ ভীতির বিপরীতে মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের সমস্ত ভরসাই রাখলেন সর্বহারাশ্রেণীর অবিরাম বৃদ্ধির উপর। যত বেশি হবে সর্বহারশ্রেণী, বিপ্লবী শ্রেণী হিসাবে ততই বাড়বে তার শক্তি, ততই নিকটতর ও সম্ভবপর হয়ে উঠবে সমাজতন্ত্র। শ্রমিকশ্রেণীর জন্যে মার্কস ও এঙ্গেলসের যা অবদান সেটা অল্প কথায় এইভাবে বলা যায়ঃ শ্রমিকশ্রেণীকে তাঁরা আত্মজ্ঞান ও আত্মচেতনার শিক্ষা দেন এবং স্বপ্নদর্শনের স্থানে স্থাপন করেন বিজ্ঞান।

এইজন্যেই এঙ্গেলসের নাম ও জীবনের কথা প্রতিটি শ্রমিকের জানতে হবে। সেইজন্যেই আমাদের সমস্ত প্রকাশনার মত এই সংকলনটিরও উদ্দেশ্য হল রুশ শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণী সচেতনতা জাগিয়ে তোলা, তাতে আধুনিক সর্বহারার দুই মহান শিক্ষকের অন্যতম ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের জীবন ও কার্যকলাপের একটা চিত্র আমাদের দেওয়া উচিত।

প্রুশীয়া রাজ্যের রাইন প্রদেশের বার্মেন শহরে ১৮২০ সালে এঙ্গেলস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন কারখানা মালিক। ১৮৩৮ সালে সাংসারিক কারনে এঙ্গেলস উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ না করেই ব্রেমেনের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসেবে ঢুকতে বাধ্য হন। ব্যবসা বাণিজ্যের কাজের মধ্যেও নিজের বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক শিক্ষার কাজ চালিয়ে যেতে এঙ্গেলসের বাধা হয়না। ছাত্র অবস্থাতেই তিনি আমলাদের স্বৈরাচার ও অত্যাচার ঘৃণা করতে শুরু করেন। দর্শনের চর্চা মারফত তিনি আরো অগ্রসর হন। সেসময় জার্মান দর্শনের ক্ষেত্রে ছিল হেগেলীয় মতবাদের প্রাধান্য, এবং এঙ্গেলস তাঁর অনুসারী হয়ে ওঠেন। হেগেল স্বয়ং স্বৈরাচারী প্রুশীয় সরকারের পক্ষপাতী ছিলেন, বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রূপে তিনি তার সেবায় রত ছিলেন, তারপরও হেগেলের শিক্ষা ছিল বিপ্লবী। মানবিক যুক্তি ও মানবিক অধিকারের উপর হেগেলের বিশ্বাস এবং বিশ্বে পরিবর্তন ও বিকাশের চিরন্তন প্রক্রিয়া চলছে এই মর্মে তাঁর দর্শনের মূল প্রতিপাদ্যের ফলে বার্লিন দার্শনিকের যেসব শিষ্যরা চলতি অবস্থা মেনে নিতে চাইছিলেননা তাঁরা এই চিন্তায় উপনীত হন যে, চলতি অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, চলতি অন্যায় ও আধিপত্যকারী দুষ্টের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূলও রয়েছে চিরন্তন বিকাশের বিশ্বজনীন নিয়মে। সবই যদি বিকশিত হয়ে উঠতে থাকে, যদি একটা প্রতিষ্ঠানের স্থান নেয় অন্য প্রতিষ্ঠান, তবে প্রুশীয় রাজা বা রুশ জারের স্বৈরাচারই বা কেন চিরকাল চলবে, কেন চলবে বিপুল অধিকাংশের ঘাড় ভেঙে নগণ্য অল্পসংখ্যকের ধনবৃদ্ধি, জনগণের উপর বুর্শোয়ার আধিপত্য? হেগেলের দর্শনে বলা হয়েছিল মন ও ভাবের বিকাশের কথা, তা ছিল ভাববাদী। মনের বিকাশ থেকে এ দর্শন পৌঁছত প্রকৃতিতে, মানুষে, জনগণে, সমাজসম্পর্কের