অনুবাদ সাহিত্য পত্র, সংখ্যা নং ৩। । নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)র দুটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলঃ ১। মাওবাদ সম্পর্কে – কমরেড প্রচণ্ড ২। প্রচণ্ড পথের দার্শনিক ধারণা – কমরেড কিরণ

অনুবাদ সাহিত্য পত্র

 

 

অনুবাদ সাহিত্য পত্র, সংখ্যা নং

নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) দুটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলঃ

১। মাওবাদ সম্পর্কে কমরেড প্রচণ্ড

২। প্রচণ্ড পথের দার্শনিক ধারণাকমরেড কিরণ

         

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির মাওবাদী ঐক্য গ্রুএর অনুবাদ সাহিত্য বিভাগ কর্তৃক ২৩ এপিল, ২০০৪ প্রকাশিত

 

 

সম্পাদকীয়

অনুবাদ সাহিত্য পত্রের ৩য় সংখ্যা যথারীতি প্রকাশিত হল পিসিপির দলিলে কেন্দ্রীভূত গত দূটো সংখ্যা ও নেপালের কমিউনিস্ট পাটির্ (মাওবাদী) [সংক্ষেপে সিপিএন(এম)] এর দলিলে কেন্দ্রীভূত বর্তমান সংখ্যাটি আমাদের ঘণীভূত শ্রমের ফসল। এ প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই মাওবাদী শিবিরে আশাবাদ সৃষ্টি করেছে কোন না কোন ভাবে। শীঘ্রই এ তিনটি সংখ্যা ছাপানো আকারে পুনমুদ্রিত হবে এবং পরবের্তী সংখ্যাগুলো ছাপানো আকারে প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তবে অনিবার্য সীমাবদ্ধতার কারনে পরবর্তী সংখ্যা থেকে পত্রিকাটি দ্বিমাসিকভাবে প্রকাশিত হবে। বর্তমান সংখ্যায় প্রকাশিত হলঃ ১) মাওবাদ সম্পর্কে – কমরেড প্রচণ্ড ২) প্রচণ্ড পথের দার্শনিক ধারণা – কমরেড কিরন – এই দুই দলিল। প্রথম দলিলটি সিপিএন (এম) চেয়ারম্যান প্রচণ্ড  ডিসেম্বর ১৯৯১ তে লিখেন, দ্বিতীয়টি সিপিএন(এম) পলিট ব্যুরোর স্ট্যণ্ডিং কমিটির সদস্য ও পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার প্রধান কমরেড কিরন লেখেন ডিসেম্বর ২০০৩ এ। এ দলিল দুটো আমরা অনুবাদ করেছি নেপালের জনদিশা প্রকাশনী কর্তৃক জানুয়ারী ২০০৪ এ ইংরেজীতে প্রকাশিতঃ প্রবেম্স এন্ড প্রস্পেক্ট্স অব রেভ্যুল্যুশন ইন নেপাল শীর্ষক দলিল থেকে।

সিপিএন(এম) বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের আরেক অগ্রবাহিনী। পেরুর গণযুদ্ধ যখন বাঁক অতিক্রম করছিল,আর আমাদের পার্টি দুই লাইনের সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় বিভক্ত হয়ে পড়ছিল তখন ’৯৬ সালে গণযুদ্ধ সূচনার মাধ্যমে বিপ্লবের যে নয়া অগিশিখা প্রজ্বলিত করেন নেপালের মাওবাদীরা সে এক নয়া জোয়ার উত্থিত করার প্রতীক, আর তা হচ্ছে বিপ্লবী আন্তর্জাতিক আন্দোলন(রিম)-এর নেতৃত্বে বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের নতুন ঘাঁটি। তাই, নেপালে মাওবাদের প্রতিষ্ঠা ও প্রচণ্ড পথের বিকাশ অধ্যয়ন আমাদের জন্য বিরাট গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত আমাদের দেশে যখন সভাপতি সিরাজ সিকদারের অবদানকে মূল্যায়ন করার মাধ্যমে নয়া সংশ্লেষণ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা দানা বেঁধে উঠছে। কেউ কেউ সিরাজ সিকদারের মৌলিক মাওবাদী পথ, কেউ কেউ সিরাজ সিকদার পথ, কেউ কেউ সিরাজ সিকদার চিন্তাধারা বলছেন; অন্যদিকে কেউ কেউ এস এস লাইনের প্রায় সবটাই বর্জন করেও এস এসকে পার্টি প্রতিষ্ঠাতা মানছেন। সুতরাং, এই প্রেক্ষাপটে আমাদের জানা দরকার চিন্তাধারা, মতবাদ, পথ ইত্যাদি সুত্রায়ণকে বিশ্ব সর্বহারার অগ্রযোদ্ধোরা কী অর্থে ব্যবহার করছেন, যাতে পূর্ব বাংলার বিপ্লবে মালেমার প্রয়োগের ফলকে আমরা যথাযথভাবে মূল্যায়ণ করতে পারি এবং সেই ভিত্তিতে নয়া সংশ্লেষণে অগ্রসর হতে পারি।

মাওবাদের তrকালীন বিকাশ মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে এদেশে প্রতিষ্ঠায় ও তাকে প্রয়োগের মাধ্যমে প্রধানত সঠিক এক গুচ্ছ লাইন গড়ে তোলার মাধ্যমে এস এস যে (মৌলিক) মাওবাদী পথ রচনা করেন তাকে এগিয়ে নেয়া ছাড়া পূর্ব বাংলায় বিপ্লব করা যায়না। বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী লাইনের বিরুদ্ধে কঠিন লাইনগত সংগ্রাম চালিয়ে এস এস চিন্তা ও কর্মের এক নিদর্শন স্থাপন করেছেন। ’৭১-এ ও ’৭২-৭৫ এর মহান সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় পার্টি ৮০র দশকেও সংগ্রাম জাগড়িত করতে করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীতে এস এস-এর বিপ্লবী পথকে নেতিকরণের যে প্রবনতা উত্থিত হয় তা পার্টিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয় আর পার্টি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে। প্রচন্ড পথ অধ্যয়ন করে আমরা এই শিক্ষাই পাই যে এস এস-এর বিপ্লবী মাওবাদী পথকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে, রক্ষা করতে হবে ও প্রয়োগ করতে হবে; মাওবাদকে তার বিকাশের সর্বোচ্চ শিখড়ে আত্মস্থ হবে এবং একটি সঠিক মতাদর্শিক রাজনৈতিক লাইন গড়ে তুলতে হবে, আর সেই ভিত্তিতে পিবিএসপি তথা গোটা মাওবাদী আন্দোলনকে পুনর্গঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

২৩শে এপ্রিল, ২০০৪

 

 

মাওবাদ সম্পর্কে

–         কমরেড প্রচণ্ড

 

শ্রেণীসংগ্রামের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও বিকাশের প্রক্রিয়ার মার্কসবাদ আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবের বিজ্ঞান হিসেবে পরিশ্রুত হয়েছে। সবার কাছে এটা ভালভাবেই জানা ও অবিরাম সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে ওঠা মহr এক প্রতিভার যা প্রদর্শন, কার্ল মার্কস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সেই মার্কসবাদী বিজ্ঞানের রয়েছে তিনটি অঙ্গঃ দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। একটি বিজ্ঞান হিসেবে মার্কসবাদের অব্যাহত বিকাশ হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। শ্রেণীসংগ্রামের নয়া অভিজ্ঞতা ও প্রশ্নের আলোকে লেনিন মার্কসবাদকে তার সামগ্রিকতায় বিকাশের দ্বিতীয়, নতুন স্তর-এ উন্নীত করেন অর্থাr লেনিনবাদে। আজকে এই বিজ্ঞান সংগ্রামের সেই প্রক্রিয়ায় বিকাশের তৃতীয়, নতুন ও উচ্চতর স্তরে প্রবেশ করেছে। এই তৃতীয়, নতুন ও উচ্চতর স্তরও হচ্ছে মাওসেতুঙ কর্তৃক গড়ে তোলা মাওবাদের স্তর। prchndএভাবে, আন্তজাতিক সর্বহারা শ্রেণীর হাতে আজকে রয়েছে এক সার্বজনীন তত্ত্ব আর সামগ্রিক একক সত্ত্বা হিসেবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ। আজকের দিনের বিশ্বের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হিসেবে মাওবাদকে আত্মস্থ না করে কেউই একজন সত্যিকার কমিউনিষ্ট হতে পারেননা। বর্তমান দিনের পৃথিবীর মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হওয়ার কারণেই বিশ্বব্যাপী-প্রতিক্রিয়াশীল ও সংশোধনবাদীরা মাওবাদ ও মাওবাদীদেরকে মারাত্মকভাবে আক্রমন করে চলেছে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ যেমন সকল প্রকার প্রতিক্রিয়া, সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, একইভাবে মাওবাদ ও কঠিন সংগ্রামের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে।

আমাদের আন্দোলনে, মাওয়ের অবদানকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হিসেবে আত্মস্থ করার  চেতনা (স্পিরিট) সত্ত্বেও এসব অবদান ‘মাওসেতুঙ চিন্তাধারা’ সূত্রায়ন দ্বারা বিবৃত হয়ে এসেছে। মাওয়ের অবদানকে সর্বহারা শ্রেণীর সার্বজনীন তত্ত্ব হিসেবে গ্রহন করে আর “মাওসেতুঙ চিন্তাধারা হচ্ছে আজকের দিনের বিশ্বের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ” এই ঘোষণা করে আমরা প্রতিক্রিয়া ও সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছি। যাহোক, কমরেড মাওয়ের মৃত্যু ও চীনের পুঁজিবাদের পুনপ্রতিষ্ঠার পর আর্ন্তজাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনে ডান সংশোধনবাদের আধিপত্যের সাথে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। আজকে সংশোধনবাদীদের চক্র ”মাও সেতুঙ চিন্তাধারা” সূত্রায়ন ব্যবহার করে মাওয়ের বিপ্লবী শিক্ষার চেতনাকে হত্যা করে আসছে। বর্তমানে একদিকে, সংস্কারবাদীদের দ্বারা ”চিন্তাধারা” শব্দটির প্রকৃত গুরত্ব হিসেবে প্রকল্প অর্থে ”মাও সেতুঙ চিন্তাধারা” সূত্রায়ন ব্যবহৃত হচ্ছে, অপরদিকে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের দ্বরা সার্বজনীন নীতির অর্থে। এই পরিস্থিতিতে, বৈজ্ঞানিক সূত্রায়ন ”বাদ” তার সার্বজনীন নীতির বিবৃতির গুরুত্ব সহকারে উপস্থিত থাকা সত্ত্বে ও বিভ্রান্তিকর সূত্রায়ন ”চিন্তাধারা”র ব্যবহার সমেত এগিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে ডান সংশোধনবাদকে পথ প্রদর্শন। তাই, যারা ইতিমধ্যেই ”মাও সেতুঙ চিন্তাধারা” কে আজকের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হিসেবে আত্মস্থ করে আসছেন, সেই কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের জন্য মাওবাদ সূত্রায়ণ ব্যবহার করা দরকার এখনই ও দৃঢ়ভাবে। চীনে প্রতিবিপ্লবের পর, মাওবাদের উপর ডানপন্থী আক্রমনের ফলশ্রূতিতে প্রাক্তন বিপ্লবীদের অনেকেই ভীত হয়ে ”চিন্তাধারা”কে মাওয়ের অবদানসমূহের অবমূল্যায়ন অর্থে ব্যবহারে উদ্যত, ও তাকে মার্কসবাদের বিকশের তৃতীয় স্তর হিসেবে ও একটি সার্বজনীন নীতি হিসেবে মানছেন না। সমস্যাটির মূল এখানেই নিহিত। এমন  প্রবনতাসমূহ শেষতক সংস্কারবাদ ও সংশোধবাদের  দিকে চালিত করে। এই পরিস্থিতির কারণে, মাও কর্তৃক বিকশিত মার্কসবাদের তিন অঙ্গের বিশদ ব্যাখ্যা প্রয়োজনীতা আর “মাওবাদ” সূত্রায়নের ব্যবহারের তাত্ত্বিক গুরুত্ব আরো বেড়েছে। তাই, যা মার্কসবাদকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করেছে, দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে মাও কৃত-গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে তুলে ধরা অপরিহার্য।

. দর্শনের ক্ষেত্রে

১. দ্বান্দ্বিক বস্তবাদের সারবস্তু হিসেবে এবং প্রকতি, সমাজ ও মানবজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে দ্বন্দবাদের মৌলিক নিয়ম হিসেবে মাও দ্বন্দ্বের নিময় (ল অব কন্ট্রাডিকশন) প্রাতষ্ঠা করেছেন। দ্বন্দ্বের সার্বজনীনতার বিশ্লেষণ এবং প্রধান দ্বন্দ্ব নিধারণের প্রক্রিয়া ও গুরুত্ব দ্বন্দ্ববাদের উপলব্ধির বিকাশকে এক নতুন উচ্চতায় উন্নীত করেছে। বিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল সূত্রায়নে দ্বন্দ্বের মৌলিক নিয়মের পালনকৃত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বতঃসিদ্ধ।

২. শ্রেণীসংগ্রাম, উrপাদনসংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাকে জ্ঞানের উrস নির্ণয় করে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের যৌক্তিক জ্ঞানে রূপান্তবের প্রক্রিয়ার তাঁর বিশ্লেষনের মাধ্যমে, আর তত্ত্ব ও অনুশীলনের আন্তসম্পর্ক নিধারণ করার মাধ্যমে জ্ঞানের তত্ত্বের জগতে মাওয়ের বিশ্লেষণ যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে তা তর্কাতীত সত্য।

৩. সংশোধনবাদ-বিরোধী সংগ্রামের সময়কালে দ্বন্দ্ববাদের প্রধান দিক হিসেবে এক নিজেকে দুয়ে বিভক্তকরণ-এর গভীর বিশ্লেষন ও প্রয়োগ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিপ্লবীদের হাতে এক ক্ষুরধার অস্ত্রের যোগান দিয়েছে।

৪. ভিত্তি ও উপরিকাঠামোর আন্তসম্পর্ক সংক্রান্ত আধিবিদ্যক ও একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি সমেত “উrপাদিকা শক্তির তত্ত্ব” ও “অর্থনীতিবাদ” সংক্রান্ত সংশোধনবাদী বুর্জোয়া চিন্তাকে আক্রমণের মাধ্যমে, কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সচেতনতা ও উপরিকাঠামো যে নির্ধারক ভুমিকা পালন করে সেই বিশ্লেষণের দ্বারা ভন্ড বুজোয়াদের উম্মোচন করেছে।

৫. দার্শনিকদের গ্রন্থাগার ও অধ্যয়ন কক্ষের বাইরে দর্শনকে নিয়ে আসার মাধ্যমে এক অপরাজেয় অস্ত্রে পরিণত করার প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয়তার ওপর মাওয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনকে এক প্রচন্ড বন্তুগত শক্তিতে পরিণত করার ভিত্তি যুগিয়েছে।

. রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে

১. এক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও তার চরিত্র বিশ্লেষন হচ্ছে মাওয়ের একটি গুরত্বপূর্ণ আবিস্কার। নিপীড়িত দেশগুলিতে সামন্তবাদের সাথে জোট বেঁধে একচেটিয়া পুঁজিবাদের এজেন্ট হিসেবে জনগনের ওপর শোষণ চালায় যে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ তার চরিত্র নিরূপণ একদিকে নয়া উপনিবেশবাদের রূপে সাম্রাজ্যবাদের অমানবিক চরিত্রকে উম্মোচনে সহযোগিতা করেছে, অন্যদিকে নিপীড়িত জাতিগুলির বিপ্লরেরimages1 নিশানা স্পষ্ট করতে সহযোগিতা করেছে। কেবলমাত্র আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের ধ্বংস ও এ ধরনের সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরণের মাধ্যমেই সাম্রাজ্যবাদকে নিপীড়িত দেশগুলি থেকে বিতাড়িত করা যায় ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করা যায় – এই উসংহারের ঐতিহাসিক তাrপর্য সম্পূর্ণ পরিস্কার।

২. সমাজতান্ত্রিক স্তরে অর্থনীতির মূল নীতিগুলোর একটি দৃঢ় ভিত্তি গঠনে মাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন (সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতার একটি সমালোচনামূলক অধ্যয়ন সহকারে)। “বিপ্লবকে আঁকড়ে ধরো, উrপাদন বাড়াও” এবং “লাল ও দক্ষ” শ্লোগানের বিপ্লবী তাrপর্য এই দৃষ্টিভাঙ্গী সহকারে তুলে ধরা হয়েছে যে আমলাতান্ত্রিক নির্দেশ দ্বারা নয় বরং জনগনের উদ্যোগ  বাড়ানোর মাধ্যমেই (সঠিক অথনৈতিক কর্মনীতির ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে) সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি দৃঢ়ভাবে নির্মাণ করা যায়; এটা স্বতঃপ্রমানিত।

৩. নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রেক্ষপটে “যে জমি চাষ করে তার হাতে জমি”- এর ভিত্তিতে সামন্তবাদকে ধ্বংস করা, সকল দেশী ও বিদেশী একচেটিয়া চরিত্রের অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলো বাজেয়াপ্ত করা, জনগনের জীবনকে নিয়ন্ত্রন করেনা এমন ব্যক্তি-পুঁজির সীমিতকরণ, নিয়ন্ত্রন ও পরিচালনা, প্রভৃতি অথনৈতিক কর্মনীতিগুলোর যৌক্তিকতা ব্যবহারিকভাবে প্রমানিত হয়েছে। রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে মাও যেসব বিকাশ সাধন করেছেন তা ওপরের তথ্যগুলো থেকে সম্পূর্ণ পরিস্কার।

. বৈজ্ঞানিক সামজতন্ত্রের ক্ষেত্রে

১. নিপীড়িত দেশগুলিতে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সামগ্রিক ধারণার বিকাশে মাওয়ের ঐতিহাসিক অবদান সবার কাছে স্পষ্ট।

২. সাম্রাজ্যবাদের যুগে শ্রেণীসংগ্রামের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মার্কসবাদী সামরিক বিজ্ঞানের শিখর হিসেবে গণযুদ্ধের তত্ত্বের বিকাশের মাধ্যমে আন্তজাতিক সর্বহারা শ্রেণী এক শক্তিশালী অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত হয়েছে। এই তত্ত্ব শক্তিধর শত্রুকে পরাজিত করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি পরিস্কার করে দেখিয়েছে।

৩. সমাজতন্ত্রের সমগ্র পর্যায় ধরে অব্যাহত শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব আর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিবিপ্লবকে মনে রেখে এ থেকে সর্বহারা একনায়কত্বের অধীনে বিপ্লবকে অব্যাহত রাখার যে তত্ত্ব মাও বিকাশিত করেন তা সমাজতান্ত্রিক পর্যায়ে পুঁজিবাদের পুণপ্রতিষ্ঠা প্রতিরোধ করতে এক প্রচন্ড শক্তিধর তত্ত্বগত অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। সর্বহারা নেতৃত্বের অধীনের পরিচালিত তৃতীয় মহাবিপ্লব হিসেবে চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সামগ্রিক পরিকল্পনার সফল প্রয়োগ বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণীর জন্য ঐতিহাসিক আলোকবার্তিকা।

৪. মাওয়ের এই উক্তি যে “সাম্রাজ্যবাদ ও সকল প্রতিক্রিয়াশীলরা হচ্ছে কাগজের বাঘ” এবং “সামনের ৫০ থেতে ১০০ বছর” বিশ্ব মহা উত্থানসমূহের মধ্যদিয়ে যাবে।”-এর তুলনাহীন গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবের রণনীতির সূত্রায়নে তা মহান অবদান রেখেছে। মাও নিজে রুশ সংশোধনবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় এগুলো ব্যবহার করেছেন।

এভাবে দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র-এই তিনটি অঙ্গের সামগ্রিকতায় মাও মার্কসবাদী বিজ্ঞানকে গুণগতভাবে এক নতুন স্তরে উন্নীত করেছেন। এই পরিস্থিতিতে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের একক অস্ত্র রূপে সর্বহারা শ্রেণী তার মুক্তির তত্ত্ব অর্জন করেছে।

নেপালী কমিউনিস্ট আন্দোলনে ‘মাওবাদ’ সূত্রায়ন ব্যবহারের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে এমনকি মাওয়ের অবদানগুলোকে অবমূল্যায়ন করার লক্ষ্য থেকে। তাদেরকে খন্ডন করা ছাড়া সামনের দিকে এগোনো সম্ভব নয়।

প্রাথমিকভাবে সেগুলো নিম্নরূপ:

১. “যুগ সংক্রান্ত তত্ত্ব”:  কিছু লোক বলেন যে একাট “বাদ” গঠিত হতে হলে তাকে একটি সমগ্র যুগকে প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। তাদের বক্তব্য অনুসারে, মার্কসবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদের যুগের ফল, আর লেনিনবাদ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের যুগের ফল কিন্তু মাওয়ের কোন যুগ নেই, তাই কোন মাওবাদ পারেনা ইত্যাদি।

যারা এমত ব্যক্ত করেন তারা না বুঝতে পেরেছেন বিজ্ঞানের সাধারন নিয়ম ও বিকাশ প্রক্রিয়া, না মার্কসবাদকে একটি বিজ্ঞান হিসেবে আত্মস্থ করেছেন। একটি যুগের বিকাশের গতির সাথে বিজ্ঞানের বিকাশকে সীমাবদ্ধ করা হচ্ছে চরমভাবে অবৈজ্ঞানিক ও হাস্যকর। একটি একক যুগে বিজ্ঞান বিভিন্ন স্তরে বিকশিত হতে পারে। সমাজের বিকাশের দৃষ্টিকোন থেকে কেউ যদি সত্যিই যুগের কথা বলেন, সাম্রাজ্যবাদ কোন নতুন যুগ নয় বরং পুঁজিবাদের উচ্চতম ও মৃত্যুপথযাত্রী অবস্থা। সুতরাং, ‘লেনিনবাদ’ বলাটা সঠিক নয়! যুগের বক্তব্যে অগ্রসর হওয়ার তাদের প্রতারণা এভাবে পরিস্কার হয়।

২. কেউ কেউ বলেন, যেহেতু মাওয়ের কোন আসল অবদান নেই, তাই ‘মাওবাদ’ সূত্রায়ন ব্যবহার করা সঠিক নয়। তাদের বক্তব্য index1অনুসারে, মাও যা কিছু বলেছেন তা লেনিন আগেই বলেছেন। এই পরিস্থিতি অধিকতর মারা ত্মক রূপ পরিগ্রহ করে যখন ‘চিন্তাধারা’ সূত্রায়ন ব্যবহারের সমর্থনকারীরা এভাবে বলেন। সন্দেহ নেই, যেসব লোক এভাবে কথা বলেন তারা এমনকি ‘মাওসেতুঙ চিন্তাধারা’ বর্জন করার রাস্তা ধরেছেন ও ডান সুবিধাবাদের দিকে যাত্রা করেছেন। মাওয়ের অবদানসমূহকে ইতিমধ্যেই সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। যাহোক, প্রশ্নটি উঠতে পারে যদি কেউ এভাবে বক্তব্য রাখেন, এটা বলবেন কি যে লেনিন মার্কসবাদকে এক নতুন পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেছেন? কেন এ ধরনের লোক মাওসেতুঙ চিন্তাধারকে তাদের পথনির্দেশক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে? উত্তর খুবই সহজ, আর তা হচ্ছে, জনগণকে ভ্রান্তপথে পরিচালিত করতে। তা না হলে, হয় তাদেরকে মাওসেতুঙ চিন্তাধারকে পার্টির পথনির্দেশক নীতি হিসেবে বর্জন করতে হবে অথবা মাওয়ের অবদানকে অবমূল্যায়ন করার কাজ বন্ধ করতে হবে।

৩. কিছু লোককে এভাবে বলতে শোনা যায়: তড়িঘড়ি মাওবাদ বলাটা আমাদের উচিত নয়, কেউ এমন একটি বড় ইস্যুতে আমাদের কথা শুনবেনা, সেই সূত্রায়নের প্রতিষ্ঠা কখনো সম্ভব নয়, আর এগুলো অপ্রয়োজনীয় বির্তক সৃষ্ট করবে। এধরণের উক্তি যারা করেন তাদের চিন্তায় যদি সততাও থাকে, এই বক্তব্যগুলো নিজেই মার্কসবাদী পদ্ধতির সাথে অসংগতিপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক এবং তড়িঘড়ির না অথবা কোন তড়িঘড়ি নয়। [এ বাক্যটির ইংরেজী অনুবাদ অসম্পূর্ণ–বাংলা অনুবাদক]। এসব বক্তব্য বেঠিক, কারণ তা অপ্রয়োজনীয় আপোষে চালিত করতে এবং বিভ্রম ছড়াতে কাজ করবে।

উপসংহারে, উচ্চতর পর্যায়ে সংশোধনবাদ-বিরোধী সংগ্রাম পরিচালনা করতে, এক নতুন ধরণের জঙ্গী কমিউনিষ্ট পার্টির বিকাশের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে, আর বিপ্লবী সংগ্রাম ও গণযুদ্ধের বিকাশের কাজে এক নতুন গতি দিতে বিভ্রান্তিকর সূত্রায়ন ‘মাওসেতুঙ চিন্তাধারা’র ব্যবহার নয় বরং বৈজ্ঞানিক সূত্রায়ন ‘মাওবাদ’ পরমভাবে প্রয়োজন।

(ডিসেম্বর, ১৯৯১)।

প্রচন্ড পথের দার্শনিক ধারণা

–         কমরেড কিরণ

 

.       সূচনা

প্রচন্ড পথ হচ্ছে একসারি ধারণা যা নেপালের মূর্ত নিদিষ্টতায় মালেমার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আবির্ভুত হয়েছে, আর বিশ্ববিপ্লবে সেবা করার জন্য এর রয়েছে শক্তি! প্রচন্ড পথের পরিচালনাধীন মহান গণযুদ্ধের দ্রুত বিকাশের কারণে আজকে নেপাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব সর্বহারাkiran শ্রেণী, শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের আকর্ষণের কেন্দ্র ও আশা।

অগ্রসর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের চেয়ে পশ্চাদপদ জার্মানী মার্কসবাদ দিয়েছে। ইউরোপ ও অপরাপর দেশের চেয়ে পশ্চাদপদ রাশিয়া লেনিনবাদের জন্ম দেয়। অনুন্নত আর সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত চীন মাওবাদের জন্ম দেয়। প্রচন্ড পথের অন্যবিধ উচ্চতায় নতুন একসারি ধারণার জন্ম দেয়ার গৌরব আজকে নেপালের, বিশ্বের তৃতীয় দরিদ্রতম দেশ। এটা একটি গৌরবময় ব্যাপার।

হিমালয়ের উপমহাদেশের একটি গরীব দেশ নেপাল, আর প্রাচীনকালে যে বিশ্বের কাছে নতুন ধ্যানধারণা ও দর্শনের ঐতিহাসিক বার্তা প্রদান করেছে। মহান চিন্তাবিদ গৌতমবুদ্ধ ছিলেন একজন নেপালী যিনি নিরীশ্বরবাদ, দ্বন্দ্ববাদ ও যুক্তরাষ্ট্র বাদের বার্তা পৃথিবীকে প্রদান করেন। এইভাবে শংখ দর্শনের প্রচারক কাপিলও নেপালের একজন মহান দার্শনিক যিনি বিশ্বকে বস্তুবাদ ও দ্বন্দ্ববাদের বার্তা প্রদান করেছেন, যাকে গৌতমবুদ্ধের জন্মস্থান জেলা কাপিলাবস্তুরও প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। প্রচন্ডপথ ইতিহাসের এই যোগসূত্রের সাথে বিজরণের প্রক্রিয়া চমৎকার ভাবে অগ্রসর হচ্ছে যা নতুন ভাবধারা ও দর্শনকে পৃথিবীর সামনে উপহার দিয়েছে।

মার্কসবাদের তিনটি অঙ্গ রয়েছে – দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। মালেমার একসারি ধারণার বিকাশ হিসেবে প্রচন্ড পথেরও রয়েছে তিনটি অঙ্গ। এই তিনটির মধ্যে এখানে প্রচন্ড পথের দর্শনের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে।

. তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা

সামগ্রিকভাবে প্রচন্ড পথ ও তার দার্শনিক ধারণার বিকাশ সংঘঠিত হয়েছে মালেমার আত্মস্থকরণ, নেপালের বিপ্লবের শ্রেণীসংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা, নেপালী কমিউনিষ্ট আন্দোলনে বিদ্যমান সকল ধরণের ভুল চিন্তা ও প্রবনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং আন্তজাতিক কমিউনিষ্ট আন্দোলনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সংশ্লেষনের প্রেক্ষাপটে।

কমরেড প্রচন্ড বিপ্লবের বিজ্ঞান হিসেবে মালেমার তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরেন। মাওয়ের তত্ত্বগত অবদানকে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে, তিনি নেপালী কমিউনিস্ট আন্দোলনে মাওসেতুঙ চিন্তাধারার পরিবর্তে মাওবাদ সূত্রায়ন ব্যবহার করার ধারণা তুলে ধরেন। ঐক্য কংগ্রেসে উত্থাপিত ও গৃহীত “মাওবাদ সম্পর্কে” শীর্ষক দলিলে এই ধারনাকে আরো বিশুদ্ধ করে তিনি মাওয়ের তত্ত্বগত অবদানকে মালেমার আকারে বৈজ্ঞানিকভাবে সংশ্লেষিত করেন। বিপ্লবের বিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরে তিনি নেপালী কমিউনিস্ট আন্দোলনে গভীর শিকর প্রথিত সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করেন তাকে রক্ষা, প্রয়োগ ও বিকাশিত করতে। তিনি বলেন “বিজ্ঞান হওয়ার কারণে মার্কসবাদ তার এই চরিত্র পরিষ্কার করেছে যে নতুন পরিস্থিতিসমূহে উদ্ভূত নতুন সমস্যাসমূহকে মোকাবেলা মধ্য দিয়ে সে এগিয়ে যাবে। তদনুযায়ী, সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় মার্কসবাদ আজকে মালেমায় বিকাশিত হয়েছে। আজকে সংস্কারবাদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটাই যে মাওবাদের বিরোধিতা করার মাধ্যমে তারা মার্কসবাদী বিজ্ঞানের বিকাশের সর্বোচ্চতাকে অস্বীকার করে……. বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশের সমস্যা হচ্ছে সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সমস্যা অর্থাr এটা হচ্ছে বিপ্লবী তত্ত্বকে রক্ষা, প্রয়োগ ও বিকাশের সমস্যা।” [নেপালী বিপ্লবের সমস্যাসমূহ ( নেপালীতে ),খন্ড-১, পৃঃ ৩] কমরেড প্রচন্ড বিপ্লবী নীতির রক্ষা, প্রয়োগ ও বিকাশের ধারনার ওপর নিদিষ্টভাবে গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন।

