সিরাজ সিকদার রচনাঃ প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বাদশ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার (মধ্য ১৯৭৪)

সিরাজ সিকদার রচনা

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির
দ্বাদশ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার

(মধ্য ১৯৭৪)

sikder

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বাদশ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সভাপতিত্ব করেন।
সভায় অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়। সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সভা সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।

১। হরতাল সংক্রান্তঃ

১৯৭৪ সালের ১৬ই জুন অর্ধদিবস হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত একটি চমৎকার সময়োচিত সিদ্ধান্ত।
পূর্ব বাংলার বহু জেলা, মহকুমা, থানা শহর এমন কি গ্রামাঞ্চলেও হরতাল পালিত হয়েছে।
এ হরতাল আহবানের উদ্দেশ্যসমূহঃ
– পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা, রাজনৈতিক শূণ্যতা পূরণ করা, সশস্ত্র বাহিনীর চাপ গ্রাম থেকে কমিয়ে শহরে ও যোগাযোগ পথে নিয়ে আসা, শত্রুদের হয়রানী করা ইত্যাদি উদ্দেশ্য চমৎকারভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।
পূর্ব বাংলার বিদ্রোহোন্মুখ জনগণকে পরিচালনার ক্ষেত্রে জাসদসহ তথাকথিত বিভিন্ন বিরোধী দলের পুরোপুরি ব্যর্থতার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূণ্যতা পূরণ এবং আমাদের পক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে হরতাল বিরাট ভুমিকা পালন করেছে।
বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লবের জন্য প্রথমে প্রয়োজন জনমত সৃষ্টি করা। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির পক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হওয়ার অর্থ হচ্ছে বিপ্লবের পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
ব্যাপক কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক, জনগণ এমনকি আমাদের সমর্থক গণতান্ত্রিক বিরোধী দলীয়রাও এ অগ্রগতিকে স্বীকার করেন।
হরতাল শত্রুমহলে মারাত্মক ত্রাসের সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরকে হতভম্ব করে দিয়েছে। তারা মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আমাদেরকে ধ্বংস করার জন্য। তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
হরতালের ফলে অর্জিত আমাদের বিরাট সাফল্যে মাথা বিগড়ালে চলবেনা।
এটা আমাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। আমাদেরকে দৃঢ়ভাবে ব্যাপক জনগণকে আমাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করা, সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা এবং বিরাটাকার গণসংগ্রাম গড়ে তোলার এবং শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করার লক্ষ্য সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
হরতালের ফলে সৃষ্ট জোয়ার ধরে রাখা এবং আওয়ামী বিশ্বাসঘাতককের চরমতম অত্যাচার থেকে মুক্তির আকাঙ্খায় বিদ্রোহোন্মুখ জনতাকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দৃঢ়ভাবে কাজ করে যেতে হবে।
হক, তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিনদের মধ্যকার সত্যিকার বিপ্লবী কর্মী, সহানুভূতিশীলদেরও এ হরতালের সফলতা আমাদের দিকে টেনে আনছে। কোথাও কোথাও তারা স্বতঃফূর্তভাবে আমাদের সমর্থন করেছে।
এ হরতালের ফলে ব্যাপক গণসংগ্রাম পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা পার্টি অর্জন করেছে যা ভবিষ্যতে ব্যাপক গণসংগ্রাম পরিচালনায় খুবই সহায়ক হবে।
-হরতালের ফলে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি খুবই সামান্য, পক্ষান্তরে আমাদের লাভ হয়েছে অভূতপূর্ব।
– হরতাল বাস্তবায়নের জন্য প্রচার এবং সশস্ত্র তৎপরতা প্রয়োজন।
প্রচারের ক্ষেত্রে চিকা, পোস্টার, লিফলেট, মিছিল, পিকেটিং ইত্যাদি পন্থা অনুসরণ করা যায়।
পত্র মারফত যানবাহন বন্ধের আহবান জানানো যায়।
– যোগাযোগ, পরিবহন ব্যবস্থা বানচাল করা।
– হরতাল বাস্তবায়নের জন্য সশস্ত্র তৎপরতা চালানো। প্রয়োজন হলে সশস্ত্র তৎপরতা হরতালের দিন চালানো।
– অর্থের সংস্থান করা।
১৯৭৩-এর ১৬ই ডিসম্বর হরতালের তুলনায় ১৬ই জুন ১৯৭৪ সাল-এর হরতাল অনেকগুণ সফল হয়েছে।