বিকাশে। বিকাশের চিরন্তন প্রক্রিয়া বিষয়ে হেগেলের ভাবনা অব্যাহত রেখে (মার্কস ও এঙ্গেলস একাধিকবার দেখিয়েছেন যে তাঁদের মানসিক বিকাশ বহু দিক থেকে মহান জার্মান দার্শনিকদের, বিশেষ করে হেগেলের নিকট ঋণী। এঙ্গেলস বলেছেন, ‘জার্মান দর্শন ছাড়া বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রও সম্ভব হতনা) মার্কস ও এঙ্গেলস আগে থেকেই ধরে নেয়া ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গী বর্জন করেন; জীবনের দিকে ফিরে তাঁরা দেখলেন যে মনের বিকাশ দিয়ে প্রকৃতির বিকাশ ব্যাখ্যা তো হয়ইনা বরং উল্টো, প্রকৃতি দিয়ে, বস্তু দিয়েই ব্যাখ্যা করা উচিত মনের… হেগেল ও অন্যান্য হেগেলপন্থীদের বিপরীতে মার্কস ও এঙ্গেলস ছিলেন বস্তুবাদী। বিশ্ব ও মানুষের উপর বস্তুবাদী দৃষ্টিপাত করে তাঁরা দেখলেন যে প্রকৃতির সমস্ত ঘটনার পেছনে যেমন আছে বস্তুগত কারণ, মানব সমাজের বিকাশও তেমনি বস্তুগত, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের শর্তাধীন। মানব চাহিদা মেটানোর জন্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনে লোকে পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্ক স্থাপন করে তা নির্ভর করে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের উপর। আর এই পরস্পর সম্পর্ক দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় সামাজিক জীবনের সমস্ত ঘটনার, মানবিক আশাআকাংখা, চিন্তা ও আইনের। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ থেকে সৃষ্টি হয় ব্যক্তি মালিকানার উপর স্থাপিত সামাজিক সম্পর্ক, কিন্তু আবার দেখি যে উৎপাদিকা শক্তির ঐ বিকাশেই ফের অধিকাংশের সম্পত্তি লোপ পায় আর তা কেন্দ্রীভূত হয় নগণ্য সংখ্যালঘুর হাতে। বর্তমান সমাজব্যবস্থার যা ভিত্তি সেই মালিকানাই লুপ্ত হয় তাতে, আর তার বিকাশ হয় সেই লক্ষ্যের দিকে যা গ্রহণ করেছে সমাজতন্ত্রীরা। সমাজতন্ত্রীদের শুধু এইটুকু বুঝতে হবে কোন সামাজিক শক্তি বর্তমান সমাজে তার নিজ অবস্থানের কারণেই সমাজতন্ত্র স্থাপনে আগ্রহী, এবং আপন স্বার্থ ও ঐতিহাসিক কর্তব্যের চেতনা সে শক্তিকে দিতে হবে। এ শক্তি হল সর্বহারাশ্রেণী। এ শক্তির সঙ্গে এঙ্গেলসের পরিচয় হয় ইংল্যান্ডে, ব্রিটিশ শিল্পের কেন্দ্র ম্যাঞ্চেস্টারে, ১৮৪২ সালে তিনি এখানে এসে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসেবে ঢুকেন, তাঁর বাবা ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম অংশীদার। এঙ্গেলস এখানে কেবল কারখানার দপ্তরে বসে থাকেননি, শ্রমিকেরা যেখানে গাদাগাদি করে থাকত সেইসব বস্তির মধ্যে ঘুরে বেড়ান তিনি, নিজের চোখে তাদের নিঃস্বতা ও দারিদ্র্য দেখেন। শুধু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে তৃপ্ত না হয়ে তিনি ইংরেজ শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা সম্পর্কে তখন পর্যন্ত যাকিছু প্রকাশিত হয়েছিল সব পাঠ করেন, আয়ত্তাধীন সমস্ত সরকারী দলিল তিনি খুঁটিয়ে অধ্যয়ন