সিরাজ সিকদার রচনাঃ পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে প্রদত্ত রিপোর্ট

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ জানুয়ারি ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক www.sarbaharapath.com এর অনলাইন প্রকাশনা ৩ অক্টোবর ২০১৩


 

পিডিএফ

 

কমরেডগণ,

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেস পূর্ব বাংলার বিপ্লব এবং পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হবে। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন এক সময় যখন পূর্ব বাংলার সমাজের গুরুতর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীরা আত্মবলিদান ও নির্ভীকতার মহান উপাখ্যানের সৃষ্টি করেছেন এবং রক্তের বিনিময়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

এ কারণে কংগ্রেস অনুষ্ঠান খুবই সময়োচিত হয়েছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া

শ্রেণী সমাজের উদ্ভবের পর থেকে নিপীড়িত শ্রেণীসমূহ শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ করে। তাদের এই বিদ্রোহ ও সংগ্রামই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

মীরজাফর কর্তৃক ক্ষমতার লোভে ব্রিটিশ দস্যুদের ডেকে এনে বাংলা ও ভারতকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার পর এ দেশের জনগণ বৈদেশিক শোষণ ও লুন্ঠনের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ করে। সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় এ সকল বিদ্রোহ সফলতা অর্জন করেনি।

বৃটিশ দস্যুরা তাদের পুঁজির স্বার্থে আমলাতান্ত্রিক পুঁজির সৃষ্টি করে। তারা সামন্তবাদকে জিইয়ে রাখে। তারা সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও তাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের ওপর নির্ভর করে এ দেশকে শোষণ ও লুন্ঠন করে।

এ সময় এ দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয় সর্বহারা শ্রেণী। এ শ্রেণীকে সংগঠিত করা ও শ্রমিক-কৃষক জনতাকে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য বিশ শতকের ত্রিশ দশকের প্রথম দিকে গড়ে উঠে পাক-ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি। এ পার্টি গঠনের প্রথম থেকেই সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীরা পার্টির ক্ষমতা দখল করে এবং পার্টিকে বিপথে পরিচালিত করে।

সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি ছিল রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এই প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীরা উপনিবেশিক সামন্তবাদী ভারতবর্ষের উপরিকাঠামোর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র দখল করেছিল।

সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষাকারী গান্ধী উপরিকাঠামোর রাজনৈতিক ক্ষেত্র দখল করেছিল।

এরা অহিংস-অসহযোগ এবং সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের সাথে আপোষের রাজনীতির পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে, যার প্রভাব থেকে সর্বহারা শ্রেণীতে আগত বুদ্ধিজীবীরা কখনও মুক্ত হতে পারেনি। এ সকল অপরিবর্তিত বুদ্ধিজীবীদের অমার্কসীয় চিন্তাধারা মার্কসবাদের বুলির আবরণে সংশোধবাদ ও সুবিধাবাদ হিসেবে বহিঃপ্রকাশ করে। তারা সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের লেজুড়ে পরিণত হয়।

তেলেঙ্গানার কৃষকদের গেরিলা সংগ্রাম, কৃষকদের তেভাগা সংগ্রাম, ১৯৪৫-৪৬-এর দেশব্যাপী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দানে এরা ব্যর্থ হয়।

ফলে বৃটিশ উপনিবেশিক দস্যুরা তাদের দালাল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী এবং প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী যারা ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাদের হাতে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

বৃটিশ উপনিবেশিক দস্যু ও তাদের দালাল প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু-ধর্মাবলম্বী বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তানে যোগদান করে।

পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদী শোষণ টিকিয়ে রাখে, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ অব্যাহতভাবে বিকাশ করতে দেয় এবং সামন্তবাদের সাথে আপোষ করে একে টিকিয়ে রাখে। এভাবে  তারা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রাখে।

পূর্ববাংলার পাকিস্তানে যোগদান ও সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসানজনিত কারণে যে সামজিক অগ্রগতি সাধিত হয়, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিকে সংশোধবাদী কমিউনিস্ট পার্টি তাকে সামজিক অগ্রগতি বলে স্বীকার করেনি।

তারা সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদকে পরিপূর্ণরূপে উৎখাত করা, পূর্ববাংলার জাতীয় বিকাশের সকল প্রকার অন্তরায় দূর করার কর্মসূচী গ্রহণ করেনি, বরং সামাজিক বিকাশের স্তরকে অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রের শ্লোগান দেয় এবং ট্রটস্কীবাদী বিচ্যুতি ঘটায়।

পরবর্তীকালে এই সংশোধনবাদীরা নিয়মতান্ত্রিকতা ও শান্তিপূর্ণ পার্লামেন্টারী পথ অনুসরণ করে। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষণার পর তারা ন্যাপে যোগদান করে।

যুবলীগ গঠন ও তার বিকাশ, মহান ভাষা আন্দোলন, পরবর্তীকালে ছাত্র ইউনিয়ন গঠন ও তার বিকাশ, ন্যাপ প্রভৃতির মাধ্যমে পূর্ববাংলার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী বামপন্থী প্রভাবে পড়ে।

কিন্তু সংশোধনবাদী নেতৃত্ব সকল বুদ্ধিজীবীদের শ্রমিক কৃষকদের সাথে একীভূত করা, মার্কসবাদ অধ্যয়ন ও প্রয়োগ এবং বিপ্লবী শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামে পোড় খাইয়ে, মতাদর্শগতভাবে পুনর্গঠিত করে সর্বহারা বিপ্লবীতে রূপান্তরিত করতে ব্যর্থ হয়। পূর্ববাংলার উপর জাতীয় নিপীড়নের বিরোধিতা, সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ উৎখাতের জন্য গ্রামে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু না করার ফলে লক্ষ লক্ষ বুদ্ধিজীবীদের পার্টিতে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সোভিয়েট আধুনিক সংশোধনবাদীদের নেতৃত্বে সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সভাপতি মাওয়ের নেতৃত্বে খাঁটি মার্কসবাদী বিপ্লবীদের বিরাট তর্কযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে চীন থেকে সভাপতি মাওয়ের রচনাবলী পূর্ববাংলায় আসে।

এর ফলে অতি সত্বর সংশোধনবাদীদের মুখোশ সর্বহারা বিপ্লবীদের সামনে উন্মোচিত হয় এবং সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মতাদর্শগত প্রস্তুতির সৃষ্টি হয়।

অবশেষে সংশোধনবাদীদের উৎখাতের জন্য সভাপতি মাও মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আহবান জানালেন “প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত”। এ মহান আহবানে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা নকসালবাড়ীতে কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান করে, গড়ে তোলে ভারতের সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি-ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)।

পূর্ববাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা মণি সিংহ-মোজাফফর সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাদের এ বিদ্রোহের সুযাগ গ্রহণ করে হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা জোতি বসু–নাম্বুদ্রিপদের অনুসরণে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে এবং জোতি বসু-নাম্বুদ্রিপদের সংশোধনবাদী লাইন অনুসরণ করে। তারা পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্ন ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশ্নে বিশ্বাসঘাতকতা করে।

বিশ্বাসঘাতক নয়া সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সাধারণ কর্মীরা বিদ্রোহ করে। এ বিদ্রোহের সুযোগ গ্রহণ করে ট্রটস্কী-চেবাদী দেবেন-বাসার, আলাউদ্দিন-মতিন, কাজী-রণো ষড়যন্ত্রকারীরা সাধারণ বিপ্লবীদের প্রতারিত করে। ইতিমধ্যে হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা নিজেদের নাম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রেখে পূর্ববাংলার ও ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীদের প্রতারিত করার চেষ্টা চালায়।

এ সকল বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী বিশ্বাসঘাতক প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সর্বহারা বিপ্লবীরা বিদ্রোহ করে এবং সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুতি সংগঠন “পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন” ১৯৬৮ সালের ৮ই জানুয়ারী প্রতিষ্ঠা করে।

পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়া, তাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রামে পরিচালনার জন্য গ্রামে যায়, তাদের কাছ থেকে পুনরায় শিক্ষা গ্রহণ করে মতাদর্শগতভাবে পুনর্গঠিত হওয়ার সঠিক পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

বামপন্থী ছাত্র ও অন্যান্যদের মাঝে কাজ করার জন্য কিছু সংখ্যক ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের শহরে রাখা হয়। এদের মাঝে একাংশ নেতৃত্বের লোভে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এর ফলে শ্রমিক আন্দোলন বুদ্ধিজীবীদের গণসংগঠনের নেতৃত্ব হারায়। এই বিশ্বাসঘাতকদের প্রতিনিধি নুরুল হাসান, আকাম ফজলুল হক, মাহবুবুল্লা শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদীতে পরিণত হয়।

