মাও সেতুঙ। হুনানের কৃষক আন্দোলনের তদন্ত রিপোর্ট।

     মাও সেতুঙ। হুনানের কৃষক আন্দোলনের তদন্ত রিপোর্ট। পিডিএফ

মাও সেতুঙ। হুনানের কৃষক আন্দোলনের তদন্ত রিপোর্ট। মুদ্রণের জন্য পিডিএফ

এই প্রবন্ধটির পূর্ণ বিবরণ “মাও সেতুঙের নির্বাচিত রচনাবলীর” প্রথম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে চীনের পিকিং গণ প্রকাশন কর্তৃক চীনা ভাষায় প্রকাশিত “মাও সেতুঙ রচনাবলীর নির্বাচিত পাঠ”-এর দ্বিতীয় সংস্করণে এই রচনাটি প্রকাশিত হয়েছে । উক্ত সংস্করণ থেকে বিদেশী ভাষা প্রকাশনা পিকিং রচনাটির “চৌদ্দটি মহান কীর্তি” বাদে বাংলায় ভাষান্তর করে প্রকাশ করে। উক্ত ভাষান্তরে সামান্য কিছু ভাষাগত সম্পাদনা করে বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদীর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন

কমরেড মাও সেতুঙ

কমরেড মাও সেতুঙ

গ্রুপ ১৫ই অক্টোবর, ২০২৩ প্রকাশ করে। সেইসাথে চৌদ্দটি মহান কীর্তি মার্কসিস্ট ইন্টারনেট আর্কাইভে সংরক্ষিত ইংরেজী সংস্করণটি থেকে সরাসরি বাংলায় অনুবাদ করে। কোলকাতা থেকে ১৯৬০ সালে নবজাতক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত মাও সেতুঙের নির্বাচিত রচনাবলীর প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত ঐ  অংশটির বাংলা অনুবাদের সাথে এই অংশটির অনুবাদ মিলিয়ে দেখা হয়েছে। সর্বহারা পথ ওয়েবসাইট থেকে এই সংস্করণটির অধ্যয়ন ও প্রিন্ট নেয়া যাবে।।

এ রচনায় কমরেড মাও সেতুঙের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি

“বিপ্লব কোন ভোজসভা নয়, বা প্রবন্ধ রচনা কিংবা চিত্র অংকন অথবা সূচিকর্মও নয়, এটা এত সুমার্জিত, এত ধীরস্থির ও সুশীল, এত নম্র, দয়ালু, বিনীত, সংযত ও উদার হতে পারেনা। বিপ্লব হচ্ছে একটা বিদ্রোহ, উগ্র বলপ্রয়োগের কাজ, যার দ্বারা এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীকে উৎখাত করে”।

 

বাংলা ভাষান্তরের ভূমিকা

চীনের সাম্যবাদী পার্টি কৃষকদের মাঝে সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তোলে। মাওয়ের জন্মস্থান হুনান প্রদেশে এই ভিত্তি ছিল সর্বাধিক। সাম্যবাদীদের সাথে তখন জাতীয়তাবাদীদের ঐক্য ছিল। এই ঐক্যের ভিত্তিতে উত্তরাভিযান চলছিল। উত্তরের যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অভিযান চলছিল। এরই মাঝে সাম্যবাদীরা কৃষকদের মাঝে হুনানসহ বিভিন্ন স্থানে ভিত্তি গড়ে তুলেছে। জাতীয়তাবাদীদের সাথে সাম্যবাদীদের ঐক্য উত্তরাভিযান সমাপ্তির সাথে সাথেই ভেঙে যায়। জাতীয়তাবাদীরা সাম্যবাদীদের বিরুদ্ধে সাংহাই গণহত্যা সংগঠিত করে। কিন্তু সাম্যবাদীদের ভিত্তি হচ্ছে ব্যাপক কৃষক জনগণ যাদেরকে তারা জাগিয়ে তুলেছেন। তাই এখান থেকেই এক অপরাজেয় লাল বাহিনী গড়ে উঠছে যার মোকাবেলা কেউ করতে পারবেনা। এক ব্যাপক গণযুদ্ধের মাধ্যমে সমগ্র প্রতিক্রিয়াশীলদের পতন ঘটবে। মাও জানতেন বিপ্লবী সংগ্রাম একই সঙ্গে অধ্যয়নও। লেনিন বর্নিত বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ ছাড়া বিপ্লবী তত্ত্ব গড়ে উঠেনা। তাই তথ্য অনুসন্ধান করতে হয়। সঠিক তথ্যের মধ্যে আবার তত্ত্ব লুকিয়ে থাকে। কারণ সঠিক তথ্য হল বাস্তব। চীনা পার্টি মাও সেতুঙের মাধ্যমেই গ্রামাঞ্চলের গরীব কৃষকদের বিপ্লবী চেতনা ও প্রবল শক্তির সন্ধান পেয়েছে। মাও দেখলেন কৃষক সমিতির মাধ্যমে গরীব সর্বহারা ও আধাসর্বহারা কৃষক জনগণ এক প্রবল শক্তি নিয়ে জেগে উঠছে যা কেউ দমাতে পারবেনা। এর বিরোধিরা তথাকথিত বাড়াবাড়ি, ভয়ংকর, ইতর লোকের আন্দোলন ইত্যাদি বলে এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একে অবনমিত করতে চাইত, আর মাও দেখলেন যে এগুলো বাড়াবাড়ি নয়, এগুলো ভয়ংকর নয় চমৎকার, ইতর লোক বলে যাদের বোঝানো হচ্ছে তারা গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবের নেতা। তারা স্থানীয় অত্যাচারী, উচ্ছৃংখল জমিদার ও অসৎ ভদ্রলোকদের ধূলায় লুটিয়ে দিয়েছে। সকল ক্ষমতা কৃষক সমিতির হাতে নিয়েছে। তাই, অবশ্যই এটা চমৎকার। কিছু কিছু সমিতির লোকের ভুলের কারণে যারা একে দমন করতে চেষ্টা করেছে, মাও তাকে সমালোচনা করেছেন। মাও বলেছেন,  তাদের দমন করলে শ্রেণীশত্রুরা খুশি হয়। মাওয়ের বিখ্যাত উক্তি, “বিপ্লব কোন ভোজসভা নয়, বা প্রবন্ধ রচনা কিংবা চিত্র অংকন অথবা সূচিকর্মও নয়, এটা এত সুমার্জিত, এত ধীরস্থির ও সুশীল, এত নম্র, দয়ালু, বিনীত, সংযত ও উদার হতে পারেনা। বিপ্লব হচ্ছে একটা বিদ্রোহ, উগ্র বলপ্রয়োগের কাজ, যার দ্বারা এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীকে উৎখাত করে”। ভুল যারা করেছেন তাদের ভুল সংশোধনও করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেছেন। আর কৃষকরা এই সঠিক রীতিকে অনুশীলনও করেছেন। মাও কৃষক সমিতির বিপ্লবী উদ্যম ও উৎসাহ বজায় রাখতে চান তারা যাতে বিপ্লবে এগিয়ে যেতে পারেন। চীনা সাম্যবাদী পার্টির নেতৃত্বে আমরা জানি কোটি কোটি কৃষক জেগে ঘূর্ণিবাত্যার মত জেগে উঠলেন যাকে কোন শক্তিই দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ।

কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ

বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী

১৫ই অক্টোবর, ২০২৩

                                                                             

হুনানের কৃষক আন্দোলনের তদন্ত রিপোর্ট

মার্চ, ১৯২৭

(টীকাঃ কৃষকদের বিপ্লবী সংগ্রামের বিরুদ্ধে সেই সময় পার্টির ভিতরে ও বাইরে যে ছিদ্রান্বেষী সমালোচনা চালানো হচ্ছিল তারই জবাবে কমরেড মাও সেতুঙ এই প্রবন্ধটি লেখেন। ঐ সব সমালোচনার উত্তর দেবার জন্য কমরেড মাও সেতুঙ হুনান প্রদেশে ৩২ দিন ধরে ঘটনাবলীর তদন্ত করেন এবং এই রিপোর্ট লেখেন। তখন চেন তুসিউয়ের নেতৃত্বে পার্টির ভেতরকার ডানপন্থী সুবিধাবাদীরা কমরেড মাও সেতুঙের মত মেনে না নিয়ে তাদের নিজস্ব ভুল চিন্তাকে আঁকড়ে ধরে রাখে। তাদের প্রধান ভুল ছিল এই যে, গণ জাতীয় পার্টি (কুওমিনতাঙ)-এর প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতায় ভয় পেয়ে কৃষকদের মহান বিপ্লবী সংগ্রামকে সমর্থন জানাতে তারা সাহস করেনি, যে সংগ্রাম তখন শুরু হয়ে গেছে বা শুরু হবার পথে ছিল। গণ জাতীয় পার্টিকে খুশি করার জন্য বিপ্লবের সর্বপ্রধান মিত্র কৃষকদেরকে তারা পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়, আর এভাবে তারা শ্রমিকশ্রেণী ও সাম্যবাদী পার্টিকে বিচ্ছিন্ন ও সহায়হীন অবস্থায় ফেলে দেয়। সাম্যবাদী পার্টির এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে গণ জাতীয় পার্টি সমর্থ হয়ে প্রধানত এই কারণে ১৯২৭ সালের গ্রীষ্মকালে তারা সাহস করে বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে, এর “পার্টি শুদ্ধি” চালাতে আর জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে)

কৃষক সমস্যার গুরুত্ব

হুনানে (টীকাঃ তখন হুনান প্রদেশ ছিল সমগ্র চীনে কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্র) আমার সাম্প্রতিক পরিদর্শনের সময়ে আমি সিয়াংথান, সিয়াংসিয়াং, হেংসান, লিলিং এবং চাংশা এ পাঁচটি কাউন্টির অবস্থা সরেজমিনে তদন্ত করি। ৪ঠা জানুয়ারি থেকে ৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩২ দিনে গ্রামাঞ্চলে ও জেলা শহরগুলিতে আমি তথ্যানুসন্ধানী সম্মেলন আহবান করি। অভিজ্ঞ কৃষক ও কৃষক আন্দোলনে কর্মরত কমরেডরা  এইসব সম্মেলনে যোগ দেন। আমি মনোযোগ সহকারে তাঁদের রিপোর্ট শুনি ও প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করি। হাংখৌ ও চাংশার ভদ্রসম্প্রদায় যা বলছে কৃষক আন্দোলনের বহু কারণ আসলে একেবারে বিপরীত। এমন অদ্ভূত অদ্ভূত বিষয় আমি দেখি আর শুনি যেগুলি সম্পর্কে এর আগে আমি অবহিত ছিলামনা। আমার বিশ্বাস কথাটা অন্যান্য অনেক স্থান সম্পর্কেও সত্য। এই কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে যেসব কথা বলা হয়েছে সেগুলিকে অবশ্যই তাড়াতাড়ি সংশোধন করতে হবে। এই কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে বিপ্লবী কর্তৃপক্ষ যেসব ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন সেগুলিকে অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তন করতে হবে। কেবল এভাবেই বিপ্লবের ভবিষ্যত লাভবান হতে পারে। কারণ বর্তমানে কৃষক আন্দোলনের উত্থান একটা অত্যন্ত বিরাট ঘটনা। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই চীনের মধ্য, দক্ষিণ এবং উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে কোটি কোটি কৃষক প্রবল ঝড় ও ঘুর্ণিবাত্যার মত এমন তীব্র গতি ও প্রচণ্ড শক্তি হয়ে জেগে উঠবে যাকে কোন শক্তি, তা যত প্রবলই হোক না কেন, দাবিয়ে রাখতে পারবেনা। তাদেরকে বন্ধনকারী সব বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে তারা মুক্তির পথে ধাবিত হবে। তারা সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী, যুদ্ধবাজ, দুর্নীতিপরায়ণ সরকারী কর্মচারী, স্থানীয় নিপীড়ক এবং অসৎ ভদ্রলোককে ঝেঁটিয়ে কবরে পৌঁছে দেবে। সমস্ত বিপ্লবী পার্টি ও দল আর সমস্ত বিপ্লবী কমরেডকেই তাদের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে—তারাই স্থির করবে কাকে গ্রহণ করা হবে আর কাকে বর্জন করা হবে। তিনটি বিকল্প রয়েছে। তাদের অগ্রভাগে থেকে তাদের নেতৃত্ব দেয়া? না তাদের পেছনে পেছনে চলে ভেংচি কাটা ও সমালোচনা করা? অথবা তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের বিরোধিতা করা? প্রতিটি চীনারই এর একটা বেছে নেয়ার স্বাধীনতা রয়েছে, তবে ঘটনাপ্রবাহ বেছে নেওয়ার কাজটা শীঘ্রই করে ফেলতে আপনাকে বাধ্য করবে।

 সংগঠিত হোন!

প্রদেশের মধ্য ও দক্ষিণভাগের যেসব জেলায় এই আন্দোলন ইতিমধ্যেই অনেকখানি অগ্রগতি লাভ করেছে সেগুলির প্রেক্ষিতে হুনানের কৃষক আন্দোলনের বিকাশকে মোটামুটি দুটি পর্যায়কালে ভাগ করা চলে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালটা ছিল প্রথম পর্যায়ের, অর্থাৎ সংগঠনের পর্যায়কাল। এই পর্যায়ে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়টা ছিল গোপন কর্মতৎপরতার সময়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়টা ছিল যখন বিপ্লবী বাহিনী চাও হেংথিকে (টীকাঃ হুনানের তৎকালীন শাসনকর্তা চাও হেংথি ছিল উত্তরাঞ্চলীয় যুদ্ধবাজদের দালাল। ১৯২৬ সালে উত্তরাভিযানকারী বাহিনী তাকে উচ্ছেদ করে) বিতাড়িত করছিল, সে সময়টা ছিল প্রকাশ্য কর্মতৎপরতার সময়। এই পর্যায়কালে কৃষক সমিতির মোট সদস্য সংখ্যা তিন থেকে চার লক্ষের বেশি ছিলনা। তাদের সরাসরি নেতৃত্বাধীন জনসংখ্যা ছিল দশ লাখের সামান্য বেশি। তখন গ্রামাঞ্চলে কোন সংগ্রাম ছিলনা বললেই চলে। তাই সমিতি সম্বন্ধে অন্যান্য মহলে সমালোচনা হত খুবই কম। কৃষক সমিতির সদস্যরা উত্তরাঞ্চলে অভিযানকারী সৈন্যবাহিনীর পথপ্রদর্শক, স্কাউট ও বাহক হিসেবে কাজ করত বলে কোন কোন অফিসার কৃষক সমিতি সম্পর্কে প্রশংসাও করেছেন। গত অক্টোবর থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত হল দ্বিতীয় পর্যায়কাল, অর্থাৎ বিপ্লবী কর্মতৎপরতার পর্যায়কাল। এ সময়ে কৃষক সমিতির সদস্য সংখ্যা দ্রুত বেড়ে হল বিশ লাখ। আর তাদের সররাসরি নেতৃত্বাধীন জনসংখ্যা হল এক কোটি। যেহেতু কৃষকরা সমিতিতে যোগদানের সময় সাধারনতঃ সমগ্র পরিবারের পক্ষ থেকে মাত্র একজনের নাম লেখায়, তাই কৃষক সমিতির সদস্য সংখ্যা বিশ লাখ বলতে এক কোটি জনগণের আনুগত্য বোঝায়। হুনানের কৃষকদের প্রায় অর্ধেক এখন সংগঠিত। সিয়াংথান, সিয়াংসিয়াং, লিউইয়াং, চাংশা, লিলিং, নিংসিয়াং, পিংকিয়াং, সিয়াংইং, হেংশান, হেংইয়াং, লেইইয়াং, চেনসিয়ান ও আনহুয়ার মত কাউন্টিগুলোতে প্রায় সমস্ত কৃষকরাই কৃষক সমিতিতে যোগ দিয়েছে অথবা তাদের নেতৃত্বাধীনে এসে গেছে।

তাদের ব্যাপক সাংগঠনিক শক্তির জোরে কৃষকরা কাজে নেমেছে আর এভাবে চার মাসের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে এক বিরাট বিপ্লব সম্পন্ন করেছে। ইতিহাসে এই বিপ্লবের তুলনা নেই।

স্থানীয় নিপীড়ক এবং অসৎ ভদ্রলোকেরা নিপাক যাক!

কৃষক সমিতির হাতে সকল ক্ষমতা চাই!

কৃষকদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হল স্থানীয় নিপীড়ক ও অসৎ ভদ্রলোকেরা এবং উচ্ছৃংখল জমিদার। কিন্তু সাথে সাথে তারা বিভিন্ন পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও বিধিব্যবস্থাকে, শহরের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদেরকে এবং গ্রামাঞ্চলের প্রচলিত কুপ্রথা ও কুরীতিকে আঘাত করে। শক্তি ও গতিবেগের দিক থেকে এই আক্রমণ হচ্ছে ঝড়ের মত, যারা এর সামনে মাথা নত করে তারা বেঁচে যায়, আর যারা একে বাঁধা দেয় তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে হাজার হাজার বছর ধরে সামন্ত জমিদাররা যে বিশেষ অধিকার ভোগ করে আসছিল তা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। জমিদাররা নিজেদের যে মান মর্যাদা তৈরি করেছিল তার প্রতিটি বিন্দু ধূলায় মিশে গেছে। জমিদারদের ক্ষমতা ভেঙে পড়ার সাথে সাথে এখন কৃষক সমিতিগুলি ক্ষমতা প্রয়োগের একমাত্র যন্ত্রে পরিণত হয়েছে আর “কৃষক সমিতির হাতে সকল ক্ষমতা চাই” এই জনপ্রিয় শ্লোগানটি বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এমন কি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ঝগড়াটির মত ছোটখাট ব্যাপারও সমাধানের জন্য কৃষক সমিতির কাছে পেশ করা হয়। কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে কেউ উপস্থিত না থাকলে কোন কিছুরই মীমাংসা হতে পারেনা। সমিতি সত্যসত্যই গ্রামাঞ্চলের সমস্ত ব্যাপারকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং “এরা যা বলে তাই হয়” কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য। সমিতি বহির্ভূতরা কেবল সমিতি সম্পর্কে ভাল কথাই বলতে পারে, বিরুদ্ধে একটি কথাও বলতে পারেনা। স্থানীয় নিপীড়ক, অসৎ ভদ্রলোক আর উচ্ছৃংখল জমিদারদেরকে কথা বলার সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ বিড়বিড় করেও ভিন্নমত প্রকাশ করতে সাহস করেনা। কৃষক সমিতিগুলির শক্তি ও চাপের মুখে স্থানীয় নিপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাসদের শীর্ষস্থানীয়রা সাংহাইয়ে পালিয়ে গেছে। দ্বিতীয় স্তরের লোকেরা হ্যাংকাউ তৃতীয় স্তরেররা চাংশা এবং চতুর্থ স্তরের লোকেরা গেছে কাউন্টি শহরগুলোতে, আর পঞ্চম স্তরের এবং তারও নিচের চুনোপুঁটিরা গ্রামের কৃষক সমিতিগুলোর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

ছোটখাট অসৎ ভদ্রলোক কেউ হয়ত বলবে, “এই নিন দশ ইউয়ান (বর্তমান মূল্য প্রায় দেড় শ’ টাকা—বাংলা অনুবাদক)। দয়া করে আমাকে কৃষক সমিতিতে যোগ দিতে দিন।

কৃষকরা উত্তর দেয়ঃ “দূর! কে চায় তোমার নোংরা টাকা”।

অনেক মাঝারি ও ছোট জমিদার এবং ধনী কৃষক, এমনকি অনেক মাঝারি কৃষক যারা সকলেই আগে কৃষক সমিতির বিরোধিতা করেছে, তারা এখন সমিতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনকালে আমি প্রায়ই এ রকম লোকের সাক্ষাত পেয়েছি যারা আমার কাছে অনুনয় করে বলেছেঃ “প্রাদেশিক রাজধানী থেকে আগত মাননীয় কমিটি নেতা, আপনি দয়া করে আমার জামিন হোন!”

