সিরাজ সিকদার রচনাঃ বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী বুর্জোয়া উপদলের সাথে যুক্ত সর্বহারা বিপ্লবীদের প্রতি

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ মার্চ ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ২৫ অক্টোবর ২০১৩


 

পিডিএফ

“বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী উপদলের সাথে যুক্ত সর্বহার বিপ্লবীরা, ‘প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত’—সভাপতি মাও-এর এ পতাকাকে ঊর্ধে তুলে ধরে সংশোধনবাদী উপদলসমূহের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করুন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা এবং পূর্ববাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনে তার বিশেষ প্রয়োগের ভিত্তিতে পূর্ববাংলার সর্বহারা শ্রেণীর সঠিক রাজনৈতিক পার্টি’ ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’র সাথে ঐক্যবদ্ধ হোন।

সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যকার অনৈক্যকে দূর করুন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সুসজ্জিত, সুশৃংখলিত, সমালোচনা-আত্মসমালোচনার পদ্ধতি প্রয়োগকারী, জনগণের সাথে যুক্ত, ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী এবং এককেন্দ্রীক পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি গড়ে তুলুন।”

কমরেডগণ,

আপনারা আন্তরিকভাবে পূর্ববাংলা ও বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের মুক্তির জন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা গ্রহণ করেছেন, বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী উপদলের নেতৃত্বের ভাওতায় পড়ে আপনারা বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী উপদলের সাথে জড়িত হয়েছেন।

এ সকল উপদলের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব আপনাদেরকে বিপথে পরিচালনা করে এবং আপনাদের সাথে, সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।

এরই ফলে পূর্ববাংলায় ভারতের উপনিবেশ কায়েম হয়েছে; সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এ উপনিবেশিক লুন্ঠনে ভাগ বসাচ্ছে, তাদের তাবেদার ছয় পাহাড়ের দালালরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের কথা বলে ছয় পাহাড়ের ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছে। এরই ফলে মহান গণচীনের এবং পূর্ববাংলার ও বিশ্বের সর্বহারাদের অসুবিধায় পড়তে হয়েছে; চীন বিরোধী, কমিউনিস্ট বিরোধী প্রতিবিপ্লবী ঘাঁটি গঠন এবং জনমতের সৃষ্টি হয়েছে।

আপনাদের আত্মত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রম ভুল পথে ব্যবহৃত হয়ে নিরর্থক হয়েছে। আসুন, আমরা বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী নেতৃত্বের অপরাধসমূহ উদঘাটন করি, এ সকল পুঁজিবাদের পথগামী কর্তৃস্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখোশ উন্মোচিত করি, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি।

নয়া সংশোধনবাদী হক-তোয়াহা-বশির

এরা সুদীর্ঘদিন মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদী পার্টিতে কাজ করে। এ সময় তারা সংশোধনবাদী বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার পরিবর্তে তাদের বিশ্বস্ত পদলেহী কুকুর হিসেবে প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপ করে। তার পার্লামেন্টারি রাজনীতি করে, নির্বাচনে দাঁড়ায়, প্রকাশ্য পার্টি তৎপরতা চালায়, তোয়াহা প্রকাশ্যে চটকল ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে শ্রমিকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।

সভাপতি মাও-এর নেতৃত্বে বিশ্বের সর্বহারা বিপ্লবীদের আধুনিক সংশোধনবাদবিরোধী বিরাট তর্কযুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় পূর্ববাংলায় সভাপতি মাও-এর রচনাবলী আসে। এর ফলে সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মতাদর্শগত প্রস্তুতির সৃষ্টি হয়।

সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি এবং এর নেতৃত্বে বিভিন্ন গণসংগঠনের সাধারণ সর্বহারা বিপ্লবীরা সংশোধনবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করে।

ছাত্র বিপ্লবীরা ছাত্র সংগঠনের সংশোধনবাদীদের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কাজী-রণো-মেনন চক্র ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সুযোগ গ্রহণ করে এবং ছাত্র ইউনিয়ন “মেনন গ্রুপ” গঠন করে।

এ সময়ে হক, তোয়াহা, বশির বিশ্বস্ততার সাথে সংশোধনবাদী লাইন অনুসরণ করছিল এবং তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ ছিল। ইহা প্রমাণ করে তারা ছাত্র বিপ্লবীদের চেয়েও পশ্চাদপদ ছিল।

কমিউনিস্টরা হচ্ছে সর্বহারার সবচাইতে অগ্রগামী যারা সর্বহারা শ্রেণী ও বিপ্লবী জনগণকে শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করে। আধুনিক সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রামে সাধারণ ছাত্র বিপ্লবীদের নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে হক-তোয়াহাদের নেতৃত্ব দেয় ছাত্র বিপ্লবীরা। ইহা প্রমাণ করে, কমিউনিস্টদের অগ্রগামী চরিত্র তাদের ছিলনা।

ইতিমধ্যে আধুনিক সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সাধারণ বিপ্লবীদের বিদ্রোহ জোরদার হয়।

হক, তোয়াহা, বশির এ বিদ্রোহের সুযোগ গ্রহণ করে, নিজেদের পার্টি কর্তা হিসেবে গড়ে তোলা ও পার্টির ক্ষমতা দখলের জন্য নাম্বুদ্রিপদ-জ্যোতি বসুর অনুসরণে মার্কসবাদী পার্টি নামধারী সংশোধনবাদী উপদল গঠন করে এবং সর্বহারা বিপ্লবীদের প্রতারিত করে।

ইতিমধ্যে হক-তোয়াহা ছয় দফার বিরোধিতা করা এবং পূর্ববাংলার উপর পরিচালিত জাতীয় নিপীড়নের বিরোধিতা না করার শর্তে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আওয়ানের সাথে বৈঠকে মিলিত হয় এবং আপোষ করে। এর ফলে তাদের উপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার করা হয়। এভাবে হুলিয়া প্রত্যাহারের বিনিময়ে পূর্ববাংলার উপর পরিচালিত জাতীয় নিপীড়ন বিরোধিতা না করার অঙ্গীকার করে তারা পূর্ববাংলার সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।

তারা ন্যাপকে বিভক্ত করে, কিন্তু তাদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপের দ্বারা প্রকাশ্যে ক্ষুদে বুর্জোয়া বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালায়, এমন কি ইসলামিক সমাজতন্ত্র্বের মত প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্যও হক-তোয়াহা প্রকাশ্যে প্রচার করে।

কৃষক সমিতিকেও একইভাবে বিভক্ত করে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অংশ দ্বারা তারা প্রকাশ্যে সংস্কারমূলক রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যায়।

