সিরাজ সিকদার রচনাঃ মতাদর্শ ও তার প্রকাশের ক্ষেত্রে শ্রেণী বিশ্লেষণ এবং শ্রেণী সংগ্রাম আঁকড়ে ধরুন

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


 


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক রচিত

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক সম্ভাব্য প্রকাশ ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ৮ আগস্ট ২০১৪


 

পিডিএফ

ঔপনিবেশিক-আধাসামান্তবাদী পূর্ববাংলার জনগণের অধিকাংশই ক্ষুদে বুর্জোয়া অর্থাৎ কৃষক (ক্ষেত মজুর, গরীব চাষী ও মাঝারী চাষী), বুদ্ধিজীবী, ক্ষুদে চাকুরিজীবী, দোকানদার, হস্তশিল্পী প্রভৃতি। এ শ্রেণী পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলনকে শুধু যে ঘিরে আছে তা নয়; এর অধিকাংশ সদস্যই এ শ্রেণী থেকে আগত। অধিকন্তু পূর্ববাংলার বর্তমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় শ্রমিক জনতা এবং শ্রমিক শ্রেণী থেকে আগত পার্টি সদস্যদেরও ক্ষুদে বুর্জোয়া ছাপ রয়েছে। এ কারণে এটা মোটেই আশ্চর্য নয় বরং অবশ্যম্ভাবী যে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ সংগঠনে বিভিন্ন রূপ নিয়ে প্রকাশ পাবে। এছাড়াও পার্টি-বহিস্থ ক্ষুদে বুর্জোয়া, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বড় বুর্জোয়াদের প্রভাব, বিপ্লবী জীবনের কঠোরতা সর্বহারা কর্মীদের চেতনার ক্ষয় আনে এবং তাদের মাঝের বুর্জোয়া দিকের প্রাধান্য ঘটে এবং তারা সুবিধাবাদী হয়ে যায়।

অতএব যতদিন সমাজে শ্রেণী থাকবে ততদিন পার্টি ও কর্মীদের মাঝে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশের সাথে শ্রেণীসংগ্রাম চলবে। অর্থাৎ পার্টি ও কর্মীরা সর্বহারা থাকবেন না বুর্জোয়া হবেন—এ সংগ্রাম যতদিন শ্রেণী থাকবে ততদিন চলবে। কখনো কখনো এই সংগ্রাম তীব্র হয়ে উঠবে এবং প্রকাশ্য শ্রেণী সংগ্রামে রূপ নেবে।

সভাপতি মাও আমাদের শিখিয়েছেন যে সর্বহারার অগ্রগামী কর্মীগণ যদি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের সাথে কিছু কিছু পার্টি সদস্যদের ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শের একটি দৃঢ় ও তীক্ষ্ণ পার্থক্যরেখা না টানেন এবং তাদের বিরুদ্ধে গুরুতররূপে কিন্তু যথাযথভাবে ও ধৈর্য্যের সাথে সংগ্রাম না করেন তবে অসম্ভব হবে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশগুলো দূর করা। আরো গুরুত্বপূর্ণ হল, এ সকল ক্ষুদে বুর্জোয়া সদস্যরা অবশ্যম্ভাবীভাবেই প্রচেষ্টা চালাবে সর্বহারার অগ্রগামী বাহিনীকে নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী পরিবর্তিত করতে (অর্থাৎ ক্ষুদে বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত করতে-লেখক) এবং পার্টি নেতৃত্ব দখল করতে। এভাবে তারা প্রচেষ্টা চালাবে পার্টি ও জনগণের উদ্দেশ্যের ক্ষতিসাধন করতে।

পার্টির বাইরে যতবেশী ক্ষুদে বুর্জোয়া থাকবে এবং পার্টির অভ্যান্তরে যতবেশী ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী উদ্ভূত সদস্য থাকবে তত কঠোরভাবে পার্টি অবশ্যই বজায় রাখবে সর্বহারা অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে তার পবিত্রতা এবং সর্বহারার মতাদর্শ ও তার প্রকাশের সাথে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশের স্পষ্ট ও কঠোর পার্থক্যরেখা টানবে।

