সিরাজ সিকদার রচনাঃ জনৈক কমরেড প্রসঙ্গে

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক পার্টি সদস্য কমরেড ঝিনুক-উত্থাপিত ভিন্নমতের খণ্ডন রচনা ও প্রকাশ ডিসেম্বর ১৯৭৩

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১২ ডিসেম্বর ২০১৪


পিডিএফ

লাইন সঠিক হলে দুর্বল শক্তি সবল হয়ে উঠতে পারে, সশস্ত্র শক্তি না থাকলে তা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলেও তা অর্জিত হতে পারে। লাইন ভুল হলে বিপ্লব বিঘ্নিত হবে এবং পূর্ব অর্জিত ফলও খোয়া যাবে।

সঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ না থাকটা হচ্ছে আত্মা না থাকার সমান।

সঠিক রাজনৈতিক লাইন সঠিক সামরিক ও সাংগঠনিক লাইনে প্রকাশ পায়।

একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টির যে কোন কার্যকলাপই হলো নীতি পালন করা।

নীতি ও কৌশলই হলো পার্টির প্রাণ।

জনৈক কমরেড বলেন, আমাদের বিজয় হচ্ছে শক্তিশালী ও যথাযথ কৌশলগত লাইনের জন্য। এজন্য আমাদের রাজনৈতিক লাইনকে নির্ভুল বলতে পারিনা।

তার এ বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে মার্কসবাদ পরিপন্থী এবং মার্কসবাদের ক-খ-গ না বুঝার প্রমাণ।

কৌশলগত ও রণনৈতিক লাইন পরস্পর যুক্ত ও নির্ভরশীল। কৌশলগত লাইন হচ্ছে রণনৈতিক লাইন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বা স্তর। রণনৈতিক লাইনের সঠিকতার উপর নির্ভর করছে কৌশলগত লাইনের সঠিকতা। আবার কৌশলগত লাইনের সঠিকতা ও সাফল্যজনক বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করছে রণনৈতিক লাইনের বিজয়।

মূল লাইন ভুল হলে তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বা স্তরগত কার্যক্রম অর্থাৎ কৌশলগত লাইন ভুল হতে বাধ্য। তা কখনো শক্তিশালী ও সঠিক হতে পারে না এবং তা বিজয় আনয়ন করতে পারেনা।

রাজনীতি কি?

রাজনীতি হচ্ছে এক শ্রেণীর অন্য শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। অর্থাৎ শ্রেণী সংগ্রাম। এ কারণে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যকার সকল সংগ্রাম হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রাম।

এ কারণে সামরিক, সাংগঠনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এমনকি মতাদর্শগত সংগ্রামও শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে পড়ে এবং এদিক দিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামের আওতায় পড়ে।

এ কারণেই রাজনীতি–শ্রেণী সংগ্রাম হচ্ছে সকল কাজের প্রাণবিন্দু।

এ কারণেই রাজনৈতিক লাইনের ভুল ও নির্ভুলতার উপর অন্যান্য লাইনের — সামরিক, সাংগঠনিক, মতাদর্শগত ও অন্যান্য লাইনের (রণনৈতিক ও রণকৌশলের)— ভুল ও নির্ভুলতা নির্ভর করে।

উপরন্তু একটি রাজনৈতিক পার্টির প্রাণ অর্থাৎ মৌলিক শ্রেণী সংগ্রামের লাইন অর্থাৎ রাজনৈতিক লাইনের উপর নির্ভর করছে ক্যাডার ও জনগণকে জাগরিত, একত্রিত ও কাজে লাগানো এবং তাদের আত্মবলিদানের ভিত্তি।

রাজনৈতিক লাইনের ভুল থাকলে কখনো পার্টি বিকাশ লাভ ও বিজয় অর্জন করতে পারে না। পার্টির বিকাশ ব্যাহত হয়, বিজয় খোয়া যায়।

পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন সঠিক রাজনৈতিক লাইন নিয়ে জন্মলাভ করে, বিভিন্ন  আকৃতির সংশোধনবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিকাশ লাভ করে এবং শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করে।

উক্ত কমরেড আমাদের অতীতের রাজনৈতিক লাইনের নির্ভুলতার জন্যই পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, কোন কৌশলগত কারণে নয় নিশ্চয়ই।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি তার সঠিক রাজনৈতিক লাইনের জন্যই পাক সামরিক ফ্যাসিস্ট ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালায়। একমাত্র পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিই এ সময়কার মারাত্মক প্রতিকুলতার মাঝে টিকে থাকে।

পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি তার সঠিক রাজনৈতিক লাইনের কারণেই বিকাশ লাভ করে, চক্র ও উপদলবাদের বিরুদ্ধে সাফল্যের সাথে সংগ্রাম করে বিজয় অর্জন করে, বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হয় এবং সাংগঠনিক সুসংবদ্ধতা অর্জন করে এবং মহান বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সঠিক রাজনৈতিক লাইনের কারণেই বর্তমানে সবচাইতে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি হিসেবে ব্যাপক জনগণের, এমনকি শত্রুর নিকটও স্বীকৃতি পেয়েছে। পার্টি পূর্ব বাংলার সকল জেলায় বিকাশ লাভ করছে এবং জাতীয় গণভিত্তিক পার্টি হিসেবে গড়ে উঠছে।

সামরিক ক্ষেত্রে পার্টি অর্জন করেছে ঐতিহাসিক সাফল্য।

পূর্ব বাংলার ইতিহাসে এই প্রথম একটি বামপন্থী সংগঠনের উপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে উঠেছে।

পূর্ব বাংলার ইতিহাসে এই প্রথম বাঙ্গালী ও পাহাড়ী জাতিসত্তাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে উঠেছে।

পার্টির এ সকল ঐতিহাসিক সাফল্যসমূহ অর্জিত হয়েছে পার্টির সঠিক রাজনৈতিক লাইন এবং তা দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য লাইনের জন্য।

এ সঠিকতা বাস্তব অনুশীলনের অগ্নি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে।

পক্ষান্তরে বাস্তব অনুশীলন প্রমাণ করছে বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য লাইন ভুল এবং তারা প্রতিনিয়ত বিভক্ত ও ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে এবং লয় পেয়ে যাচ্ছে।

পার্টির রাজনৈতিক ও অন্যান্য লাইনের সঠিকতা এবং বিজয়ের উপর ব্যাপক কর্মী, গেরিলা ও সহানুভূতিশীল এমনকি জনগণও আস্থাশীল।

উক্ত কমরেড বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সাফল্যের জন্য অভিনন্দনপত্র লেখেন কিন্তু রাজনৈতিক লাইন ভুল বলেন।

সামরিক লাইন নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক লাইন দ্বারা এবং রাজনৈতিক লাইনকে সেবা করে।

আমাদের রাজনৈতিক লাইন সঠিক না হলে আমাদের সামরিক লাইন ঠিক হতে পারতো না।

কাজেই উক্ত কমরেডের অভিনন্দন সঠিক রাজনৈতিক লাইনেরই প্রাপ্য।

‘ভুল রাজনৈতিক লাইন বিজয় অর্জন করতে পারে’ – এ বক্তব্য প্রমাণ করতে যেয়ে উক্ত কমরেড কিউবার উদাহরণ দিয়েছেন।

কিন্ত এই উদাহরণ তার নিজের বক্তব্যকেই খন্ডন করে।

কিউবার রাজনৈতিক লাইন জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লাইন ভুল ছিল না।