এ সময় তারা সভাপতি মাও-এর চিন্তাধারাকে চীনের জাতীয় নেতার বক্তব্য বলে তা পাঠ ও প্রয়োগের বিষয়ে কর্মীদেরকে নিরুৎসাহিত করে। তারা সময় হয়নি, সংগঠন হয়নি, প্রচার হয়নি ইত্যাদি যুক্তি দেখিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম ঠেকিয়ে রাখে।

ছাত্র এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের কৃষক শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়া, তাদের নিকট থেকে পুনরায় শিক্ষা গ্রহণ করা, সশস্ত্র বিপ্লবে পোড় খাওয়া, মার্কসবাদ অধ্যয়ন ও প্রয়োগ করে মতাদর্শগত পুনর্গঠনের সঠিক পথে পরিচালনার পরিবর্তে প্রকাশ্য মিটিং, মিছিল এবং অন্যান্য সংস্কারবাদী পথে পরিচালনা করে এবং তাদেরকে আরো পাকাপোক্ত ক্ষুদে বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত করে।

তারা সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদকে পূর্ববাংলার শত্রু হিসেবে উল্লেখ করার সময় সকলকে এক ও অবিচ্ছিন্ন শক্তি বলে। তারা আরো বলে দেশের প্রধান ও মৌলিক বিরোধ হলো জনগণ এবং তিনশক্তির অবিভাজ্য প্রকাশ (অর্থাৎ সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদের সাথে জনগণের দ্বন্দ্ব প্রধান ও মৌলিক দ্বন্দ্ব), এই তিন শক্তির অবিচ্ছিন্ন সত্তাকে পৃথকভাবে বিচার করার অর্থই হলো ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক এদের স্বার্থের ওকালতি করা, এদের স্বার্থের সেবা করা (অর্থাৎ, প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে বের করা, প্রধান শত্রু নির্ণয় করা হচ্ছে শত্রুকে সেবা করা)।

এ কথা বলে তারা প্রধান দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব, তা নির্ণয়ের গুরুত্বকে অস্বীকার করেছে। ইহা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মৌলিক নীতিকে অস্বীকার করা এবং স্পষ্ট ভাববাদ। প্রধান দ্বন্দ্ব নির্ণয় না করা, প্রধান শত্রু নির্ণয় না করা, সকল শত্রুকে সমভাবে বিচার করা ও আক্রমণ করার প্রকৃত অর্থ হলো প্রধান শত্রুকে আড়াল করা ও তাকে বাঁচিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ, সকলকে আক্রমণ করা গুটিকয়েককে রক্ষা করার জন্য।

ইহা প্রমাণ করে দর্শনের ক্ষেত্রে তারা পুরনো ও আধুনিক সংশোধনবাদীদের মত অনুসরণ করে ভাববাদ ও অধিবিদ্যা।

পরবর্তীকালে তারা নিজেদের ‘নকশাল’ হিসেবে জাহির করার জন্য সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, সামন্তবাদকে প্রধান শত্রু বলে নিজেদের পূর্বেকার বক্তব্যকে বিরোধিতা করে। এভাবে তারা নিজেদের গালে নিজেরাই চপোটাঘাত করে।

তারা ভারতের নকশালবাড়ীর কৃষক বিদ্রোহকে ন্যাপ অফিসে, ছাত্র ইউনিয়নের অফিসে, প্রকাশ্য সভায় হঠকারী, সিআইএ-এর কার্যকলাপ বলে বিরোধিতা করে।

তারা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ, যার সংস্কৃতি হলো জাতীয় পরাধীনতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও সামন্তবাদী—তাকে বিপ্লবী হিসেবে তুলে ধরে এবং বিপ্লবীদেরকে মতাদর্শগতভাবে নিরস্ত্র করে ফেলে। তার পূর্ববাংলার উপর পরিচালিত পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের জাতীয় নিপীড়ন ও লুন্ঠনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্ব পূর্ববাংলার আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের হাতে তুলে দেয়। যার ফলে সাম্রাজ্যবাদীরা পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্ন ব্যবহারের সুযোগ পায়। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পার্টির বিকাশ, সুসংবদ্ধতা ও বলশেভিকীকরণ, পার্টির নেতৃত্বে প্রধান ধরনের সংগঠন হিসেবে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলা, প্রধান ধরনের সংগ্রাম হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রামকে গ্রহণ করা, সশস্ত্র সংগ্রামকে সেবার উদ্দেশ্যে গণসংগঠনের কাজকে পরিচালনা করার মত মৌলিক বিষয় তারা কার্যকরী করেনি।

ব্যক্তিগত জীবন ও নারীদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা বুর্জোয়া সমাজের ইতর রীতিকে প্রয়োগ করে এবং জনগণের নিকট সর্বহারা বিপ্লবীদের সম্পর্কে কদর্য উদাহারণ সৃষ্টি করে।

এভাবে হক-তোয়াহা আধুনিক সংশোধনবাদের অনুরূপ কার্যকলাপ চালায়।

হক-তোয়াহাদের কার্যকলাপের ফলে সাধারণ কর্মীরা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এ বিদ্রোহের সুযোগ গ্রহণ করে দেবেন-বাসার, মতিন-আলাউদ্দিন, কাজী-রণো বিশ্বাসঘাতক চক্র ঘোলা জলে মাছ শিকার করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপদল গঠন করে এবং নিজেদেরকে পার্টি কর্তা হিসেবে জাহির করে।

হক-তোয়াহারা মারাত্মকভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে এবং ধ্বংসোন্মুখ হয়।

এ সময় নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য তারা নকশালপন্থী বনে যায় এবং ভারতের বিশেষ অবস্থার জন্য প্রণীত রাজনৈতিক লাইনকে পূর্ববাংলায় প্রয়োগ করার চেষ্টা করে নিজেদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে, পূর্ববাংলা ও ভারতের সর্বহারা ও জনগণকে প্রতারিত করার শেষ চেষ্টা করে। এভাবে তারা ‘বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ’, অর্থাৎ, মার্কসবাদের আত্মাকে বাদ দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক লাইন পূর্ববাংলার বিশেষ অবস্থায় প্রয়োগের চেষ্টা করে দর্শনের ক্ষেত্রে অধিবিদ্যক ও ভাববাদী ভুল করে। এর ফল হয় জুতোর মাপে পা কাটা, গোলাকার ছিদ্র পথে চারকোণা কাঠের টুকরো লাগাবার মত।

তারা পূর্ববাংলার জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে গ্রহণ না করে শ্রেণী দ্বন্দ্বকে প্রধান বলে বর্তমানের রাজনৈতিক করণীয়কে বাদ দেয় এবং সমাজের স্তরকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের করণীয়কে বর্তমানে টেনে আনে; এভাবে তারা ট্রটস্কীবাদী ভুল করে। এর ফলে তারা পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় নিপীড়ন বিরোধী সংগ্রাম থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

