সিরাজ সিকদার রচনাঃ চক্রবিরোধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানের সাথে গোড়ামীবাদ বিরোধী সংগ্রাম যুক্ত করুন

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ২৪ জুন ২০১৪


 

পিডিএফ

ভূমিকা

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে গোড়ামীবাদকে পার্টির প্রধান বিপদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে চক্রবিরোধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানের সাথে গোড়ামীবাদ বিরোধী সংগ্রাম যুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির এ সিদ্ধান্ত ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ দূর করা এবং তাদেরকে মতাদর্শগতভাবে সর্বহারায় রূপান্তরিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে পূর্ববাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনের সাথে সমন্বয় করা, পূর্ববাংলার বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সমস্যাবলীর সমাধান প্রদান করা, সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণকে সঠিক পথে পরিচালনা করা এবং বিপ্লবের বিজয় আনয়ন করার জন্য গোড়ামীবাদ বিরোধী সংগ্রাম একান্ত প্রয়োজন। কাজেই পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির চক্রবিরোধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানের সাথে গোড়ামীবাদ বিরোধী সংগ্রাম যুক্ত করার সিদ্ধান্ত পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি এবং বিপ্লবের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্পন্ন। এটা একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।

মার্কসবাদী জ্ঞানের প্রক্রিয়া ও গোড়ামীবাদ

“মার্কসবাদী দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তবাদের দুটো স্পষ্টতম বৈশিষ্ট্যঃ একটা হচ্ছে তার শ্রেণী প্রকৃতি, এটা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে দ্বান্দ্বিক বস্তবাদ সর্বহারা শ্রেণীর সেবা করে। অপরটা হচ্ছে এর বাস্তব প্রকৃতি, তত্ত্ব অনুশীলনের সেবা করেএ সবের ওপরই গুরুত্ব আরোপ করে।”

এ থেকে পাওয়া যায় সকল তত্ত্বের ভিত্তি হচ্ছে অনুশীলন অর্থাৎ বস্তুর সাথে সংস্পর্শ। বস্তুর সাথে সংস্পর্শে গেলেই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক, জিহবা) মাধ্যমে বস্ত মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়। প্রথমে এটা হচ্ছে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান।

 

জ্ঞানের প্রক্রিয়া

জ্ঞানকে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের স্তরে সীমাবদ্ধ রাখার অর্থ হচ্ছে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ বস্তু বস্তু সম্পর্কেইন্দ্রিয়লব্ধজ্ঞান অনুশীলনঃবিশেষঃজনগণঃ চেতনা জ্ঞানের বস্তুবাদ
                     ↓            ↓                                      ↓
অভিজ্ঞতার সারসংকলনের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে ধারণাত্মক জ্ঞানের স্তরে উন্নীত করা জ্ঞানের প্রথম স্তর কম গুরুত্বপূর্ণ
                      ↓                       ↓                  ↓ জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতা
তত্ত্ব থেকে শুরু করে তত্ত্বেই রয়ে যাওয়া, ধারণাত্বক জ্ঞানকে অনুশীলনে প্রয়োগ না করা হচ্ছে গোড়ামীবাদ চেতনা ধারণাত্মক জ্ঞান তত্ত্ব, প্লান পরিকল্পনা

 

 

 

                     ↓
জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্তর
 

 

                     ↓
বস্তু অর্জিত চেতনা দ্বারা বস্তু রূপান্তরিত হলে ঐ বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় বস্তু অনুশীলনঃবিশেষঃজনগণঃ  

 

 

 

 

বস্তুর নিয়মবিধির সাথে চেতনা সমাঞ্জস্যবিহীন হলে পুনরায় তা সারসংকলন করে ধারণাত্মক জ্ঞান সৃষ্টি হয়
চেতনা
↓বস্তু চেতনা অনুযায়ী বস্তু রূপান্তর করার জন্য চেতনাকে অনুশীলনে প্রয়োগ
   ↓
এভাবে বস্তু চেতনা বস্তু এই সাইকেলের প্রক্রিয়ায় বস্তু রূপান্তর করা এবং বস্তু সম্পর্কিত নির্ভুল জ্ঞান অর্জন করা হয়

ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের উৎস হচ্ছে বস্ত অর্থাৎ জ্ঞানের উৎস হচ্ছে বস্ত—এটা জ্ঞানের বস্তবাদ।

এ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে সারসংকলন করে বস্তুর নিয়মবিধি বের করতে হবে, ইন্দ্রিয়লব্ধ  জ্ঞানকে ধারণাত্মক জ্ঞানের স্তরে উন্নীত করতে হবে।

এটা জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতা।

ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে ধারণাত্মক জ্ঞানের পর্যায় পর্যন্ত হচ্ছে জ্ঞানের প্রক্রিয়ার প্রথম স্তর।

মার্কসবাদের মতে গোটা জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় এ স্তর (ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে ধারণাত্মক জ্ঞান পর্যন্ত যে স্তর) হচ্ছে কম গুরুত্বপূর্ণ স্তর।

“জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় এখানেই (ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে ধারণাত্নক জ্ঞান) শেষ নয়। যদি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানের প্রক্রিয়া ধারণাত্মক জ্ঞানের স্তরে থেমে থাকত তবে জ্ঞানের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হতো। মার্কসবাদী দর্শনের মতে এটা কম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”

মার্কসবাদী দর্শনের মতে বাইরের বস্তগত জগতের (সমাজের ও প্রকৃতির) নিয়মবিধি বুঝা এবং তা বিশ্লেষণ করতে পারাটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়; গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে বিশ্বকে পরিবর্তনে এ নিয়মবিধির জ্ঞানকে প্রয়োগ করা।

মার্কস নিজেই বলেছেন, “দার্শনিকরা বিশ্বকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে একে পরিবর্তন করা।” জ্ঞানের সক্রিয় ভূমিকা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে ধারণাত্মক জ্ঞানেই প্রকাশ পায় না, অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ  হচ্ছে এটা অবশ্যই ধারণাত্মক জ্ঞান থেকে বিপ্লবী অনুশীলনে প্রকাশ পাবে।

বিশ্বের নিয়মবিধি যে জ্ঞান উপলব্ধি করেছে তা অবশ্যই বিশ্ব পরিবর্তনের অনুশীলনে প্রয়োগ করতে হবে, অবশ্যই নতুনভাবে উৎপাদনের সংগ্রামে ও অনুশীলনে, বিপ্লবী শ্রেণী সংগ্রাম ও জাতীয় সংগ্রাম এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার অনুশীলনে প্রয়োগ করতে হবে।

এ অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় যে তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা অনুযায়ী বস্তুকে রূপান্তর করা যায় তা সঠিক। ঐ বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান তখন সম্পন্ন হয়।

এভাবে ধারণাত্মক জ্ঞান তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনার সঠিকতা যাচাই হয়।

বস্তুকে পরিবর্তন করতে যেয়ে যে সকল অসামাঞ্জস্য দেখা দেয় তা পুনরায় সারসংকলন করে দূর করা, তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা রচনা করা, পুনরায় তা বস্তু পরিবর্তনে প্রয়োগ করা।

এভাবে চলে সমাপ্তিহীন ঘূর্ণাবর্ত।

এভাবে অনুশীলন থেকে জ্ঞান, জ্ঞান থেকে অনুশীলন—এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূর্ববাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নির্ভুল রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক ও মতাদর্শগত লাইন গড়ে উঠবে।

এ সকলের একটিই উদ্দেশ্য—তা হচ্ছে পূর্ববাংলার সমাজকে রূপান্তর করা, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম বাস্তবায়িত করা।

তত্ত্ব সৃষ্টি করার জন্য বিপ্লব করা হয় না; বিপ্লব করার জন্য, বিশ্বকে রূপান্তরিত করার জন্য নিয়মবিধি বের করা হয়, তত্ত্ব সৃষ্টি হয়।

গোড়ামীবাদীরা জ্ঞানের এ প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে। তত্ত্ব থেকে শুরু করে তত্ত্বেই রয়ে যায়।

এভাবে তারা তত্ত্বের উৎস বস্তু অর্থাৎ জ্ঞানের বস্তুবাদ এবং অনুশীলনকে তত্ত্বের পর্যায়ে উন্নীত করা ও তত্ত্বকে অনুশীলনে প্রয়োগ করা অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতাকে অস্বীকার করে।

গোড়ামীবাদীরা বস্তুকে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করে না, ফলে বস্তুর বিশেষত্বকেও তারা বুঝে না, অর্থাৎ, অন্যান্য বস্তুর সাথে এর সামঞ্জস্য, বিশেষ করে পার্থক্য যা বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞানের ভিত্তি, তা তারা অধ্যয়ন করে না।

অর্থাৎ, বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ অর্থাৎ মার্কসবাদের আত্মাকে তারা বাদ দেয়।

এভাবে তারা লেনিনের বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণের নিয়মকে লংঘন করে। তারা কখনোও তাদের মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে না। এর পরিবর্তে তারা সারবস্তুহীন বাঁধাধরা গৎ ব্যবহার করে।

বস্তুর বিশেষত্ব না বুঝার ফলে গোড়ামীবাদীরা বুঝে না বিভিন্ন বিপ্লবে পরিস্থিতি ভিন্ন হয়, ফলে দ্বন্দ্ব মীমাংসার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। উপরন্তু তারা একটা ফর্মূলা কল্পনা করে এবং এলোপাথাড়ী তা প্রয়োগ করে। ফলে বিপ্লবে বিপর্যয় আসে এবং যা ভালভাবে সম্পন্ন  করা যেত তা হ-য-ব-র-ল হয়ে যায়।

