প্রসঙ্গ ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ। বামপন্থীদের অবস্থান — নীলিম বসু

 

   এই লেখা যে সময় লিখছি তখন ছত্তিশগড়ে সালয়া জুড়ুমের নব পর্যায় ঘোষিত, মুম্বাইতে এক বহুজাতিক হীরে রপ্তানী সংস্থায় চাকরির আবেদন করে এক মুসলমান প্রার্থী জবাব পেয়েছেন যে ঐ কোম্পানী শুধু অমুসলমান নাগরিকদের চাকরি দেয় (যদিও এই নিয়ে সংবিধান অবমাননা, এফআইয়ার, কোম্পানীটির মধ্যে দায় এড়ানোর নাটক চলছে), দেশের দুটি রাজ্যে গোরু হত্যা নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে একটা বড় অংশের নাগরিকের রুটিরুজি ও খাদ্যাভ্যাসে হস্তক্ষেপ করা হয়ে গেছে, নিহত হয়েছেন কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের কর্মী, গত ১বছরে ঘটে গেছে কমবেশি ৫০০টি ছোটো বড় সাম্প্রদায়ীক হিংসা (পড়ুন সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমন), সংখ্যালঘু নিধনে অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস পেয়েছেন কোর্ট থেকে,‘ঘর ওয়াপসী’র নামক এক বিশাল ধর্মান্তকরন কর্মসূচী দেশজুড়ে চলমান ইত্যাদি। এর সাথে ভারতের লোক দেখানো সংসদকেও এড়িয়ে গিয়ে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে শাষক দলের ইচ্ছা অনুযায়ী আইন তৈরির এক ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে, বিপ্লবী আন্দোলন দমনে সেনা নামানোর হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে, গুজরাটে জারী হয়েছে ঘৃণ্য কালা কানুন (যা আজ বা কাল আমরা কেন্দ্রীয় স্তরেও দেখতে পাবো), কর্পোরেট ও রাষ্ট্রের হাত মেলানোর প্রমান কেন্দ্রীয় বাজেট (কৃষিতে ব্যায় বরাদ্দ্য কমানো, ১০০ দিনের কাজের মতো সামাজিক প্রকল্পগুলিতে যেটুকু ব্যায় বরাদ্দ্য ছিল তাও কমিয়ে একই সাথে কর্পোরেট বেল আউটে বরাদ্দ্যবৃদ্ধি ও গ্রামীন সামন্তশ্রেণীর বহুদিনের দাবী মেটানোর মাধ্যমে রাষ্ট্রের আধা সামন্ততান্ত্রিক-আধা ঔপনিবেশিক চরিত্রকে শক্তিশালী করার বাজেট)। এখনো হয়ে না উঠলেও ভারত একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হয়ে ওঠার দিকে যাচ্ছে তা পরিষ্কার। এমনিতেই ভারতের মতো দেশ তার ভৌগলিক অবস্থান, আয়তন, বাজারের কারনে চীরকালই সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই দক্ষিন এশিয়াকে নিয়ন্ত্রন করতে ভারত কখনো সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের আবার কখনো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দাবার বোড়ে, যার পোষাকী নাম ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনার’। সেই কারনেই ভারত রাষ্ট্রের সম্প্রসারনবাদী চরিত্র। ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে সেই কারনেই সুপ্ত থাকে ফ্যাসিবাদের বীজ সবসময়। ১৯৭৫ এর জরুরী অবস্থার সময়, এনডিএ প্রথম শাষনকালে যা প্রকাশিত হয়ে পড়ে নগ্নভাবে। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ও মদতেই ভারতের শাষক শ্রেণী নিজেদের ফ্যাসিষ্ট অহংকার অনুশীলন করার সুযোগ পায় প্রতিবেশী দেশগুলিতে ও নিজের দেশের মধ্যে।

