ভ ই লেনিনঃ মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদ

লেনিনঃ মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদ। পড়ার জন্য পিডিএফ           লেনিনঃ মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদ। মুদ্রণের জন্য পিডিএফ

মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদ

রচনাঃ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন

লিখিতঃ ১৯০৮ সালের ১৬ মার্চ-৩রা এপ্রিল

ভই লেনিন সংগৃহীত রচনাবলী। চতুর্থ রুশ সংস্করন। ১৭শ খন্ড, পৃ ১৫-২৬

মূল রুশ রচনাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্যবাদী পার্টির মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ইন্সটিটিউট কর্তৃক ভ ই লেনিন সংগৃহীত রচনাবলীতে। সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত ইংরেজী সংগৃহীত রচনাবলী থেকে চীনের বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয় পিকিঙ ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে এই রচনাটির ইংরেজী সংস্করণ প্রকাশ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনী ১৯৭১ সালে রচনাটির ৫ম রুশ সংস্করণ থেকে বাংলায় ভাষান্তর করে প্রকাশ করে। সিপিএমএলএম বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ উক্ত বাংলা সংস্করণটিতে অনুবাদের কিছু সংশোধন ও ভাষাগত পরিমার্জন সাধন করে ৩০শে মার্চ, ২০২৪ প্রকাশ করে। এর জন্য বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয় পিকিঙ রক্ষিত ইংরেজী ভাষান্তরের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। সর্বহারা পথ ওয়েবসাইট থেকে নতুন সংস্করণটি পড়া ও প্রিন্ট নেয়া যাবে।

এ রচনায় কমরেড লেনিনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি

“সংশোধনবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধারার একটা স্বাভাবিক পরিপূরক হল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যের প্রতি তার মনোভাব। ‘আন্দোলনটাই সব, চূড়ান্ত লক্ষ্য কিছুই নয়’—বের্নস্তাইনের এই বাঁধাবুলিতে অনেক দীর্ঘ প্রবন্ধের চেয়েও ভালভাবেই সংশোধনবাদের মর্ম প্রকাশিত হয়েছে। উপলক্ষ্যে উপলক্ষ্যে নিজের আচরণ বদলানো, দৈনন্দিন ঘটনাবলীর সঙ্গে এবং সংকীর্ণ রাজনীতির

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন

ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো, সর্বহারাশ্রেণীর মূল স্বার্থগুলি আর সমগ্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তথা সমস্ত পুঁজিবাদী বিবর্তনের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি ভুলে যাওয়া, ক্ষণিকের বাস্তব কিংবা কল্পিত সুবিধার খাতিরে এইসব মূল স্বার্থ বলি দেয়া—এই হল সংশোধনবাদের কর্মনীতি”

“আধুনিক সমাজের শ্রেণীগত শিকড় থেকেই সংশোধনবাদের অবশ্যম্ভাবিতা নির্ধারিত হয়। সংশোধনবাদ একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপার। জার্মানিতে গোঁড়া আর বের্নস্তাইনপন্থীদের মধ্যে, ফ্রান্সে গেদপন্থী আর জোরেসপন্থীদের  (আর এখন বিশেষভাবে ব্রুসপন্থীদের) মধ্যে, ইংল্যান্ডের সমাজগণতন্ত্রী ফেডারেশন আর স্বাধীন শ্রমিক পার্টির মধ্যে, বেলজিয়ামে ব্রুকের আর ভান্দের্ভেলদের মধ্যে, ইতালিতে ইন্টেগ্রালিস্ট আর সংস্কারবাদীদের মধ্যে, রাশিয়ায় বলশেভিক আর মেনশভিকদের মধ্যে সম্পর্কটা ঐসব দেশের বর্তমান অবস্থায় বিভিন্ন জাতীয় পরিস্থিতির আর ঐতিহাসিক উপাদানের বিপুল বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সর্বত্র যে মূলত একইরকমের তাতে যেকোন চিন্তাশক্তিসম্পন্ন ওয়াকিবহাল সমাজতন্ত্রীর লেশমাত্র সন্দেহও থাকতে পারেনা”

“পুঁজিবাদী সমাজে সংশোধনবাদের অবশ্যম্ভাবিতা কোথায় নিহিত? বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং পুঁজিবাদী বিকাশের বিভিন্ন মাত্রার মধ্যে পার্থক্যের চেয়েও এটা বেশি গভীর কেন? তার কারণ, প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশে সর্বহারার পাশাপাশি সর্বদাই থাকে ছোট বুর্শোয়া, ছোট মালিকদের একটা বিস্তৃত স্তর। ছোট উৎপাদন থেকেই পুঁজিবাদের উদ্ভব হয়েছিল এবং নিরন্তর হচ্ছে। পুঁজিবাদ বারবার অনিবার্যভাবেই ছোট ছোট কারখানার মত নতুন কতগুলি ‘মধ্যবর্তী স্তরের’ উদ্ভব ঘটায়। নতুন নতুন এই ছোট উৎপাদকেরা আবার সমান অনিবার্যভাবেই সর্বহারার সারিতে গিয়ে পড়ে। ব্যাপক শ্রমিক পার্টিসমূহের সদস্যদের মধ্যে ছোট বুর্শোয়া বিশ্বদৃষ্টি যে বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, এটা খুবই স্বাভাবিক”