পূর্ববাংলার বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীরা পূর্ববাংলার জাতীয় নিপীড়ণের বিরোধিতা না করে পূর্ববাংলার জনগণকে নেতৃত্বহীন রাখে। পূর্ববাংলার আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীরা এ সুযোগ গ্রহণ করে জাতীয় প্রশ্নের ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিক্রিয়াশীলদের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলনকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য, যাতে সে চীন বিরোধী কমিউনিস্ট-বিরোধী পাক-ভারত যৌথ সামরিক জোট স্থাপন করে।

পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের পঁচিশে মার্চের পরবর্তী সময়কার ফ্যাসিস্ট তৎপরতার ফলে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলন পরাজিত হয়। তারা অনেকেই ভারতে আশ্রয় নেয়।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এশিয়ায় প্রভুত্ব স্থাপন, ভারতের মাধ্যমে পূর্ববাংলায় তার নয়া উপনিবেশ কায়েম, ভারত মহাসাগরে নিয়ন্ত্রনের জন্য সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ভারতের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীলদের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলন ব্যবহার করে।

সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী সমর্থন ও সহায়তায় শেষ পর্যন্ত ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করে এবং পূর্ববাংলা দখল করে নেয়; পূর্ববাংলায় তারা উপনিবেশ স্থাপন করে।

পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন পূর্ববাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা এবং পূর্ববাংলার জাতীয় সমস্যা সমাধানের সঠিক রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করে। এই সঠিক রাজনৈতিক লাইনের ভিত্তিতে গড়ে তোলা হয় জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনার সঠিক সামরিক লাইন।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কাজ দ্রুতগতিতে বিকাশ লাভ করে এবং পূর্ববাংলার বিভিন্ন স্থানে সংগঠন গড়ে উঠে।

সভাপতি মাও বলেছেন, ‘সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই পার্টি বিকাশ লাভ করে ও সুসংবদ্ধ হয়’। পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা দেশীয় অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। তারা পূর্ববাংলার বুকে সর্বপ্রথম প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান কাউন্সিল ও মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে বোমা বর্ষণ করে। আমাদের গেরিলারা সর্বপ্রথম ফটিকছড়িতে জাতীয় শত্রু খতম করে।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন সর্বপ্রথম মুন্সিগঞ্জ, ঝালকাঠি ও অন্যান্য স্থানে পূর্ববাংলার বর্তমান জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। এ জাতীয় পতাকার নকসা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক তৈরী। বাংলাদেশ পুতুল সরকার শেষ পর্যন্ত এ পতাকা গ্রহণ করে।

পঁচিশে মার্চের পরবর্তীকালীন নির্যাতনের ফলে পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা অস্থায়ীভাবে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু কর্মীরা এ অসুবিধা কাটিয়ে উঠে পুনরায় একত্রিত হয় এবং পূর্ববাংলার জনগণকে সঠিক পথে সংগ্রামে পরিচালনা করে।

পূর্ববাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম পেয়ারা বাগানে গড়ে উঠে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে নিয়মিত সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি বাহিনী। এই অঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার সময় পার্টি নিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলা, সামরিক বাহিনীর মধ্যকার রাজনৈতিক-সামরিক, পার্টি কাজ, রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম, ভূমিহীন কৃষকের মাঝে জাতীয় শত্রুর ভূমির বিতরণ করা, জনগণের সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলা, ঘেরাও-দমনজনিত সমস্যা, সশস্ত্র বাহিনীকে বিকশিত করা, গেরিলা যুদ্ধকে সম্প্রসারিত করা এবং অন্যান্য বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করে। এর ফলে পূর্ববাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম গড়ে উঠে ঘাঁটি এলাকা। এ সকল অভিজ্ঞতা বিপ্লবী পার্টির জন্য সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ।

সমগ্র পূর্ববাংলায় ও ভারতে পেয়ারা বাগানের সংগ্রাম একটি রূপকথার সৃষ্টি করে।

এ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক লাইন সঠিক বলে প্রমাণিত হয়, বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের পুরোপুরি দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হয়, সংগঠনের কর্মীরা বিপ্লবী অনুশীলনে পোড় খায়, সশস্ত্র বাহিনী ও ঐক্যফ্রন্ট গড়ে উঠে। এভাবে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিকভাবে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার বস্তুগত অবস্থার সৃষ্টি হয়।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী পরিষদ ও নেতৃস্থানীয় কর্মীদের সভায় গ্রহণ করা হয় পূর্ববাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। এভাবে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ৩রা জুন, সমাপ্ত হয় পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকা।

পূর্ববাংলার এই বিপ্লবী পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছেন শত-সহস্র বিপ্লবী, অবশেষে সার্থক হলো তাদের স্বপ্ন।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীরা এবং পাক সামরিক ফ্যাসিস্টরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে।

বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীরা পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও তার কর্মীদের বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা, অপবাদ ও গুজব রটায়। কখনও কখনও এরা পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।

পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বহু কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের গ্রেফতার করে, আরও অনেকের বিরদ্ধে বিরাট আকারে অর্থ পুরস্কারসহ গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন সংক্রান্ত তদন্ত সরাসরি পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রেসিডেন্টের অধীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সামরিক বাহিনী দ্বারা পরিচালিত হয়। এমনকি তারা কানাডা ও আমেরিকা থেকে বিশেষজ্ঞ ও যন্ত্রপাতি আনয়ন করে।

জেলের মধ্যে গ্রেফতারকৃত কর্মীদেরকে কথা বের করা, নেতৃস্থানীয় কর্মীদের বিশেষ করে কমরেড সিরাজ সিকদারকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়; অনেককে নির্দয়ভাবে সকল প্রকার অত্যাচার করা হয়; ক্যান্টনমেন্টে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট ও বৈদেশিক বিশেষজ্ঞ দ্বারা নির্যাতন ও শাসানো হয়। এ সকল নির্যাতন যশোর ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেডিয়ার দুররানীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।

গ্রেফতারকৃত কমরেডদের মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের সেলে একা রাখা হয়, নিজেদের মধ্যে যাতে দেখা-সাক্ষাত না হয় তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি এ উদ্দেশ্যে তাদেরকে বিভিন্ন জেলে রাখা হয়।

সংগঠনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য তারা নানাবিধ প্রলোভন দেখায়।

পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা বামপন্থীদের মাঝে কেবলমাত্র আমাদেরকেই একমাত্র শত্রু বলে গণ্য করে এবং আমদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের ও পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরমতম বিরোধিতা ও নির্যাতন এবং প্রলোভন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন টিকে থাকে, তার অগ্রগতি টিকে থাকে, তার অগ্রগতি অব্যাহত রাখে এবং বিরাট অর্জন করে, সমাপ্ত করে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা।

পূর্ববাংলার সর্বহারার পার্টির কার্যাবলী

অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এ সময় পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা বরিশাল জেলার সমস্ত শক্তি ও আশেপাশের সাহায্য নিয়ে পেয়ারা বাগানে প্রচণ্ড ঘেরাও-দমন অভিযান চালায়। তারা বন্দুকের ডগায় শত-সহস্র মুসলিম জনগণকে এ হামলায় শরীক করায়।

এ প্রচণ্ড চাপের মুখে পেয়ারা বাগান থেকে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীদের প্রত্যাহার করা হয়।

আমাদের গেরিলা ইউনিটের নেতৃত্বে অচিরেই গৌরনদী, মাদারীপুর, পেয়ারা বাগানের আশেপাশে, মঠবাড়িয়া, খেপুপাড়া, পাথরঘাটা, পাদ্রীশিবপুর, ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী, টাংগাইল, পাবনা, ফরিদপুর, খুলনা জেলার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে।

পূর্ববাংলার প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, বুদ্ধিজীবী ও সামন্তবাদীরা পূর্ববাংলাকে ভারত ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নিকট বিক্রি করে। ভারত পূর্ববাংলা দখল ন্যায়সঙ্গত করার জন্য তাদের দিয়ে একটি পুতুল সরকার কায়েম করে এবং তাদেরকে কামানের খোরাক হিসেবে ব্যবহার করে। তারা পূর্ববাংলায় উপনিবেশ স্থাপনের একমাত্র বাধা পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি ও তার কর্মীদের খতম করার কাজকে প্রাধান্য দেয়। তারা আলোচনার কথা বলে বা গোপনে অনুপ্রবেশ করে বা আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ফ্রন্টসমূহ ধ্বংস করার পদক্ষেপ নেয়। তারা তাদের গণসমর্থন এ কাজে ব্যবহার করে।

আমাদের কর্মীরা আমাদের গণসমর্থনকে প্রকাশ্য গণসংগ্রামে লাগাতে এবং জনগণকে সংগঠিত করতে ও শিক্ষিত করতে, নিজেদের সারি সর্বদা পরিষ্কার রাখতে, জনগণের সাথে একীভূত হয়ে কাজ করতে, কর্মীদের পার্টিগত লাইনে যথাযথভাবে শিক্ষিত করে তুলতে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রায় সকল স্থানেই আমাদের ঘাঁটিসমূহ উৎখাত হয়, বহু কর্মী নিহত ও নিখোঁজ হয়, অস্ত্র হারানো যায়।