করেন। এই অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের ফল হল ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থাইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা বইটির লেখক হিসেবে এঙ্গেলসের প্রধান কীর্তি কী তা আমরা আগেই বলেছি। এঙ্গেলসের আগে অনেকেই সর্বহারশ্রেণীর দুঃখদুর্দশা বর্ণনা করে তাদের সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা দেখিয়েছেন। এঙ্গেলসই প্রথম বলেন যে সর্বহারাশ্রেণী শুধু একটি দুঃখভোগী শ্রেণী নয়; যে অপমানজনক অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সে রয়েছে, সেই অবস্থাটাই তাকে অপ্রতিরোধ্যরূপে সামনে ঠেলে দিচ্ছে ও নিজেদের চূড়ান্ত মুক্তির জন্যে সংগ্রামে বাধ্য করছে। আর সংগ্রামী সর্বহারা নিজেই সাহায্য করবে নিজেকে। শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলন অনিবার্যভাবেই শ্রমিকদের এই চেতনায় উপনীত করাবে যে সমাজতন্ত্র ছাড়া তাদের কোন উপায় নেই। অন্যদিক থেকে, সমাজতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হবে যখন তা হয়ে উঠবে শ্রমিকশ্রেণীরাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য। ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা সম্পর্কে এঙ্গেলসের বইখানির এই হল মূলকথা, যা চিন্তাশীল ও সংগ্রামী সর্বহারাশ্রেণী আজ আত্মস্থ করে নিলেও সেসময় এটা ছিল একেবারে নতুন। আর এ ভাবনা পেশ করা হয়েছিল যে বইটিতে তার রচনাশৈলী মুগ্ধ করার মত, ইংরেজ সর্বহারাশ্রেণীর দুর্দশার অতি প্রামাণ্য ও রোমহর্ষক চিত্রে তা পরিপূর্ণ। এই বই হল পুঁজিবাদ ও বুর্শোয়ার বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর অভিযোগপত্র। এর প্রভাব হয় অতি বিপুল। আধুনিক সর্বহারাশ্রেণীর অবস্থার সেরা ছবি হিসেবে সর্বত্রই এঙ্গেলসের বইটির উল্লেখ শুরু হয়। এবং বাস্তবিকই, শ্রমিকশ্রেণীর দুর্দশার এমন জ্বলজ্বলে ও সত্য বর্ণনা ১৮৪৫ সালের আগে বা পরে আর দেখা যায়নি।

এঙ্গেলস সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠেন কেবল ইংল্যান্ডেই। ম্যাঞ্চেস্টারে তিনি তদানীন্তন ব্রিটিশ শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ও ইংরেজ সমাজতন্ত্রী প্রকাশনাগুলিতে লিখতে শুরু করেন। ১৮৪৪ সালে জার্মানিতে ফেরার পথে প্যারিসে মার্কসের সাথে তাঁর সাক্ষাত পরিচয় হয়, চিঠিপত্রের যোগাযোগ আগেই ঘটেছিল। মার্কসও প্যারিসে ফরাসী সমাজতন্ত্রী ও ফরাসী জীবনের প্রভাবে সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন। দুই বন্ধু এখানে একত্রে লেখেন পবিত্র পরিবার অথবা সমালোচনামূলক সমালোচনার সমালোচনা। বইটি প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থার এক বছর আগে, এবং তার বেশির ভাগটাই মার্কসের লেখা; বিপ্লবী বস্তুবাদী সমাজতন্ত্রের প্রধান যেসব কথা আগে বলেছি, তারই ভিত্তি স্থাপন করা হয় এই বইয়ে। দার্শনিক বাউয়ের ভ্রাতারা ও তাঁদের অনুগামীদের ব্যঙ্গ নাম হল ‘পবিত্র