সিরাজ সিকদার রচনাঃ কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে ঐক্যকে দৃঢ় করুন, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানীদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যান!

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্র লালঝাণ্ডা সংখ্যা নং ২ এর সম্পাদকীয় হিসেবে রচনা ও প্রকাশ মে ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৪


পিডিএফ

পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের কামানের গোলার শব্দের মাঝে গড়ে উঠে ৩রা জুন, ১৯৭১ সালে আমাদের প্রাণপ্রিয় “পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি”। কমরেড সিরাজ সিকদার প্রণীত সঠিক লাইন এবং তা বাস্তবায়নে কর্মীদের মহান আত্মত্যাগ ও কঠোর প্রয়াসের মাধ্যমে পার্টি সমগ্র পূর্ববাংলাব্যাপী গণভিত্তিক পার্টি হিসেবে বিকাশ লাভের পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এ সময় পার্টির আভ্যন্তরীণ শ্রেণী শত্রু ফজলু-সুলতান চক্র পার্টির চরমতম ক্ষতিসাধনের জন্য পার্টির মাঝে গুজব-অপবাদ রটায়, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে। গুপ্ত হত্যার পরিকল্পনা করে, পার্টির কাজ বন্ধের জন্য অর্থ-অস্ত্র চুরি করে।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল ক্রুশ্চোভের মত কু-দেতা (ষড়যন্ত্র করে হঠাৎ ক্ষমতা দখল) করে পার্টির ক্ষমতা দখল এবং পার্টিকে দেশীয়-আন্তর্জাতিক শত্রুদের স্বার্থরক্ষাকারীদের পার্টিতে পরিণত করা।

তাদের কার্যকলাপ ছয় পাহাড়ের দালাল, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং পূর্ববাংলার ও বিশ্বের বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের জন্য সবচাইতে উৎকৃষ্ট উপহার।

পার্টির নেতৃত্বের সতর্কতা, কর্মীদের আন্তরিকতা এবং পার্টি ও নেতৃত্বের প্রতি তাদের অবিচলিত আস্থার কারণে ফজলু-সুলতান চক্রের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তাদের কেউ কেউ সচেতন বিপ্লবী কর্মীদের বিচারের ভয়ে পলায়ন করে, কেউ কেউ গা বাঁচানোর চেষ্টা করে।

ফজলু-সুলতান চক্র এবং তাদের সাথে যুক্তদের জঘন্যতম অপরাধের জন্য সকল কর্মী দারুণ রোষে ফেটে পড়ছেন। তারা এদের কঠোর শাস্তির দাবী জানাচ্ছেন।

ফজলু-সুলতান চক্র চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে, তারা লজ্জাকর পরাজয় বরণ করেছে। তাদের কেউ কেউ শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী-চক্রান্তকারী এবং সুবিধাবাদী-সুযোগসন্ধানীদের কেউ কেউ এখনো রয়ে গেছে। তারা ভাল মানুষ সেজে পার্টিতে থাকার চেষ্টা করছে।

আমরা অবশ্যই দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথায় ভুলবনা, পাগলা কুকুর পানিতে পড়লে পিটানোর নীতিতে দৃঢ় থাকব। এদের মিষ্ট কথায় ভুলা, এদেরকে পানি থেকে উঠতে দেওয়া, এদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অর্থ হচ্ছে পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থের চরম ক্ষতি সাধন করা।

কাজেই এদের সাথে বিভেদের নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে। এদের খুঁজে বের করা, অপরাধ  নির্ণয় করা, শাস্তি বিধান করা, এদেরকে শর্তহীনভাবে বহিষ্কার করে পার্টিকে পরিষ্কার রাখার বিপ্লবী নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে।

ফজলু-সুলতান চক্রের প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা পরিচালনা সম্ভব হয়েছে আমদের কিছুসংখ্যক কর্মীর কোন কোন বিষয়ে ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি থাকার জন্য।

এ কারণে উপরোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি সংশোধন করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে সমগ্র সংগঠনব্যাপী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