সিপিএন (মাওবাদী) [নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)–বাংলা অনুবাদক]র ঐতিহাসিক ২য় সম্মেলনে প্রচন্ড পথ সূত্রায়িত হয়েছে মহান গণযুদ্ধের পাঁচ বছরের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার সংশ্লেষন হিসেবে। পার্টি এই সম্মেলনে প্রচন্ড পথকে গ্রহণ করেছে আন্তজাতিক সার ও জাতীয় প্রকাশের মধ্যে, সার্বজনীনতা ও মূর্ত নিদিষ্টতার মধ্যে, সমগ্র ও অংশের মধ্যে, আর সাধারণ ও বিশেষের মধ্যেকার এক দ্বান্দ্বিক ঐক্য হিসেবে, এবং হৃদয়ঙ্গম করেছে যে নেপালী বিপ্লবের অভিজ্ঞতার এই সংশ্লেষণ বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লব ও সর্বহারা আন্তজাতিকবাদকে সেবা করবে।

প্রচণ্ড পথের বিকাশ তার তৃতীয় পর্বের মধ্যে এগিয়ে চলেছে। এই পর্বগুলিকে এভাবে তুলে ধরা যায়ঃ ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত সিপিএন (মাওবাদী)র তৃতীয় বর্ধিত সভা- প্রথম পর্ব; ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত সিপিএন(মাওবাদী)র ঐতিহাসিক জাতীয় সম্মেলনে সংঘটিত পাঁচ বছরের মহান গণযুদ্ধের সম্মৃদ্ধ অভিজ্ঞতার মতাদর্শিক সংশেষণ- দ্বিতীয় পর্ব; এবং এই সম্মেলন-পরবর্তী বিকাশের প্রক্রিয়া হচ্ছে তৃতীয় পর্ব। কমরেড প্রচণ্ড পথের বিকাশের প্রক্রিয়ার ওপরও আলোকপাত করেন যা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞান তত্ত্ব অনুসারে অনুশীলন, জ্ঞান, আবারো অনুশীলন এবং আবারো জ্ঞানের মধ্য দিয়ে  অব্যাহতভাবে বিকশিত হয়। এ দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টি দেখলে লক্ষ্য করা যায় যে প্রচণ্ড পথও নেপালী বিপ্লব আর গণযুদ্ধের গতিশীল বিকাশের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুতগতিতে বিকশিত হচ্ছে।

মালেমাকে আঁকড়ে ধরে, প্রচণ্ড পথও তার রক্ষা, প্রয়োগ ও বিকাশের প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয়ে আসছে এবং এই ধারণাও বিপ্লবী তত্ত্বের বিকাশের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত মূর্ত আন্তর্জাতিক তাrপর্যকে বহন করে।

প্রচণ্ড পথের দার্শনিক ধারণাকে মূলগতভাবে নিুোক্তভাবে অধ্যয়ণ করা যায়-

.দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ

কমরেড প্রচণ্ড দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দর্শনকে কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামের দর্শন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন এবং তিনি বলেন যে সংগ্রামের মাধ্যমে এর বিকাশ সাধিত হয়। প্রচণ্ড পথের দর্শন সর্বহারা শ্রেণী, নিপীড়িত জনগন ও কমিউনিজমের মহান লক্ষ্যের প্রতি নিবেদিত।

(ক) বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদের পদ্ধতি

দর্শনের ইতিহাসে দুই ধরনের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি: দ্বন্দ্ববাদ ও অধিবিদ্যা প্রত্যেক বস্তু, ঘটনা ও প্রক্রিয়াকে দেখার কাজে লিপ্ত। কমরেড প্রচণ্ড অধিবিদ্যার বিরুদ্ধে বস্তুবাদের পক্ষে দাঁড়ান।

N-11_R2দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশের পক্ষে দাঁড়িয়ে এবং নেপালের কমিউনিস্ট আন্দোলনে আধিপত্যকারী অধিবিদ্যাকে বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে কমরেড প্রচন্ড বলেন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ হচ্ছে মালেমার সেই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী যা মনে করে যে প্রকৃতি, সমাজ ও মানব চিন্তনের বিকাশ ও ধ্বংসের প্রতিটি ঘটনার কারন নিহিত রয়েছে সংগ্রামে লুক্কায়িত চরম চরিত্রের মধ্যে যা একাটি বস্তু অথবা সম্পর্কিত প্রশ্নের আপেক্ষিক ঐক্যের মধ্যে বিদ্যমান। প্রতিটি বস্তু ও প্রক্রিয়া যারা পরস্পর সম্পর্কিত ও পরিবর্তনের গতিশীল প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান, তাদের বিকাশের দ্বান্দ্বিকতা এমনই যে লেনিন বলেন তা সরলরেখায় বিকশিত হয়না এবং সর্পিলভাবে সংঘটিত হয়, স্বতস্ফূর্তভাবে চোখের আড়ালে সংঘটিত হয়না, ক্রমান্বয়ে ঘটেনা বরং ধারাবাহিকতায় বিচ্ছেদ, উলম্ফন, বিপর্যয় ও বিপবের মধ্য দিয়ে, পরিমাণের গুণে রুপান্তর আর নেতিকরণের নেতিকরণের রূপে। বিকাশের মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিকতার এটাই হচ্ছে সারবস্তু।” [নেপালী বিপ্লবের সমস্যাসমূহ (নেপালীতে) , খণ্ড-২, পৃঃ ১-২]। এখানে বস্তুর বিকাশ সংক্রান্ত বিপরীতের ঐক্য, পরিমানের গুণে রুপান্তর এবং নেতিকরণের নেতিকরণের মার্কসবাদী ধারণাকে প্রচণ্ডভাবে হাজির করা হয়েছে অধিবিদ্যার ধারণার বিরুদ্ধে যা বস্তুর ভিতরে লুক্কায়িত আভ্যন্তরীণ সংগ্রামকে বিরোধিতা করে বাহ্যিক কারণের কথা বলে, সেটাকে বস্তুর বিকাশের প্রধান কারণ বলে, বিকাশকে আঁকাবাঁকা পথে না বুঝে সরলরৈখিকভাবে বোঝে আর গুনগত উলম্ফনের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়িক বিকাশ মনে করে।

 এটা স্বতসিদ্ধ যে এই সংগ্রাম যা মালেমাকে আন্দোলনে প্রতিষ্ঠা করে, তার একটা বিশেষ দার্শনিক তাrপর্য রয়েছে। নেপালের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিদ্যমান বিকাশের সংস্কারবাদী ও বিবর্তনবাদী ধারণার বিরূদ্ধে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় পার্টি সংঘর্ষ, বিচ্ছেদ, উলম্ফন ও বিপর্যয় সংক্রান্ত মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিকতার বিজ্ঞানকে বিশেষভাবে তীক্ষ্ণ করেছে। এই চিন্তাধারা (থট) সেই সুবিধাবাদের প্রতি বড় গোলা নিক্ষেপ করে যা পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তন সম্পর্কে একটি যান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ প্রতিষ্ঠা করে পরিমানের নামে সংস্কারবাদ উrপাদন করছিল; এবং তা বিপ্লবের সূচনায় একটি শক্তিশালী ভিত্তি যোগায়। গণযুদ্ধের ঐতিহাসিক সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত পার্টির কর্মনীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচীতে সংঘর্ষ, বিচ্ছেদ, উলম্ফণ ও বিপর্যয় সংক্রান্ত এই বিপ্লবী ধারণার বিশেষ নির্দেশনা শ্রেণীসংগ্রাম ও দুই লাইনের সংগ্রামে অব্যাহত জীবণীশক্তি প্রদান করেছে। দ্বন্দ্বের নিয়ম সংক্রান্ত মাওবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বকে ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রেণীসংগ্রাম ও দুই লাইনের সংগ্রামের সমস্যাসমূহ সমাধানের প্রক্রিয়ায় আদর্শ অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষামালার উচ্চতা থেকে ”এক নিজেকে দুইয়ে বিভক্ত করণ” এবং বিপরীতের ঐক্য-সংগ্রাম-রূপান্তর-এর বিজ্ঞানের প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় একটি তুলনাহীন সম্পদের দিকে অব্যাহত বিকাশের রূপে চালিত করেছে আর সকল প্রকার অসর্বহারা প্রবণতাসমূহকে পরাজিত করার মাধ্যমে ব্যাপক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে পার্টিতে বিপ্লবী স্রোত প্রতিষ্ঠিত করার রূপে, যা প্রতিক্রিয়া ও সংশোধনবাদের শেকলকে ধ্বংস করতে সহযোগিতা করেছে। এই নির্দিষ্ট ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয়ে চলতি পার্টি শুদ্ধি অভিযান ঐক্য-সংগ্রাম-রূপান্তরের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পার্টিকে এক নয়া ভিত্তিতে নয়া ঐক্যের অভূতপূর্ব উচ্চতায় উন্নীত করেছে। বই থেকে বইয়ে, চিন্তাধারা থেকে চিন্তাধারায় এবং সংস্কার থেকে সংস্কারে সংশোধনবাদী চিন্তাধারার বিরূদ্ধে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় শ্রেণীসংগ্রামের জ্ঞানের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরার এক নির্দিষ্ট চিন্তাধারা বিকাশে চালিত করেছে। বস্তুগত ও আত্মগত পরিস্থিতির মধ্যকার, সমগ্র ও অংশের মধ্যকার, এবং পরিমাণ ও গুণের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের পরিচালনা সংক্রান্ত নির্দিষ্ট বিপ্লবী ধারণাকে পার্টি বিকশিত করে আসছে। পাঁচ বছরের গণযুদ্ধের আদর্শ বিকাশের পর এটা পরিষ্কার যে দর্শনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রয়োগসমূহের মধ্য দিয়ে একটা নির্দিষ্ট চিন্তাধারা আকৃতি লাভ করেছে। (প্রাগুক্ত, খণ্ড-২, পৃঃ ১৯২-১৯৩)

বস্তুবাদী দ্বদের ভিতিগত নির্দিষটতার কারনে নেপালী বিপ্লবে তার প্রয়োগের মূর্ত ফল ও এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা সু¯পষ্ট যে এই উদ্ধৃতিসমূহে প্রচণ্ডভাবে বিবৃত হয়েছে এই সত্য যে দর্শনের ক্ষেত্রে একসারি মূর্ত ভাবধারা বিকশিত হয়ে আসছে। খুবই সুসংবদ্ধভাবে হাজিরকৃত এই ভাবধারাসমূহ দার্শনিকভাবে খুবই সতেজ ও জরুরী।

(খ) বস্তুবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বের মূল নিয়ম

কমরেড প্রচণ্ড বিপরীতের ঐক্যের নিয়ম- এক নিজেকে দুয়ে বিভক্তকরণের নিয়ম এবং দ্বন্দ্বের নিয়মকে একমাত্র মূল নিয়ম হিসেবে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরেন। কমরেড প্রচণ্ড বলেন, “বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রাম হচেছ দ্বন্দ্ববাদের মূল নিয়ম।“(প্রাগুক্ত, পৃঃ৭৬)। এই ধারণা মাওবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।

একইভাবে, কমরেড প্রচণ্ড বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রামের প্রকৃতির ওপর আলোকপাত করে বলেন, “ঐক্য হচেছ ধ্রুব ও চরম।“ (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৬)। এখানে, একদিকে সেই ধারণাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা হয়েছে যা মনে করে বিপরীতের ঐক্য হচেছ আপেক্ষিক, অস্থায়ী ও অন্তবর্তীকালীন এবং সংগ্রাম হচেছ পরম; আর অন্যদিকে সংস্কারবাদ ও সংশোধনবাদকে আক্রমণ করা হয়েছে যা দীর্ঘকাল ধরে নেপালী কমিউনিস্ট আনেন্দালনে আধিপত্য করে আসছে, যা মনে করে বিপরীতের ঐক্য হচেছ পরম আর সংগ্রাম হচেছ আপেক্ষিক ও অস্থায়ী।