চিং রাজবংশের শাসনামলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংকলিত পারিবারিক আদমশুমারির একটি নিয়মিত রেজিষ্টার এবং আর একটি “অন্য রেজিষ্টার” ছিল। প্রথমটি ছিল সৎ লোকের জন্য আর দ্বিতীয়টি ছিল সিঁদেলচোর, দস্যু এবং অনুরূপ অবাঞ্ছিতদের জন্য। কোন কোন জায়গায় কৃষকরা এখন এই পথ অবলম্বন করে পূর্বে যারা কৃষক সমিতির বিরোধিতা করেছে তাদের ভয় দেখায়। তারা বলে, “এদের নাম অন্য রেজিষ্টারে লিখে রাখ।“

অন্য রেজিষ্টারে অন্তর্ভুক্ত হবার ভয়ে এই ধরণের লোকেরা কৃষক সমিতিতে ভর্তি হবার জন্য নানা কৌশলে চেষ্টা করে। এর উপর তাদের মন এতই নিবদ্ধ হয় যে সমিতির সভ্য-রেজিষ্টারে তাদের নাম না লেখানো পর্যন্ত তারা নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করেনা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়। ফলে তারা সবসময় এক ঝুলন্ত অবস্থায় কাল কাটাচ্ছে। সমিতির দরজা তাদের কাছে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের অবস্থা হয়েছে গৃহহীন ভবঘুরের মত অথবা গ্রাম্য ভাষায় “ছন্নছাড়া”র মত। সংক্ষেপ বলতে গেলে, চার মাস আগে যাকে একট “কৃষক চক্র” বলে তুচ্ছ করা হত, সেটাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে সবচেয়ে সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান। আগে যারা ভদ্র সম্প্রদায়ের ক্ষমতার সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করত এখন কৃষকদের ক্ষমতার সামনে তারা মাথা নত করে। তাদের পরিচিতি যাই হোক, সকলেই স্বীকার করে, বিগত অক্টোবর থেকে পৃথিবী বদলে গেছে।

“এটি ভয়ংকর!” অথবা “এটি চমৎকার!”

কৃষকদের বিদ্রোহ ভদ্রসম্প্রদায়ের সুখস্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। গ্রামাঞ্চল থেকে খবরাখবর যখন শহরে পৌঁছল তখন সেখানকার ভদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল। আমার চাংশায় পৌঁছার ঠিক পরে আমি সকল স্তরের লোকের সাথে সাক্ষাত করেছি এবং বহু গালগল্প শুনেছি। সমাজের মধ্য স্তর থেকে নিয়ে উপরের দিকে গণ জাতীয় পার্টির ডানপন্থীদের পর্যন্ত এমন কেউ আমার নজরে পড়েনি যে এই সমগ্র ঘটনাকে “এটি ভয়ংকর!” এই কথায় সংক্ষেপে প্রকাশ করেনি। তখন “এটি ভয়ংকর!” এই মতবাদের শহরাঞ্চল পরিপূর্ণ এবং এর চাপে বেশ বিপ্লবী চরিত্রের লোকজনও তাদের মনের মধ্যে গ্রামাঞ্চলের ঘটনাবলীর ছবি এঁকে মনমরা হয়ে পড়েছিল এবং তারা “ভয়ংকর” কথাটিকে অস্বীকার করতে পারছিলনা। এমনকি বেশ প্রগতিশীল লোকও বলছিল, “যদিও ভয়ংকর তবু বিপ্লবে এটি অপরিহার্য”। সংক্ষেপে, “ভয়ংকর” কথাটিকে কেউই একেবারে অস্বীকার করতে পারছিলনা। কিন্তু ইতিমধ্যে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, আসল ঘটনা হল মহান কৃষক জনগণ তাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পন্ন করার জন্য জেগে উঠেছে এবং গ্রামাঞ্চলের সামন্ততান্ত্রিক শক্তিকে উৎখাতে গ্রামাঞ্চলের গণতান্ত্রিক  শক্তি জেগে উঠেছে। স্থানীয় অত্যাচারী, অসৎ ভদ্রলোক আর উচ্ছৃংখল জমিদারদের পিতৃতান্ত্রিক সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণী হাজার হাজার বছর ধরে স্বৈরাচারী সরকারের ভিত্তি তৈরি করে এসেছে এবং এই শ্রেণীই ছিল সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধবাজতন্ত্র এবং দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের ভিত্তিপ্রস্তর। এইসব সামন্তবাদী শক্তিকে উৎখাত করাই হল জাতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য। ডঃ সান ইয়াতসেন চল্লিশ বছর ধরে জাতীয় বিপ্লব সম্পন্ন করার কাজে একাগ্রভাবে লেগে থেকে যা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন, কৃষকরা মাত্র কয়েক মাসেই তা সম্পন্ন করেছে। এটি এমন এক বিস্ময়কর কাজ যা কেবল চল্লিশ বছরে সম্পন্ন হয়নি তা নয়, হাজার হাজার বছরেও সম্পন্ন হয়নি। এটি চমৎকার। এটি একেবারেই “ভয়ংকর” নয়। এটা আর যাই হোক “ভয়ংকর” নয়। “এটি ভয়ংকর” এই তত্ত্ব স্পষ্টতই জমিদারদের স্বার্থে কৃষকদের অভ্যুত্থানকে প্রতিরোধ করার তত্ত্ব। স্পষ্টতই সামন্তবাদের পুরোনো বিধিব্যবস্থাকে বজায় রাখার জন্য আর গণতন্ত্রের নতুন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাকে রোধ করার জন্য এটি জমিদার শ্রেণীর একটি তত্ত্ব। স্পষ্টতই এটি একটি প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব। কোন বিপ্লবী কমরেডের এই বাজে কথা উচ্চারণ করা উচিত নয়। যদি আপনার বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং যদি আপনি গ্রামে যান আর চারদিকের ঘটনাবলী লক্ষ্য করেন তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি এক অভূতপূর্ব শিহরণ অনুভব করবেন। এখন অগণিত হাজার হাজার দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ—কৃষকগণ নরখাদক শত্রুদেরকে আঘাত করে ধরাশায়ী করছে। কৃষকরা যা করছে তা পুরোপুরি ঠিক। তারা যা করছে তা চমৎকার! “এটি চমৎকার!” এই তত্ত্ব কৃষক ও অন্যান্য বিপ্লবীদের তত্ত্ব। প্রতিটি বিপ্লবী কমরেডের জানা উচিত যে, জাতীয় বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন হল গ্রামাঞ্চলে এক বিরাট পরিবর্তন। ১৯১১ সালের বিপ্লব (টীকাঃ ১৯১১ সালের বুর্শোয়া বিপ্লব চিং রাজবংশের স্বৈরতন্ত্রী শাসনের উচ্ছেদ ঘটায়। সে বছরের ১০ই অক্টোবর তারিখে, চিং রাজবংশের সৈন্যবাহিনীর একটা অংশ বুর্শোয়া ও পাতি বুর্শোয়া বিপ্লবী সংস্থাগুলির প্রেরণায় হুপেই প্রদেশের উচাং শহরে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। এর পরে বিভিন্ন প্রদেশে পর পর বিদ্রোহ ঘটে এবং চিং রাজবংশের শাসন অনতিবিলম্বেই ভেঙে পড়ে। ১৯১২ সালের ১লা জানুয়ারি তারিখে নানচিং শহরে স্থাপিত হয় চীন প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার, এবং সান ইয়াতসেন নির্বাচিত হন এর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট। কৃষক, শ্রমিক ও শহুরে পাতি বুর্শোয়াদের সঙ্গে বুর্শোয়াদের মৈত্রীর ভেতর দিয়ে জয়লাভ করে এই বিপ্লব। কিন্তু যে চক্র এই বিপ্লবের নেতৃত্ব করেছিল তারা ছিল আপোষপন্থী, আর তারা কৃষকদের প্রকৃত হিত সাধন করেনি এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের চাপে বিপ্লবের শত্রুদের সাথে আপোষ করেছিল বলে রাষ্ট্রক্ষমতা এসে পড়ে উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধবাজ ইউয়ান শিহকাইয়ের হাতে। বিপ্লব হয় ব্যর্থ) এই পরিবর্তন ঘটায়নি, তাই তার ব্যর্থতা। এই পরিবর্তন এখন ঘটছে এবং বিপ্লব সম্পন্ন হবার ব্যাপারে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিটি বিপ্লবী কমরেডকে অবশ্যই একে সমর্থন করতে হবে, নইলে সে প্রতিবিপ্লবের পক্ষে চলে যাবে।

“বাড়াবাড়ি করা”র প্রশ্ন

তাছাড়া আরেক ধরণের লোক আছে যারা বলে, “হ্যাঁ, কৃষক সমিতি প্রয়োজনীয়, তবে তারা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছে”। এটা হল মধ্যপন্থীদের মত। কিন্তু আসল পরিস্থিতিটা কী? সত্য বটে গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা এক অর্থে অবাধ্য। সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে কৃষক সমিতি জমিদারকে উচ্চবাচ্য করতে দেয়না আর তার মানমর্যাদা নস্যাত করে দেয়। এর অর্থ জমিদারকে আঘাত করে ধুলায় লুন্ঠিত করা ও পদানত করে রাখা। কৃষকরা ভয় দেখিয়ে বলে “তোমাকে আমরা অন্য রেজিষ্টারে তালিকাবদ্ধ করব”। তারা স্থানীয় নিপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাসদের উপর জরিমানা ধার্য করে, তাদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে আর তাদের পাল্কিগুলো ভেঙে চুরমার করে দেয়। লোকেরা কৃষক সমিতির বিরোধী স্থানীয় নিপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাসদের বাড়িতে দলে দলে ঢুকে পড়ে, তাদের শূকর জবাই করে আর তাদের খাদ্যশস্য খেয়ে ফেলে। এমনকি স্থানীয় নিপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাসদের বাড়ির তরুনী স্ত্রীদের হাতির দাতের খুদিত খাটে কিছুক্ষণের জন্য গড়াগড়িও করে। সামান্যতম প্ররোচনায় তারা গ্রেফতার করে, গ্রেফতারকৃত লোকের মাথায় লম্বা গাধার টুপি পরিয়ে দেয় এবং গ্রামের মধ্যে দিয়ে তাদের ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়।

যখন তারা বলতে বলতে যায়, “ব্যাটা হীন জমিদার, এবার তুমি বোঝ আমরা কারা”। যা খুশি তাই করে এবং সবকিছু ওলট পালট করে দিয়ে তারা গ্রামাঞ্চলে একরকম ত্রাসের সঞ্চার করেছে। এটাকেই কেউ কেউ বলে “বাড়াবাড়ি করা”, কিংবা বলে “ভুল সংশোধন করার জন্য যথাযথ সীমা অতিক্রম করা”, নয়তো বলে, “সত্যই খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে”। এই ধরণের কথাবার্তা আপাতদৃষ্টিতে সঙ্গত মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তা ভুল। প্রথমত, স্থানীয় নিপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাসরা আর উচ্ছৃংখল জমিদাররা নিজেরাই কৃষকদের এতদূর ঠেলে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে কৃষকদের উপর অত্যাচার করার জন্য আর তাদেরকে পদদলিত করার জন্য তারা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে এসেছে। সেই কারণেই কৃষকদের প্রতিক্রিয়া হয়েছে অত প্রচণ্ড। সবচেয়ে ভয়ানক বিদ্রোহ আর সবচেয়ে প্রচণ্ড বিশৃংখলা অনিবার্যভাবে সেইসব স্থানে ঘটেছে যেখানে স্থানীয় নিপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাস আর উচ্ছৃংখল জমিদারদের দৌরাত্ম ছিল সবচেয়ে জঘন্য। কৃষকরা স্পষ্টদর্শী। কে মন্দ আর কে নয়, কে নিকৃষ্টতম আর কে ঠিক অতটা নিকৃষ্ট নয়, কার কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত আর কাকেই বা সামান্য শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে কৃষকরা তার যথাযথ হিসেব রাখে এবং অপরাধের মাত্রাতিরিক্ত শাস্তির ঘটনা নিতান্তই বিরল। দ্বিতীয়ত, বিপ্লবে কোন ভোজসভা নয়, বা প্রবন্ধ রচনা কিংবা চিত্র অংকন অথবা সূচিকর্মও নয়, এটা এত সুমার্জিত, এত ধীরস্থির ও সুশীল, এত নম্র, দয়ালু, বিনীত, সংযত ও উদার হতে পারেনা। বিপ্লব হচ্ছে একটা বিদ্রোহ, উগ্র বলপ্রয়োগের কাজ, যার দ্বারা এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীকে উৎখাত করে। গ্রামাঞ্চলের বিপ্লব হল এমন এক বিপ্লব যার দ্বারা কৃষকরা সামন্ত জমিদারশ্রেণীর ক্ষমতা উচ্ছেদ করে। সবচেয়ে প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ না করে কৃষকদের পক্ষে হাজার হাজার বছরের স্থায়ী জমিদারদের পাকাপোক্ত শাসন-ক্ষমতাকে উৎখাত করা সম্ভব নয়। গ্রামাঞ্চলের প্রয়োজন হল এক শক্তিশালী বিপ্লবী অভ্যুত্থানের, কারণ কেবলমাত্র এর দ্বারাই লক্ষ লক্ষ লোককে অনুপ্রাণিত করে এক প্রচণ্ড শক্তিতে পরিণত করা চলে। “বাড়াবাড়ি করা” হয়েছে বলে চিহ্নিত করে যেসব কার্যাবলীর উল্লেখ এখানে করা হয়েছে সেগুলোর উৎস কৃষকদের শক্তি। গ্রামাঞ্চলের বলিষ্ঠ বিপ্লবী অভ্যুত্থান এই শক্তিকে উজ্জীবিত করে তুলেছে। কৃষক আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে (অর্থাৎ বিপ্লবী কর্মতৎপরতার পর্যায়) এই সব কাজ সম্পন্ন করা খুবই প্রয়োজন ছিল। এই পর্যায়ে কৃষকদের নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন ছিল, কৃষক কমিটি সম্পর্কে বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনা নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল, আর ভদ্রসম্প্রদায়ের সকল ক্ষমতা উৎখাত করা, তাদের ধরাশায়ী করা ও পদতলে রাখার প্রয়োজন ছিল। এই পর্যায়ে “বাড়াবাড়ি করা” বলে কথিত সকল কার্যাবলীর বিপ্লবী তাৎপর্য আছে। স্পষ্ট কথায় বলতে গেলে, গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি স্থানে অন্ততঃ কিছুকালের জন্য হলেও ভীতিজনক অবস্থা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। অন্যথায় গ্রামাঞ্চলে প্রতিবিপ্লবীদের কার্যকলাপ দমন করা সম্ভব হবেনা এবং ভদ্রসম্প্রদায়ের ক্ষমতা উচ্ছেদ করা সম্ভব হবেনা। ভুল সংশোধন করার জন্য যথাযথ সীমা অতিক্রম করতে হবে, অন্যথায় ভুল সংশোধন কখনো হতে পারেনা (টীকাঃ পুরনো চীনা উক্তিতে বলা হয় “ভুল সংশোধন করার জন্যে যথাযথ সীমা অতিক্রম করতে হবে”। আগে লোকদের কার্যকলাপকে সীমাবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রায়ই এই কথাটিকে উদ্ধৃত করা হত। প্রতিষ্ঠিত শৃংখলার অবয়বের মধ্যে হলে সংস্কার সাধন মেনে নেয়া হত, কিন্তু যেসব কার্যকলাপের উদ্দেশ্য ছিল পুরনো নিয়মশৃংখলাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা তা নিষেধ করা হত। এই সীমারেখার মধ্যের কার্যকলাপকে মনে করা হত “যথাযথ”, কিন্তু পুরনো নিয়মশৃংখলাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস কয়ার উদ্দেশ্যে যা করা হত তাকে বলা হত “যথাযথ সীমা অতিক্রম”। সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী শিবিরের মধ্যকার সুবিধাবাদীদের মতবাদ ছিল এটা। কমরেড মাও সেতুঙ এই ধরণের সংস্কারবাদী মতবাদ খণ্ডন করেছিলেন। আলোচ্য প্রসঙ্গে তিনি যে বলেছেন “ভুল সংশোধন করার জন্যে যথাযথ সীমা অতিক্রম করতে হবে, অন্যথায় ভুল সংশোধন কখনো হতে পারেনা”—তার অর্থ হল পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা খতম করতে জনগণের বিপ্লবী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, সংশোধনবাদী-সংস্কারবাদী পদ্ধতি নয়)। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে কৃষকদের কার্যাবলী সম্পর্কে কেউ কেউ বলে “এটা ভয়ংকর”, আবার কেউ কেউ বলে তারা “বাড়াবাড়ি করছে”। আপাতদৃষ্টিতে শেষোক্ত বক্তব্য প্রথমটি থেকে ভিন্ন মনে হতে পারে কিন্তু মূলতঃ তারা উভয়েই একই দৃষ্টিকোন থেকে দেখেছে আর একইভাবে তারা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকারী এক জমিদারশ্রেণীর তত্ত্ব প্রচার করে। যেহেতু এই তত্ত্ব কৃষক আন্দোলনের উত্থানকে ব্যাহত করে আর বিপ্লবে ভাঙন ধরায় সেজন্য আমরা অবশ্যই দৃঢ়ভাবে এর বিরোধিতা করব।

“ইতর লোকদের আন্দোলন”

গণ জাতীয় পার্টির ডানপন্থীরা বলে, “কৃষক আন্দোলন হল ইতর লোকদের আন্দোলন, অলস কৃষকদের আন্দোলন”। চাংশাতে এ অভিমত বেশ চালু। আমি যখন গ্রামাঞ্চলে ছিলাম তখন ভদ্র সম্প্রদায়কে বলতে শুনেছি, “কৃষক সমিতি প্রতিষ্ঠা করা ঠিক, কিন্তু যেসব লোক সেগুলি চালাচ্ছে তারা বাজে। তাদের বদলানো উচিত”। ডানপন্থীরা যা বলছে সেটা আর এই অভিমত একই দাঁড়ায়। তাদের উভয়ের মতে কৃষক আন্দোলন করা ঠিক (আন্দোলন ইতিমধ্যেই চলছে আর কেউ অন্যরকম বলতে সাহস করেনা), কিন্তু তারা বলে, যেসব লোক এর পরিচালনা করছে তারা কেউ কাজের নয়, তারা বিশেষ করে সমিতির নিম্নপর্যায়ের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত লোকদের ঘৃণা করে এবং তাদের “ইতর” বলে অভিহিত করে। সংক্ষেপে, ভদ্রসম্প্রদায় যাদের ঘৃণা করে এসেছে, যাদের পায়ে দলে মাটিতে মিশিয়ে এসেছে, যেসব লোকদের সামাজিক কোন স্থান ছিলনা, যেসব লোকদের কোন কথা বলার অধিকার ছিলনা তারা এখন উদ্ধতভাবে তাদের মাথা উঁচু করেছে। তারা যে কেবল তাঁদের মাথা উঁচু করেছে তাই নয়, তার উপর তারা ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে। তারা এখন থানা কৃষক সমিতি (নিম্নতর পর্যায়ে) পরিচালনা করছে আর সেগুলিকে প্রচণ্ড ও ভয়াবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। তারা তাদের কঠিন, শ্রমের মাটি লেগে থাকা হাত ভদ্রসম্প্রদায়ের উপর তুলেছে। তারা অসৎ ভদ্রলোকদের দড়ি দিয়ে বাঁধে, লম্বা গাধার টুপি তাদের মাথায় পরায় আর গ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায় (সিয়াংথান ও সিয়াংসিয়াংয়ে তারা এটাকে বলে “গ্রামের মধ্যে ঘোরান” এবং লিলিংয়ে বলে “মাঠের মধ্য দিয়ে ঘোরান”)। এমন একটা দিনও যায়না যে দিন তারা নিন্দাজ্ঞাপক কোন কর্কশ ও নির্মম কথা ওইসব ভদ্রসম্প্রদায়ের কানে প্রবিষ্ট না করায়। তারা হুকুম জারি করছে এবং সব কিছুরই পরিচালনা করছে। যারা থাকত সবার নিচে তাদের স্থান হয়েছে সবকিছুর উপরে এবং এজন্য এটাকে বলা হয়, “সবকিছু উল্টিয়ে দেয়া”।