গোড়ামীবাদীরা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে, আধিবিদ্যক ভাববাদী হয়। ফলে তারা পার্টির রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক লাইনে বিচ্যুতি ঘটায়, পার্টি ও বিপ্লবের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে।

সভাপতি মাও বলেছেন, “ভাববাদ এবং যান্ত্রিক বস্তুবাদ, সুবিধাবাদ ও হঠকারিতাবাদ সব হচ্ছে আত্মগতের সাথে বস্তুগতের অসামঞ্জস্যতা, অনুশীলন থেকে জ্ঞানের বিচ্ছিন্নতার ফল।”

গোড়ামীবাদীরা বস্তুকে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করে না, তাই তাদের চেতনা (আত্নগত) বস্তুর (বস্তুগত) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না, ফলে তারা বস্তু রূপান্তরের জন্য যে সমাধান দেয় তা বস্তুর নিয়মবিধির উপযোগী হয় না। ফলে তারা বামপন্থী হঠকারিতাবাদী (বস্তুর গতির চাইতে এগিয়ে থাকা) বা দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী (বস্তুর গতির পশ্চাতে থাকা) হিসেবে প্রকাশ পায়।

এ কারণে গোড়ামীবাদীরা হঠকারিতা-হতাশাবাদ, দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ প্রদর্শন করতে পারে, এমন কি শত্রুর চরে রূপান্তরিত হতে পারে।

চীনা বিপ্লবে গোড়ামীবাদীরা তিনবার পার্টির নেতৃত্ব দখল করে এবং বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটায়। এদের কেউ কেউ হতাশাবাদী এবং দক্ষিণাপন্থী সুবিধাবাদী হয়ে যায়; শেষ পর্যন্ত শত্রুর চরে পরিণত হয়।

পূর্ববাংলার হক-তোয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিন পূর্ববাংলার সামাজিক অবস্থা মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে, এর নিয়মবিধি বের না করে ভারতীয় সমাজের জন্য প্রণীত রণনীতি ও রণকৌশল অনুসরণ করে, বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটায়, শেষ পর্যন্ত পাক-সামরিক ফ্যাসিষ্টদের দালালী করে।

এদের কেউ কেউ বর্তমানে বাংলাদেশ পুতুল সরকারের দালালী করছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির মধ্যকার গোড়ামীবাদী কমরেডরা পার্টির ধারণাত্নক জ্ঞানকে-তত্ত্বকে অনুশীলনে প্রয়োগ করেন না, বৈদেশিক অভিজ্ঞতা আমাদের পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা চিন্তা না করেই গ্রহণ করেন এবং অন্ধভাবে তা আমাদের সমস্যার ওপর চাপিয়ে দিতে চান।

গোড়ামীবাদ ও মার্কসবাদী তত্ত্ব

মার্কবাদ-লেনিনবাদ হচ্ছে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-ষ্ট্যালিন কর্তৃক অনুশীলনের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক এবং বিপ্লবী বাস্তবতা থেকে টানা সাধারণ উপসংহার।

তারা সকলেই একে প্রাণহীন মন্ত্র বলে গ্রহণ করতে বার বার নিষেধ করেছেন।

সভাপতি মাও বলেছেন, “আমাদের কমরেডরা মার্কসবাদী তত্ত্বকে প্রাণহীন মন্ত্র বলে গ্রহণ করবে না। মার্কসবাদী তত্ত্বকে রপ্ত করা এবং প্রয়োগ করা প্রয়োজন, একমাত্র প্রয়োগের উদ্দেশ্যেই রপ্ত করা।”

তিনি প্রয়োগের উপর কতখানি গুরুত্ব দিয়েছেন তা বুঝা যায় নিম্ন বক্তব্য থেকেঃ “যদি আপনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দৃষ্টিকোণ প্রয়োগ করে একটি বা দু’টি বাস্তব সমস্যাকে ব্যাখ্যা করতে পারেন তাহলে আপনি প্রশংসার যোগ্য এবং আপনি কিছুটা সাফল্য অর্জন করেছেন বলে মনে করা যায়। যত বেশী ব্যাপক ও গভীরভাবে আপনি তা করেন, আপনার সাফল্য ততই বৃহত্তর হবে।”

কাজেই প্রয়োগ বিবর্জিত তত্ত্বগত কচকচানি গোড়ামিবাদী বিচ্যুতির জন্ম দেবে। এটা পরিহার করে তত্ত্বকে সমস্যা-সমাধানে সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সমস্যার ভিত্তিতে তত্ত্বগত আলোচনা ও অধ্যয়ন করতে হবে।

প্রয়োগ বিবর্জিত তত্ত্ব সম্পর্কে সভাপতি মাও বলেছেন, “উদ্দেশ্যহীন তত্ত্ব কোন কাজে আসে না এবং তা মিথ্যা, তা পরিহার করা প্রয়োজন। যারা উদ্দেশ্যহীন তত্ত্ব আওড়াতে পছন্দ করে তাদের প্রতি আমরা অবজ্ঞা ভরে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাব।”

