মাও সেতুঙঃ নরম্যান বেথুন স্মরণে। জনগণের সেবা করুন। যে বোকা বুড়ো লোকটি পাহাড় সরিয়েছিলেন।

পিডিএফ মুদ্রনের জন্য পিডিএফ

১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে চীনের পিকিং গণ প্রকাশন কর্তৃক চীনা ভাষায় প্রকাশিত “মাও সেতুঙ রচনাবলীর নির্বাচিত পাঠ”-এর দ্বিতীয় সংস্করণে এই রচনাগুলি প্রকাশিত হয়। উক্ত সংস্করণ থেকে বিদেশী ভাষা প্রকাশনা পিকিং বাংলায় ভাষান্তর করে প্রকাশ করে। উক্ত ভাষান্তরে সামান্য কিছু ভাষাগত সম্পাদনা করে বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদীর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ ১১ই জুন, ২০২৩ প্রকাশ করে। সর্বহারা পথ ওয়েবসাইট থেকে এই সংস্করণটির অধ্যয়ন ও প্রিন্ট নেয়া যাবে। মার্কসিস্ট ইন্টারনেট আর্কাইভে সংরক্ষিত ইংরেজী কপিটির সাথেও বাংলা ভাষান্তর মিলিয়ে দেখা হয়েছে।

এই তিনটি রচনায় কমরেড মাও সেতুঙের গুরুত্বপূর্ণ  কিছু উদ্ধৃতি

“একজন বিদেশী হয়েও কমরেড নরম্যান বেথুন সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে চীনা জনগণের মুক্তির স্বার্থকে নিজের বলে গ্রহণ করেছিলেন; এটা কি ধরণের ভাবমানস? এটা হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাবাদের ভাবমানস, এটা হচ্ছে সাম্যবাদের ভাবমানস। চীনা সাম্যবাদী পার্টির প্রত্যেক সদস্যকেই এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। লেনিনবাদ এই শিক্ষা দেয় যে, পুঁজিবাদী দেশগুলির সর্বহারাশ্রেণী যদি উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করে এবং উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশের সর্বহারাশ্রেণী যদি পুঁজিবাদী দেশগুলির সর্বহারাশ্রেণীর মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করে, তাহলেই কেবল বিশ্ববিপ্লব সফল হতে পারে (টিকাঃ জ ভ স্তালিন, “লেনিনবাদের ভিত্তি”, এপ্রিল-মে, ১৯২৪, ষষ্ঠ অংশ “জাতীয় সমস্যা)।”

“এই হল আমাদের আন্তর্জাতিকতাবাদ যা দিয়ে আমরা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও সংকীর্ণ দেশপ্রেমের বিরোধিতা করি।”

 “কমরেড বেথুনের ভাবমানস ও অন্যের প্রতি তাঁর আত্মচিন্তাহীন উৎসর্গ দেখা গিয়েছিল কাজের প্রতি তাঁর অসীম দায়িত্ববোধ আর সকল কমরেড ও জনগণের প্রতি তাঁর অসীম সহৃদয়তার মধ্যে। প্রত্যেক সাম্যবাদীরই তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।”

“এমন লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয় যাঁরা নিজেদের কাজের ব্যাপারে দায়িত্বজ্ঞানহীন, ভারিটা অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে হাল্কাটা নিজেরা তুলে নেন। তাঁরা প্রত্যেক পদে পদে অন্যের আগে নিজের কথা ভাবেন। সামান্য একটা কাজ করেই তাঁরা গর্বে ফুলে উঠেন, এবং পাছে অন্যরা তা জানতে না পারে, সেই ভয়ে ঐ সম্পর্কে বড়াই করেন। কমরেড ও জনগণের জন্যে তাঁদের আন্তরিকতা নেই, বরঞ্চ তাদের প্রতি নিষ্প্রাণ, আগ্রহহীন ও উদাসীন। আসলে এই ধরণের লোক সাম্যবাদী নন, অন্ততপক্ষে তাঁদেরকে নিবেদিতপ্রাণ সাম্যবাদী বলে গণ্য করা যায়না”

“ভিন্নতর কিছু দেখলেই যাঁরা নিজের কাজের পরিবর্তন চান এবং অর্থহীন ও ভবিষ্যত সম্ভাবনাহীন মনে করে কারিগরি কাজকে অবজ্ঞা করেন, তাঁদের জন্য কমরেড বেথুনের দৃষ্টান্ত একটি চমৎকার শিক্ষা”

“আমাদের সবারই কমরেড নরম্যান বেথুনের সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ভাবমানস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এই ভাবমানস থাকলে সকলেই জনগণের পক্ষে অত্যন্ত হিতকর হতে পারেন। কোন মানুষের যোগ্যতা বেশি বা কম হতে পারে, কিন্তু এই ভাবমানস যাঁর আছে তিনি নিঃসন্দেহে একজন মহাপ্রাণ ও খাঁটি লোক, একজন নৈতিক চরিত্রসম্পন্ন, নীচ রুচি থেকে মুক্ত লোক আর জনগণের জন্য সম্পদবিশেষ”

“মানুষের মৃত্যু হবেই, কিন্তু মৃত্যুর তাৎপর্য বিভিন্ন রকমের। প্রাচীন চীনে সুমা ছিয়েন নামক একজন সাহিত্যিক বলেছিলেন, “সব মানুষেরই মৃত্যু হবে, কিন্তু সে মৃত্যু হতে পারে তাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী বা পালকের চেয়েও হাল্কা”। জনগণের জন্য যিনি মৃত্যু বরণ করেন, তাঁর মৃত্যু তাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী; কিন্তু যে লোক ফ্যাসিবাদীদের জন্য কাজ করে অথবা শোষক ও অত্যাচারীদের জন্য মরে, তার মৃত্যু পালকের চেয়েও হালকা”