বিপ্লবের অগ্রবাহিনী

কোন বিষয় বা মানুষ সম্পর্কে দুরকম বিরুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গীর অস্তিত্ব যেখানে আছে সেখানে দুই বিরুদ্ধ মতবাদ গড়ে উঠে। এর যথাযথ উদাহারণ হল একদিকে “এটা ভয়ংকর!” এবং অপরদিকে “এটা চমৎকার!”, একদিকে “ইতর”, অপরদিকে “বিপ্লবের অগ্রবাহিনী” এই দুই বিরুদ্ধ মতবাদ।

আমরা আগে বলেছি যে কৃষকরা এক বিপ্লবী কর্তব্য সম্পন্ন করেছে, যে কর্তব্য বহু বছর যাবত অস্পূর্ণ রাখা হয়েছিল, এবং তারা জাতীয় বিপ্লবের পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছে। কিন্তু এই মহান বিপ্লবী কর্তব্য, এই গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী কাজ কি সকল কৃষকরা মিলে সম্পন্ন করেছে? না। তিন রকমের কৃষকের অস্তিত্ব আছে—ধনী, মাঝারি ও গরীব কৃষক। এই তিন রকমের কৃষক ভিন্ন ভিন অবস্থায় জীবন ধারণ করে এবং সেইজন্য বিপ্লব সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী ভিন্ন রকমের। প্রথম পর্যায়কালে ধনী কৃষকদের কাছে মনকে নাড়া দিত চিয়াংসীতে উত্তরাঞ্চলে অভিযানকারী সেনাবাহিনীর চরম পরাজয়বরণ, চিয়াং কাইশেকের পায়ে আঘাতপ্রাপ্তি (টীকাঃ ১৯২৬ সালের শীতকালে এবং ১৯২৭ সালের বসন্তকালে উত্তরাঞ্চলে অভিযানকারী সৈন্যবাহিনী যখন ইয়াংসি নদীর উপত্যকায় প্রবেশ করছিল, চিয়াং কাইশেকের প্রতিবিপ্লবী স্বরূপটি তখনো সম্পূর্ণরূপে উদ্ঘাটিত হয়নি, এবং কৃষক জনগণ তখনো মনে করত সে বিপ্লবের পক্ষে। জমিদার ও ধনী কৃষকরা তাকে অপছন্দ করত এবং তারা গুজব রটায় যে উত্তরাঞ্চলে অভিযানকারি বাহিনী পরাজিত হয়েছে আর চিয়াং কাইশেক পায়ে আঘাত পেয়েছে। ১৯২৭ সালের ১২ই এপ্রিলে যখন চিয়াং কাইশেক যখন সাংহাই ও অন্যান্য স্থানে প্রতিবিপ্লবী ক্যুদেতা ঘটায়, শ্রমিকদের হত্যা করে, কৃষকদের দমন করে এবং সাম্যবাদী পার্টিকে আক্রমণ করে তখনই তার প্রতিবিপ্লবী স্বরূপটা পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ পায়। তখন থেকে জমিদাররা ও ধনী কৃষকরা তাদের মনোভাব পরিবর্তন করে তাকে সমর্থন করতে শুরু করে) এবং বিমানযোগে তার কুয়াংতোংয়ে [টীকাঃ প্রথম বিপ্লবী গৃহযুদ্ধের (১৯২৪-১৯২৭) সময়কালে কুয়াংতোং ছিল প্রথম বিপ্লবী ঘাঁটি] প্রত্যাবর্তন এবং উ পেইফু (টীকাঃ উ পেইফু ছিল উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধবাজদের সবচেয়ে কুখ্যাতদের মধ্যে একজন। যে শাও কুন ১৯২৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পার্লামেন্টের সভ্যদের ঘুষ দেবার কৌশল অবলম্বন করে কুখ্যাত হয়, তার সাথে একযোগে উ পেইফু উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধবাজদের চিলি (হোপেই প্রদেশ) চক্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে শাও কুনকে নেতা হিসেবে সমর্থন করে এবং এই দুইজনকে সাধারণভাবে শাও-উ বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯২০ সালে আনহুই চক্রের যুদ্ধবাজ তুয়ান চিজুইকে পরাজিত করার পর উ পেইফু ইঙ্গমার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল হিসেবে পিকিংয়ের উত্তরাঞ্চলীয় যুদ্ধবাজ সরকারের ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয়। এই ব্যক্তিই ১৯২৩ সালে ৭ই ফেব্রুয়ারি তারিখে পিকিং-হানচৌ রেলপথ বরাবর ধর্মঘটি শ্রমিকদের হত্যা করার আদেশ দিয়েছিল। ১৯২৪ সালে সাধারণভাবে “চিলি ও ফেংথিয়ান (ফেংথিয়ান হল লিয়াওনিং প্রদেশের রাজধানী শেনইয়াং এর পুরনো নাম) চক্রের যুদ্ধ” বলে খ্যাত যুদ্ধে চ্যাং শুলিনের সঙ্গে পরাজিত হয় এবং তারপর তাকে পিকিং সরকার থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু জাপানী ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্ররোচনায় সে ১৯২৬ সালে চাং শুলিনের সঙ্গে তার শক্তি যোগ করে এবং এইভাবে সে ক্ষমতায় পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। উত্তরাঞ্চলে অভিযানকারী বাহিনী ১৯২৬ সালে যখন কুয়াংতোং থেকে উত্তরাভিমুখে অগ্রসর হয় তখন উ পেইফু ছিল প্রথম শত্রু যাকে উচ্ছেদ করা হয়) কর্তৃক ইয়ুয়েচৌ পুনর্দখল সম্পর্কে কথাবার্তা। কৃষক সমিতিগুলি নিশ্চয়ই বেশি দিন টিকে থাকবেনা এবং তিন গণনীতি (টীকাঃ তিন গণ নীতি ছিল চীনদেশের বুর্শোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও জনগণের জীবিকার প্রশ্নে ডঃ সান ইয়াতসেনের নীতি ও কর্মসূচি। ১৯২৪ সালে গণ জাতীয় পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের ঘোষণাপত্রে সান ইয়াতসেন তিন গণনীতিকে পুনরায় ব্যাখ্যা করেন। এই ব্যাখ্যায় তিনি জাতীয়তাবাদকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হিসেবে প্রচার করেন এবং শ্রমিক ও কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থন জ্ঞাপন করেন। পুরনো তিন গণনীতি এইভাবে নতুন তিন গণনীতিতে রূপান্তরিত হয়, যার মধ্যে ছিল তিনটি মহান কর্মনীতি অর্থাৎ রাশিয়ার সাথে মৈত্রী, সাম্যবাদী পার্টির সাথে সহযোগিতা এবং কৃষক ও শ্রমিকদেরকে সাহায্য করা। এই নতুন তিন গণনীতি প্রথম বিপ্লবী গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে চীনা সাম্যবাদী পার্টি ও গণ জাতীয় পার্টির মধ্যে সহযোগিতার রাজনৈতিক ভিত্তি হয়ে উঠেছিল) কখনো সাফল্যমণ্ডিত হতে পারেনা, কারণ আগে তাদের কথা কখনো শোনা যায়নি। এর ফলে থানা কৃষক সমিতির কোন কর্মকর্তা (সাধারণত “ইতর” ধরণের কেউ) রেজিষ্টার হাতে করে কোন ধনী কৃষকের বাড়ী ঢুকে বলত, “আপনি দয়া করে কৃষক সমিতিতে যোগ দেবেন কি?” এর উত্তরে ধনী কৃষক কী জবাব দিত? ব্যবহারে মোটামুটি ভদ্র কেউ হয়ত বলত, “কৃষক সমিতি? বছরের পর বছর ধরে আমি এখানে বাস করছি আর আমার জমি চাষ করছি। আমি এই ধরনের কোন কিছুর কথা আগে কখনো শুনিনি, তবু আমি জীবনধারণ করতে বেশ সমর্থ হয়েছি। আমি তোমাকে উপদেশ দিই এসব ছেড়ে দাও”। যে ধনী কৃষক সত্যই দুষ্ট প্রকৃতির সে বলত, “কৃষক সমিতি! যত সব বাজে! নিজের মাথা কাটা পড়বার সমিতি এগুলো! মানুষকে ঝামেলায় ফেলোনা!” তবু আশ্চর্যের বিষয় কয়েক মাস হল কৃষক সমিতিগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সাহসের সাথে  ভদ্রসম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। আশেপাশের যে ভদ্রসম্প্রদায় তাদের আফিমের হুকা সমর্পণ করতে অস্বীকার করেছিল সমিতি তাদের গ্রেফতার করেছে এবং গ্রামের পথে তাদের ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। তাছাড়া, কাউন্টি শহরগুলিতে সিয়াংথানের ইয়েন জুঙচিউ এবং নিংসিয়াংয়ের ইয়াং চিশের মত কোন কোন বৃহৎ জমিদারকে হত্যা করা হয়েছে। অক্টোবর বিপ্লবের বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বৃটিশবিরোধী গণজমায়েতের সময় এবং উত্তরাভিযানের বিজয়োৎসব উপলক্ষে প্রতিটি থানার হাজার হাজার যুবক তাদের ছোটবড় পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে লাঙল ও কোদাল হাতে নিয়ে ঢেউয়ের মত বিরাট বিরাট মিছিল বের করেছে। কেবল তখনই ধনী কৃষকরা হতবুদ্ধি এবং ভীত হতে শুরু করে। উত্তরাভিযানের বিরাট বিজয়োৎসব পালনের সময় তারা জানতে পারে যে চিউচিয়াং শহর দখল করে নেয়া হয়েছে, চিয়াং কাইশেকের পায়ে আঘাত লাগেনি এবং শেষ পর্যন্ত উ পেইফুকে পরাজিত করা হয়েছে। আরো কথা হল, তারা দেখল “তিন গণনীতি দীর্ঘজীবি হোক!” “কৃষক সমিতিগুলি দীর্ঘজীবি হোক!” এবং “কৃষকরা দীর্ঘজীবি হোক!”—এই রকমের শ্লোগান “লাল ও সবুজ ঘোষণাপত্রে” স্পষ্টাক্ষরে লেখা হয়েছে। প্রচণ্ডভাবে হতবুদ্ধি ও ভীত হয়ে ধনী কৃষকরা অবাক হয়ে ভাবল, “এ আবার কি? ‘কৃষকরা দীর্ঘজীবি হোক’। এইসব লোককে এখন তাহলে সম্রাট বলে মনে করতে হবে নাকি?” এইভাবে কৃষক সমিতিগুলি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করছে। সমিতি থেকে আগত লোকেরা ধনী কৃষকদের বলে, “তোমাকে আমরা অন্য রেজিষ্টারে তালিকাভুক্ত করব”, কিংবা বলে, “আর এক মাসের মধ্যে ভর্তি ফি মাথা পিছু দাঁড়াবে দশ ইউয়ানে (টীকাঃ কয়েক ওয়েন নিয়ে এক ফেন, দশ ফেন এক চিয়াও, আর দশ চিয়াও এক ইউয়ান। ইউয়ান, চিয়াও, ফেন ছিল রৌপ্যনির্মিত চীনা মুদ্রা আর ওয়েন ছিল তামার মুদ্রা—বাংলা অনুবাদক)। এইসব অবস্থার চাপে পড়েই কেবল ধনী কৃষকরা অনিচ্ছার সাথে সমিতিতে যোগ দিচ্ছে (টীকাঃ ধনী কৃষকদেরকে কৃষক সমিতিতে যোগ দিতে দেয়া উচিত হয়নি সেই কথাটি ১৯২৭ সালে কৃষক জনগণ তখনো বুঝতে পারেনি)। ভর্তি হবার জন্য কেউ কেউ ৫০ ফেন অথবা এক ইউয়ান দিচ্ছে (নিয়মিত ফি হল মাত্র ১০ ওয়েন), কেউ কেউ ভর্তি হতে পারছে কেবল অন্য ব্যক্তিকে তার সম্পর্কে দু একটা সুপারিশ করতে বলার পর। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক অতিশয় গোঁড়া ব্যক্তি আছে যারা আজ পর্যন্ত যোগ দেয়নি। ধনী কৃষকরা যখন সমিতিতে যোগ দেয় তখন তারা সাধারণত তাদের পরিবারের ষাট অথবা সত্তুর বছরের কোন বৃদ্ধের নাম লেখায়, কারণ “তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদলে ভর্তি করা হবে” এই ভয়ে তারা সবসময় ভীতসন্ত্রস্ত। যোগ দেবার পর ধনী কৃষকরা সমিতির পক্ষে কোন কাজ করার আগ্রহ দেখায়না। তারা সবসময় নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকে।

মাঝারি কৃষকদের অবস্থা কী রকম? তাদের মনোবৃত্তি হল দোদুল্যমান। তারা মনে করে বিপ্লব তাদের জন্য বেশি ভাল কিছু করবেনা। তাদের হাঁড়িতে ভাত আছে এবং কোন পাওনাদার মধ্য রাতে তাদের দরজায় এসে করাঘাত করেনা। তারাও কোন একটা জিনিসের অস্তিত্ব আগে ছিল কিনা তা দিয়ে তার বিচার করে, ভ্রুকুঞ্চিত করে এবং নিজের মনে ভাবে, “কৃষক সমিতি কি সত্যই টিকে থাকতে পারবে?” “তিন গণনীতি কি সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে?” তাদের সিদ্ধান্ত হল, “তা মনে হয়না।” তারা কল্পনা করে এসব কিছু খোদার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে এবং ভাবে, “কৃষক সমিতি? কে জানে খোদা এটা চায় কিনা?” প্রথম পর্যায়কালে সমিতির লোকেরা রেজিষ্টার হাতে করে মাঝারি কৃষকদের সাথে সাক্ষাত করে বলত, “আপনি কি অনুগ্রহ করে কৃষক সমিতিতে যোগ দেবেন?” মাঝারি কৃষকটি উত্তর দিত, “এত তাড়াতাড়ির কিছু নেই”। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবার পরে যখন কৃষক সমিতিগুলি ইতিমধ্যেই বিরাট শক্তি প্রয়োগ করছিল তখনই কেবল মাঝারি কৃষকরা সমিতির অন্তর্ভুক্ত হল। সমিতিতে আসতে তারা ধনী কৃষকদের চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে কিন্তু এখনো খুব উৎসাহী নয়। তারা এখনো অপেক্ষা করে দেখতে চায়। মাঝারি কৃষকদের দলে টানা এবং তাদের মধ্যে বেশ খানিকটা ব্যাখ্যামূলক প্রচারণা চালান কৃষক সমিতিগুলির জন্য অপরিহার্য।

গ্রামাঞ্চলে গরীব কৃষকরাই সব সময় তিক্ত যুদ্ধের প্রধান শক্তি হয়ে এসেছে। গোপন ও প্রকাশ্য কর্মতৎপরতার দুটি পর্যায়ে তারা সোৎসাহে যুদ্ধ করেছে। সাম্যবাদী পার্টির নেতৃত্বের প্রতি তারাই সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল। তারাই স্থানীয় উৎপীড়ক ও অসৎ ভদ্রলোকদের সবচেয়ে মারাত্মক শত্রু এবং দ্বিধাহীনভাবে এদের আক্রমণ করে থাকে। ধনী কৃষকদের তারা বলে, “আমরা বহু পূর্বে কৃষক সমিতিতে যোগ দিয়েছি,  তোমরা এখনো ইতস্তত করছ কেন?” ধনী কৃষকরা বিদ্রুপের সাথে উত্তর দেয়, “তোমাদের যোগ না দেয়ার কী কারণ আছে? তোমাদের মাথার উপর না আছে একটা টালি না আছে পায়ের নিচে একফালি জমি”। একথা সত্য যে গরিব কৃষকরা কোন কিছু হারাবার ভয়ে ভীত নয়। বাস্তবিকই তাদের অনেকেরই “মাথার উপর না আছে একটা টালি না আছে পায়ের নিচে একফালি জমি”। সত্যিই সমিতিতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকার তাদের কীইবা কারণ আছে? চাংশা জেলার সমীক্ষা অনুযায়ী গরিব কৃষকরা গ্রামাঞ্চলের জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগ, মাঝারি কৃষকরা ২০ ভাগ এবং জমিদার ও ধনী কৃষকরা শতকরা ১০ ভাগ। শতকরা ৭০ ভাগ গরিব কৃষকদের আবার দুভাগে ভাগ করা চলে, একেবারে নিঃস্ব এবং তুলনামুলক কম নিঃস্ব। “একেবারেই নিঃস্বরা” [টীকাঃ একেবারেই নিঃস্ব হল ক্ষেতমজুর (গ্রাম্য সর্বহারা) এবং গ্রাম্য ভবঘুরে সর্বহারা] হল গ্রামীণ জনগণের শতকরা ২০ ভাগ, তারা সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত অর্থাৎ তারা এমন সব লোক যাদের জমিও নেই, টাকা পয়সাও নেই, জীবিকা নির্বাহের কোন উপায়ই তাদের নেই, তারা বাধ্য হয়ে গৃহত্যাগ করে এবং তারপর তারা হয় ভাড়াটে সৈন্য হয়ে যায়, নয়ত হয় ভাড়াটে শ্রমিক, নইলে হয় ভবঘুরে ভিক্ষুক। “তুলনামূলক কম নিঃস্বরা (টীকাঃ তুলনামূলক কম নিঃস্ব হল গ্রামাঞ্চলের আধাসর্বহারা) গ্রামীণ জনগণের বাকী শতকরা ৫০ ভাগ। তারা অংশত বঞ্চিত অর্থাৎ তারা এমন সব লোক যাদের যৎসামান্য জমি আছে কিংবা অল্প কিছু টাকা পয়সা আছে। তারা যা আয় করে তার চেয়ে বেশি খেয়ে ফেলে এবং সারাবছর ধরে তারা কঠোর পরিশ্রম ও দুর্দশার মধ্যে জীবন ধারণ করে। এই ধরণের লোকের মধ্যে আছে হস্তশিল্পী, বর্গা কৃষক (ধনী বর্গাকৃষক বাদ দিয়ে) এবং আধামালিক কৃষক। গরিব কৃষকদের এই বিরাট জনসংখ্যা অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলের জনসংখ্যার মোটমাট ৭০ ভাগ লোক কৃষক সমিতিগুলির মেরুদণ্ড, সামন্তীয় শক্তিকে উৎখাত করার অগ্রবাহিনী আর তারাই হল বহু বছর ধরে অসম্পন্ন বিরাট বিপ্লবী কর্তব্য সম্পন্ন করার বীর সেনানী। গরিব কৃষক শ্রেণী (বা ভদ্রসম্প্রদায় যাদেরকে বলে “ইতর”) ব্যতীত  গ্রামাঞ্চলে বর্তমান বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্ভব হতনা কিংবা স্থানীয় নিপীড়ক ও অসৎ ভদ্রলোকদের উৎখাত করা ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করাও সম্ভব হতনা। গরিব কৃষকরা সবচেয়ে বিপ্লবী গোষ্ঠী বলে তারা কৃষক সমিতিগুলির নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় পর্যায়েই কৃষক সমিতিগুলির নিম্নতম স্তরে সভাপতি ও কমিটি সদস্যদের প্রায় সকলেই ছিল গরিব কৃষক (হেংশান কাউন্টির থানা কৃষক সমিতিগুলির অফিসারদের মধ্যে “একেবারেই নিঃস্বরা” ছিল শতকার ৫০ ভাগ জন, “অপেক্ষাকৃত কম নিঃস্বরা” ছিল শতকরা ৪০ জন এবং দারিদ্র প্রপীড়িত বুদ্ধিজীবিরা ছিল শতকার ১০ ভাগ জন)। গরিব কৃষকদের নেতৃত্ব একেবারেই অপরিহার্য। গরিব কৃষক ছাড়া বিপ্লব হতনা। তাদের ভূমিকাকে অস্বীকার করার অর্থ বিপ্লবকে অস্বীকার করা। তাদেরকে আক্রমণ করার অর্থ বিপ্লবকে আক্রমণ করা। বিপ্লবের সাধারণ গতিমুখ সম্পর্কে তারা কোনদিনই ভুল করেনি। স্থানীয় নিপীড়ক ও অসৎ ভদ্রলোকদের মর্যাদা তারা নষ্ট করে দিয়েছে। ছোটবড় সকল স্থানীয় নিপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাসদের তারা ধুলায় লুন্ঠিত করেছে এবং পায়ের তলায় দাবিয়ে রেখেছে। বিপ্লবী কর্মকান্ডের পর্যায়ে তাদের কার্যকলাপের অনেকগুলি—যেগুলিকে “বাড়াবাড়ি করা” বলে অভিহিত করা হয়—ছিল ঠিক সেইসব কাজ বিপ্লবের জন্য যা দরকার ছিল। হুনানের কোন কোন কাউন্টি সরকার, গণ জাতীয় পার্টির কাউন্টি সদরদপ্তর এবং কাউন্টি কৃষক সমিতিগুলি ইতিমধ্যেই কতকগুলি ভুল করেছে। এমনকি কেউ কেউ জমিদারদের অনুরোধে নিম্নস্তরের কৃষক সমিতির অফিসারদের গ্রেফতার করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেছে। হেংশান ও সিয়াংসিয়াং কাউন্টির থানা কৃষক সমিতির বেশ কয়েকজন সভাপতি ও কমিটি সদস্যকে জেলে দেয়া হয়েছে। এই ভুল খুবই গুরুতর এবং এতে প্রতিক্রিয়াশীলদের ঔদ্ধত্য উৎসাহ পায়। এটা একটা ভুল কিনা তা বিচার করতে হলে যেখানেই স্থানীয় কৃষক সমিতির সভাপতি বা কমিটিসদস্যকে গ্রেফতার করা হয় সেখানেই কেবল আপনি লক্ষ্য করবেন এতে উচ্ছৃংখল জমিদাররা কি উৎফুল্ল হয়ে উঠে এবং প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা কীভাবে বেড়ে উঠে।