­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­ বাংলা ভাষান্তরের ভূমিকা

লেনিনের এ রচনা থেকে আমরা মার্কসবাদ ও তার শত্রু সংশোধনবাদ সম্পর্কে জানতে পারি। ১৮৪০ দশকে মার্কসবাদের উদ্ভবের পর প্রথম অর্ধশত বছরে তাকে সরাসরি শত্রু মতবাদের সাথে লড়তে হয়েছে, যথা নবীন হেগেলপন্থীদের ভাববাদী মতবাদ, প্রুঁধো, বাকুনিন ও ব্লাঙ্কির নৈরাজ্যবাদ, দ্যুরিংয়ের দৃষ্টবাদ প্রভৃতি। ১৮৯০ দশকে মার্কসবাদ সন্দেহাতীতভাবে জয়লাভ করে। আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে সমাজতন্ত্রীগণ দ্বিধাহীনভাবে সমাজতন্ত্রের মতবাদ হিসেবে মার্কসবাদ গ্রহণ করেন। তখন থেকে সংশোধনবাদের উদ্ভব হয়, যা মার্কসবাদকে স্বীকার করে নিয়ে এর মধ্যে বিকৃতি ঘটিয়ে সংশোধন করার চেষ্টা করে। এককালের বিরাট মার্কসবাদী বের্নস্তাইনের মতবাদ দিয়ে সংশোধনবাদ শুরু হয়। রাশিয়ায় জনগনবন্ধু (নারোদবাদী)রা সরাসরি মার্কসবাদের বিরোধী ছিল। কিন্তু নয়া নারোদবাদীরা মার্কসবাদের ভেতরে থেকে তাকে সংশোধন করে বুর্শোয়াশ্রেণীর কাছে গ্রহণীয় করে তোলার চেষ্টা করে। দর্শনের ক্ষেত্রে সংশোধনবাদীরা নয়া কান্টবাদী অজ্ঞেয়বাদের পিছু পিছু একইভাবে ভাববাদের পুরনো সর্বাধিক পঁচা জিনিসগুলি নতুন নামে আনার চেষ্টা করে। এরা অগ্রণী শ্রেণীর পার্টির ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বানাতে চায়। এভাবে দ্বান্দ্বিকতার জায়গায় সরল বিবর্তন বসাতে চায়। রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে অস্ট্রিয় বুর্শোয়া অর্থনীতিবিদ বম-বার্ভেককে অনুসরণ করে মার্কসের মূল্যতত্ত্ব সংশোধন করতে চায়। বৃহৎ শিল্পের দ্বারা ছোট শিল্পের ধ্বংস এরা স্বীকার করতে চায়না, বিশেষত কৃষিক্ষেত্রেও যে একই পরিবর্তন ঘটছে তা তারা মানতে চায়না। পুঁজিবাদের সংকট ও বিপর্যয়ের তত্ত্বও মানতে চায়না। কয়েক বছর শিল্পের তেজীভাব দেখেই তারা মার্কসবাদকে সংশোধন করতে চায়। চোখের সামনে আমেরিকা ও ইউরোপের সংকট দেখেও তারা মনে করে কার্টেল ও ট্রাস্ট এ বিপর্যয় হতে দেবেনা। বাস্তবে সিন্ডিকেট, কার্টেল ও ট্রাস্টের দ্বারাই এই সংকট আসে। পুঁজিবাদের নিয়মানুসারেই বিকাশের পর আসে সংকট। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি প্রতিযোগিতা আরো বাড়িয়ে সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলে। রাজনীতির ক্ষেত্রে সংশোধনবাদ শ্রেণীসংগ্রামকে সংশোধন করতে চায়। তারা উদারনীতিক বুর্শোয়াদের মতবাদ গ্রহণ করে বলে যে সার্বজনীন ভোটাধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সংসদীয় গণতন্ত্র ইত্যাদির দ্বারা শ্রেণীসংগ্রাম বাতিল হয়। চোখের সামনে ১৮৭১ সালের প্যারি কমিউন ও ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের উদাহারণ রয়েছে। ১৮৭১ সালে শ্রমিকরা ক্ষমতা দখল করলে বুর্শোয়ারা জাতির শত্রু বিদেশী বুর্শোয়াদের সাথে হাত মিলিয়ে শ্রমিকশ্রেণীকে দমন করার চেষ্টা করে। রাশিয়ায় সুবিধাবাদী সংস্কারবাদীরা সাংবিধানিক গণতন্ত্রী পার্টি (কাদেত)-এর সাথে হাত মিলায়। বুর্শোয়াদের সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে শ্রেণীসংঘাত আরো তীক্ষ্ণ হয়।

লেনিন বলেনঃ ব্যাপক ও বাস্তবিকপক্ষে জাতীয় পরিসরে সংশোধনবাদী রাজনৈতিক কর্মকৌশল প্রয়োগের বৃহত্তম পরীক্ষা হল ফ্রান্সে মিলেরাঁবাদ (ফরাসী সমাজগনতন্ত্রীদের অভ্যন্তরে মিলেরাঁর নেতৃত্বে এক সুবিধাবাদী ধারা); তাতে কার্যক্ষেত্রে সংশোধনবাদের যে মূল্যায়ন পাওয়া গেছে সেটা সারা পৃথিবীর সর্বহারা কখনো ভুলবেনা। সংশোধনবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধারার একটা স্বাভাবিক পরিপূরক হল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যের প্রতি তার মনোভাব। ‘আন্দোলনটাই সব, চূড়ান্ত লক্ষ্য কিছুই নয়’—বের্নস্তাইনের এই বাঁধাবুলিতে অনেক দীর্ঘ প্রবন্ধের চেয়েও ভালভাবেই সংশোধনবাদের মর্ম প্রকাশিত হয়েছে। উপলক্ষ্যে উপলক্ষ্যে নিজের আচরণ বদলানো, দৈনন্দিন ঘটনাবলীর সঙ্গে এবং সংকীর্ণ রাজনীতির ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো, সর্বহারাশ্রেণীর মূল স্বার্থগুলি আর সমগ্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তথা সমস্ত পুঁজিবাদী বিবর্তনের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি ভুলে যাওয়া, ক্ষণিকের বাস্তব কিংবা কল্পিত সুবিধার খাতিরে এইসব মূল স্বার্থ বলি দেয়া—এই হল সংশোধনবাদের কর্মনীতি।

লেনিন আরো বলেনঃ আধুনিক সমাজের শ্রেণীগত শিকড় থেকেই সংশোধনবাদের অবশ্যম্ভাবিতা নির্ধারিত হয়। সংশোধনবাদ একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপার। জার্মানিতে গোঁড়া আর বের্নস্তাইনপন্থীদের মধ্যে, ফ্রান্সে গেদপন্থী আর জোরেসপন্থীদের  (আর এখন বিশেষভাবে ব্রুসপন্থীদের) মধ্যে, ইংল্যান্ডের সমাজগণতন্ত্রী ফেডারেশন আর স্বাধীন শ্রমিক পার্টির মধ্যে, বেলজিয়ামে ব্রুকের আর ভান্দের্ভেলদের মধ্যে, ইতালিতে ইন্টেগ্রালিস্ট আর সংস্কারবাদীদের মধ্যে, রাশিয়ায় বলশেভিক আর মেনশভিকদের মধ্যে সম্পর্কটা ঐসব দেশের বর্তমান অবস্থায় বিভিন্ন জাতীয় পরিস্থিতির আর ঐতিহাসিক উপাদানের বিপুল বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সর্বত্র যে মূলত একইরকমের তাতে যেকোন চিন্তাশক্তিসম্পন্ন ওয়াকিবহাল সমাজতন্ত্রীর লেশমাত্র সন্দেহও থাকতে পারেনা।

অন্যদিকে বাম দিক থেকে সংশোধনবাদ যেমন ইতালিতে ল্যাব্রিওলা ও ফ্রান্সে লাগার্দেলের মত আধা নৈরাজবাদ তখনো মতাদর্শগতভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে ততটা শক্তিশালী হয়নি, সমাজতন্ত্রীদের সাথে বড় কোন লড়াইয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি। তাই বাম সংশোধনবাদ সম্পর্কে এ রচনায় লেনিন তেমন কিছু বলার দরকার মনে করেননি।