“আমরা জনগণের সেবা করি, তাই আমাদের যদি কোন ত্রুটি থাকে, তা দেখিয়ে দিয়ে কেউ আমাদের সমালোচনা করলে আমরা ভয় করিনা। যে কেউ, তা যিনিই হোন না কেন, আমাদের ত্রুটি দেখিয়ে দিতে পারেন। যদি তাঁর কথা ঠিক হয় তাহলে আমরা নিজেদের ত্রুটি শুধরে নেব। তিনি যা প্রস্তাব করেন তাতে যদি জনগণের উপকার হয়, তবে আমরা তাঁর প্রস্তাব অনুসারেই কাজ করব”

“উন্নততর সৈন্য, এবং সহজতর প্রশাসন ব্যবস্থা” র ধারণা প্রদান করেছিলেন জনাব লি তিন মিং। তিনি সাম্যবাদী নন। তাঁর প্রস্তাবটি ভাল এবং জনগণের পক্ষে কল্যাণকর, তাই আমরা এটাকে গ্রহণ করেছি। জনগণের স্বার্থে আমরা যদি অব্যাহতভাবে যা সঠিক তা করতে থাকি আর যা ভুল তা সংশোধন করি, তাহলে আমাদের সদস্য সংখ্যা নিশ্চয়ই বৃদ্ধি পাবে”

“কষ্টের সময়ে আমাদের সাফল্যের কথা ভুললে চলবে না, বরং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে আর সাহস সঞ্চয় করতে হবে” 

“যেখানেই সংগ্রাম সেখানেই ত্যাগ অনিবার্য, এবং মৃত্যু সেখানে সাধারণ ঘটনা। কিন্তু আমাদের অন্তরে রয়েছে জনগণের স্বার্থ ও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের দুঃখদুর্দশা; আর যখন আমরা জনগণের জন্য মৃত্যুবরণ করি, তখন আমাদের মৃত্যু সার্থক হয়। তবু অনাবশ্যক প্রাণদান পরিহার করার জন্য আমাদের যথাসম্ভব চেষ্টা করা উচিত”

“আমাদের কেডারদেরকে প্রতিটি সৈনিকের প্রতি যত্নবান হতে হবে, বিপ্লবী বাহিনীর সমস্ত লোককেই পরস্পরের যত্ন নিতে হবে, পরস্পরকে ভালবাসতে হবে ও সাহায্য করতে হবে”

“আজ চীনা জনগণের মাথার উপরেও দুটো প্রকাণ্ড পাহাড় জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে আছে। একটা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, আর অন্যটা সামন্তবাদ। চীনা সাম্যবাদী পার্টি এ দুটোকে খুঁড়ে উপড়ে ফেলবার জন্য অনেক দিন আগেই মনস্থির করেছে। আমাদের অবশ্যই অধ্যবসায়ী হতে হবে এবং বিরামহীনভাবে কাজ করতে হবে। আমরাও ঈশ্বরের মন গলাতে পারব। আমাদের ঈশ্বর কিন্তু চীনা জনসাধারণ ছাড়া আর কেউ নন। তাঁরা যদি একযোগে উঠে দাঁড়ান এবং আমাদের সাথে মিলে খুঁড়তে থাকেন, তাহলে এই দুই পাহাড়কে উপড়ে ফেলা যাবেনা কেন?”

 “মার্কিন সরকারের সাম্যবাদীদের বিরুদ্ধে চিয়াং কাইশেককে সমর্থন দানের নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীলদের নির্লজ্জতা প্রমাণ করে। কিন্তু চীনের জনগণের বিজয় অর্জনে বাঁধা দেয়ার জন্য দেশী ও বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আজকের দুনিয়ায় গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহই প্রধান ধারা, পক্ষান্তরে গণতন্ত্রবিরোধী প্রতিক্রিয়া একটি প্রতিকূল ধারা মাত্র। প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিকূল ধারা এখন জাতীয় স্বাধীনতা ও জন-গণতন্ত্রের প্রধান ধারাকে প্লাবিত করে দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু কখনই তা প্রধান ধারায় পরিণত হতে পারেনা। স্তালিন যেমন অনেক আগেই দেখিয়েছিলেন, পুরোনো দুনিয়ায় এখনও তিনটি প্রধান দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে, প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহে সর্বহারাশ্রেণী ও বুর্শোয়াশ্রেণীর দ্বন্দ্ব, দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, তৃতীয়ত, উপনিবেশিক ও আধাউপনিবেশিক দেশসমূহ আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব (জ ভ স্তালিন, লেনিনবাদের ভিত্তি, এপ্রিল-মে, ১৯২৪, প্রথম অংশ “লেনিনবাদের ঐতিহাসিক উৎস”)। এই তিনটি দ্বন্দ্ব শুধু যে বর্তমান তাই নয়, বরং দিন দিন এইগুলি তীব্রতর ও ব্যাপকতর হচ্ছে। এই দ্বন্দ্বগুলির অস্তিত্ব এবং ক্রমবৃদ্ধির ফলে, এমন এক সময় আসবেই যখন এখনও বর্তমান সোভিয়েতবিরোধী, সাম্যবাদবিরোধী আর গণতন্ত্রবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিকূল ধারাটি ভেসে যাবে।”

