বাংলাদেশের প্রহসন নির্বাচন বলতে কী বোঝায়?

লেখকঃ হাসন লাল

বাংলাদেশের সর্বশেষ ২০১৮ এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন কি সাজানো, নাকি ভোট ডাকাতি, নাকি ভোট চুরি ডাকাতি? মনে হয় সাজানো ও ভোটচুরিডাকাতিপুর্ণ নামেই ডাকা যায়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নির্বাচনই ছিল এরকম। ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ এবং ২০১৮ এসব নির্বাচন ছিল সাজানো ও ভোট চুরি ডাকাতিপূর্ণ। বুর্জোয়া-সামন্তদের বিভিন্ন গ্রুপিং এর মধ্যে এবং সেইসাথে তাদের বিদেশী প্রভু সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদীদের মধ্য আপোষের প্রতিফলন ঘটেনি। আর উক্ত আপোষের কমবেশি প্রতিফলন ঘটেছিল ১৯৯০, ১৯৯৬ এর জুন, ২০০১ এবং ২০০৮ এর নির্বাচনে। এই শেষোক্তগুলিতেও তাদের ভাষায় নানা অনিয়ম যথা নিজ নিজ প্রভাবাধীন এলাকায় ভোট চুরি ও ডাকাতি, অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব ইত্যাদি ঘটলেও শোষকদের সব গ্রুপিং এগুলো ‘সুষ্ঠু’ বলে মেনে নিয়েছিল। এই দুই ধরণের মধ্যে সাজানো ও ভোট চুরিডাকাতিপুর্ণ নির্বাচনের সংখ্যাই নিরংকুশ প্রাধান্যে রয়েছে।

২০০৭ সালের দিকে ফখরুদ্দিনের পরোক্ষ সামরিক শাসনের সময় ধরে নেয়া গিয়েছিল যে আবারো বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদী সামরিক শাসনের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু তা হয়নি। এর কারণ মনে হয় এটাই যে শোষকরা সম্ভব হলে একটা ‘জনপ্রিয়’ স্বৈরতান্ত্রিক সরকারই পছন্দ করবে এক ‘অজনপ্রিয়’ সামরিক সরকারের বদলে। তাই তারা ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের হাতে দীর্ঘমেয়াদী স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের সার্টিফিকেট তুলে দিল।

ভারত সম্প্রসারণবাদ ধীরে ধীরে এদেশে নির্ণায়ক নিয়ন্ত্রণ আরোপের দিকে পুনযাত্রা শুরু করে নব্বই দশকে ১৯৯৬ জুন নির্বাচনে আলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। পার্বত্য চট্রগ্রামে কথিত শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তার অনুগত চাকমা জাতীয়তাবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে ফিরিয়ে আনে। বিনিময়ে আলীগ সরকার ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলোকে বিতাড়িত করে, এদের নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করে কয়েক দশক ধরে। ভারতের সাথে বিভিন্ন চুক্তি করে যথা ফারাক্কা পানিবন্টন, ছিটমহল বিনিময়, ভারতকে ট্রানজিট প্রদান, বড় ধরণের ঋণচুক্তি। ভারত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উতপাদন কেন্দ্র নির্মাণঃ এমনকি সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপালের কয়লা ভিত্তিক এমন বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে ও বন্দর নির্মাণে ঋণ প্রদান করছে। আলীগের ওপর ভারত মোটামুটি সন্তুষ্ট। যদিও চীনের ঋণ গ্রহণের ব্যাপারটা তারা ভাল চোখে দেখছেনা। ভারতীয় চাল ডাল তেল নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্য, ফেন্সিডিল-মাদক, সিএনজি অটোরিকশা, মোটর যন্ত্রাংশ, বাস, রেল, সুতা, কাপড় ইত্যাদি বহুবিধ পন্যের বিরাট বাজার বাংলাদেশ। আলীগ মুসলিম ধর্মবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করায় ভারত খুশি, অপরদিকে বাজাদের জামাত ইসলামী সশ্লিষ্টতার কারনে এর ওপর অখুশি। তাই ২০১৪ ও ২০১৮র ডিসেম্বরের চৌর্যবৃত্তির নির্বাচনের মাধ্যমে আলীগের মসনদে গদীনশীন থাকা বজায় রাখার পিছনে ১ নম্বর বহিশক্তি এরাই।