পরিবার’। এই ভদ্রলোকেরা এমন সমালোচনার প্রচার করতেন, যা সমস্ত বাস্তবতার ঊর্ধ্বে, পার্টি ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে, সমস্ত ব্যবহারিক কার্যকলাপ তা বর্জন করে পরিপার্শ্বের জগত ও তার ঘটনাবলী নিয়ে কেবল ‘সমালোচনামূলক’ ভাবনায় ব্যাপৃত। জনাব বাউয়েররা অসমালোচক জনগণ মনে করে সর্বহারাশ্রেণীকে তুচ্ছজ্ঞান করত। এই কান্ডজ্ঞানহীন ও ক্ষতিকর ধারার বিরুদ্ধে মার্কস ও এঙ্গেলস দৃঢ়চিত্তে দাঁড়ান। শাসকশ্রেণী ও রাষ্ট্র কর্তৃক দলিত শ্রমিক, এই বাস্তব একটি মানবিক ব্যক্তিসত্তার নামে তাঁরা শুধু ভাবনা নয়, উন্নত সমাজ গঠনের জন্যে সংগ্রামের দাবি করেন। সেরূপ সংগ্রাম চালাতে সমর্থ ও তাতে স্বার্থসম্পন্ন যে শক্তি, সেটা তাঁরা অবশ্যই দেখেন সর্বহারার মধ্যেই। পবিত্র পরিবার-এর আগেই মার্কস ও রুগের জার্মান ফরাসী পত্রিকায় এঙ্গেলসের ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে সমালোচনামূলক নিবন্ধ’ ছাপা হয়, এতে সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল ঘটনাগুলিকে দেখা হয় ব্যক্তি মালিকানার শাসনের অনিবার্য পরিণাম হিসেবে। মার্কসের রচনায় যে বিজ্ঞানে একটা বিপ্লবই ঘটে যায় সেই রাজনৈতিক অর্থনীতির চর্চা করার জন্য মার্কস যে সিদ্ধান্ত নেন, তার পেছনে এঙ্গেলসের সঙ্গে যোগাযোগের ঘটনাটা নিঃসন্দেহে সাহায্য করেছে।

১৮৪৫ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত সময়টা এঙ্গেলস ব্রাসেলস ও প্যারিসে কাটান এবং তাঁর বৈজ্ঞানিক চর্চাকে ব্রাসেলস ও প্যারিসের জার্মান শ্রমিকদের মধ্যে ব্যবহারিক কাজের সাথে মিলিয়ে নেন। এইখানেই গুপ্ত জার্মান সমিতি ‘সাম্যবাদী লীগ’-এর সঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলসের যোগাযোগ হয়, এ সংঘ তাঁদের উপর ভার দেয় তাঁদের রচিত সমাজতন্ত্রের মূলনীতি উপস্থিত করার জন্য। এভাবেই জন্ম নেয় ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত মার্কস ও এঙ্গেলসের সুবিখ্যাত সাম্যবাদী পার্টির ইশতেহার। ছোট এই বই বহু বৃহৎ গ্রন্থের মূল্য ধরেঃ সভ্য জগতের সমস্ত সংগঠিত ও সংগ্রামী সর্বহারা আজো তার প্রেরণায় সজীব ও সচল।

১৮৪৮ সালের যে বিপ্লব প্রথমে ফ্রান্সে শুরু হয়ে পরে পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বিস্তৃত হয়, তাতে মার্কস ও এঙ্গেলস দেশে ফেরেন। সেখানে, প্রুশিয়ার রাইন অঞ্চলে তাঁরা কলোন থেকে গণতান্ত্রিক নতুন রাইনীয় পত্রিকার দায়িত্ব নেন। রাইনীয় প্রুশিয়ার সমস্ত বিপ্লবী গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেন দুই বন্ধু। জনগণের স্বার্থ ও স্বাধীনতার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালান শেষ মাত্রা পর্যন্ত। সবাই জানেন, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জয়লাভ করে। ‘নতুন রাইনীয় পত্রিকা’ নিষিদ্ধ হয়, মার্কস দেশান্তরী জীবনযাত্রার সময় প্রুশীয় নাগরিকত্ব হারিয়েছিলেন, তাঁকে নির্বাসিত করা হয়, আর এঙ্গেলস সশস্ত্র গণবিদ্রোহে অংশ নেন, তিনটি সংঘর্ষে লড়াই করেন স্বাধীনতার জন্যে, এবং বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পর সুইজারল্যান্ড হয়ে লন্ডনে পালান।

