সিরাজ সিকদার রচনাঃ সমালোচনা-আত্মসমালোচনার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পয়েন্ট

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ মে ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ৩০ নভেম্বর ২০১৩


 

পিডিএফ

* পার্টির মাঝে সর্বদাই দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম থাকবে। ইহা সর্বহারা চিন্তাধারা ও কর্মপদ্বতির সাথে অসর্বহারা চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির সংগ্রাম। ইহা পার্টির মধ্যকার শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রতিফলন।

* পার্টির মধ্যকার দ্বন্দ্বের সমাধানের গণতান্ত্রিক পদ্বতি হচ্ছে ঐক্য-সমালোচনা-আত্মসমালোচনা-ঐক্য। ঐক্যের উদ্দেশ্য নিয়ে সমালোচনা-সংগ্রাম করা, যুক্তিসহ বুঝানো, শিক্ষা প্রদান করা, আত্মসমালোচনা ও ত্রুটি শোধরানোর মাধ্যমে দ্বন্দ্ব সমাধান করে নতুন ঐক্যে পৌঁছান। ইহা পার্টির অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব সমাধানের পদ্ধতি।

* ‘রোগ সারিয়ে রোগীকে বাঁচানো’, ‘অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানো’ এবং মতাদর্শগতভাবে পরিষ্কার হওয়া ও কমরেডদের মধ্যকার ঐক্য প্রতিষ্ঠার দু’লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

কাজেই কমরেডদের গুরুত্বসহকারে সমালোচনা করা উচিত। কিন্তু একই সাথে তারা যাতে জেগে উঠেন, সংশোধিত হন তার জন্য সময় দেয়া উচিত। কাজেই প্রথমে অতিমাত্রায় সংগ্রাম করা, ‘এক আঘাতেই খতম’ করার পদ্ধতি পরিহার করা উচিত।

অবশ্য কোন কমরেড যদি রোগকে গোপন করেন, বারংবার বুঝানো ও শিক্ষা প্রদানের পরও ভুলে লেগে থাকেন, তা আরও বাড়িয়ে তোলেন, আজেবাজে ভিত্তিহীন গুজব ও অপবাদ রটান, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত আঁটেন, চক্র-উপদল গঠন করেন, চিকিৎসার সাধ্যাতীত অবস্থায় পড়েন, কেবলমাত্র তখন তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালিত হবে।

এ সকল ত্রুটি নিয়ে থাকতে পারে এরূপ স্তরে নামিয়ে দেওয়া, সকল পদ থেকে সরিয়ে পার্টির মাঝে রেখে যাচাই করে দেখা, সংগঠনের মধ্যে এ সকল ত্রুটি নিয়ে থাকা সম্ভব না হলে অধঃপতিত ব্যক্তি হিসেবে বের করে দেওয়া, সহানুভূতিশীলের পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়া ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া যায়। কেউ যদি চক্র গঠন, উপদল গঠন, শত্রুর সাথে যোগাযোগ করে তখন তাকে বহিষ্কার এবং অন্যান্য শাস্তি প্রদান করা যায়।

* বুর্জোয়া পদ্ধতি হলো উদারতাবাদ প্রদর্শন করা, পার্টির অভ্যন্তরে নীতিহীন শান্তির পক্ষ নেওয়া, পরস্পরের দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে চলা, পরস্পরকে তোষামোদ করা, পরস্পরকে রক্ষা করা।

অপর এক বুর্জোয়া পদ্ধতি হলো পিছনে সমালোচনা, গুজব, অপবাদ রটনা করা, আজেবাজে কথাবার্তা বলা, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করা, উপদল গঠন করা।

* কোন কমরেড বা স্তর সম্পর্কে সমালোচনা, মন্তব্য, অভিযোগ, বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট কমরেড বা স্তর বা তার ওপরের স্তরকে লিখিত বা মৌখিকভাবে না জানিয়ে, সমস্তরের হলে সভায় না বলে (ক) অসৎ উদ্দেশ্য ব্যতীত অভ্যাসবশে উক্ত কমরেড বা স্তরের পিছনে অন্য কমরেডের নিকট সমালোচনা, অভিযোগ, মন্তব্য পেশ করা, ভিত্তিহীন আজেবাজে কথাবার্তা, গুজব, অপবাদ, বিদ্রুপ করা (খ) বা অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে উপরোক্ত কাজ করা, তখন ইহা ষড়যন্ত্র, চক্রান্তের পর্যায়ে পড়বে।

এর উদ্দেশ্য হলো কোন কমরেড বা স্তর সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করা, আস্থা কমিয়ে দেওয়া, হতাশার সৃষ্টি করা, কিছু লোককে দলে টেনে আনা, উপদল, চক্র সৃষ্টি করা, পার্টির মাঝে বিভিন্ন কেন্দ্র গড়ে তোলা, পার্টির ঐক্য বিনষ্ট করা, শত্রুকে সহায়তা করা, বিপ্লব, পার্টি ও জনগণের ক্ষতি করা।

অভ্যাসবশতঃ এ কাজ করলেও উপরোক্ত ক্ষতিসমূহ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

অসৎ উদ্দেশ্যে যারা একাজ করেন তারা অনেক সময় যার সাথে আলাপ করেন তাকে গোপন রাখতে, রিপোর্ট না করতে বলেন।

তারা সাধারণতঃ সুবিধাবাদী, অসন্তুষ্টদের সাথে আলাপ করেন, তাদেরকে দলে টানতে চান।

সুবিধাবাদীরাই পার্টির মাঝে সকল প্রকার চক্র, উপদল, হতাশা, অনৈক্য, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, গুজব, অপবাদের উৎস।

