মাও সেতুঙের দুটি রচনাঃ শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ভাল, খারাপ নয়। মার্কিন সাংবাদিক আনা লুই স্ট্রংয়ের সাথে আলাপ  

মাও সেতুঙ। দুটি রচনা। শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ভাল এবং আনা লুই স্ট্রংয়ের সাথে সাক্ষাতকার। পড়ার জন্য পিডিএফ

মাও সেতুঙ। দুটি রচনা। শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ভাল এবং আনা লুই স্ট্রংয়ের সাথে সাক্ষাতকার। মুদ্রণের জন্য পিডিএফ

এই ভাষণ ও সাক্ষাৎকার দুটির পূর্ণ বিবরণ ১৯৬৪ সালের জুন মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে প্রকাশিত “মাও সেতুঙের নির্বাচিত রচনাবলী”তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে চীনের পিকিং গণ প্রকাশন কর্তৃক চীনা ভাষায় প্রকাশিত “মাও সেতুঙ রচনাবলীর নির্বাচিত পাঠ”-এর দ্বিতীয় সংস্করণে এই রচনা দুটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। টীকা গ্রন্থকার কর্তৃক সন্নিবেশিত হয়েছ। উক্ত সংস্করণ থেকে বিদেশী ভাষা প্রকাশনা পিকিং রচনাটির বাংলায় ভাষান্তর করে প্রকাশ করে। উক্ত ভাষান্তরে সামান্য কিছু ভাষাগত সম্পাদনা করে

কমরেড মাও সেতুঙ

কমরেড মাও সেতুঙ

বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদীর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৩ প্রকাশ করে। সেইসাথে মার্কসিস্ট ইন্টারনেট আর্কাইভে সংরক্ষিত ইংরেজী কপির সাথে বাংলা এই অনুবাদ মিলিয়ে দেখা হয়েছে। সর্বহারা পথ ওয়েবসাইট থেকে এই সংস্করণটির অধ্যয়ন ও প্রিন্ট নেয়া যাবে।।                                                                                  এ দুটি রচনায় কমরেড মাও সেতুঙের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি

“আমি মনে করি, আমাদের পক্ষে, একজন লোক, একটা রাজনৈতিক পার্টি, একটা সৈন্যবাহিনী অথবা একটা বিদ্যালয় শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত না হওয়াটা খারাপ; সেক্ষেত্রে এর নিশ্চিত অর্থ দাঁড়ায় আমরা শত্রুর পর্যায়ে নেমে এসেছি। যদি আমরা শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হই, তাহলে সেটা ভাল। এটা প্রমাণ করে যে শত্রু ও আমাদের মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য রেখা টেনেছি। যদি শত্রু আমাদের ক্ষিপ্তভাবে আক্রমণ করে ও একেবারে কদর্যভাবে আমাদের চিত্রিত করে আর বলে যে আমাদের কোনই সদগুণ নেই, সেটা আরো ভাল, সেটা প্রমাণ করে যে, আমরা কেবলমাত্র যে শত্রু ও আমাদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রেখা টানতে পেরেছি তাই নয় বরং আমাদের কাজেও বিরাট সাফল্য অর্জন করেছি”।

“পারমাণবিক বোমা হচ্ছে কাগুজে বাঘ, জনগণকে ভয় দেখানোর জন্য মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলরা এটা ব্যবহার করে। এটা দেখতে ভয়াবহ, কিন্তু আসলে তা নয়। নিশ্চয়ই, পারমাণবিক বোমা গণহত্যার একটা অস্ত্র, কিন্তু জয় পরাজয় নির্ধারিত হয় জনগণের দ্বারা, দু’একটা নতুন ধরণের অস্ত্রের দ্বারা নয়।

সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরাই কাগুজে বাঘ। প্রতিক্রিয়াশীলরা দেখতে ভয়াবহ, কিন্তু বাস্তবে তারা তত শক্তিশালী নয়। দীর্ঘকালের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে প্রতিক্রিয়াশীলরা নয়, জনগণই প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের আগে রাশিয়ায় প্রকৃতপক্ষে কোন পক্ষ শক্তিশালী ছিল? বাহ্যত জারই ছিল শক্তিশালী। কিন্তু ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের একটা মাত্র দমকা বাতাসে ভেসে গিয়েছিল জার। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে রাশিয়ার শক্তি ছিল শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকদের সোভিয়েতের মধ্যে। জার ছিল একটা কাগুজে বাঘ মাত্র। হিটলারকে কি একসময় অত্যন্ত শক্তিশালী বলে গণ্য করা হয়নি? কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে যে সে ছিল একটা কাগুজে বাঘ। মুসোলিনী ও জাপানী সাম্রাজ্যবাদও ছিল ঠিক তাই। পক্ষান্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যেসব দেশের জনগণ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে ভালবাসেন, তাঁদের শক্তি যা কল্পনা করা গিয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশী বলে প্রমাণিত হয়েছে”।