দ্বিতীয় বহিশক্তি হচ্ছে রাশিয়া। বিগত শতকের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যের পতনের পর মার্কিন একক পরাশক্তি হিসেব দুনিয়ায় আধিপত্য করে কিছু দিন। অল্প কয়েক বছর পর মার্কিন এক ঘোরতর সংকটে পতিত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। এদিকে রাশিয়া একুশ শতকের প্রথম দশকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আর দ্বিতীয় দশকে পরাশক্তি হিসবে পুনরাবির্ভুত হয়। এরা আন্তর্জাতিকভাবে ইসলাম ধর্মবাদী সামন্তবাদী আই এসের উচ্ছেদে প্রধান ভুমিকা রাখে। বাংলাদেশে পুনপ্রবেশ করে বিরাট ঋণ সাহায্য নিয়ে যা রূপপুরে পারমানবিক চুল্লি তৈরিতে ব্যয় হবে। এছাড়া রুশ একচেটিয়া গ্যাস কোম্পানী গজপ্রম বাংলাদেশে ঢুকেছে। রাশিয়া বাংলাদেশকে মিশাইল, যুদ্ধ বিমান, ট্যাংক, অস্ত্রশস্ত্র, ট্রাকটর ইত্যাদি বিক্রী করে। রুশ পরাশক্তি আওয়ামী লীগের প্রতি সন্তুষ্ট কারণ তারা তাদের জন্য জায়গা তৈরি করেছে, তাদের শোষণের জাল বিস্তার করতে দিয়েছে, ইসলাম ধর্মবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাজাদ এর ওপর এরা অসন্তুষ্ট এর জামাতে ইসলামী সংশ্লিষ্টতার কারণে। আওয়ামী লীগ সরকারকে তাই তারা সার্টিফিকেট দিয়েছে বৈধ অবৈধভাবে গদিতে বজায় থাকতে।

তৃতীয় বহিশক্তি হচ্ছে চীন যাদের প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ সকলকে ছাড়িয়ে গেছে। যে ঋণ বাংলাদেশ শোধ করতে পারবেনা, শেষমেষ পাকিস্তান ও শ্রীলংকার মত কোন শহর বন্দর তাদের কাছে বেঁচে দিতে হবে। চীন এ শতাব্দীর ১ম দশকেই এক সাম্রাজ্যবাদি শক্তি হিসেবে আর ২য় দশকে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ এশিয়ার বহু দেশ চীনের ঋণের জালে বাঁধা পড়েছে-পড়ছে। বাংলাদেশও এই ফাঁদে পড়েছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলি টানেল, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ ব্যাপক নির্মাণ কাজ বাংলাদেশে চীন পরিচালনা করছে। চীনা ইলেক্ট্রনিকস পন্যের বিরাট বাজার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ চীন থেকে হালকা থেকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাংক, সাবমেরিন, ট্রেন, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, ট্রাক্টর, সেলাই মেশিন, যন্ত্রাপাতি ইত্যাদি বহুকিছু আমদানী করে। চীনের বিরাটাকার অনুপ্রবেশের সহায়ক হওয়ায় আলীগকে বৈধ-অবৈধভাবে স্বৈরাচারী শাসন বজায় রাখার সার্টিফিকেট চীন দিয়ে দিয়েছে। বাজাদকে চীন সমর্থন দেয়নি বাজাদের জামাত ইসলামী তথা ইসলামবাদী ধর্মবাদী সংশ্লিষ্টতার কারনে।