কমরেড মাও উভয়বিধ ধরণের অধিবিদ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংগ্রাম সূচিত করেন যাতে কেউ বিপরীতের ঐক্যকে  একস্তম্ভীতাবাদের অর্থে বোঝে, আর অন্যরা যারা এধরণের ঐক্যকে বহুত্ববাদের দৃষ্টিতে আলাদা করে। মাওয়ের দার্শনিক ধারণার ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে এই সংগ্রামকে কার্যকরভাবে আরো অগ্রসর করার কাজে কমরেড প্রচণ্ডের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, “স্তালিনের প্রতি কমরেড মাওয়ের মূল্যায়ন একদিকে সেই ডান সংশোধনবাদী দলত্যাগী মতের বিরূদ্ধে যা তাকে পুরোপুরি নেতিকরণ করে, অন্যদিকে সেই সংকীর্ণতাবাদী গোঁড়ামীবাদী সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে যা এমনকি কমরেড স্তালিনের ভুলগুলিকেও ইতিবাচকভাবে দেখায়। আন্তর্জাতিকimages2 কমিউনিস্ট আন্দোলনে ট্রটস্কি, টিটো, ক্রুশ্চেভ প্রভৃতিরা প্রথম বর্গে পড়ে যেখানে আলবেনিয়ার আনোয়ার হোজা পড়ে দ্বিতীয় ভাগে। আরেকটি লক্ষনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচেছ ইউরো কমিউনিজম স্তালিনের একস্তম্ভীতাবাদী  ঐক্যের ধারণা ও আমলাতন্ত্রের বিরোধিতার অসিলায় বুর্জোয়া নৈরাজ্যবাদী বহুত্ববাদের দৃষ্টিকোণ থেকে মার্কসবাদের একক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিজ্ঞানকে বিরোধিতা করা শুরু করে। “ (মহান অগ্রগামী উলমম্ফন…, পৃঃ ৯-১০)। এসব ধারণা যা ঐক্যবদ্ধ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সমৃদ্ধকরন ও বিকাশের প্রক্রিয়ায় আধুনিক, গোঁড়ামীবাদী ও বহুত্ববাদী সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচেছ তা প্রচণ্ড ও সার্বজনীন তাrপর্যসম্পন্ন।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মূল নিয়মসমূহ উল্লেখের  পেক্ষাপটে, কমরেড প্রচণ্ড পরিমানগত ও গুণগত পরিবর্তনের ওপর আলোকপাত করেন। পরিমানগত ও গুণগত পরিবর্তনের ওপর প্রচণ্ড পথের ধারণা লেনিনবাদ ভিত্তিক। এই প্রেক্ষাপটে, তিনি একদিকে ক্রমান্বয়িক পরিবর্তনের তাrপর্যকে গ্রহণ করেন, আর অন্যদিকে গুণগত পরিবর্তনের সংঘর্ষ, বিচেছদ, উলম্ফণ ও বিপর্যয়ের ওপর বিশেষভাবে জোর দেন। এটা দেখা গেছে, বস্ততুবাদী দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কমরেড প্রচণ্ড প্রতিপাদ্য (থিসিস)-পাল্টা প্রতিপাদ্য (এন্টি থিসিস) ও সংশ্লেষণ অথবা নেতিকরণের নেতিকরণের দিকে প্রয়োজনীয় মনোযোগ প্রদান করেন। পার্টি ইতিহাসের বিকাশের প্রক্রিযার মূল্যায়ণ করার পরিস্থিতিতে তিনি একই দলিলে বলেন, নেপালের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সংশ্লেষণ করার সময় এটা বলা যায় যে এটা ঐক্য-সংগ্রাম-রূপান্তর অথবা প্রতিপাদ্য (থিসিস)-পাল্টাপ্রতিপাদ্য (এন্টি থিসিস) ও সংশ্লেণের দ্বান্দ্বিক নিয়ম অনুসারে নতুন ভিত্তিতে নতুন ঐক্য অর্জন করার মাধ্যমে সামনে অগ্রসর হচেছ… নেপালের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমগ্র প্রক্রিয়াকেও নেতিকরণের নেতিকরণের রূপে উপলব্ধি করা যায়। সংশোধনবাদ পাটির প্রারম্ভিক সঠিক লাইনকে নেতিকরন করেছিল, আর সঠিক বিপ্লবী লাইন পুনরায় সংশোধনবাদকে নেতিকরন করে। এর ফল হিসেবে গণযুদ্ধের মহান প্রক্রিয়া সামনে আসে। কিন্ততু এটা যদি এভাবে বোঝা হয় অথবা অর্থ করা হয় যে এই প্রক্রিয়া সম্পূণ হয়েছে অথবা শেষ হয়েছে, তাও বিকাশের দ্বান্দ্বিক নিয়মের বিরোধী হবে। ঐক্য-সংগ্রাম-রূপান্তর-এর এই প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলবে।” কমরেড প্রচণ্ড নেতিকরণের নেতিকরনের ভিত্তিতে এখানে নেপালের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিদ্যমান মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রক্রিয়াকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেন। বিকাশের ত্রয়ী ধারণার বিরূদ্ধে প্রচণ্ড পধের প্রতিপাদ্য (থিসিস)-বিপরীত প্রতিপাদ্য (এন্টি থিসিস) ও সংশ্লেষণ ও নেতিকরণের নেতিকরন সংক্রান্ত এই ধারণা দ্বন্দ্ববাদের মূল নিয়ম বিপরীতের ঐক্যের ওপর দাড়িয়ে। বস্তুবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বের মূল নিয়ম সম্পর্কে প্রচণ্ড পথ কর্তৃক উপস্থাপিত ধারণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে দুটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদান করা দরকার। প্রথমতঃ প্রচণ্ড পথ বিপরীতের ঐক্যের নিয়মকে দ্বন্দ্ববাদের মূল নিয়ম হিসেবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে পরিমাণ ও গুণের পারস্পরিক রূপান্তর ও নেতিকরনের নেতিকরনকে মূল নিয়মে অন্তর্র্ভুক্ত করেছে। দ্বিতীয়ত, একস্তম্ভীতাবাদ ও বহুত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় এটা বিপরীতের ঐক্যের নিয়মকে বিকশিত করেছে।

গ) দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ভাবাবাদের বিরুদ্ধে চালিত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে এ ধরণের ভাববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে কমরেড প্রচণ্ড অত্যন্ত চমrকারভাবে এ সত্যকে স্পষ্ট করেন যে মহান গণযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী তত্ত্বের বিকাশ ও বিশুদ্ধকরণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।তিনি বলেন, নেপালী কমিউনিস্ট আন্দোলনে আধিপত্যকারী ধারণা,ধারণা, ধারণার বুর্জোয়া ভাববাদী চক্র বিপ্লবী অনুশীলনের মাধ্যমে চূর্ণ হয়েছে। প্রকৃত বিপ্লবী অনুশীলনের মাধ্যমে বিপ্লবী তত্ত্বের বিকাশ ও বিশূদ্ধকরণের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার দরজা খুলে গেছে।” (নেপালী বিপ্লবের সমস্যা, খণ্ড-২, পৃ:৪০)।

 নেপালী কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিদ্যমান ভাববাদ যা ধারণা থেকে ধারণায গমন করে, তাকে একদিকে এখানে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, অন্যদিকে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানের তত্ত্ব যা বিপ্লবী তত্ত্ব থেকে বিপ্লবী অনুশীলনে গমন করে তাকে অসাধারনভাবে আঁকড়ে ধরা হয়েছে। বস্তু ও চেতনার মধ্যে কোনটির ভূমিকা প্রধান? বস্তুগত ও আত্মগত পরিস্থিতির মধ্যে কোনটি প্রধান? এই প্রশ্নগুলির উত্তরে তিনি বস্তুবাদী ধারণা দৃঢ়ভাবে  উর্ধ্বে তুলে ধরেন একদিকে এটাঁ মনে করে যে বস্তু অথবা বস্তুগত পরিস্থিতি হচেছ প্রধান, আর অন্যদিকে এই দ্বান্দ্বিক ধারণাকে আঁকড়ে ধরেন যে সচেতনতা অথবা আত্মগত উপাদানও বস্তু অথবা বস্তুগত দিকের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। কমরেড প্রচণ্ড বলেন, এভাবে চিন্তা করাও মার্কসবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বের বিরোধী যে বস্তুগত পরিস্থিতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আত্মগত পরিস্থিতিকে যান্ত্রিক অথবা পরমভাবে প্রস্তুত করে। যদিও বস্তু ও সচেনতার মধ্যকার আন্তসম্পর্কের মধ্যে বস্তুই হচেছ চূড়ান্তভাবে প্রধান দিক, পরেরটা কিছু ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে এবং এ দুয়ের মধ্যে একের দ্বারা অপরকে প্রভাবিত করার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান। মাওবাদী গণযুদ্ধের বিকাশের সম্পর্কেও এটা সত্য। তাই পার্টি যার ওপর গুরত্বারোপ করে তা হচেছ নেপালের গণযুদ্ধ একদিকে হচেছ দীর্ঘ শ্রেণী সংগ্রামের ফল, অন্যদিকে দশকের পর দশক ধরে নেপালী কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংঘটিত তীব্র মতাদর্শিক সংগ্রামের বিকাশ। গণযুদ্ধের ঐতিহাসিক সূচনা তখনই সম্ভব হয়েছে যখন প্রথম উপাদান বস্তুগত পরিস্থিতি প্রস্তুত করেছে।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৯-৬০)। এখানে একদিকে যান্ত্রিক ও স্বতস্ফূর্ত চিন্তাকে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করা হয়েছে যা বিপ্লবের আত্মগত প্রস্তুতিকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে, অন্যদিকে, বস্তুগত ও আত্মগত উপাদানসমূহের মধ্যকার এবং বস্তু ও চেতনার মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ওপর চমrকারভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।

জ্ঞানের উrস কী? আর কোথা থেকেই বা তা আসে? জ্ঞানের তত্ত্বের মাওবাদী তত্ত্ব আঁকড়ে ধরে কমরেড প্রচণ্ড বলেন,  “মার্কসবাদী বিজ্ঞান অনুসারে তা শ্রেণী সংগ্রাম থেকে আসে। মাও মূর্তভাবে শ্রেণীসংগ্রাম, উrপাদন সংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষাকে জ্ঞানের উrস হিসেবে সূত্রায়িত করেছেন। নেপালের গণযুদ্ধ তার সারবস্তুতে হচ্ছে  শ্রেণীসংগ্রাম, উ।পাদন সংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মূর্তপ্রকাশ।” ( প্রাগুক্ত, পৃঃ১১৪) জ্ঞানের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে কমরেড প্রচণ্ড কয়েকটি জায়গায় উলে করেন যে অনুশীলন, জ্ঞান, পুনরায় অনুশীলন, পুনরায় জ্ঞানের প্রক্রিয়া হচেছ অসীম। এমন মন্তব্য দ্বারা তিনি একদিকে অনুশীলনকে জ্ঞানের পরিমাপ হিসেবে গ্রহণ করেন,অন্যদিকে জ্ঞানের তত্ত্বে দূই উলম্ফনের ধারণাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেন যা অনূশীলন থেকে জ্ঞান এবং তার বিপরীতে সংঘটিত হয়।

কমরেড প্রচণ্ড বিপ্লবী তত্ত্বের আত্মস্থকরণ, তার প্রয়োগ ও বিকাশের প্রশ্নকে গুরত্ব সহকারে গ্রহণ করেন। এই প্রক্রিয়ার বাঁধা গোঁড়ামীবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রযোজনীয়তার ওপর  তিনি সর্বদা জোর প্রদান করে আসছেন। তিনি বলেন, “তার জন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে আরো গভীরভাবে অধ্যয়ণ করতে হবে। মতাদর্শগতভাবে, গোঁড়ামীবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ-বিরোধী সংগ্রামকে আরো সময়োপযোগীভাবে ও প্রশস্থভাবে করতে হবে।” একইভাবে তত্ত্বকে বিকাশের নামে অভিজ্ঞতাবাদ তার বিপ্লবী সারবস্তু খতম করে আসছে। প্রচণ্ড পথের জ্ঞানতত্ত্ব এই উভয় ধরণের চিন্তার বিরুদ্ধে পরিচালিত। বিপ্লবী তত্ত্বের প্রধান উদ্যমকে রক্ষার মাধ্যমে তা অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে বিকাশের প্রশ্নে জোর দেয়। জ্ঞানের তত্ত্বের ক্ষেত্রে কমরেড প্রচণ্ড বিশ্লেষণ ও N-05_R2সংশ্লেষণকে তাদের প্রয়োগের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসহকারে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেন। তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই সংশ্লেষণের ওপর জোর দেওয়া উচিত, বিশ্লেষণের দিকেমনোযোগ দেওয়া উচিত। সংশ্লেষণের ওপর আমাদের জোর দেওয়ার চেতনা হচেছ সামগ্রিক  পরিস্থিতির ওপর জোর দেওয়া অর্থাr বিপ্লবের ওপর জোর দেওয়া, আর বিশ্লেষণের দিকে মনোযোগদেওয়ার অর্থ হচেছ কোন বস্তু ও ঘটনাকে অংশে অংশে ভেঙে ফেলা এবং তাদের মধ্যে প্রকৃত পরিস্থিতি নিরীক্ষণ করা। যদি বিশ্লেষণকে জোর দেয়া হয় তবে তা অভিজ্ঞতাবাদ, স্ববিভাগীয়তাবাদ ও আঞ্চলিকতাবাদের বিপদ সৃষ্টি করে। কেবলমাত্র সংশ্লেষণকে জোর দিয়ে ও বিশ্লেষণের দিকে মনোযোগ দিয়ে আমরা অংশ ও সমগ্রের মধ্যকার সম্পর্কই শুধু সঠিকভাবে বুঝবো তাই নয় বরং বিশ্বকে পরিবর্তনের শাঁসকেও ব্যবহারিকভাবে প্রয়োগ করতে থাকবো।”(প্রাগুক্ত, পৃঃ৪৬)। প্রচণ্ড পথের জ্ঞানের তত্ত্বের এই পদ্ধতি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সারের ওপর দাঁড়িয়ে, যা আমাদের বিশ্বকে বুঝতে ও প্রধানত একে বদলাতে সহায়তা করে।

(ঘ) সমৃদ্ধকরণ ও বিকাশ

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ক্ষেত্রে কমরেড প্রচণ্ড কর্তৃক বিকশিত মূল ধারণাগুলি হচ্ছেঃ

প্রথমত, দ্বন্দ্বতত্ত্বের মূল নিয়মঃ কমরেড প্রচণ্ড মাওবাদী ধারণার পথের ওপর দাঁড়িয়ে একদিকে শ্রেণীযুদ্ধ ও দূইলাইনের সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় দ্বন্দ্বতত্ত্বের মূল নিয়ম বিপরীতের ঐক্যের নিয়মকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেন, অন্যদিকে, স্তালিনের দূর্বলতাসহকারে আধুনিক, গোঁড়ামীবাদী ও বহুত্ববাদী সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শিক সংগ্রাম চালান। এই ধারণা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী অদ্বৈতবাদ-এর বিকাশকে এক নতুন উচ্চতায় উন্নীত করে এবং এর একটি সার্বজনীন তাrপর্য রয়েছে।

দ্বিতিয়ত, পরিমাণের গুণে রূপান্তরঃ বিচ্ছেদ, বিপ্লব, সংঘাত, গুণগত পরিবর্তন ও বিপর্যয়ের আকারে উত্থাপিত করার মাধ্যমে কমরেড প্রচণ্ড পরিমাণের রূপান্তর সংক্রান্ত লেনিনবাদী ধারণাকে আরো সমৃদ্ধ ও তীক্ষè করেছেন।

তৃতীয়ত, জ্ঞানের দুই উলম্ফণের তত্ত্বঃ কমরেড প্রচণ্ড বস্তু ও সচেতনতা এবং বস্তুগত ও আত্মগত উপাদান সম্পর্কে জ্ঞনের দুই উলম্ফনের তত্ত্বকে আরো বিশুদ্ধ ও সমৃদ্ধ করেন। অনিবার্যতা ও ঘটনা, বাস্তবতা ও সম্ভাবনা, সমগ্র ও অংশ, সার ও রূপ, তত্ত্ব ও অনূশীলন এবং বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের মধ্যে এক জীবন্ত দ্বান্দ্বিক ঐক্য প্রকাশিত হতে দেখা যায় প্রচন্ড পথের জ্ঞানের তত্ত্বে।

. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল ধারণাসমূহের ওপর কমরেড প্রচণ্ড বলেন,”প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে, শ্রেণী সংগ্রামের প্রকৃতির স্তরও নির্ধারিত হয় উrপাদিকা শক্তি ও উrপাদন সম্পর্কের মধ্যকার দ্বন্দ্বের চরিত্র অনুসারে।কিন্তু উrপাদিকা শক্তিসমূহের বিকাশের স্তর যাই হোকনা কেন প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে শ্রেণীসংগ্রামের বিকাশ সংঘটিত হয়েছে ধারাবাহিকতায় বিচেছদ এবং পশ্চাদপদ শ্রেণীর বিরূদ্ধে অগ্রসর দৃষ্টির শ্রেণীর সচেতন সংঘাতের রূপে অর্থাr বিপ্লবের রূপে। সামাজিক বিপ্লবের এই প্রক্রিয়া না সংঘটিত হয়েছে স্বতস্ফূর্ত ও ক্রমান্বয়ে, না বস্তুগত পরিস্থিতির বিকাশের বিপরীতে কোন ব্যক্তি বিশেষের ইচছায়। কিন্তু তা উrপাদিকা শক্তি ও উrপাদন সম্পর্কের মধ্যকার দ্বন্দ্বের বিকাশের স্তর দ্বারা নির্ধারিত ও বিধিবদ্ধ হয়।”(প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, পৃঃ ২) এখনে উrপাদিকা শক্তি ও উrপাদন সম্পর্কের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও শ্রেণীসংগ্রামকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, আর দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অনুসৃত হয়েছে যা ইতিহাসকে বস্তুবাদী উলম্ফনের রূপে দেখে। সেই সাথে ইতিহাসের বিকাশের প্রক্রিয়াকে ক্রমান্বয়বাদের সাহায্যে বিচার করে যে স্থূল  বিবর্তনবাদ, আর ইতিহাসকে আত্মগত ইচছার বস্তু হিসেবে দেখে থাকে যে ঐতিহাসিক ভাববাদ- উভয়কে প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করা হয়েছে।

