গল্পঃ শামুরবাড়ির প্রতিরোধ

গল্প

লেখকঃ কমরেড নিজামউদ্দিন মতিন

রচনাকালঃ ১৯৭৬-১৯৮৬

পটভূমিঃ ১৯৭৩-৭৪ সময়কালে বিক্রমপুরে সর্বহারা পার্টির ঘাঁটি রক্ষায় রক্ষীবাহিিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা ও জনগণের  প্রতিরোধ যুদ্ধ

উত্সঃ

https://lalshongbad.wordpress.com/

লালসংবাদে প্রকাশঃ ১৭/১০/২০১৯

(লাল সংবাদের ভূমিকাঃ প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড নিজামউদ্দিন মতিন। দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সামরিক শাখার প্রধান নেতৃত্ব ছিলেন। অসংখ্য বিচিত্র সামরিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন বিপ্লবী ছিলেন। আজীবন লড়াকু এই বিপ্লবী ছিল শত্রুর কাছে আতংক। বহু বহু কন্টকাকীর্ন পথে পথ চলেছেন তিনি। দীর্ঘ সময় ছিলেন শত্রু শিবিরে বন্দী । ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিজীবনে লিখেছেন “প্রেরণা”রাজনৈতিক -সাংস্কৃতিক পত্রিকায়। ঐ সময়টিতে তারই লেখা ‘শামুরবাড়ির প্রতিরোধ’ প্রকাশ করছে ‘লাল সংবাদ’)

কমরেড মোহাম্মদ শাহীন ওরফে নিজামুদ্দিন মতিন

কমরেড মোহাম্মদ শাহীন ওরফে নিজামুদ্দিন মতিন

বর্ষাকাল। তবুও আজ মেঘ নেই আকাশে। সূর্যটা ঠিক মাথার উপর আগুনের ভাটার মতো জ্বলছে, আর গনগনে আগুন ছড়াচ্ছে। অসহ্য গরম। তবু বিরাম নেই চলার। হাত আটেক চওড়া চওড়া আঁকা বাঁকা খাল দিয়ে স্রোতের অনুকূলেই এগিয়ে চলছে ডিংগী নৌকাটা। আরোহী মাত্র দু’জন। একজনের বয়স বিশ,নাম তার সানু;অপরজন তালেব,বয়স মাত্র আঠারো। চাকলাদার বাড়িকে পিছনে ফেলে,চঁইগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ধইঞ্চা গাছের সারিকে বাঁ পাশে রেখে,ডান দিকের বড় বড় গাছের ছায়ার নিচ দিয়ে দুটো বাঁক ঘুরে তারা এসে পড়লো বড় খালে। কিছু দূরেই ডহুরী লঞ্চস্টেশন। অলস দৃষ্টিতে স্টেশনের দিকে তাকালো সানু। সাথে সাথেই চমকে উঠলো সে। একটা হিম স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে নীচের দিকে নামছে -মনে হলো তার। দেখতে পেয়েছে তালেবও।

দুজনেই ছানাবড়া চোখে দেখলো -রক্ষী বাহিনী বোঝাই দুটো লঞ্চ ভিড়ে আছে স্টেশনের বিপরীতে,শামুরবাড়ি ঘাটে-ঠিক যেখানে নির্জন দোতলা ঘরটি দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ । কিছু রক্ষী নেমে পড়েছে খালের উঁচু পাড়ে। এবং ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে। আরো নামছে। ওদের লক্ষ্য শামুরবাড়ি ক্যাম্প। এ ক্যাম্পের গেরিলাদের সাথেই গতরাতে গোলাগুলি হয়েছে একটি লঞ্চের। তাই আজ কর্মী,গেরিলা আর পার্টিকে সমর্থনকারী জনগনকে ‘শায়েস্তা করতে’ এসেছে ওরা।