এভাবে আমাদের আক্রমণ করে তারা প্রমাণ করে যে, বুর্জোয়াদের সাথে যখন সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয় তখন তারা কমিউনিস্টদের ধ্বংস করতে সাহসী হয় না, বরঞ্চ নিজেদের রক্ষার জন্য কমিউনিস্টদের সহায়তা নেয়। পক্ষান্তরে যখন সাম্রাজ্যবাদের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকে তখন তারা কমিউনিস্টদের ধ্বংস করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হওয়া সত্ত্বেও কর্মীদেরকে পুনরায় কাজে বিন্যাস ও নিয়োগ সম্ভব হয়।

ইতিমধ্যে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ববাংলার মুক্তি সংগ্রামে সহায়তার নামে পূর্ববাংলা আক্রমণ ও দখল করে নেয়, পূর্ববাংলায় তার উপনিবেশ স্থাপন করে এবং পূর্ববাংলায় তার পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে।

সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাবেদার ভারতীয় সম্প্রসারনবাদ, তাদের তাবেদার ছয় পাহাড়ের দালালরা পূর্ববাংলাকে কমিউনিস্ট বিরোধী, চীন বিরোধী ঘাঁটিতে পরিণত করে।

এভাবে পূর্ববাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়ে যায়।

মনি সিং-মোজাফফর সংশোধনবাদীদের পার্লামেন্টের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখলের ভাওতা সম্পূর্ণরূপে দেউলিয়া বলে প্রমাণিত হয়। তারা ভারতে যেয়ে আশ্রয় নেয়, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও আওয়ামী লীগের লেজুড় হিসেবে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র তুলে ধরে।

হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা শ্রেণীদ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, শ্রেণী শত্রু খতমের লাইন অনুসরণ করে জনগণকে খতম করে এবং পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে হাত মিলায়।

মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাসার ট্রটস্কী-চেবাদীরা জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শ্রেণীশত্রু খতমের কথা বলে মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চেবাদীরা পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালালী করে। দেবেন-বাসার ট্রটস্কী-চেবাদী, কাজী-রণো ষড়যন্ত্রকারীরা শ্রেণী দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, শ্রেণী শত্রু খতমের বক্তব্য প্রত্যাহার করে, কোন প্রকার আত্মসমালোচনা ব্যতিরেকেই জাতীয় সংগ্রামকে প্রধান সংগ্রাম বলে। তারা ভারতে জোতি বসু-নাম্বুদ্রিপদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘তথাকথিত সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে। সমন্বয় কমিটির বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী উপদলগুলো পূর্ববাংলায় ভারতের উপনিবেশ স্থাপনকে স্বাগত জানায়, তারা ভারতের পুতুল বাংলাদেশ সরকারকে স্বাগত জানায়। চীনকে তারা প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে এবং ছয় পাহাড়ের দালাল এবং সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত হয়। পূর্ববাংলায় তারা নাম্বুদ্রিপদ-জোতি বসুর অন্ধ অনুসরণ করছে। তারা পূর্ববাংলার জোতি বসু-নাম্বুদ্রিপদ।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও পরে সর্বহারা পার্টির সাথে যুক্ত সর্বহারা বিপ্লবীরা চার বৎসরের বিপ্লবী অনুশীলনে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ববাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনের সাথে অধিকতর সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম হয়েছে এবং মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে খুবই মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।

রাজনৈতিক

একটি সংগঠনের সঠিক রাজনীতি হচ্ছে পার্টির প্রাণ, পার্টির বিকাশ, সুসংবদ্ধতা ও বলশেভিকরণের মৌলিক শর্ত। দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নিয়ে সমাজকে বিশ্লেষণ করা, তার বিকাশের জন্য দায়ী দ্বন্দ্বসমূহ ও নিয়মবিধি আবিষ্কার করা, তা সমাধানের পথ নির্দেশ করা ও তা বাস্তবায়িত করার জন্য লেগে থাকা প্রভৃতি একটি সংগঠনের রাজনৈতিক কর্তব্য। সঠিক রাজনীতি থেকে উদ্ভূত হয় সঠিক সামরিক, সাংগঠনিক লাইন, পার্টির নেতৃত্বে সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়, তাদের বিজয় নিশ্চিত হয়।

আমাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, একটি রাজনৈতিক পার্টি তা প্রথমে যত ছোটই হোক না কেন, সঠিক রাজনৈতিক লাইন থাকলে তা অবশ্যই বিকাশ লাভ করে, বিরাট হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিজয় অর্জন করে। অভিজ্ঞতা আরো প্রমাণ করেছে যে সশস্ত্র সংগ্রাম ও প্রচণ্ড বিপ্লবী ঝড়-তরঙ্গে বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদ ও অন্যান্য সুবিধাবাদের মুখোশ উন্মোচিত হয় ও তাদের দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হয় এবং তারা পরাজিত ও ধিকৃত হয়।

রাজনৈতিক রণনীতি হচ্ছে মৌলিক দ্বন্দ্বের সমাধান ও রণকৌশল হচ্ছে দ্বন্দ্বের স্তরের সমাধান। পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন পূর্ববাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী মৌলিক দ্বন্দ্বসমূহ, প্রধান দ্বন্দ্ব, দ্বন্দ্বসমূহের সমাধান, পূর্ববাংলার সামাজিক বিকাশের স্তর, এই স্তরের দ্বন্দ্বের সমাধান, সমাধানের পদ্ধতি; বিভিন্ন শ্রেণীর ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে ধরে এবং সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন করে এবং তা প্রয়োগ করে।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক লাইন বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের ডান ও অতি বাম যা আকৃতিতে বাম কিন্তু সারবস্তুতে ডান-এই দুই লাইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অগ্রসর হয় এবং অনুশীলনের অগ্নি পরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।

মনি সিং-মোজাফফর সংশোধনবাদীরা পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্নে বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি করে এবং তার নিকট আত্মসমর্পণ করে। পক্ষান্তরে হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা, দেবেন-বাসার, আলাউদ্দিন-মতিন ট্রটস্কী-চেবাদী, কাজী-রণো ষড়যন্ত্রকারীরা পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্ন পরিত্যাগ করে, সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্বকে প্রধান বলে অতি বাম অর্থাৎ সমাজের বিকাশের স্তর অতিক্রম করে ভবিষ্যতের করণীয়কে বর্তমানে টেনে এনে ট্রটস্কীবাদী ভুল করে এবং পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্নের নেতৃত্ব স্বেচ্ছায় সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ এবং পূর্ববাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের নিকট তুলে দেয়। এভাবে এরা জনগণকে বিপথে পরিচালনা করে এবং পূর্ববাংলাকে ভারতের উপনেবেশে পরিণত করতে সহায়তা করে।

ভুল ও বিশ্বাসঘাতক রাজনীতি থেকে উদ্ভূত হয় তাদের সাংগঠনিক বিশ্বাসঘাতক পদক্ষেপসমূহ। হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদী, মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চেবাদীরা পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে গোপনে আঁতাত করে, তাদের সহায়তা করে, তাদের গোয়েন্দা বিভাগের খবর সরবরাহকারী হয়, তারা রাজাকারে পরিণত হয়। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা এর বিনিময়ে তাদের গ্রেফতার করতোনা, গ্রেফতার হলে ছেড়ে দিত, বাড়ী-ঘর পোড়ায়নি, প্রকাশ্য পুস্তিকা প্রকাশ ও বিক্রয়, চলাফেরা ও থাকার অন্যান্য সুযোগ দেয়।

দেবেন-বাসার ট্রটস্কী-চেবাদী কাজী-রণো ষড়যন্ত্রকারী ও আন্যান্য সংশোধনবাদী উপদলসমূহ ভারতে আশ্রয় নেয়, জোতি বসু-নাম্বুদ্রিপদের সাথে আঁতাত করে, সমন্বয় কমিটি গঠন করে, জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান বলে, ছয় পাহাড়ের লেজুড়ে পরিণত হয়।

পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্নে কেবলমাত্র আমাদের সাথে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। পাকিস্তানের সামরিক ফ্যাসিস্টদের শ্বেতপত্রে এবং আমাদের বিরুদ্ধে তাদের কার্যকলাপে এর প্রমান রয়েছে। আমরা প্রতিনিধিত্ব করেছি সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, পূর্ববাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী পূর্ববাংলার জনগণ ও প্রগতিশীলদের।

আমাদের ক্ষুদ্র সঙ্গঠন, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, কর্মীস্বল্পতা, অনভিজ্ঞতা নিয়েও যেখানে আমরা কাজ করেছি সেখানেই কৃষক-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, দেশপ্রেমিক জনগণের সমর্থন পেয়েছি।

পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হামলার ফলে আওয়ামী লীগ পঁচিশে মার্চের পর সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে ও পূর্ববাংলার জনগণকে সংগ্রামে নেতৃত্বে দানে নিজের ব্যর্থতা প্রমাণ করে। পূর্ববাংলার জনগণের এই দুর্দিনে পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন অতি অল্প সময়ের মাঝেই পাঁচটিরও বেশি জেলায় আটটিরও বেশী গেরিলা ফ্রন্ট গড়ে তোলে, বিস্তৃত অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়ে জাতীয় প্রশ্নে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ করে।

আওয়ামী লীগ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সম্প্রসারণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা সশস্ত্র হয় এবং প্রতিবিপ্লবী জাতীয় পরাধীনতার যুদ্ধ শুরু করে। তারা পূর্ববাংলার সত্যিকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্মূল করার কাজকে প্রধান বলে গ্রহণ করে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্টদের শ্রেণী বিশ্লেষণ করে, এদেরকে ছয় পাহাড়ের দালাল হিসেবে সঠিকভাবে তুলে ধরে; “আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের প্রসঙ্গে আমাদের নীতি”, “দেশপ্রেমিকের বেশে ছয় পাহাড়ের দালাল” শীর্ষক দলিলে; এতে আরো তুলে ধরে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট এবং ছয় পাহাড়ের দালাল উভয়কে বিরোধিতা করার সঠিক নীতি।

সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার নামে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে, পূর্ববাংলা দখল করে, একে তার উপনিবেশে পরিণত করে।

মহান গণচীনের নেতৃত্বে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা সহ বিশ্বের অন্যান্য ন্যায়পরায়ণ দেশ ও জাতি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের উস্কানিতে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের পাকিস্তান আক্রমণ ও পূর্ববাংলা দখলের বিরোধিতা করে। ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও দখলের ফলে আমাদের নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ববাংলার জনগণের মহান সংগ্রাম ব্যাহত হয়।

পূর্ববাংলায় ভারতীয় দখল কায়েম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি তার রণনীতি ও রণকৌশল, অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন, ‘বর্তমান করণীয়’, ‘খোলা চিঠি’র মাধ্যমে যথাযথভাবে তুলে ধরে।

পূর্ববাংলার বর্তমান সামাজিক অবস্থায় মণি সিং-মোজাফফর সংশোধনবাদীরা পূর্ববাংলার পরাধীনতাকে স্বাধীনতা বলে আওয়ামী লীগ, সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়বৃত্তি করছে।

আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিভক্ত পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালাল নয়া সংশোধনবাদী হক-তোয়াহা পূর্ববাংলাকে সোভিয়েটের উপনিবেশ, সোভিয়েটের সাথে পূর্ববাংলার দ্বন্দ্ব প্রধান বলে নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে চিত্রিত করে পূর্ববাংলা, বিশ্বের সর্বহারা ও জনগণকে প্রতারিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালাল মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চেবাদীরা অতিমাত্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। তারা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নামধারী বুর্জোয়া উপদল গঠন করে এ সংকট কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা হক-তোয়াহাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

দেবেন-বাসার, কাজী-রণো ষড়যন্ত্রকারীরা মার্কসবাদের নামাবলী গায়ে দিয়ে পূর্ববাংলার জোতি বসু-নাম্বুদ্রিপদের ভূমিকা পালন করছে, চীনের বিরোধিতা করছে এবং সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের দালালী করছে।

পূর্ববাংলার বর্তমান জাতীয় সংগ্রামে আমাদের বিশেষ শক্তিশালী কোন বুর্জোয়া প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক অংশ পূর্ববাংলার সাথে ভারতের জাতীয় দ্বন্দ্বের এবং মুসলিম ও হিন্দু জনগণের মধ্যকার অবৈরী ধর্মীয় দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে পূর্ববাংলায় একটা প্রতিবিপ্লবী জাতীয় ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা সৃষ্টি করতে পারে। (পূর্বের তুলনায় এ ধরণের প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র খুব দুর্বল হবে)। এ ধরণের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। অতএব আমাদের দৃঢ়ভাবে জাতীয় পতাকা ঊর্ধে তুলে ধরে ব্যাপক জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং জনতার নেতৃত্ব অর্জন করে পূর্ববাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে।

সামরিক

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি বিপ্লবী অনুশীলনের মাধ্যমে সামরিক ক্ষেত্রে বহু মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকেই সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছে যে “জনগণের সেনাবাহিনী ব্যতীত জনগণের কিছুই নেই”, “রাজনৈতিক ক্ষমতা বন্দুকের নলের মধ্য দিয়েই জন্মলাভ করে”, “সশস্ত্র সংগ্রাম হচ্ছে বিপ্লবের সর্বোচ্চ রূপ”, “সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই পার্টির বিকাশ, সুসংবদ্ধতা ও বলশেভীকরণ সম্ভব”, “সশস্ত্র বাহিনী হচ্ছে পার্টির অধীন প্রধান ধরনের গণসংগঠন।”

শ্রমিক আন্দোলন আরো উপলব্ধি করে যে, “গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণকে জাগরিত, সংগঠিত ও জনগণের শক্তিকে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যায়।”

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়া ও তাদেরকে গেরিলা যুদ্ধে পরিচালনার জন্য টেকনাফ যায়। এর কারণ ছিল পাহাড়-জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধ সুবিধাজনক-এ ধারণা। কিন্তু কিভাবে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করা যায় সে সম্পর্কে সঠিক অভিজ্ঞতা না থাকায় আমাদের কর্মীরা পাহাড়-জঙ্গলে ভ্রষ্ট সশস্ত্র দলকে রাজনীতিতে শিক্ষা দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম করার ভুল পদক্ষেপ নেয়।

পরবর্তীকালে পার্টি ভারত ও ভিয়েতনামের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতার সারসঙ্কলন করে।

পূর্ববাংলার জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব। এই সঠিক রাজনীতি থেকে নির্ণীত হয় গ্রাম্য এলাকায় কৃষকের শ্রেণী-শত্রুর একাংশ, যারা জাতীয় শত্রু-সরকারের চোখ ও কানদের খতম করার মাধ্যমে অর্থাৎ জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করার সঠিক সামরিক লাইন। এই প্রকার গেরিলা যুদ্ধ নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে দেশীয় অস্ত্র দ্বারা শুরু করা যায়।

আমাদের কর্মীরা শহর ও গ্রামে গেরিলা গ্রুপ গঠন শুরু করে, অতি অল্প সময়ের মাঝেই পাকিস্তান কাউন্সিল, মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে দেশীয় বোমা বর্ষণ করে। এর ফলে জনগণকে জাগরিত করা, তাদেরকে সংগঠিত করা, কর্মীদের পোড় খাওয়ানো সম্ভব হয়, শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে বিকাশ থেকে পার্টি সংগ্রামের মাধ্যমে বিকাশের পথে প্রবেশ করে। এ হামলাকে নিয়মতান্ত্রিক পথে কার্যরত সংকীর্ণ ট্রেড ইউনিয়নপন্থী আরাম-আয়েশের সাথে বিপ্লব করার মোহগ্রস্ত ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা ও গোড়ামীবাদীরা বাম বিচ্যুতি বলে অভিযোগ করে।

আমাদের কর্মীরা চট্রগ্রামের ফটিকছড়িতে চা বাগানের শ্রমিক ও স্থানীয় কৃষকদের গেরিলা গ্রুপে সংগঠিত করে এবং প্রথম জাতীয় শত্রু হারু বাবুকে হামলা করে। স্থানীয় গেরিলাদের দিয়ে হারু বাবুর উপর অপারেশন করার সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে আমাদের বুদ্ধিজীবী কর্মী ও গেরিলা এ হামলা করে। তবুও এ হামলা জনগণের ইচ্ছা ও উদ্যোগের বিরুদ্ধে ছিলনা। এ কারণে ইহা বাম বিচ্যুতি হয়নি। হারু বাবুর হামলায় জনগণ খুবই জাগরিত হয়। তারা ব্যাপক সমর্থন দেয়, জনগণ ব্যাপক হারে সংগঠিত হতে থাকে। শত্রুর প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও আমাদের কাজ চলতে থাকে।

ফটিকছড়িতে অপর এক জাতীয় শত্রুকে আমাদের একজন কর্মী ও স্থানীয় গেরিলারা দেশীয় অস্ত্র দ্বারা খতম করে। পঁচিশে মার্চের পর সেখানকার সকল শ্রমিক ভারতে আশ্রয় দেয়। ফলে তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।

ঢাকায় আমাদের কর্মীরা বিএনআর (ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকন্সট্রাকশন, এটা পাকিস্তানী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান—সর্বহারা পথ) হামলার মাধ্যমে ব্যাপক গণসমর্থন অর্জন করে।

