আসামের নিপীড়িত বাঙালী মুসলমানদের মিঞা কবিতা

পূর্ববাংলার ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২র প্রেরণায় ১৯৬১ সালের ১৯মে আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষার দাবীতে লড়াই করে জীবন দেন ১১ নারী পুরুষ শিশু শ্রমিক। পরে আরো অনেকে শহীদ হন। শোষকরা বরাক উপত্যকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু আসামের অপরাপর অ়ঞ্চলে আজো নিজ ভাষায় কথা বলা, লেখার অধিকার নেই বাঙালীদের। যুগ যুগ ধরে তাদেরসমেত সমগ্র আসামের বাঙালী জাতিকে বাংলাদেশী বলে বিতাড়ণেব জঘন্য প্রচেষটা চালাচ্ছে, গনহত্যা চালাচ্ছে আসামের ফ্যাসিবাদীরা দিল্লীর ধর্মবাদীদের সাথে নিয়ে। ফলে সমগ্র ভারত আজ সাম্প্রদায়িক দাংগাক্রানত আর হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসনের শিকার। আসামের নিপীড়িত বাঙালী মুসলমানরা মিঞা কবিতার মাধ্যমে এক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম গড়ে তুলেছেন। এসব কবিতার কারণে কবিদের .অহম রাজ্যের ফ্যাসিবাদী নির্যাতন সইতে হচ্ছে। এসব কবিতার কয়েকটি আমরা পেয়েছি। এগুলো বাংলার আঞ্চলিক ভাষায় হলেও তারা বাংলা লিপিতে লিখতে পারেননি, নিজেদের জাতিগত পরিচয়ও দিতে পারেননা আসামের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি।

সাতটি মিঞা কবিতার অনুবাদ

লিখে নাও আমি একজন মিঞা

—ড. হাফিজ আহমেদ

[মূল কবিতা ইংরেজিতে লেখা]

লিখো
লিখে নাও
আমি একজন মিঞা
এনআরসিতে সিরিয়াল নং ২০০৫৪৩।
দুই সন্তানের বাবা আমি
সামনের গ্রীষ্মে জন্ম নেবে আরও একজন
তাকেও তুমি ঘৃণা করবে কি
যেভাবে ঘৃণা কর আমায়?

লিখো
আমি একজন মিঞা
সেই জলা জমিকে
আমি সবুজ ক্ষেত বানিয়েছি
তোমাকে খাওয়াতে,
ইটের পর ইট বয়ে এনেছি
তোমার বাড়ি বানাতে,
তোমার গাড়ি চালিয়েছি
তোমার আরামের জন্য,
খাল নালা পরিষ্কার করেছি
তোমার স্বাস্থ্যের জন্য,
তোমার খাটুনি খাটার জন্য
আমি হাজির যেকোনও সময়ে।
তবু যদি মন না ভরে
লিখে নাও
আমি একজন মিঞা।

এই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতন্ত্রের
অধিকারের জন্য অধিকার ছাড়া এক নাগরিক।
আমার মা’কে ডি ভোটার বানিয়ে দিল,
তার মা-বাপ ছিল যদিও ভারতীয়।
ইচ্ছে হলেই প্রাণে মেরে দিতে পার, লাথ মেরে
তাড়িয়ে দিতে পার আমার গ্রাম থেকে,
আমার সবুজ ক্ষেত কেড়ে নিতে পার,
বেলন দিয়ে পিষে দিতে পার আমাকে,
তোমার গুলি
আমার বুক ফুঁড়ে দিতে পারে,
জানি, তোমার কোনও শাস্তি হবে না।

লিখো
আমি একজন মিঞা
ব্রহ্মপুত্রে বেঁচে আছি
তোমার নির্যাতন সইতে সইতে,
আমার শরীর কালো হয়ে গেছে
চোখ আগুনে লাল।
দাঁড়াও!
রাগ ছাড়া ভাঁড়ারে কিছু নেই।
দূর হটো!
নাহলে
ছাই হয়ে যাও।

যদি আর কোনও ভাষা না থাকে দুনিয়ায়

——কাজী নীল

[মূল কবিতা ময়মনসিংহের বাংলায় কিনতু বর্ণ সমভবত অসমিয়া]

