সিরাজ সিকদার রচনাঃ অনুসন্ধানের গুরুত্ব (সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

সিরাজ সিকদার রচনা

অনুসন্ধানের গুরুত্ব

(সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

sikder

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটীর দ্বাদশ পূর্ণাংগ অধিবেশনের ইশতেহারে অনুসন্ধানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা ও বিকাশ সাধারনের জন্য অনুসন্ধান একান্ত প্রয়োজন।
আমাদের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক লাইন সঠিক হওয়া সত্ত্বেও যথাযথ অনুসন্ধানের অভাবে কয়েক স্থানে বিপর্যয় ঘটেছে। সংগঠনের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সাভার, মতলবের ঘটনা এর প্রমাণ।

অনুসন্ধানের দার্শনিক তাৎপর্য

আমরা মার্কসবাদী। আমাদের দর্শন হচ্ছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হওয়ার অর্থ হচ্ছে আমাদের চেতনা হবে মস্তিষ্কে বস্তুর প্রতিফলন। এ চেতনা দ্বারা বস্তুকে রূপান্তরিত করতে হবে।
বস্তু অনুযায়ী চেতনা-চিন্তা হতে হলে বস্তুকে যথাযথভাবে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করতে হবে-আর এর একমাত্র উপায় হচ্ছে অনুসন্ধান। কেবলমাত্র অনুসন্ধানের মাধ্যমে অর্থাৎ বস্তুর সংস্পর্শের মাধ্যমে বস্তুর বাইরের রূপ এবং আভ্যন্তরীন নিয়মবিধি ও অন্যান্য বস্তুর সাথে এর সম্পর্ক অবগত হওয়্যা যায়।
কাজেই বস্তুবাদী হতে হলে আমাদেরকে সভাপতি মাও-এর কথা “অনুসন্ধান ছাড়া কথা বলার অধিকার নেই” এটা সর্বদা মনে রাখতে হবে।

ক্ষুদে বুর্জোয়ারা অনুসন্ধানবিমুখ

ক্ষুদে বুর্জোয়ারা ক্ষুদে উৎপাদনের সাথে জড়িত। এ কারণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ। তাই তারা হয় একতরফাবাদী, ভাসাভাসা ও আত্মগত (একতরফাবাদ ও ভাসাভাসাভাব হচ্ছে আত্মগতভাব)। আত্মগতবাদীরা বস্তুকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করে না, এর সাথে কল্পনা (চেতনা) যুক্ত করে, আন্দাজে কথা বলে।
তোয়াহা-মতিন অনুসন্ধান না করে আমাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন আজে-বাজে গুজব রটনা করেছে, আত্মগতভাবের আশ্রয় নিয়েছে।
হক-তোয়াহা-মতিন পূর্ববাংলার বাস্তব অবস্থা মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে আত্মগতভাবে রাজনৈতিক, সামরিক লাইন রচনা করেছে।
ফলে পদে পদে তারা ভুল করেছে, তারা বিপর্যস্ত হয়েছে।
আমাদের সংগঠনে বাস্তব কাজে অনেক কর্মী আত্মগতভাব, একতরফা, ভাসাভাসাভাব দ্বারা পরিচালিত হন, ফলে তারা ভুলভ্রান্তি করেন।

সাংগঠনিক, সামরিক, মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা

শত্রু সর্বদাই আমাদেরকে ধ্বংস করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের এ অপচেষ্টা জোরদার হবে, তারা মরিয়া হয়ে উঠবে।
শত্রুরা তাদের চর আমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করাবে। সংশোধনবাদী, সুবিধাবাদী, খারাপ উপাদান, ভ্রষ্টরা আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়ার প্রচেষ্টা চালাবে।
এদের উপস্থিতিতে সংগঠন টিকিয়ে রাখা, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব হবে না, সংগঠন বিপর্যস্ত হবে, পার্টির অপুরণীয় ক্ষতি হবে, পার্টির নেতৃত্ব এদের হাতে চলে গেলে পার্টি ও বিপ্লব ব্যাহত হবে।
কাজেই সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা ও বিকাশ সাধনের জন্য অনুসন্ধান অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
সামরিক ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারণ, গেরিলা রিক্রুট, অস্ত্র রাখা, শেলটার, শত্রুর দুর্বল অবস্থান বের করা ইত্যাদির জন্য অনুসন্ধান প্রাথমিক গুরুত্বসম্পন্ন।
কর্মীদের মানোন্নয়ন, যাচাইয়ের জন্য তাদের মতাদর্শগত অবস্থা অনুসন্ধান প্রয়োজন।
সাংগঠনিক কার্য পরিচালনা, কর্মী বের করা, সমস্যার সমাধান, বিভেদপন্থীবাদ-উপদল গঠন ঠেকানো, কর্মীদের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঠেকানো, নিরাপত্তা, ইত্যাদির জন্যও অনুসন্ধান একান্ত প্রয়োজন।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও দ্বন্দ্বসমূহ নির্ণয়, এবং আমাদের রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণের জন্যও অনুসন্ধান একান্ত প্রয়োজন।

কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই

রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণ হয়ে গেলে কর্মীরাই হচ্ছে নির্ণায়ক।
ভাল অগ্রসর বিশ্বস্ত সম্ভাবনাময় কর্মী বের করা, শত্রুচর, টাউট, ভ্রষ্টদের সংগঠনে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য
কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই একান্ত প্রয়োজন।
কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই যথাযথ না হওয়ার ফলে খারাপ উপাদান পার্টিতে অনুপ্রবেশ করে, মতলব ও সাভারের কাজ এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মুন্সিগঞ্জে অনুপ্রবেশকারী কয়েক জনকে বের করা হয়, এবং শাস্তি বিধান করা হয়। ফলে মুন্সিগঞ্জের সংগঠন টিকে থাকে।
কর্মীরা নিজের যে কেডার ইতিহাস দেয় তার উপর নির্ভর করলে … হবে।
কর্মী, শেল্টার, গেরিলাদের কেডার ইতিহাস সংগ্রহ করতে হবে, তার পরিচিত সহানুভূতিশীল এবং সে জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছে এরূপ স্থানের জনগণের নিকট থেকে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে কেডার ইতিহাস যাচাই করতে হবে।
অন্যথায় শত্রুচর, টাউট, ভ্রষ্টদের হাতে নিজেদের প্রাণ খোয়া যাবে, অস্ত্র খারাপ লোকদের হাতে যাবে, সংগঠন বিনষ্ট হবে।
সাভার, মতলবের ঘটনা এর প্রমাণ।
প্রতিটি নূতন যোগাযোগ, শেল্টার যাচাই করতে হবে, তারপরে আনুষ্ঠানিকভাবে এককভুক্ত করতে হবে।
বাইরে যোগাযোগ দেওয়ার সময় বা বাইরে থেকে যোগাযোগ পাওয়ার সময় ইহা কঠোরভাবে পালন করতে হবে।
গেরিলা, অস্ত্র, বসা-থাকা শেলটারের জন্য এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে কার্যকরী করতে হবে।
এতে কর্মী, গেরিলা, শেলটার সংগ্রহ ধীরগতিতে হবে ঠিকই কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা হবে জোরদার, শত্রু আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
কারণ আজ পর্যন্ত আমাদের সকল ক্ষতির জন্য দায়ী হচ্ছে আভ্যন্তরীণ খারাপ উপাদান।
বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠনের ইতিহাসও এ সত্য প্রমাণ করে।

অলসতা অনুসন্ধানের শত্রু

সভাপতি মাও বালেছেন, ‘অলসতা ভাববাদ ও অধিবিদ্যার গর্তে নিক্ষেপ করবে।’
অনুসন্ধান করা, প্রকৃত অবস্থা অবগত হওয়ার জন্য কষ্টকর প্রচেষ্টা প্রয়োজন ।
কারণ শত্রুরা চেষ্টা করবে হাজারো উপায়ে আমাদেরকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য।
কাজেই অলসতা পরিহার করতে হবে। প্রতিটি কেডার, যোগাযোগ, শেল্টারের বিষয় অনুসন্ধান করতে হবে, শত্রুচরদের অনুপ্রবেশ প্রতিহত করতে হবে, সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা ও অব্যাহত বিকাশ বজায় রাখতে হবে।
প্রতিনিয়ত কর্মীদের কাজ অনুসন্ধান ও যাচাই করতে হবে। এর মাধ্যমেই অগ্রসর কর্মীদের খুজে বের করা সম্ভব হবে।
বর্তমান কর্মী স্বল্পতার সময় এ পদ্ধতিতে কর্মী বের করা, তাদের মানোন্নয়ন করার মাধ্যমে কর্মীস্বল্পতা দূর করতে হবে।
বর্তমান সামরিক বিকাশের লক্ষ্য সমুহ অর্জন করতে হলে ভাল অনুসন্ধানের ভিত্তিতে লক্ষ্যবস্তু, গেরিলা এবং শেল্টার ঠিক করতে হবে, অস্ত্র সংগ্রহ করা ও নিয়মিত গেরিলা গড়ে তোলা লক্ষ্য হাসিল করতে হবে।