     ব্যাপারটা ‘বাঁশবনে শেয়ালরাজা’র মতো হলেও পাত্তা না দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ‘চৈনিক ফ্যাসিবাদ প্রসঙ্গে’ দলিলে চৌ এন লাই লিখেছিলেন (এটি চীনের কমিউনিষ্ট পার্টির গৃহীত দলিল ছিল) “সারা বিশ্ব্ব আধিপত্যের স্বপ্ন এই ফ্যাসিবাদ দেখে না, তার সেই পরিকল্পনাও নেই, সেইটুকু বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ও দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দিক দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শাষন ফ্যাসিবাদের সমস্ত বৈশিষ্ট ধারন করে”। এই অবস্থায় বামপন্থীদের ভূমিকা কি হওয়া উচিৎ? অবশ্যই সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিদের একজোট করে (হিন্দু ফ্যাসিবাদ নামক ভারতীয় ফ্যাসিবাদের এই বিশেষ চরিত্রের জন্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির সাথে এখানে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে একজোট করার কর্তব্যও থেকে যায়) ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়াটা বামপন্থীদেরই দায়ীত্ব। আসুন একটু দেখা যাক ভারতে সংসদীয় এবং অসংসদীয় ধারার বামপন্থীরা কি ভূমিকা রাখছেন বা অন্তত পরিকল্পনা করছেন ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে। এখানে অসংসদীয় বামপন্থী বলতে তাদেরকেও ধরে নিচ্ছি যারা অন্তত মুখে বলেন যে অসংসদীয় সংগ্রামটাই প্রধান (কাজে কি করেন তা আলাদা ব্যাপার)।

     সংসদীয় বামেদের নিয়ে খুব কম কথা খরচ করলেই চলে, সিপিএম-সিপিআিইয়ের মতো দলগুলি তো বিপ্লব কথাটি শেষ কবে ব্যবহার করেছে তাই ভুলে গেছে। তাদের কাছে ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের রাস্তা হচ্ছে বিজেপি বিরোধী নির্বাচনী জোট গঠন করা আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে আর সরকার গড়তে ভেতর থেকে বা বাইরে থেকে কংগ্রেসকে সমর্থন করা। এই আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে বিজেপিবিরোধী ও কংগ্রেসবিরোধী তৃতীয় মোর্চার গল্পও তারা ফেঁদে থাকেন। যদিও ঐ আঞ্চলিক দলগুলির অনেকেই কোনো না কোনো সময় বিজাপি নের্তৃত্বাধীন এনডিএতে জোট শরিক ছিল। অবশ্য তাতে জোট গড়তে সিপিএম-সিপিআিইয়ের অসুবিধা না হওয়াটাই স্বাভাবিক কারন তারাই এক সময় বিজেপির সাথে হাত মিলিয়ে কেন্দ্রে ভিপি সিং সরকার তৈরি করেছিলেন, কোলকাতার ব্রিগেডে বিজেপির অটল বিহারী বাজপেয়ী ও জ্যোতি বসু একসাথে সভা করেছিলেন। বস্তুত হিন্দু ফ্যাসিবাদ নিয়ে কয়েকটা ভাষন দিলেও আর সঙ্ঘ পরিবারকে নিয়ে কিছু বই বা পিপলস ডেমোক্রাসীর পাতা ছাপলেও হিন্দু ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। নেই কারন শাষকশ্রেণীর পার্টিতে পরিনত হয়ে যাওয়ার পর সেই ভূমিকা রাখা আর সম্ভব নয়। এটা আমরা ইতিহাস থেকেই জানি যে ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় এলে বেশকিছু শাষক শ্রেণীর পার্টিও আক্রান্ত হয়, কিন্তু ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা তাদের থাকে না। সিপিএম-সিপিআইয়েরও সেই একই হাল। তবু এরই মধ্যে মজার ব্যাপার যেটা ঘটে চলেছে সেটা হলো সিপিআই (এমএল) লিবারেশান, যারা নিজেদের নকশালপন্থী-বিপ্লবী বলে এখনো দাবী করে থাকে তারাও সিপিএম-সিপিআিইয়ের সাথে নির্বাচনী জোট গড়াকেই হিন্দু ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের এক গুরুত্বপুর্ন পথ বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে শুরু করেছে। বিহার উপনির্বাচন ও ঝাড়খন্ড বিধানসভা নির্বাচনে তারা এই বলেই জোট গড়েছিল। অবশ্য গত লোকসভা নির্বাচনের