আমাদের সংগঠন সর্বাধিক সামরিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে পঁচিশে মার্চের পর। পেয়ারা বাগানে পূর্ববাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বে একটি নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়, জাতীয় শত্রু খতম অভিযান চালানো হয়, কয়েক শত জাতীয় শত্রু খতম করা হয়, জাতীয় শত্রু খতমের প্রক্রিয়ায় জনগণকে জাগরিত, সংগঠিত ও তাদের মাঝে ব্যাপক প্রচার সম্ভব হয়, অস্ত্র-অর্থ সংগৃহীত হয়। কয়েক লক্ষ লোক বসবাসকারী প্রায় আটচল্লিশটি গ্রামে পার্টি অস্থায়ী প্রকৃতির মুক্ত এলাকা গঠন করে। সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা, গ্রাম পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়, নিয়মিত বাহিনী, গ্রাম-রক্ষীবাহিনী, স্থানীয় গেরিলা গ্রুপ গঠন করা হয়, জনগণকে কৃষক মুক্তি সমিতি, নারী মুক্তি সমিতি প্রভৃতি গণসংগঠনে সংগঠিত করা, এদের মাঝে অগ্রসরদের নিয়ে সর্বহারা পার্টি ইউনিট এবং সামরিক বাহিনীতে পার্টি ইউনিট গঠন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

সামরিক বাহিনীতে নিয়মিত গেরিলা ইউনিট সাতজন সদস্য নিয়ে হয়। একজন পার্টি প্রতিনিধি যিনি রাজনৈতিক কমিশার নামে পরিচিত, কমান্ডার, সহকারী কমান্ডার, দুইজন স্কাউট এবং দুই বা চার সদস্য নিয়ে একটি গেরিলা গ্রুপ গঠন করা হয়। তিন থেকে পাঁচটি গেরিলা গ্রুপ নিয়ে একটি প্লাটুন, তিন থেকে পাঁচটি প্লাটুন নিয়ে একটি কোম্পানী গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্লাটুন কমান্ড গঠন করা হয় একজন রাজনৈতিক কমিশার, একজন কমান্ডার, দুইজন সহকারী কমান্ডার, তিনজন স্কাউট দ্বারা।

আমাদের মুক্ত এলাকার পার্টি, সামরিক সংগঠন, গণসংগঠন, রাজনৈতিক ক্ষমতার নেতৃস্তানীয় সংস্থা ছিল ১নং ফ্রন্ট এরিয়াকমিটি যা উচ্চতর নেতৃস্তানীয় সংস্থা ২নং ব্যুরোর অধীন ছিল।

এভাবে সমগ্র পূর্ববাংলার জনগণকে যখন অসহায় রেখে ছয় পাহাড়ের দালালরা ভারতে পলায়ন করে, তখন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি জনগণের প্রতিরোধ সঠিক পথে পরিচালনা করে। “সবকিছুই বন্দুকের নলের মাধ্যমে গড়ে উঠে”-এ সত্য আমরা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছি।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি প্রকাশ্য কাজের সাথে গোপন পার্টি-কাজ সমন্বিত করেনি অর্থাৎ গোপনে পার্টি-কাজ করার জন্য কিছুসংখ্যক কর্মী নিয়োগ করেনি, জনগণের মাঝে পার্টি ইউনিট গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়, কিন্তু সময়াভাবে তা কার্যকর করা হয়নি। সময়াভাব ও পার্টি কর্মীদের নিম্নমান ও অনভিজ্ঞতার কারণে সেনাবাহিনীতে মতাদর্শগত শিক্ষা ও পার্টি-কর্মী সংগ্রহের দিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সময়াভাব, কর্মীদের সশস্ত্র সংগ্রামের অনভিজ্ঞতা এবং পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরম নির্যাতনের কারণে প্রথম থেকেই আমাদের কাজ হয়েছিল এরূপ বিভিন্ন স্থানে গেরিলা কর্মী পাঠিয়ে ১নং ফ্রন্টের বিকল্প আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। একই কারণে যে সকল স্থানে হামলা হয়েছে সেখানে পার্টি কাজ গড়ে তোলা, সহানুভূতিশীল, গোপন আশ্রয়স্থল তৈরী করা, ১নং ফ্রন্টের সশস্ত্র সংগ্রামকে সহায়তা করার জন্য আশেপাশের শহর, বন্দর, বাজারসমূহে কাজ গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে…… (এই বাক্যটি অসম্পূর্ণ—সর্বহারা পথ)……..সম্মুখে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবুও ১নং ফ্রন্ট এরিয়া প্রচন্ড ঘেরাও-দমনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টা করলে ১নং ফ্রন্ট থেকে গেরিলা প্রত্যাহার না করেও টিকে থাকা সম্ভব ছিল।

১নং ফ্রন্ট এরিয়া থেকে আমাদের গেরিলাদের এক অংশ গৌরনদী অঞ্চলে সরে আসে। বাকীরা ১নং ফ্রন্টের আশেপাশে থেকে যায়।

গৌরনদী অঞ্চলে আমাদের কর্মী ও গেরিলারা বহু জাতীয় শত্রু খতম করে এবং পাতার হাট, মেহেদীগঞ্জ, উজিরপুর, ধামুরা, মুলাদী, বাবুগঞ্জ, হিজলা, বানারীপাড়া, বামনা, গলাচিপা প্রভৃতি এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত করে; প্রায় দুই শত গেরিলা সংগৃহীত হয় এবং বিরাট এলাকা মুক্ত হয়।

১নং ফ্রন্ট এরিয়ার ঘেরাও-দমন উঠে গেলে আমাদের গেরিলারা গেরিলা যুদ্ধকে কাউখালি, রাজাপুর, স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি, বরিশাল সদর থানার বিস্তৃত এলাকায় সম্প্রসারিত করে। ইতিমধ্যে পাঁচজন গেরিলা বরিশালের দক্ষিণাংশে মঠবাড়িয়া অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ বিস্তৃত করে, অচিরেই পাথরঘাটা, খেপুপাড়ায় গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়। পাঁচজন থেকে আমাদের গেরিলা সংখ্যা কয়েক শতে পৌঁছে এবং পাঁচটি রাইফেল থেকে আশিটি রাইফেল ও বন্দুক সংগৃহীত হয়।

১নং ফ্রন্টের মুজিব-তারেকের মাঝে সমরবাদ দেখা দেয়, ফলে ১নং ফ্রন্টের কাজ বিঘ্নিত হয়। তারেক-মুজিবকে প্রথমে সকল পদ থেকে সরিয়ে প্রকাশ্যে নেতিবাচক উদাহারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। আহ্বায়ক কমিটি কর্তৃক তদন্তের ভিত্তিতে সংগঠন থেকে চিরদিনের জন্য এ সকল অধঃপতিত ব্যক্তিদেরকে বহিষ্কার করা হয় এবং নেতিবাচক উদাহারণ হিসেবে তুলে ধরার জন্য আহ্বান জানানো হয়।

ইতিমধ্যে ভোলায় আমাদের কর্মীরা নিজস্ব উদ্যোগে গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করে এবং বহু জাতীয় শত্রু খতম করে ও অস্ত্র সংগ্রহ করে।

ফরিদপুর জেলায় মাদারীপুর মহকুমায় আমাদের গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রুসারিত হয়, জাতীয় শত্রু খতম হয়, অস্ত্র ও গেরিলা সংগৃহীত হয়।

ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জে গেরিলা যুদ্ধ বিস্তৃত হয়। সাভার এলাকা, নরসিংদী এলাকার গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়। সাভার এলাকায় অস্ত্র ছাড়াই গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করে শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশটিরও বেশী বন্দুক ও রাইফেল সংগৃহীত হয়। নরসিংদী এলাকায় একইভাবে বহু অস্ত্র সংগৃহীত হয়।

টাংগাইল-পাবনা জেলায় আমাদের কর্মীরা গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত করে এবং বিরাট অঞ্চল শত্রুমুক্ত করে এবং বহু অস্ত্র ও গেরিলা সংগৃহীত হয়, রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম হয়।

এভাবে পূর্ববাংলার বিস্তৃত অঞ্চলে বহু জাতীয় শত্রু, পাক-সামরিক দস্যু, রাজাকার, আল-বদর খতম করা হয়। অস্থায়ী প্রকৃতির বহু মুক্ত এলাকা গড়ে, এ সকল মুক্ত অঞ্চলের অনেক স্থানেই ভূমিহীন কৃষকের মাঝে জাতীয় শত্রুর ভূমি বতরণ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাতীয় শত্রু সঠিকভাবে খতম হয়। কর্মীদের অনভিজ্ঞতার কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে এক-আধটি ভুল হয়ে থাকতে পারে।

পাবনা-টাংগাইলে মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কি-চেবাদীরা শ্রেণী শত্রু খতমের নাম করে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালাল হিসেবে জনগণের বাড়ীতে ডাকাতি, তাদের হত্যা শুরু করে। জনগণ তাদেরকে ডাকাত বলে আখ্যায়িত করে। ব্যাপক এলাকায় জনগণ তাদেরকে প্রতিরোধের জন্য নিজেরাই উদ্যোগ নেয়, তাদের পাঁচজনকে পিটিয়ে হত্যা করে। এ এলাকায় জনগণের আহ্বানে বাধ্য হয়ে আমাদের গেরিলারা মতিন-আলাউদ্দিনের দস্যুদলকে জনগণের সহায়তায় আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত তারা এলাকা ছেড়ে পলায়ন করে।