“ইতর লোকদের আন্দোলন” এবং একটি “অলস কৃষকদের আন্দোলন” ধরণের প্রতিবিপ্লবী কথাবার্তা আমাদের প্রতিরোধ করতেই হবে এবং আমাদেরকে অবশ্যই বিশেষভাবে সাবধান হতে হবে যেন গরিব কৃষক শ্রেণীর উপর স্থানীয় নিপীড়ক ও অসৎ ভদ্রলোকদের আক্রমণকে সহায়তা করার মত ভুল আমরা না করি। যদিও নিঃসন্দেহে গরিব কৃষক নেতাদের অল্প কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে গলদ ছিল তবু তাদের মধ্যে বেশিরভাগই এখন শুধরে উঠেছে। তারা নিজেরাই উৎসাহের সঙ্গে জুয়া নিষিদ্ধ করছে আর ডাকাতি দমন করছে। কৃষক সমিতি যেখানে শক্তিশালি সেখানে জুয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে এবং ডাকাতির পাত্তা নেই। কোন কোন স্থানে একথা আক্ষরিক অর্থে সত্য যে, পথের ধারে কোন জিনিস ফেলে রাখলেও লোকে তা নেয়না এবং রাতে দরজার খিল দেওয়াও হয়না। হেংশানের সমীক্ষা অনুযায়ী গরীব কৃষক নেতাদের শতকরা ৮৫ জনের বিরাট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এবং তারা তাদেরকে সমর্থ ও কঠিন পরিশ্রমী বলে প্রমাণ করেছে। শতকরা কেবল ১৫ জনের কিছু কিছু বদভ্যাস রয়ে গেছে। তাদের সম্পর্কে বড় জোর বলা যায় যে তারা হল “এক অস্বাস্থ্যকর সংখ্যালঘু” এবং স্থানীয় নিপীড়ক ও অসৎ ভদ্রলোকদের মতের প্রতিধ্বনি করে আমরা অবশ্যই তাদেরকে “ইতর” বলে নির্বিচারে নিন্দা করবনা। এই “অস্বাস্থ্যকর সংখ্যালঘু”র সমস্যা সমাধান করা যায় কেবলমাত্র কৃষক সমিতিগুলির “শৃংখলা জোরদার কর” এই নিজস্ব শ্লোগানের মাধ্যমে, ব্যাপক জনসাধারণের মধ্যে প্রচারণা চালিয়ে, “অস্বাস্থ্যকর সংখ্যালঘু”দের শিক্ষিত করে এবং সমিতিগুলির শৃংখলা দৃঢ় করে। কোন অবস্থাতেই নির্বিচারে সৈন্য পাঠিয়ে এমন সব গ্রেফতার করা উচিত নয় যা গরিব কৃষকদের মর্যাদা হানি করে। এই বিষয়টির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া দরকার।।

 

চৌদ্দটি মহান কীর্তি­­

কৃষক সমিতির অধিকাংশ সমালোচক অভিযোগ করে যে তারা অনেক খারাপ কাজ করেছে। আমি ইতিমধ্যেই ব্যাখ্যা করেছি যে স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকদের উপর­­­ কৃষকদের আক্রমণ পুরোপুরি বিপ্লবী চরিত্রের, আর কোনভাবেই দোষারোপ যোগ্য নয়। কৃষকরা বহু কাজ সম্পাদন করেছেন। আর সমালোচনার জবাব দিতে তাদের সকল কর্মকান্ডকে আমাদের একে একে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে আসলেই তারা কী করেছেন। তাদের বিগত কয়েক মাসের তৎপরতার আমি শ্রেণীবিশ্লেষন ও সারসংকলন করেছি। সব মিলিয়ে কৃষক সমিতিগুলির নেতৃত্বে কৃষকরা নিম্নলিখিত ১৪টি মহান কীর্তি সম্পন্ন করেছেন।

১। কৃষকদের কৃষক সমিতিতে সংগঠিত করা

এটাই হল কৃষকদের প্রথম মহান কীর্তি। সিয়াংতান, সিয়াংসিয়াং ও হেংশানের মত কাউন্টিতে সকল কৃষককে সংগঠিত করা হয়েছে, আর এমন কোন দূরবর্তী স্থান নেই যেখানে তারা যায়নি। এসব প্রথম সারিতে পড়ে। ইইয়াং ও হুয়াজুংয়ের মত কাউন্টিতে অধিকাংশ কৃষক সংগঠিত হয়েছে, শুধু অল্প একটি অংশ অসংগঠিত রয়েছে। এই স্থানগুলো দ্বিতীয় সারির। চেংপু ও লিংলিংয়ের মত কাউন্টিতে ছোট একটি অংশ সংগঠিত হয়েছে, অধিকাংশই অসংগঠিত রয়ে গেছে। এই স্থানগুলো তৃতীয় সারির। ইউয়ান শুমিঙ(টীকাঃ ইউয়ান শুমিঙ ছিল কুইচৌ প্রদেশের যুদ্ধবাজ। সে তখন হুনানের পশ্চিমাংশ শাসন করত)এর নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম হুনান এখনো সমিতির প্রচারাধীনে পৌঁছেনি, আর এর অনেক কাউন্টিতে কৃষকরা সম্পূর্ণভাবে অসংগঠিত। এগুলো চতুর্থ গ্রেডের। চাংশাকে কেন্দ্র করে মধ্য হুনানের কাউন্টিগুলি সবচেয়ে অগ্রসর। দক্ষিণ হুনানের কাউন্টিগুলি দ্বিতীয়, আর পশ্চিম হুনানে সংগঠন কেবল গড়ে উঠতে শুরু করেছে। গত নভেম্বরে প্রাদেশিক কৃষক সমিতি কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যানুসারে, প্রদেশের পঁচাত্তরটির মধ্যে সাইত্রিশটিতে তের লাখ সাতষট্রি হাজার সাতশ সাতাশ (১৩,৬৭,৭২৭) জন সদস্য হয়েছে। এর মধ্যে দশ লাখের মত সংগঠিত হয়েছে অক্টোবর ও নভেম্বরে যখন সমিতিগুলির ক্ষমতা শীর্ষে উঠেছিল, যেখানে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংখ্যাটা ছিল ৩,০০,০০০-৪,০০,০০০ জন। তারপর ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে কৃষক আন্দোলন তার দ্রুত বৃদ্ধি অব্যাহত রাখে। জানুয়ারী শেষে সদস্য সংখ্যা বিশ লাখে অবশ্যই পৌঁচেছে। একটি পরিবার থেকে একজন সাধারণত সদস্যে নাম লেখায়, আর পরিবারের সদস্য সংখ্যা গড়ে পাঁচজন, তাই সংগঠনের অনুসারী দাঁড়িয়েছে প্রায় এক কোটি। এই আশ্চর্য দ্রুতবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করে কীভাবে স্থানীয় নিপীড়ক, অসৎ ভদ্রবেশী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, কীভাবে জনগণ অভিভূত হয় এটা দেখে যে কৃষক আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দুনিয়া কত পূর্ণভাবে বদলে গেছে এবং গ্রামাঞ্চলে এক মহান বিপ্লব ঘটেছে। কৃষক সমিতিগুলির নেতৃত্বে এটাই হল কৃষকদের প্রথম মহান অর্জন।

২। জমিদারদের রাজনৈতিকভাবে আঘাত করা

সংগঠন গড়ে তোলার পর কৃষকদের প্রথম যে কাজটা করে তা হল জমিদার শ্রেণীর এবং বিশেষত স্থানীয় নিপীড়ক ও অসৎ ভদ্রবেশীদের রাজনৈতিক মর্যাদা ও ক্ষমতা ধ্বংস করা, অর্থাৎ গ্রামীন সমাজে জমিদারদের কর্তৃত্ব উচ্ছেদ করা আর কৃষকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এটা হচ্ছে চরম গুরুত্বপূর্ণ ও জীবনমরণ সংগ্রাম। দ্বিতীয় পর্যায় অর্থাৎ বিপ্লবী তৎপরতার পর্যায়ে এটাই হল কেন্দ্রীয় সংগ্রাম। এই সংগ্রামে বিজয় ছাড়া খাজনা ও সুদ কমানো, ভূমি ও অন্যান্য উৎপাদনের উপায় দখলের মত অর্থনৈতিক সংগ্রামে বিজয় সম্ভব নয়। হুনানের সিয়াংসিয়াং, হেংশান ও সিয়াংতাঙের মত অনেক কাউন্টিতে এটা কোন ব্যাপারই নয়, কারণ সেখানে জমিদারদের কর্তৃত্ব ধ্বংস করে কৃষকদের সর্বসময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু লিলিঙের মত কাউন্টিতে এখনো এমন কিছু এলাকা আছে (যেমন লিলিঙের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো) যেখানে জমিদারদের কর্তৃত্ব কৃষকদের চেয়ে তুলনামূলক দূর্বল মনে হলেও, রাজনৈতিক সংগ্রাম এখনো তীক্ষ্ণতর না হওয়ার কারণে গোপনে প্রতিযোগিতা করছে। এমন এলাকাগুলোতে কৃষকরা রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করেছে একথা বলার সময় এখনো আসেনি। তাদেরকে আরো প্রবলভাবে রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে হবে জমিদারদের কর্তৃত্ব পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত। সবমিলিয়ে জমিদারদের রাজনৈতিকভাবে আঘাত হানতে কৃষকরা যে পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করেছে তা নিম্নরূপঃ

হিসাব পরীক্ষা করা। প্রায়ই স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রবেশীরা তাদের হাতে আসা জনগণের টাকা আত্মসাৎ করেছে, আর তাদের হিসাব খাতা বিশৃংখল। এখন কৃষকরা এগুলো যাচাই করছে বিপুল সংখ্যক স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকদের পতন ঘটানোর উপলক্ষ্য হিসেবে। অনেক জায়গায় হিসাব যাচাইয়ের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের আর্থিক সঠিক তথ্য স্থির করতে যা তাদের কাঁপিয়ে দিয়েছে। যেসব কাউন্টিতে কৃষক আন্দোলন সক্রিয় সেখানে এধরণের অভিযান চালানো হয়েছে। এগুলো টাকা উদ্ধারের জন্য যতনা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে স্থানীয় নিপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাসদের অপরাধ জনগণের সামনে উন্মোচন করার ও তাদেরকে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে ভূলুন্ঠিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

জরিমানা ধার্য করা। কৃষকরা এ ধরণের অপরাধের জন্য জরিমানা ধার্য করে যথা হিসাব যাচাইয়ে অনিয়ম ধরা পড়লে, কৃষকদের প্রতি অতীত অত্যাচার, বর্তমান তৎপরতা যা কৃষক সমিতিকে অসম্মান করে, জুয়া বন্ধ না মানা এবং আফিম হুঁকা ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি। এই স্থানীয় নিপীড়ককে এত টাকা জরিমানা দিতে হবে, এই অসৎ ভদ্রলোককে এত টাকা জরিমানা দিতে হবে ইত্যাদি, যা দশ বিশ থেকে হাজার হাজার ইউয়ান হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে কৃষকদের দ্বারা জরিমানাকৃতরা পুরোপুরি মানসম্মান হারায়।

চাঁদা সংগ্রহ। নীতিহীন ধনী জমিদারদের দরিদ্রদের প্রতি সাহায্য, সমবায় সমিতি অথবা কৃষক ঋণসমিতির জন্য অথবা অন্যান্য উদ্দেশ্যে চাঁদা দিতে প্রস্তুত করা হয়।

জরিমানার থেকে হালকা হলেও, এই অবদানগুলো শাস্তির একটা রূপ। ঝামেলা এড়াতে বেশ কিছু জমিদার কৃষক সমিতিতে স্বেচ্ছায় চাঁদা দেয়।

ছোটখাট প্রতিবাদ। যখন কেউ কথায় বা কাজে কৃষক সমিতির ক্ষতি করে আর অপরাধটি যদি ছোটখাট হয়, তখন কৃষকরা বোঝাপড়া করতে দল বেঁধে অপরাধীর বাড়ীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে সাধারণত “বিরত ও নিবৃত্ত” হওয়ার প্রতিশ্রুতি লিখে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় যাতে সে স্পষ্টভাবে ভবিষ্যতে কৃষক সমিতির জন্য মর্যাদাহানিকর কার্যকলাপ বন্ধ করার অঙ্গিকার করে।

বড় বিক্ষোভ প্রদর্শন। সমিতির শত্রু এক স্থানীয় অত্যাচারী অথবা অসৎ ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে এক বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। বিক্ষোভকারীরা অপরাধীর বাড়িতে তার শুকর জবাই করে আর তার শস্য নিয়ে খানাপিনা করে। এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি সিয়াংতান কাউন্টির মাচিয়াহোতে একটা ঘটনা ঘটেছে যেখানে পনের হাজার কৃষক ছয়জন অসৎ ভদ্রলোকের বাড়িতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পুরো ঘটনাটি চারদিন স্থায়ী হয়েছিল যেখানে ১৩০টিরও বেশি শূকর মেরে খাওয়া হয়। এই ধরণের বিক্ষোভের পর কৃষকরা সাধারণত জরিমানা ধার্য করে।

জমিদারদের গাঁধার টুপি পরিয়ে গ্রামের মধ্যে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো। এধরণের ঘটনা খুব সাধারণ। একটা লম্বা কাগজের টুপি স্থানীয় নিপীড়ক অথবা ভদ্রবেশী বদমাসদের মাথায় পরানো থাকে যেখানে লেখা থাকে “অমুক স্থানীয় অত্যাচারী “অথবা” অমুক ভদ্রবেশী বদমাস”। তাকে জনতার ভীড়ের মধ্যে দঁড়ি দিয়ে টেনে নেয়া হয়। অনেক সময় ঘন্টা বাজানো হয় ও পতাকা উড়ানো হয় জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। এই ধরণের শাস্তি অন্য যে কোন ধরণের চেয়ে স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটদের বেশি কাঁপন ধরায়। একবার যে গাঁধার টুপি মাথায় পড়েছে, তার মান ইজ্জত হারায়, আর কখনো মাথা তুলতে পারেনা। তাই ধনীদের অনেকেই গাঁধার টুপি পরার চেয়ে জরিমানা পছন্দ করে। কিন্তু কৃষকরা যদি জিদ ধরে তাদের এটা পরতেই হবে।

একদিন এক প্রতিভাবান থানা শহরের কৃষক সমিতি ভদ্র সম্প্রদায়ের এক জঘন্য সদস্যকে গ্রেফতার করে আর ঘোষণা করল যে ঐদিনই তাকে গাঁধার টুপি পরানো হবে। লোকটি ভয়ে নীল হয়ে গেল। তখন সমিতি তাকে সেদিন টুপি না পরানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মত প্রকাশ করল যে তখন তাকে টুপি পরানো হলে সে ঘ্যাঁচড়া হয়ে যাবে আর ভয় পাবেনা, তাই ভাল হবে আজ তাকে বাড়ি যেতে দেয়া। টুপি তাকে আরেকদিন পরানো যাবে। ঠিক কোন দিন তাকে টুপি পরানো হবে তা না জেনে লোকটি প্রতিদিন আতঙ্কিত থাকত, সহজে চলাফেরা বা ঘুমাতে পারতনা।

জমিদারদের কাউন্টি জেলে বন্দী করা। এটা গাঁধার টুপি পড়ানোর চেয়ে ভারি শাস্তি। একজন স্থানীয় অত্যাচারি অথবা টাউট ভদ্রবশীকে গ্রেফতার করে বিভাগীয় জেলে পাঠানো হয়। তাকে বন্দী রাখা হয়। বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটকে বাধ্য করা হয় তার বিচার করে শাস্তি দিতে। যারা বন্দী হয় তারা আর আগের লোক নয়। আগে ভদ্রলোকেরা কৃষকদের বন্দী করত, এখন বিপরীত।

“নির্বাসন”। স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটদের মধ্যে সর্বাধিক জঘন্য অপরাধীদের নির্বাসন দেয়ার কোন ইচ্ছাই কৃষকদের নেই বরং তাদের গ্রেফতার অথবা মৃত্যুদণ্ড দিতে ইচ্ছুক তারা। গ্রেফতার অথবা মৃত্যুদন্ডের ভয়ে তারা পালিয়ে যায়। অধিক বিকশিত কৃষক আন্দোলনের বিভাগগুলিতে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটরা পালিয়ে গেছে যা নির্বাসনের সমান। এদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়রা সাংহাইয়ে পালিয়ে গেছে, দ্বিতীয় সারিররা হ্যাংকাউয়ে পালিয়েছে, তৃতীয় সারিররা চাংশায় পালিয়েছে আর চতুর্থ সারিররা বিভাগীয় শহরগুলিতে পালিয়েছে। পলাতক স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটদের মধ্যে সাংহাইয়ে যারা পালিয়েছে তারা সবচেয়ে নিরাপদ, যারা হ্যাংকাউয়ে পালিয়েছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন হুয়াংজুর তিনজন শেষ পর্যন্ত ধরা পরে ফেরত এসেছে। চাংশায় যারা পালিয়েছে তারা ঐসব কাউন্টি থেকে প্রাদেশিক রাজধানীতে পড়তে আসা ছাত্রদের দ্বারা ধরা পরার বিরাট বিপদে আছে। আমি নিজেই চাংশায় দুজনকে ধরা পড়তে দেখেছি।

যারা বিভাগীয় শহরগুলিতে আশ্রয় নিয়েছে তারা চতুর্থ সারির, আর কৃষকদের অনেক চোখ ও কান থাকায় তারা সহজেই তাদের খুঁজে বের করতে পারে। কৃষকরা স্বচ্ছলদের নির্বাসন দিচ্ছিল এই কথা উল্লেখ করে হুনান প্রাদেশিক সরকারের কর্মকর্তারা টাকা উত্তোলনে যে সমস্যা মোকাবেলা করছিল তা ব্যাখ্যা করে। এ থেকে বোঝা যায় যে স্থানীয় নিপীড়ক ও ভদ্রবেশী বদমাসদের তাদের গ্রামে কতটা কম সহ্য করা হচ্ছে।

মৃত্যুদণ্ড। স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী বদমাসদের সবচেয়ে খারাপদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। কৃষকরা জনগণের অন্যান্য অংশের সাথে মিলে এটা পরিচালনা করে। উদাহারণস্বরূপ, নিংসিয়াংয়ের ইয়াং চিহশে, ইউয়েহিইয়াংয়ের চৌ চিয়াকান ও হুয়াজুনের ফু তাওনান ও সুন পোচুকে কৃষক ও জনগণের অন্যান্য অংশের দাবিতে সরকারী কর্তৃপক্ষ গুলি করে মারে। শিয়াংতানের ইয়েন জুঙচিউকে কৃষক ও জনগণের অন্যান্য অংশ হস্তান্তরের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে রাজি করায়, তারপর নিজেরাই মৃত্যুদণ্ড দেয়। নিংসিয়াঙের লিউ চাও কৃষকদের হাতে মারা যায়। লিলিংয়ের পেঙ চিহফ্যান, ই ইয়াংয়ের চৌ তিয়েনচুয়েহ ও সাউ ইউনের মৃত্যুদণ্ড ঝুলে আছে স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটদের বিচারের বিশেষ আদালতে। এমন এক বড় জমিদারের মৃত্যুদণ্ড সারা দেশে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে, আর সারা দেশে সামন্তবাদের দুষ্ট অবশেষের বিলোপে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকরও। প্রতিটি বিভাগেই বড় বড় নিপীড়ক আছে, কোন কোনটিতে কয়েক ডজন আছে, অন্যগুলোতে কমকরে হলেও কয়েক জন আছে, আর প্রতিক্রিয়াশীলদের দমনের একমাত্র কার্যকর পথ হচ্ছে প্রতি কাউন্টিতে অল্পকিছু মৃত্যুদণ্ড দেয়া যারা সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধে অপরাধী। যখন স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটরা ক্ষমতায় ছিল তারা আক্ষরিক অর্থেই চোখের পলক ফেলার আগেই কৃষকদের জবাই করত।  দশ বছর চাঙশা বিভাগের সিংকিয়াং শহরের বাহিনী প্রধান ছিল হো মেইচুয়ান যে প্রায় এক হাজার দারিদ্রপীড়িত কৃষক হত্যার জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী ছিল, যাকে সে ঠান্ডা গলায় “ডাকাতদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান” হিসেবে বর্ণনা করে। আমার নিজ বিভাগ সিয়াংতানে ইনতিয়েন শহরে সৈন্যবাহিনী প্রধান তেঙ চুনইয়েন ও লো শুলিন পঞ্চাশের বেশী জনগণকে হত্যা করেছে আর চারজনকে জীবন্ত কবর দিয়েছে ১৯১৩ সাল থেকে চৌদ্দ বছরে। যে পঞ্চাশ জনকে তারা খুন করেছে তার প্রথম দুইজন ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ ভিক্ষুক। তেঙ চুনইয়েন বলল, “একজোড়া ভিক্ষুক মেরে শুরু করি”। এভাবে দুটি জীবন শেষ করে দিল। আগের দিনে এমনই ছিল স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটদের নিষ্ঠুরতা, গ্রামাঞ্চলে তারা যে শ্বেতসন্ত্রাস কায়েম করেছিল তা ছিল এমনই, আর আজকে যখন কৃষকরা জেগে উঠেছে, কয়েকজনকে হত্যা করেছে, প্রতিবিপ্লবীদের দমনে সামান্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, এমন বলার কোন কারণ আছে কি যে এটা তাদের করা উচিৎ নয়?

৩। জমিদারদের অর্থনৈতিকভাবে আঘাত হানা

শস্য এলাকার বাইরে পাঠানো, জোরপূর্বক দাম বৃদ্ধি, মজুদদারী ও কৃত্রিম সংকট তৈরি নিষিদ্ধকরণ। এটা হুনান কৃষকদের অর্থনৈতিক সংগ্রামে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে এক বিরাট অর্জন। গত অক্টোবর মাস থেকে গরীব কৃষকরা জমিদার ও ধনী কৃষকদের শস্য বাইরে পাঠানো প্রতিরোধ করেছে আর শস্যের জোরপূর্বক দাম বৃদ্ধি, মজুদদারী ও কৃত্রিম সংকট তৈরি নিষিদ্ধ করেছে। ফলে গরীব কৃষকরা সম্পূর্ণভাবে তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছে। শস্যের বহিপ্রবাহ নিষিদ্ধকরণ অলঙ্ঘনীয়। শস্যের দাম যথেষ্ট কমেছে, আর মজুদদারী ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার অবসান হয়েছে।

খাজনা ও জামানত বৃদ্ধি নিষিদ্ধকরণঃ খাজনা ও জামানত কমানোর আন্দোলন [টীকাঃ জামানত হচ্ছে একজন কৃষক সাধারণত জমিদারকে চাষের শর্ত হিসেবে নগদ টাকা বা অন্য সম্পদ দেয় যা জমির দামের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয় প্রায়ই। এটা খাজনা দেয়ার এক নিশ্চয়তা হিসেবে ধরা হলেও, প্রকৃতপক্ষে এটা অতিরিক্ত শোষণ]। গত জুলাই ও আগস্টে যখন কৃষক সমিতিগুলি দুর্বল ছিল, জমিদাররা তাদের দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত সর্বোচ্চ শোষণের প্রথার ধারাবাহিকতায় তাদের চাষীদের একের পর এক নোটিশ দেয় যে খাজনা ও জামানত বৃদ্ধি করা হবে। অক্টোবরের মধ্যে কৃষকরা শক্তিতে যখন যথেষ্ট বেড়ে গেল আর খাজনা ও জমা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল, তখন জমিদাররা এ নিয়ে একটি কথাও আর বলতে সাহস করলনা। নভেম্বরের পর থেকে কৃষকরা যখন জমিদারদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করল, তারা খাজনা ও জমা কমানোর বিরুদ্ধে আন্দোলনের আরো পদক্ষেপ নিল। এখন তারা বলছে, দুঃখের বিষয় কৃষকরা যখন গত শরতে খাজনা দিয়েছে তখন কৃষক সমিতিগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলনা অথবা তাহলে তারা খাজনা কমিয়ে দিতে পারত। আসছে শরতে খাজনা কমানোর জন্য কৃষকরা প্রচুর প্রচার চালাচ্ছে আর জমিদাররাও জানতে চায় কীভাবে খাজনা কমানো যায়। জামানত কমানোর ব্যাপারে বলতে গেলে এটা হেংশান ও অন্যান্য বিভাগে ইতিমধ্যেই কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রজাস্বত্ব বাতিল নিষিদ্ধকরণ। গত বছরের জুলাই ও আগস্টে অনেক জমিদারকে দেখা গেছে প্রজাস্বত্ব বাতিল করে জমি পুনরায় জমি রেখেছে। কিন্তু অক্টোবরের পর কেঁউ প্রজাস্বত্ব বাতিলের সাহস করেনি। আজকে প্রজাস্বত্ব বাতিল ও জমি পুনরায় রাখা প্রশ্নের অতীত। যা বাকি আছে তা হল জমিদার যদি নিজে আবাদ করতে চায় তাহুলে সে প্রজা কৃষক বাতিল করতে পারে কিনা। কিছু এলাকায় এটাও কৃষকরা অনুমোদন করেনা। কিছু এলাকায় কৃষক বাতিল করা যায় যদি জমিদার জমি নিজে চাষ করতে চায়, কিন্তু তখন কৃষকদের মধ্যে বেকারত্ব সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যার সমাধানের কোন সুষম পথ এখনো তৈরি হয়নি।

সুদ কমানো। আনহুয়াতে সুদ কমানো হয়েছে, আন্যান্য কাউন্টিতেও কমানো হয়েছে। কিন্তু যেখানেই কৃষকসমিতিগুলি শক্তিশালী, গ্রামীন সুদী কারবার বাস্তবিক বিলুপ্ত হয়েছে, জমিদাররা এই ভয়ে “টাকা খাটানো” বন্ধ করেছে যে টাকা “সর্বসাধারণের” করা হবে। বর্তমানে যাকে সুদ কমানো বলা হচ্ছে তা পুরনো ঋণের সাথে সম্পর্কিত।

এই ধরণের পুরনো ঋণের সুদ কমানোই শুধু হয়নি, দাতাকে মূলধনের পুনপরিশোধের চাপ দিতে নিষেধ করা হয়েছে, গরীব কৃষক উত্তর দেয়, “আমাকে দোষ দেবেননা। বছর প্রায় শেষ। আগামী বছর আমি আপনাকে শোধ করব”।

৪। স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকদের সামন্ত শাসন উচ্ছেদ। তু ও তুয়ান ধ্বংস করা

(টীকাঃ হুনানে তু হল জেলা আর তুয়ান হল থানা। তু ও তুয়ানের পুরোনো প্রশাসন ছিল জমিদারদের শাসনের যন্ত্র)-

তু ও তুয়ান এ বিশেষ করে, তু স্তরে যা কাউন্টির ঠিক নিচের স্তর, রাজনৈতিক ক্ষমতার পুরনো অঙ্গগুলি প্রায় পুরোপুরি স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকদের হাতে ছিল। তুর আধিপত্য ছিল দশ থেকে পঞ্চাশ বা ষাট হাজারের ওপর জনগণের উপর, তাদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী ছিল যথা থানা রক্ষী বাহিনী; তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিল যথা প্রতি মৌতে খাজনা নেয়ার ক্ষমতা (টীকাঃ প্রতি মৌতে কর ধার্য করা ছিল নিয়মিত করের উপর এক অতিরিক্ত কর। জমিদার সরকার নির্মমভাবে কৃষকদের উপর এই বাড়তি কর ধার্য করত), নিজস্ব বিচারিক ক্ষমতা ছিল যথা কৃষকদের ইচ্ছামত গ্রেফতার, বন্দী করা, বিচার করা ও শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা। এই অঙ্গগুলির পরিচালনা অসৎ ভদ্রলোকেরা ছিল গ্রামাঞ্চলের প্রকৃত রাজা। তুলনামূলকভাবে বলতে গেলে, কৃষকরা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, প্রাদেশিক সামরিক শাসক (টীকাঃ উত্তরাঞ্চলীয় যুদ্ধবাজদের শাসনামলে প্রদেশের সামরিক প্রধান ছিল প্রকৃতপক্ষে প্রদেশের একনায়ক সর্বেসর্বা, সমগ্র প্রদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা তার হাতে থাকত। সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে যোগসাজশে তারা স্থানীয় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সামন্ততান্ত্রিক-সামরিক ব্যবস্থা চালু রাখত) অথবা কাউন্টি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে অতটা চিন্তিত ছিলনা, তাদের প্রকৃত “অধিপতি ছিল গ্রামীন রাজারা। এই লোকের স্রেফ একটু নাসিকা গর্জন শুনলেই কৃষকরা জানত তাদের সতর্ক হতে হবে। গ্রামে বর্তমান বিদ্রোহের ফল হিসেবে জমিদার শ্রেণীর উপর আঘাত হানা হয়েছে, আর এই ঢেউয়ের ধাক্কায় স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটদের গ্রামীণ শাসনব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবে ধ্বংস হয়েছে। তু ও তুয়ানের প্রধানরা জনগণ থেকে দূরে চলে যায়, তাদের মুখ দেখাতে সাহস করেনা আর সকল স্থানীয় সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষক সমিতির দিকে ঠেলে দেয়। তারা জনগণের কাছে এই কথা বলে সরে যায়, “এটা আমার ব্যাপার না।“

যখনই তু ও তুয়ানের প্রধানদের ব্যাপারে কথা উঠে, কৃষকরা রেগে বলে, “ঐ বদমাসরা!, ওরা শেষ!”

হ্যাঁ, “শেষ” কথাটা সত্যিই বিপ্লবের ঝড়ের কবলে পড়া গ্রাম্য শাসনব্যবস্থার পুরনো যন্ত্রগুলির বর্তমান অবস্থা প্রকাশ করে।

৫। জমিদারদের সশস্ত্র বাহিনীর উচ্ছেদ ও কৃষকদের সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা

হুনান প্রদেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলের চেয়ে মধ্যাঞ্চলে জমিদারশ্রেণীর সশস্ত্র বাহিনী ছোট ছিল। প্রতিটি কাউন্টিতে গড়ে ৬০০ রাইফেল ধরে ৭৫টি কাউন্টিতে ৪৫,০০০ রাইফেল রয়েছে। বাস্তবে এর চেয়ে বেশীও হতে পারে। দক্ষিণ ও মধ্য অঞ্চলে যেখানে কৃষক আন্দোলন বেশী বিকশিত, সেখানে কৃষকদের প্রচণ্ড আন্দোলনের চাপে জমিদাররা টিকে থাকতে পারেনা আর তাদের বাহিনীগুলো ব্যাপকভাবে কৃষক সমিতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, তার পক্ষ নিয়েছে, এর উদাহারণ দেখা যায় নিঙসিয়াঙ, পিঙকিয়াঙ, লিউইয়াং, চাঙশা, লিলিঙ, সিয়াঙতাঙ, সিয়াংসিয়াং, আনহুয়া, হেঙশান ও হেঙইয়াং-এর মত কাউন্টিগুলিতে। পাওচিংয়ের মত কিছু কাউন্টিতে জমিদারদের সশস্ত্র বাহিনীর একটি ছোট অংশ নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে যদিও এদেরও আত্মসমর্পণের প্রবণতা রয়েছে। আরেকটি ছোট অংশ কৃষক সমিতিগুলির বিরোধিতা করছে, কিন্তু কৃষকরা তাদের আক্রমণ করছে, আর তাদের উৎখাত করতে বেশি সময় লাগবেনা, উদাহারণস্বরূপ ইচাং, লিনউ ও চিয়াহোতে। এভাবে জমিদারদের বাহিনীকে দখলে নিয়ে তাদেরকে “নিয়মিত পারিবারিক মিলিশিয়া” (টীকাঃ নিয়মিত পারিবারিক মিলিশিয়া ছিল গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের সশস্ত্র বাহিনীর একটি। পারিবারিক কথাটা ব্যবহৃত হয়েছে কারণ প্রায় প্রতিটি পরিবারের কিছু সদস্যকে এতে যোগ দিতে হত। ১৯২৭ সালে বিপ্লবের পরাজয়ের পর অনেক জায়গায় জমিদাররা মিলিশিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাকে প্রতিবিপ্লবী বাহিনীতে রূপান্তর করেছিল)তে সংগঠিত করা হচ্ছে। আর তাদের গ্রামীণ স্বশাসিত সরকারের নতুন ব্যবস্থার অধীন আনা হচ্ছে, যে সরকার হচ্ছে কৃষকদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অঙ্গ। পুরোনো সশস্ত্র বাহিনীকে জয় করা হচ্ছে একটি উপায় যা দ্বারা কৃষকরা নিজের বাহিনী গড়ে তোলে। আরেকটি নতুন পথ হচ্ছে কৃষক সমিতির অধীন বর্শা বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা। বর্শাগুলো সূচালো, দুধারে ব্লেড লম্বা দন্ডের উপর বসানো, এবং এখন শুধু সিয়াংসিয়াং কাউন্টিতেই ১,০০,০০০টি এই অস্ত্র আছে। সিয়াংতান, হেংসান, লিলিঙ ও চাঙশার মত কাউন্টির প্রতিটিতে ৭০,০০০-৮০,০০০ অথবা ৫০,০০০-৬০,০০০ অথবা ৩০,০০০-৪০,০০০ বর্শা রয়েছে। কৃষক আন্দোলন রয়েছে এমন প্রতিটি কাউন্টিতে দ্রুত বর্ধমান বর্শাবাহিনী রয়েছে। তাই এই কৃষক জনগণ এভাবে “অনিয়মিত পারিবারিক মিলিশিয়া” গঠন করে। উপরে উল্লেখিত পুরোনো বাহিনীর চেয়ে বড় বর্শাসজ্জিত জনগণ হচ্ছে একটি সদ্যোজাত সশস্ত্র শক্তি যার দৃশ্যমাত্র দেখার সাথে স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রোলোকেরা কেঁপে উঠে। হুনানের বিপ্লবী কর্তৃপক্ষকে এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে যে দুই কোটিরও বেশি জনগণ অধ্যুষিত পঁচাত্তুরটি কাউন্টিতে এটা সত্যিই যেন ব্যাপক মাত্রায় গড়ে তোলা হয়। যেন প্রতিটি যুবক অথবা সক্ষম লোকের একটি বর্শা থাকে, বর্শা ভয়ংকর কিছু এমন মনে করে এর উপর বিধিনিষেধ দেয়া যাবেনা। যে বর্শা দেখে যে ভয় পায় সে আসলেই দূর্বল! শুধুমাত্র স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকেরা একে ভয় পায়, কিন্তু কোন বিপ্লবীর একে ভয় পাওয়া উচিত নয়।

৬। কাউন্টি ম্যাজিস্ট্র্যাট ও তার কর্মচারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা উচ্ছেদ করা

কৃষকদের উত্থানের আগে কাউন্টি সরকার যে পরিচ্ছন্ন হতে পারেনা তা প্রমাণিত হয়েছে কিছুদিন আগে কুয়াংতোং প্রদেশের হ্যাইফ্যাংয়ে। এমন আরো প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিশেষ করে হুনানে। যেসব কাউন্টিতে স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট সে যেই হোক, প্রায় সর্বদাই হচ্ছে এক দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তা। যেসব কাউন্টিতে কৃষক উত্থান ঘটেছে, সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট যেই হোক, একটি পরিচ্ছন্ন সরকার রয়েছে। আমি সেসব কাউন্টি ভ্রমণ করেছে সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটকে আগেই কৃষক সমিতির সাথে পরামর্শ করতে হয়। যেসব কাউন্টিতে কৃষকদের ক্ষমতা ছিল খুব শক্তিশালী, কৃষক সমিতির কথা যাদুর মত কাজ করে। সমিতি কোন স্থানীয় অত্যাচারীর গ্রেফতার সকালে দাবি করলে ম্যাজিস্ট্রেট দুপুর পর্যন্ত দেরি করারা সাহস পায়না। যদি গ্রেফতার দুপুর দাবি করা হয়, ম্যাজিস্ট্রেট বিকাল পর্যন্ত দেরি করার সাহস পায়না। যখন কৃষকদের ক্ষমতা গ্রামাঞ্চলে কেবল অনুভুত হতে শুরু করছিল, ম্যাজিস্ট্রেট কৃষকদের বিরুদ্ধে স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে কাজ করছিল। যখন কৃষকদের ক্ষমতা জমিদারদের ক্ষমতার সমান হয়, ম্যাজিস্ট্রেট কৃষক ও জমিদার উভয়ের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, কৃষক সমিতির কিছু পরামর্শ শোনে, কিছু শোনেনা। কৃষক সমিতির কথা “যাদুর মত কাজ করে”, এই কথাটা তখনই খাটে যখন জমিদারদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ পরাভুত করেছে কৃষকরা। বর্তমানে সিয়াংসিয়াং, সিয়াংতান, লিলিঙ ও হেংশান কাউন্টির পরিস্থিতি নিম্নরূপঃ

১। ম্যাজিস্ট্রেট ও বিপ্লবী গণসংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত যুক্ত পরিষদ সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ম্যাজিস্ট্রেট পরিষদ আহবান করে ও তার দপ্তরে বসে। কিছু কাউন্টিতে এর নাম “জনগণের সংস্থা ও স্থানীয় সরকারের যৌথ পরিষদ”, অন্য কাউন্টিগুলিতে “কাউন্টি কার্যাবলীর পরিষদ”। ম্যাজিস্ট্রেট নিজে ছাড়াও যারা  পৃ ৩৫

যোগ দেয় তাদের মধ্যে রয়েছে কাউন্টি কৃষক সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন পরিষদ, বণিক সমিতি, নারী সমিতি, বিদ্যালয় কর্মচারী সমিতি, ছাত্র সমিতি ও গণ জাতীয় পার্টির সদর দপ্তরের প্রতিনিধিগণ (টিকাঃ সেসময় গণ জাতীয় পার্টির অনেক কাউন্টি সদরদপ্তর উহানে উক্ত পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির নেতৃত্বের অধীনে ডঃ সান ইয়াতসেনের তিন মহান গণনীতি অনুসরণ করত যা ছিল রাশিয়ার সাথে মৈত্রী, সাম্যবাদী পার্টির সাথে সহযোগিতা এবং কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতি সহায়তা। তারা সাম্যবাদীদের সাথে, গণ জাতীয় পার্টির বামপন্থীদের সাথে ও অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে জোট বেঁধেছিল)। এ ধরণের পরিষদ সভায় ম্যাজিস্ট্রেট গণসংগঠনগুলোর মত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনিবার্যভাবে তাদের কথায় উঠে বসে। তাই হুনানে বর্তমানে গণতান্ত্রিক কমিটি ব্যবস্থায় কোন সমস্যা হওয়া উচিত নয়। বর্তমান কাউন্টি সরকারগুলো ইতিমধ্যেই রূপ ও সার উভয়তই সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। শুধুমাত্র গত দুই তিন মাসে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যখন থেকে কৃষকরা সমগ্র গ্রামাঞ্চলে উত্থিত হয়েছে আর স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকদের ক্ষমতা উচ্ছেদ করেছে। এখন ম্যাজিস্ট্রেটরা দেখছে যে তাদের পুরোনো আশ্রয় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, নতুন আশ্রয় দ্বারা পদ ধরে রাখতে গণসংগঠনগুলোর সাথে সহযোগিতা করতে শুরু করেছে।

২। বিচারিক সহকারীর হাতে বলতে গেলে তেমন কোন মামলাই নেই পরিচালনার জন্য। হুনানের বিচার ব্যবস্থা এমনই হয়ে গেছে যে কাউন্টি ম্যাজিস্ট্রেট একই সাথে বিচারিক বিষয়ের দায়িত্বে থাকেন। একজন সহকারী তাকে মামলা পরিচালনায় সাহায্য করেন। ধনী হওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট ও তার আজ্ঞাবহরা সম্পূর্ণভাবে কর ও খাজনা আদায়, সশস্ত্র বাহিনীর জন্য লোক ও রসদ সংগ্রহ এবং দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলায় সঠিক ও ভুলকে বিভ্রান্ত করে জবরদস্তি অর্থ আদায়ের উপর নির্ভর করত। সর্বশেষটি ছিল সবচেয়ে নিয়মিত ও নির্ভরযোগ্য উপায়। গত কয়েকমাসে, স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকদের পতনে সকল আইনী বটতলার উকিল অদৃশ্য হয়ে গেছে। তার উপর, কৃষকদের ছোটবড় সকল সমস্যা  কৃষক সমিতির সকল স্তরে সমাধা হচ্ছে। তাই কাউন্টি বিচারিক সহকারীর এখন আর কোন কিছু করার নেই। সিয়াংসিয়াংয়ে একজন লোক আমাকে বলল, “যখন কোন কৃষক সমিতি ছিলনা, প্রতিদিন গড়ে ষাটটি দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা আসত কাউন্টি সরকারের কাছে; এখন তারা দিনে চার পাঁচটি মামলা পায়। তাই, ম্যাজিস্ট্রেট ও তার অধীনস্তদের টাকার থলি এখন খালি থাকে।

৩। সশস্ত্র রক্ষী, পুলিশ ও পাইক পেয়াদারা আশেপাশে ভেড়েনা এবং চাঁদাবাজী অনুশীলন করার জন্য গ্রামের কাছাকাছি যেতে সাহস করেনা। আগে গ্রামবাসীরা শহরবাসীদের ভয় পেত, এখন শহরবাসীরা গ্রামবাসীকে ভয় পায়। বিশেষ করে কাউন্টি সরকার দ্বারা রাখা দুষ্ট অভিশাপ—পুলিশ, সশস্ত্র রক্ষী ও পাইক পেয়াদারা—গ্রামে যেতে ভয় পায়, যদিবা তারা যায়, তাদের চাঁদাবাজি অনুশীলন করার সাহস করেনা। কৃষকদেদের বর্শা দেখে তারা ভয়ে কেঁপে উঠে।

৭। প্রাচীন মন্দির ও গোষ্ঠীপতিদের গোষ্ঠী কর্তৃত্ব, গ্রাম ও শহরের দেবতাদের ধর্মীয় কর্তৃত্ব এবং স্বামীদের পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব উচ্ছেদ করা।

চীনে একজন পুরুষ সাধারণত তিন ধরণের কর্তৃত্বের দ্বারা আধিপত্যের স্বীকারঃ ১। রাষ্ট্রব্যবস্থা (রাজনৈতিক কর্তৃত্ব) যা  জাতীয়, প্রাদেশিক ও কাউন্টি সরকার থেকে থানা শহরগুলির সরকার পর্যন্ত বিস্তৃত। ২। পরিবারতন্ত্র (গোষ্ঠীগত কর্তৃত্ব) যা কেন্দ্রীয় প্রাচীন মন্দির ও তার শাখা মন্দিরগুলো থেকে পরিবারপ্রধান পর্যন্ত ব্যাপ্ত। ৩। অলৌকিক তন্ত্র (ধর্মীয় কর্তৃত্ব) নরকের রাজা থেকে পাতাললোকের সাথে যুক্ত শহর ও গ্রামের দেবদেবী পর্যন্ত ব্যাপ্ত এবং স্বর্গের সম্রাট থেকে স্বর্গলোকের সাথে যুক্ত সকল দেবতা ও আত্মা পর্যন্ত। নারীদের ক্ষেত্রে এই তিনই কর্তৃত্বের ব্যবস্থা ছাড়াও তারা পুরুষদের (স্বামীর কর্তৃত্ব) আধিপত্যের অধীন। রাজনৈতিক, গোষ্ঠী, ধর্মীয় ও পুরুষতান্ত্রিক, এই চার কর্তৃত্ব হচ্ছে সমগ্র সামন্তীয় পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মতাদর্শের মূর্ত নির্দিষ্টতা, আর এ হচ্ছে চার দড়ি যা চীনের জনগণকে বিশেষত কৃষকদের বেঁধে রেখেছে। কীভাবে কৃষকরা গ্রামাঞ্চলে জমিদারদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব উচ্ছেদ করে তা উপরে বর্ণিত হয়েছে। জমিদারদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হচ্ছে অন্য সকল কর্তৃত্বের ব্যবস্থার মেরুদন্ড। সেটা উচ্ছেদ হলে, গোষ্ঠী কর্তৃত্ব, ধর্মীয় কর্তৃত্ব এবসং স্বামীদের কর্তৃত্ব সব টলায়মান হয়ে যেতে শুরু করে। যেখানে কৃষক সমিতি শক্তিশালী, সেখানে পরিবারের প্রবীণরা ও মন্দিরের কোষাগারের দায়িত্বশীলরা গোষ্ঠী প্রথাবদ্ধ নিচের তলার লোকদের নিপীড়ণ করতে বা গোষ্ঠী তহবিল তসরুপ করতে সাহস করেনা। নিকৃষ্টতম গোষ্ঠীপতি ও প্রশাসকরা স্থানীয় নিপীড়ক হওয়ায় তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। চাবুক মারা, ডুবিয়ে মারা ও জীবন্ত কবর দেয়ার মত যে নিষ্ঠুর শারিরীক ও প্রাণঘাতি শাস্তি দেয়া হত প্রাচীন মন্দিরগুলিতে, তা করতে কেউ আর এখন সাহস করেনা। প্রাচীন মন্দিরগুলিতে ভোজসভায় নারী ও দরিদ্রদের অংশ নিতে বাধা দেয়ার পুরোনো প্রথা ভেঙে দেয়া হয়েছে। হেংশান কাউন্টির পাইকনোর নারীরা প্রবলভাবে জড়ো হয়ে প্রাচীন মন্দিরে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করে দৃঢ়ভাবে আসন গ্রহণ করে খানাপিনায় যোগ দেয়। সেখানে গোষ্ঠীপতিরা তাদের যা খুশি করতে দিতে বাধ্য হয়। আরেকটি জায়গায় যেখানে গরীব কৃষকদের ভোজ থেকে বাদ দেয়া হয়, তাদের এক গ্রুপ ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়ে পেট ভরে পানাহার করে, সেখান থেকে স্থানীয় অত্যাচারী, অসৎ ভদ্রলোক ও অন্যান্য দীর্ঘ আলখেল্লাধারী ভদ্রলোকেরা ভয়ে সটকে পড়ে। প্রতিটি স্থানে কৃষক আন্দোলন বিকাশের সাথে ধর্মীয় কর্তৃত্ব টলে উঠে। অনেক জায়গায়, কৃষক সমিতি দেবতার মন্দিরগুলিকে দপ্তর বানিয়েছে। সর্বত্র তারা মন্দিরের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, কৃষক স্কুল ও সমিতির খরচ নির্বাহ করতে চায় একে “কুসংস্কার থেকে খাজনা” নাম দিয়ে। লিলিঙ কাউন্টিতে কুসংস্কার অনুশীলন নিষিদ্ধ করা ও মূর্তি ভাঙা জনপ্রিয় হয়েছে। এর উত্তরের জেলাগুলোতে কৃষকরা মহামারীর দেবতাকে খুশি করতে ধূপ জ্বালানোর মিছিলকে নিষিদ্ধ করেছে। লুকৌয়ের ফুপোলিঙে তাওবাদী মন্দিরে অনেক মূর্তি ছিল, যখন গণ জাতীয় পার্টির সদর দপ্তরের জন্য অতিরিক্ত কক্ষ দরকার পড়ল তখন ছোটবড় মূর্তিগুলিকে স্তূপাকারে এক কোনায় রেখে দেয়া হল, আর এতে কোন কৃষকই আপত্তি করেননি। তারপর থেকে কোন পরিবারে কারো মৃত্যু হলে খুব কম ক্ষেত্রেই দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও পবিত্র আলোক নিবেদন পালিত হয়েছে। এই ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন কৃষক সমিতির সভাপতি সুন শিয়াওসান, তাই স্থানীয় তাওবাদী পুরোহিতরা তাকে ঘৃণা করে। উত্তর তৃতীয় জেলার লুঙফেঙ নারীমঠে কৃষক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকরা কাঠের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলে সেগুলোকে রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার করে। তুঙদু মঠে কৃষক ও ছাত্ররা ত্রিশটিরও বেশি মূর্তি পুড়িয়ে ফেলেছে, কেবল লর্ড পাও (লর্ড পাও অর্থাৎ পাও চ্যাঙ ছিলেন উত্তর সুঙ রাজবংশ (৯৬০-১১২৭ খৃষ্টাব্দ)-এর রাজধানী কাইফ্যাঙের শাসক। লোকশ্রুতিতে তিনি ছিলেন বিখ্যাত এক শাসক ও নির্ভীক ও নিরপেক্ষ বিচারক যে কিনা সকল মামলার সঠিক রায় দিতেন)-এর দুটি মূর্তি এক কৃষক কেড়ে নিয়ে বলে, “পাপ কাজ কোরনা!” যেসব এলাকায় কৃষক সমিতির নির্ধারক ক্ষমতা রয়েছে সেখানে কেবল বয়স্ক কৃষক ও নারীরা এখনো ঈশ্বর বিশ্বাস করেন, নবীন কৃষকরা আর তা করেননা। নবীন কৃষকরা যেহেতু সমিতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও কুসংস্কার অপসারণ সর্বত্রই চলছে। স্বামীদের কর্তৃত্বের কথা বলতে গেলে গরীব কৃষকদের মধ্যে সর্বদাই তা দূর্বলতর ছিল কারণ অর্থনৈতিক কারণেই তাদের নারীরা ধনী শ্রেণীর নারীদের চেয়ে বেশি দৈহিক শ্রম করেন, তাই তাদের বলার ক্ষমতা বেশি ও পারবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অধিকতর ক্ষমতা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে গ্রামীণ অর্থনীতির বাড়ন্ত দেউলাত্বের কারণে নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য ইতিমধ্যেই দূর্বল হয়ে গেছে। কৃষক আন্দোলনের উত্থানের সাথে সাথে অনেক জায়গায় এখন নারীরা গ্রামীণ নারী সমিতি গড়ে তুলতে শুরু করেছেন। তাদের মাথা তোলার সুযোগ এসেছে, আর স্বামীর কর্তৃত্ব দিন দিন নড়বড়ে হচ্ছে এককথায় সমগ্র সামন্তীয় পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মতাদর্শ ভেঙে যাচ্ছে কৃষকদের ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে। তবে বর্তমানে কৃষকরা জমিদারদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ধ্বংসের দিকে মনোনিবেশ করছেন। যেখানেই তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে, তারা অন্য তিনটি ক্ষেত্রে আক্রমণের বর্শাফলক তাক করেছেন যথা গোষ্ঠী, দেবতা ও পুরুষাধিপত্য। কিন্তু এধরণের আক্রমণ সবে শুরু হয়েছে, আর অর্থনৈতিক সংগ্রামে সম্পূর্ণ বিজয়লাভ না করা পর্যন্ত তিনটিকে পুরোপুরি উৎখাত করা যাবেনা। তাই আমাদের বর্তমান কর্তব্য হচ্ছে কৃষকদের সম্পূর্ণ সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা রাজনৈতিক সংগ্রামে নিবদ্ধ করায় চালিত করা যতে জমিদারদের কর্তৃত্ব সমগ্রভাবে উচ্ছেদ করা যায়। এর পরপরই অর্থনৈতিক সংগ্রাম শুরু করতে হবে যাতে গরীব কৃষকদের ভূমি সমস্যা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সমস্যা মৌলিকভাবে সমাধা করা যায়। পরিবার প্রথার কথা বলতে গেলে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামে বিজয়ের পর তার স্বাভাবিক ফল হিসেবে কুসংস্কার ও নারীপুরুষের মধ্যে থাকা অসাম্য দূর হবে। এসব বিলোপ করতে যদি আরোপিতভাবে ও অপরিপক্কভাবে অতিপ্রচেষ্টা চালানো হয়, স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটরা এই সুযোগে “কৃষক সমিতির পূর্বপুরুষদের প্রতি কোন ধার্মিকতা নেই”, “কৃষক সমিতি ধর্মবিদ্বেষী আর ধর্মকে ধ্বংস করছে” এবং “কৃষক সমিতি স্ত্রীদের সাধারণ সম্পত্তি বানিয়ে ফেলতে চাইছে” এসব প্রতিবিপ্লবী প্রচারণা চালাবে। এসব কিছুরই উদ্দেশ্য ছিল কৃষক সমিতির মান মর্যাদা নষ্ট করা। এরকম একটি ঘটনা ছিল হুনানের সিয়াংসিয়াং এবং হুপেইর ইয়াংসিতে যেখানে মূর্তি ভাঙার প্রতি কিছু কৃষকের বিরোধিতাকে জমিদাররা ব্যবহার করে। কৃষকেরাই মূর্তি বানিয়েছে, সময় এলে তারাই নিজ হাতে মূর্তিগুলি সরিয়ে দেবে, অসময়োচিতভাবে অন্য কারোর এটা করার প্রয়োজন নেই। এসংক্রান্ত প্রশ্নে সাম্যবাদী পার্টির প্রচার কর্মনীতি হতে হবেঃ “ধনুক হাতে নাও, তীর ছোড়না, শধু নিশানা কর”(টীকাঃ ধনুর্বিদ্যার এই উদ্ধৃতিটি মেনশিয়াস শীর্ষক বই থেকে নেয়া। এখানে বলা হয়েছে যে ধনুর্বিদ্যার একজন দক্ষ শিক্ষক শিক্ষা দেয়ার সময় শুধু নাটকীয় ভঙ্গীতে ধনুক টেনে ধরেন কিন্তু তীর ছোড়েননা। অর্থাৎ সাম্যবাদীদের উচিত কৃষকদের পরিচালনা করা কৃষকরা যাতে পূর্ণ রাজনৈতিক চেতনা লাভ করে, নিজেদের উদ্যোগে, সচেতনভাবে কুসংস্কার ও অন্যান্য খারাপ অভ্যাস পরিত্যাগ করার জন্য অগ্রণী হয় তার জন্য। সাম্যবাদীরা এ ব্যাপারে তাদের হুকুম করবেনা বা তাদের হয়ে নিজেরাই করবেনা)। মূর্তিগুলি সরিয়ে দেয়া, শহীদ কুমারিদের মন্দির নামিয়ে আনা আর সতি বিশ্বস্ত বিধবাদের  খিলানগুলো নামিয়ে আনার কাজ কৃষকরাই করবে। অন্য কারোর তাদের হয়ে এটা করা ভুল।

আমি যখন গ্রামে ছিলাম, আমি কৃষকদের মধ্যে কুসংস্কারবিরোধী কিছু প্রচার চালাই। আমি বলেছিলামঃ

“আপনারা যদি আট চিত্রাক্ষরে (টীকাঃ আট চিত্রাক্ষর হল পুরোনো চীনদেশের ভাগ্যগণনার একটি পদ্ধতি। এর ভিত্তি ছিল যথাক্রমে কোন ব্যক্তির জন্মের বছর, মাস, দিন ও ঘন্টার প্রত্যেকটির জন্য দুটি করে বৃত্তাকার চিত্রাক্ষর পরীক্ষা )-এ বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনারা সৌভাগ্যের আশা করেন, আপনারা যদি মাটির স্থান গুণের শুভাশুভে বিশ্বাস করেন (টীকাঃ মাটির স্থান গুণ হল পুরোনো চীনের এক কুসংস্কার। এই কুসংস্কার অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয় যে, কারো পূর্বপুরুষের কবরের অবস্থান সেই ব্যক্তির ভাগ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে। মাটির স্থানগুণ বিশেষজ্ঞরা দাবি করে যে তারা কোন নির্দিষ্ট স্থান ও তার চারপাশ শুভ কিনা তা বলে দিতে পারে), আপনি আপনাদের পূর্বপুরুষদের সমাধি এলাকা থেকে লাভবান হতে আশা করেন। এবছর কয়েক মাসের মধ্যেই ভদ্রবেশী টাউট ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তাদের গর্ত থেকে অপসারিত হয়েছে। কয়েক মাস আগে যখন তাদের সৌভাগ্য ছিল, পূর্বপুরুষদের সুস্থিত সমাধি থেকে লাভ নিয়েছে, হঠাৎ দুয়েক মাসের মধ্যে তাদের ভাগ্য বদলে গেল আর আর তাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা উপকারী প্রভাব বন্ধ করে দিল, তাকি সম্ভব? স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকেরা আপনাদের কৃষক সমিতিকে ঠাট্রা করে বলে, ‘কী অদ্ভূত! আজ পৃথিবীটা কমিটির লোকদের পৃথিবী। দেখ, কমিটির লোকদের মুখোমুখি না হয়ে প্রস্রাব করতেও যেতে পারনা!’ একেবারে সত্য, শহর ও গ্রাম, ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতি, গণজাতীয় পার্টি ও সাম্যবাদী পার্টি, ব্যতিক্রমহীনভাবে সকলেরই কার্যনির্বাহী সদস্য রয়েছে—এটি আসলেই কমিটি মানুষদের একটি জগত। কিন্তু এটা কি আট চিত্রাক্ষর আর পূর্বপুরুষদের সমাধি অবস্থানের কারণে? কী আশ্চর্য! গ্রামাঞ্চলের সব দরিদ্র হতভাগ্যদের আটটি সংকেত হঠাত শুভ হয়ে উঠেছে। আর তাদের পূর্বপুরুষদের কবরগুলো হঠাৎ করেই উপকারী প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে! দেবতাদের সর্বপ্রকারে পূজা করেও আপনাদের যদি শুধু লর্ড কুয়ান [টীকাঃ (কুয়ান ইয়ু, ১৬০-২১৯ খৃষ্টাব্দ)], ছিলেন তিন রাজ্যের যুগের এক যোদ্ধা যাকে চীনারা আনুগত্য ও যুদ্ধের দেবতা হিসেবে ব্যাপকভাবে পূজা করত] আর করুনার দেবী থাকত, আপনারা কি স্থানীয় অত্যাচারী ও অসৎ ভদ্রলোকদের উচ্ছেদ করে পারতেন? দেবদেবীরা সত্যিই শোচনীয় জিনিস। আপনারা শতশত বছর যাবত তাদের উপাসনা করছেন, কিন্তু তারা একটি স্থানীয় অত্যাচারী অথবা অসৎ ভদ্রলোককেও আপনাদের জন্য উচ্ছেদ করেনি। আজ আপনারা আপনাদের খাজনা কমাতে চান। কীভাবে আপনারা সেটা করবেন? আপনারা কি দেবতাদের উপর না কৃষক সমিতির উপর বিশ্বাস রাখবেন?” আমার কথাওগুলো শুনে কৃষকরা হাসিতে ফেঁটে পড়ল।

৮। রাজনৈতিক প্রচার ছড়ানো

দশ হাজার আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠশালা যদি প্রতিষ্ঠা করা হত, তারা কি এতটা রাজনৈতিক শিক্ষা দিতে পারত যা কৃষক সমিতি অতি অল্প সময়ের মধ্যে দিয়েছে নারীপুরুষ, নবীনপ্রবীণ জনগণের মধ্যে গ্রামাঞ্চলের দূরবর্তী অঞ্চলে? না পারতনা। সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক!, যুদ্ধবাজেরা নিপাত যাক, স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটরা নিপাত যাক!—এই রাজনৈতিক শ্লোগানগুলি জনপ্রিয় হয়েছে, তারা নবীন, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ এবং নারী ও শিশুদের মাঝে স্থান করে নিয়েছে অগণিত গ্রামে, সেগুলো তাদের মনে গেঁথে গেছে আর ঠোঁটে প্রকাশিত হয়েছে। উদাহারণস্বরূপ, শিশুদের একটি গ্রুপকে খেলারত অবস্থায় দেখুন। একজন ক্রুদ্ধ হয়ে  মাটিতে পদাঘাত করলে ও মুষ্টি নাড়ালে, অপরজনকে সাথে সাথেই বলতে শুনবেন, “সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক! নিপাত যাক!”

সিয়াংতান এলাকায়, রাখাল শিশুরা যখন মারামারি লাগে একজন তাঙ শেঙচি আর অন্যজন ইয়েহ কাইসিন (টীকাঃ তাঙ শেঙচি ছিলেন একজন জেনারেল যিনি সে সময়ে ইনি বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন এবং উত্তরাভিযানে যোগ দিয়েছিলেন। ইয়েহ কাইসিন ছিলেন একজন জেনারেল যিনি উত্তরের যদ্ধবাজদের পক্ষে ছিলেন এবং বিপ্লবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন)-এর ভূমিকা নেবে; একজন পরাজিত হয়ে যখন পালায় আর অন্যজন তাকে ধাওয়া করে, ধাওয়াকারী হচ্ছে তাঙ শেঙচি আর পলায়নকারী হচ্ছে ইয়েহ কাইশিন। “সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ধ্বংস হোক! নিপাত যাক!” গানটি শহরের অধিকাংশ শিশুই গাইতে পারে, আর এখন অনেক গ্রাম্য শিশুও এটা গাইতে পারে।

কিছু কৃষক ডঃ সান ইচ্ছাপত্র থেকেও আবৃত্তি করতে পারেন। তারা “স্বাধীনতা”, “সমতা”, “তিন গণনীতি” এবং “অসম চুক্তি” শব্দগুলি সেখান থেকে নিয়ে প্রয়োগ করেন কাঁচাভাবে হলেও। কোন কৃষকের পথ কোন ভদ্রলোক আগলে ধরলে কৃষক ক্রুদ্ধভাবে বলে, “এই ব্যাটা জুলুমবাজ, তুমি কি তিন গণনীতির কথা শোননি?” আগে চাঙশার শহরতলীতে সবজি বাগান থেকে কৃষকরা তাদের সামগ্রী বেঁচতে শহরে ঢুকলে পুলিশ তাদের হয়রানি করত। এখন তাদের একটা অস্ত্র আছে, তা তিন গণনীতি ছাড়া আর কিছু নয়, আর যখন কোন পুলিশ মারে বা গালিগালাজ করে, কৃষকরা তৎক্ষণাৎ তিন গণনীতি বিবৃত করে জবাব দেয়, আর পুলিশদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। একবার সিয়াঙতানে এক জেলা কৃষক সমিতি ও থানা কৃষক সমিতির মধ্যে ঝগড়া বাঁধল, থানা সমিতির সভাপতি ঘোষণা করল, “জেলা কৃষক সমিতির অসম চুক্তি নিপাত যাক!”

 সমগ্র গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক প্রচারের প্রসার হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে সাম্যবাদী পার্টি ও কৃষক সমিতির এক কীর্তি। সহজ সরল শ্লোগান, কার্টুন ও বক্তব্যসমূহ কৃষকদের মধ্যে এমন ব্যাপক বিস্তৃত ও দ্রুত প্রভাব ফেলে যে মনে হয় তাদের সবাই যেন এক রাজনৈতিক পাঠশালায় পড়ে এসেছে। গ্রামীন রাজনৈতিক প্রচারে নিয়োযিত কমরেডদের রিপোর্ট থকে জানা যায় প্রচুর রাজনৈতিক প্রচার চলানো হয়েছিল তিন বিরাট শোভাযাত্রা, বৃটিশবিরোধী মিছিল, অক্টোবর বিপ্লব আর উত্তর অভিযানের বিজয় উদযাপনের সময়। এই দিবসগুলিতে যেখানেই কৃষক সমিতি ছিল সেখানেই বিপুল রাজনৈতিক প্রচার চালানো হয়, যা সমগ্র গ্রামাঞ্চলকে জাগিয়ে তোলে প্রচণ্ড প্রভাবসমেত। এখন থেকে প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগাতে হবে যাতে শ্লোগানগুলির বিষয়বস্তুকে সমৃদ্ধ করা যায় এবং ঐসব সাধারণ শ্লোগানের অর্থকে পরিষ্কারভাবে বোঝানো যায়।

৯। কৃষকরা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে

যখন কৃষক সমিতি সাম্যবাদী পার্টির নেতৃত্বাধীনে গ্রামাঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে, কৃষকরা যা অপছন্দ করে তা নিষিদ্ধ করে অথবা বিধিনিষেধে আবদ্ধ করার চেষ্টা করে। বাজি ধরে খেলা, জুয়া ও আফিম গ্রহণ হচ্ছে তিনটি জিনিস যা তারা সবচেয়ে কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করে।

বাজি ধরে খেলা। যেখানে কৃষক সমিতি শক্তিশালী, মাহজঙ, ডমিনো ও তাসখেলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সিয়াংসিয়াংয়ের ১৪তম জেলায় কৃষক সমিতি দুই ঝুড়ি ভর্তি মাজং সেট পুরিয়েছে। আপনি যদি গ্রামাঞ্চলে যান, এসব কোন খেলাই আর খেলতে দেখবেননা। যেই এই নিষেধ ভঙ্গ করে সেই তড়িৎ কঠিন শাস্তি প্রাপ্ত হয়।

জুয়া। সাবেক পাঁড় জুয়াড়ুরা এখন নিজেরাই জুয়া প্রতিরোধ করছে। যেসব অঞ্চলে কৃষক সমিতি শক্তিশালী সেখানে এই আবর্জনাটাকেও ঝেটিয়ে বিদেয় করা হয়েছে।

আফিম গ্রহণ। এই নিষিদ্ধকরণ অত্যন্ত কঠোর। যখন কৃষক সমিতি আফিম হুকা সমর্পণের আদেশ দেয় তখন কেউ ন্যূনতম আপত্তি তোলার সাহস করেননি। লিলিঙ কাউন্টিতে একজন অসৎ ভদ্রলোক হুকা সমর্পণ না করায় তাকে গ্রেফতার করে গ্রামে ঘোড়ানো হয়।

““আফিম গ্রহণকারীদের নিরস্ত্রীকরণ” করার কৃষকদের অভিযান উত্তরাভিযানকারী বাহিনী কর্তৃক উ পেইফু এবং সুন চুয়ান ফ্যাংয়ের বাহিনীকে নিরস্ত্রীকরণের চেয়ে কম চিত্তাকর্ষক নয়। অফিসারদের বেশ কিছু শ্রদ্ধেয় বাবা বৃদ্ধ লোকেরা ছিল আফিমাসক্ত ও তাদের হুকার থেকে অবিচ্ছিন্ন, তারাও “সম্রাট”দের কর্তৃক (টীকাঃ ভদ্রবেশী বদমাসরা কৃষকদের সম্রাট বলে উপহাস করত) নিরস্ত্র হয়েছে। “সম্রাটরা” শুধু আফিমের উৎপাদন ও ব্যবহারই নিষিদ্ধ করেনি, এর পাচারও বন্ধ করেছে। কোয়েইচৌ থেকে পাওচিং, সিয়াংসিয়াং, ইউশিয়ে ও লিলিংয়ের মধ্য দিয়ে কিয়াংসিতে পরিবহনের পথে বিপুল পরিমাণ আফিম বাজেয়াপ্ত ও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এটা সরকারি রাজস্বের উপরে প্রভাব ফেলেছে। ফলে, উত্তরাভিযানে বাহিনীর তহবিলে সংগ্রহের বিবেচনায় প্রাদেশিক কৃষক সমিতি নিচের স্তরের সমিতিকে আদেশ দেয় “আফিম পাচারের উপর সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করতে”। এটা অবশ্য কৃষকদের দুঃখিত ও অখুশি করেছে।

এই তিন ছাড়াও অনেক কিছু কৃষকরা নিষিদ্ধ অথবা বিধিনিষেধে আবদ্ধ করেছে। নিচে তার কিছু উদাহারণ দেয়া হল।

পুষ্পঢাক। অনেক এলাকাতেই এই অশ্লীল অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

পালকি। অনেক কাউন্টিতে বিশেষত সিয়াঙসিয়াঙে পালকি ধ্বংস করার মত ঘটনা ঘটেছে। যারা এটা ব্যবহার করে কৃষকরা তাদের ঘৃণা করে, তাই এটা ভাঙতে তারা সদা প্রস্তুত। কিন্তু কৃষক সমিতি তাদের তা করতে নিষেধ করে। সমিতির কর্তারা কৃষকদের বলে “তোমরা যদি পালকি ভাঙ, ধনীদের টাকাই কেবল রক্ষা পাবে,বাহকরা তাদের কাজ হারাবে। তাকি আমাদের নিজেদের লোককে আঘাত করেনা?” এটা দেখে কৃষকরা নতুন কৌশল নিল, পালকি বাহকদের পারিশ্রমিক যথেষ্ট বাড়িয়ে দিল যাতে ধনীদের শাস্তি দেয়া যায়।

মদ পাতন ও চিনি তৈরি। শস্য থেকে মদ পাতন ও চিনি উৎপাদন সর্বত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আর মদ ও চিনি উৎপাদকরা অব্যাহতভাবে আপত্তি জানাচ্ছে। হেংশান কাউন্টির ফুতিয়েনপুতে মদ তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়নি, কিন্তু দাম খুব কম স্থির করা হয়েছে, আর মদ ব্যবসায়ীরা লাভের আশা না দেখে এটা বন্ধ করেছে।

শূকর। শুকর শস্য খেয়ে ফেলে, তাই একটি পরিবার কতগুলি শুকর পালতে পারবে তা সীমাবদ্ধ করা থাকে।

হাঁস-মুরগী। সিয়াংসিয়াং কাউন্টিতে হাঁস-মুরগী পালন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্ত নারীরা এতে আপত্তি জানায়। হেংশান কাউন্টিতে ইয়াংতাং এর প্রতিটি পরিবার ৩টি পালার অনুমতিপ্রাপ্ত। ফুতিয়েনপুতে পাঁচটি। অনেক স্থানে হাঁস পালন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কারণ হাঁসেরা শুধু শস্যই খায়না ধানের চারাগাছও নষ্ট করে। তাই তারা মুরগির চেয়েও খারাপ।

ভোজ। জমকালো ভোজন সাধারণত নিষিদ্ধ। হেংশান কাউন্টির শাওসানে সিদ্ধান্ত হয়েছে অতিথিদের কেবল তিন ধরণের প্রাণীখাদ্য দেয়া হবে, যথা মুরগি, মাছ ও শুকর। বাঁশের অংকুর, শ্যাওলা ও মসুর ডালের নুডলস পরিবেশন করাও নিষিদ্ধ। হেংশান কাউন্টিতে ঠিক করা হয়েছে আটটি খাবারের বেশি কোন ভোজনশালায় পরিবেশন করা যাবেনা(টীকাঃ চীনে টেবিলে একজনের জন্য আলাদাভাবে নয়, একটি গামলায় বা বড় থালে সকলের জন্য খাবার সরবরাহ করা হয়)। লিলিঙ কাউন্টির পূর্ব তৃতীয় জেলায় শুধু পাঁচটি খাবার অনুমোদিত, উত্তর দ্বিতীয় জেলায় তিন মাংস ও তিন শাকসবজি খাবার অনুমোদিত, আর পশ্চিম তৃতীয় জেলায় নববর্ষের ভোজন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সিয়াংসিয়াং কাউন্টিতে সকল প্রকার  “ডিমপিঠা ভোজন” নিষিদ্ধ যদি এটা কোনভাবেই জমকালো নয়। যখন সিয়াংসিয়াংয়ের দ্বিতীয় জেলায় কোন পরিবার ছেলের বিয়েতে “ডিমপিঠা ভোজন” আয়োজন করল, কৃষকরা নিষেধ লংঘন হচ্ছে দেখে বাড়িতে ঢুকে পড়ে আয়োজন ভেঙে দিল। সিয়াংসিয়াং কাউন্টির চিয়ামো শহরে পূর্বপুরুষদের নিবেদন করার সময় দামি খাবার খাওয়া থেকে বিরত হয়ে জনসাধারণ কেবল ফলই পরিবেশন করে।

গরু। গরু হচ্ছে কৃষকদের দামি সম্পদ। “এ জীবনে কখনো গরু হত্যা করলে পরের জীবনে তুমি গরু হয়ে জন্ম নেবে”—কথাটি প্রায় একটি ধর্মীয় নীতিবাক্যে পরিণত হয়েছিল। কখনো গরু হত্যা করা যাবেনা। যখন কৃষকদের হাতে ক্ষমতা ছিলনা, তারা শুধু ধর্মীয় বিধিনিষেধের কাছে আবেদন জানাতে পারত, আর এর নিষিদ্ধকরণের কোন উপায় তাদের ছিলনা। কৃষক সমিতির উত্থানের সময় থেকে, তাদের আইন গবাদি পশু পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে, আর তারা শহরে গবাদিপশু জবাই নিষিদ্ধ করেছে। সিয়াঙতাং কাউন্টি শহরের ছয়টি কসাইখানার মধ্যে পাঁচটি বন্ধ হয়েছে আর অবশিষ্ট একটিতে কেবল জীর্ন ও অক্ষম প্রাণীদের জবাই করা হয়। হেংশান কাউন্টির সর্বত্র গরু জবাই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একজন কৃষক তার ষাড়ের এক পা ভেঙে গেলে কৃষক সমিতির সাথে পরামর্শ করে, তারপর সে একে মারার সাহস করে। চুচৌয়ে ব্যবসায়ীদের সমিতি বেপরোয়াভাবে একটি গরু জবাই করলে কৃষকরা শহরে চলে এসে এর ব্যাখ্যা দাবি করে, তারপর ব্যবসায়ীদের সমিতি জরিমানা প্রদান করে ক্ষমা চেয়ে আতশবাজি ছোড়ে।

ভবঘুরে ও ভাগ্যান্বেষীরা। লিলিঙ কাউন্টিতে একটি সিদ্ধান্ত পাস হয় যে নববর্ষ উদযাপনে ঢাকঢোল বাজানো, স্থানীয় দেবদেবীদের প্রশংসা গীত গাওয়া বা পদ্মকাব্য গাওয়া নিষিদ্ধ করা। অন্য অনেক কাউন্টিতেও একইরকম নিষিদ্ধকরণ পাশ হয়, অথবা এই অনুষ্ঠানগুলো নিজে থেকে বিলুপ্ত হয় কারণ কেউ এটা পালন করছিলনা। ভবঘুরে বা ভাগ্যান্বেষীরা যারা অতীতে খুবই আগ্রাসী ছিল তাদের তখন কৃষক সমিতির কাছে নত হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। সিয়াঙতান কাউন্টির শাওশানে ভাগ্যান্বেষীরা মেঘের দেবতার মন্দিরকে তাদের নিয়মিত আস্তানা বানাত, আর তারা কাউকে ভয় করতনা, কিন্তু সমিতির উত্থানে তারা চুপিসারে সরে গেছে। একই কাউন্টির হুতি শহরের কৃষক সমিতি এরকম তিন ভাগ্যান্বেষীকে ধরে ইটের ভাটায় কাঁদামাটি বহন করায়। নববর্ষের আমন্ত্রণ ও উপহারজনিত অপচয়মূলক রীতিনীতিকে নিষিদ্ধ করে প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে।

এগুলি ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে আরো অনেক ছোটখাট নিষেধাজ্ঞা বলবত করা হয়েছে। যেমন, লিলিঙে মহামারীর দেবতাকে শান্ত করার জন্য আলোক শোভাযাত্রা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে নৈবেদ্যের জন্য দামি জিনিস ও ফলমূল কেনা, প্রেতাত্মার উৎসবে কাগজের পোশাক পোড়ানোর শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান এবং নববর্ষ উতসবে সৌভাগ্য কামনা করে পোষ্টার লাগানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সিয়াংসিয়াং কাউন্টির কুসুইয়ে হুকায় করে ধূমপানও নিষিদ্ধ। এই কাউন্টির দ্বিতীয় জেলায় আতশবাজি ও অনুষ্ঠানমূলক তোপধ্বনি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রথমটির জরিমানা ১.২০ ইউয়ান, আর দ্বিতীয়টির জরিমানা ২.৪০ ইউয়ান। সপ্তম ও বিশতম জেলায় মৃত ব্যক্তির জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আঠারোতম জেলায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় টাকা উপহার দেয়া নিষিদ্ধ। এই ধরণের অসংখ্য নিষেধাজ্ঞাকে সাধারণভাবে কৃষকদের নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধ আরোপ বলে অভিহিত করা হয়।