লেনিন আরো বলেনঃ পুঁজিবাদী সমাজে সংশোধনবাদের অবশ্যম্ভাবিতা কোথায় নিহিত? বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং পুঁজিবাদী বিকাশের বিভিন্ন মাত্রার মধ্যে পার্থক্যের চেয়েও এটা বেশি গভীর কেন? তার কারণ, প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশে সর্বহারার পাশাপাশি সর্বদাই থাকে ছোট বুর্শোয়া, ছোট মালিকদের একটা বিস্তৃত স্তর। ছোট উৎপাদন থেকেই পুঁজিবাদের উদ্ভব হয়েছিল এবং নিরন্তর হচ্ছে। পুঁজিবাদ বারবার অনিবার্যভাবেই ছোট ছোট কারখানার মত নতুন কতগুলি ‘মধ্যবর্তী স্তরের’ উদ্ভব ঘটায়।                           

নতুন নতুন এই ছোট উৎপাদকেরা আবার সমান অনিবার্যভাবেই সর্বহারার সারিতে গিয়ে পড়ে। ব্যাপক শ্রমিক পার্টিসমূহের সদস্যদের মধ্যে ছোট বুর্শোয়া বিশ্বদৃষ্টি যে বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, এটা খুবই স্বাভাবিক। সর্বহারা বিপ্লব সঙ্ঘটিত হওয়া পর্যন্ত এটা হবার কথা এবং সর্বদাই হবেও, খুবই স্বাভাবিক এটা। কারণ, তেমন বিপ্লব সাধনের আগে জনসংখ্যার অধিকাংশের ‘সম্পূর্ণ’ সর্বহারাকরণ অত্যাবশ্যক মনে করলে প্রচন্ড ভুল হবে। বর্তমানে কেবল মতাদর্শের জগতে, যেমন মার্কসের উপরে বিভিন্ন তত্ত্বগত সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে, আমরা প্রায়শই যার সম্মুখীন হচ্ছি, শ্রমিক আন্দোলনের বিভিন্ন আংশিক প্রশ্নে সংশোধনবাদীদের সঙ্গে কর্মকৌশলগত পার্থক্য এবং তার ভিত্তিতে ভাঙন হিসেবেই শুধু এখন যা বাস্তবে মাথাচাড়া দিচ্ছে, তা শ্রমিকশ্রেণীকে অনিবার্যভাবেই উত্তীর্ণ হতে হবে, এমন বৃহত্তর পরিসরে মোকাবেলা করতে হবে যার কোন তুলনা চলেনা। সেটা ঘটবে যখন সর্বহারা বিপ্লব সমস্ত বিতর্কিত প্রশ্নকে আরো তীব্র করে তুলবে এবং জনগণের করণীয় নির্ধারণের পক্ষে আশু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির ক্ষেত্রে সমস্ত পার্থক্যকে কেন্দ্রীভূত করে তুলবে, লড়াইয়ের উত্তাপের মধ্যে বন্ধুদের থেকে পৃথক করে তুলবে শত্রুকে আর শত্রুর উপরে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য খারাপ বন্ধুদের বর্জন করবে।…ছোট বুর্শোয়াদের সমস্ত দোদুল্যমানতা আর দুর্বলতা সত্ত্বেও লক্ষ্যসাধনের সম্পূর্ণ জয়ের দিকে সর্বহারাশ্রেণী এগিয়ে চলেছে। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মার্কসবাদের তত্ত্বগত সংগ্রাম সর্বহারাশ্রেণীর সেই বিপুল বিপ্লবী সংগ্রামেরই ভূমিকা মাত্র।।

লেনিনের পর আমরা দেখব স্তালিনকে এক ঝাঁক সংশোধনবাদীকে মোকাবেলা করতে হবেঃ ত্রৎস্কি, বুখারিন, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ প্রমুখ। স্তালিনের পর মাওকে মোকাবেলা করতে হবে ক্রুশ্চেভ, তোগলিয়াত্তি, টিটো, লিউ শাউচি, দেঙ শিয়াওপিং, লিন পিয়াও প্রমুখ সংশোধনবাদকে। মাও সেতুঙের মৃত্যুর পর আমরা দেখেছি আলবেনিয়ার আনোয়ার হোজা, আলিয়াকে সংশোধনবাদে অধঃপতিত হতে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্য সম্পন্ন হওয়ার পরও চিন্তার দিক থেকে সংশোধনবাদীদের উদ্ভব ঘটে, সমাজতান্ত্রিক সমাজে বুর্শোয়া অধিকারের ভাবধারা কাজে লাগিয়ে তারা শ্রেণীসংগ্রাম চালায় এবং ক্ষমতা দখল করে নিতে সক্ষম হয়। কমরেড মাও এজন্য সাংস্কৃতিক বিপ্লব চালানোর কথা বলেছেন। পার্টিতেও দুই লাইনের সংগ্রামের কথা বলেছেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লব এক বিরাট দুই লাইনের সংগ্রাম। এতে ব্যাপক জনগণ অংশগ্রহণ করে। সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করা ছাড়া দুনিয়াব্যাপী সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের পূর্ণ বিজয়লাভ সম্ভব নয়।।

কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ

বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী

৩০শে মার্চ, ২০২৪

  • মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদ

একটা সুপরিচিত প্রবাদ আছে যে, জ্যামিতির স্বতসিদ্ধগুলি লোকের স্বার্থ ক্ষুন্ন করলে সেগুলিকেও খন্ডন করা হত নিশ্চয়ই। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের যেসব তত্ত্ব ধর্মশাস্ত্রের বিভিন্ন প্রাচীন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গিয়েছিল সেগুলির চূড়ান্ত মাত্রায় বিরোধিতা জাগিয়েছিল এবং এখনো জাগায়। কাজেই, মার্কসের যে মতবাদ আধুনিক সমাজের অগ্রণী শ্রেণীকে শিক্ষিত ও সংগঠিত করতে সরাসরি নিযুক্ত, সে শ্রেণীর কর্তব্য নির্দেশ করে এবং অর্থনৈতিক বিকাশের ফলে বর্তমান ব্যবস্থার জায়গায় নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অবশ্যম্ভবিতা প্রতিপন্ন করে তাকে যে জীবনপথের পদে পদে লড়তে হয়েছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।

সম্পত্তি মালিক শ্রেণীগুলির উদীয়মান বংশধরদের বোকা বানাতে আর আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের ‘প্রশিক্ষণ’ দেবার জন্য সরকারীভাবে সরকারী অধ্যাপকদের দ্বারা শেখানো বুর্শোয়া বিজ্ঞান আর দর্শনের কথা বলাই বাহুল্য। মার্কসবাদকে খণ্ডন ও খতম করা হয়ে গেছে, এই কথা বলে দিয়ে এ বিজ্ঞান মার্কসবাদের নাম শুনতেও নারাজ। যে নবীন পন্ডিতরা সমাজতন্ত্র খণ্ডন করে নিজেদের পদ-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন এবং যে অথর্ব প্রবীনরা সর্বপ্রকারের সেকেলে ‘তন্ত্রের’ ঐতিহ্য সংরক্ষন করছেন, তারা উভয়েই সমান উৎসাহ নিয়ে মার্কসের উপর আক্রমণ চালান। মার্কসবাদের প্রগতির ফলে, শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে তার চিন্তার প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ফলে অনিবার্যভাবেই মার্কসবাদের বিরুদ্ধে এইসব বুর্শোয়া আক্রমণ আসছে আরো ঘনঘন ও প্রবলভাবে; আর মার্কসবাদ যতই সরকারী বিজ্ঞানের দ্বারা ‘খতম’ হচ্ছে ততই তা আরো শক্তিশালী, আরো পোক্ত এবং আরো প্রাণশক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠছে।

কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং প্রধানত সর্বহারাশ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত মতবাদগুলির মধ্যেও মার্কসবাদ মোটেই তৎক্ষণাৎ নিজ প্রতিষ্ঠা সংহত করেনি। অস্তিত্বের প্রথম অর্ধশতকে উনিশ শতকের চল্লিশ দশক থেকে মার্কসবাদ তার প্রতি মূলগতভাবে শত্রুভাবাপন্ন তত্ত্বগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়োযিত ছিল। চল্লিশ দশকের গোড়ার দিকে মার্কস ও এঙ্গেলস চরমপন্থী ‘নবীন হেগেলবাদী’দের মোকাবিলা করেন যাদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল দার্শনিক ভাববাদ। চল্লিশ দশকের শেষে অর্থনৈতিক মতবাদের ক্ষেত্রে প্রুধোঁপন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরম্ভ হয়। ১৮৪৮ সালের ঝড়ো বছরে যেসব পার্টি আর মতবাদ আত্মপ্রকাশ করেছিল সেগুলির সমালোচনার ভিতর দিয়ে পঞ্চাশ দশকে এ সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে। ষাট দশকে সংগ্রাম সাধারণ তত্ত্বের ক্ষেত্র থেকে সরে আসে প্রত্যক্ষ শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ একটা ক্ষেত্রেঃ আন্তর্জাতিক থেকে বাকুনিনবাদের বিতাড়ন। সত্তুর দশকের গোড়ার দিকে অল্পকিছু কালের জন্যে জার্মানির মঞ্চ অধিকার করে প্রুধোঁবাদী ম্যুলবের্গার এবং এই দশকের শেষদিকে দৃষ্টবাদী দ্যুরিং। তবে ইতিমধ্যেই সর্বহারাশ্রেণীর উপর উভয়ের প্রভাব হয়ে পড়ল নিতান্তই সামান্য। মার্কসবাদ তখনই শ্রমিক আন্দোলনের অন্য সমস্ত মতাদর্শের উপর প্রশ্নাতীত জয় অর্জন করেছে।

৯০ দশক নাগাদ এই জয় মোটের উপর সমাপ্ত হয়ে যায়। লাতিন দেশগুলিতে, যেখানে প্রুধোঁবাদের ঐতিহ্য সর্বাধিক দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল—এমনকি সেখানেও শ্রমিক পার্টিগুলি তাদের কর্মসূচি এবং রণকৌশল কার্যত রচনা করল মার্কসবাদী ভিত্তির উপরই। কিছুকাল অন্তর অন্তর অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কংগ্রেস রূপে শ্রমিক আন্দোলনের পুনরুজ্জীবিত আন্তর্জাতিক সংগঠন গোড়া থেকেই এবং প্রায় বিনা সংগ্রামেই মূলত মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মার্কসবাদ তার বিরোধী কমবেশি সুসম্পূর্ণ সবকটি তত্ত্বকে বিতাড়িত করার পর ঐসব তত্ত্বের মধ্যে অভিব্যক্ত ধারাগুলি আত্মপ্রকাশের অন্য পথ খুঁজতে লাগল। সংগ্রামের রূপ ও উদ্দেশ্য বদলে গেল, কিন্তু সংগ্রাম চলতেই থাকল। আর মার্কসবাদের অস্তিত্বের দ্বিতীয় অর্ধশতাব্দী শুরু হল ১৮৯০ দশকে মার্কসবাদের ভিতরেই, মার্কসবাদবিরোধী একটি ধারার সঙ্গে সংগ্রাম দিয়ে।

এককালের গোঁড়া মার্কসবাদী বের্নস্তাইনের নামে এই ধারার নামকরণ হল, কারণ তিনিই এগিয়ে এসেছিলেন সব থেকে সোরগোল তুলে এবং মার্কসকে সংশোধনের, মার্কসকে পুনর্বিচারের, সংশোধনবাদের সব থেকে সুসম্পূর্ণ প্রকাশ নিয়ে। এমনকি রাশিয়াতে, যেখানে দেশের অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতার ফলে এবং ভূমিদাসপ্রথার বিভিন্ন অবশেষগুলির চাপে পিষ্ট কৃষক সংখ্যাধিক্যের দরুণ অমার্কসবাদী সমাজতন্ত্র স্বভাবতই সবচেয়ে দীর্ঘকাল যাবত টিকে আছে, এমনকি সেখানেও আমাদের চোখের সামনে ঐ অমার্কসবাদী সমাজতন্ত্র স্পষ্টতই সোজা সংশোধনবাদে পরিণত হচ্ছে। জমিবিষয়ক প্রশ্নে (সমস্ত জমির পৌরকরণ) এবং কর্মসূচি আর রণকৌশলের সাধারণ প্রশ্নাবলীতে আমাদের সামাজিক-জনগণবন্ধু (নারোদবাদীরা)দের যে প্রাচীন তন্ত্রটা ছিল তার নিজের দিক থেকে অখন্ড ও মার্কসবাদের আমূল বিরোধী, তার মুমূর্ষু আর অচল অবশেষগুলির জায়গায় ক্রমাগত অধিকতর সংখ্যায় স্থান নিচ্ছে মার্কসের উপর বিভিন্ন ‘সংশোধনী’।

প্রাকমার্কসীয় সমাজতন্ত্র পরাজিত হয়েছে। সে সমাজতন্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার নিজের স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে নয়, বরং মার্কসবাদের সাধারণ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে, সংশোধনবাদ হিসেবেই। এবার তাহলে সংশোধনবাদের মতাদর্শগত সারবস্তুটা পরীক্ষা করে দেখা যাক।

