সিরাজ সিকদার রচনাঃ লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরোধী চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মহান সংগ্রাম (সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

সিরাজ সিকদার রচনা

লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরোধী চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মহান সংগ্রাম

(সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

 sikder

সভাপতি মাওসেতুঙ-এর নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরোধী মহান সংগ্রাম পরিচালনা করছে। এ সংগ্রামে চীনের ব্যাপক শ্রমিক-কৃষক-সৈনিক ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা অংশগ্রহণ করছে।

লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরোধী সংগ্রাম সংশোধনবাদী, পুঁজিবাদী পথগামীদের চীনের ক্ষমতা দখল, সমাজতান্ত্রিক চীনে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সর্বহারার একনায়কত্ব উৎখাত করে বুর্জোয়া একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা, চীনকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদের লুন্ঠন ক্ষেত্রে পরিণত করার চক্রান্ত নস্যাত করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছে।

চীনের ইতিহাসের অন্যতম প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতারক, অন্তর্ঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বাসঘাতক দু’মুখো লিনপিয়াও কনফুসিয়াসবাদকে তার ক্ষমতা দখল ও পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার মতাদর্শগত অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে ওয়াংমিং-লিউ শাওচি ইত্যাদি দলত্যাগী বিশ্বাসঘাতকরাও মার্কসবাদ-সর্বহারাদের বিরোধিতা করার জন্য কনফুসিয়াসবাদকে মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

দু’মুখো প্রতারক লিনপিয়াও মাওসেতুঙ জিন্দাবাদ ব্যতীত কথা বলত না এবং উদ্ধৃতি হাতে ব্যতীত বের হতো না। সেও ওয়াংমিং-লিউ শাওচির অন্ধ কানাগলিপথ অনুসরণ করে।

শ্রেণী সমাজে মার্কসবাদী মতাদর্শ গ্রহণ করতে হবে বা প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ গ্রহণ করতে হবে, এর মাঝামাঝি কিছু নেই।

এ কারণে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে দেখা যায় সংশোধনবাদী বার্নেস্টাইন, কাউটস্কি, ক্রুশ্চোভ, তোগলিয়াত্তি, ব্রেজনেভ মার্কসবাদের নামে বুর্জোয়া মতাদর্শ গ্রহণ করেছে এবং এর দ্বারা মার্কসবাদের বিরোধিতা করছে।

মার্কসবাদের বিরোধিতা করার জন্য লিনপিয়াও চীন ও বিশ্বের সংশোধনবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের অনুরূপ চীনের প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ কনফুসিয়াসবাদকে গ্রহন করে।

এ কারণে লিনপিয়াও বিরোধী সংগ্রাম, লিনপিয়াও-এর প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ কনফুসিয়াস বিরোধী সংগ্রামের সাথে যুক্ত। এই মতাদর্শগত সংগ্রাম বাদ দিলে লিনপিয়াও বিরোধী সংগ্রাম অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে, এ সংগ্রামের আত্মাকেই বাদ দেওয়া হবে।

এ কারণেই চীনে লিনপিয়াও বিরোধী সংগ্রামের সাথে কনফুসিয়াস বিরোধী সংগ্রাম যুক্ত হয়েছে।

আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর পূর্বে কনফুসিয়াস জীবিত ছিল। এ সময় চীনের সমাজে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হচ্ছিল। চীনের দাস সমাজ ভেঙ্গে পড়ছিল এবং সামন্তবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল।

কনফুসিয়াস দাস সমাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে মত প্রচার করে এবং তখনকার জন্য প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থা সামন্তবাদকে বিরোধিতা করে।

আচার-অনুষ্ঠান পুনঃপ্রবর্তন, লুপ্ত বংশধারা ও পদ পুনরায় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মাধ্যমে সে দাস সমাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।

কনফুসিয়াস অবশ্য সমাজের গতিধারা রোধ করতে ব্যর্থ হয়। চীনে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মালিকদের প্রগতিশীল ভুমিকা শেষ হয়ে গেলে তারা সামন্তবাদ টিকিয়ে রাখা এবং কৃষকদের দাবিয়ে রাখার জন্য কনফুসিয়াসবাদ গ্রহণ করে।

চীনে পুঁজিবাদের অনুপ্রবেশের কালে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের সহযোগী আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদীরা চীনের জনগণকে দাবিয়ে রাখার জন্য কনফুসিয়াসবাদকে গ্রহণ করে।

লিনপিয়াও-এর শ্রেণীভিত্তি হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ, সেও এই মতাদর্শ থেকে মুক্ত ছিল না।

মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম বিরোধিতা করার জন্য সেও এই প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ গ্রহণ করে এবং পার্টির মাঝে একজন লুক্কায়িত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিরাজ করে, পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের সুবিধাজনক সময়ের অপেক্ষা করে।

লিনপিয়াও কনফুসিয়াসের ‘নিজেকে সংযত কর, আচার-অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রবর্তন কর’—এ প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব তুলে ধরে নবম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় অধিবেশনে পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের জন্য ষড়যন্ত্র করে। সে বলে রাষ্ট্র রয়েছে, অতএব রাষ্ট্রপতি থাকতে হবে অর্থাৎ সে চীনের রাষ্ট্রপতি হওয়ার চেষ্টা করে।