তাদের যুদ্ধ পরিচালনার পদ্ধতি হয়েছে বামঝোঁকা বুর্জোয়াদের মত।

বিপ্লব উত্তরকালে দেশীয়-আন্তর্জাতিক শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাদের ভুল রয়েছে। এ ভুল তাদের বিজয়কে ব্যাহত করেছে, বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সম্ভবনাকে জোরদার করেছে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট আন্দোলনের লাইন হিসেবে গ্রহণের জন্য তারা যে সকল তত্ত্ব দেয়—বিপ্লব রপ্তানী করা, বিপ্লব পরিচালনার জন্য বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা, জনগণের উপর নির্ভর না করেই বিপ্লব করা, সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা-ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের ভুল রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী কিউবার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্ব বিপ্লবের একটি মহান সাফল্য। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে কিউবার ভুল হয়েছে।

উক্ত কমরেড বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণে ব্যর্থ হন, কিউবার জাতীয় গণতান্ত্রিক স্তরের মহান বিজয়কে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে এ বিজয়কে [১] বিভ্রান্তির সৃষ্টি কারণ বলে আক্রমণ করেন এবং এ কারণে এ বিজয় না হলে তিনি খুশী হতেন এমন সাম্রাজ্যবাদীদের অনুরূপ যুক্তি তোলেন।

একই যুক্তি ধরে তিনি বলেন আমাদের ভুল লাইনের বিজয় হলে আন্তর্জাতিক সর্বহারা আন্দোলনে বিভ্রান্তি হবে, অতএব, আমাদের বিজয় হওয়া উচিৎ নয়।

এটা পার্টির কোন সদস্য, সহানুভূতিশীল, এমনকি সমর্থক জনগণও কামনা করেন না। এটা কেবল মাত্র শত্রু শ্রেণীভূক্ত প্রতিবিপ্লবীদেরই কামনা। তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি উক্ত কমরেডকে শত্রু শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের অনুরূপ কামনায় প্ররোচিত করেছে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীন ও ভিয়েতনামের পার্থক্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির তথাকথিত ভুল লাইনের বিজয় হলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে এরূপ মতপার্থক্য সৃষ্টি হবে।

বর্তমান কমিউনিস্ট আন্দোলনে কোন কোন ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টি সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে আধুনিক সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রামকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন না। এটা তাদের দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি।

পক্ষান্তরে মহান চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সর্বহারা দৃঢ়তায় অটল থেকে সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশোধনবাদ বিরোধী মহান সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের পার্টি ও বিশ্বের সর্বহারা বিপ্লবীরা এ সংগ্রামকে সমর্থন করে এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের পবিত্রতা রক্ষার জন্য চীনা পার্টির নিকট কৃতজ্ঞ।

বাংলাদেশ প্রশ্নে ভিয়েতনাম ও চীনা পার্টির পার্থক্য হচ্ছে আধুনিক সংশোধনবাদের প্রশ্নে চীনা ও ভিয়েতনাম পার্টির পার্থক্যের পরিণতি।

এ পার্থক্য বাংলাদেশ অভ্যূদয়ের ফলে সৃষ্টি হয়নি, এটা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে আধুনিক সংশোধনবাদকে বিরোধিতা করা হবে কি হবে না এ থেকে সৃষ্টি হয়েছে।

উপরন্তু পূর্ব বাংলার বিপ্লবের মৌলিক লাইন ও কৌশল পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থার সাথে মার্কসবাদের বিশেষ প্রয়োগের ভিত্তিতেই রচিত হবে, বাইরের কোন পার্টির বা দেশ দ্বারা নির্ধারিত হবে না। কাজেই পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে লাইন পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তি আনয়ন করবে তাকেই ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিসমূহ সমর্থন করবে। ইহা তাদের মাঝে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে না।

আমাদের লাইনের বিজয়, বিপ্লবের বিজয় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে, এ কথা বলার অর্থ হচ্ছে সর্বহারা আন্তর্জাতিকবাদকে অস্বীকার করা, ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিসমূহের পূর্ব বাংলার বিপ্লবে হস্তক্ষেপের ভুল তত্ত্বকে স্বীকার করা।