“এই মুহুর্তে চীনে দুটি কংগ্রেস চলছে, কুওমিনতাঙের ষষ্ঠ জাতীয় কংগ্রেস আর সাম্যবাদী পার্টির সপ্তম জাতীয় কংগ্রেস। এই দুটি কংগ্রেসের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটির উদ্দেশ্য সাম্যবাদী পার্টি ও চীনের সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে নিশ্চিহ্ন করে চীনকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া; অন্যটির উদ্দেশ্য জাপানী সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুর চীনের সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলিকে উচ্ছেদ করা এবং একটি নয়াগণতান্ত্রিক চীন গড়ে তুলে চীনকে আলোকের পথে পরিচালিত করা। এই দুটি লাইন পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, চীনের সাম্যবাদী পার্টির নেতৃত্বে আর তার সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসে গৃহীত লাইনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে চীনের জনগণ পূর্ণ বিজয় অর্জন করবেন, পক্ষান্তরে কুওমিনতাঙের প্রতিবিপ্লবী লাইন অনিবার্যভাবে ব্যর্থ হবে”।।

“আমাদের সাম্যবাদী পার্টি এবং সাম্যবাদী পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত অষ্টম রুট বাহিনী ও নতুন চতুর্থ বাহিনী হচ্ছে বিপ্লবের বাহিনী। আমাদের এই বাহিনী জনগণের মুক্তির জন্য সম্পূর্ণরূপে নিবেদিতপ্রাণ এবং সর্বান্তকরণে জনগণের স্বার্থের জন্য কাজ করে”

বাংলা ভাষান্তরের ভূমিকা

এই রচনাগুলি যুগ যুগ ধরে সারা দুনিয়ার সাম্যবাদীদের পথ নির্দেশ হয়ে রয়েছে। একজন সাম্যবাদী কোন আদর্শে তাঁর জীবন গড়বেন তা দেখানো হয়েছে। কীভাবে তাঁর ভাবমানস গড়বেন তার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

নরম্যান বেথুন স্মরণে রচনাটিতে তিনি আন্তর্জাতিক ভাবমানসের কথা বলেন। সংকীর্ণ দেশপ্রেম ও সংকীর্ণ জাতীয়বাদের যা বিরোধী। সাম্যবাদীরা জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ করেননা। সাম্যবাদীরা কোন দেশে থাকলেও তাঁরা অন্তর্বস্তুতে আন্তর্জাতিকতাবাদী। বেথুনের মত কমরেডরা নিজের কথা ভাবেননা, অপরের প্রতি যত্ন নেন। কমরেডদের উচিত ভারী কাজ নিজে নিয়ে হাল্কাটা অন্যকে দেয়া। তাঁরা আত্মপ্রচারের জন্য কোন কাজ করেননা। সম্পূর্ণ নিঃসার্থভাবে কাজ করেন। বেথুন কমরেড ও জনগণের প্রতি ছিলেন সহৃদয়, আত্মচিন্তাহীন নিবেদিতপ্রাণ আর কাজের প্রতি তাঁর ছিল অসীম দায়িত্ববোধ। কারিগরী কাজকে তিনি সম্মান করতেন। মাও বলেনঃ “কোন মানুষের যোগ্যতা বেশি বা কম হতে পারে, কিন্তু এই ভাবমানস যাঁর আছে তিনি নিঃসন্দেহে একজন মহাপ্রাণ ও খাঁটি লোক, একজন নৈতিক চরিত্রসম্পন্ন, নীচ রুচি থেকে মুক্ত লোক আর জনগণের জন্য সম্পদবিশেষ”

জনগণের সেবা করুন রচনায় মাও বলেনঃ “যেখানেই সংগ্রাম সেখানেই ত্যাগ অনিবার্য, এবং মৃত্যু সেখানে সাধারণ ঘটনা। কিন্তু আমাদের অন্তরে রয়েছে জনগণের স্বার্থ ও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের দুঃখদুর্দশা; আর যখন আমরা জনগণের জন্য মৃত্যুবরণ করি তখন আমাদের মৃত্যু সার্থক হয়। তবু অনাবশ্যক প্রাণদান পরিহার করার জন্য আমাদের যথাসম্ভব চেষ্টা করা উচিত। আমাদের কেডারদেরকে প্রতিটি সৈনিকের প্রতি যত্নবান হতে হবে, বিপ্লবী বাহিনীর সমস্ত লোককেই পরস্পরের যত্ন নিতে হবে, পরস্পরকে ভালবাসতে হবে ও সাহায্য করতে হবে”।

“যে বোকা বুড়ো পাহাড় সরিয়েছিলেন” বক্তৃতায় মাও দৃঢ়চিত্ত ও আত্মবলিদানে নির্ভীক হয়ে বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করার কথা বলেন। অর্থাৎ অধ্যবসায়ের সাথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেনঃ আজ চীনা জনগণের মাথার উপরেও দুটো প্রকাণ্ড পাহাড় জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে আছে। একটা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, আর অন্যটা সামন্তবাদ। চীনা সাম্যবাদী পার্টি এ দুটোকে খুঁড়ে উপড়ে ফেলবার জন্য অনেক দিন আগেই মনস্থির করেছে। আমাদের অবশ্যই অধ্যবসায়ী হতে হবে আর বিরামহীনভাবে কাজ করতে হবে। আমরাও ঈশ্বরের মন গলাতে পারব। আমাদের ঈশ্বর কিন্তু চীনা জনসাধারণ ছাড়া আর কেউ নন। তাঁরা যদি একযোগে উঠে দাঁড়ান এবং আমাদের সাথে মিলে খুঁড়তে থাকেন, তাহলে এই দুই পাহাড়কে উপড়ে ফেলা যাবেনা কেন?”

কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ

বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী

১১ই জুন, ২০২৩                                                                

নরম্যান বেথুন স্মরণে

২১শে ডিসেম্বর, ১৯৩৯

কানাডার সাম্যবাদী পার্টির সদস্য কমরেড নর্ম্যান বেথুন (টীকাঃ প্রসিদ্ধ শল্যচিকিৎক নর্ম্যান বেথুন কানাডার সাম্যবাদী পার্টির একজন সদস্য ছিলেন। ১৯৩৬ সালে জার্মান ও ইতালীয় ফ্যাসিবাদী দস্যুরা যখন স্পেন আক্রমণ করেছিল, তখন তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে স্পেনের ফ্যাসিবিরোধী জনগণের পক্ষে কাজ করেছিলেন। জাপানবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে চীনের জনগণকে সাহায্যের জন্য তিনি একটি চিকিৎসক দলের নেতা হিসেবে চীনে আসেন আর ১৯৩৮ সালের বসন্তকালে ইয়েনানে পৌঁছেন। তার কিছুদিন পরেই তিনি শানসি-ছাহার-হোপেই সীমান্ত অঞ্চলে গমন করেন। একনিষ্ঠ আন্তর্জাতিকতাবাদী ভাবমানস ও সাম্যবাদী অসীম উদ্দীপনায় উদ্বুদ্ধ চিকিৎসক বেথুন প্রায় দুই বৎসর মুক্ত অঞ্চলসমূহে অষ্টম রুট বাহিনীর আহত ও অসুস্থ সৈনিকদের সেবা করেন। আহত সৈনিকদের অস্ত্রোপচারের সময় তিনি রক্তের বিষক্রিয়া দ্বারা আক্রান্ত হন। চিকিৎসা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আরোগ্য লাভ করেন না এবং ১৯৩৯ সালের ১২ই নভেম্বর হোপেই প্রদেশের তাংশান জেলায় মৃত্যুবরণ করেন) যখন কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্যবাদী পার্টি কর্তৃক চীনে প্রেরিত হয়েছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৫০ বছর। জাপানবিরোধী যুদ্ধে চীনকে সাহায্য করার জন্য তিনি হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করাকেও তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন। গত বছরের বসন্তকালে তিনি ইয়েনানে আসেন এবং পরে উতাই পার্বত্য অঞ্চলে কাজ করতে যান। আমাদের দুর্ভাগ্য, কর্মরত অবস্থায়ই তিনি শহীদ হন। একজন বিদেশী হয়েও তিনি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে চীনা জনগণের মুক্তির স্বার্থকে নিজের বলে গ্রহণ করেছিলেন; এটা কি ধরণের ভাবমানস? এটা হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাবাদের ভাবমানস, এটা হচ্ছে সাম্যবাদের ভাবমানস। চীনা সাম্যবাদী পার্টির প্রত্যেক সদস্যকেই এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। লেনিনবাদ এই শিক্ষা দেয় যে, পুঁজিবাদী দেশগুলির সর্বহারাশ্রেণী যদি উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করে এবং উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশের সর্বহারাশ্রেণী যদি পুঁজিবাদী দেশগুলির সর্বহারাশ্রেণীর মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করে, তাহলেই কেবল বিশ্ববিপ্লব সফল হতে পারে (টীকাঃ জ ভ স্তালিন, “লেনিনবাদের ভিত্তি”, এপ্রিল-মে, ১৯২৪, ষষ্ঠ অংশ “জাতীয় সমস্যা)। কমরেড বেথুন এই লেনিনবাদী লাইনকে কার্যে পরিণত করেছিলেন। আমাদের চীনা সাম্যবাদীদেরকেও আমাদের কাজে এই লাইন অনুসরণ করতে হবে। সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের সর্বহারাশ্রেণীর সঙ্গেঃ জাপান, বৃটেন, আমেরিকা, জার্মানী, ইতালী ও অন্যান্য সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের সর্বহারাশ্রেণীর সঙ্গে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শুধু এইভাবেই সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত  করা যাবে, আমাদের জাতি ও জনগণ আর বিশ্বের অন্যান্য জাতি ও জনগণকে মুক্ত করা যাবে। এই হল আমাদের আন্তর্জাতিকতাবাদ যা দিয়ে আমরা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও সংকীর্ণ দেশপ্রেমের বিরোধিতা করি।

কমরেড বেথুনের ভাবমানস ও অন্যের প্রতি তাঁর আত্মচিন্তাহীন উৎসর্গ দেখা গিয়েছিল কাজের প্রতি তাঁর অসীম দায়িত্ববোধ আর সকল কমরেড ও জনগণের প্রতি তাঁর অসীম সহৃদয়তার মধ্যে। প্রত্যেক সাম্যবাদীরই তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এমন লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয় যাঁরা নিজেদের কাজের ব্যাপারে দায়িত্বজ্ঞানহীন, ভারিটা অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে হাল্কাটা নিজেরা তুলে নেন। তাঁরা প্রত্যেক পদে পদে অন্যের আগে নিজের কথা ভাবেন। সামান্য একটা কাজ করেই তাঁরা গর্বে ফুলে উঠেন, এবং পাছে অন্যরা তা জানতে না পারে, সেই ভয়ে ঐ সম্পর্কে বড়াই করেন। কমরেড ও জনগণের জন্যে তাঁদের আন্তরিকতা নেই, বরঞ্চ তাদের প্রতি নিষ্প্রাণ, আগ্রহহীন ও উদাসীন। আসলে এই ধরণের লোক সাম্যবাদী নন, অন্ততপক্ষে তাঁদেরকে নিবেদিতপ্রাণ সাম্যবাদী বলে গণ্য করা যায়না। ফ্রন্ট থেকে যাঁরা প্রত্যাবর্তন করেছেন, তাঁদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি বেথুনের নাম উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ না হয়েছেন আর তাঁর ভাবমানসে মুগ্ধ না হয়েছেন। শানসী-ছাহার-হোপেই সীমান্ত অঞ্চলে চিকিৎসক বেথুন যে সব সৈনিক অথবা বেসামরিক লোকের চিকিৎসা করেছেন অথবা যাঁরা তাঁকে কাজ করতে স্বচক্ষে দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি মুগ্ধ হননি। প্রত্যেক সাম্যবাদীকে অবশ্যই কমরেড বেথুনের কাজ থেকে এই ধরনের খাঁটি সাম্যবাদী ভাবমানস শিক্ষা নেয়া উচিত।