() নেপালী সমাজের ঐতিহাসিক অধ্যয়ন

নেপালী সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে কমরেড প্রচণ্ড বলেন, কেন্দ্রীভূত সামন্ত ক্ষমতার বিকাশের পূর্বে নেপাল কতগুলি ক্ষুদে রাজতন্ত্রীয় ও উপজাতীয় প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সেসময়, রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রের রূপ আজকের মত ছিলনা। নেপালী সমাজ যখন প্রয়োজন রাজা পরিবর্তন করা, রাজা নির্বাচন করা ও দূষ্কর্ম করলে রাজাকে শাস্তি দেয়ার এক্টা দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে, এই বাস্তবতা নেপালী সমাজের মানসিক গঠণ ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করে… সমাজে শ্রেণীসমূহের বিভাজনের সাথে সাথে তূলনামূলক শক্তিশালী রাজাদের দেখা গেছে নিজেদের ইশ্বরের অবতার হিসেবে চিহ্নিত করতে।”(মহান অগ্রগামী উলম্ফণ…পৃঃ ২৫-২৬)।

নেপালী সমাজের বিকাশের প্রক্রিয়া মাতৃতন্ত্র থেকে পিতৃতন্ত্রে সংঘটিত হয়েছে, রাজা মনোনীত করার প্রচলিত উপজাতীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র জন্ম নিয়েছে আর রাজতন্ত্র প্রথমে যে খুবই দুর্বল ছিল কিন্তু শ্রেণী বিভাজনের সাথে শক্তি অর্জন করে, এই বাস্তবতা চমrকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এখানে। অধিকন্তু, রাজার স্বর্গীয় উrস সম্পর্কিত অবতারবাদী ধারণাও এখানে প্রচণ্ডভাবে খন্ডিত হয়েছে।

নেপালী সমাজ কিভাবে বিকশিত হয়েছে? কমরেড প্রচণ্ড বলেন, ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দিক থেকে নেপালের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে সহজে দেখা যায় যে নেপালের জনগন প্রাকৃতিক শক্তিসমুহের বিভিন্ন জটিলতার বিরূদ্ধে এবং বিবিধ মনুষ্য সৃষ্ট সমস্যাসমুহের বিরূদ্ধে নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ও বিকাশের জন্য সংগ্রাম করে আসছেন। একদিকে সরল ও নিষ্পাপ জনগন তাদের স্বাভাবিক অথনৈতিক ব্যবস্থা ও উপজাতীয় সংস্কৃতি সহকারে চড়াই উrড়াইয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচার জন্য সংগ্রামরত, অন্যদিকে মুসলিম দ্বারা পরাজিত হবার পর দক্ষিন দিক থেকে উrপাদনের উন্নত প্রযুক্তি ও যুদ্ধের কলাকৌশল সহকারে এদেশে হিন্দুরা অনুপ্রবেশ করে। এই ঐতিহাসিক পর্যায়ে রাজকুমার ও সর্দার (শিফটেইন) দের উত্থান আর যে সংগ্রাম তাদের নিজেদের মধ্যে ব্যপৃত রাখে তা জনগণকে সহিংস সংগ্রামে শিক্ষিত হতে বাধ্য করে images3যা ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। নেপালী জনগন, যারা তাদের বিকাশের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সামরিক ও যূদ্ধ পরাক্রম অর্জন করেছে, তারা পরে আধুনিক জ্ঞান, উন্নত অস্ত্র, প্রযুক্তি ও কৌশল সজ্জিত দক্ষিণে ব্রিটিশদের আর উত্তরে চীনাদের বিরূদ্ধে সাহসের সাথে লড়তে সক্ষম হয়েছে। নিজ সার্বভৌমত্বের জন্য তারা যে যুদ্ধ চালিয়েছে তাতে শিশু, বৃদ্ধ, নারী ও তরুণরা দেশে তৈরী অস্ত্র ও গোলাবারুদের ওপর ভিত্তি করে অভূতপূর্ব ত্যাগ, সাহসিকতা ও চাতুর্য প্রদর্শন করেছে। এটা এমনকি বৃহr সাম্রাজ্যবাদী বহিনী ও তাদের কমান্ডারদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করেছে  নেপালী (গোর্খালী) জনগনকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম যোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনকি আজকেও অতীত ইতিহাসে নেপালী জনগনের সমর শৌর্য, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগকে স্মরনকরে প্রতিটি নেপালী গর্ব বোধ করে। এটা কোনভাবেই কম গর্বের নয় যে কার্ল মার্কস যিনি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রবক্তা ও বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণীর নেতা ছিলেন, তিনিও সেসব যূদ্ধে নেপালী জনগন প্রদর্শিত আত্মত্যাগ, সাহসিকতা ও দক্ষতার প্রশংসা করেন।”(মাওবাদী, ডিসেম্বর, ১৯৯৫, পৃঃ ১)

নেপালী ইতিহাসের বিনির্মানের প্রক্রিয়ায় জনগনের আত্মনিবেদন, আত্মত্যাগ, ও সাহসিকতার ভূমিকা, শ্রেণীসংগ্রাম, সহিংসতার ব্যবহার এবং বিভিন্ন যুদ্ধের পরিস্থিতি এখানে চমrকার চিত্রিত হয়েছে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে কমরেড প্রচণ্ড খুব গভীরভাবে ও বস্তুগতভাবে কেন্দ্রীয় সামন্ত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নকে উপস্থাপিত করেন। তিনি বলেন, নতুন উrপাদন সম্পর্কের প্রয়োজন পূর্বতন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের দাবী করে আসছিল, আর তা দেশে ক্ষুদে রাজা, সর্দার (শিফটেন)  ও উপজাতীয়  প্রজাতন্ত্রসমূহের উপস্থিতির অপ্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করেছিল। এই বস্তুগত প্রয়োজনীয়তা একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত সামন্ত ক্ষমতার বিকাশে চালিত করে। নতুন উদ্ভূত ও দূর্বল রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও, সামন্ত ক্ষমতার সম্প্রসারণে পৃথ্বি নারায়ণ শাহের অভিযানের সাফল্যের পেছনে এই বস্তুগত প্রয়োজনসমূহ পেছন থেকে কাজ করছিল, এই সত্যকে অবমূল্যায়ন করার অর্থ হচেছ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে বুঝতে না পারা। এখানে উলেখ্য যে, সামন্তীয় পরম রাজতন্ত্রের বিকাশ সংক্রান্ত নেপালী প্রক্রিয়া পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষেট্রর উদ্ভব শীর্ষক ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের বইয়ে আনা তদন্ত ও সংশ্লেষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”(মহান অগ্রগামী উলম্ফণ…পৃঃ ২৬)

এখানে কমরেড প্রচণ্ড কেন্দ্রীয় সামন্ত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠাকে নেপালী সমাজের বিকাশের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় বস্তুগত প্রয়োজনীয়তা হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু সেই সাথে তিনি কেন্দ্রীয় সামন্ত ক্ষমতার নেতিবাচক দিকের প্রতি সমানভাবে মনোযোগ প্রদান করেন। তিনি আরো বলেন, নেপালে কেন্দ্রীভূত সামন্ত রাষ্ট্র হিন্দু সামন্ত ও ব্রাহ্মন্যবাদী বর্ণবাদী উগ্রজাতীয়তাবাদকে বিভিন্ন বর্ণ, আদিবাসী জনগন ও অঞ্চলের ভাষাগত, ধর্মীয় ও কৃষ্টিগত গণতান্ত্রিক ধারণাগুলোর ওপর আরোপ করে প্রকৃত জাতীয় ঐক্য ও শক্তির বিকাশে বাঁধা প্রদান করেছে; এবং আজকে বর্তমান নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পেক্ষ্রাপটে আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার অনুসারে সমতা ও স্বাধীনতা ভিত্তিক এক শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।”(প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৩)। কমরেড প্রচণ্ড মনে করেন পৃথ্বিনারায়ণ শাহ  কর্তৃক আনীত হিন্দু সামন্তীয় ও ব্রাহ্মাণ্যবাদী বর্ণবাদী উগ্রজাতীয়তাবাদ ভিত্তিক ঐক্য  ছিল প্রকৃত জাতীয় ঐক্যের বাঁধা, এবং বিপরীতে তিনি আত্মনিয়šত্রনাধিকারের ভিত্তিতে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে একটি নতুন পথে এক বাস্তব ও শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করেন।

একই দলিলে তিনি বলেন, যদিও নেপাল আনুষ্ঠিকভাবে সার্বভৌম, বাস্তবে সে ২০০ বছর যাবr আধা-উপনিবেশিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচেছ। বৃটিশদের সাথে কূখ্যাত সুগৌলি চুক্তি পরবর্তী পরিস্থিতি নেপালে সামন্তবাদের গর্ভে পুঁজিবাদের স্বাভাবিক গড়ে ওঠায় বাঁধা সৃষ্টি করেছে। তখন থেকে নেপালী সমাজে বিদেশী পুঁজির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে অর্থনীতি ছত্রভঙ্গ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যে অর্থনীতি কৃষি, ব্যবসা, বিনিময় প্রভৃতি ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতার দিকে যাচিছল। বিদেশী পুঁজির স্বার্থে কিছ ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশের সাথে নেপাল সামন্তীয় থেকে আধা-সামন্তীয় পরিস্থিতিতে ধারাবাহিকভাবে বাঁক নেয়। এভাবে, এখন পর্যন্ত নেপালে একটি আধা-সামন্তবাদী আধা-উপনিবেশিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।”(প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫) এই সত্য চমৎকারভাবে এখানে উন্মোচিত হয়েছে যে সুগৌলী চুক্তির পর বিদেশী পুঁজির প্রবেশ নেপালের আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে, আর এই প্রক্রিয়ায় নেপাল আধা-সামন্তবাদী আধা-উপনিবেশিক দেশে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ায় নেপালে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ জন্ম নেয়। এটি ছিল নেপালের ইতিহাসে আরেকটি বাঁক। কমরেড প্রচণ্ড আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ কে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের এক অপবিত্র জোট বাঁধার মাধ্যমে উদ্ভূত জারজ সংকর হিসেবে সূত্রায়িত করেন। আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের ওপর ভিত্তি করে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার জোট বাঁধার এমন প্রক্রিয়ায় একদিকে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকরা সামনে আসে অপরদিকে নেপালে মহান দেশপ্রেমিকরা জন্ম নেয়। এই জোট একদিকে জনগনের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র সম্পর্কে বিভ্রম ছড়ায় আর অন্যদিকে ১৯৪৯ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত গণআন্দোলনগুলোকে বিশ্বাসঘাতকতার আপোষে চালিত বহুবিধ ষড়যন্ত্রের জাল বোনে। জনগনকে বিভ্রান্তকারীদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে কমরেড প্রচণ্ড বলেন, “সামন্তবাদ জাতীয়তাবাদের কথা বলে আর সাম্রাজ্যবাদ একইভাবে গণতন্ত্রের কথা বলে শুধুমাত্র জনগনকে বিভ্রান্তকরার জন্য। সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের বৈশিষ্টসমূহ আর নেপালে আমাদের নিজ অভিজ্ঞতা থেকে এটা পরিস্কার যে সামন্তবাদ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যায়না আর সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদের বিরুদ্ধে যায়না। “(প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০)

জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে এসব ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয়তাবাদের নামে রাজাকে অনুসরণ আর গণতন্ত্রের নামে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারনবাদের পেছন পেছন চলার লেজুরবাদ নেপালী কমিউনিস্ট আন্দোলনে মারাÍক হয়েছিল। এখানে যে মূল চেতনা কমরেড প্রচণ্ড বর্ণনা করতে চান তহলো সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ কর্তৃক জনগনের মধ্যে ছড়ানো বিভ্রান্তি ছিন্ন করে ও লেজুরবাদকে বিরোধিতা করে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের উচিত তাদের নিজেদের স্বাধীন উদ্যোগে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের যুদ্ধ সংগঠিত করায় ও বিকাশে কঠোর প্রচেষ্টা চালানো। এর সারবস্তু হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহার বিপ্লবের যুগে কেবলমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রকে লক্ষ্য করে বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারে, আর কেবলমাত্র এই পথেই, সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সাথে জনগনের মূল দ্বন্দ্বসমূহ  সমাধা হতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে, নেপালী সমাজের বিকাশের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া অধ্যয়ন করে কমরেড প্রচণ্ডের লেখা “ঐতিহাসিক বিকাশের প্রেক্ষাপটে নেপালী নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুদ্ধের কর্মনীতি“ শীর্ষক একটি নিবন্ধ বিশেষ তাrপর্য বহন করে। এই প্রবন্ধে, ১৯৪৯ থেকে নেপালী সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় চালিত সশস্ত্র বিদ্রোহসমূহ, গণআন্দোলনসমূহ ও সেইসঙ্গে বিদ্যমান শ্রেণীসংগ্রাম ও যুদ্ধের বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন করা হয়েছে। এই অধ্যয়নের একটি উপসংহার হিসেবে তিনি বলেন, “ ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি যে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাওয়ের রণকৌশল দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শুধু তাই নয়, নেপালের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার বিকাশের সাথেও। আমাদের মতো দেশগুলোতে গণযুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া ছাড়া কোন  নতুন সমাজের প্রশ্নই উঠতে পারেনা। শ্রেণীসংগ্রামের অভিজ্ঞতা এটাই দেখিয়েছে যে আজকে বিশ্বে গণযুদ্ধের কোন বিকল্প নেই। গণআন্দোলন ও সংসদীয় সংগ্রামকে প্রধান বলে জনগনকে ভাওতা দেয় যে সুবিধাবাদী বিভ্রম, তাকে চূর্ণ করে গণযুদ্ধের প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগন হচেছ ইতিহাসের স্রষ্টা। বীরত্বের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধ নেপালী জনগনকে নেতৃত্ব যোগান দেয়া কমিউনিস্টদের আজকের দায়িত্ব। “(মাওবাদী, পৃঃ ১৫)

শুধু মালেমার ভিত্তিতে নয় বরং নেপালী সমাজের ইতিহাস ও বর্তমানের বৈশিষ্টের ভিত্তিতে নেপালে যে দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ অনিবার্য এই সত্য এখানে চমrকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। অন্যদিকে, গণআন্দোলন ও সংসদীয় সংগ্রাম প্রধান বলার সুবিধাবাদকেও উন্মোচন করা হয়েছে যা গণযুদ্ধকে বিরোধিতা করে।

কমরেড প্রচণ্ড কর্তৃক উপস্থাপিত নেপালী সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধ্যয়ন থেকে এটা পরিস্কার যে নেপালী সমাজ তার উপজাতীয় স্তর থেকে অর্থাr মাতৃতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক স্তর থেকে উrপাদন সংগ্রাম, শ্রেণীসংগ্রাম ও

বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধের প্রক্রিয়া সহকারে বর্তমান আধা-সামন্তবাদী আধা উপনিবেশিক পরিস্থিতিতে বিকশিত হয়েছে ক্ষুদে সামন্ত রাজ্যসমূহ কর্তৃক পরিচালিত সামন্তীয় কেন্দ্রীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে। ইতিহাসের এই অধ্যয়ন থেকে কিছু অন্তর্দৃষ্টি ও নেপালী বিপ্লবের নির্দিষ্ট কিছু নিয়মসমূহ এখানে প্রকাশিত হয়েছে।

() বিশ্ব বিপ্লবের পেক্ষ্রাপট

কমরেড প্রচণ্ড নেপালী সমাজ ও বিপ্লবের বৈশিষ্ট অধ্যয়নের প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের বিপ্লবের পেক্ষ্রাপটের প্রতিও প্রযোজনীয় মনোযোগ প্রদান করেন। কমরেড প্রচণ্ড বলেন, এই অঞ্চলের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির কারনে এটা পরিষ্কার যে একচেটিয়া বুর্জোয়া ভারতীয় শাসক শ্রেণী ও বিভিন্ন দেশে তার এজেন্টেদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের অনিবার্যভাবে একটি একক রননীতি অবলম্বন করা প্রয়োজন। এই অনিবার্যতা এই অঞ্চলের একুশ শতকের নয়া সোভিয়েত ফেডারেশন-এ রূপান্তরিত প্রয়োজনীয়তার দরজায় করাঘাত করেছে।”(মহান অগ্রগামী উলম্ফণ.. …পৃঃ ২৪)

এখানে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিসমুহের সংগ্রামে, একটি সাধারণ দায়িত্ব হিসেবে একটি ঐক্যবদ্ধ রননীতি বিকশিত করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদান করা হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ রননীতির ধারণা ও নয়া সোভিয়েত ফেডারেশনের ধারণা বিশেষ তাrপর্য বহন করে।

কমরেড প্রচণ্ড এই প্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের বর্তমান যুগের সামগ্রিক বৈশিষ্টসমূহ অধ্যয়নের প্রশ্নে বিশেষভাবে গুরত্ব প্রদান করেন। কমরেড প্রচণ্ড বর্তমান কালের সাম্রাজ্যবাদের বৈশ্ষ্টিসমূহ আর বিপ্লবের জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক যা সে উrসারিত করে তা আলোচনা করে বলেন, বর্তমান বিশ্বে মুনাফা লোটার অসr আকাংখা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ যে নির্দিষ্ট পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তার দিকে আমাদেরকে অতি অবশ্যই গুরত্ব সহকারে মনোযোগ প্রদান করা দরকার। প্রথমত, এঁটা অনিবার্যতার বিশ্ব থেকে স্বাধীনতার বিশ্বে জনগনের সচেতন গমনের গতি ত্বরান্বিত করার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে জনগণের বিপুল সংখ্যার সস্ত শ্রমশক্তির সাথে উচ্চ প্রযুক্তির যোগ সাধন করে। দ্বিতীয়ত, মুনাফা লুটতে ভূমণ্ডলীকরণের সাথে সাথে তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রধানত ইলেক্ট্রনিক্স-এর ক্ষেত্রে N-01_R4অভূতপূর্ব বিকাশ বিশ্বকে একটি ক্ষুদ্র গ্রামীণ এককে সংকুচিত করে ফেলেছে। তাই, খুব স্বাভাবিক যে, যে কোন স্থানে একটি ঘটনা সমগ্র বিশ্বে সামগ্রিকভাবে বিরাট ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এবং বিপরীতটাও সত্য। তৃতীয়ত, অস্ত্র উrপাদন ও বিনিময়ের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়া পরোক্ষভাবে বিশ্বব্যাপী গণযুদ্ধের প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির ভূমিকা পালন করছে। চতুর্থত, এর সামাজিক প্রক্রিয়ার সীমাহীন উৎপাদন ও ভূমণ্ডলীকরন আশ্চর্য দ্রুতগতিতে সামর্থ্য অনুসারে কাজ ও প্রয়োজনানুযায়ী বন্টনের বস্তুগত ভিত্তি গঠণ করেছে। পঞ্চমত, প্রধানতঃ সাম্রাজ্যবাদ শ্রেণীসংগ্রামকেঃ প্রধানত সাম্রাজ্যবাদ বনাম নিপীড়িত জাতি ও জনগণের দ্বন্দ্বকে সর্বোচ্চত তীব্রতর করার মাধ্যমে বিশ্বের শতকরা ৮০ ভাগ জনগণের জন্য এক বিপ্লবী বস্তুগত পরিস্থিতি প্রস্তুত করে চলেছে।”(মহান অগ্রগামী উলম্ফন,…পৃঃ ১৯-২০)

মুনাফা লোটার সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য এবং ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তি সহকারে উrপাদিকা শক্তির তীব্র বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ভূমণ্ডলীকরণের মাধ্যমে গুণযুদ্ধের প্রস্তুতি ও কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার বস্তুগত ভিত্তি গড়ে উঠে আসছে- এই বাস্তবতা চমৎকারভাবে এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। লেনিন ও মাওয়ের পর, সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের অর্থনীতির নয়া বৈশিষ্টসমূহ খুবই সময়োচিতভাবে, গভীরভাবে ও চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ভূমণ্ডলীকরণের প্রক্রিয়ায় বিশ্ব যখন একটি ক্ষুদে গ্রামাঞ্চলে পরিণত হয়েছে, আজকের সেই নয়া পরিস্থিতিতে বিপ্লবী যুদ্ধের তত্ত্বগত ধারণার কথা চিন্তা করা কতটুকু যথোচিত? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আজকে সশস্ত্র অভ্যূথ্যান ও দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্দের রণনীতির পারস্পরিক ফিউশন (মিথস্ক্রিয়া) জরুরী হয়ে দাঁড়িযেছে।  এটা করা ছাড়া কোন দেশে সত্যিকার বিপ্লব অসম্ভব প্রতীয়মান হয়।” (মহান অগ্রগামী উলম্ফণ,…, পৃঃ ২০) বিপ্লবী যুদ্ধের তত্ত্বগত ধারণা সম্পর্কে, দুই রণনীতির ফিউশন (মিথস্ক্রিয়া)-এর এই নয়া তত্ত্বের সার্বজনীন তাrপর্য রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী একক বিশ্বব্যবস্থা ও নেপালে তার ক্রমবর্ধিত হস্তক্ষেপের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপ্লবকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে বিপ্লব পরিচালনার মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক লাইনের বিকাশ অপরিহার্য। কমরেড প্রচণ্ড এই প্রশ্নের বিশেষ গুরত্বারোপ করেন যে, গোঁড়ামীবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে পার্টিকে সতর্ক হতে হবে, যা এমন ধরণের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ ও জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতাকে মোকাবেলা করে বিপ্লবকে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ে নিয়ে যাওয়ার যে চ্যালেঞ্জ উত্থিত হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত হচেছ একটি সঠিক মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক লাইন বিকাশের চ্যালেঞ্জ।

মূর্ত বাস্তবতার মূর্ত বিশ্লেষণ দ্বারা কোন পার্টি যদি নতুন পরিস্থিতিতে একটি মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক লাইন গড়ে তুলতে

ব্যর্থ হয়, গোঁড়ামীবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন বিপ্লবকে বিজয়ের পথে পরিচালনা করা অসম্ভব।” (বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য, পৃঃ ৫)। মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক লাইনের বিকাশ সংক্রান্ত যে ধারণাগুলো এখানে উপস্থাপিত হলো তত্ত্বগতভাবে তার সুদূরপ্রসারী তাrপর্য রয়েছে। লাইনের বিকাশের এই প্রশ্ন বিপ্লব সম্পদন করার ও প্রতিবিপ্লব ঠেকানোর মহান লক্ষ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকে মূল্যায়ন করা ও আধুনিক, গোঁড়ামীবাদী ও বহুত্ববাদী সংশোধনবাদকে বিরোধিতা করার প্রক্রিয়ায় তাঁর “মহান অগ্রগামী উলম্ফণঃ ইতিহাসের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা” শীর্ষক দলিলে কমরেড প্রচণ্ড কতগুলি গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেন যা কমিন্টার্ন, স্তালিনের ভূমিকা ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে প্রতিবিপ্লবের ইতিহাসের নয়া কৌতুহল ও অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে। ইতিহাসে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগ সম্পর্কে এটাকে একটা বিশেষ সূক্ষাতিসূক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

এই প্রক্রিয়ায় আরেকটি যোগসূত্র হিসেবে, বিশ শতকে বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবসমূহের অভিজ্ঞতার অধ্যয়ন প্রক্রিয়ায় কমরেড প্রচণ্ড খুবই গুরত্ব সহকারে বলেন, “কেন সেসব পার্টি যারা ভেতরে ও বাইরে বিপ্লবের পর্যাযে মতাদর্শগতভাবে ডান, বাম ও মধ্যপন্থী বিচ্যুতিসমূহের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে বিজয় অর্জন করেছিল, জনগনের প্রয়োজনীয়তা ও স্বার্থের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আর শত্রুর বিরূদ্ধে শ্রেণীযুদ্ধের ভুবন কাঁপানো বীরত্বের ও আত্মত্যাগের অভূতপূর্ব রেকর্ড অর্জন করে ক্ষমতা দখলের অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী আমলাতান্ত্রিক, সংশোধনবাদী, গণবিচ্ছিন্ন ও প্রতিবিপ্লবীতে পরিণত হলো? মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবে আরোহন করে নিশ্চিতভাবে মালেমা এ প্রশ্নের একটা মূল তত্ত্বগত উত্তর জুগিয়েছে। কিন্তু ঐসব মূল তত্ত্বে সাংগঠনিক নীতিমালা, পদ্ধতি, ধারণা বিকাশের প্রয়োজনীয়তা এখনো বিদ্যমান, যাতে প্রতিবিপ্লবকে প্রতিহত করতে সেগুলো প্রয়োগ করা যায়। এঁটা হচেছ পার্টির অভ্যন্তরে দুই লাইনের সংগ্রাম ও সর্বহারা একনায়কত্বের অধীনে বিপ্লবের তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ ও বিকাশের সমস্যা” (বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য, পৃঃ ৯)

কমরেড প্রচণ্ডের উপস্থাপিত এই ধারণাগুলো মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জন্ম নিয়েছে, কিন্তু তা থেকে অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে। অতঃপর, দুই লাইনের সংগ্রাম ও সর্বহারা একনায়কত্বের অধীনে অব্যাহত বিপ্লবের তত্ত্বকে কীভাবে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রয়োগ ও বিকশিত করা যায়? ইতিহাসের অভিজ্ঞতার অন্তসার চিত্রিত করে কমরেড প্রচণ্ড এই প্রশ্নের উত্তরে একুশ শতকের গণতন্ত্রের বিকাশের ধারণা তুলে ধরেন। এই ধারণা পার্টি, বাহিনী ও রাষ্ট্রক্ষমতা সম্পর্কিত।

) মূল ধারণা

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তিতে নেপালী সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশ, বর্তমান পৃথিবীর রাজনৈতিক বিশিষ্টতাসমূহ ও বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতাসমূহের প্রক্রিয়ায় যে অধ্যয়ণ কমরেড প্রচণ্ড করেন তা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল ধারণাসমূহ উপস্থিত করেছে, উন্মোচিত ও সমৃদ্ধ করেছে। এই ধারণাসমূহকে সংক্ষেপে নীচের মতো করে উপস্থিত করা যায়ঃ

)      ইতিহাসের বিনির্মানে জনগণের ভূমিকাঃ

রাজা ও বীরেরা যে ভূমিকা পাল করে তার বিরুদ্ধে আর অবতারবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে কমরেড প্রচণ্ড নেপালী জনগনকে ইতিহাসের হিসেবে নির্মাতা তুলে ধরেন। ইতিহাসে ও বর্তমানের পৃথিবীতে শ্রেণীশত্রু ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জনগন যে ভূমিকা পালন করেন তা কমরেড প্রচণ্ড ঘনিষ্ঠভাবে আত্মস্থ করে আসছেন। কমরেড প্রচণ্ডের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে, যদি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়, যত কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতি হোক, বিপ্লবের বিজয় সুনিশ্চিত। এই ধারনার উপর ভিত্তি করে প্রচণ্ড পথের গণলাইন গঠিত।

) শ্রেণীসংগ্রাম বলপ্রয়োগের ভূমিকাঃ

কমরেড প্রচণ্ড প্রতিভার সাথে নেপালী ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে উrপাদিকা শক্তি ও উrপাদন সম্পর্কের মধ্যকার সংগ্রাম, শ্রেণীসংগ্রাম, বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ ও সহিংস বিপ্লবের ভূমিকা প্রকাশ করে দেন। এই প্রাসঙ্গিকতায় তিনি এই সত্য স্বচ্ছ করেন যে, নেপালী সমাজের বিকাশের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী চরিত্রের গেরিলা যুদ্ধ একটি ভূমিকা পালন করেছে। সহিংস বিপ্লবের সার্বজনীন তাৎপর্যকে তিনি খুব গুরুত্বের সাথে আলিঙ্গন করেন। ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য ও মালেমার ভিত্তিতে গণযুদ্ধের তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরে কমরেড প্রচণ্ড তাকে বিকশিত করে আসছেন।

) নেপালী বিপ্লব বিশ্ব বিপ্লবের মধ্যকার সম্পর্কঃ

কমরেড প্রচণ্ড নেপালী নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের অবিচেছদ্য অংশ হিসেবে আঁকড়ে ধরে আসছেন। তিনি এই সত্যের ওপর চমৎকারভাবে আলোক সম্পাত করে আসছেন যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে যে উত্থান ও পতন, সাযুজ্যতা ও প্রতিকূলতার প্রভাব উত্থিত হচেছ তা গুণগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এই কারণে যে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের বর্তমান যুগে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে একটি অশুভ জোট গড়ে উঠেছে, আর তাছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তীব্র বিকাশের কারণে বিশ্ব সংকুচিত হয়ে এসেছে। তিনি নেপালকে বিশ্ব বিপ্লবের একটি ঘাঁটি হিসেবে দেখেছেন। এসব উপাদানই পার্টির লাইন নির্ধারন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

) ইতিহাস বিপ্লবে সচেতন ভূমিকার তাrপর্যঃ

কমরেড প্রচণ্ড গুণগত ধাক্কা (পুশ) ও সচেতনতার ভূমিকা সংক্রান্ত ধারণা তীক্ষ্ণতর করেন যা ইতিহাসের বিকাশে জনগন ও বিপ্লবীদের পালন করা উচিত। সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বকারী ভূমিকা, স্বাধীন উদ্যোগ, সৃজনশীলতা, আত্মগত প্রস্তুতি, গুণগত ধাক্কা ইত্যাদির মতো বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধারণা-যা প্রচণ্ড পথ কতৃক উপস্থাপিত হয়েছে এই সত্যের উপর দাঁড়িয়ে।

) অব্যাহত বিপ্লবের তত্ত্বঃ

এই ধারণা এটা বিবৃত করে যে শ্রেণীসংগ্রামের দীর্ঘস্থায়ী চরিত্র অনুসারে দুই লাইনের সংগ্রামের প্রকৃতিও দীর্ঘস্থায়ী। বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের অভিজ্ঞতাসমূহ, আর যা সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়কালে চেয়ারম্যান মাও কর্তৃক বিকশিত হয়েছে সেই সর্বহারা একনায়কত্বধীনে অব্যাহত বিপ্লবের তত্ত্বকে তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরে এটা দাঁড়িয়ে।

) বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী বিপ্লবের লাইন

বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী ও লাইনের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রয়েছে। একদিকে, বিপ্লবী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী একটি পাটির লাইন গড়ে তোলায়, বিশুদ্ধকরনে ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে অন্যদিকে বিপ্লবী লাইন এ ধরণের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী সমৃদ্ধকরন ও বিকাশে মূর্ত শক্তি যোগায়। প্রচণ্ড পথ বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী ও লাইনের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে একদম ঠিক এইভাবে আত্মস্থ করেছে। দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রয়োগের ওপর ভিত্তি করে নেপালী বিপ্লবের রাজনৈতিক লাইন ও সামরিক লাইন নির্মান ও গড়ে তোলার কাজে কমরেড প্রচণ্ড এক নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেন। ধারণা, কর্মনীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচির সামগ্রিকতার ওপর এই লাইন দাঁড়িয়ে।

() শ্রেণীসংগ্রামের প্রশ্ন

দ্বন্দ্ব চিহ্নিত করা ও মীমাংসা সম্পর্কে কমরেড প্রচণ্ড বলেন, গণযুদ্ধ পরিচালনা করা ও বিপ্লব সম্পাদন করা মানে সমাজে বিদ্যমান বৈর দ্বন্দ্বসমূহ সমাধান করা। শুধু একটি নয়, যে কোন সমাজে বহু দ্বন্দ্ব রয়েছে, আর আমাদের আধা-সামন্তবাদী ও আধা-উপনিবেশিক সমাজেও। সকল সামন্তবাদ বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শ্রেণী, স্তর ও বর্ণ জনগনের বর্গে পড়ে (যেমন, উদাহারণস্বরূপ শ্রমিক, গরীব কৃষক ও ধনী কৃষক, ক্ষুদে বুর্জোয়া ও জাতীয় বুর্জোয়া পর্যন্ত)। তাদের মধ্যেও অসংখ্য দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। একইভাবে এমনকি শাসকশ্রেণীর মধ্যেও সামন্ত, আমলাতান্ত্রিক ও মুrসুদ্দি শ্রেণীসমূহের প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের দ্বন্দ্ব রয়েছে, এবং প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যেও দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের জালসমূহ বুঝতে ও তাদেরেকে একটি একটি করে সমাজকে সামনের এগিয়ে নিতে মালেমা আমাদেরকে চাবিকাঠি জুগিয়েছে। শ্রেণী বিশেষণ করা, শত্র“ ও মিত্রের মধ্যে পার্থক্যকরণ, মিত্রদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে মীমাংসা করে প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে N-02_R1শ্রেণীমিত্রদের ঐক্যবদ্ধ করা, মিত্র ও শত্র“শ্রেণীসমূহের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বসমূহের মধ্যে প্রধান খুঁজে বের করা, শুধু তাই নয়, শত্রুশ্রেণীসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্বসমূহকে সচেতন ভাবে ব্যবহার করা, একবারে একটি লক্ষ্যবস্তুর ওপর এক মুষ্টিতে আঘাত হানা এবং অন্য শত্রুকে অস্থায়ী মিত্র বানানো, যদি সম্ভব হয় অথবা নাও হয়, একটি লক্ষবস্তুর ওপর আঘাত হানার সময় অন্যটিকে নিষ্ক্রিয় করা। এইভাবে, একটি নির্দিষ্টকালে, বিশ্ব, দেশ, অঞ্চল, শ্রেণী ও গ্রামের এলাকার প্রেক্ষাপটে এবং একটি নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে ও দ্বন্দ্বসমূহের সঠিক চিহ্নিতকরণ ও মীমাংসা হচেছ কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশে ও জনগনকে একের পর এক বিজয়ে চালিত করতে গ্যারান্টিযুক্ত মার্কসবাদী অস্ত্র।”(নেপালী বিপ্লবের সমস্যা, খণ্ড-২, পৃঃ ৫০-৫১)

দ্বন্দ্বের নিয়মসমূহের ভিত্তিতে শ্রেণীসংগ্রামের সমস্যাসমূহ বোঝা ও সমাধান করার একটি দার্শনিক অন্তদৃষ্টি এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। মূর্ত বাস্তবতার মূর্ত বিশ্লেষণ চালিয়ে প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করা, অপরাপার শত্রুদেরকে নিজেদের পক্ষে আকর্ষণ করা অথবা তাদের নিষ্ক্রিয় করার প্রচেষ্টা চালানো, এবং মিত্রদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে সমাধান করার একটা দার্শনিক পথনির্দেশ এখানে চমrকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

রাজনৈতিক ও সামরিক লাইনের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড পথ কার্যকরভাবে ধারাবাহিকতায় বিচেছদ, বিপ্লব, গুণগত উলম্ফণ ও বিপর্যয়- এর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ধারণার প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা করে আসছে। অসংখ্য ঝাঁক ঝাঁক গণবিদ্রোহ ও অতর্কিত সামরিক আক্রমণের মধ্য দিয়ে গণযুদ্ধের সূচনা, এর ধারাবাহিকতা ও বিকাশ সংঘটিত হয়েছে। মূল সত্ত্বা, বিশিষ্টতা ও বিশালত্ব বের করে আনতে প্রচণ্ড পথের দ্বন্দ্বতত্ত্ব হচেছ খুবই জঙ্গী, বিপ্লবী ও মহr।

প্রচণ্ড পথের মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও সামরিক লাইন গণলাইনের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে। এ সম্পর্কে কমরেড প্রচণ্ড বলেন, “‘জনগনই হচেছন ইতিহাসের স্রষ্টা’ এই বিখ্যাত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী নীতিকে আঁকড়ে ধরে নেপালের মূর্ত অবস্থা অনুযায়ী পার্টি সামগ্রিক গণলাইন বিকশিত করছে। জনগনের বিদ্রোহসমূহের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া সংশ্লেষিত করে পার্টি জনগনের বিদ্রোহের আকাংখাকে সংগঠিতকরণের প্রশ্নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করে আসছে। গনযুদ্ধের মাধ্যমে গণক্ষমতা করায়ত্ব করার লক্ষ্য ছাড়া গণসমাবেশিতকরণ ও গণলাইনের কথা বলা হচেছ সংশোধনবাদ।”(মহান অগ্রগামী উলম্ফণ…,পৃঃ ৭১-৭২)। নিপীড়িত জাতিসমূহ, আদিবাসী, নিম্নশ্রেণী, দমিত জনগণ ও নারীদের আকাংক্ষা সংগঠিত করার, এবং জনগনকে তাদের সাহায্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভু বানানোর আর, জনগন থেকে জনগনের দৃষ্টিভঙ্গীর উপলব্ধীর ওপর এই গণলাইন দাঁড়িয়ে। এখানে জনগনকে ধোঁকা প্রদানকারী সংশোধনবাদকে প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করা হয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের বিপদের বাড়ন্ত বর্তমান পরিস্থিতিতে গণযুদ্ধকে বিকশিত করার জন্য মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক লাইন বিকাশের প্রয়োজনীয়তার ওপর কমরেড প্রচণ্ড বিশেষভাবে জোর দেন। এই পরিস্থিতিতে বিকাশের জন্য কী ধরণের  রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়োজন? এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কমরেড প্রচণ্ড বলেন, মালেমার সার্বজনীন নীতি ও ইতিহাসের অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত এক অনস্বীকার্য সত্য হচেছ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করা সম্ভব কেবলমাত্র গণযুদ্ধের প্রক্রিয়ায়। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠার পরিস্থিতিতে বিশ্ব বিপ্লবের নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করে নেপালী গণযুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। যদি ডানপন্থী বিশ্বাসঘাতকতাবাদ অথবা বাম হঠকারিতাবাদ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নেপালী গণযুদ্ধ বিপর্যস্ত হয়, তা কোন না ভাবে বিশ্ব বিপ্লবের বিকাশে এক বিরাট নেতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। অতীত সাত বrসরের প্রচণ্ড জয়মণ্ডিত অভিযানসমূহ ও রণনৈতিক ভারসাম্যের বর্তমান পরিস্থিতির কারনে সাম্রাজ্যবাদী শত্রু গণযুদ্ধের বিরূদ্ধে একটি নতুন রননীতি প্রনয়নে বাধ্য হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, চিলি, ভিয়েতনাম, নিকারাগুয়া ও সর্বশেষ পেরুর অভিজ্ঞতাকে হিসেবে নিয়ে নেপালের গনযুদ্ধকে খতম করতে সাম্রাজ্যবাদ প্রকাশ্য ও গোপন রণনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। তন্মধ্যে সর্বাধিক কার্যকর হতে যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করে তীব্র সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া। এই পরিস্থিতিতে, সঠিক রণনীতি ও রণকৌশলের ভিত্তিতে অগ্রসর হয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরূদ্ধে বিশ্বজনমত বিক্ষুব্ধ ও আক্রমণাত্মক করে তোলার মাধ্যমে বিপ্লবকে বিজয়ে পোঁছানো সম্পূর্ণ সম্ভব। নিশ্চিতভাবে এজন্য পার্টিকে রণকৌশলে কিছু পরিবর্তন, বাঁক ও উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এখানে মূল প্রশ্ন হচ্ছে, একুশ শতকে বিপ্লবের পতাকাকে অবনত না করার রণনৈতিক সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকা।”( বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য; পৃঃ ৫-৬)। বিশ্ব আশাবাদ ও বিজ্ঞান এর উভয দৃষ্টিকোন থেকে এই বক্তব্যগুলো সমৃদ্ধ। বিপ্লবকে সফল করার লক্ষ্যে মহান গণযুদ্ধের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের সমগ্র ষড়যন্ত্রমূলক তrপরতাকে ব্যাখ্যা করে এখানে তাদের বিরূদ্ধে সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল গবেষণা ও বিকাশের প্রক্রিয়ার প্রতি এখানে বিশেষ মনোযোগ প্রদান করা হয়েছে। গণযুদ্ধের লাইন ও কৌশলের বিকাশে এটা একটা নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।

() দুই লাইনের সংগ্রামের প্রশ্ন

কমরেড প্রচণ্ডের উপলব্ধি অনুসারে কমিউনিস্ট পার্টি হচ্ছে একের দুয়ে বিভক্তি। পার্টিও জীবন ও বিকাশের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে পার্টিতে বিদ্যমান দ্বন্দ্বসমূহ ও দুই লাইনের সংগ্রামকে তিনি গ্রহণ করেছেন। বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদের ওপর ভিত্তি করে পার্টি-অভ্যন্তরে দ্বন্দ্বকে সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণের প্রশ্নে ও তাদেও নিরসনে এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করে আসছেন। এই প্রক্রিয়ায়, দুই লাইনের সংগ্রামের কিছু শিক্ষা ও ধারণা গড়ে তোলা হয়েছে।

কমরেড প্রচণ্ড বলেন, পার্টি ঐক্য ও সংগ্রামের সামগ্রিক অভিজ্ঞতাসমূহ থেকে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের যে প্রধান শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে তা হচ্ছে মতাদর্শিক স্বচ্ছতার ওপর গুরুত্ব প্রদান, রাজনীতিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো, গৌণ রণকৌশলগত ও ব্যবহারিক প্রশ্নগুলিতে সর্বোচ্চ নমনীয় থাকা, সুবিধাবাদকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রতি পূর্ণ মনোযাগ প্রদান করা”(নেপালী বিপবের সমস্যাবলী, খন্ড-২, পৃঃ৩২)। দুই লাইনের সংগ্রামকে সঠিকভাবে বোঝা ও পরিচালনার প্রশ্নে এই শিক্ষা দীর্ঘদিন হতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়কালে মাওয়ের নেতৃত্বাধীন শ্রেণীসংগ্রাম ও দুই লাইনের সংগ্রামের প্রশ্নে এক গুরুত্বপূর্ন সংশ্লেষন ঘটে। সেই সংশ্লেষনে যা উল্লেখিত হয়েছে তা হচ্ছে সমাজের শ্রেণীসংগ্রামের দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃতির মতো পার্টির মধ্যকার দুই লাইনের সংগ্রামের প্রকৃতিও দীর্ঘস্থায়ী। এসব সংগ্রাম অদৃশ্য হয়ে যায়না, বরং, মহাসাগরের তরঙ্গমালার মতো কখনো উচ্চ ও কখনো নিুস্তরে থাকে, আর তা থেকে যে নিয়মসমূহ উrসারিত হয় তাকেসহ পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করেই কেবল বিপ্লবকে বিজয়ের পথে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে নেয়া যায়। সংশ্লেষনের ওপর এধরণের ধারণা উদ্ধৃত করে কমরেড প্রচণ্ড বলেন, দুই লাইনের সংগ্রামের প্রকৃতি সম্পর্কে উপরেল্লিখিত সংশ্লেষণ হচ্ছে মালেমার সংশ্লেষন। দুই লাইনের সংগ্রাম হঠাr মিলিয়ে যাওয়া কোন প্রক্রিয়া নয় বরং তা অব্যাহতভাবে বিদ্যমান, কখনো উচ্চ কখনো নিম্নস্তরে,এই সত্য পরিস্কার। যখন দুই লাইনের সংগ্রাম বিকশিত হয়নি ও নিুমাত্রার থাকে তখন তা অবৈরী সংগ্রামের সীমার মধ্যে থাকে আর তা সমালোচনা, আত্মসমালোচনা ও শৃংখলার পদ্ধতির দ্বারা মীমাংসা হয়। কিন্তু যখন তা উচ্চতার মাত্রায় বিকশিত হয় ও আবির্ভূত হয়, তখন তা বৈরি রূপে প্রকাশিত হয়, যা এক গুণগত পদ্ধতির দ্বারা মীমাংসা হয়।”(মাওবাদী, ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯, পৃঃ২২)।

মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও আমাদের পার্টির অভিজ্ঞতাসমূহের ভিত্তিতে কমরেড প্রচণ্ড যে ধারণা সংশ্লেষিত করেন তা প্রণিধাণযোগ্য ও ফলপ্রসূ। এই সংশ্লেষণ নয়া শক্তি যোগান দিয়েছে যা পার্টিকে সমগ্র আন্তর্জাতিক আন্দোলনে বিদ্যমান দুই লাইনের সংগ্রামকে সঠিকভাবে বোঝা ও তার থেকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক শিক্ষা নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে শিক্ষিত করেছে।