এ শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ায় ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি সংশোধিত হবে, একই সাথে ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানীদের অবশিষ্টাংশ এবং অসংশোধিত অপরিবর্তিত বাসী উপাদান বর্জিত হবে। এ প্রক্রিয়ায় টাটকা ও প্রাণপূর্ণ সক্রিয় নতুন উপাদান পার্টিতে গৃহীত হবে।

যারা আন্তরিকভাবে বিপ্লবী কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারীদের প্রতারণায় বিভ্রান্ত হয়েছেন, তাদের যথেষ্ট সুযোগ প্রদান করতে হবে যাতে শিক্ষার মাধ্যমে রোগ থেকে তারা সেরে উঠেন, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়াতে পারেন।

ফজলু-সুলতান চক্রের এ সকল কার্যাবলীর শেকড় কোথায়?

সভাপতি মাও বলেছেন, “অতীত জান, তাহলে বর্তমান বলতে পারবে, অতীত বর্তমান জান, তাহলে ভবিষ্যত বলতে পারবে।” ফজলু-সুলতান চক্র এবং তাদের সাথে যুক্তদের শ্রেণী খারাপ, অতীতে তারা প্রত্যেকেই কমবেশী ভ্রষ্ট জীবন যাপন করেছে, তাদের প্রত্যেকেরই কমবেশী পদের লোভ, নেতৃত্বের লোভ, নাম যশের লোভ দেখা গেছে।

সুদীর্ঘদিন পার্টিতে থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেদেরকে সংশোধন করতে পারেনি। বিভিন্ন পার্টির ইতিহাসে দেখা যায় কয়েক যুগ ধরেও এ ধরণের অনেকেই সংশোধিত হয়নি।

তাদের ভ্রষ্ট জীবন থকে এসেছে নিজেদেরকে কেউকেটা মনে করা, চক্র গঠন করার সাহস। অসর্বহারা শ্রেণী ভিত্তি থেকে এসেছে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ, পদ-নেতৃত্ব, ক্ষমতা, নাম যশের লোভ।

ফজলু সামন্তবাদী শ্রেণী থেকে এসেছে। ছোট কাল থেকেই শিখে এসেছে অভিনয় করা, দু’মুখো হওয়া। একই শ্রেণী ও পরিবেশ থকে আগত সালমার সাথে তার হুবুহু মিল রয়েছে। ফজলু-সালমা প্রতারণা, অভিনয়, দু’মুখো ব্যবহারের উদাহারণ স্থাপন করে।

তাদের ভ্রষ্ট জীবন এবং কারো কারো ক্ষুদে বুর্জোয়া সামন্ত শ্রেণী ভিত্তি থকে এসেছে অভিনয় করা, প্রতারণা করা, মিথ্যা বলা, দু’মুখো হওয়ার খারাপ স্বভাব।

বুর্জোয়ারাও তাদের শ্রেণীর স্বার্থে প্রতারণা করে, ভাওতা দেয়, দু’মুখো হয়, মিথ্যা বলে। ইহা সকল শোষক শ্রেণীর শ্রমিক-কৃষক জনতাকে শোষণ করার সাধারণ কৌশল।

কাজেই পার্টির কর্মী সংগ্রহ ও নিয়োগের সময় তাদের শ্রেণী ও অতীতের জীবন (বিশেষ করে ভ্রষ্ট ছিল কিনা তা), পদের লোভ, নেতৃত্ব-ক্ষমতার লোভ, নাম যশের লোভ এবং অন্যান্য ব্যক্তি স্বার্থ রয়েছে কিনা তা কঠোরভাবে যাচাই করতে হবে।

অন্যথায় অসর্বহারা শ্রেণী থেকে আগত ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্যকারীরা ফজলু-সুলতান চক্রের মত পার্টির চরম ক্ষতি সাধন করবে।

এ কারণে পার্টি কর্তৃক জরুরী ভিত্তিতে প্রতিটি কর্মীর কেডার ইতিহাস সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