মার্কসও সেখানে বসতি পাতেন। এঙ্গেলস অচিরেই ফের কেরানির কাজ নেন, এবং পরে ৪০ দশকে ম্যাঞ্চেস্টারে যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছিলেন তার অংশীদার হন। ১৮৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ম্যাঞ্চেস্টারে বাস করেন আর মার্কস থাকেন লন্ডনে, এতে তাঁদের একটা জীবন্ত মানসিক যোগাযোগে বাধা হয়নাঃ প্রায় প্রতিদিন চিঠির আদান প্রদান চলত তাঁদের। এইসব পত্রালাপে তাঁ  বই। পুঁজিবাদী অর্থনীতির জটিল ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করেন মার্কস। আর অতি সহজ ভাষায় প্রায়ই বিতর্কমূলক রচনায় সাধারণ বৈজ্ঞানিক সমস্যা আর অতীত বর্তমানের বহু বিচিত্র বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ইতিহাসের বস্তুবাদী বোধ ও মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে লেখেন এঙ্গেলস। এঙ্গেলসের এইসব রচনার মধ্যে উল্লেখ করবঃ দ্যুরিঙের বিরুদ্ধে বিতর্কমূলক রচনা, এখানে দর্শন, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের বড় বড় প্রশ্ন আলোচিত হয়েছে [লেনিনের টিকাঃ আশ্চর্য রকমের সারগর্ভ ও শিক্ষাপ্রদ বই এটি। দুঃখের বিষয় রুশ ভাষায় তার অল্প অংশমাত্রই অনূদিত হয়েছে, যাতে আছে সমাজতন্ত্র বিকাশের ঐতিহাসিক রূপরেখা (‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিকাশ’, ২য় সংস্করণ, জেনেভা, ১৮৯২)], পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব (রুশ ভাষায় অনুবাদ, সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে প্রকাশিত, ৩য় সংস্করণ, ১৮৯৫), ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ (গ প্লেখানভের টিকাসহ রুশ অনুবাদ, জেনেভা, ১৮৯২), রুশ সরকারের বৈদেশিক নীতির উপর প্রবন্ধ (জেনেভার সমাজ গণতন্ত্রী পত্রিকার ১ম ও ২য় সংখ্যায় রুশ ভাষায় অনূদিত), বাসসংস্থান সমস্যা নিয়ে চমৎকার প্রবন্ধাবলী, এবং পরিশেষে, রাশিয়ার অর্থনৈতিক বিকাশ সম্পর্কে ছোট হলেও দুটি অতি মূল্যবান নিবন্ধ (‘রাশিয়া প্রসঙ্গে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস’, ভ ই জাসুলিচ কর্তৃক রুশ ভাষায় অনূদিত, জেনেভা, ১৮৯৪)। মার্কস মারা যান, পুঁজি বিষয়ে তাঁর বিশাল রচনা সম্পূর্ণরূপে শেষ করে যেতে পারেননি। খসড়া হিসাবে তা অবশ্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুর মৃত্যুর পর পুঁজির দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ড গুছিয়ে তোলা ও প্রকাশনের গুরুভার শ্রমে আত্মনিয়োগ করেন এঙ্গেলস। ১৮৮৫ সালে তিনি প্রকাশ করেন দ্বিতীয় এবং ১৮৯৪ সালে তৃতীয় খন্ড (চতুর্থ খন্ড গুছিয়ে যেতে পারেননি তিনি) (কার্ল মার্কস, উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব)। এই দুই খন্ড নিয়ে খাটতে