সিপিএমএলএম বাংলাদেশ-এর দলিল। । প্রতারণার স্বীকার যে জন মানুষেরা

সিপিএমএলএম বাংলাদেশএর দলিল

 

প্রতারণার স্বীকার যে জন মানুষেরা

 Bogra-Shajahanpur-Hartal-6

ধর্মের নামে অথবা ক্ষমতার লোভে কামরাকামরিতে হত্যা, লুটতরাজ, ভাঙচুর, জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি চলছে অবিরাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্প-ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ কাজে যেতে পারছেনা। কিন্তু কেন?

কারণ ’৭১-এর এক কুখ্যাত রাজাকার সাঈদীকে যুদ্ধপরাধ ট্রাইবুনাল ফাঁসির রায় দিয়েছে। তাই ক্ষিপ্ত হয়েছে সাঈদীর দল জামাত-শিবির। তাদের কয়েকদিনের তাণ্ডবে প্রায় সত্তুর জন নিহত, আহত বহু। এরা যাত্রীবাহী বাসে আগুণ দিয়েছে, এম্বুলেন্সে আগুণ দিয়ে রোগী হত্যা করেছে, যাত্রীবাহী বাসে ও রেলের অনেক বগি আগুণ দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ীঘর, মন্দির ভাঙচুর করছে। নিহতদের বেশিরভাগই জামাত-শিবির কর্তৃক প্ররোচিত ও প্রতারিত দরিদ্র ও পশ্চাদপদ জনগণ।

সীমান্তবর্তী এলাকার বেশিরভাগ মানুষই সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের ফলে ভারত বিভাগের সময় ভারত থেকে আসা মুসলিম জনগণ, আর কক্সবাজার ও বান্দরবানে রযেছে মায়ানমার থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে সেখান থেকে আসা মুসলমান রোহিঙ্গারা। এসব এলাকায় দীর্ঘদিন জামাত সংগঠনিক কাজ চালিয়েছে, ইসলামবাদের ভিত্তিতে সামন্তবাদী ধর্মবাদী পশ্চাদপদ চেতনা সঞ্চারিত করেছে। অপরদিকে বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায়ই মানুষের মধ্যে শিক্ষা বলতে কেবল ধর্মীয় কুসংস্কারই রয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান তাদের কাছে অপরিচিত। এরকম কিছু এলাকার অজ্ঞতার অন্ধকারে ইসলামবাদী জামাত কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে কুখ্যাত ইসলামবাদী সাঈদীর ছবি চাঁদের ছবির সাথে জুড়ে দিয়ে দেখায় যে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। পশ্চাদপদ নারীপুরুষদের প্রতারিত করে ইসলামবাদী প্রতারকরা তাদের উত্তেজিত করে ‘জেহাদ’-এ নামায়। নিরপরাধ এইসব বহু নারীপুরুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ‘জিহাদ’-এর আপাত সমাপ্তি ঘটে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছোঁয়া  শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণদের মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কিছুটা সঞ্চারিত হলেও, বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই রয়েছে মধ্যযুগীয় অন্ধকারে।

আর এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

শিশুদের ধর্মীয় কুসংস্কার বিশ্বাসে বাধ্য করা হয়, ভূত-প্রেত, অলৌকিকতা, পারলৌকিকতায় ভীতি প্রদর্শন করা হয়। আর দরিদ্র মানুষের এ ধরণের বিশ্বাস করাটা সহজ ও স্বাভাবিক। কারণ তাদের ইহজগত ফলপ্রদ নয় তেমনটা। অপরদিকে ধনিদের ইহজগত মুনাফা আর লোভে পরিপূর্ণ। কিন্তু এতেও তারা সন্তুষ্ট নয়।

জামাত শিবিরের এ তাণ্ডবে যোগ দেয় বিএনপি। জামাতের লেজ ধরে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে নেমেছে।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাপা এরা শাসকশ্রেণীর প্রধান প্রধান দল। বাংলাদেশের পুঁজি ও সম্পদ এদেরই করায়ত্ত। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকায় সে মুনাফার বড় অংশ ভোগ করছে, তার সাথে রয়েছে জাপা ও সংশোধনবাদী বামেরা।

