মধ্য ২০১৭-ফেব্রুয়ারি ২০১৮ দেশের পরিস্থিতিঃ প্রতিক্রিয়াশীলদের সংকট আর জনগণের সংকট

লেখকঃ হাসন লাল

দেশের পরিস্থিতি বলতে শ্রমিক কৃষক মধ্যশ্রেণীভুক্ত জনসাধারণ এর পরিস্থিতি বোঝায়। আর এর বিপরীতে দেশে ক্রিয়াশীল দেশী বিদেশী শোষকদের পরিস্থিতি রয়েছে। আলীগ প্রতিক্রিয়াশীলরা দাবী করে দেশ অনেক উন্নত হয়েছেঃ আয় উন্নতি হতে হতে দেশ এখন মধ্যবিত্তে রূপান্তরিত হচ্ছে। হ্যা, আয় উন্নতি হচ্ছে, তবে জনগণের নয়, শোষকদের। বিরাট জনসংখ্যার হাড় ভাঙা পরিশ্রমে অনেক নির্মাণ হচ্ছে, রাস্তাঘাট দালানকোঠা গড়ে উঠছে, কিন্তু তা শোষকদের জন্য। চালের দাম ৬০/৭০ টাকা, নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য সামগ্রীর আকাশ ছোঁয়া দাম একটুও কমেনি। আন্তর্জাতিক এক হিসেবে দেখানো হয়েছে ঢাকার জীবনযাত্রার ব্যয় কানাডার টরেন্টোর চেয়ে বেশি, কিন্তু আয় তার থেকে একশত ভাগের এক ভাগও নয়। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলতে জনসাধারণের কোন শক্তির বিকাশপ্রাপ্তি ঘটেনি। প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে বৈরিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির দায়ে জেলে ঢোকানো হয়েছে। এর আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে অপসারণ করা হয়েছে তার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে সরকারের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়ার কারণে। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার বিচারপতি নিয়োগ সংসদের হাতে ন্যাস্ত করেছিল। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধিত চৈনিক ও কিছুটা রুশ অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ভারতকে চিন্তিত করে তুলেছিল। অবশেষে ২০১৭ সালের মধ্যেই ভারত বাংলাদেশে সরকারকে বড় বিনিয়োগ চুক্তিতে নিয়ে এসেছে। যদিও সেটা বাস্তবয়ায়ন সক্ষমতার অভাব ভারতের রয়েছে। ভারত সম্প্রসারণবাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে আলীগ সরকার এককভাবে ভুয়া নির্বাচনসহ ক্ষমতা অনুশীলন করছে। বিএনপিকে কিছু সিট ভিক্ষে নিতেও ভারতের অনুমোদন লাগবে। আলীগ মুসলিম হওয়ার কারণে ভারতের সাথে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বও আছে।

হাওড়ে অকাল বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়

হাওড়ে অকাল বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়

২০১৭ সালের প্রথমদিকে বৃহত্তর সিলেটের হাওড় অঞ্চলের বাঁধ ধ্বসে বিরাট অঞ্চল অকাল বন্যা দ্বারা আক্রান্ত হয়, পরে জুলাই থেকে দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, শেরপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ,

২০১৭ সালের বন্যায় উত্তর ও পূর্বাঞ্চলসহ গোটা দেশের এক তৃতীয়াংশ ডুবে যায়

২০১৭ সালের বন্যায় উত্তর ও পূর্বাঞ্চলসহ গোটা দেশের এক তৃতীয়াংশ ডুবে যায়

টাঙ্গাইলসহ বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যায় তলিয়ে যায়। ধ্বংস হয় ঘরবাড়ী, স্কুল কলেজ, গবাদী পশু, সমুদয় ফসল। উপরোক্ত কারণগুলো চালসহ সবজি ও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে ভুমিকা রেখেছে। ভারত নেপাল বাংলাদেশে এই বন্যা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্ত্রন এর কারণ। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিমালয়ে অত্যধিক বরফ গলে অধিক পানি প্রবাহিত হয়েছে আর গাছ কাটাসহ বনধ্বংস ইত্যকার পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে দেশে নদীগুলোর নাব্যতা কমে গেছে ও যাচ্ছে। ফলে সহজেই বন্যা ঘটে।

জনৈক টিটু রায়ের নামে ভ্রান্ত এক ফেসবুক পোস্টের অছিলায় ধর্মবাদীরা রংপুরের গ্রামাঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ীতে হামলা চালায়

জনৈক টিটু রায়ের নামে ভ্রান্ত এক ফেসবুক পোস্টের অছিলায় ধর্মবাদীরা রংপুরের গ্রামাঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ীতে হামলা চালায়

২০১৭ এর নভেম্বরে রুংপুরের গ্রামাঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ীতে হামলা চালায় ধর্মবাদী গোষ্ঠীর লোকেরা এক ভুয়া ফেসবুক পোস্টের অছিলায়। বহু ঘরবাড়ী এরা ধ্বংস করে, মানুষকে নির্যাতন করে। এসময় পুলিশের গুলিতে একজন নিহত আর কিছু গুলিবিদ্ধ হয়।

২০১৭ এর শেষার্ধে হাজার হাজার লোক চিকুনগুনিয়া ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়। সরকারীভাবে একে প্রতিরোধের জন্য এডিশ মশা ধ্বংসের সেরকম কোন উদ্যোগ নেয়া হয়ন্নি। গ্রামাঞ্চল চিকিৎসকশুন্য। শহরে চিকিৎসা ব্যবসায় ডাক্তাররা