দর্শনের ক্ষেত্রে সংশোধনবাদ বুর্শোয়া অধ্যাপকীয় ‘বিজ্ঞানের’ পিছু পিছু চলে। অধ্যাপকগণ ‘কান্টে ফিরে’ গিয়েছিলেন আর সংশোধনবাদ চলল নয়া কান্টবাদীদের পিছনে পা টেনে টেনে (টীকাঃ উনিশ শতকের শেষার্ধে জার্মানিতে আবির্ভূত বুর্শোয়া দর্শনের একটি ধারা যা ছিল কান্টের দর্শনের অধিক প্রতিক্রিয়াশীল ভাববাদী ধারণাগুলির পুনরুজ্জীবন আর ‘কান্টে ফিরে চল’ শ্লোগানের তলে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিরোধী)। দার্শনিক বস্তুবাদের বিরুদ্ধে যাজকেরা হাজারবার যেসব বস্তাপচা বুলি উচ্চারণ করেছিলেন, সেগুলিরই পুনরাবৃত্তি করলেন ঐ অধ্যাপকেরা আর সংশোধনবাদীরাও প্রশ্রয়ের হাসি হেসে সর্বশেষ নির্দেশিকা পুস্তিকার অক্ষরে অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, বস্তুবাদ তো ‘খণ্ডিত’ হয়ে গেছে অনেক আগেই; পুঁজি বইয়ের দ্বিতীয় জার্মান সংস্করণের পাদটীকায় মার্কস এ কথা বলেন যে অধ্যাপকগণ হেগেলকে একটা ‘মরা কুকুরের’  মত উপেক্ষা করতেন আর নিজেরা প্রচার করতেন ভাববাদ, যদিও সেটা হেগেলের ভাববাদের চেয়ে হাজারগুণ বেশি তুচ্ছ আর বাজে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে অবজ্ঞা প্রকাশ করে দ্বান্দ্বিকতার প্রতি ‘শৈল্পিক’ ও বৈপ্লবিক দ্বান্দ্বিকতার স্থানে ‘সরল’ আর প্রশান্ত বিবর্তন বসিয়ে সংশোধনবাদীরা ঐ অধ্যাপকদের পিছন পিছন গিয়ে পড়লেন বিজ্ঞানের দার্শনিক অতিসরলীকরণের পাঁকে। প্রভাবশালী মধ্যযুগীয় ‘দর্শন’-এর অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে নিজেদের ভাববাদী আর ‘সমালোচনামূলক’ উভয় পদ্ধতিকে খাপ খাইয়ে ঐ অধ্যাপকরা তাদের সরকারী বেতন উপার্জন করতেন—আর আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নয়, অগ্রণী শ্রেণীর পার্টির ক্ষেত্রে ধর্মকে ‘ব্যক্তিগত ব্যাপার’ করবার চেষ্টা করে সংশোধনবাদীরা পৌঁছলেন ঐ অধ্যাপকদের কাছাকাছি।

মার্কসের উপর ঐ ধরণের বিভিন্ন ‘সংশোধনীর’ শ্রেণীগত অর্থ কী তা বিবৃত করার দরকার নেই, সেটা স্বতপ্রতীয়মান। কেবল উল্লেখ করে রাখি যে, আন্তর্জাতিক সমাজ-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে একমাত্র যে মার্কসবাদী সঙ্গতিপূর্ণ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সংশোধনবাদীদের অবিশ্বাস্য বস্তাপচা বুলিগুলির সমালোচনা করেন তিনি হলেন প্লেখানভ। সেটা আরো বেশি গুরুত্বসহকারে জোর দিয়ে বলা চাই, তার কারণ প্লেখানভের রণকৌশলগত সুবিধাবাদের সমালোচনার ছদ্মবেশে পুরোনো, প্রতিক্রিয়াশীল দার্শনিক আবর্জনার চোরাই আমদানির অতি ভ্রান্ত চেষ্টা চলছে বর্তমানে (লেনিনের টীকাঃ বগদানভ, বাজারভ প্রভৃতির ‘মার্কসবাদের দর্শন সম্পর্কে পর্যালোচনা’ দ্রষ্টব্য। ঐ বই নিয়ে আলোচনার স্থান এটা নয়। বর্তমানে আমাকে শুধু একথা বলে শেষ করতে হচ্ছে যে, খুবই নিকট ভবিষ্যতে আমি ধারাবাহিক প্রবন্ধাবলীতে বা একটা পৃথক পুস্তিকায় প্রমাণ করব যে, আমার লেখায় নয়া কান্টবাদী সংশোধনবাদীদের সম্পর্কে আমি যাকিছু বলেছি তার সবটাই মূলত ‘নতুন’ এই নয়া হিউমবাদী এবং নয়া বার্কলিবাদী সংশোধনবাদীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য)।

রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এসে সর্বপ্রথম উল্লেখ করা দরকার যে, এই ক্ষেত্রে সংশোধনবাদীদের ‘সংশোধনগুলি’ অনেক বেশি পূর্ণাঙ্গ ও নির্দিষ্ট; ‘অর্থনৈতিক বিকাশের বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য’ দিয়ে জনসাধারণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, বৃহৎ উৎপাদনের কেন্দ্রীভবন এবং তা দিয়ে ছোট উৎপাদনের উচ্ছেদসাধন কৃষিক্ষেত্রে আদৌ ঘটেনা আর বানিজ্য এবং শিল্পে সেটা চলে অত্যন্ত ধীর গতিতে। বলা হল যে, সংকট এখন আরো বিরল ও ক্ষীণ হয়ে পড়েছে, কার্টেল আর ট্রাস্টগুলি থাকায় সম্ভবত পুঁজি সম্পূর্ণরূপেই সংকট বিলুপ্ত করতে সমর্থ হবে। বলা হল যে, শ্রেণীবিরোধগুলি তুলনামূলক হালকা আর কম তীব্র হবার প্রবণতার ফলে পুঁজিবাদ যেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেই ‘বিপর্যয়ের তত্ত্ব’টা যথার্থ নয়। সবশেষে এও বলা হল যে অস্ট্রিয়ান বুর্শোয়া অর্থনীতিবিদ বম-বাভের্ক অনুসারে মার্কসের মূল্যতত্ত্বটিকেও সংশোধন করা অসমীচীন হবেনা।