 বাংলা ভাষান্তরের ভূমিকা

মাওয়ের ‘শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ভাল, খারাপ নয়’ বক্তৃতাটি জাপানবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধের সময়কালের। এই সময় চীনের সাম্যবাদী পার্টি জাপানী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধকে এগিয়ে নিচ্ছে। জাতীয়তাবাদীদের সাথে ঐক্যের সময়কালে হুয়াংপু সামরিক একাডেমি আর ১৯৩৭ সালে সাম্যবাদীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জাপানবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক মহাবিদ্যালয় এখানে তুলনীয় হয়েছে। এই গ্রন্থের টীকায় বলা হয়েছেঃ “১৯২৪ সালে ডঃ সান ইয়াৎসেন চীনা সাম্যবাদী পার্টি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে কুয়াংচৌর নিকটবর্তী হুয়াংপুতে পদাতিক বাহিনীর অফিসারদের জন্য একটি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটাই হুয়াংপু সামরিক একাডেমী নামে খ্যাত। সে সময়ে এটা ছিল গণ জাতীয় পার্টি [কুওমিন্তাঙ] ও সাম্যবাদী পার্টির যুক্ত সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত একটি সামরিক একাডেমী। চীনা সাম্যবাদী চৌ এনলাই, ইয়ুন তাইইং, সিয়াও ছুন্যু, সিয়োং সিয়োং ও অন্যান্য কমরেডরা বিভিন্ন সময়ে এই একাডেমীতে রাজনৈতিক ও অন্যান্য কাজ করেছেন। তখনকার বিপ্লবী সৈন্যবাহিনীর জন্য তাঁরা বিপুল সংখ্যক কেডারকে বিপ্লবী ভাবমানসে গড়ে তুলেছেন। এই কেডারদের ভেতরে অনেকেই সাম্যবাদী পার্টির সদস্য ও সাম্যবাদী যুবলীগের সদস্য ছিলেন। কিন্তু এই একাডেমীর পরিচালক ছিল চিয়াং কাইশেক। পদমর্যাদার অপব্যবহার করে সর্বত্রই সে সাম্যবাদীদের ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল এবং তার নিজের পদলেহীদের পুষ্ট করে তুলেছিল আর পরিশেষে ১৯২৭ সালের ১২ এপ্রিলের প্রতিবিপ্লবী কুদেতার পর এই একাডেমীকে সে এক প্রতিবিপ্লবী সংগঠনে পরিণত করেছিল”। অন্যদিকে ১৯৩৬ সালে সাম্যবাদীদের প্রতিষ্ঠিত জাপানবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক মহাবিদ্যালয় সম্পর্কে মাও বলেনঃ “জাপানবিরোধী সবগুলো সামরিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এটাই সবচেয়ে বেশি বিপ্লবী, সবচেয়ে বেশি প্রগতিশীল আর জাতীয় মুক্তি ও সামাজিক মুক্তির সবচেয়ে ভাল যোদ্ধা।… মহাবিদ্যালয়টি বিপ্লবী ও প্রগতিশীল, কারণ এর কর্মচারী, শিক্ষক ও পাঠক্রম উভয়ই হল বিপ্লবী ও প্রগতিশীল”। তাই আত্মসমর্পণপন্থী ও গোঁড়াপন্থীরা এই মহাবিদ্যালয়টিকে আক্রমণ করে। আর এ কারণেই মাও মনে করেন বিদ্যালয়টির যশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন যে মহাবিদ্যালয়টি একটি গৌরবময় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তার কারণ শুধু এই নয় যে জনগণের অধিকাংশ এটিকে সমর্থন করেন ও প্রশংসা করেন, বরং তার কারন এও যে আত্মসমর্পণপন্থী ও গোঁড়াপন্থীরা এটাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে ও এর বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়ায়। এখানেই মাওয়ের বিখ্যাত উক্তিঃ “আমি মনে করি, আমাদের পক্ষে, একজন লোক, একটা রাজনৈতিক পার্টি, একটা সৈন্যবাহিনী অথবা একটা বিদ্যালয় শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত না হওয়াটা খারাপ; সেক্ষেত্রে এর নিশ্চিত অর্থ দাঁড়ায় আমরা শত্রুর পর্যায়ে নেমে এসেছি। যদি আমরা শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হই, তাহলে সেটা ভাল। এটা প্রমাণ করে যে শত্রু ও আমাদের মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য রেখা টেনেছি। যদি শত্রু আমাদের ক্ষিপ্তভাবে আক্রমণ করে ও একেবারে কদর্যভাবে আমাদের চিত্রিত করে আর বলে যে আমাদের কোনই সদগুণ নেই, সেটা আরো ভাল, সেটা প্রমাণ করে যে, আমরা কেবলমাত্র যে শত্রু ও আমাদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রেখা টানতে পেরেছি তাই নয় বরং আমাদের কাজেও বিরাট সাফল্য অর্জন করেছি”

