সিরাজ সিকদার রচনাঃ এক নিজেকে দুইয়ে বিভক্ত করে—ইহা পার্টির মাঝেও প্রযোজ্য

 

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার

 


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১ আগস্ট ২০১৪


 

পিডিএফ

এক নিজেকে দুইয়ে বিভক্ত করে’— ইহা দ্বান্দ্বিকতার মৌলিক নিয়ম, এটা মানব চিন্তাধারা, প্রকৃতি ও সমাজ অর্থাৎ সর্বত্রই সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য।

পার্টি ও কমরেডদের বেলায়ও এই মৌলিক দ্বান্দ্বিক নিয়ম প্রযোজ্য।

পার্টির মাঝে কমরেডরা প্রতিটি প্রশ্নে দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কিছু কিছু কমরেড সর্বহারা মতামত ও কর্মরীতি আঁকড়ে থাকেন, তার বিপরীত অন্যান্য কমরেড সর্বহারা মতামত ও কর্মরীতিকে পরিত্যাগ করেন। এই দুই লাইনের সংগ্রাম চলে। পার্টি বিপ্লবী থাকে যদি সর্বহারা বিপ্লবীদের লাইন বিজয় অর্জন করে এবং পার্টি তা গ্রহণ করে।

কমরেডদেরও দু’ভাগে ভাগ করা যায়, তার সর্বহারা দিক আর অসর্বহারা দিক। এ দু’দিকের মাঝে সংগ্রাম চলে প্রতিনিয়ত। যে দিক প্রধান তাই নির্ণয় করে কমরেডটির প্রকৃত রূপকে।

যার বিপ্লবী দিক প্রধান সে বিপ্লবী, আর যার অবিপ্লবী দিক প্রধান সে অবিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী, সুবিধাবাদী।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির মাঝে কমিউনিস্টদের কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে কিনা, যৌনস্বার্থ বিপ্লবের স্বার্থের অধীন থাকবে না যৌনস্বার্থের অধীনে থাকবে বিপ্লবী স্বার্থ—এ প্রশ্নে দুই লাইনের সংগ্রাম হয়।

ফজলু-সুলতান চক্র ‘কমিউনিস্টদের কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে’, ‘যৌনস্বার্থের অধীন থাকবে বিপ্লবী স্বার্থ’ প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব হাজির করে।

এর বিপরীতে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি কমিউনিস্টদের কোন ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে না, যৌনস্বার্থ বিপ্লবী স্বার্থের অধীন থাকবে—এ সর্বহারার লাইন তুলে ধরেন এবং নীতির প্রশ্নে দৃঢ় থাকেন। এ দুই লাইনের সংগ্রাম চলে। কেন্দ্রীয় কমিটি ও পার্টি ফজলু-সুলতান চক্রের প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে।

এ তত্ত্বগত সংগ্রামে দেউলিয়া প্রমাণিত হয়ে অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে তারা কমিউনিস্টদের ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে এ তত্ত্ব আনে, পার্টিপদ, নেতৃত্ব, ক্ষমতার লোভে প্রতিক্রিয়াশীল সাংগঠনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে, গুজব-অপবাদ রটায়, দু’মুখো অভিনেতা সাজে, মিথ্যার আশ্রয় নেয়, চক্র গঠন করে, পার্টির অর্থ-অস্ত্র চুরি করে, গুপ্ত হত্যার ষড়যন্ত্র করে, শেষ পর্যন্ত পার্টি থেকে পলায়ন করে।

তাদের এ শেষোক্ত পরিনতির কারণ তারা নিজেদের খারাপ দিক ও ভাল দিক, সর্বহারা দিক ও অসর্বহারা দিক বিশ্লেষণ করে খারাপ ও অসর্বহারা দিকের বিরুদ্ধে সজাগ থাকেনি, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেনি, নিজেদেরকে যাচাই করেনি।

এভাবে তাদের মধ্যকার অসর্বহারা ও খারাপ দিক প্রাধান্য লাভ করে, তারা প্রতিক্রিয়াশীলে রূপান্তরিত হয় এবং পার্টি ও জনগণের ক্ষতি সাধন করে।

কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি যদি তাদের প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে তা মেনে নিতেন, তবে সমগ্র পার্টিকে সুবিধাবাদের ও ভূলের নিকট আত্নসমর্পণ করতে হতো, পার্টিও অচিরেই সুবিধাবাদী, যৌনস্বার্থকে প্রাধান্যপ্রদানকারী, ব্যক্তিস্বার্থ বজায়কারীদের পার্টিতে পরিণত হতো, অর্থাৎ পার্টি আওয়ামী লীগের মত বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল পার্টিতে রূপান্তরিত হতো। পার্টির এ পরিণতি হোক এটা কোন কমরেড ও জনগণ চাইবেন না।

সভাপতি মাও বলেছেন, “একজন মানুষের ধমনী ও শিরা রয়েছে, হৃদপিণ্ডের সাহায্যে তার সারা শরীরে রক্ত সঞ্চারিত হয়, আর ফুসফুসের সাহায্যে সে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে, টাটকা অক্সিজেন গ্রহণ করে, অর্থাৎ বাসিটা বর্জন করে ও টাটকাটা গ্রহণ করে। একটা সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি কেবলমাত্র বাসিটা বর্জন ও টাটকাটা গ্রহণ করেই সজীব ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর হতে পারে। আবর্জনা পরিষ্কা না করলে, টাটকা রক্ত গ্রহণ না করলে পার্টি সতেজ হতে পারে না

অর্থাৎ সর্বদাই কিছু সংখ্যক কর্মী যারা নিজেদেরকে কঠোরভাবে যাচাই না করেন, নিজেদের অসর্বহারা ও খারাপ দিকসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না চালান, যারা স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করেন, সংশোধনবাদকে বিরোধিতা করার নীতিকে দৃঢ় না থাকেন, তাদের মধ্যকার অসর্বহারা দিক ধীরে ধীরে প্রাধান্য লাভ করতে পারে, ফলে তারা অসর্বহারা, পশ্চাদপদ কমরেড, বাসি কমরেড, এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবীতে রূপান্তরিত হতে পারেন।

পার্টিকে অবশ্যই এ সকল বাসি উপাদান বাদ দিয়ে টাটকাটা গ্রহণ করে সর্বদাই প্রাণশক্তি বজায় রাখতে হবে।

এভাবে সর্বদাই পার্টি দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সর্বহারা বিপ্লবী আর সুবিধাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবীতে।

বস্তু বিকাশের এ বিভক্তিকরণের সাধারণ নিয়মকে মেনে চলতে হবে। সুবিধাবাদী, প্রতিবিপ্লবীদের থেকে সর্বদাই পৃথক থাকতে হবে। তাদেরকে বহিষ্কার করে দিয়ে সংগঠনের বিপ্লবী চরিত্র বজায় রাখতে হবে।

তাদের সাথে ঐক্যের নীতি, তাদেরকে পার্টির মাঝে রেখে সংশোধনের নীতি হলো বস্তুর নিয়মের পরিপন্থী।

এর পরিণতি হলো পার্টিকে আভ্যন্তরীণ ও বাইরের শত্রুর গোলার সম্মুখীন হওয়া। এ অবস্থায় পার্টির পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।

এ কারণেই সুবিধাবাদীদের, প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবীদের, ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারীদের, উপদলীয় কার্যকলাপ পরিচালনাকারীদের বহিষ্কার করে, অধঃপতিত ব্যক্তিদের বের করে দিয়ে পার্টি শক্তিশালী হয়।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি ও পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই বাসি উপাদান বর্জনের এবং টাটকাটা গ্রহণের প্রক্রিয়া সর্বস্তরে চলে আসছে, একারণেই সংগঠন সর্বদাই প্রাণশক্তিতে ভরপুর রয়েছে।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী পরিষদের বহু সদস্যই বাসি উপাদান হওয়ার কারণে বর্জিত হন। নতুন কর্মী তাদের স্থান দখল করেন। তাদের মধ্যেও কেউ কেউ বাসি হওয়ায় বর্জিত হন।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিতে একই প্রক্রিয়া চলবে, এটা পার্টির বিকাশের বস্তুগত নিয়ম।

চীনা পার্টির ইতিহাসে দেখা যায় কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি চেনতাওশিউ শেষ পর্যন্ত চিয়াং কাইশেকের গুপ্ত পুলিশে পরিণত হয়, গুরুত্বপূর্ণ নেতা চেনকাওতো একইভাবে গুপ্ত পুলিশে পরিণত হয়। এ ধরণের আরো অনেক ঘটনাই ঘটে।

পরবর্তীকালে লিউশাওচি এবং আরো বহু নেতা সংশোধনবাদীতে রূপান্তরিত হয়।

কাজেই কোন কর্মীর পক্ষেই সুবিধাবাদী, চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী বা প্রতিবিপ্লবীতে রূপান্তরিত হওয়া বিচিত্র নয়।

কাজেই ফজলু-সুলতানচক্রের সুবিধাবাদী, চক্রান্তকারীতে রূপান্তর মোটেই আশ্চর্য ঘটনা নয়। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির বিপ্লবীদের মহান দায়িত্ব হল নিজেদের প্রতি এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করার তত্ত্ব প্রয়োগ করা, প্রতিনিয়ত নিজেদের সর্বহারা ও অসর্বহারা দিক, ভাল ও খারাপ দিক খুঁজে বের করা, নিজেদের মধ্যকার অসর্বহারা ও খারাপ দিকগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, প্রতিনিয়ত কঠোরভাবে নিজেদের যাচাই করা, সমালোচনা-আত্মসমালোচনা করা, আজীবন বিপ্লবী থাকার জন্য প্রচেষ্টা চালানো, সুলতান-ফজলুচক্রের নেতিবাচক উদাহরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।