আগেও তার বারানসী কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে আম আদমী পার্টি প্রার্থী অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে সমর্থন করে। নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার এই রননীতির ক্ষেত্রে বিশ্ব ইতিহাসের শিক্ষা না হয় বাদই দিলাম, শুধু ভারতের দিকে তাকালেই এর অসারতা বোঝা যায়। ১৯৭৭সালে একবার এই নীতি নিয়েছিলেন অনেকে, সেই প্রচেষ্ঠার মধ্যে দিয়েই সঙ্ঘ পরিবারের বাড় বাড়ন্ত শুরু হয়, ২০০৪ সালে এই যুক্তি (নাকি অপযুক্তি) নিয়েই সিপিএম-সিপিআিই কংগ্রেস নের্তৃত্বাধীন ইউপিএ-১ কে সমর্থন করে, ১০ বছর পরে হিন্দু ফ্যাসিবাদী শক্তি চার-পাঁচগুন শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে (যে টুকু প্রাসঙ্গিকতা আছে তাও রাজ্যসভায়, ২০১৭সালের মধ্যে সেটুকুও থাকবে কতটা সন্দেহ)। যদিও লিবারেশানের পক্ষ থেকে অন্তত মৌখিকভাবে বলা হয়ে থাকে যে নির্বাচনী জোটটা একটা কৌশলমাত্র, কিন্তু তাহলে নীতিটি কি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে নীরবতা বা তাদের পার্টি দলিলগুলির মতোই স্ববিরোধীতায় ভরা উত্তরই পাওয়া যায়।

   কোলকাতা থেকে প্রকাশিত কিছু ‘বামপন্থী’ পত্রিকা ফ্যাসিবাদকে কেন্দ্র করে তাদের বেশ কিছু সংখ্যা বার করেছে। তারা তাতে ফ্যাসিবাদ কম আর সিপিএম-সিপিআিইকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে দিতেই বেশি মনোযোগী। তাদের কাছে এখনো সিপিএম-সিপিআই প্রকৃত ও ভারতের একমাত্র বামপন্থী আশা ভরসা। নির্বাচনে জেতার জন্য সিপিএম-সিপিআইয়ের কি কি করা উচিৎ তা নিয়ে নানা প্রস্তাবের সাথে তারা শুধু সমস্ত ধরনের বামপন্থী-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে নিয়ে গণ আন্দোলনের কথা বলেছে ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে। মন্দের ভালো। কিন্তু সমস্যাটা হলো ভারতের বামপন্থী আন্দোলনের নেতা হিসাবে কেউ যদি আজো সিপিএম-সিপিআিইকেই ধরে বসে থাকে তাহলে তার বা তাদের রাজনৈতিক বোধ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে বা তাদের স্বার্থ নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয়। প্রভাত পট্টনায়েকের একটি লেখা মাঝে এমনই একটি পত্রিকা ‘দেশকাল ভাবনা’তে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে প্রভাতবাবু বর্তমান জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের কি করনীয় তা বিশদে লিখেছেন। যার মোদ্দা কথাটা হলো এখন বামপন্থীদের কিছুই করার নেই অপেক্ষা করা ছাড়া। বিষয়গত পরিস্থিতি ও বিষয়ীগত শক্তির যে যৌথ ভূমিকার কথা মার্কসবাদীরা বলে থাকেন তার থেকে বিষয়ীগত শক্তির ভূমিকাটিকে বেমালুম উড়িয়ে দিয়ে লেখাটি লিখেছেন প্রভাতবাবু (শোধনবাদ পার করেগা)। ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ যখন কর্তব্য তখন এই হচ্ছে ‘বামপন্থী’ বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয়তা।