পঁচিশে মার্চের পর আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগীরা ভারতে আশ্রয় দেয়। পূর্ববাংলায় তাদের সংগঠন ভেঙ্গে পড়ে। এ সময় এদের বহু কর্মী, সমর্থক এবং ইপিআর, পুলিশ, আনসার, বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক আমাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।

আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা ভারতে যেয়ে পুনরায় মিলিত হয় এবং ভারতের তাবেদারে রূপান্তরিত হয়। তারা ‘নকসাল খতম’ অভিযান চালিয়ে ভারতের উপনিবেশ স্থাপনে রাজী হবে না এরূপ আমাদেরসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের খতম করার নীতি গ্রহণ করে।

আমাদের কর্মীরা আওয়ামী লীগ, মতিয়া গ্রুপ, মস্কো ন্যাপ ও তাদের সহযোগীদের ছয় পাহাড়ের দালালে পরিণত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সম্পর্কে আমাদের নীতি পাল্টাতে এবং নিজেদের মধ্যকার পার্টি-বহির্ভূত গেরিলাদের সম্পর্কে, পার্টি-বহির্ভূত গেরিলা সংগ্রহ করা সম্পর্কে, জনগণের মধ্যকার কাজের পদ্ধতি সম্পর্কিত নীতি পাল্টাতে ব্যর্থ হয়।

গেরিলারা প্রধানতঃ ক্ষেত মজুর, গরীব চাষীদের মধ্য থেকে সংগ্রহ না করে বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়, তাদের মাঝে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক শিক্ষা চালিয়ে সমস্ত গেরিলাদের পার্টি-কর্মী বা সহানুভূতিশীলে রূপান্তরিত করা হয়নি, পার্টি-কর্মী বা সহানুভূতিশীল নয় এরূপ বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রহ বন্ধ করা হয়নি (এরাই অনেকে পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং আমাদের গেরিলাদের ধরিয়ে দেয়, নিরস্ত্র করে এবং খতম করে ছয় পাহাড়ের দালালের উস্কানিতে); কর্মী ও গেরিলারা ছয় পাহাড়ের দালালদের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়, জনগণের সাথে যথাযথভাবে যুক্ত হয়নি, তাদের মাঝে গোপনে কাজ করেনি।

যে সকল স্থানে ব্যাপক জনগণ আমাদের সমর্থক ছিল আমাদের কর্মী ও গেরিলারা গোপনে থেকে সে সকল স্থানের জনগণকে প্রকাশ্য গণসংগ্রামে লাগায়নি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রের ও লোকসংখ্যার তুলনা করেই আমাদের কর্মীরা এলাকা পরিত্যাগ করে।

জনগণের মাঝে গোপনে পার্টি গড়ে না তোলা, সহানুভূতিশীল, আশ্রয়স্থল তৈরী না কর; গোপন কাজের জন্য কর্মী নিয়োগ না করে সকলেই প্রকাশ্যে কাজ করা ও প্রকাশ হয়ে পড়া এবং উপরোক্ত কারণসমূহের জন্য ছয় পাহাড়ের দালাল ফ্যাসিস্টদের হামলার ফলে আমাদের সকল মুক্ত অঞ্চল হারাতে হয়, বহু কর্মী প্রাণ হারায়, বহু অস্ত্র হারাতে হয়।

এ সময় কিছুসংখ্যক কর্মী যারা এ জটিল অবস্থায় তাদের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, তারা বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করা, সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত করা, গ্রামে গেরিলা যুদ্ধ করা যাবেনা প্রভৃতি হতাশাব্যাঞ্জক দক্ষিণপন্থী মতামত ব্যক্ত করে। এগুলো হচ্ছে ঝড় উঠলে অপরিবর্তিত বুদ্ধিজীবীদের শ্রমিক-কৃষকের থেকে উল্টো ভূমিকার প্রকাশ। পার্টি সময়মত বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে কয়েকটি দলিলের (১নং ও ২নং) মাধ্যমে এ সকল মতামতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং যে কোন অবস্থায় শ্রমিক-কৃষকের উপর নির্ভর করে, তাদের সাথে যুক্ত হয়ে, নিজের শক্তির উপর নির্ভর করে গেরিলা যুদ্ধের বস্তুগত নিয়ম অনুযায়ী চলার নীতি তুলে ধরে।

বর্তমানে ছয় পাহাড়ের দালালদের বিরুদ্ধে জাতীয় ও শ্রেণী ঘৃণা জাগিয়ে তুলতে হবে এবং জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে হবে, অতীতের ভুল-ত্রুটি-সীমাবদ্ধতাকে অবশ্যই দূর করে সঠিকতা ও সাফল্যকে অনুসরণ করে অগ্রসর হতে হবে।

পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরচালিত হবে ছয় পাহাড়ের দালাল, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধ পরিচালিত হবে আমাদের নেতৃত্বে অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে। প্রায় শুন্য থেকে বিকাশ লাভ করতে হবে, নির্ভর করতে হবে নিজেদের ও জনগণের শক্তির উপর। এ কারণে এ যুদ্ধ হবে দীর্ঘস্থায়ী ও নির্মম।

জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ প্রধানতঃ কৃষকের যুদ্ধ। কাজেই গেরিলা সংগ্রহ করতে হবে প্রধানতঃ কৃষক ও শ্রমিক থেকে, বুদ্ধিজীবীদের অবশ্যই পার্টির কর্মী হতে হবে, যারা কৃষক-শ্রমিকদের রাজনৈতিক-মতাদর্শগত শিক্ষা দেবে।

গোপন কাজ করতে হবে, গেরিলা যুদ্ধ চালাতে হবে। গেরিলাদের দ্রুত পার্টি-লাইনে শিক্ষিত করে পার্টি-কর্মী তৈরী করতে হবে।

গোপনভাবে কৃষকদের উপর নির্ভর করে দেশীয় অস্ত্রের দ্বারা জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করা, গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ করা, গেরিলা ও পার্টি-কর্মী সংগ্রহ করা, জনগণের মাঝে প্রচার করা, জনগণকে সংগঠিত করা, নিজেদের পোড় খাওয়ানো ও শত্রুকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা যায় এবং তা সম্ভব।

ভৌগোলিক অবস্থা নির্বিশেষে পার্টির মূল্যবান অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পূর্ববাংলার সর্বত্র গেরিলা যুদ্ধের বিকাশ ঘটাতে হবে, সশস্ত্র সংগ্রামে লেগে থাকতে হবে। সশস্ত্র সংগ্রাম বাদ দিয়ে পার্টি বিকাশের সকল প্রকার সুবিধাবাদী চিন্তাধারাকে দূর করতে হবে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পার্টির বিকাশ, সুসংবদ্ধতা ও বলশেভিকরণ অর্জন করতে হবে। প্রধান ধরণের সংগঠন হিসেবে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি বাহিনী গড়ে তুলতে হবে।

সাংগঠনিক

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার সময় কমরেডদের মার্কসবাদী পার্টি গঠনের কাজের কোন অভিজ্ঞতাই ছিলনা। কিন্তু অনভিজ্ঞতা আমাদেরকে ভীত করতে পারেনি। আমরা অনুশীলনে লেগে থাকি এবং অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় সর্বহারার রাজনৈতিক পার্টি সংগঠন পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করি।

বর্তমানে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির শৃংখলা উন্নত, পার্টির মাঝে একটি সুদৃঢ় কেন্দ্র রয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি কর্মীদের অটুট ও দৃঢ় আস্থা রয়েছে; কর্মীরা শৃংখলা, গোপনীয়তা, সাংগঠনিক এককসমূহ পরিচালনা ও তার দায়িত্ব সম্পর্কে মোটামুটি অবগত হয়েছেন।

কিন্তু এখনো কর্মীরা জনগণ থেকে আসা, জনগণের নিকট নিয়ে যাওয়ার কর্মপদ্ধতি, পার্টি-কমিটি সুচারুরূপে পরিচালনা, অধীনস্থ কর্মীদের পরিচালনা, প্রকাশ্য গণসংগ্রামে জনগণকে চালিত করার বিষয়ে দক্ষ নন।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন তার সাংগঠনিক কাজে বস্তুর দ্বান্দ্বিক গতির নিয়ম বজায় রেখেছে, পুরোনো কর্মীদের তুলনায় যোগ্য নতুন কর্মীদের পুরোনো কর্মীদের স্থানে দায়িত্ব দিয়েছে, বাসীটা বর্জন করে টাটকাটা গ্রহণ করেছে, যার ফলে সংগঠন প্রাণবন্ত রয়েছে।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে উপদলবাদ, পার্টির অভ্যন্তরে বিভেদপন্থীবাদের উদাহারণ খুবই কম। পক্ষান্তরে বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী সংগঠনগুলো বিভেদপন্থীবাদ ও উপদলবাদের ফলে ছিন্নভিন্ন।