এসব প্রশ্নে সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ফলে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে তত্ত্বগত চিন্তার যে পুনরুজ্জীবন ঘটল তা কুড়ি বছর আগে দ্যুরিঙের সঙ্গে এঙ্গেলসের বিতর্কের ফলে যেমনটি হয়েছিল তেমনিই ফলপ্রসূ হল। বিভিন্ন তথ্য আর চিত্রের সাহায্যে সংশোধনবাদীদের যুক্তিগুলিকে বিশ্লেষণ করা হল। প্রমাণ করা হল যে, সংশোধনবাদীরা ধারাবাহিকভাবে আধুনিক ছোট উৎপাদনকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তুলে ধরছেন। কেবল শিল্পক্ষেত্রেই শুধু নয়, কৃষিক্ষেত্রেও ছোট আকারের উৎপাদনের উপর বৃহদাকার উৎপাদনের প্রযুক্তিগত আর ব্যবসায়িক শ্রেষ্ঠত্ব বিভিন্ন অখণ্ডনীয় তথ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়। তবে, কৃষিক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদন অনেক কম উন্নত, আর কৃষিক্ষেত্রের যে বিশেষ শাখাগুলি এবং কখনো কখনো এমনকি কর্মপ্রক্রিয়াগুলি থেকে বোঝা যায় যে, কৃষি ক্রমাগত অধিকতর মাত্রায় বিশ্ব অর্থনীতির বিনিময় প্রক্রিয়ার মধ্যে গিয়ে পড়ছে, সেগুলিকে বেছে বের করতে আধুনিক পরিসংখ্যানবিদ আর অর্থনীতিবিদেরা সাধারণত তেমন পটু নয়। খাদ্যের মানের নিরন্তর অবনতি, দীর্ঘস্থায়ী অনাহার, দৈনিক কাজের সময় বৃদ্ধি, গবাদি পশুর মান ও যত্ন-পরিচর্যার অবনতির দ্বারা, এক কথায়, ঠিক যে পদ্ধতিগুলি দিয়ে হস্তশিল্প উৎপাদন পুঁজিবাদী উৎপাদনের বিরুদ্ধে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছিল, ঠিক সেগুলির দ্বারাই ছোট উৎপাদন স্বাভাবিক উৎপাদনের ধ্বংসস্তুপের উপর নিজেকে টিকিয়ে রাখে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতিটি অগ্রগতি অনিবার্যভাবে এবং অব্যাহতভাবে পুঁজিবাদী সমাজে ছোট আকারের উৎপাদনের ভিত্তিকে বিপর্যস্ত করে। সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক অর্থনীতির কর্তব্য হল এই প্রক্রিয়াটির প্রায়শই দুর্বোধ্য ও জটিল সমস্ত রূপ সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে ছোট উৎপাদকদের কাছে এটা দেখানো যে, পুঁজিবাদের অধীনের তাদের অবস্থান বজায় রাখা অসম্ভব, পুঁজিবাদের অধীনে কৃষকের খামারের চেষ্টা বৃথা আর কৃষকের পক্ষে সর্বহারার দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করাই প্রয়োজন। এই প্রশ্নে একতরফাভাবে এবং গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে নির্বাচিত তথ্যের ভিত্তিতে ভাসাভাসাভাবে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে সংশোধনবাদীরা পাপ করেছেন বলা যায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের পাপ হয়েছে এই যে, কৃষককে বিপ্লবী সর্বহারাশ্রেণীর দৃষ্টিকোণ গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত না করে তারা অনিবার্যভাবেই মালিকের মনোভাব অর্থাৎ বুর্শোয়াদের মনোভাব অবলম্বন করতেই বলছেন, কিংবা চান বা না চান, তাদের সেদিকে ঠেলে দিয়েছেন।

সংকটের তত্ত্ব এবং বিপর্যয়ের তত্ত্বের ব্যাপারে সংশোধনবাদীদের অবস্থানটা আরো খারাপ। কয়েকটা বছরের জন্য শিল্পক্ষেত্রে তেজীভাব আর সমৃদ্ধির প্রভাবে পড়ে লোকে, তাও কেবল অতি অদূরদর্শীরাই, মাত্র স্বল্পকালের জন্যেই মার্কসবাদী তত্ত্বের ভিত্তিগুলিকে পুনর্গঠিত করার কথা ভাবতে পেরেছিল। বাস্তবতা অচিরেই সংশোধনবাদীদের কাছে স্পষ্ট করে দিল যে, সংকট অতীতের বস্তু নয়ঃ সমৃদ্ধির পরে আসে সংকট। নির্দিষ্ট কোন কোন সংকটের রূপ, ধারা এবং চিত্র বদলেছে, কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে সংকট থেকেই গেছে। কার্টেল এবং ট্রাস্টগুলি উৎপাদন একত্রিত করার সঙ্গে সঙ্গে সবার কাছে সুস্পষ্ট রূপেই উৎপাদনের অরাজকতা, সর্বহারাশ্রেণীর অস্তিত্বের নিরাপত্তাহীনতা এবং পুঁজিবাদী নিপীড়ন তীব্রতর করেছে এবং তার ফলে শ্রেণীবিরোধগুলিকে অভূতপূর্ব মাত্রায় তীব্রতর করে তুলেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক সংকট এবং সমগ্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পতন, এই উভয় অর্থেই পুঁজিবাদ যে ধ্বংসের দিকে চলেছে, সেটা নতুন অতিকায় ট্রাস্টগুলিকে দিয়েই বিশেষভাবে এবং বিশেষ ব্যাপক আকারেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। আমেরিকায় সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট এবং ইউরোপের সর্বত্র বেকারির ভয়াবহ বৃদ্ধি—বহু লক্ষণ থেকে শিল্পক্ষেত্রে আসন্ন সংকটের যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তার কথা তো বলাই বাহুল্য, এ সবের ফলে সবাই, তার মধ্যে স্পষ্টতই সংশোধনবাদীদেরও অনেকে, সংশোধনবাদীদের হালের ‘তত্ত্বগুলি’র কথা ভুলে গেছে। তবে, বুদ্ধিজীবীদের এই অস্থিরতা শ্রমিকশ্রেণীকে যেসব শিক্ষা দিল সেগুলি কিছুতেই ভোলা চলবেনা।

মূল্যের তত্ত্ব সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলা দরকার যে, বম-বার্ভেকের ছাঁচে অতি অস্পষ্ট কিছু কিছু আভাস আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া একেবারে আর কোন অবদানই সংশোধনবাদীদের নেই, কাজেই কোন চিহ্নই তার রেখে যায়নি বৈজ্ঞানিক চিন্তা বিকাশের ক্ষেত্রে।

রাজনীতির ক্ষেত্রে সংশোধনবাদ বাস্তবিকই মার্কসবাদের ভিত্তিকে, শ্রেণীসংগ্রামের মতবাদকে পুনর্বিচারের চেষ্টা করেছিল। আমাদের শোনানো হত যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর সার্বজনীন ভোটাধিকার শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিকে অপসারিত করে দেয় এবং মিথ্যা প্রতিপন্ন করে সাম্যবাদী ইশতেহার-এর এই পুরনো বক্তব্যকে যে শ্রমজীবী মানুষের কোন দেশ নেই। কারণ তারা বলতেন, যেহেতু গণতন্ত্রে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা’ প্রাধান্য পায়, তাই রাষ্ট্রকে শ্রেণীগত শাসনের যন্ত্র মনে করাও যায়না, প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সমাজ-সংস্কারবাদী বুর্শোয়াদের সঙ্গে মৈত্রীও প্রত্যাখ্যান করা চলেনা।