যদি আর কোনও ভাষা থাকে না পৃথিবীতে
যদি হারিয়ে যায় সব অক্ষরমালা
যদি ভেসে যায় খাতা কলম, কবিতার উপমা
যদি কোনও সাঙ্কেতিক ভাষায় আর না বলতে পারি
তোমাকে আমার এই নীরব দুঃখ

এই মরে যাওয়া মন যদি
আর না পায় গানের ঠিকানা
যদি না লিখা হয় চিঠি এই আগুন জ্বলা বসন্তে
যদি বোবা হয়ে যাই, যদি আমাদের চোখ
আর না বলে কোনও কথা

যদি নদী থাকে নদীর মতন, ঢেউয়ের কোনও শব্দ নাই
যদি পাখি থাকে গাছের ডালে, ঠোঁটে কোনও বাঁশি নাই
যদি আমরা ছটফট করি সারা রাত
কথাগুলি উড়ে বেড়ায় শিমুল তুলার মতন
আর বুঝতে না পারি বুকফাটা মেঘের বিষাদ

যদি সব ভাষা হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে
যদি থেমে যায় এই কলম
ভালোবাসার কথা কি আমি বলব না, বলো?
আমি কি বলব না এই নীরব দুঃখের কথা
অন্য কোনও আদিম ভাষায়?

সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না

——কাজী নীল

[মূল কবিতা ময়মনসিংহের বাংলায় কিনতু বর্ণ সমভবত অসমিয়া]

যে দেশ আমার বাবাকে বিদেশি বানায়
যে দেশ আমার ভাইকে গুলি করে মারে
যে দেশে আমার বোন মরে গণধর্ষণে
যে দেশে আমার মা বুকে আগুন চেপে রাখে
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।

যে দেশে লুঙ্গি পরার অধিকার নাই
যে দেশে কান্না শুনার মানুষ নাই
যে দেশে সত্য বললে ভূত কিলায়
যে দেশ আমার আজীবন দাসত্ব চায়
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।

যে দেশে টুপি মানেই মৌলবাদী
যে দেশে মিঞা মানে নীচজাতি
যে দেশে ‘চরুয়ারা’ সব বাংলাদেশি
যে দেশ টাটা বিড়লা আম্বানির হাতে বিক্রি হয়ে যায়
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।

যে দেশে আমাদের লাশের পর লাশ কুপিয়ে কেটে
নদীতে ভাসিয়ে দেয়
যে দেশে ৮৩তে মানুষ মেরে শালার বেটারা জল্লাদের
মতো উল্লাস নৃত্য নাচে
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।

যে দেশে আমার ভিটা বাড়ি উচ্ছেদ করা হয়
যে দেশে আমার অস্তিত্বকে বাতিল করা হয়
যে দেশ আমাকে অন্ধকারে রাখার ষড়যন্ত্র চালায়
যে দেশ আমার থালাতে পান্তার বদলে পাথর ঢালতে চায়
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।

যে দেশে আমি গলা ছিঁড়ে চিৎকার করলেও কেউ শুনে না
যে দেশে আমার খুনের জন্য কেউ দায়ী না
যে দেশে আমার ছেলের কফিন নিয়ে রাজনীতি চলে
যে দেশ আমার বোনের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে
যে দেশে আমি জানোয়ারের মতো বেঁচে থাকি
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।

তুমি আর লিখো না জাহাঙ্গীর

——কাজী নীল

[মূল কবিতা ময়মনসিংহের বাংলায় কিনতু বর্ণ সমভবত অসমিয়া]

তুমি আর লিখো না জাহাঙ্গীর
আমার দম বন্ধ হয়ে আসে
আমার বাড়িতে দুইটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে
সাইকেলের শব্দ শুনার জন্য জেগে রয়েছে এখনও
ভাতের থালা নিয়ে আশা নিয়ে বসে রয়েছে
আমার আদরের বাহারুন নেসা

তুমি আর লিখো না জাহাঙ্গীর
আমার আর বাড়ি যাওয়া হবে না
সকাল হলেই আমাকে আবার বেরোতে হবে
গরু দুটোকে মাঠে দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটো ইস্কুলে
যাবে মজিদভিটার চরে।
সাইকেলে করে সব্জি নিয়ে দুপুরের আগেই
পৌঁছতে হবে বাজারে

তুমি আর লিখো না জাহাঙ্গীর
আমার কেমন যেন ভয় ভয় করে
জাহাঙ্গীর তুমি কি লিখবে
লিখে এমন কি বিপ্লব ঘটাবে!