এ রচনাটির মূল বিষয় এটাই। অর্থাৎ আমরা এক শ্রেণী সমাজে বাস করি। এখানে সংগ্রাম ও যুদ্ধ ছাড়া কোন কিছু অর্জিত হয়না। এক শ্রেণীর জন্য যা ভাল, শত্রুশ্রেণীর জন্য তা খারাপ। তাই প্রগতিশীল শ্রেণীর ভাল কাজ প্রতিক্রিয়াশীলরা সহ্য করতে পারেনা। তারা আক্রমণ করে। তখনই বুঝতে হবে কাজে সাফল্য সূচিত হয়েছে। আর সংগ্রামের মাধ্যমে এগিয়ে চলাই হচ্ছে ধারা।।

মার্কিন প্রগতিশীল সাংবাদিক আনা লুই স্ট্রং-এর সাথে মাও যখন সাক্ষাতকার দেন তখন চীনা সাম্যবাদী পার্টি ইতিমধ্যেই জাপান বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর পুনরায় গৃহযুদ্ধ পরিচালনা করছে আর রণনৈতিক ভারসাম্যের স্তর থেকে রণনৈতিক আক্রমণের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বে চীনের প্রতিক্রিয়াশীল বুর্শোয়ারা অচিরেই পরাজিত হবে। চিয়াংয়ের পেছনে ছিল মার্কিন। চীনের জনগণের পাশে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। মার্কিন কর্তৃক সাম্যবাদীদের উপর পারমাণবিক হামলার আশংকার কথা উঠলে মাও তাঁর বিখ্যাত উক্তি করেন যে সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলরা হচ্ছে কাগুজে। তিনি বলেনঃ “সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরাই কাগুজে বাঘ। প্রতিক্রিয়াশীলরা দেখতে ভয়াবহ, কিন্তু বাস্তবে তারা তত শক্তিশালী নয়। দীর্ঘকালের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে প্রতিক্রিয়াশীলরা নয়, জনগণই প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী”।  এখানে মাও চমৎকারভাবে বিশ্ব পরিস্থিতির বিশ্লেষণ দেন। দেখান যে সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধ পরিকল্পনার ভুক্তভোগী সাম্রাজ্যবাদী ও মধ্যবর্তী পুঁজিবাদী দেশগুলির জনগণও ভোগ করেন। তাই সাম্যবাদী দেশগুলির সাথে সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী দেশগুলির জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।।

কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ

বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৩                                                    

শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ভাল, খারাপ নয়

চীনা জনগণের জাপানবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তৃতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে। ২৬শে মে, ১৯৩৯

জাপানবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক মহাবিদ্যালয় কেন সমগ্র দেশে নাম করেছে এবং এমনকি বিদেশেও কিছুটা সুখ্যাতি পেয়েছে? এর কারণ হল এই যে, জাপানবিরোধী সবগুলো সামরিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এটাই সবচেয়ে বেশি বিপ্লবী, সবচেয়ে বেশি প্রগতিশীল আর জাতীয় মুক্তি ও সামাজিক মুক্তির সবচেয়ে ভাল যোদ্ধা। ইয়েনান পরিদর্শনে যাঁরা আসেন তাঁরা যে এটা দেখতে এত আগ্রহশীল, আমি মনে করি, তার কারণও এটাই।

মহাবিদ্যালয়টি বিপ্লবী ও প্রগতিশীল, কারণ এর কর্মচারী, শিক্ষক ও পাঠক্রম উভয়ই হল বিপ্লবী ও প্রগতিশীল। এই বিপ্লবী ও প্রগতিশীল চরিত্র ব্যতিরেকে কলেজটি কখনো স্বদেশে ও বিদেশে বিপ্লবী জনগণের প্রশংসা অর্জন করতে পারতনা।

কিছু কিছু লোক মহাবিদ্যালয়টিকে আক্রমণ করে, তারা দেশের আত্মসমর্পণপন্থী ও গোঁড়াপন্থী। এর থেকে কেবলমাত্র এটাই প্রমাণিত হয় যে মহাবিদ্যালয়টি সবচেয়ে বিপ্লবী ও প্রগতিশীল, তা না হলে তারা এটাকে আক্রমণ করতনা। আত্মসমর্পণপন্থী ও গোঁড়াপন্থীদের জোরালো আক্রমণ কলেজটির বিপ্লবী ও প্রগতিশীল চরিত্রের প্রমাণ দেয় আর এর যশবৃদ্ধি করে। মহাবিদ্যালয়টি একটি গৌরবময় সামরিক ইন্সটিটিউট, তার কারণ শুধু এই নয় যে জনগণের অধিকাংশ এটিকে সমর্থন করেন ও প্রশংসা করেন, বরং তার কারন এও যে আত্মসমর্পণপন্থী ও গোঁড়াপন্থীরা এটাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে ও এর বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়ায়।