তিনি আরো বলেছেন, “বর্তমানেও কম লোক নেই যারা মনে করে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি আয়ত্ব করলেই সর্ব রোগের মহৌষধ হবে এবং সব অসুবিধা দূর হবে। এ সকল লোক শিশুসুলভ অজ্ঞতা দেখায়। আমাদের উচিৎ তাদেরকে শিক্ষিত করে তোলা। এ সকল অজ্ঞ লোকই মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে ধর্মীয় মন্ত্র হিসেবে নেয়। আমরা তাদের মুখের ওপর বলব তোমাদের মন্ত্র হচ্ছে অপদার্থ।”

মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, ষ্ট্যালিন বারবার বলেছেন, “মার্কসবাদী তত্ত্ব মন্ত্র নয়, অনুশীলনের পথ প্রদর্শক।”

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বকে কিভাবে পূর্ববাংলার বিপ্লবী অনুশীলনের সাথে সমন্বিত করতে হবে? সাধারণ ভাষায় বলা যায়, “নিশানার প্রতি শর নিক্ষেপ।” শর হচ্ছে তীর, নিশানা হচ্ছে লক্ষ্য। লক্ষ্যের প্রতি তীর নিক্ষেপ করতে হবে। নিশানার সাথে তীরের যে সম্পর্ক মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাথে পূর্ববাংলার বিপ্লবের একই সম্পর্ক।

কেউ কেউ লক্ষ্যহীনভাবে তীর ছোঁড়েন, এলোপাথাড়ী তীর ছোঁড়েন। এ ধরণের লোক বিপ্লবের ক্ষতি সাধন করতে পারেন।

কেউ কেউ তীরের গায়ে হাত বুলিয়ে বলতে ভালবাসেন, “কত সুন্দর তীর।“ কিন্তু কখনো তা প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক নন।

সমস্যাবলী সমাধানের জন্য যারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রয়োগ না করে এলোপালথাড়ী, উদ্দেশ্যহীনভাবে মার্কসবাদের কথা বলেন তারা হচ্ছেন গোড়ামিবাদী। পাণ্ডিত্য জাহির করাই তাদের উদ্দেশ্য। আদৌ প্রয়োগ না করে তত্ত্বের প্রশংসা করেন, চায়ের টেবিলে, ড্রয়িং রুমে তত্ত্ব ঝেড়ে মস্ত পাণ্ডিত্য দেখান, কাজ দূরের কথা সামান্য সাহায্যও অনেক সময় করেন না। এরূপ বহু ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবি পূর্ববাংলায় রয়েছে।

এদের উভয়েরই বিপ্লবের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।

আমাদের পার্টিতে অনেক কমরেডই পার্টির রাজনৈতিক-সামরিক ও অন্যান্য লাইন সঠিক বলে আনন্দ পান, বারবার বলে বেড়ান, এ নিয়ে তর্ক করেন, কিন্তু এগুলো প্রয়োগ করে কাজ বাড়ান না, পার্টি-বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যান না।

পার্টির লাইন যত সঠিকই হোক না কেন তা প্রয়োগ না করলে পার্টি ও বিপ্লবের কোন সমস্যার সমধান হবে না।

কাজেই এ সকল কমরেডদের মনোভাব পাল্টাতে হবে, পাটির লাইন প্রয়োগ করতে লেগে থাকতে হবে শেষ পর্যন্ত।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে পূর্ববাংলার বিপ্লবের সাথে সমন্বিত করার অর্থ কি?

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি, পদ্ধতি দ্বারা ইতিহাস ও বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় উথাপিত বাস্তব সমস্যাবলীর সঠিক বিশ্লেষণ প্রদান করা এবং পূর্ববাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য সমস্যাবলীর বৈজ্ঞানিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রদান করা এবং সে অনুযায়ী পূর্ববাংলাকে রূপান্তরিত করা।

এ ধরণের তত্ত্ববিদ হতে হলে একজনকে অবশ্যই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার বস্তুকে রপ্ত করতে হবে, মার্কসবাদী অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি, পদ্ধতি এবং ঔপনিবেশিক-আধা ঔপনিবেশিক দেশ সম্পর্কে লেনিন-ষ্ট্যালিন-মাওসেতুঙের তত্ত্ব রপ্ত করতে হবে, তাকে সক্ষম হতে হবে সূক্ষ্মভাবে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে পূর্ববাংলার বাস্তব সমস্যাবলীর সমাধান করতে, এর নিয়মবিধি আবিস্কার করতে এবং তা প্রয়োগ করতে।

কেবলমাত্র পূর্ববাংলার সমাজ পরিবর্তনের অনুশীলনে যুক্ত থাকলেই এটা সম্ভব।

কারণ পৃথিবীতে একটাই সত্যিকার তত্ত্ব রয়েছে যা বস্তুগত বাস্তবতা থেকে এসেছে এবং বস্তুগত বাস্তবতায় পরীক্ষিত। এ ছাড়া আর কিছুই তত্ত্ব নাম পাওয়ার যোগ্য নয়। অর্থাৎ, পূর্ববাংলার সমাজের বাস্তবতা এ সকল তত্ত্বে প্রতিফলিত হতে হবে এবং পূর্ববাংলার সমাজ পরিবর্তনে প্রয়োগের মাধ্যমে তা পরীক্ষিত হতে হবে।