হরতালের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে—
পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শ্রমিক অঞ্চলে শক্তিশালী কাজ হলে পূর্ব বাংলার গণসংগ্রাম অভ্যূত্থানে রূপ প্রদান করা যায়।
এ কারণে শ্রমিক এলাকায় কাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের মাঝে কাজের সাথে গ্রামে কৃষকদের মাঝে কাজকে জোরদার করতে হবে। যাতে শ্রমিকদের সাথে কৃষকরাও গণসংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারে।
আমাদের পার্টি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি। কাজেই শ্রমিকদের নেতৃত্ব অর্জন করা এবং শ্রমিকদের অগ্রগামী প্রতিনিধিদের পার্টিতে নিয়ে আসার জন্য শ্রমিকদের মাঝে কাজ খুবই প্রয়োজন।
সর্বহারা পার্টিকে সত্যিকার শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির রূপ দেওয়ার জন্য এ পদক্ষেপ একান্ত অপরিহার্য।
কাজেই পার্টি কর্মীরা শ্রমিকদের মাঝে কাজে বিশেষ গুরুত্ব দিবেন। এটা করতে যেয়ে গ্রামের কৃষকের মাঝে কাজ এবং সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার প্রক্রিয়াকে বিঘ্ন করা চলবে না।

৩। যৌথ অভিযান সংক্রান্তঃ

আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকরা রক্ষী-পুলিশ দ্বারা আমাদের তৎপরতা দমনে ব্যর্থ হয়ে সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছে এবং যৌথ অভিযান পরিচালনা করছে।
এ যৌথ অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের নির্মূল করা, আমাদের বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ ব্যাহত করা।
১৬ই জুনের সফল হরতাল এ যৌথ অভিযানের একটি উপযুক্ত জবাব।
যৌথ অভিযানের দ্বারা শত্রু আমাদেরকে ধ্বংস দূরের কথা দুর্বল করতেও সক্ষম হয়নি। উপরন্তু আমাদের বিকাশ এবং অগ্রগতি দ্রুততর হচ্ছে।
জনগণ উপলব্ধি করেছে যৌথ অভিযান কালোবাজারী, মজুতদারী, রাহাজানী, কালো টাকার মালিক আওয়ামী পাণ্ডাদের গা-ও স্পর্শ করেনি, দেশের চরম আর্থিক সংকটের কোন পরিবর্তন হয়নি।
উপরন্তু সশস্ত্র বাহিনী দুর্নীতিবাজ এবং আওয়ামী লীগারদের রক্ষক হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। আমাদের দাবিয়ে রাখাই বর্তমানে তাদের একমাত্র কাজ হয়েছে। এভাবে সশস্ত্র বাহিনী জনগণের আস্থা হারাচ্ছে।
সেনা বাহিনী আমাদের রাজনৈতিক প্রচারের সম্মুখীন হচ্ছে, ফলে তাদের মধ্যকার দেশপ্রেমিক প্রগিতিশীল অংশ বিপ্লবের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
এদের অনেকেই আজ হোক, কাল হোক বিপ্লবে যোগদান করবে।
উপরন্তু যৌথ বাহিনীর দেশপ্রেমিকরা প্রকৃত সমাজবিরোধী-আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের কিছু করতে না পেরে মারাত্নকভাবে বিক্ষুব্ধ।
ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের নির্দেশ পালনে তারা বাধ্য, এ কারণে তাদের তৎপরতার বিরুদ্ধে সর্তকতা বজায় রাখতে হবে।
সশস্ত্র বাহিনীর যে সকল অফিসার ও সাধারণ সৈনিকেরা আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের যোগসাজশে আমাদের বিরুদ্ধে তৎপরতা এবং অত্যাচার চালাচ্ছে তাদেরকে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দিতে হবে।
আমাদেরকে দমনে যৌথ বাহিনীর ব্যর্থতা ভারতীয় বাহিনীকে ডেকে আনবে যা বিপ্লবকে আরো ত্বরান্বিত করবে।

৪। বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণঃ

আমাদেরকে দৃঢ়তার সাথে বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে, নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গঠন এবং অর্তকিতে চলমান শত্রুকে ঘিরে ফেলে খতম করার যুদ্ধে (এম্বুশ যুদ্ধে) পারদর্শী হতে হবে।
পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বিবৃতি মনোযোগের সাথে পাঠ ও প্রয়োগ করতে হবে।
শহরে, যোগাযোগ পথে শত্রুকে হয়রানীমূলক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে।
আমাদের বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমনের সফলতা ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে, যৌথ অভিযান আমাদের রণনৈতিক আক্রমণ থামাতে সক্ষম নয়।