আমরা অবশ্যই প্রতিনিয়ত সভাপতি মাও–এর এই নির্দেশ পালন করবো।

পূর্ববাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে ঐতিহাসিকভাবে উপলব্ধি করেছে যে পূর্ববাংলায় একটি বিপ্লবী সর্বহারার পার্টি প্রতিষ্ঠা ও তা টিকিয়ে রাখা নির্ভর করছে, কতখানি তারা সক্ষম হন পার্টি–অভ্যান্তরে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশকে পার্টি অভ্যন্তরে ও বাইরে বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদকে (আধুনিক সংশোধনবাদ, নয়াসংশোধনবাদ, ট্রটস্কি–চেবাদ ইত্যাদি) সংগ্রাম করে দূর করতে।

মতাদর্শগত, চিন্তা, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে  ক্ষুদে বুর্জোয়া ও সর্বহারার প্রকাশসমূহঃ

ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর লাইন

 

সর্বহারা শ্রেণীর লাইন

 

(১) মতাদর্শগত ক্ষেত্রে
ব্যক্তি স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।

 

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুং চিন্তাধারা, জনগণের স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।

 

(২) চিন্তার ক্ষেত্রে
আত্নগতভাব (দার্শনিকভাবে আত্নগতভাব হচ্ছে ভাববাদ, অধিবিদ্যা ও যান্ত্রিক বস্তুবাদ)। এটা প্রকাশ পায় (ক) একতরফাবাদ (খ) ভাসাভাসাভাব (গ) দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ (ঘ) বামপন্থী হঠকারিতা (ঙ) গোড়ামীবাদ (চ) সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ (ছ) লেখার ক্ষেত্রে একঘেয়ে লেখা।

 

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ
৩) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
ডানে-বামে দোদুল্যমানতা, চরমে যাওয়ার মনোবৃত্তি, অধৈর্য প্রভৃতি। ডান ও বামকে সংগ্রাম করে চলা, আত্মগতের সাথে বস্তুগতের সামঞ্জস্য বিধান করা, বাস্তবনিষ্ঠ ও দূরদর্শী হওয়া।
(৪) সাংগঠনিক ক্ষেত্রে

 

উদারতাবাদ, উগ্রগণতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র, ব্যক্তিতাবাদ, আমলাতন্ত্র, দমননীতি, আধানৈরাজ্যবাদ, স্বাতন্ত্র্যবাদী করা, গিল্ড মনোভাব, শক্তিশালী দুর্গের মনোভাব, উপদলীয় সংঘাত, বিভেদপন্থীবাদ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা

নোট

আত্মগতভাবঃ

বস্তুকে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে মনের ইচ্ছা-আকাঙ্খা-কল্পনাকে বস্তু হিসেবে নেয়া। চিন্তা, ধ্যান, ধারণা বস্তুর যথাযথ প্রতিফলন না হয়ে বস্তুর সংশ্রবহীন হওয়া।

একতরফাবাদ

বিপরীতের একত্বের নিয়ম হচ্ছে বিশ্বের মৌলিক নিয়ম, অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুর মধ্যকার দ্বন্দ্বের দুটো দিক রয়েছে। যেমন কমরেডদের মধ্যে সর্বহারা দিক ও বুর্জোয়া দিক, ভাল ও মন্দ দিক। শক্তিশালী ও দুর্বল দিক রয়েছে, কিন্তু একতরফাবাদীরা শুধু একটি দিকই দেখেন অন্য দিকটি দেখেন না।

ভাসাভাসাভাব

বিশ্বের প্রতিটি বস্তু আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসমুহের সংঘাতের জন্য গতিশীল। একটি বস্তুকে জানা তার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসমুহ এবং অন্যান্য বস্তুর সাথে এর সম্পর্ককে জানা বুঝায়। কিন্তু ভাসাভাসাভাব হলো এভাবে না জেনে বস্তুর বাইরেরটা, পরিলেখ, অবয়ব দেখে সন্তুষ্ট থাকা, কিন্তু বস্তুকে পুরোপুরি না জানা।

দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ

প্রতিটি বস্তুই আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসমুহের সংঘাতের জন্যই গতিশীল। বস্তুকে পরিবর্তনের জন্য যারা নিয়োজিত তাদের অনেকের চিন্তাধারা বস্তুর বিকাশের গতির পশ্চাতে রয়ে যায়। এদের চিন্তাধারা সামাজিক অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা সমাজের রথচক্রকে নেতৃত্ব দিয়ে সম্মুখে নিয়ে যেতে পারে না, বরঞ্চ এর লেজুড়বৃত্তি করে, এটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করে, চেষ্টা করে একে পিছে টেনে আনতে বা বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিতে। উদাহরণস্বরূপ, কোন এলাকায় কৃষকরা রাজনৈতিক কাজের ফলে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য এগিয়ে যেতে চায় কিন্তু ভারপ্রাপ্ত কমরেডগণ সময় হয়নি, অন্যান্য স্থানে সংগঠন হয়নি প্রভৃতি বলে কৃষকদের উদ্যম থামিয়ে দেন। এটা দক্ষিণপন্থী মনোভাবের প্রকাশ।

বামপন্থী হঠকারিতাবাদ

বামপন্থী হঠকারিতাবাদীর চিন্তাধারা বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ার স্তরকে অতিক্রম করে যায়। তারা তাদের আকাশ-কুসুম কল্পনাকে বাস্তব বলে ভাবে। এদের মধ্যে অনেকে ভবিষ্যতে যা হবে তা এখনই ব্যস্তবায়িত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। তারা সমাজের অধিকাংশ লোকের অনুশীলন থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং তাদের কাজে হঠকারিতার পরিচয় দেয়।

[প্রক্রিয়া বলতে বুঝায়— আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বাইরের শর্ত যার জন্য বস্তু বিকাশ লাভ করে। এই বিকাশের কালে কোন কোন নতুন দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়, আবার কোন কোন পুরানো দ্বন্দ্ব মীমাংসা হয় এবং অনেক সময় বাইরের শর্তেরও পরিবর্তন হয়। এভাবে বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়া স্তরে বিভক্ত হয়।]

ডানপন্থী সুবিধাবাদ ও বামপন্থী হঠকারীতাবাদ হয় আত্মগতের সাথে বস্তুজগতের সামঞ্জস্য বিধান না হওয়ার ফলে।

গোড়ামীবাদ

গোড়ামীবাদীরা বই এর জ্ঞান অর্থাৎ, ধারণাত্মক জ্ঞান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে কিন্তু বাস্তব অনুশীলনে এই জ্ঞান যাচাই করে নেয় না, এভাবে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান অর্জন করে না।

সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ

বাস্তব অনুশীলনের প্রাক্কালে যে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান হয় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা এবং তার উপর নির্ভর করা, ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা দ্বারা সারসংকলন করে বস্তুর নিয়মবিধি বের করা, এভাবে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে তত্ত্ব, প্লান, পরিকল্পনার পর্যায়ে উন্নীত না করা।

গিল্ড মনোবৃত্তি

নতুন ও কর্মক্ষম কর্মীদের ওপর দায়িত্বপূর্ণ কাজ না দিয়ে নেতৃত্ব সর্বদা কয়েকজনের হাতে কুক্ষিগত রাখা। অতীতে গিল্ড মাষ্টাররা (ছোট হস্তশিল্প কারখানার মালিক) কখনো গিল্ড শিক্ষানবিশদের গিল্ড মাস্টার হতে দিত না।

শক্তিশালী দুর্গের মনোভাব

কোন বিভাগ বা সাংগঠনিক স্তর “নিম্ন স্তর উচ্চস্তরের অধীন, অংশ সমগ্রের অধীন, ব্যক্তি সংগঠনের অধীন, সমগ্র সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন” এই কথাকে বাতিল করে দিয়ে শুধু নিজ ইউনিট, স্তর, বিভাগের কথা চিন্তা করে, নিজের তাবেদারদের দিয়ে একটি দুর্গ গঠন করে। এটা উপদলীয় কার্যকলাপের আওতায় পড়ে। এটা বুর্জোয়া ব্যক্তি স্বার্থ থেকে উদ্ভূত।

আধানৈরাজ্যবাদ

পার্টি শৃংখলাকে অমান্য করা বা উপেক্ষা করার দৃষ্টিকোণ। “মানিনাকো কোন আইন, কোন নিয়ম-কানুন শৃংখলা” এই মনোবৃত্তি।

(উদারতাবাদ, উগ্রগণতন্ত্র, ব্যক্তিতাবাদ প্রভৃতি “পাচটি প্রবন্ধ”র শেষের দু’টি প্রবন্ধে রয়েছে। উপদলবাদ, বিভেদপন্থীবাদ মতাদর্শগত দলিলে দ্রষ্টব্য।)