তারা “পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন”কে প্রথমে অস্বীকার করে। পরে এর বিরুদ্ধে জঘণ্য কুৎসা ও অপবাদ রটায়। এমনকি একে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করে। পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও তারা একই গুজব ও অপবাদ রটায়।

তারা ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীদের প্রতারিত করতে সক্ষম হয়। তাদের সমর্থনের সার্টিফিকেট দেখিয়ে এবং তাদের সুনামকে ব্যবহার করে বাইরের কারণের উপর নির্ভর করে নিজেদের কুকর্ম ঢাকতে চায় এবং বাঁচতে চায়।

পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব এমন তীব্র আকার ধারণ করে যে, তা সমাধানের জন্য যুদ্ধ শুরু হয়। পাক সামরিক ফ্যাসিস্টরা বাঙালী জাতির অস্তিত্বকে ধংস করা, লক্ষ-কোটি জনগণকে খতম করে তাকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা, পূর্ববাংলার শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্যকে ধ্বংস করার বর্বর ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

এ সময় পাক সামরিক ফ্যাসিস্ট ও তাদের সহযোগীদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, প্রধান দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট ও তাদের সহযোগীরা প্রধান শত্রু হিসেবে সমগ্র বাঙালী জাতির সামনে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত হয়। তারা জনগণের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়, জাতীয় দ্বন্দ্বের সমাধান সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, জনগণ নিজেরাই জাতীয় শত্রু খতম শুরু করে।

এভাবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিয়ম অর্থাৎ, প্রধান দ্বন্দ্বের সমাধানের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে দ্বন্দ্বসমূহের সমাধানের মাধ্যমে সমাজ অগ্রসর হয়, প্রধান দ্বন্দ্বের ভিত্তিত্বে প্রধান শত্রু নির্ণিত হয়, প্রধান শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করা যায়, প্রধান দ্বন্দ্বের সমাধান বিপ্লবের প্রধান দিক নির্ণয় করে, বিপ্লবের প্রতি বিভিন্ন শ্রেণীর ভূমিকা এবং ঐক্যফ্রন্টের সাধারণ ভিত্তি নির্ণয় করে—পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক উথাপিত প্রভৃতি তত্ত্বগত বিষয়ের সঠিকতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়।

এ সময় হক-তোয়াহা সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব প্রধান বলে, শ্রেণী শত্রু হিসেবে জনগণকে খতম করে, এভাবে তাদের কার্যকলাপ পূর্ববাংলার সমগ্র জনগণের অনুশীলনের বিরুদ্ধে যায়।

ইহা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী গণলাইনের কাজের সম্পূর্ণ বিপরীত মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক ব্যক্তির জনগণের অধিকাংশের অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন বামপন্থী হঠকারিতামূলক ট্রটস্কীবাদী কার্যকলাপ। তাদের বিশ্বাসঘাতক রাজনীতি থেকে উদ্ভূত হয় বিশ্বাসঘাতকতামূলক সাংগঠনিক পদক্ষেপসমূহ। তারা আওয়ামী লীগ এবং শ্রেণী শত্রুদের বিরোধিতার নামে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে আঁতাত করে এবং পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট গোয়েন্দাদের খবর সরবরাহকারী হয় এবং রাজাকার হয়।

তারা ছয় দফা বিরোধিতা করবে এবং পূর্ববাংলার উপর পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের জাতীয় নিপীড়নের বিরোধিতা করবে না—এ দাসখত লিখে দিয়ে গোয়েন্দা প্রধান আওয়ানের মাধ্যমে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে আপোষ করে। এর ফলে তাদের উপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার হয়, তারা প্রকাশ্য কাজের সুযোগ পায়।

ইহা পুরোপুরি লিউ শাওচি ও সংশোধনবাদীদের যে কোন কিছুর বিনিময়ে বেঁচে থাকার তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ। তারা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভূট্রো, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং অন্যান্য পদস্থ সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে বিভিন্ন সময় বৈঠকে মিলিত হয় এবং সংযোগ রাখে। এমন কি তারা নিয়াজী, ফরমান আলী ও তাদের চেলা-চামুণ্ডারদের সাথেও সংযোগ রাখে এবং পূর্ববাংলার সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের স্বার্থ বিক্রী করে।

পূর্ববাংলার আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী, বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিরা যখন জেল-নির্যাতন ভোগ করছে, ষড়যন্ত্র মামলার শিকারে পরিণত হয়েছে, তখন হক-তোয়াহাদের পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে দহরম-মহররম কি প্রমাণ করে না যে, আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের চেয়েও তারা অধঃপতিত? পূর্ববাংলার জনগণ তাদেরকে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালাল ব্যতীত আর কি বলবে?

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা এ সময় জেলে চরম নির্যাতন ভোগ করছিল, তাদেরকে বিচ্ছিন্নভাবে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর সেলে একা রাখা হয়েছিল, তাদের বিষয়ে তদন্ত পরিচালনার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে বিশেষজ্ঞও আনা হয়েছিল, নেতৃস্থানীয় কর্মীদের গ্রেপ্তারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল, গ্রেপ্তারকৃতদের বিশ্বাসঘাতকতা করানোর জন্য প্রলোভন দেখানো হয়েছিল।

এ সময় হক-তোয়াহা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতো, ধরা পড়লেও তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হতো, প্রকাশ্যে পত্রিকা-পুস্তিকা প্রকাশ ও বিক্রয় করতে পারতো, তাদের ঘর-বাড়ী পোড়ানো হয়নি। এমনকি তাদেরকে অস্ত্র প্রদান করা হয়। ইহা কি প্রমাণ করে না যে শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত না হয়ে তারা প্রকৃতপক্ষে শত্রুর সারিতে নেমেছিল অর্থাৎ তারা শত্রুর দালালে পরিণত হয়েছিল?