কাজেই পূর্ববাংলার সামাজিক বিপ্লবের সমস্যাবলীর তত্ত্বগত সমাধান সম্ভব, পূর্ববাংলার সমাজের বাস্তব অবস্থা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করা, তার নিয়মবিধি বের করা এবং এ নিয়মবিধি অনুযায়ী পূর্ববাংলার সমাজ পরিবর্তন করে তা যাচাই করার মাধ্যমে।

অনুশীলনের পরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত অর্থাৎ, যে তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা পূর্ববাংলার সমাজের নিয়মবিধির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা সঠিক।

কেবলমাত্র এ তত্ত্বই তখন পুরোপুরি তত্ত্বের পর্যায়ে পড়ে।

গোড়ামিবাদীরা মার্কসবাদের প্রয়োগের গুরুত্বকে অস্বীকার করে, কতকগুলো মার্কসবাদী তত্ত্ব মুখস্ত করে নিজেদেরকে মস্ত পণ্ডিত ঠাওরায়, লেজ ফুলিয়ে আকাশে তোলে।

গোড়ামীবাদ ও বৈদেশিক পার্টির অভিজ্ঞতা           

গোড়ামিবাদীরা আমাদের দেশের সমস্যা পর্যালোচনা করে তার ভিত্তিতে রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ না করে অন্য পার্টির রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করে, আমাদের দেশের ওপর তা অন্ধভাবে চাপিয়ে দেয়, আমাদের দেশের সমস্যা সে অনুযায়ী সমাধান করতে চায়।

এভাবে তারা বস্তুকে তার বিশেষত্বসহ মস্তিস্কে প্রতিফলিত করে না, মার্কসবাদের আত্মা ‘বিশেষ অবস্থার  বিশেষ বিশ্লেষণ’কে বাদ দেয়; বৈদেশিক পার্টির রণনীতি-রণকৌশল অর্থাৎ তাদের দেশের জন্য রচিত তত্ত্ব-চেতনা অনুযায়ী আমাদের দেশ বস্তুকে দেখে।

এভাবে তারা আমাদের দেশ সম্পর্কিত নয় এরূপ চেতনাকে দেয় প্রাথমিক স্থান, আমাদের দেশ বস্তুকে দেয় গৌণ স্থান।

এ কারণে গোড়ামিবাদীরা ভাববাদী।

হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাসার সকলেই এককালে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদকে এক ও অবিচ্ছিন্ন বলেছে এবং এই তিনটাকেই প্রধান শত্রু বলেছে।

[বর্তমানে হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন ভারত-সোভিয়েটকে যুক্তভাবে প্রধান শত্রু বলছে।]

এভাবে তারা প্রধান শত্রু এবং প্রধান দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করছে।

পরবর্তীকালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) এর বক্তব্য অনুযায়ী তারা সামন্তবাদকে প্রধান শত্রু বলে এবং ভারতীয় সামাজিক অবস্থার জন্য প্রণীত রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করে।

ভারতীয় সমাজের বিশেষ অবস্থার জন্য প্রণীত রণনীতি ও রণকৌশল পূর্ববাংলার ক্ষেত্রে হুবহু প্রয়োগের অর্থ হচ্ছে পূর্ববাংলার বিশেষত্বকে অস্বীকার করা।

অর্থাৎ জুতোর মাপে পা কাটা, গোলাকার ছিদ্র পথে চারকোণা কাঠ ঢোকানো।

এর ফলে উপরোক্ত নয়া সংশোধনবাদীরা পূর্ববাংলার সামাজিক বিকাশের সমস্যাবলীর সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়, এবং বুর্জোয়ারা পূর্ববাংলায় প্রতিবিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হয়।

হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিনরা গোড়ামীবাদী হতে হতে এরূপ অবস্থায় পৌঁছেছে যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাথে ভারতীয় পার্টির নেতার শিক্ষাকে পার্টির তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে।

তারা পূর্ববাংলার সমস্যাবলীর বিশ্লেষণ দেওয়ার পরিবর্তে ভারতীয় পার্টির নেতা এবং রেডিও পিকিং-এর উদ্ধৃতি বিকৃত করে তা থেকে শুরু করে।

এভাবে তারা আমাদের সমস্যা-পরিস্থিতির বিশ্লেষণ থেকে উপসংহার টেনে তা ভাতৃপ্রতিম পার্টর উপসংহারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা যাচাই করার পরিবর্তে ভাতৃপ্রতিম পার্টির উপসংহার থেকে শুরু করে (অর্থাৎ সংজ্ঞা থেকে শুরু করে)।

বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ লাইনে এদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