আমি মনে করি, আমাদের পক্ষে, একজন লোক, একটা রাজনৈতিক পার্টি, একটা সৈন্যবাহিনী অথবা একটা বিদ্যালয় শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত না হওয়াটা খারাপ; সেক্ষেত্রে এর নিশ্চিত অর্থ দাঁড়ায় আমরা শত্রুর পর্যায়ে নেমে এসেছি। যদি আমরা শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হই, তাহলে সেটা ভাল। এটা প্রমাণ করে যে শত্রু ও আমাদের মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য রেখা টেনেছি। যদি শত্রু আমাদের ক্ষিপ্তভাবে আক্রমণ করে ও একেবারে কদর্যভাবে আমাদের চিত্রিত করে আর বলে যে আমাদের কোনই সদগুণ নেই, সেটা আরো ভাল, সেটা প্রমাণ করে যে, আমরা কেবলমাত্র যে শত্রু ও আমাদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রেখা টানতে পেরেছি তাই নয় বরং আমাদের কাজেও বিরাট সাফল্য অর্জন করেছি।

গত তিন বছরে জাপানবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক মহাবিদ্যালয়টি অযুত অযুত প্রতিশ্রুতিশীল, প্রগতিশীল ও বিপ্লবী ছাত্র যুবদের শিক্ষিত করে তুলে দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য মহান অবদান জুগিয়েছে। ভবিষ্যতেও মহাবিদ্যালয়টি নিশ্চয়ই দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য তার অবদান যোগাতে থাকবে, কারণ এটা বিপুল সংখ্যায় এই রূপ ছাত্র যুবদের শিক্ষিত করে তুলতে থাকবেই। মহাবিদ্যালয়টি সম্পর্কে বলতে গিয়ে, লোকেরা প্রায়ই তাকে উত্তর অভিযানের পূর্বেকার হুয়াংপু সামরিক একাডেমির সাথে তুলনা করে থাকে। আসলে দুটি ইন্সটিটিউটের মধ্যে মিল রয়েছে, আবার অমিলও রয়েছে। মিল হল উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে সাম্যবাদীদের উপস্থিতি। অমিল হল এই যে হুয়াংপু সামরিক একাডেমিতে প্রধান নেতৃবৃন্দ ও অধিকাংশ ছাত্র ছিল গণ জাতীয় পার্টির সদস্য, অপরদিকে, জাপানবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক মহাবিদ্যালয়ের গোটা নেতৃত্ব সাম্যবাদীদের হাতে এবং বিপুল সংখ্যাধিক ছাত্র হল সাম্যবাদী অথবা সাম্যবাদী ভাবাপন্ন। এই কারণেই, আজকের জাপানবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক মহাবিদ্যালয় অতীতের হুয়াংপু সামরিক একাডেমি অপেক্ষা অধিক বিপ্লবী ও অধিক প্রগতিশীল না হয়েই পারেনা, এবং জাতীয় মুক্তি ও সামাজিক মুক্তির জন্য এটা নিশ্চয়ই আরো মহান অবদান যোগাতে পারবে।

জাপানবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষানীতি হচ্ছে দৃঢ় ও সঠিক রাজনৈতিক দিশা, কঠোর ও সরল কর্মরীতি এবং নমনীয় রণনীতি ও রণকৌশল। জাপানবিরোধী বিপ্লবী সৈন্য গড়ে তোলার জন্য এই তিনটি অপরিহার্য। মহাবিদ্যালয়ের কর্মচারী, শিক্ষক ও ছাত্ররা এই তিনটা উপাদান অনুসারে শিক্ষা দেন ও শেখেন।

বিগত কয়েক বছরে কলেজের অগ্রগতি ও বিকাশ সাধনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু ত্রুটিও ঘটেছে। মহাবিদ্যালয়টি সম্প্রসারিত হয়েছে কিন্তু অসুবিধারও উদ্ভব হয়েছে। প্রধান অসুবিধা হল, টাকাপয়সা, শিক্ষক ও পাঠ্যবইয়ের অভাব। তবু, সাম্যবাদী পার্টির নেতৃত্বে মহাবিদ্যালয়টি কোন অসুবিধারই ভয় করেনা এবং সব অসুবিধাই নিশ্চয়ই অতিক্রম করতে পারবে। সাম্যবাদী পার্টির কাছে কোন বাঁধাই বাঁধা নয়, কারণ সে তা দূর করতে পারে।

মহাবিদ্যালয়টির তৃতীয় বার্ষিকী উদযাপনের পর তার ত্রুটি দূর হবে এবং মহাবিদ্যালয়টি আরো অধিক প্রগতিশীল হবে—এটাই আমার আশা এবং সমগ্র দেশের জনগণের আশা।

মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্রগণ, আসুন আমাদের প্রচেষ্টাকে আরো জোরদার করি।।