তারা “পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন”-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, তার গঠন প্রকৃতি, নেতৃত্বের কারো কারো ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এমন সব তথ্য পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নিকট প্রদান করে যা দলত্যাগী বিশ্বাসঘাতক নুরুল হাসানের মাধ্যমে তারা জেনেছে।

তারা ভারতে গঠিত বাংলাদেশ পুতুল সরকারের সাথে লাইন রেখেছে এবং বর্তমানেও লাইন দিচ্ছে।

এদের, মতিনদের ও কাজী-রণোদের কার্যকলাপের কারণে জনগণের মাঝে ‘নকশাল’ সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়।

তারা পূর্ববাংলার কৃষকের সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব প্রমাণ করার জন্য স্ট্যালিনের একটি উদ্ধৃতির শেষের অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করে লিউ শাওচির মত কাজ করে।

হক লিখেছে “জাতীয় প্রশ্ন হছে মূলতঃ কৃষক প্রশ্ন।” এর পরের অংশটি হক ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করেছে।

স্ট্যালিনের পুরো উদ্ধৃতিটি নিম্নে প্রদত্ত হলঃ “আমরা প্রায়ই বলে থাকি জাতীয় প্রশ্নের সারবস্তু হলো কৃষক প্রশ্ন। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, জাতীয় প্রশ্ন কৃষক প্রশ্নের আওতায় পড়ে, কৃষক প্রশ্ন জাতীয় প্রশ্নের মত সমান ব্যাপ্তি বিশিষ্ট, কৃষক প্রশ্ন ও জাতীয় প্রশ্ন অভিন্ন। কোন প্রকার প্রমাণের প্রয়োজনই হয় না যে জাতীয় প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাপ্তির দিক থেকে ব্যাপকতর এবং সারবস্তুর দিক দিয়ে অধিকতর সমৃদ্ধশালী।

পূর্ববাংলার ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে কৃষক প্রশ্ন, অর্থাৎ, শ্রেণী দ্বন্দ্ব পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্ন অর্থাৎ জাতীয় দ্বন্দ্বের চেয়ে গৌণ ছিল। জাতীয় দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে সমগ্র বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সর্বহারাদের নেতৃত্ব না থাকায় বুর্জোয়া, সাম্রাজ্যবাদীরা ও সম্প্রসারণবাদীরা এর সুযোগ গ্রহণ করে এবং পূর্ববাংলা দখল করে নেয়।

পূর্ববাংলায় যখন জাতীয় সংগ্রাম প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে তখন স্ট্যালিনের উদ্ধৃতির অংশ গোপন করে জাতীয় প্রশ্ন পরিত্যাগ করা কি সচেতনভাবে সর্বহারা শ্রেণী ও বাঙালী জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয়?

পক্ষান্তরে মহান গণচীন, চৌএনলাই, পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীফেংপি এবং অন্যান্যরা পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্নের কথা স্বীকার করেছেন এবং বাইরের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই এর সমাধান পাকিস্তানের সরকার ও পূর্ববাংলার জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা আরও বলেছেন, পূর্ববাংলার জাতীয় সমস্যার সুযোগ নিয়েছে সম্প্রসারণবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা।

বর্তমানে তাদের কেউ কেউ বলছে পূর্ববাংলা ভারতের উপনিবেশ, কেউ কেউ বলছে পূর্ববাংলা সোভিয়েতের উপনিবেশ।

অতীতে তার যুক্তি দেখিয়েছে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলার উপর উপনিবেশিক শোষণ চালাতে পারে না যেহেতু পাকিস্তান আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ।

ভারতও আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ, ভারত পূর্ববাংলায় তার উপনিবেশ কায়েম করেছে। তাদের যুক্তি যদি সঠিক হতো তবে ভারতের পক্ষেও উপনিবেশ কায়েম করা যায় না।

হক-তোয়াহা এভাবে নিজেদের যুক্তিকে নিজেরাই খণ্ডন করেছে।

হক-তোয়াহা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দিয়ে সকল সমস্যার বিচার বিশ্লেষণ না করে ভাববাদ, অধিবিদ্যা এবং ঐতিহাসিক ভাববাদ দ্বারা সমস্যার বিচার করেছে। এবং প্রতি প্রশ্নে জনগণের ও সর্বহারাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

হক-তোয়াহা তাদের কর্মসূচীতে ২৬ পাতায় বিপ্লবের জন্য তিনটি অস্ত্র নিম্নভাবে উল্লেখ করেছেঃ

ক) মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও-এর চিন্তাধারায় সুসজ্জিত একটি শক্তিশালী বিপ্লবী পার্টি গঠন, সর্বপ্রকার সুবিধাবাদ, দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী, বিশেষ করিয়া আধুনিক সংশোধনবাদের কবর রচনা করিয়াই এইরূপ পার্টি গড়িয়া তুলিতে হইবে।

খ) শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির নেতৃত্বে সমস্ত সাম্রাজ্যবাদ ও মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক পুঁজি বিরোধী শ্রেণী সমূহের সমন্বয়ে গঠিত বিপ্লবী ঐক্যফ্রন্ট গঠন।

গ) গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী ঘাঁটি গঠন। কারণ শহরের তুলনায় গ্রাম হইল শত্রুর দুর্বল স্থান। গ্রামকে ভিত্তি করিয়াই শহর ঘেরাও এবং দখল এইভাবে গোটা দেশে বিপ্লব জয়যুক্ত করা।

ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সংশোধনবাদী নেতৃত্ব কর্তৃক অনুসৃত তিনটি করণীয় নিম্নরূপঃ

১। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পতাকা

২। পার্টি গঠনের পতাকা

৩। ১৯৪৫–এর আগষ্ট বিপ্লবের পতাকা।

উপরোক্ত দুটো “করণীয়” নিম্নে উল্লিখিত সভাপতি মাও-এর তিনটি করণীয়ের সাথে তুলনীয়ঃ

“সুশৃংখলিত, মার্কসবাদ-লেনিনবাদে সুসজ্জিত, আত্মসমালোচনার পদ্ধতি প্রয়োগকারী ও জনগণের সাথে যুক্ত একটি পার্টি; এমন একটি পার্টির নেতৃত্বাধীন একটি সৈন্যবাহিনী; এমন একটি পার্টির নেতৃত্বে সকল বিপ্লবী শ্রেণী ও বিপ্লবী দলের একটি যুক্তফ্রন্ট—এই তিনটি হচ্ছে আমাদের শত্রুকে পরাজিত করার প্রধান অস্ত্র।”

হক-তোয়াহা ও ইন্দোনেশিয়ার সংশোধনবাদীরা সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিয়েছে।

এভাবে তারা সশস্ত্র সংগ্রামকে বিরোধিতা করেছে।

তারা সুশৃংখল, আত্মসমালোচনা, জনগণের সাথে যুক্ত—এর মত পার্টি গঠনের মৌলিক বিষয়সমূহ বাদ দিয়ে দিয়েছে।

হক চক্র ১৮/১২/৭১ তারিখের দলিলে তিনটি করণীয়কে উল্লেখ করেছে নিম্নভাবেঃ

ক) মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সজ্জিত সুদৃঢ় পার্টি;

খ) পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী;

গ) পার্টির নেতৃত্বে প্রতিরোধের ঘাঁটি।

এখানে তারা ঐক্যফ্রন্ট যা বিপ্লবের বিজয়ের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র তা বাদ দিয়ে দিয়েছে।

পার্টি গঠনে এখানেও তার সুশৃংখলিত, সমালোচনা-আত্মসমালোচনা ও জনগণের সাথে যুক্ত—এর মত মৌলিক বিষয় বাদ দিয়েছে।

ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বের কথা তারা কখনও উল্লেখ করেনি। এভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ববাংলার উপর হামলা এবং পূর্ববাংলা গ্রাস ও নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনাকে তারা কখনো উল্লেখ না করে জনগণকে অপ্রস্তুত রাখে। “পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন” তার থিসিসে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বকে পূর্ববাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব বলে উল্লেখ করে।

ঘটনাবলী পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিশ্লেষণের সঠিকতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ করেছে।

তারা আমাদের ব্যঙ্গ করে বলেছে তাহলে বার্মার সাথে পূর্ববাংলার দ্বন্দ্ব কেন মৌলিক হবে না। একথা বলে তারা সম্প্রসারণবাদের প্রকৃত শ্রেণী বিশ্লেষণ করতে এবং সম্প্রসারণবাদের অর্থ বুঝতে নিজেদের অক্ষমতা প্রমাণ করেছে। সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রথম দিকে তারা উল্লেখ করেনি। পরবর্তীকালে উল্লেখ করলেও পূর্ববাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব হিসেবে উল্লেখ না করে নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে জাহির করার উদ্দেশ্যে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে কিছু গাল দেয়।

পক্ষান্তরে, পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রথম থেকেই তার থিসিসে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বকে পূর্ববাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব বলে উল্লেখ করেছে। পূর্ববাংলার সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় ইহাও ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

হক-তোয়াহা-বশির এতদিনে কবরস্থ হতো যদি না তারা ভারতের মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের প্রতারিত করে তাদের সুনাম ও সমর্থন ব্যবহার করতে সক্ষম হতো।

বস্তুর বিকাশের কারণ আভ্যন্তরীণ। ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীদের সুনাম ব্যবহার করেও তারা সুবিধা করতে পারেনি। কারণ সারবস্তুগতভাবে তারা বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল সংশোধনবাদী।

তারা মারাত্মকভাবে অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত, বিভক্ত এবং সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে। হক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নামধারী একটি উপদল গঠন করেছে। তোয়াহা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নামধারী অপর একটি উপদল গঠন করেছে। তারা একে অপরকে মিথ্যাবাদী, বিভেদপন্থীবাদী, চক্রান্তকারী, সংশোধনবাদী বলে অভিযোগ ও পালটা অভিযোগ করছে এবং নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ আরও অধিকতর সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরছে।

এদের মধ্যকার বদরুদ্দিন-নজরুল-অমলসেন ‘সংহতি কেন্দ্র’ নামে অপর এক উপদল গঠন করেছে।

এভাবে শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের প্রবল ঝড়-তরঙ্গে তাদের মুখোশ অনেকখানি উন্মোচিত হয়েছে। তাদের প্রতারণা সর্বহারা বিপ্লবীরা উপলব্ধি করেছেন। ভারতীয় সর্বহারা বিপ্লবীরাও অচিরেই তাদের প্রতারণা বুঝতে সক্ষম হবেন। পূর্ববাংলার ও ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীরা তাদের ঝেড়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবেন।

মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চেবাদী

এরা মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদী পার্টির সাথে যুক্ত ছিল। সাধারণ সর্বহারা বিপ্লবী কর্মীদের, সংশোধনবাদ বিরোধী বিদ্রোহের সুযোগ গ্রহণ করে হক-তোয়াহাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে নয়া সংশোধনবাদী উপদল গঠন করে এবং সাধারণ কর্মী ও জনগণকে প্রতারিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়।

হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সাধারণ কর্মীদের বিরোধিতার সুযোগ গ্রহণ করার জন্য তারা তাদের প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য নিয়ে হাজির হয়। তারা পূর্ববাংলাকে ধনতান্ত্রিক সমাজ বলে বিশ্লেষন করে এবং এ ভুল রাজনীতির পিছনে পার্টি কর্মী ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে।

এই বক্তব্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই উপসংহার টানা যায় যে, পূর্ববাংলার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে, গ্রামে সামন্তবাদী শোষণ নেই বা গৌণ, সেখানে পুঁজিবাদ বিকাশ লাভ করেছে এবং প্রাধান্য পেয়েছে, দেশে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ নেই, আমলাতান্ত্রিক পুঁজির শোষণ নেই। পূর্ববাংলায় ধনতান্ত্রিক শোষণ প্রধান হলে তার সমাধান হিসেবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার কর্মসূচী গ্রহণের কর্মসূচী গ্রহণের প্রশ্ন আসে।

ইহা হলো সমাজের বর্তমান স্তরকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের করণীয়কে বর্তমানে সম্পন্ন করা। ইহা ট্রটস্কীবাদী ভুল। ইহা প্রমাণ করে—সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রয়োগের পরিবর্তে আধুনিক ও পুরনো সংশোধনবাদীদের মতো তারা প্রয়োগ করেছে ঐতিহাসিক ভাববাদ।

এই ভুল ও প্রতিক্রিয়াশীল ট্রটস্কীবাদী রাজনৈতিক লাইনে তার একগুঁয়েভাবে লেগে থাকে, শক্তিশালী দুর্গ ও উপদল গঠন করে, এই বক্তব্যে বিশ্বাসী দেবেন-বাসারদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উপদলের মধ্যে গোপনে ভ্রূণ উপদল গঠন করে।

হক-তোয়াহারা তাদেরকে বহিষ্কার করে।

মতিন-আলাউদ্দিনরা তখনই শেষ হয়ে যেত যদি না দেবেন-বাসার তাদেরকে ছত্রছায়া দিত এবং হক-তোয়াহাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সাধারণ কর্মীদের মাঝে বিদ্রোহ হত।

মতিন-আলাউদ্দিনরা কৃষক সমিতি, ন্যাপ প্রভৃতি আঁকড়ে থাকে এবং প্রকাশ্য সংস্কারবাদী কার্যকলাপ চালায়।

তারা মাহবুবুল্লাহ, আকাম ফজলুল হক, আমজাদ প্রভৃতি চেবাদীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়।

তারা “ধনতান্ত্রিক শোষণ প্রধান”—এই ট্রটস্কীবাদী বক্তব্য আত্মসমালোচনা সহকারে বর্জন না করেই পূর্ববাংলার সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, শ্রেণী শত্রু খতমের কথা অর্থাৎ, হক-তোয়াহাদের অনুরূপ কথা বলে এবং দেবেন-বাসারদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে “পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি” গঠন করে নিজেদের পার্টি-কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং ‘নকশাল’ হিসেবে জাহির করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়।

তারা পূর্ববাংলার জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে গ্রহণ না করে শ্রেণী দ্বন্দ্বকে প্রধান বলে বর্তমানের রাজনৈতিক করণীয়কে বাদ দেয় এবং সমাজের স্তরকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের করণীয়কে বর্তমানে টেনে আনে। এভাবে তারা ট্রটস্কীবাদী ভুল করে।