অনুশীলনই প্রতিভার সৃষ্টি করে। ব্যক্তি নয় জনগণই সমাজ বিকাশের মৌলিক পরিচালিকা শক্তি, লিনপিয়াও এই ঐতিহাসিক বস্তুবাদী সত্যকে অস্বীকার করে, কনফুসিয়াসের সহজাত প্রতিভার, ব্যক্তি বিশেষই সমাজ পরিবর্তনের কারন ইত্যাদি ভাববাদী তত্ত্ব প্রচার করে, নিজেকে ও তার পরিবারকে প্রতিভাবান মহামানব হিসেবে তুলে ধরে। এভাবে ক্ষমতা দখলের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও লিন রাজবংশ কায়েমের ষড়যন্ত্র করে।

লিনপিয়াও মনে করতো শ্রমিক কৃষক জনগণ ভাত-রুটি ইত্যাদির কথা চিন্তা করবে, আর বুদ্ধিজীবীরা তাদের উপর মাতব্বরী করবে। সে বুদ্ধিজীবীদের গ্রামে যাওয়া, শ্রমিক কৃষকের সাথে একীভূত হয়ে সর্বহারায় রূপান্তরের মহান প্রক্রিয়াকে …হিসেবে চিহ্নিত করে ও বিরোধিতা করে।

লিনপিয়াও কনফুসিয়াসের মধ্যপন্থী তত্ত্বের অনুকরণ করে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রামে বাম-বিচ্যুতি হয়েছে বলে বিরোধিতা করে।

সভাপতি মাও বলেছেন, ‘একটি ভুলকে সঠিক করতে হলে সাধারণ সীমারেখা অতিক্রম করতে হবে।’ প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা যায় না। দৃঢ়ভাবে শ্রমিক কৃষক জনগণের পক্ষে থাকতে হবে, প্রতিক্রিয়াশীলদের উপর কঠোরভাবে একনায়ত্ব চালাতে হবে।

লিনপিয়াও কনফুসিয়াসের বদান্যতা, আনুগত্যের তত্ত্ব প্রচার করতো। সে বদান্যতার কথা বলত, কিন্তু সর্বহার শ্রেণী ও তার মহান নেতা সভাপতি মাওয়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করতো। সে ‘Outline of the Project 571’ তৈরী করে সভাপতি মাওকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তার বদান্যতা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল, সামন্ত, আমলা বুর্জোয়া ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য।

লিনপিয়াও-এর আনুগত্যের তত্ত্ব ছিল লিন ও তার রাজবংশের প্রতি আনুগত্যের তত্ত্ব, চীনের প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি আনুগত্যের তত্ত্ব, নারী-সন্তানদের স্বামী-পিতামাতা-বংশের প্রতি আনুগত্য, সর্বহারা শ্রেণী, পার্টি, সভাপতি মাও এবং জনগণ ও মার্কসবাদের প্রতি আনুগত্য নয়।

লিনপিয়াও-এর সকল তত্ত্বের উদ্দেশ্য ছিল সংশোধনবাদী বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলদের টিকিয়ে রাখা, তাদের দ্বারা ক্ষমতা দখল করা, সোভিয়েট সংশোধনবাদীদের কোলে আশ্রয় নেওয়া, চীনকে সোভিয়েটের উপনিবেশে পরিণত করা।

লিনপিয়াও কনফুসিয়াস ও তার শিষ্য মেনসাস বিরোধী সংগ্রাম চীনের উপরিকাঠামোর প্রতিক্রিয়াশীল, সংশোধনবাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে একটি মহান সংগ্রাম, এ সংগ্রাম দ্বারা উপরিকাঠামোর যে সকল অংশ সংশোধনবাদী বুর্জোয়াদের দখলে রয়েছে তাদের উৎখাতের পক্ষে জনমত সৃষ্টি হবে এবং তারা উৎখাত হবে। ফলে সর্বহারার একনায়ত্ব দৃঢ় হবে। এ সংগ্রাম জনগণের মতাদর্শগত উন্নতি করবে। সর্বহারার অগ্রগামী চিন্তাধারা দ্বারা তারা সুসজ্জিত হবে। ইহা বস্তুগত শক্তি হয়ে সমাজ ও দুনিয়ার রূপান্তর ত্বরান্বিত করবে। ফলে চীনের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদন শক্তির বিকাশ ত্বরান্তিত হবে।

লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরোধী সংগ্রাম দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া ও বিশ্বের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কোরিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে কনফুসিয়াসের প্রভাব রয়েছে। চীনের এ সংগ্রাম এ প্রভাব দূরীকরণে সহায়তা করবে।

বিশ্বের আধুনিক সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রামে ইহা বিরাট বিজয়। সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে আধুনিক সংশোধনবাদীদের এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের ও প্রতিক্রিয়াশীলদের চীনে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং শোষণ ও লুন্ঠন পরিচালনার রঙিন স্বপ্ন এ সংগ্রামের ফলে ধুলিসাৎ হয়েছে।

এটা বিশ্ব বিপ্লবের একটি বিরাট বিজয়।

পূর্ববাংলার বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদ এবং পার্টির অভ্যন্তরস্থ অপরিবর্তিত বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের ক্ষমতা দখল প্রতিহত করার ক্ষেত্রে চীনের এ মহান সংগ্রাম বিরাট উদাহারণ উদাহারণ হিসেবে কাজ করবে।