 মার্কিন সাংবাদিক আনা লুই স্ট্রংয়ের সাথে আলাপ

আগস্ট, ১৯৪৬

[টীকাঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের স্বল্পকাল পরেই কমরেড মাও সেতুঙ আন্তর্জাতিক ও দেশের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিবৃতি দেন। কমরেড মাও সেতুঙ তাঁর বিখ্যাত সিদ্ধান্ত “সাম্রাজ্যবাদ ও সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা কাগুজে বাঘ” তখনই তুলে ধরেন। এই সিদ্ধান্তই আমাদের দেশের জনগণকে মতাদর্শের অস্ত্রে সুসজ্জিত করেছিল, বিজয়ের প্রতি তাদের আস্থাকে সুদৃঢ় করেছিল এবং গণ মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত মহান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। লেনিন যেমন সাম্রাজ্যবাদকে “কাদামাটির পা বিশিষ্ট অতিকায় দৈত্য” বলে অভিহিত করেছিলেন, কমরেড মাও সেতুঙ তেমনি সাম্রাজ্যবাদ ও সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের কাগুজে বাঘ বলে গণ্য করেন, উভয়েই বিষয়টির সারমর্ম নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই সিদ্ধান্তটি হল বিপ্লবী জনগণের জন্য একটি মূল রণনীতিগত ধারণা। দ্বিতীয় বিপ্লবী গৃহযুদ্ধের সময় থেকে কমরেড মাও সেতুঙ বারংবার উল্লেখ করেছেন যে রণনীতির দিক থেকে বিপ্লবীদেরকে সামগ্রিকগভাবে শত্রুকে ছোট করে দেখতে হবে, শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার সাহস রাখতে হবে, বিজয় অর্জনে সাহসী হতে হবে, আবার রণকৌশলের দিক থেকে প্রতিটি অংশ, প্রতিটি নির্দিষ্ট সংগ্রামের ক্ষেত্রে শত্রুকে গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে, শত্রু সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, সংগ্রামের কলাকৌশল সযত্নে পর্যালোচনা করতে হবে এবং সেগুলিকে নিখুঁত করে তুলতে হবে, এবং বিভিন্ন স্থান, কাল ও পরিবেশের উপযোগী সংগ্রামের ধরণ অবলম্বন করে ধীরে ধীরে শত্রুকে বিচ্ছিন্ন করে ধ্বংস করতে হবে। ১৯৫৮ সালের ১লা ডিসেম্বর তারিখে উহাংয়ে অনুষ্ঠিত চীনের সাম্যবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর এক অধিবেশনে কমরেড মাও সেতুঙ বলেছেনঃ

পৃথিবীতে যেমন এমন কোন বস্তু নেই যা দ্বৈত প্রকৃতিবিশিষ্ট নয় (এটা হল বিপরীতের একত্বের নিয়ম), তেমনি সাম্রাজ্যবাদ ও সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরাও দ্বৈত প্রকৃতিবিশিষ্ট, তারা একই সঙ্গে প্রকৃত বাঘ ও কাগুজে বাঘ উভয়ই। প্রাচীন ইতিহাসে দাসমালিকশ্রেণী, সামন্ত জমিদারশ্রেণী এবং বুর্শোয়াশ্রেণী শাসন ক্ষমতা দখলের আগে ও পরে কিছুদিন প্রাণবন্ত, বিপ্লবী ও প্রগতিশীল ছিল, তারা তখন প্রকৃত বাঘই ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের বিপরীতপক্ষ অর্থাৎ দাসশ্রেণী, কৃষকশ্রেণী ও সর্বহারাশ্রেণী ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠল আর অধিক থেকে অধিকতর তীব্রভাবে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করল, ফলে এই শাসক শ্রেণীগুলি ধাপে ধাপে বিপরীতে পরিবর্তিত হল, প্রতিক্রিয়াশীলে ও পশ্চাদপদে রূপান্তরিত হল আর কাগুজে বাঘে পরিণত হল। অবশেষে জনগণ হয় তাদের উচ্ছেদ করে ফেলেছে, নয়ত করে ফেলবে। জনগণের সর্বশেষ জীবনমরণ সংগ্রামের সম্মুখীন হয়েও প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাদপদ এবং ক্ষয়িষ্ণু শ্রেণীগুলো  তাদের এই দ্বৈত প্রকৃতি বজায় রেখেছে। একদিকে তারা প্রকৃত বাঘই, তারা মানুষ খায়, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ ভক্ষণ করে। জনগণের সংগ্রামকে অনেক দুরূহ বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে, অনেক আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে। চীন দেশে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের শাসন ধ্বংস করার জন্য চীনা জনগণের একশ’ বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল, প্রায় কয়েক কোটি মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, শুধু তার পরেই ১৯৪৯ সালে বিজয়লাভ হয়েছে। লক্ষ্য করুন! এরা কি জ্যান্ত বাঘ, লোহার বাঘ এবং প্রকৃত বাঘ ছিলনা? কিন্তু পরিশেষে তারা কাগুজে বাঘ, মৃত বাঘ ও বড়ির বাঘে পরিবর্তিত হয়েছে। এটা হচ্ছে ঐতিহাসিক তথ্য। মানুষ কি এ সব তথ্য দেখেনি বা শোনেনি? এ ধরণের হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বাস্তব তথ্য রয়েছে। সুতরাং সারমর্মকে বিবেচনা করে, দীর্ঘকালের পরিপ্রক্ষিতে এবং রণনীতির দৃষ্টিকোন থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা আসলে যা তাদেরকে সেইভাবে অর্থাৎ কাগুজে বাঘ হিসেবেই দেখতে হবে। এর উপরই আমাদের রণনীতিগত চিন্তাধারা গড়ে তোলা উচিত। অপরদিকে তারা জ্যান্ত, লৌহনির্মিত ও প্রকৃত বাঘও বটে, এরা মানুষ খায়। এর উপরই আমাদের রণকৌশলগত চিন্তাধারা গড়ে তোলা উচিত।