এ ধরণের কার্যকলাপের টের পেলে সঙ্গে সঙ্গে উচ্চস্তরে রিপোর্ট করা উচিৎ।

কোন কমরেড বা স্তর সম্পর্কে তার পিছনে বলা কথাবার্তা, সমালোচনা, মন্তব্য, বিদ্রুপ, গুজব শুনে বিশ্বাস করা উচিৎ নয়। সভাপতি মাও বলেছেন, এক পক্ষকে শুনলে আঁধারে ডুববেন, উভয় পক্ষকে জানলে আলোক উজ্জ্বল হবেন।

এ অবস্থায় উচিৎ এ ধরণের কথাবার্তা যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে তাকে বা তার স্তরকে বা উচ্চস্তরকে জানিয়ে দেওয়া এবং সত্যতা যাচাই করা।

যে কমরেড পিছনে বলেন তাকে সমালোচনা করা উচিৎ। পিছনে বলা কথাবার্তা শুনে সমালোচনা করা উচিৎ নয়।

কোনক্রমেই নিষেধ বা গোপন রাখার অনুরোধ মেনে রিপোর্ট করা থেকে বিরত থাকা বা সমালোচনা না করা উচিৎ নয়। তাহলে তিনি চক্রান্তের অংশীদার হবেন।

* কমরেড বা স্তর সম্পর্কে সমালোচনা, বক্তব্য, মন্তব্য অভিযোগ ঘটনা ঘটার সময় পেশ না করে কয়েকমাস পরে করা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেবে এতদিন কোন বক্তব্য পেশ না করে হঠাৎ করা হচ্ছে কেন?

অনেক কমরেড তার স্বার্থে আঘাত লাগার ফলে প্রতিশোধবাদের কারণে বানোয়াট ভিত্তিহীন অভিযোগ খাড়া করেন, অনেকদিন পূর্বে ঘটেছে তাই যাচাই করতে অসুবিধা—এ সুযোগ নেন।

এ কারণেই সভাপতি মাও বলেছেন, সমালোচনা যথাসময়ে করা উচিৎ, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সমালোচনা করার শখ থাকা উচিৎ নয়।

ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা উচিৎ।

* সমালোচনা গ্রহণ করতে না পারা;

কোন কোন কমরেড অন্যদের কাছে থেকে উদারতাবাদ, হালকা সমালোচনা, তোষামোদ করা আশা করেন।

“যা জানেন বলুন, যদি জানেন সবটাই বলুন, ভুল থাকলে শুধরে নিন, না থাকলে সতর্কবাণী হিসেবে গ্রহণ করুন”, অনেকে সমালোচনা শুনার সময় এ মনোভাবকে গ্রহণ করতে পারেন না।

তারা অভিমান, কান্নাকাটি করেন, কেউ প্রতিশোধের ছুতা খোঁজেন। এগুলো ব্যক্তিতাবাদ, অর্থাৎ ব্যক্তিস্বার্থ থেকে আসে।

অনেক সময় তারা সমালোচনার বিষয়বস্তুকে গ্রহণ না করে পদ্ধতিকে বিরোধিতা করার নামে সমালোচনাকে এড়িয়ে যান।

আবার অনেক সময় ‘আমার সবই ভুল’ একথা বলে সমালোচনা এড়িয়ে যেতে চান।

কাজেই সমালোচনার পদ্ধতিকে বিরোধিতা করার সুযোগ যাতে কেউ না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ। অর্থাৎ যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণাত্মকভাবে সমালোচনা করা উচিৎ।

* সমালোচনা বাস্তবভিত্তিক অর্থাৎ বাস্তবে যা ঘটেছে তাই হওয়া উচিৎ। ইচ্ছা খুশীমত কথাবার্তা বলা, ভাসাভাসাভাবে, একতরফাভাবে, আত্মগতভাবে সমালোচনা করা উচিৎ নয়।

* সমালোচনার নামে যা-তা বলা, ইতরামী, স্বেচ্ছাকারী করা, গুজব, অপবাদ রটনা করা উচিৎ নয়।

* কোন কমরেড সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট স্তর বা উচ্চস্তর কর্তৃক অনুমোদিত সমালোচনা, মন্তব্য যথাযথ অনুমতি থাকলে ঐ স্তরের আওতাধীন কর্মীরা শিক্ষার জন্য আলোচনা করতে পারেন।

কিন্তু অননুমোদিত ব্যক্তিবিশেষের মন্তব্য, সমালোচনা, তার নিজস্ব অভিমত, তিনি উহা সংশ্লিষ্ট স্তর, উচ্চস্তর বা কমরেড ব্যতীত অন্য কারো সাথে আলোচনা করতে পারেন না।

* কেউ দেখিয়ে না দিলেও নিজে নিজে ভুলের জন্য আত্মসমালোচনা করা এবং অন্যের সমালোচনা আহ্বান করা প্রমাণ করে যে, তিনি একজন ভালো কমরেড। আমাদের সর্বদা এরূপ হওয়া উচিৎ।

* ছিদ্রানুসন্ধান করাঃ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক স্বার্থের সাথে জড়িত না হলে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ছিদ্রানুসন্ধান করা উচিৎ নয়। এর ফলে কোন কোন কমরেড সম্পর্কে সাধারণ কর্মীদের ধারণা খারাপ হয়ে পড়ে, সে নিজেও অতিসাবধানী ভদ্রলোক হয়ে যাবেন।

এগুলো হচ্ছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যা সমালোচনা-আত্মসমালোচনা বিষয়ক শুদ্ধি অভিযানের সময় আলোচিত হওয়া উচিৎ। ■