এর ফলে জাতীয় পতাকা তারা তুলে দেয় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং পূর্ববাংলার আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের হাতে।

তারা হক-তোয়াহাদের অনুরূপ ভুল করে এবং দর্শনের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পরিবর্তে অনুসরণ (করে) ভাববাদ ও অধিবিদ্যা, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পরিবর্তে ঐতিহাসিক ভাববাদ।

তাদের বিশ্বাসঘাতক রাজনৈতিক লাইন থেকে উদ্ভূত হয় বিশ্বাসঘাতক সাংগঠনিক পদক্ষেপসমূহ।

পঁচিশে মার্চের পূর্বে ও পরে তারা পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে আঁতাত করে। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা তাদের গ্রেপ্তার হলে ছেড়ে দেয়, তাদের চলাফেরার সুযোগ দেয়, তাদের ওপর নির্যাতন পরিহার করে।

তারা গোপনে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের সহযোগিতা করে। তারা শ্রেণী শত্রু খতমের নামে জনগণের বাড়ীতে ডাকাতি করে, তাদেরকে হত্যা করে। জনগণ তাদেরকে ডাকাত হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং তাদেরকে প্রতিরোধ করে ও তাদের কয়েকজনকে হত্যা করে। তাদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত ঐ এলাকা থেকে তারা উৎখাত হয়।

পঁচিশে মার্চের পর তারা পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং দেবেন-বাসার ও মতিন-আলাউদ্দিন একে অপরকে বহিষ্কার করে।

মতিন-আলাউদ্দিন নিজেদের শেষ রক্ষার জন্য মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নামধারী উপদল গঠন করে।

মতিনদের প্রকৃত কদর্য চেহারা অনেকখানি প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তারা মারাত্মকভাবে একঘরে হয়ে পড়েছে। তারা হক-তোয়াহাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদেরকে বাঁচাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

তারা পার্টি-কর্মীদের মধ্যে সামন্তবাদী পদ্ধতিতে আত্মীয়ের সম্পর্ক স্থাপন করে উপদল বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।

তারা “পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন” ও তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা ও অপবাদ রটিয়েছে। এমনকি সিআইএর সাথে যুক্ত বলেছে।

পূর্ববাংলার ‘স্বাধীকার’, ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা” প্রভৃতি কথা বলে তারা নিজেদেরকে জাতীয় নিপীড়ন বিরোধী, স্বাধীনতা সমর্থক হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করে এবং নিজেদের তাত্ত্বিক দেউলিয়াত্ব আরও পরিষ্কার করে।

জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার মধ্যেই জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা রয়েছে। কোনটা প্রধান তা নির্ণিত হবে সমাজে কোন দ্বন্দ্ব প্রধান তা দ্বারা। তারা সামন্তবাদকে প্রধান শত্রু এবং সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব প্রভৃতি বলেছে, স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধান। অতএব স্বাধীন অর্থাৎ, জাতীয় বিপ্লব গৌণ।

কাজেই ‘স্বাধিকার’, ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’র দাবী তাদের প্রধান দ্বন্দ্ব এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামরিক লাইনের সম্পূর্ণ উলটো ছিল।

দেবেন-বাসার ট্রটস্কী-চেবাদী

এরা মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিল। পরে সংশোধনবাদবিরোধী সাধারণ কর্মীদের বিদ্রোহের সুযোগ গ্রহণ করে হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিনের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নয়া সংশোধনবাদী উপদল গঠন করে।

এরা “পূর্ববাংলায় ধনতান্ত্রিক শোষণ প্রধান”—এ প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্যের অনুসারী ছিল। এ বক্তব্যের জন্য তারা কখনো আত্মসমালোচনা করেনি।

পূর্ববাংলার উপর জাতীয় নিপীড়নকে স্বীকার করেও তারা তত্ত্বগত দেউলিয়াত্বের কারণে সুবিধাবাদের সাথে আপোষ করে এবং মতিন-আলাউদ্দিনের ঐক্যে সুযোগ দেয় এবং তাদেরকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করে।

মাহবুবুল্লাহ-আমজাদ চেবাদীদেরকেও তারা ঐক্যের সুযোগ দেয়। এভাবে নীতিকে বিসর্জন দিয়ে সুবিধাবাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদেরকেও সুবিধাবাদী বলে প্রমাণ করে।

মতিন-আলাউদ্দিনদের সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, শ্রেণী শত্রু খতমের লাইন পুরোপুরি মেনে না নিয়ে তারা উপদলের মাঝে উপদল হিসেবে বিরাজ করে।

ইহা প্রমাণ করে, তাদের মধ্যকার ঐক্য রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ঐক্য ছিলনা, তাদের ঐক্য ছিল সুবিধাবাদের ভিত্তিতে।

ইহা প্রমাণ করে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি সংক্রান্ত জ্ঞান তাদের আদৌ নেই। শেষ পর্যন্ত তারা পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং পঁচিশে মার্চের পর ভারতে পলায়ন করে।

ভারতে তারা জ্যোতিবসু ও নাম্বুদ্রিপদ সংশোধনবাদীদের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয়। ইহা প্রমাণ করে সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদ সম্পর্কে তাদের আপোষের চরিত্রকে। আরও প্রমাণ করে, আত্মত্যাগ ও ও জনগণের উপর নির্ভরতার ভিত্তিতে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায় তাদের অক্ষমতাকে।

তার কাজী-রণো ষড়যন্ত্রকারী এবং মার্কসবাদী নামধারী কতগুলো বুর্জোয়া উপদলের সাথে নীতিহীন ঐক্য স্থাপন করে এবং তথাকথিত “জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করে।

সর্বহারারা উপদলের অস্তিত্বকে কখনও স্বীকার করে না। বরঞ্চ এর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আপোষহীন সংগ্রাম করে। উপদলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অর্থ হচ্ছে মার্কসবাদের পার্টি সংক্রান্ত মৌলিক নীতিকে বিসর্জন দেয়া। এভাবে তারা মার্কসবাদের পার্টি সংক্রান্ত মৌলিক নীতিকে বিসর্জন দিয়েছে।

সমন্বয় কমিটি গঠন করে ঐক্যফ্রন্ট সংক্রান্ত তাদের অজ্ঞতার কথা প্রমাণ করেছে। পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রচণ্ড ফ্যাসিস্ট হামলা, জনগণের মহান প্রতিরোধ ও ভূমিকা, সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ এবং ছয় পাহাড়ের দালালদের প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ এ সময়কার প্রচণ্ড ঝড়তরঙ্গে তারা সম্পূর্ণ বিগড়ে যায় এবং তাদের প্রকৃত ক্ষুদে বুর্জোয়া চরিত্র প্রকাশ পায়।