রণনীতির দিক থেকে শত্রুকে ছোট করে দেখা আর রণকৌশলের দিকে থেকে তাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দেখুন “মাও সেতুঙের নির্বাচিত রচনাবলী” প্রথম খণ্ডের “চীনের বিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতির সমস্যা” পঞ্চম অধ্যায়, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, এবং এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত “পার্টির অভ্যন্তরে ভ্রান্ত ঝোঁকগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার সমস্যা”]

স্ট্রংঃ আপনি কি মনে করেন যে, নিকট ভবিষ্যতে চীনের সমস্যার একটি রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশা আছে?

মাওঃ সেটা নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনোভাবের উপর। যদি আমেরিকার জনগণ চিয়াং কাইশেককে গৃহযুদ্ধ চালাতে সাহায্যকারী মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলদের বাঁধা দেয়, তাহলে শান্তির আশা রয়েছে।

স্ট্রংঃ ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্র চিয়াং কাইশেককে এ যাবৎ যে সাহায্য দিয়েছে, তার বেশি আর দেবেনা [টীকাঃ জনগণের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ বাধাতে চিয়াং কাইশেককে সমর্থন করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চিয়াং সরকারকে বিপুল পরিমাণে সাহায্য দান করে। ১৯৪৬ সালের জুনের শেষ অবধি যুক্তরাষ্ট্র ৪৫টি গণ জাতীয় পার্টি (গজাপা) ডিভিশনকে সমর সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করেছে। গজাপার ১,৫০,০০০ সামরিক কর্মচারীকে শিক্ষা দিয়েছে—তার মধ্যে রয়েছে, স্থল, নৌ এবং বিমান বাহিনী, গুপ্তচর, যোগাযোগ পুলিশ, স্টাফ অফিসার, মেডিকেল অফিসার, সরবরাহ কর্মচারী ইত্যাদি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ জাহাজ ও বিমানে করে গজাপার ১৪টি কোর (মোট ৪১টি ডিভিশন) এবং যোগাযোগ পুলিশ কোরের ৮টি রেজিমেন্ট, অর্থাৎ সর্বমোট ৫,৪০,০০০ বাহিনী সদস্যকে মুক্ত অঞ্চলের বিরুদ্ধে ফ্রন্টে পরিবহণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ৯০,০০০ জন নৌবাহিনীর স্থল সৈনিক চীনে অবতরণ করায় আর সাংহাই, চিংতাও, থিয়ানচিন, পেইপিং, চিনহুয়াংতাওয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ শহরে তাদের মোতায়েন করে। উত্তর চীনে তারা গজাপার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা পাহারা দেয়। ১৯৪৯ সালের ৫ই আগস্ট স্বরাষ্ট্র দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত “চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক (শ্বেতপত্র)”-এর উদ্ঘাটিত তথ্যানুযায়ী জাপানবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত চিয়াং কাইশেককে প্রদত্ত বিভিন্ন প্রকার মার্কিন সাহায্যের মোট পরিমাণ ৪৫০ কোটি ডলারের উপর ছিল। গজাপা জাপানবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় দেয়া মার্কিন সাহায্যের বেশির ভাগই জনগণের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের জন্য মজুত করে রেখেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সাহায্য উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতপত্র স্বীকার করেছে যে, মার্কিন সাহায্য “চিয়াং কাইশেক সরকারের মোট মুদ্রা খরচের অর্ধেকেরও বেশী ছিল”। এবং “ঐ সরকারের বাজেটের পরিমাণের তুলনায় এ সাহায্য আনুপাতিকভাবে যুদ্ধশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পশ্চিম ইউরোপের কোন দেশকে দেয়া সাহায্যের চেয়ে বেশী ছিল], তাহলে চিয়াং কাইশেক আর কতদিন যুদ্ধ করতে পারবে?

মাওঃ এক বছরের বেশী।

স্ট্রংঃ অর্থনৈতিক দিক থেকে চিয়াং কাইশেক কি এতদিন টিকে থাকতে পারবে?

মাওঃ পারবে।

স্ট্রংঃ যদি যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে, চিয়াং কাইশেককে আর কোন সাহায্য দেয়া হবেনা, তাহলে কি হবে?