   এবারে আসা যাক সেই বামপন্থীদের কথায় যারা অন্তত মৌখিকভাবে অসংসদীয় সংগ্রামকেই প্রধান বলে থাকেন। সিপিআই (এমএল) নিঊ ডেমোক্রাসী ও সিপিআই (এমএল) রেডস্টার তাদের কোনো লেখা বা কর্মসূচীতেই হিন্দু ফ্যাসিবাদের বিপদ দেখছে বলে বোঝাচ্ছে না। বরং যারা হিন্দু ফ্যাসিবাদের বিপদ দেখচে তাদেরকে তারা বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারকে বাড়িয়ে দেখা হচ্ছে বলে বলেছেন শোনা যাছে। ফলে এদের থেকে ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে কোনো ভূমিকার কথা আশা করাটাও সোনার পাথরবাটির মতো হয়ে যাবে। আর এমনিতেও নিজেদের ইউনিয়ান থাকা কিছু কারখানায় বছরে একবার মে দিবস, ২৫শে মে তে নকশালবাড়ীতে একটা জমায়েত আর বছরে একটা বা দুটো যৌথ মিছিল ছাড়া আর কোনো সক্রীয়তা এদের কোনোদিনই ছিল না। এছাড়া আছে পিসিসি সিপিআই(এমএল)। তাদের বিভিন্ন লেখা ও কর্মসূচী থেকে বোঝা যায় যে তারা হিন্দু ফ্যাসিবাদের বিপদ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছেন। এবং তারা সেটা প্রকাশ্যেই ঘোষনা করছেন। তারা হিন্দু ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে সমস্ত বামপন্থী-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে একজোট করে গণ আন্দোলনের কথা বলছেন। এলআইসিতে এফডিআই, কয়লা বেসরকারীকরন, জমি অর্ডিন্যান্স নিয়ে তারা যৌথ আন্দোলনের পথেও হাঁটছেন যাদের পাসে পান তাদের নিয়েই। খুবই সদর্থক কর্মসূচী। কিন্তু শুধু এইটুকুই কি যথেষ্ট ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে? ডিমিট্রভ তাঁর লেখায় ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে সোশাল ডেমোক্রাট থেকে অন্যান্য আক্রান্ত শাষক শ্রেণীর পার্টিগুলিকেও সাথে নিয়ে আন্দোলনের কথা বলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সশস্ত্র প্রস্তুতির কথাও বলেছিলেন। এই সশস্ত্র প্রস্তুতির পথে সবাই আসবে না কিন্তু যারা আসবে তাদের নিয়েই সশস্ত্র প্রস্তুতি প্রয়োজন। চৌ এন লাইয়ের সেই লেখাটায় আবার ফিরে যাই “ফ্যাসিবাদ একটি সশস্ত্র প্রতিবিপ্লব, যার মোকাবিলা করা যায় শেষ অর্থে একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে”। এই শিক্ষা কি মাথায় রেখেছেন পিসিসি সিপিআই (এমএল) এর কমরেডরা? কয়লা বেসরকারীকরন বিরোধীতায় ডাকা সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ানগুলির ধর্মঘটে পুলিশ-আধা সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক দলের পোষা গুন্ডাদের আক্রমনে ধর্মঘট বানচাল হয়ে যায়, সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তাটা এখানেই বোঝা যায়। ছত্তিশগড়ে সালয়া জুড়ুম প্রতিরোধে সেখানে ও দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধ্য গণ আন্দোলন নিঃসন্দেহে এক বড় ভূমিকা নিয়েছিল, কিন্তু তার সাথে সিপিআই (মাওবাদী)র নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিরোধের ভূমিকাটাই প্রধান ছিল। রনবীর সেনা-সানলাইট সেনার মতো সামন্ততান্ত্রিক বেসরকারী সেনাগুলির বিরুদ্ধেও তাই। সামন্ততান্ত্রিক বেসরকারী সেনা হলেও এদেরো যে বিভিন্ন সময়ে হিন্দু ফ্যাসিবাদীরা ব্যবহার করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে সেটা খুব পরিষ্কার। সিপিআই (মাওবাদী)র বিভিন্ন লেখাপত্রে ও কর্মসূচীতে এটা পরিষ্কার যে তারা হিন্দু ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্মন্ধে ওয়াকিবহাল ভালো ভাবেই। যদিও অনেকেই তাদের এই অবস্থান নিয়ে সচেতনভাবে বা না জেনে সংশয় ছড়াতে খুব তৎপর। যেমন সুমন্ত বন্দোপাধ্যায়, তিনি কয়েক মাস আগে ফ্রন্টিয়ার পত্রিকায় প্রকাশ করলেন সিপিআই (মাওবাদী)র সাধারন সম্পাদাক গনপতিকে উদ্দেশ্য করে এক খোলা