সঠিক রাজনীতি পার্টির মধ্যে লৌহ-কঠিণ শৃংখলা এবং এক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। সংশোধনবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র ও কপটতা তাদের মধ্যকার অনৈক্যের জন্য দায়ী।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে বরিশাল জেলায় বিভেদপন্থীবাদের উদ্ভব হয়। সেখানে ছাত্র পরিচালনা গ্রুপের সাথে শ্রমিক পরিচালনা গ্রুপের দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয় এবং সংগঠন প্রায় বিভক্ত হয়ে যায়। বরিশাল জেলা নেতৃত্বের মতাদর্শগত কাজ পরিচালনায় অক্ষমতা, নিজেদেরকে দুই দলের একটার সাথে জড়িয়ে ফেলা প্রভৃতির ফলে ইহা প্রকট আকার ধারণ করে।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ অবস্থা তদারক করতে যায় এবং সাংগঠনিক বিষয় সব কিছু ঠিক করার পূর্বে মতাদর্শগতভাবে সব কিছু ঠিক করার জন্যে পাঁচটি প্রবন্ধ বিশেষ করে ভুল চিন্তাধারার সংশোধন এবং কতগুলো দলিল (লাল ঝাণ্ডা ২নং-এ সংযোজিত হয়েছে) পড়ায় এবং দ্বন্দ্বের সমাধান করে।

ময়মনসিংহের হাজিপুরে ভাগ্যান্বেষী, নেতৃত্বলোভী, বিশ্বাসঘাতক সাদিক, দলত্যাগী আসাদ ও তার ভাই, হটকারী-সমরবাদী বেবীর সাথে যুক্ত হয়ে একটি চক্র গঠন করে এবং ‘পার্টি সঠিক কিন্তু নেতৃত্ব খারাপ’ এ অভিযোগ উথাপন করে নিজেদেরকে পার্টিকর্তা বলে জাহির করে এবং সেখানখার কর্মীদেরকে ডাকাতি, পার্টি ও জনগণ বিরোধী কাজে প্ররোচিত করার প্রচেষ্টা চালায়। সাচ্চা পার্টি-কর্মী ও জনগণ তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করে দেয় এবং তাদেরকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করে। শেষ পর্যন্ত তারা ছয় পাহাড়ের দালালে পরিণত হয়। এর ফলে স্থানীয় পার্টি-কাজে মারাত্মক ক্ষতি হয়।

পার্টির অভ্যন্তরে সাংগঠিক ত্রুটি-বিচ্যুতির উৎস হলো ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শের বহিঃপ্রকাশ। কাজেই সাংগঠনিকভাবে সকল প্রকার অসুস্থতা দূর করতে হলে অবশ্যই কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সর্বহারা মতাদর্শের প্রকাশ রপ্ত করতে হবে।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টি সর্বদাই সংগঠনের অভ্যন্তরস্থ ও বাইরের সর্বহারা বিপ্লবীদের সাথে সাংগঠনিক ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক ঐক্যকে, নীতিহীন বাহ্যিক ঐক্যকে নয়। নীতিকে বিসর্জন দিয়ে সুবিধাবাদের সাথে আপোষ করে ঐক্যের অর্থ হলো নিজেরাই সুবিধাবাদী হওয়া।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মার্কসবাদী নামধারী বুর্জোয়া উপদলের সাথে আমাদের ঐক্য ফ্রন্ট, যৌথ একশন, সমন্বয় করার প্রশ্ন এসেছে। আমরা উপদলের অস্তিত্বকে দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করেছি, উপদলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে সংগ্রাম করেছি, একই সময় এ সকল উপদলস্থ বা বিছিন্ন সর্বহারা বিপ্লবীদের সাথে ঐক্যের প্রচেষ্টা চালিয়েছি। এ উদ্দেশ্যে আমরা সর্বহারা বিপ্লবীদের সাথে ঐক্যের প্রচেষ্টা চালিয়েছি। এ উদ্দেশ্যে আমরা সর্বহারা বিপ্লবীদের ঐক্যের জন্য প্রকাশ্য আহ্বান জানাই এবং দেবেন-বাসারদের সাথে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হই।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন বিকাশের সাথে সাথে সংগঠন যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য মহান চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সংবিধান অধ্যয়ন ও প্রয়োগ করে, বিশেষ করে গত চার বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির বর্তমান সংবিধান লিপিবদ্ধ হয়েছে।

পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের ও ছয় পাহাড়ের দালালদের চরম নির্যাতনের সময় পার্টি-কর্মীরা সকল প্রকার নির্যাতন এমনকি মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে সাংগঠনিক কার্য চালায়, বিভিন্ন দলিল প্রকাশ করে, বিভিন্ন স্তর ও জনগণের নিকট তা পৌঁছে দেয়, বিভিন্ন স্তরের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখে। এ সময় অন্যান্য রাজনৈতিক পার্টি ও বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীরা কোন প্রকার সাংগঠনিক তৎপরতা কেন্দ্রীভূতভাবে চালাতে সক্ষম হয়নি। ইহা আমাদের বিরাট সফলতা ও শক্তির পরিচায়ক।

সাংগঠনিক ক্ষেত্রে মতাদর্শগত শিক্ষা জোরদার করতে হবে, সর্বস্তরে শৃংখলা ও নেতৃত্ব জোরদার করতে হবে, সঠিকভাবে নেতৃত্বের পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। গুজব রটনা করা, ষড়যন্ত্র করা, নির্দেশ অমান্য করা, শৃংখলাকে অবহেলা করা, নেতৃত্বকে দুর্বল করা পরিহার করতে হবে। সভাপতি মাওয়ের সাংগঠনিক লাইন দৃঢ়ভাবে প্রয়োগ করে সর্বস্তরের সংগঠনকে সংগ্রামের দূর্গে রূপান্তরিত করতে হবে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির বর্তমান সংবিধান আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত। আপনারা এ সংবিধান পর্যালোচনা করবেন ও অনুমোদন করবেন।

মতাদর্শগত

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির অধিকাংশ কর্মীই ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত। পূর্ববাংলার জনগণের অধিকাংশই ক্ষুদে বুর্জোয়া। পার্টি এদের দ্বারা পরিবেষ্টিত।

কাজেই মতাদর্শগত ক্ষেত্রে ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের অসর্বহারা মতাদর্শ দূর করে সর্বহারা শ্রেণীর মতাদর্শ গ্রহণ করানো, তাদের মতাদর্শগতভাবে পুনর্গঠনই হচ্ছে সংগঠনের প্রধান সমস্যা।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন ও সর্বহারার বিশ্বদৃষ্টিকোণ অর্জনের জন্য অভিজ্ঞতার সারসংকলনের মাধ্যমে প্রণয়ন করেছে নিম্নলিখিত সঠিক পদ্ধতিঃ

সৃজনশীলভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুং চিন্তাধারা অধ্যয়ন ও প্রয়োগ করা; কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়া; বিপ্লবী ঝড়তরঙ্গে পোড় খাওয়া।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি মতাদর্শগত পুনর্গঠনের জন্য তিনটি প্রবন্ধ, পার্টির মধ্যকার ভুল চিন্তাধারার সংশোধন, উদারতাবাদ বিরোধিতাকে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বদা পাঠ ও প্রয়োগ করার রীতি সৃষ্টির জন্য বলে আসছে। মতাদর্শগত পুনর্গঠনে সাফল্য অর্জনের জন্য পার্টি ২নং লাল ঝাণ্ডা প্রণয়ন করেছে।

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন মতাদর্শগত পুনর্গঠনে শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত হওয়া ও বিপ্লবী ঝড়-তরঙ্গে পোড় খাওয়ার তাৎপর্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করেনি। কিছু মার্কসবাদী পুস্তক পাঠ, তত্ত্ব ও উদ্ধৃতি আওড়ানো, শ্রমিক বা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে পাঠচক্র বা গ্রুপ গঠন ও পরিচালনা করতে পারলেই তাকে উন্নত কর্মী বলা হতো।

সংগঠনে অধিক সংখ্যায় বুদ্ধিজীবীদের আগমন, তথাকথিত তত্ত্বগত উন্নত কর্মীদের কার্যকলাপ প্রমাণ করছে মতাদর্শগত পুনর্গঠনে শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত হওয়া, বিপ্লবী ঝড়-তরঙ্গে পোড় খাওয়ার প্রকৃত তাৎপর্য আমরা উপলব্ধি করিনি।

আমাদের সংগঠনে বহু কর্মী রয়েছেন যাঁরা তত্ত্ব জানেন কিন্তু অনুশীলনের সাথে সে তত্ত্ব সংযুক্ত নয়। তাঁরা বাস্তব থেকে শুরু না করে শুরু করেন তত্ত্ব থেকে।