হয়েছে অনেক। অস্ট্রীয় সমাজগণতন্ত্রী আদলের সঠিকভাবেই বলেছেন যে পুঁজির ২য় ও ৩য় খন্ড প্রকাশ করে এঙ্গেলস তাঁর প্রতিভাবান বন্ধুর যে মহান স্মৃতিস্তম্ভ গড়েছেন তাতে তাঁর অনিচ্ছাসত্ত্বেও অক্ষয় অক্ষরে তাঁর নিজের নামটাও ক্ষোদিত হয়ে গেছে। সত্যিই, পুঁজির এই দুই খন্ড হল মার্কস ও এঙ্গেলস এই দুই জনের রচনা। প্রাচীন পুরাকথায় বন্ধুত্বের অনেক মর্মস্পর্শী দৃষ্টান্তের কাহিনী শোনা যায়। ইউরোপীয় সর্বহারাশ্রেণী এ কথা বলতে পারে যে তাদের বিজ্ঞান গড়ে দিয়ে গেছেন এমন দুই মনীষী ও যোদ্ধা, যাঁদের পরস্পর সম্পর্ক মানবিক বন্ধুত্বের সর্বাধিক মর্মস্পর্শী সমস্ত প্রাচীন কাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায়। এঙ্গেলস সর্বদাই, এবং সাধারণত অতি সঙ্গতভাবেই নিজেকে রেখেছেন মার্কসের পেছনে। তাঁর এক পুরোনো বন্ধুর কাছে তিনি লেখেন, ‘মার্কস থাকলে আমি দোহারের কাজ করেছি’ (দেখুন জে পি বেকারের কাছে এঙ্গেলসের পত্র, ১৫ই অক্টোবর, ১৮৮৪)। জীবিত মার্কসের প্রতি ভালবাসায় এনং মৃতের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায় তাঁর সীমা ছিলনা। রুক্ষ যোদ্ধা ও কঠোর চিন্তাবিদ এই মনীষীর ছিল এক গভীর স্নেহশীল হৃদয়।

১৮৪৮-৪৯ সালের আন্দোলনের পর নির্বাসনকালে মার্কস ও এঙ্গেলস কেবল বিজ্ঞান নিয়েই ব্যাপৃত থাকেননি। ১৮৬৪ সালে মার্কস স্থাপন করেন ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমিতি’ এবং পুরো দশ বছর ধরে তার নেতৃত্ব করেন। এ সমিতির কাজকর্মে এঙ্গেলসও সক্রিয় অংশ নেন। শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশে এই ‘আন্তর্জাতিক সমিতি’র কার্যকলাপের তাৎপর্য বিপুল, মার্কসের চিন্তা অনুসারে সমস্ত দেশের সর্বহারাশ্রেণীকে সম্মিলিত করেছে তা। কিন্তু ৭০ দশকে ‘আন্তর্জাতিক সমিতি’ বন্ধ হয়ে গেলেও মার্কস ও এঙ্গেলসের ঐক্যবিধায়ক ভূমিকা থামেনি। বরং বলা যেতে পারে, শ্রমিক আন্দোলনের আত্মিক নায়ক হিসেবে তাঁদের তাৎপর্য অবিরাম বেড়ে গেছে, কারণ এই আন্দোলনই বেড়ে উঠেছে অবিচ্ছিন্নভাবে। মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস একাই ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রীদের উপদেষ্টা ও নেতার কাজ চালিয়ে যান। তাঁর কাছে পরামর্শ ও নির্দেশ যেমন চাইতেন জার্মান সমাজতন্ত্রীরা, সরকারী দমন সত্ত্বেও এঁদের শক্তি দ্রুত ও অবিচ্ছিন্নভাবে বেড়ে উঠে, তেমনি চাইতেন পিছিয়ে থাকা দেশের প্রতিনিধিরা যেমন স্পেনীয়, রুমানীয়, রুশীয়রা, ভেবে চিন্তে মেপে মেপে যাঁদের প্রথমে পা ফেলতে হচ্ছিল। বৃদ্ধ এঙ্গেলসের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে এঁরা সকলেই আহরণ করেছেন।