তোমার এক একটা শব্দে যদি
টনক নড়ত মানুষের দুনিয়া কবেই বদলে যেত
কাগজ-কলম ভাসিয়ে দেও পাগলদিয়ার জলে
এই দেশ আর মানুষের নাই সব পিশাচ হয়ে গেছে

তুমি আর লিখো না জাহাঙ্গীর
বাজারে তোমাকে ধরার জন্য পুলিশ ঘুরঘুর করে
জাহাঙ্গীর তুমি লিখলে ওদের তক্ত কেঁপে উঠে
মানুষের বুকে তুষের আগুন থেকে দাবানল জ্বলে
তুমি লিখলে বিপ্লব আসে মজনু মিঞার লাঙলে
তুমি লিখলে স্বপ্ন দেখে মানুষ নতুন করে
এই খেত-খামার-গঞ্জ-গ্রাম
সব শ্মশান হয়ে যাক

তুমি আর লিখো না জাহাঙ্গীর
তুমি যদি লেখো গেদারা পাহাড় ভাঙতে চায়
সোনার বরণ রোদ উঠে পাথর গলিয়ে ঝর্ণা নামায়
তুমি যদি লেখো গুয়াহাটির পূজা নিরালা
প্রেমে পড়ে ধুবড়ির আজিজুল হকের
তুমি জানোয়ারদের জানোয়ার থাকতে দাও
হিন্দু-হিন্দু মুসলিম-মুসলিম থাকতে দাও

তুমি আর লিখো না জাহাঙ্গীর
আমার গলা ধরে আসে আবেগে
তুমি আর লিখো না জাহাঙ্গীর
মানুষের চিৎকারের শব্দ আমি শুনতে পারি না
আমার কান তালি লেগে যায়
হাত-পা থরথর করে কব্জিতে জোর নাই
পেডেলে জোর দিয়ে এগুতে পারি না
তোমার কলমের সামনে আমার মাথা নিচু হয়ে যায়
তুমি আর লিখো না জাহাঙ্গীর।

কবর খুঁদে

——-কাজী নীল

[মূল কবিতা ময়মনসিংহের বাংলায় কিনতু বর্ণ সমভবত অসমিয়া]

কবর খুঁদে আমি আমার
পূর্বজন্মের ফসিল বের করে আনি
দেখি দুইশ বছরের গোলামিতে
বাঁকা হয়ে গেছে আমার মেরুদণ্ড
দেখি আমার বুকের ভিতরে মাটির ভিজা গন্ধ
হাতের মুঠোয় লাঙলের ভগ্নাংশ

কবর খুঁদে আমি
বের করে আনি আমার অন্ধকার অতীত
দেখি সবারই এক একটা ভ্রমণের ইতিহাস আছে
মাথা নিচু করে হেঁটে যায় নিরন্ন মানুষের মিছিল
সবারই এক একটা কাহিনী আছে ভেসে যাওয়ার

কবর খুঁদলে আমি একটা রক্তাক্ত নদী পাই
দেখি অথৈ জলে ভাসছে আমার গুলিবিদ্ধ লাশ
কবর খুঁদলে
আগুন কি না আমি জানি না
একটা লাল টকটকে উত্তেজনা পাই

কবর খুঁদে আমি নিজেই নিজের লাশ নিয়ে
পৌঁছে যাই গোরস্থানে
ওরা আমাকে শহীদ ঘোষণা করুক আর না ই করুক
এই জমিন বিক্রি হওয়ার আগে এই বাতাস ফুরিয়ে যাওয়ার আগে এইসব নদী বিষাক্ত হওয়ার আগে
একবার, অন্তত একবার আমি তুমুল যুদ্ধে বিধস্ত হতে চাই…