শামুরবাড়ি ক্যাম্প থেকেই সকালে বের হয়েছিল দুজনে,আবার ফিরে আসছিল ক্যাম্পেই। কিন্ত মাঝখানে একি বিপত্তি-ভাবলো সানু। আরো ভাবলো সে,দশ মিনিটেরও কম সময়ে এই রক্ষীরা পৌছে যাবে গ্রামে। গ্রামের অধিকাংশ যুবকই থাকে ঢাকা শহরে। যারা গ্রামে থাকে তাদের অনেককেই এই ভর দুপুরে গ্রামে পাওয়া যাবে না। কেউ গেছে স্কুলে,কেউ ক্ষেতে,কেউবা হাটে -বাজারে। সকালে দেখেছিল ক্যাম্পে গেরিলারা আছে মোটে পাঁচজন। মিলিশিয়াদের কাউকে কাউকে হয়তো গ্রামে পাওয়া যাবে। কিন্তু তারা সকলেই অনভিজ্ঞ। অনভিজ্ঞ কয়েকজন মিলিশিয়া আর পাঁচজন গেরিলা দিয়ে ঠেকানো যাবে না ট্রেনিংপ্রাপ্ত রক্ষীদের বিরাট বাহিনীকে। বিপদটা এড়ানো যাবেনা, বুঝতে পারলো দু’জনেই।

চকিতে জেগে ওঠা পালাবার ইচ্ছাটাকে সজোরে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ক্যাম্পে যাবারই সিদ্ধান্ত নিল তারা।

খাল পাড়ি দিয়ে পশ্চিম পাশে এলো দুজনে। এ পাড়ে উঁচু মাটির বাঁধ। কোথাও কোথাও ভাংগা। এগুলো দিয়ে হুহু করে পানি ঢুকছে চকে। চক বোঝাই আমন ধানের গাছ। ধান গাছগুলো যেন প্রতিযোগিতা করে পানি বাড়ার সাথে সাথে তাল মিলিয়ে মাথা তুলছে আকাশ পানে। বাঁধের একটি ভাংগা দিয়ে ডিংগিটাকে ঠেলে নিয়ে দু’জনে ঢুকলো চকে। তারপর কোনাকুনি দ্রুত চালাতে চেষ্টা করলো নৌকাটা। কিন্ত ধান গাছে আটকে যাচ্ছে নৌকা,কচুরিপানাও যেন শত্রুতা শুরু করেছে আজ। “আরো জোরে”হাঁক দিলো সানু। সমস্ত শক্তিতে বৈঠাটা জাপটে ধরলো তালেব। দু’জনের আপ্রাণ চেষ্টায় নৌকা এসে ভিড়লো গ্রামের পুর্ব পাশে। নৌকা থেকে লাফিয়ে নেমে নানির বৈঠকখানা লক্ষ্য করে ছুটলো সানু। ওখানেই পার্টির স্থানীয় অফিস আর অস্ত্রাগার।

ছুটতে ছুটতে অফিসে এলো সানু। অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল বেলা ও ফাহমিদা। দু’জনকেই প্রশ্ন করলো সে,” গেরিলা-মিলিশিয়ারা কোথায়?” “গেরিলারা ক্যাম্পে। মিলিশিয়াও কয়েকজন আছে গ্রামে” উত্তর দিল বেলা। “কিন্ত রক্ষীরা আসছে শুনে কোথায় যে পালালো, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” ক্ষুব্ধ স্বরে জানালো ফাহমিদা। “ঠিক আছে” আমি দেখছি। “তোমরা অফিসই রক্ষা করো”বলে দ্রুত অফিসে ঢুকে পড়লো সানু। কাঁধে তুলে নিল রুশ নির্মিত ঝকঝকে প্রিয় সাব মেশিনগানটা। গুলি ভর্তি দুটো স্পেয়ার ম্যাগজিন নিতেও ভুলল না সে। এরপর দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে গেল ক্যাম্পকে লক্ষ্য করে।

ক্যাম্পের সামনে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল জীবন, রাজু,পলাশ,হাফিজ ও হিরু। সানুকে আসতে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো সবাই। ঝটপট প্রাথমিক ডিফেন্স পরিকল্পনা তৈরী করে স্ব স্ব পজিশনে চলে গেল সকলে। সানু বের হলো মিলিশিয়াদের খোঁজে। তার সাথে যোগ দিল আলম,লোকমান ও রাজু। পাঁচজন মিলিশিয়াকে খুঁজে বার করতে সক্ষম হলো তারা। ভয়ে কুঁকড়ে গেছে মিলিশিয়ারা। তাদেরকে পজিশন নেওয়ানো হলো- জবরদস্তিমুলকভাবে।