ফজলু-সুলতান চক্র পার্টির কিছুটা প্রতিকুলতা অস্থায়ীভাবে সৃষ্টি করেছে। কিন্তু খারাপ জিনিসও ভাল জিনিসে রূপান্তর করা যায়।

ফজলু-সুলতান চক্রকে বহিষ্কার করে পার্টি চূড়ান্ত বিশ্লেষণে শক্তিশালী হয়েছে। ফজলু-সুলতান চক্র থেকে পার্টি অর্জন করেছে একটি অতিশয় মূল্যবান অভিজ্ঞতা। ফজলু-সুলতান চক্র হচ্ছে আমাদের নেতিবাচক শিক্ষক। কাজেই তাদের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করা, তার নিয়মবিধি বের করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো একটি বিপ্লবী দায়িত্ব।

সমগ্র পার্টি শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ায় এবং সাধারণভাবে ফজলু-সুলতান চক্র সম্পর্কিত নেতিবাচক অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করবেন এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন।

ফজলু-সুলতান চক্রের আবির্ভাব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইহা পার্টি অভ্যন্তরে সর্বহারা শ্রেণী ও অসর্বহারা শ্রেণীর মধ্যকার শ্রেণী সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি। ফজলু-সুলতান চক্র এবং তাদের সাথে যুক্তদের বহিষ্কারের মাধ্যমেই এ সংগ্রাম শেষ হবে না। যতদিন পূর্ব বাংলার সমাজে শ্রেণী থাকবে ততদিন পার্টির অভ্যন্তরে শ্রেণী সংগ্রাম শেষ হবে না। পার্টি অভ্যন্তরে প্রতিটি প্রশ্নে দুধরনের মতামত আসবে— সর্বহারা ও অসর্বহারা। এর মাঝে সংগ্রাম চলবে, সর্বহারা জিতবে না অসর্বহারারা জিতবে তা নির্ধারণের জন্য সংগ্রাম কখনও কখনও অতিশয় তীব্র আকার ধারণ করবে।

এ সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় অনিবার্যভাবেই কিছুসংখ্যক অসর্বহারারা অসংশোধিত হিসেবে আত্নপ্রকাশ করবে, তাদের কেউ কেউ তাদের ভুল মতামত কার্যকরী করার জন্য পদ, নেতৃত্বের জন্য ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করবে।

পার্টির মধ্যকার সর্বহারা বিপ্লবীদের দায়িত্ব হলো পার্টির মধ্যকার সর্বহারা স্বার্থরক্ষাকারীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, অসর্বহারাদের ভুল লাইনকে পরাজিত করা, তাদের চক্রান্ত–ষড়যন্ত্রকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা, বাসী উপাদান বর্জন করা।

এভাবে সর্বহারা বিপ্লবীদের বিজয় হলে পার্টি বিপ্লবী থাকবে, অব্যাহত হবে…,সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণকে ক্ষমতা দখল ও তা বজায় রাখার সংগ্রামে পার্টি নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।

আর অসর্বহারাদের বিজয় হলে পার্টি অসর্বহারাদের পার্টিতে রূপান্তরিত হবে, পার্টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া ও শোষকদের স্বার্থরক্ষাকারী পার্টিতে পরিণত হবে। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিতে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতিনিধিত্ব করেন পার্টির মধ্যকার সর্বহারাদের। ইহা পার্টির মধ্যকার সর্বহারাদের একমাত্র কেন্দ্র। কাজেই প্রতিটি প্রশ্নে সচেতনভাবে বুঝে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটিকে রক্ষা করা, তা সমর্থন এবং তা যাতে অসর্বহারাদের উপর বিজয় অর্জন করে তা নিশ্চিত করা প্রতিটি বিপ্লবীর মহান দায়িত্ব।

কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন সকল কর্মী ঐক্য ও আস্থা দৃঢ় করবেন, অসর্বহারা চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাবেন, প্রতিকুলতাকে অনুকুলতায় রূপান্তরিত করে অধিকতর বিজয় অর্জন করবেন। ■