মিঞা

—–শালিম হোসেন

পাবলিক নোটারি দিয়ে ভেরিফাই করে নিয়েছি—
আমি একজন মিঞা।

এখন আমি বানের জল থেকে উঠি, ধ্বসের ওপর ভাসি
বালুচর, পাঁক আর সাপ মাড়িয়ে আসি
মাটির অনিচ্ছায় কুড়াল দিয়ে আঁকছি পরিখা
১০% স্বাক্ষরতা হারের ভেতর দিয়া দেখো কেমনে ঝাঁকরা চুল দুলিয়ে হাঁটছি;
দেখো—কেমন হাবলার মতো তারা আমাকে ‘বাংলাদেশি’ বলে।

আমার ধুকপুক কলজেকে বলে দিও—
আমি একজন মিঞা;

হাতে ধরে আছি সংবিধান, দিল্লির দিকে তুলেছি আঙুল
পার্লামেন্ট, সুপ্রিমকোর্টের দিকে হাঁটছি
এমপিদের, মান্যগণ্য বিচারকদের বলে দিও—
আমি একজন মিঞা। আমি গর্বিত।

হাত

——কাজী নীল

[মূল কবিতা ময়মনসিংহের বাংলায় কিনতু বর্ণ সমভবত অসমিয়া]

চলন্ত মেশিনে ঢুকে
একটা হাত কাটা গেছিল আকবর আলির
তারপর তাকে ছাঁটাই করা হয়েছিল
কারখানা থেকে
একটা কানা পয়সাও সাহায্য করেনি কোম্পানি
উল্টে একমাসের বেতন কাটা গেছিল
দশদিন কাজের পরে হাতটা হারিয়েছিল আকবর আলি

আকবর আলি ফিরে এসেছিল কাটা হাত নিয়ে
সমস্ত চরের মানুষ তাকে দেখতে এসেছিল
বলেছিল – চিন্তা করিস না আকবর। আমরা আছি। ওপরে আল্লা আছে।
ভরসা পেয়েছিল আকবর আলি। ভেবেছিল কোম্পানি না থাক। মানুষ আছে।

তারপর না ছিল মানুষ। না আল্লা।
ছিল একটা হাটের দিন। ছিল ভিক্ষার থলি। গলা ভাঙ্গা গান।
একদিন আকবর আলিও আর ছিল না। পোকা ধরেছিল তার শরীরে।
এরকমই এক হাটের দিনে রাস্তার ধারে পড়ে ছিল সে।

আর তারপর মধ্যে মধ্যে জ্যোৎস্না রাতে
চাঁদ যখন উঠে আসত কারখানার চিমনির মাথায়
তাকে খপ করে হাতের মুঠোতে নেওয়ার জন্য
বের হয়ে আসত একটা বাঁশঝোপের ভিতর থেকে
আকবর আলির কাটা যাওয়া হাত….

কারা যেন

——কাজী নীল

[মূল কবিতা ময়মনসিংহের বাংলায় কিনতু বর্ণ সমভবত অসমিয়া]

কারা যেন খসখস করে ঘরের পাশে
কারা যেন হেঁটে যায় রাতদুপুরে। মাঘ মাস। ধানের খেতে খড়ের পাহাড় পার হয়ে কারা যেন হেঁটে যায়
আমার হাত-পা কাঁপে—

কারা যেন টোকা দেয় বাঁশের বেড়া’তে। ফিসফিসিয়ে ডাকে – ওই রহিম কই! দরজা খোল।
আমি। আমি অম্লান!
ওরা নতুন দিনের কথা বলে। এই চরম আকালের দিনে স্বপ্ন দেখায়। বলে একণাত্র বন্দুকই দিতে পারে দু-মুঠো অন্নের ঠিকানা –

নতুন পতাকার জোয়ার আসে। মানুষের মুখে মুখে স্বাধীনতার স্লোগান –
জঙ্গলের ভেতরে কারা জানি মশাল জ্বালায়
গ্রামে গ্রামে বুটজুতার শব্দ সারা রাত
কার বোনের চিৎকার শোনা যায় – মা ঐ —
কার ভাইয়ের লাশ পাওয়া যায় –
রক্তে ভেসে যায় নব্বইয়ের অসম —

শুকনো বাতাসের শুমশুম শব্দে আমার ঘুম আসে না
কারা যেন হেঁটে যায় — কারা যেন টোকা মারে
বাঁশের বেড়ায় —

মিঞা কবিতা — কবিতার মশাল

//https://fateh24.com/মিঞা-কবিতা-আসামে-প্রতিরোধ///

।।