শত্রুর যৌথ অভিযানের চাপের মুখে আমাদের মধ্যকার অপ্রকাশিত টাউট, ভ্রষ্ট, সুবিধাবাদীদের কেউ কেউ শত্রুর নিকট আত্মসমর্পণ করে, এভাবে সাভার, মতলবে আমাদের কিছু ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
এ সকল স্থানে জাতীয় শত্রুরা এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে এবং আত্মীয়স্বজনদের হুমকি দিয়ে অদৃঢ় কর্মীদের আত্মসমর্পণ করায়।
এ ঘটনা থেকে পার্টি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা অর্জন করেছে।
– গুরুত্বপূর্ণ কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল, শেল্টার খুব ভালভাবে যাচাই হওয়া প্রয়োজন যাতে ভ্রষ্ট, টাউট, সুবিধাবাদী শত্রু চর অনুপ্রবেশ করতে না পারে।
– বারংবার অনুসন্ধান সংগঠনকে টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।
-স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মী-গেরিলাদের বদলী করা। গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থানীয় কর্মী না রাখা। প্রকাশিত শত্রুর চাপ রয়েছে এরূপ অদৃঢ় কর্মীদের তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সংযোগ করতে না দেওয়া । এর ফলে আত্মীয়-স্বজনদের প্রভাব এড়ানো যায় এবং কর্মীদের দুর্গ, উপদল গঠন ইত্যাদি ঠেকানো যায়।
– গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম্য এলাকা উপ-আঞ্চলিক এবং আঞ্চলিক নেতৃত্বের সরাসরি পরিচালনাধীন থাকা উচিৎ।
গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গোটা উপ-অঞ্চল এমনকি অঞ্চলের জন্যও নির্ণায়ক হয়।
খারাপ পরিচালক, ভ্রষ্ট, সুবিধাবাদি, শত্রুচর, গুরুত্বহীন অনভিজ্ঞদের দ্বারা এ ধরনের গ্রাম্য এলাকা পরিচালিত হলে বিরাট বিপর্যয় হতে পারে।
মতলব, সাভারের বিপর্যয় এর প্রমাণ।
উপরন্তু আমাদের সংগঠনের অতীতের অবস্থা এবং বর্তমান অবস্থা মূলগতভাবে পৃথক।
অতীতে আমাদের শহরকেন্দ্রীক কাজ ছিল, শহর থেকে কর্মী বের করে গ্রামে কাজ গড়ে তোলা ছিল প্রধান দিক।
বর্তমানে গ্রামে কাজ বিস্তার লাভ করেছে। অস্ত্র, গেরিলা, কর্মী, অর্থের এবং পরবর্তী বিকাশের দিক দিয়ে গ্রাম প্রাধান্য পাচ্ছে।
এ কারণে পরিচালকদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রামাঞ্চলে আকড়ে ধরতে হবে।

শত্রুর নিকট আত্মসমর্পণ করার অর্থ হচ্ছে শত্রু শ্রেণীভুক্ত হওয়া।
আত্মসমর্পণে প্ররোচিত করাও শত্রুর সাথে সহযোগিতা করার সামিল।
আত্মসমর্পণ করে আমাদের ক্ষতি সাধন করেছে, পার্টির অস্ত্র-সম্পদ শত্রুর নিকট দিয়ে দিয়েছে, কর্মীদের ধরিয়েছে এরূপ ব্যক্তিদের চরম শাস্তি প্রদান করতে হবে। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্রাপ্ত করতে হবে।
আত্মসমর্পণকারী এবং আত্মসমর্পণে প্ররোচনাকারীদেরও প্রাপ্য শাস্তি প্রদান করতে হবে।
কর্মী এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
কারো কারো সম্ভাব্য আত্মসমর্পণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। টাউট, ভ্রষ্ট আধিক্য এলাকায় কাজের ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক হওয়া যাতে টাউট, ভ্রষ্টরা অনুপ্রবেশ করতে না পারে।
বিপ্লব পরিত্যাগ এবং পুরানো শ্রেণীতে ফিরে যাওয়া, শত্রুর সহযোগী হওয়া, দোদুল্যমান ক্ষুদে বুর্জোয়া, টাউট, ভ্রষ্ট, সুবিধাবাদীদের চরিত্র।
কাজেই শ্রেণী সমাজে উপরোক্তদের শত্রুর নিকট আত্মসমর্পণের ঘটনা স্বাভাবিক। এতে ঘাবড়াবার কারণ নেই।
সংশোধনবাদীরাও এক ধরনের আত্মসমর্পণকারী। শত্রুর চাপ এবং বুর্জোয়াদের প্রভাবের নিকট আত্মসমর্পণকারীরাই হচ্ছে সংশোধনবাদী সুবিধাবাদী।
– গ্রামাঞ্চলে টাউট জাতীয় শত্রুদের খতম খুবই প্রয়োজন অন্যথায় তারা কর্মীদের আত্মসমর্পণ করানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়।