আওয়ামী লীগ বিরোধীরা যাতে ভোটে জিততে না পারে সেজন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করেছে।

জামাত-বিএনপি তিন বছর কোন আন্দোলন না করলেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার তৃতীয় বছর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা পুনপ্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। সবকিছু ভালয় ভালয় চলছিল। আওয়ামী লীগের ভোটে জেতার আশা ছিল শুণ্যের কোঠায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কৃষকের ধানের দাম না পাওয়া, তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দামের বহুবার বৃদ্ধি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি, শেয়ার ব্যবসায় বিপর্যয় বহুবিধ কারণে তাদের জেতার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। আওয়ামী লীগ জামাত ও বিএনপির জোট ভেঙে দেওয়ার জন্য জামাতের সাথে গোপন আঁতাত করে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে ’৭১-এর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চিহ্নিত দোসরদের বিচারের প্রক্রিয়ায় কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এতে মধ্যবিত্ত তরুন প্রজন্ম বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা এক আন্দোলন গড়ে তোলে কাদের মোল্লাসহ রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে। ফলে আপিলের বিধান রেখে সরকার আইন সংশোধন করতে বাধ্য হয়। আপিল করে কাদের মোল্লার শাস্তি বাড়াতে। ইতিমধ্যে শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্ত নিরীশ্বরবাদী তরুণ ব্লগার রাজীব হায়দারকে জামাত-শিবির ক্যাডাররা নৃশংসভাবে খুন করে। এটা মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্মসহ সারা দেশের জনসাধারণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এদিকে ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবারের জুম্মার নামাজের সময় জামাতের সমমনা দলগুলো বিভিন্ন মসজিদে ঘাঁটি গাঁড়ে, ব্লগারদের বিরুদ্ধে মুসল্লিদের এই বলে ক্ষেপিয়ে তোলে যে নাস্তিক ব্লগাররা মোহাম্মদের নামে কটুক্তি করেছে। এভাবে তারা দাঙ্গা বাঁধায়। ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পুলিশের গুলিতে ৫/৭ জন ইসলামবাদী নিহত হয়। ২/১ জন নিরীহ পথচারী , নারী ও দোকানদারও নিহত হয়। এর কয়েকদিন পর, সাঈদীর বিচারে ফাঁসির রায় দেয়া হলে সেই দিন থেকে জামাত-শিবির দেশের সীমান্তবর্তী কিছু এলাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তাণ্ডব চালায়, দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করে।

শাহবাগ আন্দোলন কেবল একটি ইস্যু নিয়ে, ’৭১-এর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। এটা খুবই আংশিক চরিত্রের আন্দোলন হলেও জনসমর্থন পেয়েছিল। আংশিক চরিত্রের কারণঃ

১। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। ভারতের দালাল হওয়ায় শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ বিচার দাবী করেনি। প্রকৃতপক্ষে, ভারত কর্তৃক পুর্ববাংলা দখল হওয়ায়, ভারত পাকিস্তানী সৈন্যদের শিমলা চুক্তিতে কাশ্মীরের বিনিময়ে পাকিস্তানের কাছে অর্পণ করে।

২। শেখ মুজিব রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিল।

৩। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সিরাজ সিকদারসহ হাজার হাজার মাওবাদী কমিউনিস্টকে হত্যা করেছিল, যা ছিল যুদ্ধাপরাধ।

৪। জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার হাজার হাজার বিদ্রোহী সৈনিক হত্যা করে, যা ছিল যুদ্ধাপরাধ।

৫। এরশাদের সামরিক শাসনে বহু মানুষ নিহত হয়।

৬। মাঝখানে একবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ খালেদার বিএনপির দুই দফা ও হাসিনার আওয়ামী লীগের দুই দফার সরকারে শত শত মাওবাদী নেতা কর্মী ও জনগণকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়। যা ছিল রাষ্ট্রীয় যুদ্ধাপরাধ।

এসবই যুদ্ধাপরাধ। রাষ্ট্র নিজেই সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধী।