গ্রামের লোকজন কিছুটা সন্তষ্ট হয়ে ছোটাছুটি করছে। প্রশ্ন করছে গেরিলাদেরকে,”জিততে পারবে তো বাবা?” “সাধ্যমতো চেষ্টা করবো” মৃদু হেসে উত্তর দিচ্ছে গেরিলারা। বিজয় কামনায় মসজিদে সিন্নি দেবার মানত করছে অনেকে,কেউবা মানত করছে মিলাদ শরীফের। গেরিলাদের অনুরোধে নারী-পুরুষ সকলেই হাতে তুলে নিল টেটা,বল্লম,লেজা। কেউবা দা,বটি। বাঁশের লাঠিও কারো কারো হাতে দেখা গেল। গুলি বিনিময় শুরু হলে লোকজন আহত হতে পারে ভেবে সকলকে অনুরোধ করলো সানু,”আপনারা শুয়ে পড়ুন মাটির উঁচু ভিটার আড়ালে।”

রক্ষীদের হামলা প্রতিরোধ করার জন্য অপেক্ষা করছে সকলে। কিন্ত ওরা আসছে না। আসতে হয়তো ওদের কিছু দেরি হবে। ওরা চুল্লী তৈরী করছে দোতলা ঘরটির পাশে। রান্নার আসবাবপত্র সাথে নিয়েই এসেছে ওরা,লুটপাট করে বিরাট ভোজ খাবে বলে।”এতো সহজে না,বাচাধনরা”চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করলো সানু। তারপর নিজেদের প্রস্তুতিটা আরেকবার দেখে নেবার জন্য লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলো।