মাওঃ এখন পর্যন্ত এমন কোন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছেনা যে অচিরেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও চিয়াং কাইশেক যুদ্ধ বন্ধ করার ইচ্ছা রাখে।

স্ট্রংঃ সাম্যবাদী পার্টি কি ততদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে?

মাওঃ আমাদের নিজস্ব ইচ্ছার কথা বলতে গেলে, আমরা একদিনও যুদ্ধ করতে চাইনা। কিন্তু পরিস্থিতি যদি আমাদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করে, তবে আমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে পারি।

স্ট্রংঃ সাম্যবাদী পার্টি কেন যুদ্ধ করছে, যদি আমেরিকার জনগণ এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, তবে আমি কি উত্তর দেব?

মাওঃ কেননা চিয়াং কাইশেক চীনা জনগণকে হত্যা করতে বদ্ধ পরিকর এবং যদি জনসাধারণ বেঁচে থাকতে চায়, তবে তাদের আত্মরক্ষা করতে হবে। একথা আমেরিকার জনগণ বুঝতে পারে।

স্ট্রংঃ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করার সম্ভাবনা সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?

মাওঃ সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ সম্পর্কে প্রচারণার দুটো দিক রয়েছে। একদিকে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রকৃতপক্ষেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে, বর্তমান সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ প্রচারণা ও সোভিয়েতবিরোধী অন্যান্য প্রচার হল এধরণের যুদ্ধের রাজনৈতিক প্রস্তুতি। অপরদিকে, এধরণের প্রচারণা হল মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলদের সৃষ্ট একটি ধুম্রজাল, যাতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, এই মুহুর্তে যেসব প্রকৃত দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছে, সেগুলি ধামাচাপা পড়ে যায়। এইসব দ্বন্দ্ব হল মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলদের ও আমেরিকার জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশ ও উপনিবেশিক ও আধাউপনিবেশিক দেশগুলির মধ্যকার দ্বন্দ্ব। বর্তমানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের শ্লোগানের প্রকৃত তাৎপর্যই হল আমেরিকার জনগণের উপর নির্যাতন আর বিশ্বের অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী শক্তির সম্প্রসারণ। আপনি তো জানেন, হিটলার ও তার দোসর জাপানী সমরনায়করা দীর্ঘদিন যাবত সোভিয়েতবিরোধী শ্লোগানকে স্বদেশের জনগণকে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করার ও অন্য দেশ আক্রমণের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। বর্তমানে মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলরা ঠিক সেই পন্থাই অবলম্বন করছে।

যুদ্ধ বাধাতে হলে মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলদের অবশ্যই প্রথমে আমেরিকার জনগণকে আক্রমণ করতে হবে। তারা ইতিমধ্যেই এ আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে, তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে আমেরিকার শ্রমিক ও গণতন্ত্রীদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে এবং সেখানে ফ্যাসিবাদ কায়েমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলদের এই আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য আমেরিকার জনগণের রুখে দাঁড়ানো উচিত। আমার বিশ্বাস তাঁরা তা করবেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করছে যে বিরাট অঞ্চল, তার মধ্যে রয়েছে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেকগুলো পুঁজিবাদী, উপনিবেশিক ও আধাউপনিবেশিক দেশ। মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলরা এই সমস্ত দেশ পদানত না করা পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আক্রমণের প্রশ্নই উঠেনা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন যে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে তা সেখানে প্রাক্তন বৃটিশ প্রভাবাধীন সমস্ত এলাকার চেয়ে বড়। সে জাপান, চীনের গজাপা শাসিত অংশ, কোরিয়ার অর্ধাংশ ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ করছে। সে দীর্ঘকাল মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ করেছে। সমগ্র বৃটিশ সাম্রাজ্য ও পশ্চিম ইউরোপকেও সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বিভিন্ন অযুহাতে যুক্তরাষ্ট্র বহু দেশে ব্যাপক আকারে সামরিক ব্যবস্থা ও সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করছে। মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলরা বলছে যে, বিশ্বের সর্বত্র তারা যে সমস্ত সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে ও করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। সত্য বটে, এই সমস্ত সামরিক ঘাঁটি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। তবে যেসব দেশে এই সব ঘাঁটি বর্তমান, তারাই এখন প্রথমে মার্কিন আগ্রাসনের দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। আমি বিশ্বাস করি, এইসব দেশগুলির বুঝতে বেশী সময় লাগবেনা যে, তাদের উপর আসলে অত্যাচার করছে কে—সোভিয়েত ইউনিয়ন না যুক্তরাষ্ট্র? এমন দিন আসবে যখন মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলরা দেখবে যে তাঁরা সমগ্র বিশ্বের জনগণের বিরোধিতার সম্মুখীন।