২০১৭ সালে এডিস মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া ভাইরাস জ্বর মহামারী আকার ধারণ করে

২০১৭ সালে এডিস মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া ভাইরাস জ্বর মহামারী আকার ধারণ করে

বিরাট অংকের টাকা নেয়। তাই ডাক্তারের কাছে যাওয়া একপ্রকার অসম্ভব।

এদিকে ২০১৭-২০১৮ সালে প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। পাঠ্যপুস্তকে ভিন্ন ধর্মীয় বড় বড় লেখকের লেখা আর কিছুটা প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেয়া হয়।

পাঠ্যপুস্তক বিকৃত, ভ্রান্ত, ধর্মবাদীকৃত

পাঠ্যপুস্তক বিকৃত, ভ্রান্ত, ধর্মবাদীকৃত

পাঠ ইসলামীকৃত মুসলিম ধর্মবাদী বানানো হয়। অশিক্ষা আর কুশিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে এরা ব্যাপক বানান ভুল করে। মলাটে হাসিনার ছবি যুক্ত কুরে। এরা কুসুম কুমারী দাশের লেখা কবিতা বিকৃত করে ছাঁপায়। সৃজনশীলের নামে তারা যে পরীক্ষা প্রশ্ন পদ্ধতি দিয়েছে তা তারা নিজেরাই জানেনা কী। অতপর প্রশ্ন ফাঁস হতে হতে এমন কোন পরীক্ষা নেই যার প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। এইসব তথাকথিত শিক্ষাবিদরা মধ্যশ্রেণির তোপের মুখে এখন। শিক্ষা নামক ব্যবসা দরিদ্র শ্রেণীর জন্য শুধু নয়, মধ্যশ্রেণীর জন্য বিরাট বোঝা। স্কুল কলেজের ভর্তি ফি, বেতন, পরীক্ষা ফি, কোচিং বেতন, প্রাইভেট বেতনসহ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় জনসাধারণকে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় টিকে থাকতে।

অত্যধিক ভ্যাট চাপানোর অর্থমন্ত্রীর কুপ্রচেষ্টা আর এক বছরে দুইদফা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সরকারী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার ঘরবাড়ীর পৌর কর পাঁচ থেকে দশগুণ বৃদ্ধি করে যা শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত হয়েছে, কিন্তু ইতিমধ্যেই সরকারী কর্মকর্তারা লক্ষকোটি টাকা শহরের মধ্যশ্রেণীর কাছ থেকে আদায় করেছে।

এইসময়ে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ ব্যাপক আকার ধারণ করে। ঢাকার বনশ্রীতে গৃহকর্মী লাইলী বেগমকে নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদে জনগণ বিদ্রোহে ফেঁটে পড়েন। সামনে আসছে

বনশ্রীতে গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদ জানান জনগণ

বনশ্রীতে গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদ জানান জনগণ

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের উল্লেখযোগ্য কোন সংগঠন গড়ে না উঠলেও নারী নিপীড়ণ বিরোধি গণচেতনা ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে উপরেল্লিখিত ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হয়।

এই সময়ে রোহিঙ্গা শরনার্থী সংকট বিরাটাকার ধারণ করে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতির জাতীয়তাবাদী ও মুসলিম ধর্মবাদী একটি গ্রুপ প্রায় ত্রিশটি থানাসহ সীমান্ত চৌকি ও সেনা অবস্থানে হামলা চালালে মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মবাদী জাতীয়তাবাদী সরকার ব্যাপক জ্বালাও পোড়াও গণহত্যা চালায়। ফলে প্রায় গোটা রোহিঙ্গা

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরসমূহ

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরসমূহ

জাতিই উদ্বাস্তু হয়ে এখন বাংলাদেশে। এখন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছেন। ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রাজি হলেও নিরাপত্তার অভাবে রোহিঙ্গারা যেতে চাননা। সেখানে তাদের ক্যাম্পে রাখা হবে। পরে তাদের ঘরবাড়ি বানিয়ে দেয়া হবে বলা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংগঠন জাতিসংঘের উপস্থিতি চেয়েছে মিয়ানমারে তাদের নিরাপত্তার জন্য। তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে, ঘরবাড়ি দেয়া হবে, নিরাপত্তা দেয়া হবে এমন নিশ্চয়তা না পেলে রোহিঙ্গারা যেতে চাইবেননা এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ সরকার প্রথমে তাদের আশ্রয় দিতে চায়নি। পরে আশ্রয় দিতে রাজি হয় ও বিদেশী সাহায্যে আশ্রয় শিবির বানায়। প্রতিক্রিয়াশীল সরকার বঙ্গোপসাগরের দুর্গম এক চরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেতে চেয়েছে যে চর অধিকাংশ সময় পানির নিচে থাকে। এথেকে সরকারী মনোভাব স্পষ্ট। যাই হোক রোহিঙ্গাদের সংগ্রাম করেই বাঁচতে হবে এখানেই হোক আর মিয়ানমারেই হোক। ধর্মবাদ বা জাতীয়তাবাদ মুক্তি দিতে পারেনা। শোষকদের মতাদর্শ শোষণের লক্ষ্যে কার্যরত হয়। কেবল সাম্যবাদী মতাদর্শই মুক্তিদাত্রি।  একই কথা বাংলাদেশের জনগণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।■