কমরেড বেথুন একজন চিকিৎসক ছিলেন, রোগ নিরাময় করাই ছিল তাঁর পেশা, আর তিনি আপন দক্ষতাকে ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করতেন। অষ্টম রুট বাহিনীর চিকিৎসা বিভাগে তাঁর দক্ষতা অত্যন্ত উচ্চমানে পৌঁছেছিল। ভিন্নতর কিছু দেখলেই যাঁরা নিজের কাজের পরিবর্তন চান এবং অর্থহীন ও ভবিষ্যত সম্ভাবনাহীন মনে করে কারিগরি কাজকে অবজ্ঞা করেন, তাঁদের জন্য কমরেড বেথুনের দৃষ্টান্ত একটি চমৎকার শিক্ষা।

কমরেড বেথুনের সাথে আমার একবারই মাত্র সাক্ষাৎ হয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি আমাকে অনেক চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু আমি ব্যস্ত ছিলাম বলে তাঁকে মাত্র একটা চিঠিই দিয়েছিলাম এবং সে চিঠি তিনি পেয়েছিলেন কিনা তাও আমি জানিনা। তাঁর মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। এখন আমরা সকলেই তাঁকে স্মরণ করছি—তাঁর ভাবমানস যে প্রত্যেককে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে এটা তারই প্রমাণ। আমাদের সবারই তাঁর সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ভাবমানস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এই ভাবমানস থাকলে সকলেই জনগণের পক্ষে অত্যন্ত হিতকর হতে পারেন। কোন মানুষের যোগ্যতা বেশি বা কম হতে পারে, কিন্তু এই ভাবমানস যাঁর আছে তিনি নিঃসন্দেহে একজন মহাপ্রাণ ও খাঁটি লোক, একজন নৈতিক চরিত্রসম্পন্ন, নীচ রুচি থেকে মুক্ত লোক আর জনগণের জন্য সম্পদবিশেষ।।

জনগণের সেবা করুন

৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪

[চীনের সাম্যবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন বিভাগগুলি কর্তৃক কমরেড চাং সুতের স্মরণে অনুষ্ঠিত সভায় কমরেড মাও সেতুঙ এই ভাষণটি দিয়েছিলেন]

আমাদের সাম্যবাদী পার্টি এবং সাম্যবাদী পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত অষ্টম রুট বাহিনী ও নতুন চতুর্থ বাহিনী হচ্ছে বিপ্লবের বাহিনী। আমাদের এই বাহিনী জনগণের মুক্তির জন্য সম্পূর্ণরূপে নিবেদিতপ্রাণ এবং সর্বান্তকরণে জনগণের স্বার্থের জন্য কাজ করে। কমরেড চাং সুতে [টীকাঃ কমরেড চাং সুতে চীনের সাম্যবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রক্ষী রেজিমেন্টের একজন সৈনিক ছিলেন। তিনি ছিলেন পার্টির সদস্য ও জনগণের অকৃত্রিম সেবক। ১৯৩৩ সালে তিনি বিপ্লবের কাজে যোগদান করেন, দীর্ঘ যাত্রায় অংশ নেন আর যুদ্ধে আহত হন। তিনি ১৯৪৪ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর উত্তর সেনশির আনসাই জেলার পার্বত্য অঞ্চলে জ্বালানী কয়লা তৈরি করার সময় চুল্লি ধ্বসে পড়ায় তার মৃত্যু ঘটে] এই বাহিনীর একজন সৈনিক ছিলেন।

মানুষের মৃত্যু হবেই, কিন্তু মৃত্যুর তাৎপর্য বিভিন্ন রকমের। প্রাচীন চীনে সুমা ছিয়েন নামক একজন সাহিত্যিক বলেছিলেন, “সব মানুষেরই মৃত্যু হবে, কিন্তু সে মৃত্যু হতে পারে তাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী বা পালকের চেয়েও হাল্কা”। [টীকাঃ সুমা ছিয়েন ছিলেন খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর চীনের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক। তিনি ১৩০টি প্রবন্ধের সংকলন “ঐতিহাসিক রেকর্ডসমূহ”-এর লেখক ছিলেন। এই উদ্ধৃতিটি তাঁর “রেন-শাও-ছিং-এর চিঠির উত্তর” থেকে নেওয়া হয়েছে] জনগণের জন্য যিনি মৃত্যু বরণ করেন, তাঁর মৃত্যু তাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী; কিন্তু যে লোক ফ্যাসিবাদীদের জন্য কাজ করে অথবা শোষক ও অত্যাচারীদের জন্য মরে, তার মৃত্যু পালকের চেয়েও হালকা।

কমরেড চাং সুতে জনগণের জন্য মৃত্যু বরণ করেছেন, তাই তাঁর মৃত্যু সত্যিই তাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী।