“গোড়ামিবাদী ভুল হবে যদি কেঊ যান্ত্রিকভাবে অন্য কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ও কৌশল অনুসরণ করে, অন্যের ইচ্ছার নিকট আত্নসমর্পণ করে, অথবা অন্য কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচী ও সিদ্ধান্তসমূহ কোন প্রকার বিশ্লেষণ ছাড়াই নিজের বলে গ্রহণ করে।”

হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন প্রভৃতি সকলেই ভারতীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ও কৌশল যান্ত্রিকভাবে অনুকরণ করছে, কোন প্রকার বিশ্লেষণ ছাড়াই তারা নিজের বলে গ্রহণ করেছে।

এভাবে তারা গোড়ামিবাদী ভুল করে পূর্ববাংলার বিপ্লবের মারাত্মক ক্ষতি করেছে।

এদের সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, “…… এমন একটা পার্টি যা অন্যের কথা তোতা পাখীর মতো আওড়ায়, কোন বিশ্লেষণ ব্যতিরেকেই বিদেশী অভিজ্ঞতা অনুকরণ করে, বিদেশের কোন ব্যক্তির বেটনের নির্দেশে এখানে-সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে, তা হলে সে পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির পরিবর্তে সংশোধনবাদ-গোড়ামিবাদের হ-য-ব-র-ল-তে পরিণত হয়।”

কাজেই হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, মণিসিং-মোজাফফর (যারা প্রায়ই মস্কো-ভারত দৌড়াদৌড়ি করে নির্দেশ আনতে), কাজী-রনো-অমল, দেবেন-বাসার (জ্যোতিবসুর নির্দেশ নেয়) এভাবে সংশোধনবাদী ও গোড়ামিবাদী হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির বিশতম কংগ্রেসের রিপোর্ট (ক্রুশ্চোভ কর্তৃক সংশোধনবাদ এ রিপোর্টে প্রথম প্রণীত হয়) বিশ্লেষণ ছাড়াই গ্রহণ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা প্রনয়ন ও সে অনুযায়ী কাজ করে।

তারা তাদের ভুল সংশোধনের পূর্বেই প্রতিক্রিয়াশীলদের হামলার মুখে পড়ে, কয়েক লক্ষ কমরেড প্রাণ হারায়, ইন্দোনেশীয় বিপ্লব ও পার্টির মারাত্মক ক্ষতি হয়।

পূর্ব ইউরোপের প্রায় সকল দেশের কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েট আধুনিক সংশোধনবাদীদের লাইন অন্ধভাবে গ্রহণ করে। ফলে সে সকল কমিউনিস্ট পার্টি সংশোধনবাদী হয়ে যায়, ঐ সকল দেশসমূহ সোভিয়েটের উপনিবেশ বা তার উপর নির্ভরশীল দেশে পরিণত হয়।

এনভার হোকজার নেতৃত্বে আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্লেষণ করে ক্রুশ্চোভ-এর আধুনিক সংশোধনবাদী লাইন প্রত্যাখ্যান করে, এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। ফলে আলবেনিয়া সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিরাজ করে।

বার্মার কমিউনিস্ট পার্টি ক্রুশ্চোভের লাইন এমনকি লিউশাউচীর পরামর্শ বিশ্লেষণ করে প্রত্যাখ্যান করে, ফলে বার্মার কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবী রয়ে গেছে এবং বিপ্লব পরিচালনা করছে। আলবেনিয়ার এনভার হোকজা, বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড থাকিন-থান-তুনের মহান বিপ্লবী ভূমিকার জন্য সভাপতি মাও তাদেরকে মহান মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বলে অভিনন্দিত করেছেন।

সভাপতি মাও-এর নেতৃত্বে মহান চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্রুশ্চোভের আধুনিক সংশোধনবাদী লাইন বিশ্লেষণ করে প্রত্যাখ্যান করে এবং এর বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বহারাদের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করে।

ফলে মহান চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবী রয়ে গেছে এবং চীন সমাজতান্ত্রিক হিসেবে বিরাজ করছে।

কাজেই গোড়ামিবাদী হয়ে বৈদেশিক পার্টিকে অন্ধ অনুকরণ করা, বিদেশের পার্টির  কর্মসূচী ও প্রস্তাব বিশ্লেষণ ছাড়াই অন্ধভাবে গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে সুবিধাবাদ ও সংশোধনবাদী হওয়া এবং পার্টি ও বিপ্লবের চরম ক্ষতি সাধন করা।

আমরা এ সকল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবো, নিজের জন্য মাথা খাটিয়ে ভাবতে সক্ষম হবো, দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দ্বারা পূর্ববাংলার সমাজের বিশ্লেষণ করবো, গভীর অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা চালিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর গতিধারা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করবো, পূর্ববাংলার সমাজের বিকাশের নিয়মাবলী আবিষ্কার করবো, এর ভিত্তিতে, রণনীতি ও রণকৌশল প্রনয়ণ করবো, এভাবে সক্ষম হবো মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ববাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনে সমন্বয় সাধন করতে।