শাহবাগ আন্দোলনে এ সামগ্রিক দাবী দাওয়া উঠছেনা। জনগণের মৌলিক বাঁচার দাবী যে উঠবেনা সেটা বলাই বাহুল্য। উপরন্তু রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য গ্রহণ করা হয়েছে। তথাপি খুবই আংশিক হলেও আমরা এ দাবীকে ন্যায্য মনে করেছি। যদিও তা মুল সমস্যার সমাধান করতে পারবেনা। কেন? কারণ মূল সমস্যা হাসিনা-খালেদা-এরশাদ-গোলাম আযম এরা সকলে, যার মধ্যে হাসিনাই এখন প্রধান, যেহেতু সে ক্ষমতাসীন।

ধর্মকে এরা পাল্লা দিয়ে রাষ্ট্রে সমাজে আধিপত্যকারী ভাবধারা হিসেবে যুক্ত করেছে।

এরা ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামুলক করেছে, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালূ রেখেছে। মানুষকে পেছনে আটকে রাখলে তারা নিশ্চিন্তে শাসন শোষণ চালিয়ে যেতে পারবে আশা করে। জামাত শিবির ধর্মের নামে যে নোংরামী শুরু করেছে আমরা তার প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করি। একই সঙ্গে ঘৃণা পোষণ করি তার লেজুর বিএনপির তrপরতাকে। ধর্মের ভিত্তিতে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারকে পুঁজি করে তারা ক্ষমতায় যেতে চাইছে। এরা ইসলামের নামে সামন্তবাদী উrপাদন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়। সৌদি আরব, ভারত ও বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের আধা-উপনিবেশিক অধীনতা টিকিয়ে রাখতে চায়।

জামাত-বিএনপি অব্যাহত গণবিরোধী হরতাল ও জ্বালাও পোড়াওয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। আওয়ামী সরকারের শোষন নির্যাতন নিপীড়ণে এমনিতেই জনগণ দিশেহারা, এমতাবস্থায় এই নতুন অত্যাচার মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। যাত্রীসমেত বাস ও ট্রেনে আগুণ লাগানোসহ রাস্তায় বোমাবাজি ও গোলাগুলির কারণে সকলে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। সংখ্যালঘু জনগনের জান-মাল আক্রান্ত হচ্ছে।

ক্ষমতার লোভে বুর্জোয়া ও সামন্ত রাজনৈতিক দলগুলো এসব করছে।

আর জনগনই কিনা এই শত্রুদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে, বলা ভাল, বাধ্য হয়ে ভোট দিতে যায়। শোষকদের রাজনৈতিক চালবাজি দ্বারা বিভ্রান্ত মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া অধিকাংশ জনগণ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপে পড়ে ভোট দিতে যায়। জনগণকে তারা তাদের বাঁশীর সুরে নাচতে বাধ্য করে। এটাই হচ্ছে দাসত্বের পরিচয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক সমাজের শতকরা আশিজনই ভূমিহীন ও গরীব যাদের ভাত ও  কাজের ব্যবস্থা নেই। ধানের ভাল দাম না থাকায় আর কৃষির উrপাদন খরচ অনেক বেশি হওয়ায় কৃষকেরা কৃষি উrপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় অর্থের তিন ভাগের এক ভাগ। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বেশিরভাগ বেকারত্ব, মোটামুটি জীবন যাপনের অনিশ্চয়তার অনিরাপত্তায় আক্রান্ত।

এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। শাসক শ্রেনীর এক দলের পরিবর্তে আরেক দল, সরকারী জরুরী আইন অথবা ঐ শ্রেণীর সামরিক আমলাতন্ত্র কর্তৃক সামরিক শাসন কোনটাই মৌলিক পরিবর্তন ঘটাবেনা। ধর্মভিত্তিক যে পশ্চাদপদ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদদে, তার ফল হল ইসলামবাদী অন্ধত্ব।

সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর ব্যতিত মানুষের বেঁচে থাকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের আদর্শে এরকম একটা বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন শহীদ কমরেড সিরাজ সিকদার। এমন একটা সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এ লড়াই, যেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণ থাকবেনা। নবগঠিত সিপিএমএলএম সেই বার্তাটাই জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। নবীন প্রজন্মের কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে গঠিত এই পার্টিকে গড়ে তুলতে হবে আর এই পার্টি জনগনকে নয়া গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে।

৭ মার্চ ২০১৩

 

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদীলেনিনবাদীমাওবাদী