মাও সেতুঙ। উদারতাবাদের বিরোধিতা করুন। লটবহর পরিত্যাগ করুন ও যন্ত্রটাকে চালু করুন। সহজ সরল জীবনযাপন ও কঠোর সংগ্রামের রীতিকে বজায় রাখুন।

পিডিএফ  মুদ্রনের জন্য পিডিএফ

মাও সেতুঙ। উদারতাবাদের বিরোধিতা করুন। রচনাটির প্রকাশকাল ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৩৭। লটবহর

মাও সেতুঙ

            মাও সেতুঙ

পরিত্যাগ করুন ও যন্ত্রটাকে চালু করুন। প্রবন্ধটি ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাসে ইয়েনানে উচ্চপদস্থ কেডারদের আলোচনা সভায় প্রদত্ত কমরেড মাও সেতুঙের ভাষণের তৃতীয় অংশ। ভাষণের শিরোনাম হচ্ছে “অধ্যয়ন ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি”। “মাও সেতুঙ নির্বাচিত রচনাবলী” তৃতীয় খণ্ডে রচনাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সহজ সরল জীবনযাপন ও কঠোর সংগ্রামের রীতিকে বজায় রাখুন। চীনের সাম্যবাদী পার্টির সপ্তম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে কমরেড মাও সেতুঙ প্রদত্ত রিপোর্টের দশম অংশ। এই রিপোর্টের পূর্ণ বিবরণ “মাও সেতুঙ নির্বাচিত রচনাবলী”র চতুর্থ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে চীনের পিকিং গণ প্রকাশন কর্তৃক চীনা ভাষায় প্রকাশিত “মাও সেতুঙ রচনাবলীর নির্বাচিত পাঠ”-এর দ্বিতীয় সংস্করণে এই রচনাগুলি প্রকাশিত হয়। উক্ত সংস্করণ থেকে বিদেশী ভাষা প্রকাশনা পিকিং বাংলায় ভাষান্তর করে প্রকাশ করে। উক্ত ভাষান্তরে সামান্য কিছু ভাষাগত সম্পাদনা করে বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদীর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ ১৬ই জুন, ২০২৩ প্রকাশ করে। সর্বহারা পথ ওয়েবসাইট থেকে এই সংস্করণটির অধ্যয়ন ও প্রিন্ট নেয়া যাবে। মার্কসিস্ট ইন্টারনেট আর্কাইভে সংরক্ষিত ইংরেজী কপিটির সাথেও বাংলা ভাষান্তর মিলিয়ে দেখা হয়েছে।

এই তিন রচনা থেকে কমরেড মাও সেতুঙের কিছু উদ্ধৃতি

“আমরা সক্রিয় মতাদর্শগত সংগ্রামের পক্ষে, কারণ এটা হচ্ছে আমাদের সংগ্রামের স্বার্থে পার্টির ভিতরে ও বিপ্লবী সংগঠনগুলোর ভেতরে ঐক্যকে নিশ্চিত করার হাতিয়ার। প্রত্যেক সাম্যবাদী ও বিপ্লবীর উচিত এই হাতিয়ার হাতে তুলে নেয়া”

“কিন্তু উদারতাবাদ মতাদর্শগত সংগ্রামকে বাতিল করে দেয় এবং নীতিহীন শান্তির পক্ষ নেয়, এইভাবে তা ক্ষয়িষ্ণু ও অসভ্য মনোভাবের জন্ম দেয় আর পার্টি ও বিপ্লবী সংগঠনগুলোর কোন কোন একক ও ব্যক্তির রাজনৈতিক অধঃপতন ঘটায়”

“বিপ্লবী যৌথ সংগঠনের ভেতরে উদারতাবাদ অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটা হচ্ছে একটা ক্ষয়কারক বস্তু যা ঐক্য নষ্ট করে, সংহতি ধ্বংস করে, কাজে নিষ্ক্রিয়তা আনে আর মতভেদ সৃষ্টি করে। এটা বিপ্লবী বাহিনীকে দৃঢ়বদ্ধ সংগঠন ও কঠোর শৃংখলা থেকে বঞ্চিত করে, নীতিগুলোকে পুরোপুরি কার্যকরী করা অসম্ভব করে তোলে আর পার্টি যাঁদের পরিচালনা করে সেই জনসাধারণ থেকে পার্টি-সংগঠনকে পর করে দেয়। এটা অত্যন্ত খারাপ ঝোঁক”

“পাতি বুর্শোয়া স্বার্থপরতা হতে উদারতাবাদের জন্ম, এটা ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রথম স্থান দেয় এবং বিপ্লবের স্বার্থকে দেয় দ্বিতীয় স্থান। ফলে মতাদর্শগত, রাজনীতিগত ও সংগঠনগত উদারতাবাদের উদ্ভব ঘটে”

“একজন সাম্যবাদীকে বিশাল মনের অধিকারী, একনিষ্ঠ ও সক্রিয় হতে হবে। বিপ্লবের স্বার্থকে নিজের প্রাণের মত করে দেখতে হবে আর ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিপ্লবের স্বার্থের অধীনে রাখতে হবে। তাকে সর্বদা ও সর্বক্ষেত্রেই নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে আর সমস্ত ভুল চিন্তাধারা ও আচরনের বিরুদ্ধে অক্লান্তভাবে সংগ্রাম করতে হবে যাতে করে পার্টির যৌথ জীবনকে সুসংবদ্ধ আর পার্টি ও জনসাধারণের মধ্যকার সংযোগকে জোরদার করা যায়; ব্যক্তিবিশেষের চাইতে পার্টি ও জনসাধারণের সম্বন্ধে আর নিজের চেয়ে অপরের সম্বন্ধে তাঁকে বেশি যত্নশীল হতে হবে। শুধু তাহলেই তাঁকে একজন সাম্যবাদী বলে বিবেচনা করা যেতে পারে”

 “উদারতাবাদীরা মার্কসবাদের নীতিগুলিকে বিমূর্ত ধর্মকথার মত মনে করেন। মার্কসবাদকে তাঁরা অনুমোদন করেন, কিন্তু তাকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে বা পুরোপুরি প্রয়োগ করতে তাঁরা প্রস্তুত নন, নিজেদের উদারতাবাদের পরিবর্তে মার্কসবাদকে গ্রহণ করতে তাঁরা তৈরি নন। এইসব লোকের আছে তাঁদের মার্কসবাদ, আবার তাঁদের উদারতাবাদও আছে। মুখে তাঁরা মার্কসবাদের কথা বলেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োগ করেন উদারতাবাদ। অন্যদের প্রতি তাঁরা প্রয়োগ করেন মার্কসবাদ, কিন্তু নিজেদের প্রতি প্রয়োগ করেন উদারতাবাদ। দুই ধরণের জিনিসই তাঁরা মজুদ রাখেন, আর একেকটি একেক কাজে ব্যবহার করেন”                  

“নতুন বিজয় অর্জন করার জন্য আমাদের অবশ্যই পার্টি কেডারদের আহবান জানাতে হবে লটবহর পরিত্যাগ করে যন্ত্রটাকে চালু করতে। “লটবহর পরিত্যাগ করার” অর্থ হচ্ছে বহু বোঝা থেকে মনকে মুক্ত করা। এমন বহু জিনিস আছে যাকে অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরলে সেগুলি লটবহরে পরিণত হতে পারে, বোঝা হয়ে উঠতে পারে”

“একটা সাধারণ প্রবাদ আছে “ভ্রু কোঁচকালেই বুদ্ধি আসে”। অন্য কথায়, বেশি করে ভাবলেই প্রজ্ঞার উদয় হয়। আমাদের পার্টির ভেতরে প্রায়ই দেখা যায় যে অন্ধভাবে কাজ করার অনুশীলন, তা থেকে মুক্ত হতে চিন্তা করার ও বিশ্লেষণের পদ্ধতিকে শিখে নিতে আর বিশ্লেষণের অভ্যাস চর্চা করতে আমাদের কমরেডদেরকে অবশ্যই উৎসাহ দিতে হবে। আমাদের পার্টিতে এর অভ্যাস খুব কমই আছে। আমরা যদি লটবহর পরিত্যাগ করি এবং যন্ত্রটাকে চালু করি, আমরা যদি হাল্কা বোঝা নিয়ে অগ্রসর হই এবং কি করে কঠিনভাবে চিন্তা করতে হয় তা জানি, তাহলে আমাদের বিজয় অবধারিত”

“দেশব্যাপী বিজয়লাভ করাটা হচ্ছে দশ হাজার লি (৫০০০ কিলোমিটার) দীর্ঘযাত্রার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। এই পদক্ষেপ গৌরবের হলেও তা খুবই তুচ্ছ, আরো গৌরবজনক ব্যাপার ভবিষ্যতে হবে। কয়েক দশক পরে চীনা জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হবে এটা যেন এক সুদীর্ঘ নাটকের একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা। নাটক অবশ্যই ভূমিকা থেকে শুরু হয়, কিন্তু ভূমিকাটাই চরম পরিণতি নয়। চীনা বিপ্লব মহান, কিন্তু বিপ্লবের পরের পথ হবে দীর্ঘতর, কাজটা হবে আরো মহান, আরো কঠিন”

“কমরেডদের শিক্ষা দিতে হবে যাতে তাঁদের কাজে বিনয়ী ও বিচক্ষন হবার রীতিতে, অহংকার ও অসহিষ্ণুতা থেকে মুক্ত থাকার রীতিতে অবিচল থাকেন, আর অবিচল থাকেন সহজ সরল জীবনযাত্রা আর কঠোর সংগ্রামের রীতিতে। সমালোচনা ও আত্মসমালোচনা—এই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হাতিয়ার আমাদের রয়েছে। আমরা খারাপ কর্মরীতি পরিত্যাগ করতে পারি এবং ভালটা রাখতে পারি। আমরা যা জানতাম না তা শিখতে পারি”

 

বাংলা ভাষান্তরের ভূমিকা

কমরেড মাও সেতুঙের অতি গুরুত্বপূর্ণ এসব রচনা ছিল সাম্যবাদী জীবন দর্শন গড়ার ভিত্তি। সাম্যবাদী ক্যাডারদেরকে এই রচনাগুলির প্রতিটি লাইন অধ্যয়ন করতে হবে।

প্রথমে উদারতাবাদের বিরোধিতা করুন রচনায় আসি। উদারতাবাদ এমন এক বিষ যা ব্যক্তি সাম্যবাদী ও যৌথ জীবন, পার্টি সবকিছুই ধ্বংস করে দেয়। উদারতাবাদীরা নিজেকে বড় মনে করে, নিজেকে নিয়েই শুধু ভাবে, নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, নিজেকে আড়াল করে, নিজের ঝোঁকে চলে, যৌথ জীবনকে শ্রদ্ধা করেনা, আদেশ অমান্য করে, নিজের মতকে প্রাধান্য দেয়, পিছনে কথা বলে, গুজব রটনা করে, ঝগড়া বাঁধায়, ব্যক্তিগত আক্রোশ ও প্রতিহিংসা প্রকাশ করে, যুক্তিতর্ক দিয়ে সমস্যার সমাধান করেনা, স্বজনপ্রীতি করে, জেনেশুনেও ভুল মত খন্ডন করেনা, জনগণের ক্ষতি হচ্ছে দেখেও নির্বিকার থাকে, প্রতিবাদ করেনা, জনগণকে সঠিক লাইনে উদ্বুদ্ধ করেনা, নিজের ভুল সংশোধন করেনা, বিপ্লবে উৎসাহ উদ্দীপনাহীন থাকে মঠের সন্ন্যাসীর মত, মার্কসবাদকে ধর্মের মত গোঁড়া জিনিস মনে করে, তারা সক্রিয় মতাদর্শিক সংগ্রাম চালায়না।

মাও বলেন, “একজন সাম্যবাদীকে বিশাল মনের অধিকারী, একনিষ্ঠ ও সক্রিয় হতে হবে। বিপ্লবের স্বার্থকে নিজের প্রাণের মত করে দেখতে হবে আর ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিপ্লবের স্বার্থের অধীনে রাখতে হবে। তাকে সর্বদা ও সর্বক্ষেত্রেই নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে আর সমস্ত ভুল চিন্তাধারা ও আচরনের বিরুদ্ধে অক্লান্তভাবে সংগ্রাম করতে হবে যাতে করে পার্টির যৌথ জীবনকে সুসংবদ্ধ আর পার্টি ও জনসাধারণের মধ্যকার সংযোগকে জোরদার করা যায়; ব্যক্তিবিশেষের চাইতে পার্টি ও জনসাধারণের সম্বন্ধে আর নিজের চেয়ে অপরের সম্বন্ধে তাঁকে বেশি যত্নশীল হতে হবে। শুধু তাহলেই তাঁকে একজন সাম্যবাদী বলে বিবেচনা করা যেতে পারে”

‘লটবহর পরিত্যাগ করুন, যন্ত্রটাক চালু রাখুন’ রচনায় মাও মনের মধ্যে যে বোঝা রয়েছে তা থেকে সাম্যবাদী কমরেডদের মুক্ত হওয়ার কথা বলেন। বোঝাগুলি একদিকে দুর্বলচিত্ততা, অন্যদিকে অহংকার ও দম্ভ। এগুলো বারবার চীনের বিপ্লবীযুদ্ধের ক্ষতি করেছে। তাই মাও এগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার উপর জোর দেন।

সহজ সরল জীবনযাপনের রীতিকে বজায় রাখুন রচনায় মাও সচেতন ছিলেন আসন্ন দেশব্যাপী বিজয়ের পর অহংকার ও দম্ভ অনেক কমরেডকে গ্রাস করবে। শত্রু অস্ত্রের যুদ্ধে আমাদের সাথে পারেনা কিন্তু চিনির গোলা ছুড়ে দুর্বলচিত্ত ঐ সকল কমরেডদের বিলাসী জীবনে আটকে ফেলতে পারে। এটা চীনের নয়াগণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আর আমরা পরবর্তী ইতিহাস থেকে জানি মাও কত সঠিক ছিলেন।।

কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ

বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী

১৬ই জুন, ২০২৩

                            

উদারতাবাদের বিরোধিতা করুন

৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৩৭

আমরা সক্রিয় মতাদর্শগত সংগ্রামের পক্ষে, কারণ এটা হচ্ছে আমাদের সংগ্রামের স্বার্থে পার্টির ভিতরে ও বিপ্লবী সংগঠনগুলোর ভেতরে ঐক্যকে নিশ্চিত করার হাতিয়ার। প্রত্যেক সাম্যবাদী ও বিপ্লবীর উচিত এই হাতিয়ার হাতে তুলে নেয়া।

কিন্তু উদারতাবাদ মতাদর্শগত সংগ্রামকে বাতিল করে দেয় এবং নীতিহীন শান্তির পক্ষ নেয়, এইভাবে তা ক্ষয়িষ্ণু ও অসভ্য মনোভাবের জন্ম দেয় আর পার্টি ও বিপ্লবী সংগঠনগুলোর কোন কোন একক ও ব্যক্তির রাজনৈতিক অধঃপতন ঘটায়।

উদারতাবাদ বিভিন্নভাবে নিজেকে প্রকাশ করে।

যখন সুস্পষ্টই দেখা যায় যে, কোন লোক ভুল পথে যাচ্ছেন, অথচ সে লোক একজন পুরোনো পরিচিত লোক, একই জায়গার অধিবাসী, সহপাঠী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রিয়জন, পুরনো সহকর্মী বা পুরনো অধস্তন লোক বলে তাঁর সাথে নীতির ভিত্তিতে যুক্তিতর্ক না করা, শান্তি ও সখ্যতা বজায় রাখার জন্য হাল্কাভাবে কিছু বলা, কিন্তু চূড়ান্তভাবে মীমাংসার চেষ্টা না করা। এর ফলে সংগঠন ও ব্যক্তিবিশেষ উভয়েরই ক্ষতি হয়। এটা হচ্ছে প্রথম প্রকারের উদারতাবাদ।

নিজের প্রস্তাব সংগঠনের সামনে সক্রিয়ভাবে উত্থাপন না করে আড়ালে দায়িত্বজ্ঞানহীন সমালোচনা করা। সামনা-সামনি কিছু না বলে পেছনে গুজব রটনা করা, অথবা সভায় কিছু না বলা কিন্তু পরে আজেবাজে কথা বলা। যৌথ জীবনের নীতির প্রতি আদৌ কোন প্রকার শ্রদ্ধা না দেখিয়ে নিজের ঝোঁকে চলা। এটা দ্বিতীয় প্রকারের।

যে ব্যাপার নিজেকে স্পর্শ করে না তাকে চলতে দেয়া; কোন বিষয়কে স্পষ্টতই ভুল জেনেও সে বিষয় সম্পর্কে যথাসম্ভব কম বলা; সাংসারিক বিষয়ে অভিজ্ঞ সাজা, গা বাঁচিয়ে চলা ও কেবলমাত্র দোষ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা। এটা তৃতীয় প্রকারের।

আদেশ অমান্য করা ও নিজের মতামতকে প্রথম স্থান দেয়া। সংগঠনের কাছ থেকে শুধু বিশেষ সুবিধা দাবি করা, কিন্তু সংগঠনের শৃংখলা অস্বীকার করা। এটা চতুর্থ প্রকারের।

ঐক্য বা অগ্রগতি অথবা সুষ্ঠুভাবে কর্ম সম্পাদনের জন্য ভুল মতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুক্তিতর্ক না করে ব্যক্তিগত আক্রমণ চালানো, ঝগড়া বাধানো, ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রকাশ করা বা প্রতিহিংসা নেওয়ার চেষ্টা করা। এটা পঞ্চম প্রকারের।

ভুল মতামত শুনেও তা খণ্ডন না করা, এমনকি প্রতিবিপ্লবী মন্তব্য শুনেও সে সম্বন্ধে কোন রিপোর্ট না করা, বরং সেগুলো নির্বিকারভাবে গ্রহণ করা যেন কিছুই ঘটেনি। এটা ষষ্ঠ প্রকারের।

জনসাধারণের মধ্যে থেকেও তাঁদের মধ্যে প্রচার না চালানো এবং তাঁদেরকে উত্তেজিত না করা, সভায় বক্তৃতা না দেয়া, তাঁদের মধ্যে তদন্ত ও অনুসন্ধান না চালানো, তাঁদের সুখদুঃখের প্রতি কোন রকম যত্ন না নেয়া, বরং তাঁদের সম্বন্ধে উদাসীন থাকা এবং নিজে যে একজন সাম্যবাদী সে কথা ভুলে একজন অ-সাম্যবাদীর মত আচরণ করা। এটা সপ্তম প্রকারের।

কেউ জনসাধারনের স্বার্থের ক্ষতি করছে দেখেও ক্রোধ অনুভব না করা বা তাকে উপদেশ দিয়ে বিরত না করা, না থামান, যুক্তি দিয়ে তাকে না বুঝানো, বরং জেনে শুনেও তাকে সে কাজ করে যেতে দেয়া। এটা অষ্টম প্রকারের।

কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা লক্ষ্য ছাড়া উৎসাহহীনভাবে কাজ করা, যেনতেন ভাবে কাজ করা এবং জগাখিচুড়ী পাকিয়ে চলা যেন “যতদিন মঠের সন্যাস্যী থাকব ততদিন ঘন্টা বাজিয়েই যাব”। এটা নবম প্রকারের।

বিপ্লবের জন্য নিজে বিরাট অবদান রেখেছেন বলে মনে করা, প্রবীন অভিজ্ঞ বলে নিজেকে জাহির করা, বড় কাজ করতে অসমর্থ হওয়া সত্ত্বেও ছোট কাজ করতে ঘৃণা করা, কাজে অমনোযোগী হওয়া আর পড়াশুনায় ঢিল দেয়া। এটা দশম প্রকারের।

নিজের ভুল জানতে পেরেও তা সংশোধনের চেষ্টা না করা, নিজের প্রতি উদার মনোভাব পোষন করা। এটা একাদশ প্রকারের।

আমরা আরো কয়েকটি ধরণের কথা উল্লেখ করতে পারি। কিন্তু এই এগারটিই প্রধান।

এসবগুলিই উদারতাবাদের অভিব্যক্তি।

বিপ্লবী যৌথ সংগঠনের ভেতরে উদারতাবাদ অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটা হচ্ছে একটা ক্ষয়কারক বস্তু যা ঐক্য নষ্ট করে, সংহতি ধ্বংস করে, কাজে নিষ্ক্রিয়তা আনে আর মতভেদ সৃষ্টি করে। এটা বিপ্লবী বাহিনীকে দৃঢ়বদ্ধ সংগঠন ও কঠোর শৃংখলা থেকে বঞ্চিত করে, নীতিগুলোকে পুরোপুরি কার্যকরী করা অসম্ভব করে তোলে আর পার্টি যাঁদের পরিচালনা করে সেই জনসাধারণ থেকে পার্টি-সংগঠনকে পর করে দেয়। এটা অত্যন্ত খারাপ ঝোঁক।

পাতি বুর্শোয়া স্বার্থপরতা হতে উদারতাবাদের জন্ম, এটা ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রথম স্থান দেয় এবং বিপ্লবের স্বার্থকে দেয় দ্বিতীয় স্থান। ফলে মতাদর্শগত, রাজনীতিগত ও সংগঠনগত উদারতাবাদের উদ্ভব ঘটে।

উদারতাবাদীরা মার্কসবাদের নীতিগুলিকে বিমূর্ত ধর্মকথার মত মনে করেন। মার্কসবাদকে তাঁরা অনুমোদন করেন, কিন্তু তাকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে বা পুরোপুরি প্রয়োগ করতে তাঁরা প্রস্তুত নন, নিজেদের উদারতাবাদের পরিবর্তে মার্কসবাদকে গ্রহণ করতে তাঁরা তৈরি নন। এইসব লোকের আছে তাঁদের মার্কসবাদ, আবার তাঁদের উদারতাবাদও আছে। মুখে তাঁরা মার্কসবাদের কথা বলেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োগ করেন উদারতাবাদ। অন্যদের প্রতি তাঁরা প্রয়োগ করেন মার্কসবাদ, কিন্তু নিজেদের প্রতি প্রয়োগ করেন উদারতাবাদ। দুই ধরণের জিনিসই তাঁরা মজুদ রাখেন, আর একেকটি একেক কাজে ব্যবহার করেন। কোন কোন লোকের চিন্তা এইভাবে কাজ করে থাকে।

উদারতাবাদ সুবিধাবাদের এক প্রকারের প্রকাশ, আর মার্কসবাদের সঙ্গে এর মৌলিক সংঘর্ষ রয়েছে। এটা নেতিবাচক এবং বাস্তব ক্ষেত্রে এটা শত্রুকে সাহায্য করার ভূমিকা গ্রহণ করে। তাই, শত্রুরা আমাদের মধ্যে এর সংরক্ষণকে স্বাগত জানায়। উদারতাবাদের প্রকৃতি যখন এইরূপ তখন বিপ্লবীদের মধ্যে তার কোন স্থান থাকতে পারেনা।

নেতিবাচক উদারতাবাদ দূর করার জন্য আমাদেরকে মার্কসবাদের ইতিবাচক ভাবমানস গ্রহণ করতে হবে। একজন সাম্যবাদীকে বিশাল মনের অধিকারী, একনিষ্ঠ ও সক্রিয় হতে হবে। বিপ্লবের স্বার্থকে নিজের প্রাণের মত করে দেখতে হবে আর ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিপ্লবের স্বার্থের অধীনে রাখতে হবে। তাকে সর্বদা ও সর্বক্ষেত্রেই নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে আর সমস্ত ভুল চিন্তাধারা ও আচরনের বিরুদ্ধে অক্লান্তভাবে সংগ্রাম করতে হবে যাতে করে পার্টির যৌথ জীবনকে সুসংবদ্ধ আর পার্টি ও জনসাধারণের মধ্যকার সংযোগকে জোরদার করা যায়; ব্যক্তিবিশেষের চাইতে পার্টি ও জনসাধারণের সম্বন্ধে আর নিজের চেয়ে অপরের সম্বন্ধে তাঁকে বেশি যত্নশীল হতে হবে। শুধু তাহলেই তাঁকে একজন সাম্যবাদী বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

সকল বিশ্বস্ত, সৎ, সক্রিয় ও ন্যায়পরায়ণ সাম্যবাদীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের কিছু সংখ্যক লোকের মধ্যে যে উদারতাবাদের যে ঝোঁক রয়েছে তার বিরোধিতা করে তাঁদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের মতাদর্শগত ফ্রন্টের অন্যতম কর্তব্য।।

লটবহর পরিত্যাগ করুন ও যন্ত্রটাকে চালু করুন

১২ই এপ্রিল, ১৯৪৪

নতুন বিজয় অর্জন করার জন্য আমাদের অবশ্যই পার্টি কেডারদের আহবান জানাতে হবে লটবহর পরিত্যাগ করে যন্ত্রটাকে চালু করতে। “লটবহর পরিত্যাগ করার” অর্থ হচ্ছে বহু বোঝা থেকে মনকে মুক্ত করা। এমন বহু জিনিস আছে যাকে অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরলে সেগুলি লটবহরে পরিণত হতে পারে, বোঝা হয়ে উঠতে পারে। কয়েকটা উদাহারণ দেওয়া যাক। ভুল করার পর “যাই হোক, আমি ভুল করেছি”—এটা ভেবে আপনি নিরুৎসাহী হয়ে পড়তে পারেন, ভুল না করলে, ভুল থেকে আপনি মুক্ত, এটা ভেবে আপনি অহংকারী হয়ে পড়তে পারেন। কাজের অসফলতা নৈরাশ্য ও বিষন্নতার জন্ম দিতে পারে, আবার সফলতা অহংকার ও ঔদ্ধত্যের জন্ম দিতে পারে। অল্পকাল ধরে সংগ্রাম করছেন বলে কোন কমরেড তাঁর দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে পারেন, আবার দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করছেন বলে কোণ প্রবীণ কমরেড মতের ব্যাপারে একগুঁয়ে হয়ে উঠতে পারেন। শ্রমিক ও কৃষক কমরেডরা নিজেদের জন্মগত শ্রেণীর গৌরবে বুদ্ধিজীবিদেরকে অবজ্ঞার চক্ষে দেখতে পারেন, আবার বুদ্ধিজীবিরাও নিজেদের কিছু জ্ঞান আছে বলে শ্রমিক-কৃষকদেরকে অবজ্ঞার চক্ষে দেখতে পারেন। যে কোন বিশেষ দক্ষতা মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে যা দম্ভ আর অন্যের প্রতি অবজ্ঞা সৃষ্টি করতে পারে। এমন কি বয়সও আত্মঅহংকারের কারণ হয়ে উঠতে পারে। যুবকরা বুদ্ধিমান ও কর্মক্ষম বলে বৃদ্ধদের অবহেলা করতে পারেন, আবার বৃদ্ধরা অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ বলে যুবকদের অবজ্ঞা করতে পারেন। সমালোচনামূলক সতর্কতা না থাকলে এই ধরণের সমস্ত জিনিস বোঝা বা লটবহর হয়ে উঠে। অনেক কমরেড যে নিজেদের আকাশে তোলেন ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন, বারবার ভুল করেন তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই যে তাঁরা এ ধরণের লটবহর বহন করেন। কাজেই জনগণের সঙ্গে গভীর সংযোগ রক্ষার এবং ভুলের সংখ্যা কমানোর পূর্বশর্ত হচ্ছে প্রত্যেকের লটবহর পরীক্ষা করে দেখা, তা পরিহার করা ও মনকে মুক্ত করা। আমাদের পার্টির ইতিহাসে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যাতে প্রবল আত্মম্ভরিতা দেখা দিয়েছে আর তার ফল আমাদের ভোগ করতে হয়েছে। প্রথম ঘটনা ১৯২৭ সালের প্রথমার্ধের। তখন উত্তরাঞ্চলীয় অভিযানকারী বাহিনী উহানে পৌঁছেছে, কিছু সংখ্যক কমরেড এত গর্বিত ও দাম্ভিক হয়ে উঠলেন যে তাঁরা ভুলে গেলেন, কুওমিনতাঙ আমাদের আক্রমণ করতে উদ্যত। তার ফল হয়েছিল চেন তুসিউ লাইনের ভ্রান্তি—যার ফলে বিপ্লবে পরাজয় এসেছিল। দ্বিতীয় ঘটনা ১৯৩০ সালের। ফেং ইউসিয়াং এবং ইয়ান সীশানের বিরুদ্ধে চিয়াং কাইশেকের ব্যাপক যুদ্ধের (টীকাঃ একদিকে চিয়াং কাইশেক ও অপরদিকে ফেং ইয়ুসিয়াং ও ইয়ান সীশান সমরনায়কদের মধ্যে এই ব্যাপক যুদ্ধ লোংহান ও খিয়ানচিং-পুখৌ রেলপথের পাশে সংঘটিত হয়। ছয় মাস তা স্থায়ী হয় ১৯৩০ সালের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। দুই পক্ষে ৩,০০,০০০ সৈন্য হতাহত হয়) সুযোগ নিয়ে লাল ফৌজ অনেকগুলি যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং কিছু সংখ্যক কমরেড আবার আত্মম্ভরি ও  দাম্ভিক হয়ে উঠেন। ফল হয়েছিল লি লিসান লাইনের ভ্রান্তি—যাতে পুনরায় বিপ্লবী শক্তিসমূহের কিছু ক্ষতি হয়েছিল। তৃতীয় ঘটনা ১৯৩১ সালের। লাল ফৌজ কুওমিনতাঙের তৃতীয় “ঘেরাও দমন” অভিযানকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং তার অব্যবহিত পরই জাপানী আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য সারা দেশ জুড়ে জনগণ এক ঝটিকা ও বীরত্বপূর্ণ জাপানবিরোধী আন্দোলন আরম্ভ করেছে। এবারও কিছু সংখ্যক কমরেড আত্মম্ভরি ও দাম্ভিক হয়ে উঠলেন। ফল হয়েছিল রাজনৈতিক লাইনের আরো গুরুতর ভুল, যার দরুন আমাদেরকে বিপ্লবী শক্তির প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ এলাকা হারাতে হয় যে শক্তিগুলো আমরা অর্জন করেছিলাম কঠোর পরিশ্রমের বদৌলতে। চতুর্থ ঘটনা ১৯৩৮ সালের। প্রতিরোধ যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে এবং যুক্তফ্রন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবারও কিছু সংখ্যক কমরেড আত্মম্ভরিতা ও দম্ভ প্রকাশ করলেন। ফলে পুনরায় অনেকটা চেন তুসিউ লাইনের মত ভুল দেখা দিল। এবার যে সব এলাকায় এই সব কমরেডদের ভুল ধারণা বিশেষভাবে প্রচারিত হয়েছিল সেসব জায়গায় বিপ্লবী কাজ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গর্ব ও ভুলের এইসব উদাহারণ থেকে সমগ্র পার্টির কমরেডদের সতর্কতা গ্রহণ করা উচিত। সম্প্রতি আমরা লি জিচেং এর উপর কুও মোজোর প্রবন্ধটি (টীকাঃ “১৬৪৪ সালের অভ্যুত্থানের তিনশত বছর পুর্তি” এই রচনাটি কুও মোজো ১৯৪৪ সালে লিখেছলেন। লি জিচেং পরিচালিত মিং রাজবংশের শেষ দিককার কৃষক অভ্যুত্থানের বিজয়ের স্মারক হিসেবে। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে ১৬৪৫ সালে অভ্যুত্থান পরাজিত হবার কারণ হচ্ছে ১৬৪৪ সালে কৃষকরা যখন পিকিঙে প্রবেশ করে তখন তাদের কিছু সংখ্যক নেতা বিলাসবহুল জীবনযাপনের দ্বারা কলুষিত হয়ে পড়ে ও তার ফলে উপদলীয় কোন্দল আরম্ভ হয়। রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল চুংচিংয়ে “নয়া চীন দৈনিক”-এ এবং পরে ইয়েনানে ও অন্যান্য মুক্ত অঞ্চলে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়) পুনপ্রকাশ করেছি যাতে কমরেডরা এই কাহিনী থেকে সতর্কতা গ্রহণ করতে পারেন আর সাফল্যের মুহুর্তে আত্মম্ভরি হওয়ার ভুল না করেন।

“যন্ত্রটাকে চালু করার” অর্থ হচ্ছে চিন্তার অঙ্গের সদ্ব্যবহার করা। যদিও অনেক লোক লটবহর নিয়ে চলেন না এবং জনগণের সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলার সদ্গুণের অধিকারী, তবু তাঁরা কোন কিছু সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হন কারণ তাঁরা জানেননা কি করে অনুসন্ধিৎসার সঙ্গে চিন্তা করতে হয় অথবা তাঁরা মাথা খাটিয়ে বেশি চিন্তা করতে ও কঠিন চিন্তা করতে অনিচ্ছুক। আবার অনেকে মাথা খাটাতে অস্বীকার করে কারণ তারা যে লটবহর নিয়ে চলে তা তাদের বুদ্ধিতে খিল দিয়ে রাখে। লেনিন ও স্তালিন প্রায়ই জনগণকে মাথা খাটাবার উপদেশ দিতেন, আমাদেরকেও একই উপদেশ দেওয়া উচিত। মস্তিষ্ক নামীয় এই যে যন্ত্র, এর বিশেষ ক্রিয়া হচ্ছে চিন্তা করা। মেনসিয়াস বলেছিলেন, “মনের কাজ হচ্ছে চিন্তা করা।” (টীকাঃ মেনসিয়াস, একাদশ পুস্তক, “কাও জি” প্রথম অংশ থেকে) তিনি মস্তিষ্কের ক্রিয়া সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। আমাদের যথাসময় মাথা ঘামাতে হবে এবং প্রত্যেকটি বিষয়কে বারবার যত্নসহকারে ভেবে দেখতে হবে। একটা সাধারণ প্রবাদ আছে “ভ্রু কোঁচকালেই বুদ্ধি আসে”। অন্য কথায়, বেশি করে ভাবলেই প্রজ্ঞার উদয় হয়। আমাদের পার্টির ভেতরে প্রায়ই দেখা যায় যে অন্ধভাবে কাজ করার অনুশীলন, তা থেকে মুক্ত হতে চিন্তা করার ও বিশ্লেষণের পদ্ধতিকে শিখে নিতে আর বিশ্লেষণের অভ্যাস চর্চা করতে আমাদের কমরেডদেরকে অবশ্যই উৎসাহ দিতে হবে। আমাদের পার্টিতে এর অভ্যাস খুব কমই আছে। আমরা যদি লটবহর পরিত্যাগ করি এবং যন্ত্রটাকে চালু করি, আমরা যদি হাল্কা বোঝা নিয়ে অগ্রসর হই এবং কি করে কঠিনভাবে চিন্তা করতে হয় তা জানি, তাহলে আমাদের বিজয় অবধারিত।।

 

সহজ সরল জীবনযাপন ও কঠোর সংগ্রামের রীতিকে বজায় রাখুন

৫ই মার্চ, ১৯৪৯

আমরা শীঘ্রই দেশব্যাপী বিজয় অর্জন করব। এই বিজয় সাম্রাজ্যবাদের প্রাচ্যফ্রন্টে ফাটল ধরাবে, এর মহান আন্তর্জাতিক তাৎপর্য থাকবে। এই বিজয় অর্জন করার জন্য আর খুব বেশী সময় ও প্রয়াসের প্রয়োজন হবেনা, কিন্তু এই বিজয়কে সুসংবদ্ধ করার জন্য তার প্রয়োজন হবে। আমাদের গঠনকার্য চালানোর ক্ষমতা সম্পর্কে বুর্শোয়াদের সন্দেহ রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীরা মনে করে যে বাঁচার জন্য আমরা শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে ভিক্ষা চাইব। বিজয়লাভের কারণে পার্টির ভিতরে অহংকারের মনোভাব, নিজেকে নিজে বীর বলে জাহির করার মনোভাব, প্রগতিতে জড়তা ও অনিচ্ছার মনোভাব, ভোগবিলাসের প্রতি অনুরাগ এবং অনবরত কঠোর জীবন যাপনে বিরাগ জন্মাতে পারে। বিজয়লাভ করলে জনগণ আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবেন, এবং বুর্শোয়াশ্রেণী আমাদের তোষামোদ করতে এগিয়ে আসবে। শত্রুরা অস্ত্রশক্তির দ্বারা আমাদের জয় করতে পারেনা, একথা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। তবে, আমাদের বাহিনীতে যাঁরা দুর্বলচেতা তাঁদেরকে বুর্শোয়াশ্রেণী তোষামোদ করে জয় করে নিতে পারে। এমন সাম্যবাদীও সম্ভবতঃ কিছু কিছু থাকতে পারেন, বন্দুকধারী শত্রু যাঁদের জয় করতে পারেনি এবং যাঁরা এই শত্রুদের মোকাবিলা করার ব্যাপারে বীর উপাধি পাবার যোগ্য ছিলেন, কিন্তু চিনির গোলার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেননা, তাঁরা এই চিনির গোলার দ্বারা পরাজিত হবেন। আমাদের অবশ্যই এই ধরণের পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। দেশব্যাপী বিজয়লাভ করাটা হচ্ছে দশ হাজার লি (৫০০০ কিলোমিটার) দীর্ঘযাত্রার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। এই পদক্ষেপ গৌরবের হলেও তা খুবই তুচ্ছ, আরো গৌরবজনক ব্যাপার ভবিষ্যতে হবে। কয়েক দশক পরে চীনা জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হবে এটা যেন এক সুদীর্ঘ নাটকের একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা। নাটক অবশ্যই ভূমিকা থেকে শুরু হয়, কিন্তু ভূমিকাটাই চরম পরিণতি নয়। চীনা বিপ্লব মহান, কিন্তু বিপ্লবের পরের পথ হবে দীর্ঘতর, কাজটা হবে আরো মহান, আরো কঠিন। পার্টিতে একথা এখনই স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে। কমরেডদের শিক্ষা দিতে হবে যাতে তাঁদের কাজে বিনয়ী ও বিচক্ষন হবার রীতিতে, অহংকার ও অসহিষ্ণুতা থেকে মুক্ত থাকার রীতিতে অবিচল থাকেন, আর অবিচল থাকেন সহজ সরল জীবনযাত্রা আর কঠোর সংগ্রামের রীতিতে। সমালোচনা ও আত্মসমালোচনা—এই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হাতিয়ার আমাদের রয়েছে। আমরা খারাপ কর্মরীতি পরিত্যাগ করতে পারি এবং ভালটা রাখতে পারি। আমরা যা জানতাম না তা শিখতে পারি। আমরা যে শুধু পুরোনো দুনিয়া ধ্বংস করতেই ভাল তাই নয়, আমরা নতুন দুনিয়া গড়ে তুলতেও ভাল। চীনা জনগণ শুধু যে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে ভিক্ষা না নিয়েও বেঁচে থাকতে পারেন তাই নয়, বরং ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যবাদী দেশের চেয়েও অধিকতর ভাল জীবনযাপন করবেন।।