এগুলো দুইদিক থেকে বিরাট গুরুত্বের। প্রথম, তারা সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ, যথা বাজি খেলা, জুয়া ও আফিম নেশার বিরুদ্ধে। এসব প্রথা জমিদারশ্রেণীর পঁচা রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে জন্ম নিয়েছে আর তার কর্তৃত্ব উৎখাত হওয়ার সাথে সেগুলোকেও ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। দ্বিতীয়, শহরের বণিকদের শোষণের বিরুদ্ধে এই নিষিদ্ধকরণ এক ধরণের আত্মরক্ষা। যেমন ভোজন এবং আচার অনুষ্ঠানের জন্য দামি জিনিস ও ফলমূল ক্রয়। শিল্পোৎপাদিত দ্রব্য খুবই প্রিয় আর কৃষি উৎপন্ন খুবই সস্তা বলে কৃষকরা গরীব হয়ে যায় আর বণিকদের দ্বারা নির্মমভাবে শোষিত হয়, তাই নিজেদের রক্ষায় তাদের মিতব্যয়িতা উৎসাহিত করতে হবে।

শস্য বাইরে বিক্রি নিষিদ্ধকরণের কারণ হচ্ছে শস্যের দাম যাতে না বাড়ে কারণ গরীব কৃষকদের পর্যাপ্ত নেই, আর বাজার থেকে তাদের কিনতে হয়। এসবকিছুর কারণ হচ্ছে কৃষকদের দারিদ্র্য, আর শহর ও গ্রামের দ্বন্দ্ব। তথাকথিত প্রাচ্য সংস্কৃতিকে (টীকাঃ “প্রাচ্য সংস্কৃতির মতবাদ” ছিল এক প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদ যা আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতা বর্জন করে পশ্চাদপদ কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি ও প্রাচ্যের সামন্ত সংস্কৃতিকে সমর্থন করত) ঊর্ধ্বে তুলে ধরে শিলজাত দ্রব্য বর্জন বা শহর ও গ্রামের মধ্যে উৎপাদিত দ্রব্যের বিনিময় প্রত্যাখ্যান করা হয়নি। অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের রক্ষা করতে কৃষকদের ভোক্তা সমবায় গঠন করতে হবে যৌথভাবে দ্রব্য কেনার জন্য। ঋণদান সমবায় গঠণে কৃষক সমিতিকে সরকারের সহযোগিতা করতে হবে। এই জিনিসগুলো করা হলে দাম কম রাখার উপায় হিসেবে শস্যের বহিপ্রবাহ নিষিদ্ধে করতে হবেনা, আর অর্থনৈতিকভাবে আত্মরক্ষা করতে কিছু শিল্পোৎপাদিত দ্রব্যের অন্তপ্রবাহকেও আর বাঁধা দিতে হবেনা।

১০। দস্যুতা নির্মূল

আমার মতে, ইউ, তাঙ, ওয়েন ও উ থেকে চিং সম্রাট ও প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত কোন শাসনকর্তাই দস্যুতা উচ্ছেদে এতখানি ক্ষমতা দেখায়নি যতটা কৃষক সমিতি আজকে দেখিয়েছে। যেখানেই কৃষক সমিতি শক্তিশালী সেখানেই দস্যুতার কোন চিহ্নমাত্র নেই। আশ্চর্যজনকভাবে কোন কোন এলাকায় সবজি চুরির মত ছিঁচকে চুরি উধাও হয়ে গেছে। কিছু কিছু এলাকায় এখনো ছিঁচকে চুরি রয়ে গেছে। কিন্তু যে বিভাগগুলিতে আমি পরিদর্শন করেছি তার মধ্যে এমনকি সাবেক ডাকাত অধ্যুষিত এলাকাগুলিতেও দস্যুতার কোন চিহ্ন ছিলনা। প্রথম কারণ হচ্ছে কৃষক সমিতির সদস্যরা পাহাড় উপত্যকার সর্বত্র পাহাড়া দিচ্ছে হাতে বর্ষা ও লাঠি হাতে, শতসহস্র সংখ্যায় তারা এক ডাকে জড়ো হয়, তাই দস্যুরা কোথাও পালিয়ে যেতে পারেনা। দ্বিতীয়, কৃষক আন্দোলনের উত্থানের সময় থেকে শস্যের দাম পড়ে গেছে—গত বসন্তে এক পিকুল (= প্রায় ৬০ কেজি)  শস্যের দাম ছিল ৬ ইউয়ান, কিন্তু গত শীতে হয়েছে ২ ইউয়ান, আর খাদ্যশস্যের সমস্যা জনগণের জন্য কম সমস্যা হয়েছে। গোপন সমিতির সদস্যরা কৃষক সমিতিতে যোগ দিয়েছে যেখানে তারা প্রকাশ্যে নিজেদের বীরত্ব জাহির করতে পারে ও অভাব অভিযোগের কথা বলতে পারে, যাতে গোপন ‘পাহাড়’, ‘কুটির’, ‘মন্দির’ আর ‘নদী’ ভিত্তিক গোপন সংগঠনের প্রয়োজন হয়না। স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটদের শূকর ও ভেড়া জবাই করার আর তাদের উপর ভারি শুল্ক ও জরিমানার মাধ্যমে এদের নিপীড়ণের বিরুদ্ধে কৃষকদের নিজ অনুভূতি প্রকাশ করার পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চতুর্থ, সৈন্যবাহিনী বিপুল সৈন্য নিয়োগ করছে যাতে বহু ‘অবাধ্য’ যোগ দিয়েছে। এভাবে কৃষক আন্দোলনের উত্থানের মধ্য দিয়ে দস্যুতার কুফলের অবসান হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বচ্ছলরাও কৃষক সমিতিকে অনুমোদন করে। তাদের মন্তব্য হচ্ছে “কৃষক সমিতি? সত্যি বলতে, তাদের সপক্ষেও কিছু বলার আছে”।

বাজি খেলা, জুয়া ও আফিম নেশা বন্ধ করতে আর ডাকাতি উচ্ছেদে কৃষক সমিতি সাধারণ অনুমোদন অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

১১। অত্যধিক করের অবসান

যেহেতু আমাদের দেশ এখনো ঐক্যবদ্ধ হয়নি এবং সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাজদের কর্তৃত্ব উচ্ছেদ হয়নি, কৃষকদের উপর সরকারী কর ও শুল্কের প্রচণ্ড বোঝা এখনো অপসারণ করার কোন উপায় নেই, অথবা আরো নির্দিষ্টভাবে বিপ্লবী বাহিনীর খরচের বোঝাও দূর করার উপায় এখনো কোন উপায় নেই। যাহোক, কৃষক আন্দোলনের উত্থান আর স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী বদমাসদের পতনের সাথে কৃষকদের উপর স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটদের অধীন প্রশাসনের দ্বারা চাপানো অত্যধিক শুল্ক অর্থাৎ প্রতি মৌ (১ মৌ=১০ কাঠা প্রায়) জমির জন্য সারচার্য বিলুপ্ত হয়েছে অথবা অন্তত কমে এসেছে। একেও কৃষক সমিতির একটি কীর্তি বলে গন্য করতে হবে।

 ১২। শিক্ষা আন্দোলন

চীনে শিক্ষা সর্বদাই ছিল জমিদারদের জন্য একান্ত সংরক্ষিত। কৃষকদের এতে কোন প্রবেশাধিকার ছিলনা। কিন্ত জমিদারদের সংস্কৃতি কৃষকদের দ্বারাই সৃষ্ট, কৃষকদের শ্রমঘামেই তা তৈরি হয়েছে। চীনে শতকরা ৯০ ভাগ জনগণের কোন শিক্ষা নেই যার মধ্যে নিরংকুশ সংখ্যাগুরু হচ্ছে কৃষক। যে মুহুর্তে জমিদারের ক্ষমতা উচ্ছেদ হল সে মুহুর্তে কৃষকদের শিক্ষা আন্দোলন শুরু হল। দেখুন আগে যে কৃষকরা শিক্ষাকে অপছন্দ করত তারা উদ্যমের সাথে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে। তারা সর্বদাই ‘বিদেশী ধরণের বিদ্যালয়’ অপছন্দ করত। আমাদের ছাত্র জীবনে আমি যখন গ্রামে ফিরে গিয়ে দেখলাম কৃষকরা “বিদেশী ধরণের পাঠশালা’র বিরুদ্ধে, আমি নিজেও ‘বিদেশী ধরণের ছাত্র ও শিক্ষকদের’ সাধারণ পরিচালনার সাথে ছিলাম আর তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম এটা মনে করে যে কৃষকরা কোন না কোন ভাবে ভুল করছে। ১৯২৫ সালের পর আমি গ্রামে যখন ছয় মাস ছিলাম, ইতিমধ্যেই একজন সাম্যবাদীতে পরিণত হয়েছি, মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ অর্জন করেছি, আমি বুঝতে পারলাম যে আমি ভুল ছিলাম, কৃষকরা সঠিক ছিল। গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয় যে পাঠদান করত তা ছিল শহরের জীবন সম্পর্কিত, তা গ্রামের উপযোগী ছিলনা। তাছাড়া কৃষকদের প্রতি শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল খুব খারাপ, কৃষকদের সহযোগিতা করা দূরের কথা, তারা ছিল তাদের অপছন্দের বস্তু। তাই কৃষকরা পুরোনো ধরণের বিদ্যালয় পছন্দ করে (তারা একে বলে চীনা ধরণের) আধুনিক বিদ্যালয় (যাকে তারা বলে বিদেশী ধরণের)-এর চেয়ে, আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে পুরনো ধরণের পাঠশালার পণ্ডিতমশাইয়দের বেশি পছন্দ করত। বর্তমানে কৃষকরা উৎসাহের সাথে নৈশ বিদ্যালয়সমূহ প্রতিষ্ঠা করেছেন যাকে তারা বলেন কৃষক বিদ্যালয়। কিছু ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে, অন্যগুলো সংগঠিত হচ্ছে, গড়ে প্রতিটি থানায় একটি করে বিদ্যালয়। কৃষকরা তাদের বিদ্যালয় সম্পর্কে খুবই উৎসাহী, কেবল তাকেই তারা শ্রদ্ধা করে ও নিজের বলে মনে করে। নৈশ বিদ্যালয়ের তহবিল আসে “কুসংস্কারের উপর কর” থেকে, প্রাচীন মন্দির তহবিল এবং অন্যান্য অলস গণতহবিল অথবা সম্পত্তি থেকে। দেশের শিক্ষাবোর্ড শুধু এই টাকা দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় অর্থাৎ “বিদেশী ধরণের বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল যা কৃষকদের প্রয়োজনের উপযোগী ছিলনা, আর কৃষকরা চেয়েছে সেই টাকা দিয়ে কৃষক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে। এই বিতর্কের ফল হল যে উভয় পক্ষই কিছু টাকা পেল, যদিও কিছু এলাকায় কৃষকরাই সব পেল। কৃষক আন্দোলনের বিকাশের ফলে সাংস্কৃতিক স্তরের দ্রুত উত্থান ঘটেছে। শীঘ্রই অযুত অযুত বিদ্যালয় প্রদেশের সর্বত্র উত্থিত হবে; বুদ্ধিজীবি ও তথাকথিত “শিক্ষাবিদ”দের মুখরিত করে তোলা “সার্বজনীন শিক্ষা”র শুন্যগর্ভ বুলির চেয়ে এটা পুরোপুরি ভিন্ন।

১৩। সমবায় আন্দোলন

কৃষকদের সত্যি সমবায় প্রয়োজন, বিশেষত ভোক্তা, বাজার ও ঋণদান সমবায়। যখন তারা কোন দ্রব্য কেনে, ব্যবসায়ী তাকে শোষণ করে, যখন তাদের খামারের ফসল বিক্রি করে, ব্যবসায়ী তার সাথে ঠকায়; যখন তারা ধানের জন্য টাকা ধার করে, সুদী মহাজনের দ্বারা তারা ঠকে, তাই এই তিন সমস্যার তারা সমাধান চান। গত শীতে ইয়াংসি উপত্যকায় লড়াইয়ের সময় যখন বাণিজ্য রুট বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তখন হুনানে লবণের দাম বেড়ে গেছিল। তখন অনেক কৃষক লবণ কেনার জন্য সমবায় গঠন করেছিল। যখন জমিদাররা একরোখাভাবে টাকা লাগানো বন্ধ করল, কৃষকদের দ্বারা অনেকগুলো প্রচেষ্টা চলে ঋণদান সমিতি গঠনের, কারণ তাদের টাকা ধার করার প্রয়োজন ছিল। একটা বড় সমস্যা ছিল সংগঠনের বিস্তারিত মানদন্ড নীতিমালার অনুপস্থিতি। যেহেতু স্বতস্ফূর্তভাবে সংগঠিত কৃষক সমবায়গুলি প্রায়ই সমবায় নীতিমালা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, কৃষকদের মধ্যে কাজ করছেন যেসব কমরেড তারা আগ্রহের “গঠনতন্ত্র ও নীতিমালা”র সন্ধান করেন। সঠিক পরিচালনা থাকলে কৃষক সমিতি বিকাশের সাথে সমবায় আন্দোলনও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে।

১৪। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও বাঁধ মেরামত

এটাও কৃষক সমিতির একটি কীর্তি। কৃষক সমিতি হওয়ার আগে রাস্তাঘাঁট ছিল শোচনীয়। টাকা ছাড়া রাস্তা মেরামত অসম্ভব, আর যেহেতু ধনীরা তাদের টাকা খরচ করতে চায়না, রাস্তা খারাপ অবস্থায় পড়ে থাকে। যদিবা কোন রাস্তায় কাজ করা হত তা দান দক্ষিণা হিসেবে, যেসব পরিবার “পরকালে কিছু পেতে চায়” তাদের কাছ থেকে অল্প কিছু টাকা সংগ্রহ করে কয়েকটি সংকীর্ণ অন্ধ গলি রাস্তা বানানো হয়েছিল। কৃষক সমিতির উত্থানের সাথে তিন, পাঁচ, সাত অথবা দশ ফুট ইত্যাদি বিভিন্ন রুটের প্রয়োজনানুযায়ী রাস্তা প্রশস্ত করার আদেশ দেয়া হয়েছে, আর প্রতিটি রাস্তায় এক একজন জমিদারকে আদেশ দেয়া হয়েছে একটা অংশ গড়ে দেয়ার জন্য। একবার আদেশ দিলে কার সাধ্য তা না মানে? অল্প সময়ের মধ্যে অনেক ভাল রাস্তা আবির্ভূত হল। এটা দয়া দাক্ষিণ্যের নয় বরং বাধ্যবাধকতার ফল, আর এধরণের কিছু বাধ্যবাধকতা খারাপ জিনিস নয়। বাঁধের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। নির্মম জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে সর্বদাই নিয়েছে, কিন্তু বাঁধ নির্মাণে একটি টাকাও খরচ করেনি, তারা পুকুর শুকিয়ে যেতে দিয়েছে যাতে কৃষকরা উপাস থাকে, তারা খাজনা ছাড়া আর কিছুই ভাবতনা। আজ যখন কৃষক সমিতি ক্ষমতা নিয়েছে, জমিদারদের কঠিনভাবে আদেশ দেয়া যায় বাঁধ মেরামতে। যখন কোন জমিদার প্রত্যাখান করে, সমিতি তাকে বিনীতভাবে বলে “ঠিক আছে, তুমি যদি মেরামত না কর, তাহলে তুমি শস্য দেবে প্রতিটি কর্মদিবসে ১ তৌ করে”। যেহেতু এটা খারাপ দরকষাকষি হয়ে যায় জমিদারের জন্য, সে মেরামত করতে এগিয়ে যায়। ফলে অনেক ত্রুটিযুক্ত বাঁধ ভাল বাঁধে রূপান্তরিত হয়েছে।

উপরে বর্ণিত সকল চৌদ্দটি কীর্তি কৃষক সমিতি কর্তৃক সম্পন্ন হয়েছে। পাঠকরা দয়া করে চিন্তা করবেন, এর একটিও কি মৌলিক চেতনা ও বিপ্লবী তৎপরতার দিক থেকে খারাপ? কেবল স্থানীয় অত্যাচারী ও ভদ্রবেশী টাউটরা একে খারাপ বলতে পারে। যথেষ্ট কোউতুহলজনক যে নানচাং (টীকাঃ উত্তর অভিযানকারী বাহিনী ১৯২৬ সালের নভেম্বররে যখন নানচাং দখল করল, চিয়াং কাইশেক এই সুযোগে তার সদরদপ্তর সেখানে প্রতিষ্ঠা করল। সে সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে যোগসাজসে গণবিপ্লবী পার্টির ডানপন্থী সদস্যদের আর বেশকিছু উত্তরের যুদ্ধবাজ রাজনীতিবিদকে তার চারপাশে সমবেত করে তৎকালীন বিপ্লবী কেন্দ্র উহানের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র করল। তারপর সে ১৯২৭ সালের ১২ই এপ্রিল প্রতিবিপ্লবী কুদেতা ঘটাল যা সাংহাইয়ে বিরাট গণহত্যা দ্বারা চিহ্নিত) থেকে জানা গেছে যে চিয়াং কাইশেক, চ্যাং চিংচিয়াঙ (টীকাঃ গণ জাতীয় পার্টির একজন ডানপন্থী নেতা চ্যাং চিংচিয়াঙ ছিল ছিল চিয়াং কাইশেকের একজন উপদেষ্টা) এবং এই জাতীয় অন্যান্য ভদ্রলোকেরা হুনান কৃষকদের তৎপরতাকে সবমিলিয়ে অনুমোদন করেননা। এই একই মত হুনানের লিউ ইউয়েহচিহ (টীকাঃ হুনানের এক গুরুত্বপূর্ণ সাম্যবাদবিরোধী গ্রুপ “বাম সমাজ”-এর শীর্ষনেতা ছিল লিউ ইউয়েহচিহ) ও অন্যান্য ডানপন্থী নেতারা ধারণ করে, এরা সকলেই বলে, “তারাতো একেবারে লাল হয়ে গেছে”। কিন্তু এইটুকু লাল ছাড়া কীভাবে জাতীয় বিপ্লব সম্ভব? সকালসন্ধা ব্যাপক জনগণকে জাগিয়ে তোলার কথা বলা, তারপর জনগণ জাগলে মৃত্যুর ভয় পাওয়া—এর সাথে রাজা শেহ’র ড্রাগনপ্রীতির [টীকাঃ ইয়ে শে’র ড্রাগনপ্রীতি ছিল লিউ সিয়াংয়ের (৭৭-৬ খৃষ্টপূর্ব) সিন সু বই থেকে নেয়া এক গল্প। এতে বলা হয় যে, রাজা শে ড্রাগনকে খুব ভালবাসতেন। তিনি তার অস্ত্রশস্ত্র, হাতিয়ার আর সমগ্র প্রাসাদকে ড্রাগনের চিত্র ও ভাস্কর্য দিয়ে সাজিয়েছলেন। তার এই অনুরাগের কথা শুনে এক প্রকৃত ড্রাগন আকাশ থেক নেমে এল। সে জানালা দিয়ে ইয়েং কোংয়ের বাড়ীর ভেত্র উঁকি দিল আর নিজের লেজটি দরজ্র ভিতর ঢুকিয়ে দিল। ইয়ে কোং ড্রাগনকে দেখে দিশাহারা হয়ে পালিয়ে গেল। এখানে কমরেড মাও সেতুঙ এই রূপক ব্যবহার করে দেখাতে চেয়েছেন যে চিয়াং কাইশেক ও তার মত ব্যক্তিরা  যদিও বিপ্লবের কথা বলেছিল, তবু তারা বিপ্লবের ভয়ে ভীত এবং তার বিরোধ] পার্থক্য কোথায়? ।।