রূপোলী পর্দার গৈরিকিকরন বিষবৃক্ষের চারা আজ মহীরুহ।। নীলিম বসু

 

     শুরুটা আজ হয় নি, খুব ধীরে ধীরেই শুরু হয়েছিল এবং এগিয়েছে খুব পরিকল্পনামাফিক। পুনেতে ফিল্ম আন্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান পদে গজেন্দ্র চৌহানের মতো এক চতূর্থ শ্রেণীর অভিনেতা তথা সঙ্ঘ পরিবারের অনুগত একজনকে বসানো আসলে বৃত্ত সম্পূর্ন করার চেষ্টা মাত্র। রূপোলী পর্দার হিন্দুত্বকরনের চেষ্টা। এটি আসলে সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রন কায়েম করার চেষ্টা, যার উদ্দ্যোগ শুরু হয়েছিল গত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই। যদিও তার আগেও হিন্দি সিনেমায় হিন্দুত্ববাদের সুড়সুড়ি ছিলই। ছিল দেশাত্মবোধক ফিল্মগুলির মধ্যে দিয়ে। কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক ফ্রন্ট বিজেপি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বাড়াতে শুরু করার পর থেকেই সর্বগ্রাসী চরিত্র নিয়ে হিন্দি সিনেমায় হিন্দুত্ববাদের পরিকল্পনামাফিক যাত্রা শুরু মোটামুটি ১৯৯৪-৯৫ সাল থেকে। তখনো তা ছিল বিষবৃক্ষের চারা, আজ যা বটানিক্যাল গার্ডেনের বিখ্যাত বটগাছের মতোই বড় হয়ে উঠেছে।

     আইপিটিএর প্রভাবে ১৯৬০এর হিন্দি সিনেমা ছিল বাম দিকে হেলে থাকা, মূলতঃ রাজকাপুরের ফিল্মগুলি। ১৯৭০-৮০র অমিতাভ বচ্চনের ‘আংরি ইয়ংম্যান’ ইমেজের ফিল্মগুলিতেও প্রধান চরিত্র আসতো শ্রমজীবি পরিবারের থেকে। ১৯৯০এর মাঝামাঝি থেকে পুরো উল্টো মেরুতে ছুটলো হিন্দি সিনেমা। যার শুরু হলো ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ ফিল্মটি থেকে। যে ফিল্মে একটিও শ্রমজীবি চরিত্র নেই, পুরো ফিল্মটিই ঘোরাফেরা করে উচ্চবিত্ত নয় উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৃত্তে। আরো লক্ষনীয় যে ফিল্মটিতে কোনো হিন্দু চরিত্রই নেই, নেই কোনো নিম্নবর্ন হিন্দু চরিত্রও। হিন্দু ব্রাক্ষন্যবাদের অন স্ক্রিন আগ্রাসন শুরু হলো। এই ফিল্মটিতেই হিন্দু সংস্কৃতি ও আচার আচরনের ঢালাও প্রদর্শন এবং তার ওপর মহিমা আরোপ করা শুরু। এবং এমন ভাবেই তা শুরু যেন সেগুলিকে বাদ দিয়ে জীবন চালানো হয় সম্ভব নয় নয়তো চালানোটা অপরাধ। এর পর থেকে বানিজ্য সফল হিন্দি ফিল্ম(যাকে চলতি ভাষায় ‘হিট’ ফিল্ম বলা হয়) মানেই হয়ে দাঁড়ায় হিন্দুত্ববাদের প্রচার, তা সে প্রেমকাহিনী, পারিবারিক গল্পের মোড়কেই আসুক বা দেশাত্মবোধক ফিল্মের নামে।

       ‘দিলওয়ালে দূলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’, ‘মোহব্বতে’র মতো ফিল্মগুলিও সেই পথেই হেঁটেছে। ‘হাম দিল দে চুকে সনম’, ‘পরদেশ’, ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ এর ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হয় নি। বরং ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’র দেখানো পথকে আরো বেশি করে ও আরো সফলতার সাথে ব্যবহার করেছে হিন্দুত্ববাদীরা পরের ফিল্মগুলিতে তাদের মতাদর্শ প্রচার করার ক্ষেত্রে। কারন ভারতীয়ত্বর ধারনার সাথে হিন্দুত্বের ধারনাকে মিলেয়ে দেখানোর এক সুক্ষ কিন্তু সফল কৌশল দর্শকদের সামনে নিয়ে আসা হয় এবার। মনে পড়ে ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ ফিল্মটির সেই কলেজ র‍্যাগিং দৃশ্য যেখানে বিদেশ থেকে দেশে ফেরা রানী মুখার্জির লিপে ‘ওম জয় জগদিশ হরে’ ভজন? এবং তার পরে বলা ডায়লগ যে বিদেশে থাকলেও সে নিজের দেশের সংস্কৃতি ভোলেনি। লক্ষ করুন দেশের সংস্কৃতি ও হিন্দু সংস্কৃতিকে কিভাবে মিলেয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং সিনেমা হল ভক্তিরস ও দেশপ্রেমে ভেসে গিয়ে হাততালিতে উপচে পড়েছে। ‘দিলওয়ালে দূলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘পরদেশ’ এই কাজটাকেই ফিল্মে ‘ইউনিক সেলিং পয়েন্ট’ করে তুলে বক্স অফিসের ‘বুলস আই’ ফুঁড়ে দিয়েছিল। অবশ্য ‘দিলওয়ালে দূলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’ এখানেই থেমে না থেকে খাপ পঞ্চায়েত ও ‘অনার কিলিং’এর মহত্ব প্রচারও করে গেছিল সেই ১৯৯৫ সালেই।