কর্মীদের বড় বড় বই, তত্ত্ব পড়ার ঝোঁক, কিন্তু প্রয়োগ করতে অক্ষমতা বাস্তব বিবর্জিত তত্ত্বগত বিবাদের জন্ম দেয়। বুর্জোয়া সমাজের প্রয়োগ বিবর্জিত বোকা বানাবার শিক্ষার পদ্ধতির বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে অনুশীলনের সাথে যুক্ত না করে তত্ত্ব পড়া।

ইহা বিপ্লবী তত্ত্ব অধ্যয়নে প্রয়োগ করলে তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে গোড়ামীবাদ।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রেণী সংগ্রামের জটিল সংগ্রামে এই সকল বুলি শেখা কমরেডদের ভূমিকা কৃষক-শ্রমিকের থেকে সম্পূর্ণ উলটো হয়, তাঁরা হন অস্পষ্ট, দোদুল্যমান। পক্ষান্তরে শ্রমিক শ্রেণী হল দৃঢ়, স্পষ্ট।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির মাঝে কিছু কর্মী রয়েছেন যাঁরা বাস্তব কাজ করেছেন কিন্তু নিজেদের সংকীর্ণ অভিজ্ঞতা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন, অভিজ্ঞতাকে তত্ত্বের সাথে সমন্বিত করে প্রতিনিয়ত নিজেদের মান ও কর্মদক্ষতা উন্নত করেন না। এরা হচ্ছেন সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী। এরা সহজেই গোড়ামীবাদীদের লেজুড়বৃত্তি করেন।

গোড়ামীবাদ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদের মাঝে বর্তমানে গোড়ামীবাদ পার্টির মধ্যকার প্রধান বিপদ।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির অবশ্যই গোড়ামীবাদ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ দূর করার জন্য গোড়ামীবাদী কর্মীদের অনুশীলনে প্রেরণ করতে হবে, বিশেষ করে শ্রমিক কৃষকের সাথে একীভূত হওয়া, তাদের মাঝে কাজ করার ব্যবস্থা করতে হবে।

সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীদেরকে মনোযোগের সাথে তত্ত্বগত পড়াশুনা ও পর্যালোচনা করতে হবে।

মতাদর্শগত ফ্রন্টে সকল কর্মীকে কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত করা, তাদের সাথে সর্বক্ষণ বা আংশিক শ্রমে অংশগ্রহণ করা এবং শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামে পোড় খাওয়ার দৃঢ় পদক্ষেপের ব্যবস্থা করতে হবে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি সকল পার্টি-কর্মীকে শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শ্রমিক-কৃষক কর্মীদের বাড়ীতে থাকা, উৎপাদনে অংশগ্রহণ করা; তাদের মাঝে কাজ করা, তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা পার্টির একটা নিয়ম হওয়া উচিত। অন্যথায় তাদেরকে পার্টি সদস্যপদ প্রদান করা উচিত নয়।

এভাবে অপরিবর্তিত বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পার্টির সংশোধনবাদী বা ক্ষুদে বুর্জোয়া পার্টিতে পরিণত হওয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে হবে।

মতাদর্শগত ক্ষেত্রে পার্টির আভ্যন্তরীণ ও বাইরের বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদ ও তার প্রকাশের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হবে। তাদের মুখোশ উন্মোচন  করতে হবে, তাদের সাথে আমাদের সংগ্রামকে আঁকড়ে ধরতে হবে।

আন্তর্জাতিক

পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন ১৯৬৮ সালে তার থিসিসে বর্তমান বিশ্বের বিকাশের জন্য মৌলিক দ্বন্দ্বসমূহ নিম্নরূপ বলে উল্লেখ করেছেঃ

১। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের সাথে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশ ও জাতিসমূহের দ্বন্দ্ব।

২। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বের সাম্রাজ্যবাদের ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের শাসকগোষ্ঠীর সাথে নিজেদের দেশের জনগণের দ্বন্দ্ব।

৩। একদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের নিজেদের মধ্যকার এবং সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব।

অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের সাথে সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের দ্বন্দ্ব।

৪। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের দ্বন্দ্ব।

উপরোক্ত দ্বন্দ্বসমূহের বিকাশের কারণেই বর্তমান পৃথিবী এগিয়ে চলেছে।

এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণের সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলেছে।

সাম্রাজ্যবাদ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপ, নিয়ন্ত্রণ, প্রভাব ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণ তাদের সংগ্রাম অধিকতর জোরদার করছে। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি দেশের জনগণের সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদকে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করেছে।

খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও কালো অধিবাসীদের সংগ্রাম প্রচণ্ড রূপ গ্রহণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছে।

সোভিয়েট জনগণ এবং বিভিন্ন জাতি সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করছে। সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার রাষ্ট্রসমূহের সাথে সোভিয়েটের দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে।

তাবেদারদের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম জোরদার হচ্ছে।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়াকে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তীব্রতর করছে।

সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারতে তার নিয়ন্ত্রণ জোরদার করছে। পূর্ববাংলায় তার নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য সমস্ত আন্তর্জাতিক মতামত উপেক্ষা করে ভারতকে উস্কে দেয় পূর্ববাংলা দখল করার জন্য। তারা এখানকার কাঁচামাল, সস্তা শ্রমশক্তি দখল করা, ভারত মহাসাগরে প্রভুত্ব স্থাপন এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও বৃটিশের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় নিজেদের প্রভাব স্থাপন ও দখল করার জন্য এ জঘন্য কাজ করে।

এ উদ্দেশ্যে তার ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের সাথে যৌথ সামরিক জোট গঠন করেছে, নৌবহর প্রেরণ করছে। তাদের কার্যকলাপ পুরানো জারদেরই অনুরূপ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারত ও বঙ্গোপসাগরে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নৌবহর প্রেরণ করে।

বর্তমান বিশ্বে বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা বর্তমান, কিন্তু বিপ্লব হচ্ছে প্রধান প্রবণতা।

মহান গণচীন ও এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশ ও রাষ্ট্রসমূহ পূর্ববাংলার বিষয়ে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদীদের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে এবং পূর্ববাংলার জাতীয় প্রশ্নের সমাধান পূর্ববাংলার জনগণ ও পাকিস্তান সরকারের হাতে ন্যাস্ত করার দাবী জানিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মহান গণচীন পূর্ববাংলার প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ করে ফেলে এবং তাদের মুখোশ উন্মোচিত করে।

সভাপতি মাও-এর বৈদেশিক নীতির সাফল্যের ফলে চীন জাতিসংঘে তার ন্যায্য ভূমিকা অর্জন করেছে, নীতিতে অটল থেকে বিশ্ববিপ্লবকে অধিকতর সহায়তা করেছে। মহান গণচীনের নেতৃত্বে বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী, বিপ্লবী জনগণ, নিপীড়িত জাতি ও রাষ্ট্রসমূহ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে চূড়ান্তভাবে কবরস্থ করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে।

মহান গণচীন পূর্ববাংলায় ভারতীয় উপনিবেশ স্থাপন ও তাদের তাবেদারদের পুতুল সরকারকে সমর্থন ও স্বীকৃতি জানায়নি। পরন্তু সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও ছয় পাহাড়ের দালাল ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণের মহান সংগ্রাম সমর্থন দানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিপ্লবে বিরাট সাহায্য করছে।

দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ অবশ্যই সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণের হস্তক্ষেপ, প্রভাব কায়েমের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করবেন, নিজেদের ঐক্যকে দৃঢ় করে নিজেদের মুক্ত করবেন।

উপসংহার

কমরেডগণ,

পূর্ববাংলার সমাজের বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশল সর্বদাই অনুশীলনের অগ্নিপরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আমরা প্রথম থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামকে প্রধান ধরণের সংগ্রাম এবং সশস্ত্র সংগঠনকে প্রধান ধরণের সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করেছি।

সাংগঠনিক ক্ষেত্রে আমরা প্রয়োগ করেছি সঠিকভাবে মার্কসবাদী সাংগঠনিক লাইন। সঠিক রাজনীতি ও সামরিক লাইনে পরিচালিত সশস্ত্র সংগ্রামে লেগে থাকার ফলেই পার্টির বিকাশ, সুসংবদ্ধতা ও বলশেভীকরণ অর্জিত হয়েছে।

মতাদর্শগত ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী কর্মীদের পুনর্গঠনের জন্য শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত হওয়া, দৈহিক শ্রমে অংশগ্রহণ করা, তাদের কাছ থেকে পুনরায় শিক্ষা গ্রহণ করে মতাদর্শগত পুনর্গঠনের ধারণা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে।

আমাদের এ সকল সাফল্যের কারণেই সংগঠন অল্পসংখ্যক কর্মী থেকে বিকাশ লাভ করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরম নির্যাতনের মুখেও একমাত্র আমাদের সংগঠন টিকে…■

(রিপোর্টটির শেষের দিকের কিছু অংশ পাওয়া যায়নি—সর্বহারা পথ)