সিপিএমএলএম বাংলাদেশঃ নেপালের আন্তরিক কমরেডদের প্রতি খোলা চিঠি

নেপালের আন্তরিক কমরেডদের প্রতি খোলা চিঠি

 

কমরেড ও বন্ধুগণ,

লাল সালাম।

এই চিঠি আমরা প্রদান করছি এমন একটা সময়ে যখন নেপালে বিপ্লবের সূর্য অনেক আগেই অস্তমিত। সাম্প্রতিক বিশ্বে এক দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা ছিল যে গণযুদ্ধ তা ১০ বছরে দেশের শতকরা আশিভাগ এলাকা মুক্ত করার পরও তার নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতাবাদী লাইনে বিপর্যস্ত হয়, সকল অর্জিত ফলN-14_R3 খোয়া যায়। এখন কোন গণযুদ্ধ নেই, নেই কোন মুক্ত এলাকা, নেই কোন গণ মুক্তি বাহিনী। আশা জাগানোর মত কোন কিছু নেই কেবল জনগণ ছাড়া। আর রয়েছেন অনেক আন্তরিক বিপ্লব আকাঙ্খী নেতা কর্মী যেমনটা বিপ্লবী প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে সব দেশেই থেকে থাকে।

পূর্বতন নেপালের কমিউনিস্ট পাটি (মাওবাদী) বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন (রিম)-এর সদস্য হয়েও মাওবাদী নামে মাওবাদের বিরুদ্ধে দাড়ায়, বিপ্লবের পথ বর্জন করে, জনগণকে নিরস্ত্র করে, ঘাঁটি এলাকাগুলো ভেঙে দেয়।  এসব বিশ্বাসঘাতকতা রিম কমিটি গোপন করে, এক গোপন দুই লাইনের সংগ্রামের নসিহত করে, সুবিধাবাদের সাথে সহাবস্থানকে ঊর্ধে তুলে ধরে, লাইনগত সংগ্রাম বিধি নিষেধের বেঁড়া জালে আটকে দেয়াার বেঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করে এবং এভাবে রিমের নেতৃত্বকারী ভূমিকাকে ত্যাগ করে। ‘মাওবাদ অথবা মাও চিন্তাধারা’ এভাবে মতাদর্শকে উপস্থাপন করে প্রচণ্ড-বাবুরামের নেতৃত্বে সংশোধনবাদীরা নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) কে একীকৃত নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) তে পরিণত করেছিল। এটা ছিল মাওবাদের চুড়ান্ত বর্জন। প্রচণ্ড-বাবুরাম সংশোধনবাদীরা দেখিয়েছিল বর্তমান বিশ্ব ও দেশীয় পরিস্থিতি ক্ষমতা দখলের জন্য অনুকুল নয়, তাই আপোষ করতে হবে। তারা নয়া গণতন্ত্রের বদলে তথাকথিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কথা বললো। কথিত শান্তি আলোচনার মাধ্যমে গণ মুক্তি বাহিনীকে প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনীর অধীনে আত্মসমর্পণ করালো, অর্জিত ভুমি ও ক্ষমতা শোষকদের কাছে অর্পন করে নিজেরা সাম্রাজ্যবাদীদের, সম্প্রসারণবাদীদের দালাল ফ্যাসিবাদী আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়ায় পরিণত হল। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিও তাদের নিজ সংশোধনবাদে উলম্ফন ঘটায়। সিপিএন ও আরসিপি উভয়ই ভূমণ্ডলীকরণের নামধারী সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার বাইরের খোলস দেখে তার ভয়ানক দ্বন্দ্বমূলক ও ক্ষয়িষ্ণু অন্তসার না দেখে তাকে এক মেরুক আখ্যা দিয়ে দেখায় যে যুদ্ধ অথবা বিপ্লব অনিবার্য নয়। তারা মার্কসবাদকে অপর্যাপ্ত ঘোষনা করে। তারা উভয়েই মার্কসবাদের মৌলিক অঙ্গ সর্বহারা একনায়কত্বের ধারণাকে বর্জন করে। আরসিপি এমনকি মার্কসবাদী দর্শনের ওপর আস্থাকে রাজনৈতিক সত্য নাম দিয়ে অ-রাজনৈতিক সত্যের ধ্বজা ওড়ায়।