সভাপতি মাও বলেছেন, এটা সর্বদাই প্রয়োজন বাস্তবতা থেকে শুরু করা। জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রক্ষা করা, প্রতিনিয়ত গণসংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা, এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রণনীতি ও রণকৌশল প্রনয়ণ করা এবং তা প্রয়োগ করা।

আমরা সর্বদা এ নীতিতে দৃঢ় থাকবো।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টি সর্বদাই স্বাধীনভাবে পূর্ববাংলার সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করেছে, রণনীতি ও রণকৌশল প্রনয়ণ করেছে, বৈদেশিক অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করে পূর্ববাংলার পরিস্থিতির জন্য যা প্রয়োজন তা গ্রহণ করেছে, অন্ধ অনুকরণ পরিহার করেছে।

এ কারণেই পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টি পূর্ববাংলার সামাজিক বিকাশের নিয়মাবলী সঠিকভাবে নির্দেশ করতে সক্ষম হয়েছে, সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছে, শ্রমিক আন্দোলন ও পার্টি অব্যাহতভাবে বিকাশ লাভ করেছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির সকল কর্মী এ ঐতিহ্যকে বজায় রাখবেন, গোড়ামীবাদকে পরিহার করবেন।

গোড়ামীবাদ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ                 

সভাপতি মাও বলেছেন, “গোড়ামীবাদ এবং সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ হচ্ছে আত্নগতভাব (বস্তুকে যথাযথভাবে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে বস্তু সম্পর্কে মনগড়া ধারণা করা)। উভয়েই বিপরীত দিক থেকে উদ্ভূত

“সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ গোড়ামীবাদ থেকে পৃথক হল এটা পুস্তক থেকে শুরু না করে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে।”

সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান রয়েছে, অর্থাৎ তারা বস্তুর সংস্পর্শে রয়েছে, অনুশীলনে রয়েছে। তারা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে সারসংকলন করে ধারণাত্মক জ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করে না, বস্তুর নিয়মবিধি বের করে না। সে অনুযায়ী বস্তুকে রূপান্তরিত করে না।

এভাবে তারা জ্ঞানকে প্রতিনিয়ত উন্নত পর্যায়ে উন্নীত করে না। এ সকল কারণে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীদের জ্ঞান একতরফা।

তারা তাদের একতরফা সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। তাকে মন্ত্র হিসেবে নেয়। তারা ‘বিপ্লবী তত্ত্ব ব্যতীত বিপ্লব হয় না’ এ সত্যকে অস্বীকার করে। ফলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অধ্যয়নকে গুরুত্বহীন মনে করে। তারা সারবস্তুহীন আনুষ্ঠানিকতা এবং নিয়মতান্ত্রিকতা দ্বারা পূর্ণ থাকে, এটা তাদের কোন উপকারই করে না। এরূপ অবস্থায় তারা যদি ওপরে থেকে নির্দেশ দেয়, আধা অন্ধ থেকে নিজেদের বীর এবং নেতা মনে করে তবে বুঝতে হবে তারা প্রকৃতই সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী হয়েছে।

এভাবে গোড়ামিবাদী ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীরা বিপরীত দিক থেকে (একজন তত্ত্ব অপরজন অভিজ্ঞতা) শুরু করলেও চিন্তার ক্ষেত্রে তারা মূলত এক। উভয়ই মার্কসবাদী-লেনিনবাদের সার্বজনীন সত্য এবং নিজ দেশের বিশেষ অনুশীলন এ দুটোকে পৃথক করে ফেলে, উভয়েই দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে লংঘন করে, আংশিক ও আপেক্ষিক সত্যকে সার্বজনীন সত্য বলে, এদের কারোরই চিন্তা বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীদের সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতা থাকার কারণে সাধারণ প্রকৃতির সমস্যা সম্পর্কে তাদের স্বাধীন, স্পষ্ট ধারণা থাকেনা। ফলে তারা গোড়ামীবাদের লেজুরবৃত্তি করে।

“চীনা পার্টির ইতিহাস প্রমাণ করে গোড়ামীবাদীরা তাদের বিষ সমগ্র পার্টিতে ছড়াতে পারতো না যদি সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীরা তাদের সহযোগীতা না করতো।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিতে ফজলু-সুলতান চক্র করতে সক্ষম হতো না যদি প্রতারিত সাধারণ কমরেডরা সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী না হতেন।

হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাসার এমনকি মণিসিং-মোজাফফরদের সাধারণ কর্মীরা যদি সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী না হতেন তবে তাদেরকে প্রতারণা করা সম্ভব হতো না।

এ সকল গোড়ামীবাদ পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রধান বিপদ।

কাজেই গোড়ামীবাদ পরিহার করার প্রাক্কালে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদকে বিরোধীতা করতে হবে। গোড়ামীবাদ পরিহার হলে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ মার্কসবাদের বিকাশের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