জাতীয় শত্রুর মূল্যবান দ্রব্যাদি ব্যতীত সাধারণ দ্রব্যাদি দখল না করা। এতে গেরিলাদের মধ্যে জনগনের মধ্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।

৮। পার্টির সম্পদ সংক্রান্তঃ

পার্টির সম্পদ হচ্ছে পার্টি ও জনগণের সম্পদ। ইহা পার্টি ও জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে।
পার্টির সম্পদ আত্মসাত করা, ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের অনুরূপ স্বজনপ্রীতিমূলক কাজ।
এ ধরনের কাজ কঠোরভাবে পরিহার করতে হবে। এ ধরনের অপরাধকারীদের যথাযথ শাস্তি প্রদান করতে হবে।

শহরে ও গ্রামে সংস্কারমূলক সংগঠন গড়ে তোলা।
এর ফলে কর্মীদের কাজে লাগানো, যাচাই, জনসংযোগ এবং পরিচয়ের সুবিধা অর্জিত হবে।

১০। সশস্ত্র বাহিনীর মাঝে কাজঃ

বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনীর বিরাট অংশই ভারত ও আওয়ামী লীগের প্রতি বিক্ষুব্ধ। উপরন্তু পূর্ববাংলা ও পাক–ভারতের ইতিহাস থেকে দেখা যায় সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।
কাজেই সশস্ত্র বাহিনীর মাঝে কাজ করা উচিৎ, এদেরকে বিদ্রোহ করা বা সৈন্যবাহিনী ত্যাগ করে আমাদের সাথে যোগদান করতে উৎসাহিত করা উচিৎ।
এভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের বাঙালী দিয়ে বাঙালী দমনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দিতে হবে।

১১। পাকিস্তানের স্বীকৃতিঃ

পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং ‘বাংলাদেশ’ সরকারের ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান পূর্ববাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের স্বার্থের উপর একটি আঘাত।
পাকিস্তানের স্বীকৃতি পূর্ববাংলার রাজনৈতিক অবস্থার মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটায়নি।
পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ববাংলাকে তার অংশ হিসেবে দাবি পরিত্যাগ হকদের রাজনৈতিক বক্তব্য—অর্থাৎ, নয়া পাকিস্তান গড়ার বক্তব্যের চরম ভুল প্রমান করেছে।
পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্য ‘বাংলাদেশে’র সাথে ভারতীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটানো, পাকিস্তান ও মার্কিনীদের প্রভাব বৃদ্ধি করা।
তৈলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বৈর করতে সাহস পায়নি বলে ভারত গা জ্বালা সত্বেও পূর্ববাংলাকে মুসলিম দেশসমুহের সম্মেলনে যোগদান করতে দিয়েছে।

১২। ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণঃ

ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেকে একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, নিজস্ব প্রভাবাধীণ এলাকা গড়ে তোলা ও আনবিক ব্লাকমেইলের মাধ্যমে তা সংরক্ষণ করা, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে প্রভুত্ব করা।
এ পদক্ষেপের ফলে ভারত বৃহৎ শক্তি, পশ্চিম ইউরোপ ও জাপান এবং ‘বাংলাদেশ’ সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমুহের অধিকতর বিরোধিতার সম্মুখিন হবে।
উপরন্তু ভারতের চরম সংকটাপন্ন অর্থনীতি আরো সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে যা আভ্যন্তরীণ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে।
এ আনবিক বিস্ফোরণ—‘ভারত বৃহৎ শক্তি হতে ইচ্ছুক এবং উপনিবেশ বজায় রেখে নিজস্ব প্রভাবাধীন এলাকা সৃষ্টি করতে চায়’ আমাদের এ বক্তব্যের সঠিকতা প্রমাণ করে।

১৩

নিয়মিত পার্টির পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
পার্টির মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক, ঐক্য ও শিক্ষা এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে পত্রিকা একান্ত প্রয়োজন।
পত্রিকা প্রকাশের জন্য সকল অঞ্চলকে অর্থনৈতিক সহায়তা করতে আহবান জানানো হচ্ছে।