       ১৯৯০এ হিন্দি সিনেমার প্রধান দুটি ধারা ছিলো, একটি ছিল প্রেমকাহিনী ও পারিবারিক ফিল্মের ধারা, আরেকটি ছিল দেশাত্মবোধক আকশ্যানভিত্তিক ধারা। দ্বিতীয় ধারাটি সরাসরি পাকিস্থান ও অহিন্দু-নিম্নবর্নের হিন্দু এবং আদিবাসীদের শত্রু হিসেবে ঘোষনা করছিল। যেমন ‘গদর, এক প্রেম কথা’, ‘সরফরোশ’, ‘বর্ডার’, ‘এলওসি কারগিল’, ‘রিফিউজি’। ফিল্মের চরিত্রগুলি থেকে হয় অহিন্দু-নিম্নবর্নের হিন্দু-আদিবাসী চরিত্র হারিয়ে গেছিল বা তাঁরা খারাপ চরিত্র হিসেবে চিত্রিত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে কিন্তু সফলভাবে ও পরিকল্পিতভাবে রূপোলী পর্দার গৈরিকিকরন এগিয়ে গিয়েছিল।

       দুটি মাত্র ফিল্ম এই সময় হিন্দুত্ববাদকে মতাদর্শগতভাবে আক্রমন করার সাহস দেখিয়েছিল। ‘ফায়ার’ ও ‘ওয়াটার’। সেন্সর বোর্ডের বারবার বাধাদান থেকে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের আক্রমন যে কি পরিমানে সামলাতে হয়েছিল এই দুটি ফিল্মকে তার বিবরন দিতে গেলে আরো একটি আলাদা লেখা লিখতে হবে। আসলে এই সবই ছিল হিন্দি সিনেমায় হিন্দুত্বের রথ এগিয়ে চলার প্রমান। ২০০০ সালে এসেও এই প্রবনতা বিন্দুমাত্র কমেনি। বারবারই বড় ব্যানার, বড় বাজেট, বড় স্টারদের নিয়ে তৈরি ফিল্মগুলি হয় হিন্দু সংস্কৃতি তথা হিন্দুত্ববাদের জয়গান গেয়েছে, নয় হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্ব এবং হিন্দুত্বকে মিলেয়ে দেখানোর সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতিকেই অনুশরন করে চলেছে। সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতি একদিকে যেমন হিন্দুত্ববাদী অন্যদিকে তেমনই সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট পুঁজির দালালির রাজনীতি। ২০০০ সালের হিন্দি সিনেমা সবদিক দিয়েই সেই পথেরও সেবা করেছে। এই সময়ই হিন্দি সিনেমা এক ঝাঁ চকচকে ভারতের স্বপ্ন ফেরী করতে থাকে। বলাই বাহুল্য যে সেই স্বপ্ন আসলে অলীক স্বপ্ন মাত্র। কিন্তু আজকের ‘স্মার্ট সিটি’, ‘সবকা বিকাশ সবকে সাথ’, ‘আচ্ছে দিন’ এর গপ্পো শোনানো মোদীজীর কষ্ট কল্পিত ভারতের সাথে সিনেমার সেই ভারতের অদ্ভুত মিল।

     হিন্দুত্ববাদ যে আসলে ফ্যাসিবাদ সেটা আমরা আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছি আজ। তার সাথে এটাও বুঝতে শুরু করেছি যে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের সামাজিক ভিত্তি তৈরি করার কাজটা কতদিন ধরে, কত ধৈর্য ধরে করেছে সঙ্ঘ পরিবার। আমরা যারা ফ্যাসিবাদী শাসনকে প্রতিরোধ করতে চাই তারা সেই তুলনায় কোনো প্রস্তুতিই নিই নি বলা চলে। বলা ভালো পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে আমাদের কোনো বোঝাপড়াই ছিলো না তো প্রস্তুতি দুরের বিষয়। ফলে অনেক পিছিয়ে থেকেই আজ আমাদের শুরু করতে হচ্ছে, এবং খুব তাড়াতাড়ি আমরা ভালো কিছু আশা করতেও পারিনা তাই। হিন্দি সিনেমার হিন্দুত্বকরন নিয়ে এই সামান্য পর্যালোচনা থেকেই আমরা দেখতে পাই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের প্রচারযন্ত্র হয়ে ওঠার সাথে সাথেই হিন্দি সিনেমা উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। যা আগে শ্রমজীবি জনতার থেকেই প্রধান চরিত্রদের তুলে আনতো। ফলে বোঝাই যায় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ বা সাম্প্রদায়ীক ফ্যাসিবাদের সাথে সখ্যতা উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীরই। আর কোনো সখ্যতাই নেই শ্রমজীবির। ফলে শ্রেণী সংগ্রামেই প্রতিরোধ করতে হবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদকে। লেখাটা শুরু করেছিলাম ফিল্ম আন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান পদে সঙ্ঘ পরিবার অনুগত গজেন্দ্র চৌহানকে বসানোর মাধ্যমে হিন্দি সিনেমার হিন্দুত্বকরনের বৃত্ত সম্পূর্ন করার চেষ্টার কথা বলে। সেই বৃত্ত কিন্তু আজো সম্পূর্ন হয় নি। এই লেখা লেখার সময় আমরন অনশনে বসেছেন ফিল্ম আন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার অধ্যাপক ও ছাত্ররা গজেন্দ্র চৌহানসহ সমস্ত সঙ্ঘ পরিবার অনুগতদের নিয়োগ রুখতে। ১০০ দিনে পড়তে চলেছে তাঁদের ধর্মঘট। সারা দেশে সমর্থনের ঝড় না হলেও হাওয়া বইছে। বৃত্ত সম্পূর্ন এখনো হয়নি। না হতে দেওয়ার দায়ীত্ব আমাদের।