উপসংহার

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির অধিকাংশ কর্মী ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবি শ্রেণী উদ্ভূত। এরা পাঠ্যপুস্তক মুখস্ত করে পরীক্ষা পাশের অভ্যাস নিয়ে এসেছে। কোন দিন এ সকল বিদ্যা প্রয়োগের প্রয়োজন তাদের হয়নি।

পুরোনো অভ্যাসমত মার্কসবাদী তত্ত্ব মুখস্ত করে এবং বুলি আওড়াতে পছন্দ করে।

তারা পার্টির দলিলের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি ব্যবহার করে।

একইভাবে তারা বিদেশের অভিজ্ঞতাও অন্ধভাবে পাঠ ও গ্রহণ করে।

এ উদ্দেশ্যে সকল ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবি শ্রেণী উদ্ভূত কমরেডদেরকে বুলি মুখস্ত করা, যত্রতত্র তা আওড়ানোর বদঅভ্যাস পরিত্যাগ করে তত্ত্বকে প্রয়োগ করতে এবং সমস্যা নিয়ে তত্ত্ব পড়তে উৎসাহিত করতে হবে।

বুর্জোয়া সমাজের প্রয়োগ বিবর্জিত বোকা বানাবার শিক্ষা পদ্ধতির বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে অনুশীলনের সাথে যুক্ত না করে তত্ত্ব পড়া। এটা বিপ্লবী তত্ত্ব অধ্যায়নে প্রয়োগ করলে তার অনিবার্য পরিণতি গোড়ামীবাদ।

সভাপতি মাও বলেছেন, “বাস্তব উৎপাদনের পদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবিদের শুধু বইয়ের জ্ঞান রয়েছে কিন্তু ইন্দিয়লব্ধ জ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং একারণে তাদের চিন্তার পদ্ধতি গোড়ামীবাদরূপে প্রকাশ পায়।”

কাজেই গোড়ামীবাদ ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবিদের একটি অন্যতম মতাদর্শগত বহিঃপ্রকাশ। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিতে এটা প্রধান বিপদ।

কাজেই পার্টির বুদ্ধিজীবি শ্রেণী উদ্ভুত কর্মীদের গোড়ামীবাদ সম্পর্কে সবর্দা সতর্ক থাকতে হবে, এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং একে পরিহার করতে হবে। পার্টির নির্দেশ, দলিল, অভিজ্ঞতা, লাইন নিয়ে আত্নপ্রসাদ লাভ করা, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার বদভ্যাস পরিহার করে প্রতিনিয়ত তা প্রয়োগ করতে হবে।

যাদের তত্ত্বগত জ্ঞান রয়েছে তাদেরকে অনুশীলনে নিয়ে যেতে হবে।

মার্কসবাদ এবং সংগঠনের লাইনের প্রয়োগের দক্ষতার ওপর কর্মী মূল্যায়ন করতে হবে।

সকল স্তরের নেতৃত্বে গোড়ামীবাদের অনুপ্রবেশ রোধ করতে হবে।

বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বে অনুশীলন বিচ্ছিন্ন তত্ত্বগত জ্ঞান সম্পন্ন কমরেডদের প্রাধান্য ঠেকাতে হবে, তত্ত্ব ও অনুশীলনের সমন্বয় সাধনে সক্ষম কমরেডদের প্রাধান্য দিতে হবে।

অভিজ্ঞতা রয়েছে এরূপ কমরেডদেরকে তত্ত্বগত পড়াশুনা করার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা তাদের ইন্দ্রিয়লদ্ধ জ্ঞানকে সর্বদা সারসংকলন করতে পারেন, ধারণাত্মক জ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেন।

এভাবে প্রতিনিয়ত তারা যাতে জ্ঞানকে, তাদের কাজকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন।

পার্টির রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও অন্যান্য লাইনের সঠিকতার মতাদর্শগত ভিত্তি রয়েছে। এটা নির্ভর করছে বিভিন্ন লাইন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দ্বান্দ্বিক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং পূর্ববাংলার বিপ্লব ও জনগণের প্রয়োজন থেকে শুরু হয়েছে কিনা।

কাজেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা অধ্যায়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে পূর্ববাংলার সমস্যাবলীর অধ্যয়ন ও তার সমাধান হিসেবে সঠিক লাইন প্রণয়ন করা এবং তা প্রয়োগ করে সমাজকে রূপান্তরিত করা।

কাজেই বিপ্লব, জনগণ ও পার্টির স্বার্থে আমাদেরকে তত্ত্বের সাথে অনুশীলনের সংযোগ এবং অনুশীলনের সাথে তত্ত্বের সংযোগ করতে হবে, গোড়ামীবাদ পরিহার করতে হবে, একই সাথে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদকে ঠেকাতে হবে। তত্ত্ব অনুশীলনের সমন্বয়ের মার্কসবাদী প্রাণবন্ত রীতি রপ্ত করতে হবে।