চতু্র্থ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। দীর্ঘকাল বা্ংলাদেশে পুঁজি ও ঋন বিনিয়োগ করে। এদেশের অধিকাংশ গাস ক্ষেত্রই এদের শেভরনের মত একচেটিয়া কোমপানির দখলে। বাংলাদেশের গ্রামিন মাঝারি, গরীব ও ভুমিহীন কৃ্ষকের ওপর অন্যতম বৃহত্তম শোষক গ্রামিন ব্যাংক এদের দালাল। এছাড়াও মার্কিনের বহু এনজি্ও এখানে কাজ করে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিলপের একটি বড় বাজার মার্কিন। রশ ভারতের দিকে ক্ষমতা ঘুরে গেলে মার্কিন বাংলাকে দেয়া জিএসপি সুবিধা বাতিল করে। পাকিস্তান আমলে মর্কিনের সাথে আলীগ দালালী চুক্তিবদধ হয। একাত্তরেও তারা অপ্রধানভাবে এ লাইন বজায় রেখেছিল। আলীগের প্রধান অংশ ভারত রুশের লাইন নেয়। আর ৭২-৭৫ সময়ে অপ্রধানভাবে মার্কিনের স্বার্থ বজায় রেখেছে। শেখ আলীগের পতন হলে মার্কিনের স্বার্থ প্রাধান্যে থাকে জিয়ার সামরিক-বাজাদ, এরশাদ সামরিক-জাপা, ১৯৯১-১৯৯৬ খালেদা বাজাদ আমল, অংশত হাসিনার ৯৬-২০০১ তারপর ২০০১-২০০৬ খালেদা বাজাদ আমল, তারপর ফখরুদ্দিনে্র সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২ বছর ২০০৬-৭ পর্যন্ত মার্কিন প্রাধান্য বজায় ছিল। ১৯৯০ দশকে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর দুনিয়ায় মার্কিনের একক আধিপত্য বজায় থাকে। তাররপর একুশ শতকে একদিকে মার্কিন সংকটে পড়ে আর রাশিয়া পুনরুতথিত হয়, ১ম দশকে সামরাজবাদ আর ২য় দশকে পরাশক্তিতে পরিনত হয়। এদিকে চীনও ২১ শতকের ১ম দশকে সামরাজবাদ আর ২য় দশকে পরাশক্তিতে পরিনত হয়। রুশ ও চীনকে একে একে জায়গা ছেড়ে দিতে হয মার্কিনকে। বিশে করে পশ্চিম এশিয়ায় রুশ আর পূ্র্ব এশিয়ায চীন এর উপসথি্তি মার্কিনের ভুমিকাকে খর্ব করেছে। বাংলায নিয়নত্রণ হারিযে ২০১৪ এর চৌর্য নির্বাচন মেনে নিতে পারেনি। বাজাদের মাধমে ফিরতে চায়। কিনতু বাজাদের জামআত সংশ্লিষটতা পছন্দ হয়না কারণ ইসলাম ধর্মবাদীদের নিযে তঅ্যাক্ত বিরক্ত সে। তাই ২০১৮ ডিসেমবরের চৌর্য নির্বাচনের জোরালো প্রতিবাদ করেনা। এদিকে চীন এর কারনে প্রশানত মহাসাগর তেকে পালাতে হচছে। দঃ পূর্ব এশিয়া থেকে বিতাড়িত মা্র্কিন বর্তমানে রোহিঙগা ইসু্তে আরাকান উদধার করে বাঙলাদেশের সাথে যুক্ত করে তার অবস্থান জোরদার করতে চায়।