প্রচণ্ড পথের দ্বন্দ্ববাদ পার্টিকে বিপরীতের ঐক্য বিবেচনা করে। পার্টি-জীবনে বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদ প্রয়োগ করে; উপদলবাদ, বিভেদবাদ ও সকল ধরণের অ-সর্বহারা চিন্তা, প্রবণতা ও কাজের ধারার বিরূদ্ধে অব্যাহত সংগ্রাম পরিচালনা করে, শুদ্ধি অভিযান প্রক্রিয়াকে সামনে nepal4এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে, মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উচ্চতায় উত্তীর্ণ হয়ে পার্টিকে বিপ্লবী দিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে, ঐক্য-সংগ্রাম-রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সে পথে এগিয়ে এক নতুন ঐক্য অর্জন করার মাধ্যমে দুই লাইনের সমস্যাসমূহের নিরসন এবং পার্টিকে জীবন্ত, গতিশীল, স্বাস্থ্যবান ও জঙ্গী করা প্রভৃতি এই প্রেক্ষাপটে লক্ষনীয়। এখানে বিশেষভাবে উলেখ্য যে প্রচণ্ড পথের বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদ চমৎকারভাবে একস্তম্ভীবাদী সামন্তবিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীকে এবং উপদলবাদ ও বিভেদবাদ অনুশীলণ করার মাধ্যমে পার্টি ঐক্যে বাঁধা সৃষ্টিকারী নেপালী হোজাপন্থী মোহন বিক্রম সিং-এর অনুশীলনকে চূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া বিলোপবাদ, নৈরাজ্যবাদ, ব্যক্তিতাবাদ, বাজে আলোক প্রবণতা* ও বহুত্ববাদ-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রচণ্ড পথের দ্বন্দ্ববাদ চমrকারভাবে সফল হয়েছে। এটা সংগঠন ও সংগ্রামসহ ধারণা, কর্মনীতি, পরিকল্পনা, পরিচালনা ও কর্মতৎপরতার সকল ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ ও কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বের পক্ষে।

সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে সামাজিক বিপ্লব, শ্রেণীসংগ্রাম ও দুই লাইনের সংগ্রামে বস্তুবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্ব প্রয়োগ করা হচ্ছে প্রচণ্ড পথের বিশিষ্টতা। শ্রেণীসংগ্রামের বিকাশের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ও বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষতায় নেপালী নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনৈতিক ও সামরিক লাইনের নির্ধারন ও বিকাশে, আর শ্রেণীসংগ্রাম ও দুই লাইনের সংগ্রামসমূহের সমস্যসমূহের সমাধানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলায় প্রচণ্ড পথ হচ্ছে খুবই বিনীত।

)বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে বিকাশ

ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর ভিত্তি করে একে প্রয়োগ করে সামাজিক জীবন, বিপ্লব ও পার্টিকে ধারণ করে কমরেড প্রচণ্ড সাম্রাজ্যবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি অধ্যয়ন ও নেপালের শ্রেণী বিশেষণের মাধ্যমে কিছু গুরত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ধারণা গড়ে তুলেছেন। এসব তাত্ত্বিক ধারণাসমূহকে সংক্ষেপে নীচের মতো করে উপস্থাপিত করা যায়।

(রণকৌশলগত তত্ত্বসমূহের বিকাশ

মতাদর্শিক সংশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় এই সত্য উল্লেখিত হয়েছে যে প্রচণ্ড পথের আকারে নেপালী বিপ্লবের রণকৌশলগত তত্ত্বসমূহের বিকাশ সাধিত হয়েছে গণযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তাঁর মতে, সেই তত্ত্বসমূহ হচ্ছেঃ রাজনৈতিক ও সামরিক অগ্রাভিযানের ভারসাম্য, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের ভারসাম্য, গণযুদ্ধ ও গণআন্দোলনের ভারসাম্য, প্রধান ও গৌণ অঞ্চলসমূহের মধ্যে ভারসাম্য, স্বাধীন উদ্যোগ ও রণকৌশলগত ঐক্যের মধ্যে ভারসাম্য, কথোপকথন ও কূটনীতির মধ্যে ভারসাম্য, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় যুক্তফ্রন্টের মধ্যে, দেশের ভেতরে ও বাইরের কাজের মধ্যে, সংগ্রাম ও দুই লাইনের সংগ্রামের মধ্যে ভারসাম্য ইত্যাদি।”(নেপালী বিপ্লবের সমস্যাসমূহ, খণ্ড-২, পৃঃ ১৯৫)। এসকল রণকৌশলগত তত্ত্বসমূহ ধারণা, কর্মনীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচিভিত্তিক। সেইসাথে, প্রচণ্ড পথ দ্বারা উপস্থাপিত ও বিকশিত রাজনৈতিক শ্লোগান, জনগণের সরকার, নয়া গণক্ষমতা, সাম্র্রাজ্যবাদ বিরোধী রণনীতি ও রণকৌশল; বিবিধ দ্বন্দ্বের মীমাংসা ইত্যাদি রণকৌশলগত তত্ত্বসমূহের মধ্যে পড়ে যার অনেকগুলোই রণনৈতিক গুরুত্বসম্পন্নও।

() সর্বহারা আন্দোলন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ফিউশন (মিথষ্ক্রিয়া)-এর ধারণা

সর্বহারা বিপ্লবী আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে ফিউশনের এই ধারণা লেনিনবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই সর্বহারা আন্তজাতিকবাদ সহকারে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার ও স্থানীয় স্বশাসন-এর প্রশ্নের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত।

() দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ অভ্যত্থানের রণনীতির মধ্যে ফিউশন (মিথষ্ক্রিয়া)-এর তত্ত্ব

যদিও অভ্যত্থানের পথ মূলগতভাবে উন্নত দেশগুলোর জন্য আর দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের পথ অন্নন্নত দেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্ত আজকের বাস্তবতার দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের অভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্য; আর বিপরীতটা ঘনিষ্ঠভাবে ষুক্ত। এই পরিস্থিতিতে, দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ ও অভ্যুত্থানের ফিউশনের দ্বারা বিকশিত তত্ত্বের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, আর এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সার্বজনীন।

() দক্ষিণ এশীয় নয়া সোভিয়েত ফেডারেশন ধারণা

দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ও নিপীড়িত জনগণের সাধারণ শত্রু হয়ে দাঁড়ানো ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে যৌথভাবে যুদ্ধ করার ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে এই ধারণা। এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবr বিকশিত ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও মুক্তি কামনার সাধারণ অনুভূতিকে এটা তত্ত্বগতভাবে প্রতিফলিত করে।

) একুশ শতকে গণতন্ত্রের বিকাশের তত্ত্ব

পার্টি, বাহিনী ও গণক্ষমতায় গণতন্ত্রের বিকাশের প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে এই ধারণা। এটা সেই ধারণা উপস্থিত করে যা পার্টি, বাহিনী ও ক্ষমতাকে জনগণের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাধীনে রাখার নিশ্চয়তা দেয়, তাদেরকে জনগণের কাজে লাগানোর, সেগুলোকে অব্যাহতভাবে গণতন্ত্রীকরণ ও বিপ্লবীকরণে, এবং এই তিন ক্ষেত্রে বিদ্রোহ করার নিশ্চয়তা বিধান করে। এখানে যেসব বিষয়কে হিসেব করা হয়েছে তা হচ্ছে অব্যাহতভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে সর্বহারাকরণ, পার্টি ভুল পথে গেলে বিদ্রোহ করে আরেকটি কমিউনিস্ট পার্টি গঠণের অধিকারের নিশ্চয়তা, পার্টির একটি অংশকে ক্ষমতায় অংশ গ্রহণ করানো, আর অন্য অংশকে জনগণের সেবায় নিযুক্ত করা, দুই লাইনের সংগ্রামে বল প্রয়োগকে নিরুrসাহিত করা, সৈন্যবাহিনীকে ব্যারাকে নয় জনগণের কাছে পৌঁছানো, জনগণকে সশস্ত্র করা এবং মিত্র শ্রেণীসমূহকে শুধুমাত্র সমবায়ী ভূমিকায় সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ক্ষমতায় অংশ নেয়ার নিশ্চয়তা বিধান। এই কর্তব্যগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য কিছু তত্ত্ব, পদ্বতি ও ধারণা গড়ে তোলা ও বিকাশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।

কেঊ এই প্রক্রিয়াকে সন্দেহের চোখেও গ্রহণ করতে পারেন। সেদিকে মনোযোগ দিয়ে কমরেড প্রচণ্ড বলেন,  এখানে আমরা যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছি তার সাথে দুনিয়ার নানা রঙের সংশোধনবাদী ও বিলোপবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতার কোন সম্পর্ক নেই যারা জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব অথবা সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বকে বিরোধিতা করে বুর্জোয়াদের আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রের ফাঁদে আটকা পড়েছে। এখানে আমাদের প্রশ্ন কেন্দ্রীভূত হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতাকে এমন এক প্রাতিষ্ঠানিকতায় বিকশিত করায় যা বিপ্লবের অব্যাহত গতিকে সংঘটিত করতে পারে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব অথবা সর্বহারা একনায়কত্ব চুড়ান্তভাবে ক্ষমতা দখলের প্রশস্ত ও জীবন্ত গণতন্ত্রীকরণের N-14_R3প্রক্রিয়ায় সুসংহত হতে পারে। এক মহান বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার এছাড়া অন্য কোন অর্থ হতে পারেনা। সেই পার্টিগুলো, যারা ক্ষমতা দখলের পূর্বে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা সঠিকভাবে অনুশীলন করে ক্ষমতা দখলে সাফল্য অর্জন করেছে কেন তারা পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিকতার শিকারে পরিণত হল? সংশোধনবাদ পার্টি অভ্যন্তরে আধিপত্যকারী ছিল বলে এমনটা ঘটেছে- এই যুক্তি পুরোপুরি এর জবাব দিতে পারেনা। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগে কার্যকর কোন না কোন রূপের দূর্বলতাও এর জন্য দায়ী।”( বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের কর্তব্য, পৃঃ ১০)।

বিপ্লবের ইতিহাস, শ্রেণী সংগ্রাম ও দুই লাইনের সংগ্রামের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগের প্রকৃত মূল্য ও তাrপর্য এখানে খুবই গভীরভাবে ও গুরুত্বসহকারে চিত্রিত করা হয়েছে। প্রতিবিপ্লবের জন্য সংশোধনবাদকে দায়ী করে পলায়ন করতে (দায়িত্ব থেকে) ইচ্ছুক আর অব্যাহতভাবে আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ অনুশীলনকারী প্রবণতা ও চিন্তাধারাকে আক্রমণ করার মাধ্যমে এখানে এই সত্যকে প্রচণ্ড ও কার্যকরভাবে উত্থাপন করা হয়েছে যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় মার্কসবাদীদের তরফ থেকে দূর্বলতা ছিল। এখানে খুবই সৃজনশীলভাবে ও জঙ্গীভাবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সমালোচনামূলক ও বিপ্লবী সারবস্তুকে উন্মোচন করা হয়েছে। কমরেড প্রচণ্ড কর্তৃক উপস্থাপিত রাষ্ট্র ক্ষমতা সম্পর্কিত নতুন ধারণাসমূহের সার হচ্ছে বিপ্লবের অব্যাহত ধারা সংঘটিত করতে সক্ষম এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতার বিকাশ ও ব্যাপক গণতন্ত্রীকরণ-ভিত্তিক সর্বহারা একনায়কত্ব সংহতকরণের ধারণার সাথে জড়িত।

সামগ্রিকভাবে, কমরেড প্রচণ্ড কর্তৃক বিকশিত একুশ শতকের গণতন্ত্রের বিকাশ সংক্রান্ত এই ধারণা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে মালেমার সর্বশেষ তত্ত্বগত আবিষ্কার। আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনে এর একটি দূরদর্শী ও যুগসষ্ট্রা তাrপর্য রযেছে। এই নতুন আবিষ্কার প্রচণ্ড পথের বিকাশে গুনগত মান প্রদান করে একে সার্বজনীন স্তরে উন্নীত করার লক্ষ্যে খুবই শক্তিশালী ভিত্ এর ভূমিকা পালন করেছে।

. উপসংহার

প্রচণ্ড পথের দার্শনিক ধারণার উপর এটি একটি সংক্ষিপ্ত অধ্যয়ন। প্রচণ্ড পথের এই সামগ্রিক দার্শনিক ধারণা গণযুদ্ধের মৌলিক বিকাশ ও প্রচণ্ড পথের মৌলিক ভাবধারার মধ্যেকার দ্বান্দ্বিক ঐক্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বসমূহের বিকাশের কাজে কমরেড প্রচণ্ড চমrকার ভূমিকা পালন করেছেন। একুশ শতকের গণতন্ত্রের বিকাশের এই ধারণা একদিকে কমিউনিজমে পৌঁছার পরিস্কার প্রক্রিয়া প্রদর্শন করেছে সমাজতান্ত্র্রিক সমাজে আসা সমগ্র বাঁধা চূর্ণ করে, এবং অন্যদিকে সেইসব শ্রেণীশত্রু ও সংশোধনবাদীদেরকে এক শক্ত তত্ত্বগত আঘাত ছুঁড়ে প্রচণ্ড আক্রমণ করেছে, যারা নিজেরা বিরাট গণতন্ত্রী সেজে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের গোঁড়ামীবাদ, একদলীয় শাসন ও এক-পার্টিবাদের অভিযোগ দেয়, আসলে তারাই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রকৃত হত্যাকারী। বিশ শতকের বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবসমূহকে গুরুত্বের সাথে সারসংকলন করে প্রচণ্ড পথ কর্তৃক উপস্থাপিত গণতন্ত্রের নয়া সমৃদ্ধ তত্ত্বসমূহের ওপর ভিত্তি  করে আমরা একুশ শতকে একটি খুবই নতুন ধরণের নির্ধারক গণযুদ্ধ গড়ে তুলতে যাচ্ছি।

নেপালী সমাজের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায়, অনিবার্যতার বিশ্ব থেকে স্বাধীনতার বিশ্বে একটি গুণগত উণম্ফন দেয়ার মাধ্যমে প্রচণ্ড পথ মহান গণযুদ্ধের মাধ্যমে এতে তীব্র ও ত্বরিত গতি সঞ্চারিত করছে। শ্রেণীযুদ্ধের সেই একই ত্বরিত গতি সহকারে প্রচণ্ড পথও বিকশিত হচ্ছে। বিপ্লব সম্পাদন করা ও প্রতিবিপ্লব প্রতিহত করার মহান লক্ষ্য ও আদশের্র ওপর এটি প্রতিষ্ঠিত। মালেমার শিখরে দাঁড়িয়ে একুশ শতকের পরিচালনারত সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের তীব্র চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে মহান সম্ভাবনাসমূহ উrসারিত করতে সংগ্রামরত প্রচণ্ড পথ কতিপয় নয়া তত্ত্বগত ধারণা বিকশিত করেছে। তত্ত্বগত বিকাশ ও নয়া আবিষ্কারসমূহের মধ্য দিয়ে নয়া সারসমূহের মধ্য দিয়ে কমরেড প্রচণ্ডের যে তত্ত্বগত অবদানসমূহ সমৃদ্ধ হচ্ছে, তা তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়া আকৃতিতে প্রকাশিত হওয়ার দাবী করছে। বিশিষ্ট নয়, সার্বজনীন হওয়ার প্রক্রিয়ায় একটি গুণগত উলম্ফন ঘটানোর জন্য প্রচণ্ড পথ এখন ইতিহাসের নতুন বাঁকে দাঁড়িয়ে। নয়া আাকৃতি নয়া সার প্রকাশে আমাদের অবশ্যই সিরিয়াস হতে হবে।

ডিসেম্বর, ২০০৩

পাদটীকা

●    অর্থাr রাজতন্ত্রীরা

●    অর্থাr ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রী ব্যবস্থা

●   জনৈক আলোক কর্তৃক পার্টিতে প্রতিনিধিত্ব করা একটি পেটি বুর্জোয়া প্রবণতা যা ২০০০ সালে উন্মোচিত ও পরাজিত করা হয়।