পূর্ব-পশ্চিমে দুই শত গজ লম্বা আর উত্তর-দক্ষিনে ত্রিশ গজ চওড়া গ্রামের চারিদিকে পানি। পানির গভীরতাও অনেক। হাত তিনেক চওড়া ও আড়াই হাত গভীর একটা খাল কোমর বন্ধনীর মতো ঘিরে আছে গ্রামকে। আরেকটি ছোট খাল এক হাঁটু পানি বুকে নিয়ে আড়াআড়ি দ্বিখন্ডিত করেছে গ্রামকে। এ দুটো খালই শত্রুর আক্রমণ বেগকে কিছুটা মন্থর করতে সাহায্য করবে গেরিলাদের। উত্তরে মাইলখানেকের মধ্যে কোন গ্রাম নেই। দূরে -বহু দূরে দেখা যায় দ্বীপের মতো পানির উপর ভাসছে গ্রামগুলো। এ গ্রামগগুলোতে যেতে পারলে নিরাপদ হতে পারতো কর্মী,গেরিলা ও জনগণ। কিন্তু যাবে কি করে? উন্মুক্ত চক দিয়ে নৌকায় পালাবার চেষ্টা করলেই দেখতে পাবে রক্ষীরা। সাথে সাথেই গুলি ছুঁড়বে ওরা। সাঁতার কেটেও পাড়ি দেয়া যাবে না এত বড় চক। এদিক দিয়ে অবশ্য নৌকা ব্যতিরেকে আসতে পারবেনা রক্ষীবাহিনীও। যদি আসে তবে ওদেরকে ঠেকানোর দায়িত্ব পড়েছে পাঁচজনের উপর। মিলিশিয়া তিনজন শুয়ে আছে মরার মতো। প্রয়োজনে তারা গুলি ছুঁড়তে পারবে বলে মনে হয় না। তবে চাংগা আছে বাচ্চা ছেলে দুটো। সর্বদাই উচ্ছাসে ভরপুর ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র মান্নান। রাইফেলটা বাগিয়ে উত্তেজিতভাবে পায়চারি করছে -আসন্ন যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেবার জন্য। একটা বিরাট আম গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছেলে লালু। শ্রমিক পরিবারের সন্তান সে। ছোটছোট হাত দুটো দিয়ে রাইফেলটা সাপটে ধরে সদা সতর্ক প্রহরীর মত তাকিয়ে আছে রক্ষীবাহিনী আসার পথের দিকে। পশ্চিমে মাইল দেড়েক দূরে গাওদিয়া বাজার। ওদিক দিয়েই আসতে পারে থানার ফোর্স,এ সম্ভাবনা বিবেচনা করেই নিয়োগ করা হয়েছে দুজন মিলিশিয়া। দুজনেই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ভয়ে। হাত কাঁপছে তাদের। এস,এল,আর, ও জি-থ্রিটাকেও শক্ত করে ধরে রাখতে পারছে না তারা। উত্তর আর পশ্চিমের ডিফেন্সের সহায়তার জন্য রয়েছে তালেব। মিলিশিয়াদের অবস্থা দেখে হতাশ হয়ে জি-থ্রিটাকে হাতে নিয়ে পায়চারি করছে সে। অফিস ও অস্ত্রাগার রক্ষার দায়িত্ব পড়েছে ফাহমিদা,বেলা,মুন্নি ও আসমার উপর। সকলের হাতেই রাইফেল,কোমরে গুলির বেল্ট। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী তারা,আসন্ন যুদ্ধের উন্মাদনায় উদ্দীপ্ত। তাদের মৃদু হাসি আর মুখের ভাব দেখেই বুঝা যায়, জান দিয়েই লড়বে তারা। পুবে আধা মাইলেরও কম দুরত্বে ডহুরী লঞ্চ স্টেশন। স্টেশন থেকে
একটা মাটির রাস্তা এসে গ্রামের দক্ষিণ পাশ দিয়ে গাওদিয়া হয়ে চলে গিয়েছে লৌহজং থানায়। রাস্তার সাথে গ্রামের সংযোগ রক্ষা করছে একটা কাঠের পুল। এ পুল পেরিয়েই গ্রামে ঢুকতে হবে রক্ষীদের। পুলের পাশের ছোট কোনটার মধ্যে এল,এম,জি,সহ অবস্থান নিয়েছে হাফিজ। সে একজন খাঁটি শ্রমিক -বেজায় ফুর্তিবাজ লোক। আসন্ন যুদ্ধের চিন্তা বিন্দু মাত্র বিচলিত করতে পারেনি তাকে। এ অবস্থায়ও হাসি মুখে নীচু গলায় গান গাইছে সে। সাথে গলা মিলাচ্ছে আলম ও লোকমান। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আলম-তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র পিতৃহারা লোকমান এ বয়সেই কামলা খাটে অন্যর জমিতে। দুজনেই রাইফেল নিয়ে বসে আছে হাফিজের দুপাশে-কাঠের পুলকে রক্ষা করবে বলে। স্টেশন থেকে মাটির রাস্তা ধরেই এগিয়ে আসবে রক্ষীর। তাই রাস্তার সমান্তরাল রেখার তৈরী করা হয়েছে এ্যামবুশ ফাঁদ। এ্যামবুশের দ্বায়িত্বে আছে ছাত্র জীবন ত্যাগ করে আসা জীবন,রাজু,রেডিও মেকানিক পলাশ ও বেকারী শ্রমিক হিরু। সাথে থাকবে সানু নিজে। এ ফাঁদের সফলতার বা ব্যর্থতার উপর নির্ভর করছে জয় অথবা পরাজয়। তাই সকলকে জানিয়ে দিয়েছে সানু,রক্ষীদের বড় একটা অংশ এ্যামবুশ ফাঁদের মধ্যে আসলে সে নিজেই প্রথমে গুলি ছুঁড়বে ;তার পর অন্যরা। তা’না হলে রক্ষীরা সতর্ক হয়ে যাবে, ফাঁদ কার্যকরী হবে না। তবে রক্ষীরা যদি নৌকাপথে আসার চেষ্টা করে তা’হলে নিকটে অবস্থানরতরাই প্রথমে গুলি ছুঁড়বে _এটাও জানিয়ে দিয়েছে সে।