আমরা জনগণের সেবা করি, তাই আমাদের যদি কোন ত্রুটি থাকে, তা দেখিয়ে দিয়ে কেউ আমাদের সমালোচনা করলে আমরা ভয় করিনা। যে কেউ, তা যিনিই হোন না কেন, আমাদের ত্রুটি দেখিয়ে দিতে পারেন। যদি তাঁর কথা ঠিক হয় তাহলে আমরা নিজেদের ত্রুটি শুধরে নেব। তিনি যা প্রস্তাব করেন তাতে যদি জনগণের উপকার হয়, তবে আমরা তাঁর প্রস্তাব অনুসারেই কাজ করব। “উন্নততর সৈন্য, এবং সহজতর প্রশাসন ব্যবস্থা”[টীকাঃ জাপানবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় “উন্নততর সৈন্য ও সহজতর প্রশাসন ব্যবস্থা” চীনের সাম্যবাদী পার্টি কর্তৃক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতিরূপে কার্যকর করা হয়েছিল। এই নীতি অনুযায়ী বিভিন্ন বিভাগের লোকসংখ্যা, বিশেষ করে দপ্তরে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর বেসামরিক কর্মচারীর সংখ্যা সর্বাধিক কমিয়ে জাপানবিরোধী ঘাঁটি এলাকাগুলির পার্টি, সরকার ও সামরিক সংগঠনগুলির আকার ছোট করা হয়েছিল, আর তাতে সশস্ত্র বাহিনী, পার্টি ও সরকারী সংস্থাগুলি অধিকতর সক্রিয়, সংহত ও কার্যকর হতে পেরেছিল। ফলে তারা আরো সাফল্যের সঙ্গে জাপানী আক্রমণকারী ও কুওমিনতাঙের প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণ ও অবরোধ মোকাবেলা করতে ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়েছেল]-র ধারণা প্রদান করেছিলেন  জনাব লি তিন মিং [টীকাঃ লি তিং-মিং উত্তর সেনশি প্রদেশের একজন আলোকপ্রাপ্ত ভূস্বামী ছিলেন। একসময় তিনি সেনশি-কানসু-নিংসিয়া সীমান্ত অঞ্চলের সরকারের সহ সভাপতি নির্বাচিত হয়েছলেন]; তিনি সাম্যবাদী নন। তাঁর প্রস্তাবটি ভাল এবং জনগণের পক্ষে কল্যাণকর, তাই আমরা এটাকে গ্রহণ করেছি। জনগণের স্বার্থে আমরা যদি অব্যাহতভাবে যা সঠিক তা করতে থাকি আর যা ভুল তা সংশোধন করি, তাহলে আমাদের সদস্য সংখ্যা নিশ্চয়ই বৃদ্ধি পাবে।

আমরা দেশের সব জায়গা থেকে এসেছি আর এক সাধারণ বিপ্লবী লক্ষ্যের জন্য একত্রিত হয়েছি। এই উদ্দেশ্য সাধনের পথে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে আমাদের সঙ্গে পাওয়া প্রয়োজন। এখন নয় কোটি দশ লক্ষ লোক [টীকাঃ এটা সেনশি-কানসু-নিংসিয়া সীমান্ত অঞ্চল এবং উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ চীনের অন্যান্য মুক্ত অঞ্চলের তৎকালীন মোট জনসংখ্যা] অধ্যুষিত ঘাঁটি এলাকাগুলি আমরা পরিচালনা করছি; কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। সমগ্র জাতিকে মুক্ত করতে হলে এগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কষ্টের সময়ে আমাদের সাফল্যের কথা ভুললে চলবে না, বরং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে আর সাহস সঞ্চয় করতে হবে। চীনের জনসাধারণ দুঃখদুর্দশায় জর্জরিত, তাঁদের বাঁচানো আমাদের কর্তব্য, তাই আমাদেরকে সংগ্রামে সচেষ্ট হতে হবে। যেখানেই সংগ্রাম সেখানেই ত্যাগ অনিবার্য, এবং মৃত্যু সেখানে সাধারণ ঘটনা। কিন্তু আমাদের অন্তরে রয়েছে জনগণের স্বার্থ ও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের দুঃখদুর্দশা; আর যখন আমরা জনগণের জন্য মৃত্যুবরণ করি তখন আমাদের মৃত্যু সার্থক হয়। তবু অনাবশ্যক প্রাণদান পরিহার করার জন্য আমাদের যথাসম্ভব চেষ্টা করা উচিত। আমাদের কেডারদেরকে প্রতিটি সৈনিকের প্রতি যত্নবান হতে হবে, বিপ্লবী বাহিনীর সমস্ত লোককেই পরস্পরের যত্ন নিতে হবে, পরস্পরকে ভালবাসতে হবে ও সাহায্য করতে হবে।

এখন থেকে আমাদের মধ্যে কিছু ভাল কাজ করেছেন এমন যে কোন ব্যক্তি, তিনি সৈনিকই হন রাঁধুনীই হন, তাঁর মৃত্যু ঘটলে আমাদের অবশ্যই তাঁর সম্মানে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান ও একটি স্মরণসভা করতে হবে। এটা একটা নিয়মে পরিণত হওয়া উচিত, এবং জনসাধারণের মধ্যেও এই নিয়ম প্রবর্তন করা উচিত। কোন গ্রামে কারো মৃত্যু ঘটলে, একটা স্মৃতি সভার আয়োজন করুন। এই পদ্ধতিতেই আমরা মৃতের জন্য শোক প্রকাশ করতে পারি আর সমগ্র জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি।।

যে বোকা বুড়ো লোকটি পাহাড় সরিয়েছিলেন

(চীনের সাম্যবাদী পার্টির সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসে কমরেড মাও সেতুঙের সমাপ্তি ভাষণ)