উক্ত কমরেড মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ নিয়মও জানেন না।

উপরন্তু একটি দেশ কতগুলো দেশের স্বীকৃতি পেলেই স্বাধীন… নয়… তার প্রমাণ হচ্ছে মঙ্গোলিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া এবং অন্যান্য পূর্ব ইউরোপের দেশ। এ সকল দেশের সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু মঙ্গোলিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া হচ্ছে সোভিয়েতের উপনিবেশ, অন্যান্যগুলো তার উপর নির্ভরশীল দেশ।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য প্রযোজ্য।

উক্ত কমরেড বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের নয়া উপনিবেশ।

নয়া উপনিবেশের উদ্ভব হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর। এ ধরনের উপনিবেশবাদীরা তাবেদার সরকার, পুঁজি প্রভৃতির মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।

এটা সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের মধ্যকার সম্পর্কের একটি রূপ।

পূর্ববাংলাকে ভারতের নয়া উপনিবেশ বলার অর্থ হচ্ছে ভারতকে সাম্রাজ্যবাদের সমপর্যায় ভূক্ত করা।

এটা বাস্তব অবস্থার সাথে সম্পূর্ণরূপে অসংগতিপূর্ণ। ভারত হচ্ছে একটি আধা উপনিবেশিক আধা–সামন্তবাদী দেশ যার সম্প্রসারণবাদী চরিত্র রয়েছে।

পূর্ব বাংলা ভারতের নয়া উপনিবেশ—এ ভুল লাইন থেকে উদ্ভব হয়েছে অন্যান্য ভুল লাইন ও কৌশল যার পরিণতি বিপর্যয় ও ধ্বংস।

পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির রাজনৈতিক লাইন—পূর্ব বাংলা ভারতের উপনিবেশ, পূর্ব বাংলা ও ভারতের বাস্তব অবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ।

ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলার উপর উপনিবেশিক শোষণ ও নিয়ন্ত্রন গোপন করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

উক্ত কমরেড ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের এ চাতুরীতে বিভ্রান্ত হয়েছেন; এর সাথে যুক্ত হয়েছে তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি। যার পরিণতি হিসেবে পূর্ব বাংলাকে তিনি ভারতের নয়া উপনিবেশ বলেছেন।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সঠিক রাজনৈতিক লাইন ও তা থেকে নির্ধারিত অন্যান্য লাইন ইতিমধ্যেই পার্টির সকল কর্মী, সহানুভুতিশীল, সমর্থক এমনকি ব্যাপক জনগণের দ্বারা গৃহীত হয়েছে। পার্টির সঠিক লাইন ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পন্ন বিজয় আনয়ন করেছে।

একমাত্র উক্ত কমরেডই এর ব্যতিক্রম।

উক্ত কমরেড বলেছেন বর্তমান যুগে উপনিবেশের তত্ত্ব হাস্যস্পদ।

এ যুগে উপনিবেশের তত্ত্ব হাস্যস্পদ অর্থাৎ বর্তমান যুগে উপনিবেশ হতে পারে না। অর্থাৎ কোন জাতি বা দেশকে পদানত করতে পারে এরূপ সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ বা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী পৃথিবীতে নেই।

এ তত্ত্ব বিশ্বের বর্তমান অবস্থার সাথে সম্পূর্ণরূপে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও হাস্যস্পদ কল্পনাবাদীদের তত্ত্ব।

বিশ্বে এখনো সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, পুরোনা উপনিবেশবাদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল শাসক গোষ্ঠী বিদ্যমান, উপনিবেশ ও নির্ভরশীল দেশ বিদ্যমান।

উক্ত কমরেডের এ তত্ত্ব বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের “আধা-উপনিবেশের উপনিবেশ হয় না” তত্ত্বের অনুরূপ বস্তাপঁচা মাল।