তারা মহান চীনা সর্বহারা এবং ভারত ও অন্যান্য দেশের সর্বহারাদের সঠিক ভূমিকাকে বিরোধিতা করে।

তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী কুকুর ছয় পাহাড়ের দালালদের নেতৃত্বে প্রগতিবিরোধী প্রতিবিপ্লবী জাতীয় পরাধীনতার যুদ্ধকে সমর্থন করে।

তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ববাংলা দখল স্বাগত জানায়; ভারতের তাবেদার বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে স্বাগত জানায়, প্রকাশ্যে চীনকে বিরোধিতা করে।

পূর্ববাংলায় জাতীয় প্রশ্নে বৈদেশিক হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানায় এবং সত্যিকার সর্বহারাদের নেতৃত্বে জাতীয় সংগ্রাম ব্যাহতকারী, সর্বহারা বিপ্লবীদের হত্যাকারী, পূর্ববাংলার জনগণ এবং বাঙালী জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী ছয় পাহাড়ের দালাল ফ্যাসিস্টদের সমর্থন করে। এভাবে তারা পূর্ববাংলায় সম্প্রসারণবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের পদলেহী কুকুর ছয় পাহাড়ের দালালদের তল্পীবাহকে পরিণত হয় এবং পূর্ববাংলা ও বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।

তারা সশস্ত্র সংগ্রামকে বাদ দিয়ে পার্লামেন্টারী নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেয়, বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে স্বীকার করে, সম্প্রসারণবাদীদের স্বাগত জানায়, চীনকে বিরোধিতা করে, জ্যোতিবসু-নাম্বুদ্রিপদের অনুসরণে প্রকাশ্যে পার্টি গঠনের প্রতিক্রিয়াশীল জনমত সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায়।

তারা এতদূর নাকে খত দেয় যে, দেবেন সিকদার ছয় পাহাড়ের দালালী, জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা, ফ্যাসিবাদী শাসন ও লুন্ঠনের স্তম্ভ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ অর্থাৎ, মুজিববাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে।

তারা শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্য কমিনিউনিস্ট পার্টি নামধারী বুর্জোয়া উপদল গঠন করে।

এভাবে তাদের সাথে যুক্ত আন্তরিক বিপ্লবীদেরকে ছয় পাহাড়ের দালাল ফ্যসিস্ট বাহিনীর সামনে প্রকাশ করে দেয় এবং তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে ফেলে। তাদের এ সকল জঘন্য কার্যকলাপ তাদের কবরে যাওয়ার পদক্ষেপকে ত্বরান্বিত করেছে।

দেবেন-বাসার আমাদের সম্পর্কে বলে যে, আমাদের রাজনীতি ঠিক, কিন্তু আমরা জনগণের সাথে যুক্ত নই, আমরা ট্রটস্কীবাদী।

একথা বলে তারা প্রমাণ করছে যে, মার্কসবাদের ক-খ-গ সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই, তারা ভাববাদী।

যারা ট্রটস্কীবাদী তারা কখনও রাজনীতিতে ঠিক হতে পারে না। তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বদাই বিচ্যুতি ঘটাবে। কাজেই আমরা যদি ট্রটস্কীবাদী হই তবে অবশ্যই আমরা রাজনীতিতে ঠিক হতে পারি না। এভাবে তারা নিজেরাই নিজেদের বক্তব্যকে খণ্ডন করছে।

সভাপতি মাও বলেছেন, “মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে? সেগুলো কি আকাশ থেকে পড়ে? না। সেগুলো কি নিজের মনে সহজাত? না। মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কেবলমাত্র সামাজিক অনুশীলন থেকেই আসে; সমাজের উৎপাদনের সংগ্রাম, শ্রেণীসংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা—এই তিনটা অনুশীলন থেকেই সেগুলো আসে।

ইহাই ব্যক্ত হয়েছে সভাপতি মাওয়ের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী কর্মপদ্ধতি গণলাইনের মাধ্যমে, “আমাদের পার্টির সমস্ত বাস্তব কাজকর্মে সমস্ত নির্ভুল চিন্তাধারার নেতৃত্ব অপরিহার্যভাবে হচ্ছে জনসাধারণের থেকে আসা এবং জনসাধারণের নিকট নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।

আমরা জনসাধারণের সাথে যুক্ত হয়ে তাদের উৎপাদনের সংগ্রাম, শ্রেণী সংগ্রাম এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মহান অনুশীলনের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছি। তাকে সুব্যবস্থিত মতে রূপান্তরিত করেছি, (রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক এবং অন্যান্য লাইনে) তা পুনরায় জনসাধারণের নিকট গিয়ে কার্যকরী করেছি, এ প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে আমাদের সঠিক রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক লাইন।

আমরা রাজনীতিতে ঠিক কিন্তু জনগণের সাথে যুক্ত নই—এ কথার অর্থ আমাদের সঠিক রাজনৈতিক লাইন আকাশ থেকে পড়েছে বা সহজাত। ইহা পরিষ্কার ভাববাদ; ‘বস্তু থেকে চেতনা আসে’ এই বস্তুবাদী নীতির পরিপন্থী ‘চেতনা সহজাত, বস্তুনির্ভরশীল নয়’—এই ভাববাদী তত্ত্ব।

তাদের এই বক্তব্য দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও গণলাইনের কাজের পদ্ধতির বিরোধী।

পূর্ববাংলার সর্বহারা শ্রেণীর সত্যিকার বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য “পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন” প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর কারণ, পূর্ববাংলায় যে সকল কমিউনিস্ট নামধারী বুর্জোয়া উপদল ছিল, তারা সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধি বা বিপ্লবী ছিল না; তারা বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী বুর্জোয়া উপদল ছিল।

দেবেন-বাসার আমাদের সঠিক বলেও আমাদের সাথে শর্তহীনভাবে যোগ না দিয়ে বয়সকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বলছে, এখানে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ছিল এবং তারা তার প্রতিনিধি। এটাকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানা জারী করা।

একথা দ্বারা ‘পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন’ ও সর্বহারা পার্টিকে তারা বিরোধিতা করছে এবং বয়সের জোরে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব দাবী করছে এবং আমাদেরকে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে বলছে।

এভাবে তারা প্রমাণ করছে তারা ভাগ্যান্বেষী ও নেতৃত্বলোভী।

তারা তাদের কার্যকলাপ দ্বারাই নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানা জারী করেছে, পূর্ববাংলার জনগণ ও বিপ্লরীরা অচিরেই তাদেরকে চূড়ান্তভাবে কবরস্থ করবে। তাদের এ সকল জঘন্য কার্যকলাপ তাদের কবরে যাওয়ার পদক্ষেপকে ত্বরান্বিত করছে।