এটা তর্কাতীত যে, সংশোধনবাদীদের এই যুক্তিগুলি মিলে একটি সুসঙ্গত মতবাদ দাঁড়াচ্ছেঃ সেটা হল পুরনো এবং সুপরিচিত উদারপন্থী বুর্শোয়া মতামত। উদারপন্থীরা বরাবর বলেছেন যে, বুর্শোয়া সংসদীয় প্রথা শ্রেণীগুলিকে এবং শ্রেণী বিভাগগুলিকে ধ্বংস করে দেয়, কেননা নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের ভোটের অধিকার এবং দেশের সরকারে যোগদানের অধিকার আছে। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপের গোটা ইতিহাস এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে রুশ বিপ্লবের গোটা ইতিহাস স্পষ্টভাবেই দেখায় যে, এই রকমের মতামত কত উদ্ভট। ‘গণতান্ত্রিক’ পুঁজিবাদের স্বাধীনতার আমলে অর্থনৈতিক পার্থক্যগুলির উপশম না হয়ে সেগুলির গভীরতা আর তীব্রতা বরং বাড়ে। শ্রেণীগত নিপীড়নের যন্ত্র হিসেবে সর্বাধিক গণতান্ত্রিক বুর্শোয়া প্রজাতন্ত্রগুলিরও চরিত্রের সারবস্তুকে সংসদীয় প্রথা বিলুপ্ত না করে নগ্ন করে দেয়। জনসংখ্যার যে অংশ আগে রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছে তাদের তুলনায় অপরিমেয়ভাবে ব্যাপকতর অংশকে শিক্ষিত এবং সংগঠিত করতে সাহায্য করে সংসদীয় প্রথা বিভিন্ন সংকট এবং রাজনৈতিক বিপ্লবকে বিলুপ্ত করবার দিকে যায়না, বরং এই রকমের বিপ্লবের সময় গৃহযুদ্ধকে চরম মাত্রায় তীব্র করে তোলার দিকেই যায়। কীরকম অনিবার্যভাবেই এই তীব্রতাবৃদ্ধি ঘটে, তা যতদূর সম্ভব স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে ১৮৭১ সালের বসন্তকালে প্যারিসের এবং ১৯০৫ সালের শীতকালে রাশিয়ার ঘটনাবলী। সর্বহারাশ্রেণীর আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে ফরাসী বুর্শোয়ারা এক মুহুর্তও ইতস্তত না করেই সমগ্র জাতির শত্রুর সঙ্গে আপোষ করে, যে বৈদেশিক বাহিনী দেশের সর্বনাশ করেছিল তার সঙ্গে আপোষ করেছিল। সংসদীয় প্রথা আর বুর্শোয়া গণতন্ত্রের যে অনিবার্য আভ্যন্তরীণ দ্বান্দ্বিকতার ফলে ব্যাপকতর সহিংসতার দ্বারা বিতর্কের মীমাংসা ঘটে আগের চেয়ে তীক্ষ্ণতরভাবে যিনি সেটা বোঝেননা, তিনি সেই সংসদীয় প্রথার ভিত্তিতে কখনো এমন নীতিগত প্রচার ও আন্দোলন চালাতে পারবেননা, যাতে সেই ‘বিতর্কে’ বিজয়ী অংশগ্রহণের জন্যে শ্রমিকশ্রেণীর ব্যাপক অংশ সত্যই প্রস্তুত হয়। পশ্চিমে সমাজতন্ত্রী-সংস্কারবাদী উদারপন্থীদের সঙ্গে এবং রুশ বিপ্লবে উদারপন্থী সংস্কারবাদী (সাংবিধানিক গণতন্ত্রী, সংক্ষেপে কাদেত)-দের সঙ্গে বিভিন্ন মৈত্রী চুক্তি আর জোটবন্ধনের অভিজ্ঞতা প্রত্যয়জনকভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে যে, যাদের লড়াই করবার ক্ষমতা সামান্য, যারা সবচেয়ে বেশি দোদুল্যমান আর বিশ্বাসঘাতক তাদের সঙ্গে সংগ্রামীদের সংযুক্ত করে এসব চুক্তি জনগণের চেতনাকে কেবল ভোঁতাই করে দেয়, জনগণের সংগ্রামের প্রকৃত তাৎপর্য না বাড়িয়ে বরং কমিয়েই দেয়। ব্যাপক ও বাস্তবিকপক্ষে জাতীয় পরিসরে সংশোধনবাদী রাজনৈতিক কর্মকৌশল প্রয়োগের বৃহত্তম পরীক্ষা হল ফ্রান্সে মিলেরাঁবাদ (ফরাসী সমাজগনতন্ত্রীদের অভ্যন্তরে মিলেরাঁর নেতৃত্বে এক সুবিধাবাদী ধারা); তাতে কার্যক্ষেত্রে সংশোধনবাদের যে মূল্যায়ন পাওয়া গেছে সেটা সারা পৃথিবীর সর্বহারা কখনো ভুলবেনা।

সংশোধনবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধারার একটা স্বাভাবিক পরিপূরক হল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যের প্রতি তার মনোভাব। ‘আন্দোলনটাই সব, চূড়ান্ত লক্ষ্য কিছুই নয়’—বের্নস্তাইনের এই বাঁধাবুলিতে অনেক দীর্ঘ প্রবন্ধের চেয়েও ভালভাবেই সংশোধনবাদের মর্ম প্রকাশিত হয়েছে। উপলক্ষ্যে উপলক্ষ্যে নিজের আচরণ বদলানো, দৈনন্দিন ঘটনাবলীর সঙ্গে এবং সংকীর্ণ রাজনীতির ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো, সর্বহারাশ্রেণীর মূল স্বার্থগুলি আর সমগ্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তথা সমস্ত পুঁজিবাদী বিবর্তনের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি ভুলে যাওয়া, ক্ষণিকের বাস্তব কিংবা কল্পিত সুবিধার খাতিরে এইসব মূল স্বার্থ বলি দেয়া—এই হল সংশোধনবাদের কর্মনীতি। এই নীতির চরিত্র থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে এটি অসংখ্য রূপধারণ করতে পারে এবং কমবেশি ‘নতুন’ কোন প্রশ্ন উঠলে, ঘটনার গতি কমবেশি অপ্রত্যাশিত ও অদৃষ্টপূর্ব খাতে ঘুরলে, আর তাতে বিকাশের মূল ধারা শুধু সামান্য মাত্রায় ও স্বল্পতম সময়ের জন্য বদলালেও, তার থেকে কোন না কোন রকমের সংশোধনবাদের উদ্ভব অবশ্যম্ভাবী।