বর্তমান যুগে উপনিবেশের তত্ত্ব যদি হাস্যস্পদ হয় তবে সর্বহারা পার্টির সকল লাইন, এর বিজয় এবং এতে আস্থাশীল কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক ও জনগণ হাস্যস্পদ। অর্থাৎ সকলেই হাস্যস্পদ, একমাত্র উক্ত কমরেডই হচ্ছে বিজ্ঞ।

নিজের বিজ্ঞতার প্রমাণ হিসেবে জাহির করেছেন নিম্ন যুক্তি—

শ্রমিক আন্দোলনের সময় কমরেড সিরাজ সিকদারের যে মানদন্ড ছিল তা অনেকেই অর্জন করেছে অর্থাৎ তিনি অর্জন করেছেন।

নিজেকে একমাত্র বিজ্ঞ, ঠিক ও যোগ্য মনে করা এবং অন্য সকল কমরেডকে হাস্যস্পদ মনে করার উৎস কোথায়?

এ মনোভাবের উৎস ক্ষুদে বুর্জোয়াদের গোঁড়ামীবাদের মাঝে নিহিত।

গোঁড়ামীবাদীরা জনগণ থেকে আসা জনগণের নিকট নিয়ে যাওয়ার বস্তুবাদী কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে না। কতগুলো তত্ত্ব ও পুস্তক এবং মার্কসবাদের বুলি মুখস্থ করে, নিজেদেরকে মস্ত পন্ডিত মনে করে, লেজ ফুলিয়ে আকাশে তোলে, কমরেড ও জনগণকে হেয়, অজ্ঞ ও হাস্যস্পদ মনে করে। এভাবে জনগণ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

উক্ত কমরেড জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নিজের মারাত্মক ভুল লাইন আঁকড়ে ধরেন, কমরেড ও জনগণ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, বিভিন্ন লাইন—এমন কি রাজনৈতিক লাইনে মতপার্থক্য পোষণ করেন বলে সামরিক কাজ অন্যকে দিতে বলেন, এভাবে পার্টি থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।

এছাড়াও উক্ত কমরেডের গোঁড়ামীবাদী বিচ্যুতি—অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিরাট বিরাট দলিল লেখা, তা সর্বস্তরে পড়ানো এবং পেশ করতে বলা, (যাতে সকলেই তার পান্ডিত্যে তাক লাগে), সাধারণ প্রশ্ন বুঝতে না চেয়ে গেড়া পাকানো, নিজেকে সঠিক যোগ্য মনে করা, অন্যদের হাস্যস্পদ ও অযোগ্য মনে করার মাঝে প্রকাশ পায়।

উক্ত কমরেড ফজলু চক্রের অনুরূপ কঃ সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বের জনপ্রিয়তাকে পছন্দ করেন না। এতে ঐক্য বিনষ্ট হবে এ অজুহাত দেখিয়ে সঠিক নেতৃত্বকে জনগণ ও সর্বহারা বিপ্লবীদের নিকট গোপন রাখতে চান।

উক্ত কমরেডের সামন্ত শ্রেণী ভিত্তি, গোড়ামীবাদী বিচ্যুতি, অন্যান্য ত্রুটি এবং নিজের ভুল লাইন ও তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি খুবই বিপদজ্জনক।

সমগ্র পার্টিকে অবশ্যই এ থেকে সতর্ক থাকতে হবে। আশা করা হচ্ছে উক্ত কমরেড উপরোক্ত বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভুলসমুহ বিচার করবেন, নিজেকে সংশোধনে ব্রতী হবেন এবং সংশোধন করে জনগণের মুক্তির জন্য শেষ পর্যন্ত কাজ করে যাবেন।

নোটঃ

১। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল না করে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ইতালীর কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান তোগলেয়াত্তি (মৃত)। আধুনিক সংশোধনবাদীরা তোগলেয়াত্তির তত্ত্বমালা দ্বারাই মূলতঃ পরিচালিত