৫ ক। পশ্চিম ইউরোপ বাংলার তৈরি পোষাক শিলপের বৃহত্তম বাজার। অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশি পোষাক ইউরোপে যায়। এখানে তাদের পুঁজি-ঋণ খাটে, মেশিন বিক্রি হয়। এরা নির্মাণ কাজও পায়। এরা এখনও মার্কিনের সাঙাত। মার্কিনের সাথে মিলে বাংলার গ্যাস লু্টছে । এরা মার্কিনের বিটিম। তাই বক্তব্য একই। বাংলাদেশে এদের অনেক লোক ধর্মবাদী আক্রমণের স্বীকার হয়েছে।
খ। জাপান বাংলাদেশে বিরাট পুঁজি-ঋণ খাটায়। এরা এখানে অনেক নির্মাণ কাজ পায়। মেট্রো রেলের মত বিরাট কাজ এরা পেয়েছে। এরা এখানে গাড়ি ও ইলেক্ট্রনিকস সামগ্রী বিক্রি করে। এখন মেট্রো ট্রেনও এখানে বিক্রির তালিকায়। এরা মার্কিন ইইউ বিশ্বব্যাংক আইএমএফের সাঙাত। বাংলাদেশে এদের অনেক কর্মকর্তা ধর্মবাদী আক্রমণের স্বীকার হয়েছে। তাই বাজাদের ধর্মবাদী সংশ্লিশষটতা তাদের ভাল লাগবেনা স্বাভাবিক। বিপরিতে আলীগ তাদের সন্তুষট করেছে। শোষণের ক্ষেত্র দিয়েছে। ভারতে এ ধরণের কাজে যে খরচ হয় তার চে তিগুন বেশি খরচে মেট্রোরেল করে নিচছ। আরো কত কি! তাই চোর্যবৃত্তি নির্বাচন তাদের কাছে অগ্রহণীয় হয়নি।
গ। দঃ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর বাংলাদেশের শ্রমিক খাটিয়ে মুনাফা করে। এরা এদেশে কিছু পুঁজিও খাটায়। কিছু নির্মাণ কাজও পায়। এরা এদেশে ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রি বিক্রি করে। এদের রাজনৈতিক ভুমিকা এখানে নেই।

৬। ইসলাম ধর্মবাদী সামন্তবাদী-পুঁজিবাদী সৌদী-আরব আমিরাত-পাকিস্তানের মত শক্তিগুলো। এরা জামাতে ইসলামীর,দ্বারা নির্বাচন বিজয়ের স্বপন দেখে। তাই বাজাদের উপর নির্ভর। ৭১ এ বহিষকৃত, নিন্দিত হওয়ার পর পুনরায় শেখ আলীগের দ্বারা এদেশে প্রবেশ পাকিস্তানের ধারাবাহিকতায়। তারপর জিয়া বাজাদ, এরশাদ-জাপা, খালদা বাজাদ, হাসিনা আলীগেরা এদের সেবা দিয়ে যাচছে। এরা ইসলামী ব্যাংকের মত ইসলামী নামের ব্যাংকের মারফত শোষণ চালায়। এরা দেশে সাম্প্রদায়িক দাংগা লুটতরাজ চালায়। সাম্প্রতিক কালে এরা দেশে ভয়াবহ ধর্মবাদী আগ্রাসন চালিয়ে অবশেষে আলীগের দ্বারা নিযন্ত্রিত হয়েছে। এরা দেশে মসজিদ মাদ্রাসা ধর্মীয় অসিলায় বিপুল অর্থ বিনিয়য়োগ করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে বাংলাদেশের বিরাট জনশক্তি সামান্য অর্থের বিনিময়ে কাজ করছে।এরা দেশে সামন্তততন্ত্রের বহি উৎস। এরা শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মকে যক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এদের লোকেরা প্রগতিশীল শক্তির ওপর হামলা করে, খুন জখম করে। এরা নারীদের উপর সীমহীন নির্যাতন চালায়। এরা দেশে কুসংস্কার ছড়ায়। এরা চৌর্য নির্বাচনে হাসিনাদের বিজয়ের পর বহুবিধ ইসলামবাদী দলকে দিয়ে হাসিনা আলীগের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। রোহিংগা ইসুতে ইসলাম ধর্মবাদ চাংগা করার একটা সুযোগ তারা পেয়েছে।

সুতরাং, বাংলাদেশের প্রহসন নির্বাচন বলতে কী বোঝায়?
বাংলাদেশের প্রহসন নির্বাচন বলতে আমরা বুঝলাম যে নির্দিষট সম্প্রসারণবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও বুর্জোয়া-সামন্ত গোষঠীর প্রাধান্য আগেই নিশিচিত হয়েছে অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ক্ষেত্র দখলের মধ্য দিয়ে। পরে নাটক মঞ্চস্থ করে এটা দেখানো যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদল হচছে। আসল ঘটনা আগেই ঘটে। পরে নাটক মঞ্চস্থ হয়। এটা এখানে প্রতিক্রিয়াশীল সংষকৃতির অংশ হয়ে গেছে। এ নিয়ে তারা গর্বিতও বটে!।।