এদিকে এবছর ২০১৩-এর শুরুতে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) পুনরায় গঠিত হয়েছে। তারা তাদের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে অর্থাত তাদের পর্টির ৭ম কংগ্রেসে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এজন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। উল্লেখ্য এই পার্টিতে বেশ কিছু আন্তরিক মাওবাদী নেতা ও কর্মী ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন যাদের অনেকেরই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিছুদিন আগে আমাদের পার্টির একজন প্রতিনিধির সাথে সিপিএন (মাওবাদী)র দুজন উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের আলোচনা হয়। তারা আশাবাদী যে সিপিএন এম বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে এবং সেই সাথে তারা নতুন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ও দক্ষিণ এশীয় মাওবাদীদের সমন্বয় কমিটির মত সংগঠন পুনরায় গড়ে তোলার ব্যাপরে জোর দেন। সকলেই জানেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমরা পেরু, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, ইকোয়েডর, পানামা, ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়াম, আরব ও আফগানিস্তানের nepal4মালেমাবাদী কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের সাথে মিলে বিবিধ বিবৃতি প্রদান করেছি যেখানে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিদ্যমান ধারাবাহিক সুবিধাবাদ যথা রিম কমিটির নেতৃত্বের মধ্যেকার সুবিধাবাদ, এভাকিয়ানবাদ, প্রচণ্ডবাদ ও মধ্যপন্থাকে সংগ্রাম করার পাশাপাশি একটি নতুন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার জন্য একটি অগ্রসর চিন্তাধারার গুরুত্বকে তুলে ধরেছি। এই প্রেক্ষিতে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)র মধ্যেকার আন্তরিক মাওবাদী কমরেডদের প্রতি আমরা কিছু কথা তুলে ধরতে চাই। সেই সাথে এর বাইরে থাকা আন্তরিক কমরেডদের প্রতিও আমরা এসকল বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই।

কমরেডগণ, একটি বিপ্লবী বাহিনী কি প্রতিক্রিয়াশীলদের অধীনে আত্মসমর্পণ করতে পারে? যত মর্যাদাই তারা আপনাদের দিক না কেন, আত্মসমর্পণ নিজেই কি চরম অমর্যাদা নয়? এটা কি বিশ্বাসঘাতকতা নয়? তাহলে সিপিএন মাওবাদী মর্যাদাপূর্ণ আত্মসমর্পণ বলতে কি বোঝাতে চায়? আত্মসমর্পণবাদী কোন পার্টিতো বিপ্লবী হতে পারে না।

কোন শ্রেণীর গণতন্ত্রে সিপিএন (মাওবাদী) বিশ্বাস করে? কোন প্রজাতন্ত্র সে প্রতিষ্ঠা করতে চায়? নয়া গণতন্ত্রের বিপ্লবী প্রজাতন্ত্র নাকি বুর্জোয়া ফেডারেল রিপাবলিক?

বিপ্লব করার জন্য চিন্তাধারা প্রয়োজন। একটি চিন্তাধারা গণযুদ্ধের মাধ্যমে বিপ্লবকে নেতৃত্ব করে। প্রতিটি দেশে নিজ নিজ চিন্তাধারার মাধ্যমেই মাওবাদ মূর্ত হয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ ও গণযুদ্ধ সার্বজনীন। এই সব সত্য তুলে ধরে যে গনসালো চিন্তাধারা যা কিনা চেয়ারম্যানের মাওয়ের মৃত্যুর পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট চিন্তাধারা, তাকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন কিনা? তথাকথিত শ্রেণীসহযোগিতার শান্তিবাদী প্রচণ্ডবাদ কি বুর্জোয়া চিন্তাধারা নয়? প্রচণ্ডের নাম বাদ দিয়ে কি সিপিএন(এম) ঐ একই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ? উত্তর মাওবাদের নামে সংশোধনবাদী নয়া সংশ্লেষণের এভাকিয়ানবাদকে আপনারা বর্জন করেন কি?