কাজী-রণো-মেনন ষড়যন্ত্রকারী

এরা ব্যক্তিগত কোন্দলকে রাজনৈতিক রূপ দেয় এবং ছাত্র ইউনিয়নের বিপ্লবীদের প্রতারিত করে এবং ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করে তার নেতৃত্ব কব্জা করে।

তারা প্রথমে হক-তোয়াহাদের সাথে যুক্ত হয়, কিন্তু নেতৃত্ব ও ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব বাধলে তারা বিভিন্ন সংগঠনে নেতৃত্ব দখলের জন্য জঘন্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়।

তারা মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে সভাপতি মাও-এর পাগলামী বলে উল্লেখ করে একে বিরোধিতা করে এবং লিউশাউচিকে সমর্থন করে।

এরা নকশালবাড়ীর মহান কৃষক বিদ্রোহকে বিরোধিতা করে এবং একে সিআইএ’র কারবার বলে উল্লেখ করে।

এরা মতিন-আলাউদ্দিনের সাথে যুক্ত হয় এবং তাদের সাথে কাজ করে। পরবর্তীকালে ক্ষমতার কারণে তার সরে আসে। পুনরায় হক-তোয়াহাদের সাথে জড়িত হয়।

ইতিমধ্যে এরা ট্রেড ইউনিয়নের একাংশ, ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ দখল করে।

তারা তাদের চক্রান্ত আরও সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য কমিউনিস্ট সমন্বয় সাধন কমিটি গঠন করে।

রাজনীতি হিসেবে তারা উত্থাপন করে পূর্ববাংলার উপর জাতীয় নিপীড়নকে বিজাতীয় শোষণ বলে। এভাবে শত্রুকে চিহ্নিত না করে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত নিজেদেরকে নকশাল হিসেবে জাহির করার জন্য কৃষকের সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব, শ্রেণী শত্রু খতমের কথা বলে।

এভাবে তারা হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিনের অনুরূপ ভুল করে। তারা পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক হাজার একটা কুৎসা, অপবাদ ও গুজব রটনা করে, এমনকি একে সিআইএ’র এজেন্ট বলে প্রচার করে।

তার পঁচিশে মার্চের পর ভারতে যায়, জাতীয় দ্বন্দ্বকে বিনা আত্মসমালোচনায় প্রধান দ্বন্দ্ব বলে, জ্যোতিবসু-নাম্বুদ্রিপদের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয় এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটিতে যোগ দেয়। এভাবে তারা দেবেন-বাসারদের অনুরূপ কাজ করে।

তারা ছয় পাহাড়ের লেজুড়বৃত্তি করে, নিজেদের সাংগঠনিক স্বতন্ত্রতা বিসর্জন দেয়, “মুক্তি বাহিনী”তে যোগ দেয় এবং প্রতিবিপ্লবী জাতীয় পরাধীনতার যুদ্ধ করে। তাদের নিজেদের কোন স্বতন্ত্র গেরিলা গ্রুপ ছিলনা একথা তারা প্রকাশ্য বক্তব্যে স্বীকার করেছে।

তারা পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীদের নিরস্ত্র ও খতম করার কাজে কয়েক স্থানে ‘মুক্তি বাহিনী’র ফ্যাসিস্টদের সাথে শরীক হয়।

পূর্ববাংলায় ভারতের উপনিবেশ স্থাপনকে তারা স্বাগত জানায়। পূর্ববাংলার পুতুল সরকারকে তারা স্বাগত জানায়। তারা প্রকাশ্যে পার্টি তৎপরতা চালায়। ফলে তাদের সাথে যুক্ত খাঁটি বিপ্লবীরা বিপদগ্রস্থ হয়।

এরা ছয় পাহাড়ের দালালদের কর্তার নির্দেশে অস্ত্র জমা দেওয়া সমর্থন করে। এভাবে তাদের মধ্যকার সত্যিকার বিপ্লবীদের নিরস্ত্র করে। তারা প্রকাশ্যে চীনকে বিরোধিতা করে।

বর্তমানে তারা জ্যোতিবসু-নাম্বুদ্রিপদের অনুসরণে প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট নামধারী বুর্জোয়া উপদল গঠনের পাঁয়তারা করছে।

তারা পূর্ববাংলার সর্বহার পার্টির বিরুদ্ধে জঘন্য অপপ্রচার করেছে।

মাহবুবুল্লাহও বর্তমানে কাজী-রণোদের মতো কার্যকলাপ চালাচ্ছে।

পূর্ববাংলায় দাঁড়কাক ও ময়ূরের গল্প রয়েছে। দাঁড়কাক নিজেকে ময়ূর সাজাবার জন্য ময়ূরের পালক গায়ে লাগায়। কিন্তু ময়ূরের ঠোকর লেগে তার সব পালক পড়ে যায় এবং প্রকৃত দাঁড়কাকের কালো চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং সে পালায়।

এ সকল বুর্জোয়াদের এজেন্ট বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী নেতৃত্ব মার্কসবাদের পালক গায়ে লাগিয়ে নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে জাহির করা এবং সর্বহারা বিপ্লবী ও জনগণকে প্রতারিত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রচণ্ড বিপ্লবী ঝড়তরঙ্গে তাদের পালক খসে পড়ে। তাদের প্রকৃত বুর্জোয়াদের প্রতিনিধির কদর্য চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ে।

হক-তোয়াহা-বশির নিজেদেরকে পূর্ববাংলার লিউশাউচী-ক্রুশ্চেভ হিসেবে তুলে ধরেছে।

দেবেন-বাশার-কাজী-রণো নিজেদেরকে জ্যোতিবসু-নাম্বুদ্রিপদ হিসেবে তুলে ধরেছে।

মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চে হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করেছে।

সভাপতি মাও বলেছেন, “ধ্বংসোন্মুখ শত্রুকে তাড়া কর এবং চূড়ান্তভাবে ধ্বংস কর।” আমরা অবশ্যই এ ধ্বংসোন্মুখ শত্রুদেরকে তাড়া করে চূড়ান্তভাবে কবরস্থ করব। এ সকল পুঁজিবাদের প্রতিনিধি কর্তাস্থানীয় বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে “বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত”—এ পতাকা ঊর্ধে তুলে ধরে বিদ্রোহ করব।

আসুন, আমরা সর্বহারা বিদ্রোহীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা এবং পূর্ববাংলার বিশেষ অনুশীলনে তার বিশেষ প্রয়োগের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হই, সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যকার অনৈক্যকে দূর করি, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সুসজ্জিত, সুশৃংখলিত, সমালোচনা-আত্মসমালোচনার পদ্ধতি প্রয়োগকারী, জনগণের সাথে যুক্ত, ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী এবং এককেন্দ্রীক পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি গড়ে তুলি।