মার্কস ও এঙ্গেলস দুজনেই রুশ ভাষা জানতেন, রুশী বই পড়তেন, রাশিয়া নিয়ে তাঁদের জীবন্ত আগ্রহ ছিল, রুশ বিপ্লবী আন্দোলনকে তাঁরা দরদ দিয়ে অনুসরণ করেছেন ও রুশ বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে গেছেন। এঁরা দুজনেই গণতন্ত্রী থেকে সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠেন, এবং রাজনৈতিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঘৃণার গণতান্ত্রিক বোধ এঁদের মধ্যে ছিল অসাধারণ প্রবল। এই প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অনুভূতি এবং সেইসাথে রাজনৈতিক স্বৈরাচারের সঙ্গে অর্থনৈতিক পীড়নের সম্পর্ক বিষয় গভীর তাত্ত্বিক বোধ ও সমৃদ্ধ জীবনাভিজ্ঞতার ফলে মার্কস ও এঙ্গেলস হয়ে উঠেন বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যাপারে অসাধারণ সজাগ। সেই কারণেই পরাক্রমশালী জার সরকারের বিরুদ্ধে মুষ্টিমেয় রুশ বিপ্লবীদের বীরোচিত সংগ্রাম পরীক্ষিত এই বিপ্লবীদের হৃদয়ে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল সাড়া জাগায়। অন্যদিকে, মেকি অর্থনৈতিক সুবিধালাভের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের অতি আশু ও জরুরী কর্তব্য থেকে রুশ সমাজতন্ত্রীদের সরে আসার হীন চেষ্টাটা তাঁদের চোখে স্বভাবতই সন্দেহজনক ঠেকেছিল এবং একে এমনকি সামাজিক বিপ্লবের মহান আদর্শের প্রতি সরাসরি বেইমানি বলেই তাঁরা তা গণ্য করেছিলেন। ‘সর্বহারাশ্রেণীর মুক্তি হওয়া চাই তাদের নিজেদের কাজ’—অবিরাম এই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন মার্কস ও এঙ্গেলস। আর নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করতে হলে কিছুটা রাজনৈতিক অধিকার সর্বহারাকে জয় করতে হবে। তাছাড়া, মার্কস ও এঙ্গেলস পরিষ্কার দেখেছিলেন যে, পশ্চিম-ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনের জন্যও রাশিয়ায় রাজনৈতিক বিপ্লবের তাৎপর্য বিপুল। স্বৈরতন্ত্রী রাশিয়া চিরকালই ছিল ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়ার দুর্গপ্রাচীর। ফ্রান্স ও জার্মানীর মধ্যে দীর্ঘকালের মতবিরোধ বপন করে ১৮৭০ সালের যুদ্ধ রাশিয়াকে যে অসাধারণ অনুকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে স্থাপন করে তাতে অবশ্যই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে স্বৈরতন্ত্রী রাশিয়ার তাৎপর্যটাই বেড়েছে। পোলীয়, ফিনীয়, জার্মান, আর্মেনীয় ও অন্যান্য ছোট ছোট জাতিদের যার পীড়ন করার দরকার নেই, দরকার নেই অবিরাম ফ্রান্সের সঙ্গে জার্মানীকে লাগানোর, তেমন এক স্বাধীন রাশিয়া থাকলেই কেবল বর্তমান ইউরোপ তার সামরিক চাপ থেকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে, ইউরোপের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল উপাদানগুলি দুর্বল হয়ে যাবে, এবং ইউরোপীয় শ্রমিকশ্রেণীর শক্তি বেড়ে উঠবে। তাই এঙ্গেলস পশ্চিমে শ্রমিক আন্দোলনের সাফল্যের জন্যেও রাশিয়ায় রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন সাগ্রহে। তাঁর মধ্যে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে হারাল রুশ বিপ্লবীরা।

সর্বহারাশ্রেণীর মহাযোদ্ধা ও শিক্ষক ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের স্মৃতি অক্ষয় হোক!।।