আধুনিক সমাজের শ্রেণীগত শিকড় থেকেই সংশোধনবাদের অবশ্যম্ভাবিতা নির্ধারিত হয়। সংশোধনবাদ একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপার। জার্মানিতে গোঁড়া আর বের্নস্তাইনপন্থীদের মধ্যে, ফ্রান্সে গেদপন্থী আর জোরেসপন্থীদের (ফ্রান্সে জোরেস মিলেরাঁর সাথে মিলে ফরাসী সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের ডানপন্থী সংস্কারবাদী অংশের নেতৃত্ব দেন) (আর এখন বিশেষভাবে ব্রুসপন্থীদের) মধ্যে, ইংল্যান্ডের সমাজগণতন্ত্রী ফেডারেশন আর স্বাধীন শ্রমিক পার্টির (শ্রমিকশ্রেণীর স্বাধীন কর্মকান্ডের কথা দিয়ে শুরু করে বুর্শোয়ার অধীন এক সুবিধাবাদী পার্টি) মধ্যে, বেলজিয়ামে ব্রুকের আর ভান্দের্ভেলদের মধ্যে, ইতালিতে ইন্টেগ্রালিস্ট (ইন্টেগ্রলিস্টরা সমাজতন্ত্রী ধারার মধ্যে একটি ছোট বুর্শোয়া ধারা হলেও সুবিধাবাদী-সংস্কারবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালায়) আর সংস্কারবাদীদের মধ্যে, রাশিয়ায় বলশেভিক আর মেনশভিকদের (বলশেভিকরা বিপ্লবী আর মেনশেভিকরা সুবিধাবাদী) মধ্যে সম্পর্কটা ঐসব দেশের বর্তমান অবস্থায় বিভিন্ন জাতীয় পরিস্থিতির আর ঐতিহাসিক উপাদানের বিপুল বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সর্বত্র যে মূলত একইরকমের তাতে যেকোন চিন্তাশক্তিসম্পন্ন ওয়াকিবহাল সমাজতন্ত্রীর লেশমাত্র সন্দেহও থাকতে পারেনা। বর্তমান আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ ‘বিভাগটা’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সারবস্তুতে একই ধারাতে চলছে, কিন্তু ত্রিশ বা চল্লিশ বছর আগে একই আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের ভিতরে বিভিন্ন দেশে বিচিত্র ধারার যে লড়াই চলত তার তুলনায় এটি প্রচন্ড অগ্রগতিরই সাক্ষ্য দেয়। তেমনি, লাতিন দেশগুলিতে যে ‘বাম দিক থেকে সংশোধনবাদ’ ‘বৈপ্লবিক সিন্ডিক্যালিজম’ (ছোটবুর্শোয়া আধানৈরাজ্যবাদী ধারা) রূপে গড়ে উঠেছে, তাও মার্কসবাদের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াচ্ছে তাকে ‘সংশোধন’ করে। ইতালিতে লাব্রিওলা ও ফ্রান্সে লাগার্দেল ভুলভাবে বোঝা মার্কসের থেকে ঘনঘন আর্জি জানাচ্ছেন সঠিকভাবে বোঝা মার্কসের কাছে।

এই সংশোধনবাদ এখনো পর্যন্ত সুবিধাবাদী সংশোধনবাদের মত বেড়ে উঠেনি, তার মতাদর্শগত সারবস্তুর আলোচনায় এখানে সময় নষ্ট করা চলেনা, এ সংশোধনবাদ এখনো আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেনি, এখনো কোন দেশে সমাজতান্ত্রিক পার্টির সঙ্গে বাস্তব কোন বড় রকমের লড়াইয়ের পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়নি। কাজেই উপরে বিবৃত সেই ‘ডানপন্থী সংশোধনবাদ’-এর আলোচনায় আমরা সীমাবদ্ধ রাখছি নিজেদের।

পুঁজিবাদী সমাজে সংশোধনবাদের অবশ্যম্ভাবিতা কোথায় নিহিত? বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং পুঁজিবাদী বিকাশের বিভিন্ন মাত্রার মধ্যে পার্থক্যের চেয়েও এটা বেশি গভীর কেন? তার কারণ, প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশে সর্বহারার পাশাপাশি সর্বদাই থাকে ছোট বুর্শোয়া, ছোট মালিকদের একটা বিস্তৃত স্তর। ছোট উৎপাদন থেকেই পুঁজিবাদের উদ্ভব হয়েছিল এবং নিরন্তর হচ্ছে। পুঁজিবাদ বারবার অনিবার্যভাবেই নতুন কতগুলি ‘মধ্যবর্তী স্তরের’ উদ্ভব ঘটায় (কারখানার বিভিন্ন লেজুড়, গার্হস্থ্য কর্ম, বাইসাইকেল, মোটরগাড়ি ইত্যাদি দেশের সর্বত্র ছড়ানো ছোটছোট কারখানাগুলি যা বৃহদায়তন শিল্পের চাহিদা মেটায়)। নতুন নতুন এই ছোট উৎপাদকেরা আবার সমান অনিবার্যভাবেই সর্বহারার সারিতে গিয়ে পড়ে। ব্যাপক শ্রমিক পার্টিসমূহের সদস্যদের মধ্যে ছোট বুর্শোয়া বিশ্বদৃষ্টি যে বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, এটা খুবই স্বাভাবিক। সর্বহারা বিপ্লব সঙ্ঘটিত হওয়া পর্যন্ত এটা হবার কথা এবং সর্বদাই হবেও, খুবই স্বাভাবিক এটা। কারণ, তেমন বিপ্লব সাধনের আগে জনসংখ্যার অধিকাংশের ‘সম্পূর্ণ’ সর্বহারাকরণ অত্যাবশ্যক মনে করলে প্রচন্ড ভুল হবে। বর্তমানে কেবল মতাদর্শের জগতে, যেমন মার্কসের উপরে বিভিন্ন তত্ত্বগত সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে, আমরা প্রায়শই যার সম্মুখীন হচ্ছি, শ্রমিক আন্দোলনের বিভিন্ন আংশিক প্রশ্নে সংশোধনবাদীদের সঙ্গে কর্মকৌশলগত পার্থক্য এবং তার ভিত্তিতে ভাঙন হিসেবেই শুধু এখন যা বাস্তবে মাথাচাড়া দিচ্ছে, তা শ্রমিকশ্রেণীকে অনিবার্যভাবেই উত্তীর্ণ হতে হবে, এমন বৃহত্তর পরিসরে মোকাবেলা করতে হবে যার কোন তুলনা চলেনা। সেটা ঘটবে যখন সর্বহারা বিপ্লব সমস্ত বিতর্কিত প্রশ্নকে আরো তীব্র করে তুলবে এবং জনগণের করণীয় নির্ধারণের পক্ষে আশু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির ক্ষেত্রে সমস্ত পার্থক্যকে কেন্দ্রীভূত করে তুলবে, লড়াইয়ের উত্তাপের মধ্যে বন্ধুদের থেকে পৃথক করে তুলবে শত্রুকে আর শত্রুর উপরে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য খারাপ বন্ধুদের বর্জন করবে।

ছোট বুর্শোয়াদের সমস্ত দোদুল্যমানতা আর দুর্বলতা সত্ত্বেও লক্ষ্যসাধনের সম্পূর্ণ জয়ের দিকে সর্বহারাশ্রেণী এগিয়ে চলেছে। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মার্কসবাদের তত্ত্বগত সংগ্রাম সর্বহারাশ্রেণীর সেই বিপুল বিপ্লবী সংগ্রামেরই ভূমিকা মাত্র।।