প্রস্তুতিটা খুব বেশি সন্তোষজনক মনে হলো না সানুর। সে জানে,সশস্ত্র প্রতিরোধ ভেঙে পড়লেই বাঁধ ভাংগা জলোচ্ছাসের মত গ্রামে ঢুকে পড়বে রক্ষীবাহিনী। শুরু হবে হাতাহাতি লড়াই। এ লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বে গ্রামের সকল নারী,কিশোর,বালক ও বৃদ্ধ। রক্তের ঢ্ল নামবে শামুর বাড়ির গ্রামে। আর ভাবতে পারছে না,মাথাটা ঝিম ঝিম করছে তার। এ অবস্থাতেই এগিয়ে গিয়ে পুর্ব-দক্ষিণ দিকের শেষ প্রান্তে অবস্থান নিল সে। তার পাশেই পজিশন নিয়েছে জীবন। জীবনের পর রাজু। তার পাশে পলাশ। সর্বশেষে হিরু। সকলের হাতেই চকচকে অটোমেটিক অস্ত্র। এগুলো মাত্র কয়েকদিন পূর্বে তারা দখল করেছে শত্রু বাহিনীর নিকট থেকে। সানুকে দেখে প্রশ্ন করলো জীবন,”প্রস্তুতি কেমন দেখলেন”? “মোটামুটি”জবাব দিল সানু।” “রক্ষীরা কিন্তু এখনও রান্নার আয়োজনেই ব্যস্ত” জানালো জীবন। “ভালই হয়েছে,না হলে প্রস্তুতি নেয়ার সময়ই পেতাম না আমরা” বললো সানু। “এ…ই…চুপ করুন,ওরা আসছে!” চাপা স্বরে বলে উঠলো রাজু।
ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে এগিয়ে আসছে রক্ষীবাহিনী। প্রথম দলটা একেবারে গ্রামের সামনে। ওরা গেরিলাদের নিকট থেকে মাত্র আট হাত দূরেই রাস্তায় ঘোরাফিরা করছে। হয়তো রেকি করছে। নয়তো অল্প লোক নিয়ে গ্রামে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। দ্বিতীয় দলটা এসে পড়লে সন্মিলিতভাবে গ্রামে ঢুকবে -এমন পরিকল্পনাও থাকতে পারে ওদের। লতাপাতা, গাছ-গাছালির আড়ালে লুকিয়ে থাকা গেরিলাদের দেখতে পাচ্ছে না রক্ষীরা। কিন্তু গেরিলারা সবই দেখতে পাচ্ছে। এতো অল্প দূর থেকে অটোমেটিক ব্রাশের একটা গুলিও বাজে খরচ হবে না ভেবে উল্লসিত হয়ে উঠলো তারা। এগিয়ে আসছে রক্ষীদের দ্বিতীয় দলটাও। সংখ্যায় ওরা অনেক। এতোগুলো রক্ষীকে একবারেই ব্রাশের আওতায় আনা যাবে ভেবে বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে উঠলো গেরিলারা। এ অবস্থায় জীবন আর চুপ করে থাকতে পারলো না। খুশি খুশি গলায় ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো সে,”এতো বড় শিকার সহজে মেলে না”।”ঠিক বলেছেন কমরেড”সমর্থন জানালো রাজু।

এল,এম,জি,’র ট্রিগারে আংগুল রেখে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল হাফিজ। উত্তেজনায় ট্রিগারে চাপ পড়ে বেরিয়ে গেল একটা গুলি। সাথে সাথেই পজিশন নিয়ে নিলো রক্ষীরা। ভন্ডুল হয়ে গেল গেরিলাদের পরিকল্পনা। সবেধন নীলমনি এল,এম,জি,টাও গেলো অকেজো হয়ে। শত চেষ্টাতেও সেটাকে আর কার্যকর করতে পারলো না তারা।

গুলি ছুঁড়ছে রক্ষীরা। দুটো লঞ্চ থেকে, বড় খালে উঁচু পাড়ের আড়াল থেকে,স্টেশন আর গ্রামের মাঝ বরাবর অবস্থিত ব্রীজ থেকে,ডহুরী খালের পাড়ে অবস্থিত শামুর বাড়ি গ্রামের বিচ্ছিন্ন অংশ থেকে,গ্রামের সামনের রাস্তার আড়াল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুঁড়ছে ওরা। গাছ-পালা ছিঁড়ে, ডাল-পালা ভেঙে, ঘরের দরজা-বেড়া-চাল ফুটো করে ছুটে চলছে গুলি। নীরব-নিঃশব্দ গ্রামীন পরিবেশ ভেঙে খান খান হয়ে পড়ছে এল,এম,জি.,এস,এল,আর.,রাইফেলের অট্টহাসিতে। এ শব্দ শুনতে পেয়ে এগিয়ে আসবে থানার রক্ষী-পুলিশ। থানার ওয়ারলেসে খবর যাবে নিকটবর্তী থানাগুলোতে। খবর যাবে মুন্সিগঞ্জ,নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায়। দু’তিন ঘণ্টার মধ্যেই এসে পড়বে বিরাট বাহিনী। এমনকি হেলিকপ্টারও আসতে পারে। কি দিয়ে, কেমন করে ঠেকাবে ওদের-ভাবতে পারছে না গেরিলারা।