অবশ্য আমি একথা বোঝাতে চাইনা যে, মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলদের সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আক্রমণের ইচ্ছা নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বশান্তির রক্ষক এবং মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীল কর্তৃক বিশ্বে কর্তৃত্ব বিস্তার রোধ করার একটি শক্তিশালী উপাদান। সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্বের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে তাদের দুরাভিলাষ চরিতার্থ করা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। সেজন্যই মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্ষিপ্তের মত সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘৃণা করে এবং সত্য সত্যই এই সমাজতান্ত্রিক দেশকে ধ্বংস করার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার অল্পকাল পরেই মার্কিন-সোভিয়েত যুদ্ধ সম্পর্কে মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলদের সরব ঢাকঢোল পেটানো ও একটি জঘন্য পরিবেশ সৃষ্টি তাদের প্রকৃত অভিপ্রায়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে আমাদেরকে বাধ্য করছে। প্রকৃত ব্যাপার হল সোভিয়েতবিরোধী শ্লোগানের আড়ালে তারা উন্মত্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক ও গণতান্ত্রিক ব্যক্তিদের আক্রমণ করে চলেছে এবং যেসব দেশ মার্কিন সম্প্রসারণবাদের লক্ষ্য, সেসব দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে। আমি মনে করি যে, আমেরিকার জনগণ ও যেসব দেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমনের ভীতি প্রদর্শন করছে সেই সব দেশের জনগণের উচিত একতাবদ্ধ হওয়া এবং মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীল ও ঐ সকল দেশে তাদের পদলেহী কুকুরদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। এই সংগ্রামে বিজয়ের দ্বারাই কেবল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো সম্ভব। অন্যথায় তা অনিবার্য।

স্ট্রংঃ একথা অত্যন্ত স্পষ্ট। কিন্তু ধরুন যুক্তরাষ্ট্র যদি পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করে? যদি যুক্তরাষ্ট্র আইসল্যান্ড, ওকিনাওয়া ও চীনে তার ঘাঁটি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর বোমাবর্ষণ করে?

মাওঃ পারমাণবিক বোমা হচ্ছে কাগুজে বাঘ, জনগণকে ভয় দেখানোর জন্য মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলরা এটা ব্যবহার করে। এটা দেখতে ভয়াবহ, কিন্তু আসলে তা নয়। নিশ্চয়ই, পারমাণবিক বোমা গণহত্যার একটা অস্ত্র, কিন্তু জয় পরাজয় নির্ধারিত হয় জনগণের দ্বারা, দু’একটা নতুন ধরণের অস্ত্রের দ্বারা নয়।

সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরাই কাগুজে বাঘ। প্রতিক্রিয়াশীলরা দেখতে ভয়াবহ, কিন্তু বাস্তবে তারা তত শক্তিশালী নয়। দীর্ঘকালের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে প্রতিক্রিয়াশীলরা নয়, জনগণই প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের আগে রাশিয়ায় প্রকৃতপক্ষে কোন পক্ষ শক্তিশালী ছিল? বাহ্যত জারই ছিল শক্তিশালী। কিন্তু ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের একটা মাত্র দমকা বাতাসে ভেসে গিয়েছিল জার। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে রাশিয়ার শক্তি ছিল শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকদের সোভিয়েতের মধ্যে। জার ছিল একটা কাগুজে বাঘ মাত্র। হিটলারকে কি একসময় অত্যন্ত শক্তিশালী বলে গণ্য করা হয়নি? কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে যে সে ছিল একটা কাগুজে বাঘ। মুসোলিনী ও জাপানী সাম্রাজ্যবাদও ছিল ঠিক তাই। পক্ষান্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যেসব দেশের জনগণ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে ভালবাসেন, তাঁদের শক্তি যা কল্পনা করা গিয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশী বলে প্রমাণিত হয়েছে।

চিয়াং কাইশেক এবং তার সমর্থক মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলরাও কাগুজে বাঘ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কথা বলতে গেলে, মনে হয় লোকে ভাবে যে ওরা ভীষণ শক্তিশালী। চীনের প্রতিক্রিয়াশীলরা চীনা জনগণকে ভয় দেখাবার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের “শক্তি” ব্যবহার করছে। কিন্তু একথা প্রমাণিত হবে যে ইতিহাসের অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলদের মত মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলরাও যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা সত্যিকারের শক্তিশালী তারা হল আমেরিকার জনগণ।

চীনের কথাই ধরা যাক। ভরসা করার মত আমাদের রয়েছে কেবল ভুট্টা আর রাইফেল, কিন্তু ইতিহাস শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করবে যে আমাদের ভুট্টা ও রাইফেল চিয়াং কাইশেকের বিমান ও ট্যাংকের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। যদিও চীনের জনগণ এখনো অনেক অসুবিধার সম্মুখীন এবং দীর্ঘদিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনা প্রতিক্রিয়াশীলদের যুক্ত আক্রমণের ফলে দুঃখকষ্ট ভোগ করবে, তবুও একদিন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পরাজয় ঘটবেই এবং আমরা বিজয়ী হব। এর সহজ কারণ হচ্ছেঃ প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রতিক্রিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে আর আমরা প্রগতির।।