১৪

৩রা জুন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপিত হয়।

১৫

বর্তমানে আওয়ামী সরকারের ব্যর্থতা এবং চরম আর্থিক সংকট মার্কিনের নেতৃত্বে তার তাবেদারদের সাথে ভারত-সোভিয়েতের তাবেদারদের দ্বন্ধ তীব্রতর করছে।
কাজেই মার্কিনের নেতৃত্বে তার তাবেদাররা ভারত-সোভিয়েত বিরোধি কু-দেতার মাধ্যমে বা চক্রান্তের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভের প্রচেষ্টা চালাতে পারে।
এ অবস্থায় ভারতীয় হস্তক্ষেপ এবং পূর্ববাংলায় ব্যাপক বিশৃংখলা দেখা দিতে পারে।
এমত অবস্থায় কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্বেকার অধিবেশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যাপক সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে। (কেন্দ্রীয় কমিটির ৬ষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার দ্রষ্টব্য।)
কিছু মন্ত্রী-আমলা পরিবর্তন, কালোবাজারী মহাজন দমনের নামে বিপ্লবীদের প্রকাশ্যে খতম, আওয়ামী লীগের সংকটজনক পরিস্থিতির কোন উন্নতি করবে না, উপরন্তু জনগণের উপর সন্ত্রাস বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে।

১৬

পূর্ববাংলা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদীদের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু।
ইহা হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার দুর্বলতম লিংক। কাজেই দক্ষিণ এশিয়ায় বিপ্লবের কেন্দ্র হচ্ছে পূর্ব বাংলা। যেমন প্রথম মহাযুদ্ধের সময় রাশিয়া ছিল ইউরোপের দ্বন্দ্বসমূহের কেন্দ্র এবং সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম লিংক।
কাজেই পূর্ববাংলার বিপ্লবের এ চমৎকার পরিস্থিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে কাজের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে আমাদের বিরাট বিরাট পদক্ষেপে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

১৭

আমাদের নেতৃত্বে মধ্যবর্তী শ্রেণীসমুহকে ব্যাপক সংখ্যায় ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। (দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া, সামন্ত, ধর্মীয় গোষ্ঠী, সরকারি কর্মচারী, গণতান্ত্রিক বিরোধী ইত্যাদি)।

১৮

একাদশ ইশতেহার এবং ১-গ উপব্যুরোর দলিল অনুমোদিত হলো।

১৯

কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কর্তৃক প্রদত্ত সিদ্ধান্তসমূহ, সর্বোচ্চ পরিচালক মন্ডলী কর্তৃক প্রকাশিত সামরিক দলিল গৃহীত হলো।

২০

সদস্য/প্রার্থী সদস্য পদের জন্য তালিকা প্রতি অঞ্চল প্রেরণ করবে।
কেডার ইতিহাস যাচাই করে পাঠাতে হবে (ইতিমধ্যে যাদের পাঠানো হয়নি)।
যাদের কেডার ইতিহাস পাঠানো হয়েছে তাদের সম্পর্কে সর্বশেষ মন্তব্য পাঠাতে হবে।
অঞ্চল পরিচালক এ মন্তব্য দিবেন।

২১

ফ্রন্টের লাইনে কাজ চালিয়ে যাওয়া।
ফ্রন্টের কর্মসূচী, চাঁদার বই এবং সদস্যপদপত্র ছাপানো।
যথাযথ সময়ে ফ্রন্টের অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক করা।

২২

গণসংগ্রাম পরিচালনা, পার্টির কাজ পরিচালনা এবং সর্বোপরি বিপ্লবের জন্য নারীদের মাঝে কাজ একান্ত প্রয়োজন।
ভ্রষ্ট নারীদের পরিহার করা। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীদেরকে এবং তাদের মাঝে যারা কাজ করবে তাদের শিক্ষাদান, প্রেম-বিয়ে সংক্রান্ত পার্টির সিদ্ধান্ত ভালভাবে তাদেরকে অবহিত করা।

২৩

সার্বক্ষণিক করার ক্ষেত্রে অনুশীলনকে প্রাধান্য দেওয়া, দূরারোগ্য ব্যাধিতে গুরুতর অসুস্থ্য এবং কর্মক্ষম নয় ও মানসিক ভাবে অসুস্থ্যদের সার্বক্ষণিক না করা।
এ ছাড়া সার্বক্ষণিক করার ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ নিয়মবিধি প্রয়োগ করা।
সার্বক্ষণিক করার ক্ষেত্রে খুব ভালভাবে যাচাই করা যাতে শত্রুচর, ভ্রষ্ট, টাউটরা অনুপ্রবেশ করতে না পারে।