নিশ্চিত পরাজয়-বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারো। সকলের মুখেই ফুটে উঠেছে আসন্ন মৃত্যুর ম্লান ছায়া। সমস্ত গ্রামটা দ্রুত একবার চক্কর দিল সানু। কেউ কিছু বললো না তাকে। কিন্তু সকলের চোখে সে দেখতে পেয়েছে একটা নীরব প্রশ্ন-কি করবে তারা এখন? প্রশ্নটা তো তার নিজেরও। কি করবে সে? সামনে এগুলে মৃত্যু। গ্রামে বসে থাকলেও রেহাই নেই। চারিদিকে থৈ থৈ পানি,পালাবারও যে পথ নেই। তবে কিভাবে মৃত্যুকে বরন করবে তারা-সে সিদ্ধান্ত নেয়ার একটুখানি সময় তাদের হাতে আছে।

চরম সিদ্ধান্ত নিলো সানু-সামনে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বরন করবে চারজন,বাকিরা থাকবে গ্রামে;তারাই দেবে শেষ লড়াই। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মসজিদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ঝাঁকড়া মাথাওয়ালা মহীরুহের মতো বড় বড় তিনটা আম গাছের নীচে টান টান হয়ে পাশাপাশি দাঁড়ানো চারজন। লুংগিটাকে মালকোঁচা দিয়ে, উদাম শরীরে,দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। শক্ত হয়ে উঠেছে তাদের মুখের পেশি-দাঁতের চোয়াল। সাগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে তারা-প্রত্যাশিত কমান্ডের অপেক্ষায়।

“এডভান্স”-রক্ষীবাহিনীর একটানা গুলির শব্দকে ছাপিয়ে ঘোষিত হলো কমান্ড। সাথে সাথেই উন্মুক্ত প্রান্তরে ঝাঁপিয়ে পড়লো সানু,জীবন,রাজু,পলাশ। প্রচন্ড গুলি বর্ষনকে উপেক্ষা করে মাটির রাস্তা ধরে তারা এগিয়ে চললো স্টেশনের দিকে।

নিমিষেই খবরটা রটে গেল গ্রামে।খবরটা শুনতে পেয়েই বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীরটাকে এক ঝটকায় সোজা করে চীৎকার দিল নানী,” আমাকে একটা অস্ত্র দে,আমিও যাবো সানুদের সাথে “।তাকে অনেক কষ্টে থামালো বেলা। ” শামুর বাড়ি আদর্শ বিদ্যাপীঠ”-এর ছাত্র-ছাত্রীরা সমস্বরে গেয়ে উঠলো গেরিলাদের প্রিয় গান,”লক্ষ জনতা,জাগ্রত আজ। বাঁধব্র বুনো ষাঁড়। রক্ত পতাকা,খুনে রঙিন। সংগীন সর্বহারা।”লেজটাকে ঝান্ডার মতো উঁচু করে ধরে আলমের বুড়ো দাদু দিল শ্লোগান। সাথে তান ধরলো গ্রামের সকল নারী-পুরুষ-বালক-বৃদ্ধ। এ শ্লোগানে সাড়া দিল গাওদিয়া,রানাদিয়া,পাখীদিয়া,বনসামন্ত,ডহুরীর হাজার হাজার জনগণ। সমুদ্রের জলোচ্ছাসের মতো আকাশ-বাতাস মুখরিত হতে থাকলো শ্লোগানে শ্লোগানে।

জনগনের সক্রিয় সমর্থনে ভীতি কেটে গেলো মিলিশিয়াদের। তারা গেরিলাদের সাথে এগিয়ে গেলো গ্রামের পূর্ব পাশে এবং একযোগে গুলি ছুঁড়তে শুরু করলো অগ্রসরমাণ চারজনের মাথার উপর দিয়ে লঞ্চ দুটোকে লক্ষ্য করে।

এগিয়ে চলছে কখনো দৌড়ে,কখনো হামাগুড়ি দিয়ে। কখনো বা চুপচাপ থাকছে তারা। গতি খুব ধীর,তবুও তারা এগিয়ে চলছে জীবনকে বাজি রেখে।

(সমাপ্ত)