১১ই জুন, ১৯৪৫

আমাদের কংগ্রেস অত্যন্ত সফল হয়েছে। আমরা তিনটি কাজ করেছি। প্রথমতঃ আমরা আমাদের পার্টির লাইন নির্ধারণ করেছি। এটা হচ্ছে সাহসের সঙ্গে জনসাধারণকে সংগঠিত করা আর গণবাহিনীগুলিকে সম্প্রসারিত করা, যাতে আমাদের পার্টির নেতৃত্বে তারা জাপানী হানাদারদের পরাজিত করতে পারে, সমগ্র জনগণকে মুক্ত করতে পারে এবং নয়া গণতান্ত্রিক চীন গড়ে তুলতে পারে। দ্বিতীয়তঃ আমরা পার্টির নতুন সংবিধান গ্রহণ করেছি। তৃতীয়তঃ পার্টির নেতৃস্থানীয় সংস্থা কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত করেছি। এখন থেকে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সব সদস্যদেরকে এই পার্টি লাইন কার্যকরী করতে নেতৃত্ব দেয়া। আমাদের কংগেস ছিল বিজয় ও ঐক্যের কংগ্রেস। প্রতিনিধিরা তিনটি রিপোর্ট সম্বন্ধেই চমৎকার মন্তব্য করেছেন। অনেক কমরেড আত্মসমালোচনা করেছেন এবং ঐক্যকে লক্ষ্যবস্তু করে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ঐক্য অর্জন করেছেন। এই কংগ্রেস হল ঐক্যের, আত্মসমালোচনার এবং পার্টির আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের একটি আদর্শ।

কংগ্রেস সমাপ্ত হলে বহু কমরেড তাঁদের নিজ নিজ কর্মস্থানে এবং বিভিন্ন যুদ্ধফ্রন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। কমরেডগণ! যেখানেই আপনারা যাননা কেন, আপনাদের উচিত কংগ্রেসে গৃহীত লাইন প্রচার করা আর পার্টির সদস্যদের মারফত জনসাধারণের নিকট তা ব্যাখ্যা করা।

কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত লাইন আমরা প্রচার করব বিপ্লবের নিশ্চিত বিজয় সম্পর্কে পুরো পার্টি ও সমগ্র জনগণের আস্থা গড়ে তোলার জন্য। প্রথমে অগ্রগামী বাহিনীর রাজনৈতিক চেতনাকে উন্নীত করতে হবে, যার ফলে দৃঢ়চিত্ত ও নির্ভীক আত্মত্যাগী এই বাহিনী বিজয় অর্জনের জন্য প্রত্যেকটি বাঁধা অতিক্রম করবে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে সমগ্র জনগণের রাজনৈতিক চেতনাকেও জাগিয়ে তুলতে হবে যাতে বিজয়ের জন্য তাঁরা স্বেচ্ছায় ও সানন্দে আমাদের সঙ্গে একত্রে সংগ্রাম করেন। সমগ্র জনগণের মনে এই বিশ্বাসের অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করে তুলতে হবে যে, চীন চীনের জনগণেরই, প্রতিক্রিয়াশীলদের নয়। একটা প্রাচীন চীনা উপকথা আছে, যার নাম হল “যে বোকা বুড়ো পাহাড় সরিয়েছিলেন”। এই উপকথায় প্রাচীন কালের এক বুড়োর কাহিনী বলা হয়েছে। তিনি বাস করতেন উত্তর চীনে। উত্তর পাহাড়ের বোকা বুড়ো নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। দক্ষিণমুখী তাঁর বাড়ির দরজা ছাড়িয়ে পথ আঁটকে দাঁড়িয়ে ছিল দুটি উঁচু পাহাড়, তাইহাং আর ওয়াংউ। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে, তিনি তাঁর ছেলেদের নিয়ে শাবল দিয়ে পাহাড় দুটিকে খুঁড়ে ফেলার কাজে লেগে গেলেন। বিজ্ঞ বুড়ো নামে পরিচিত অপর একজন পাকা দাঁড়ি বিশিষ্ট লোক তাঁদের উপহাস করে বললেন, “তোমরা কি বোকার মতই না কাজ করছ! এই বিরাট পাহাড় দুটোকে খুঁড়ে সরিয়ে ফেলা তোমাদের এই ক’জনের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব”। “বোকা বুড়ো জবাব দিলেন, “আমি মরে গেলে আমার ছেলেরা একাজ চালিয়ে যাবে, তারা যখন মারা যাবে তখন কাজ চালাবে আমার নাতিরা, আর তার পরে চালাবে তাদের ছেলেরা ও নাতিরা। এমনি চলবে অনন্ত কাল ধরে। পাহাড় দুটি অনেক উঁচু বটে, কিন্তু এগুলি এর চেয়ে বেশিতো আর উঁচু হতে পারবেনা। আমরা যতটুকু খুড়ব, ততটুকুই এগুলি নীচু হয়ে আসবে। তাহলে কেন আমরা এগুলিকে খুঁড়ে সরিয়ে ফেলতে পারবনা?” বিজ্ঞ বুড়োর ভুল অভিমতটা খণ্ডন করে তিনি অবিচল বিশ্বাসের সাথে প্রতিদিন খুঁড়তে থাকলেন। এই দেখে ঈশ্বর মুগ্ধ হলেন আর দুজন দেবদুতকে পৃথিবীতে পাঠালেন। তাঁরা এসে পাহাড় দুটিকে পিঠে করে নিয়ে চলে গেল (টীকাঃ “যে বোকা বুড়ো পাহাড় সরিয়েছিলেন” উপকথাটি “লিয়ে জি” নামক গ্রন্থে দেখুন)

আজ চীনা জনগণের মাথার উপরেও দুটো প্রকাণ্ড পাহাড় জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে আছে। একটা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, আর অন্যটা সামন্তবাদ। চীনা সাম্যবাদী পার্টি এ দুটোকে খুঁড়ে উপড়ে ফেলবার জন্য অনেক দিন আগেই মনস্থির করেছে। আমাদের অবশ্যই অধ্যবসায়ী হতে হবে আর বিরামহীনভাবে কাজ করতে হবে। আমরাও ঈশ্বরের মন গলাতে পারব। আমাদের ঈশ্বর কিন্তু চীনা জনসাধারণ ছাড়া আর কেউ নন। তাঁরা যদি একযোগে উঠে দাঁড়ান এবং আমাদের সাথে মিলে খুঁড়তে থাকেন, তাহলে এই দুই পাহাড়কে উপড়ে ফেলা যাবেনা কেন?

আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছেন এমন দুজন আমেরিকানকে আমি গতকাল কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম যে, মার্কিন সরকার আমাদের ধ্বংস করার চেষ্টা করছে আর আমরা তা করতে দেবনা। সাম্যবাদীদের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার কর্তৃক চিয়াং কাইশেককে সমর্থন দানের নীতির আমরা বিরোধিতা করি। কিন্তু প্রথমত মার্কিন জনগণ ও তাঁদের সরকার, দ্বিতীয়ত, মার্কিন সরকারের অভ্যন্তরে নীতি নির্ধারক দল ও তাদের অধীনস্ত সাধারণ কর্মচারীদের মধ্যে আমাদের পার্থক্য করা উচিত। এই দুইজন আমেরিকানকে আমি বলেছিঃ “আপনাদের সরকারের নীতি নির্ধারকদের বলবেন যে আমরা মার্কিনীদের মুক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করতে নিষেধ করি, কারণ আপনাদের নীতি হচ্ছে সাম্যবাদীদের বিরুদ্ধে চিয়াং কাইশেককে সমর্থন করা, যার জন্যে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। আপনাদের উদ্দেশ্য যদি জাপানীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা হয়, তাহলে আপনারা মুক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেন, কিন্তু তার আগে একটি চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। আমরা আপনাদেরকে সর্বত্র ঊঁকিঝুঁকি মারতে দেবনা। যখন প্যাট্রিক জে হার্লি (টীকাঃ প্রজাতন্ত্রী পার্টির অন্যতম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদ প্যাট্রিক জে হার্লি ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে চীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। তিনি চিয়াং কাইশেকের সাম্যবাদবিরোধী নীতি সমর্থন করলে চীনের জনসাধারণের মধ্যে প্রবল বিরোধিতার সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৫ সালের নভেম্বরে তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।                            

১৯৪৫ সালের ২রা এপ্রিল ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগের এক সাংবাদিক সম্মেলনে হার্লি চীনের সাম্যবাদী পার্টিকে সহযোগিতার বিরোধিতার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। বিস্তারিত বিবরণের জন্য “হার্লি-চিয়াং দ্বৈত সঙ্গীত জমলনা”, মাও সেতুঙ নির্বাচিত রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড দ্রষ্টব্য) প্রকাশ্যে চীনের সাম্যবাদী পার্টির সঙ্গে সহযোগিতা করার বিরোধিতা করেছেন, তারপরেও আপনারা আমাদের মুক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করতে আর ঘুরঘুর করতে চান কেন?”

মার্কিন সরকারের সাম্যবাদীদের বিরুদ্ধে চিয়াং কাইশেককে সমর্থন দানের নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীলদের নির্লজ্জতা প্রমাণ করে। কিন্তু চীনের জনগণের বিজয় অর্জনে বাঁধা দেয়ার জন্য দেশী ও বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আজকের দুনিয়ায় গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহই প্রধান ধারা, পক্ষান্তরে প্রতিক্রিয়া একটি প্রতিকূল ধারা মাত্র। প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিকূল ধারা এখন জাতীয় স্বাধীনতা ও জন-গণতন্ত্রের প্রধান ধারাকে প্লাবিত করে দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু কখনই তা প্রধান ধারায় পরিণত হতে পারেনা। স্তালিন যেমন অনেক আগেই দেখিয়েছিলেন, পুরোনো দুনিয়ায় এখনও তিনটি প্রধান দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে, প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহে সর্বহারাশ্রেণী ও বুর্শোয়াশ্রেণীর দ্বন্দ্ব, দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, তৃতীয়ত, উপনিবেশিক ও আধাউপনিবেশিক দেশসমূহ আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব (জ ভ স্তালিন, লেনিনবাদের ভিত্তি, এপ্রিল-মে, ১৯২৪, প্রথম অংশ “লেনিনবাদের ঐতিহাসিক উৎস”)। এই তিনটি দ্বন্দ্ব শুধু যে বর্তমান তাই নয়, বরং দিন দিন এইগুলি তীব্রতর ও ব্যাপকতর হচ্ছে। এই দ্বন্দ্বগুলির অস্তিত্ব এবং ক্রমবৃদ্ধির ফলে, এমন এক সময় আসবেই যখন এখনও বর্তমান সোভিয়েতবিরোধী, সাম্যবাদবিরোধী আর গণতন্ত্রবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিকূল ধারাটি ভেসে যাবে।

এই মুহুর্তে চীনে দুটি কংগ্রেস চলছে, কুওমিনতাঙের ষষ্ঠ জাতীয় কংগ্রেস আর সাম্যবাদী পার্টির সপ্তম জাতীয় কংগ্রেস। এই দুটি কংগ্রেসের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটির উদ্দেশ্য সাম্যবাদী পার্টি ও চীনের সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে নিশ্চিহ্ন করে চীনকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া; অন্যটির উদ্দেশ্য জাপানী সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুর চীনের সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলিকে উচ্ছেদ করা এবং একটি নয়াগণতান্ত্রিক চীন গড়ে তুলে চীনকে আলোকের পথে পরিচালিত করা। এই দুটি লাইন পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, চীনের সাম্যবাদী পার্টির নেতৃত্বে আর তার সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসে গৃহীত লাইনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে চীনের জনগণ পূর্ণ বিজয় অর্জন করবেন, পক্ষান্তরে কুওমিনতাঙের প্রতিবিপ্লবী লাইন অনিবার্যভাবে ব্যর্থ হবে।।