চিঠি। যেখানে তিনি লিখলেন যে কর্মসূচীতে হিন্দু ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধকে এক গুরুত্বপুর্ন কাজ বললেও ২০০৮সালে ওডিশা্র কান্ধামালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা লক্ষীনন্দ স্বরসতীকে চরম শাস্তি (সুমন্তবাবু খুন কথাটা লিখলেও সেটির সাথে আমি একমত নই বলে চরম শাস্তি কথাটাই লিখলাম) দেওয়া বাদে মাওবাদীরা হিন্দু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আর কিছুই করেন নি।

কি মুশকিল, যে সালয়া জুড়ুমের আজ দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হতে চলেছে তার প্রথম পর্যায়টি হিন্দু ফ্যাসিবাদী আক্রমন ছাড়া আর কি ছিল? সঙ্ঘ পরিবারের কি ভূমিকা ছিল ওখানে তা কি সুমন্তবাবু জানেন না? রনবীর সেনা-সানলাইট সেনার মতো সামন্ততান্ত্রিক বেসরকারী সেনাগুলি যে হিন্দু ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে তাও কি তিনি জানেন না? নাকি এগুলিকে প্রতিরোধ করার পথে মাওবাদীদের ভূমিকা তিনি দেখেও না দেখে থাকতে চান? মোদী শপথ নেওয়ার পরপরই মাওবাদীরা প্রেস রিলিজ দিয়ে হিন্দু ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল। এবং সেই প্রেস রিলিজে গণ আন্দোলন ও সশস্ত্র পথে হিন্দু ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করার কথাও তারা বলেছিলেন। একদিকে সমস্ত বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে একজোট করা, দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ্য ফ্রন্টের কথা ও অন্যদিকে ফ্যাসিবাদের সামরিক শক্তিকে সামরিকভাবেই মোকাবিলা করার কথা তাদের সেই প্রেস রিলিজে ছিল। ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় সেইটাই সবচেয়ে সঠিক পথ নয় কি?

   আজ হিন্দু ফ্যাসিবাদীরা কেন্দ্রীয় সরকারে এসেছে, ফ্যাসিবাদ নগ্নভাবে ভারতে রাজত্ব করছে, কিন্তু হিন্দু ব্রাক্ষন্যবাদী মতাদর্শ ভারতে শক্তিশালী হয়ে থেকে যাওয়ার জন্য হিন্দু ফ্যাসিবাদের একটি ধারা সমাজজীবনে সবসময়ই বহমান। যা রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করে এসেছে বরাবরই। এই হিন্দু ব্রাক্ষন্যবাদ একদিকে যেমন হিন্দু ফ্যাসিবাদের বীজকে রক্ষা করে এসেছে তেমনি শক্তি জুগিয়ে গেছে ভারতীয় সামন্ততন্ত্রকেও। এই মতাদর্শ ও ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শিকার যারা সেই দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের মধ্যে দলিত ও আদিবাসীদের মধ্যে যদি প্রভাব থেকে থাকে কোনো বামপন্থী শক্তির তবে সেটি হলো সিপিআই (মাওবাদী)। এবং আজ যদি দিন্দু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে একজোট করা, দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের নিয়ে এক বৃহৎ মোর্চা গড়ে তুলতে হয় তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাও তাদেরই আছে। কারন আর কারুর জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্যতা আছে কিনা সেটাই সন্দেহের ব্যাপার। এই কাজে তাদের সাথে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে পিসিসি সিপিআই (এমএল), লাল নিশান পার্টি মহারাষ্ট্র, সিপিআই (এমএল) এসওসি তামিলনাড়ুর মতো দলগুলি। পিসিসি সিপিআই (এমএল)এর মতো শেষাক্ত দুটি দলও সীমিত ক্ষমতার মধ্যে কিছু সদর্থক পদক্ষেপ নিয়েছে হিন্দু ফ্যাসিবাদের বিরোধীতায়।