শান্তি আলোচনা চালানোর উদ্দেশ্য কি? তা কি বাহিনী, এলাকা ও ক্ষমতা প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে অর্পণ করার জন্য? বাহিনী, এলাকা ও ক্ষমতা বর্জন করার পর  শান্তি আলোচনার দ্বারা আর কি উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে?

প্রতিটি দেশেই বিপ্লবের পথে নতুনত্ব রয়েছে। নেপালের বিপ্লবের বিশেষত্ব অবশ্যই প্রচণ্ডবাদী শান্তিবাদ নয়। কিন্তু কী সেই বিশেষত্ব সেটা নেপালী কমরেডদের অবশ্যই আবিষ্কার করার কর্তব্য রয়েছে, তাই নয় কি?

একটি আধা সামন্তবাদী  আধা উপনিবেশিক সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়ারা যারা জাতীয়তাবাদ, ধর্মবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে যা কায়েম করতে চায় তা হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। আজকে পুঁজিবাদ তার শেষ পর্যায় সাম্রাজ্যবাদের স্তরে মৃত্যুশয্যায়। এর আর কোন বিকাশের সম্ভাবনা নেই। ভাঁওতা দেওয়া ছাড়া এর কোন আদর্শ নেই। সুতরাং মুমূর্ষু বুর্জোয়াদের বিভিন্ন রূপের মতবাদ হচ্ছে বিবিধ ভণ্ডামী। আর এটাই হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। তাই, নেপালের প্রতিক্রিয়াশীলরা শান্তি প্রক্রিয়া, আলোচনার ও নির্বাচনের মাধ্যমে যা কায়েম করতে চায় তা ফ্যাসিবাদ, তাই নয় কি?

একটি কমিউনিস্ট পর্টি যখন বিশ্বাসঘাতকতার কানাগলিতে বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত ও বিলুপ্ত তখন কি সে বুর্জোয়া রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করে উঠে আসবে নাকি সর্বহারা শ্রেণীর রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরবে?

কাঠমান্ডুতে শতকারা ১০ ভাগ নেপালী বাস করে। সেটাকেই কেন প্রাধান্য দিতে হবে? যখন শতকরা ৮০ ভাগ এলাকা মুক্ত হয়েছিল তখন কাঠমান্ডুকে বাদ দিয়েই নয়াগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হতে পারতো, পরে কাঠমান্ডুও সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় একীভূত হতো।

‘বাহিনী ছাড়া জনগণের কিছু নেই’ কি আপনারা মানেন? তাহলে এ পরিস্থিতিতে কিছু জনসমর্থন থাকলে তাকি বাহিনী গড়ে তোলায় প্রয়োগ করা যায় না? আর তাতো বুর্জোয়াদের মতো গোপনভাবে ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তোলার মত নয় বরং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে, তাই নয় কি?

গণযুদ্ধ সার্বজনীন এটা কি আপনারা মানেন? তাহলে গণযুদ্ধ সূচনা না করে আপনারা শহরভিত্তিক অভ্যুত্থানের কথা কেন বলছেন? গণযুদ্ধের অংশ হিসেবে অভুত্থান নয় কেন? কাঠমান্ডু প্রতিক্রিয়াশীলদের কেন্দ্র হওয়ায় সেখানে অভুত্থান কি বড় ধরণের বিপর্যয় ডেকে আনবেনা? তার চেয়ে অন্য কোন অঞ্চলে অভ্যুত্থান ঘটানো ও সেখান থেকে সশস্ত্র সংগ্রাম সূচিত করা সহজ ও উচিত নয় কি?

চীন সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য কি? চীন কি একটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নয়? চীনের সাথে মিত্রতা করে নেপালে কি অর্জন করা যেতে পারে? আরো অধিক সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ ছাড়া অন্য কিছু কি? কমিউনিস্ট পার্টিকে এটা কি সাম্রাজ্যবাদের দালাল পার্টিতে পরিণত করবে না?

রাজতন্ত্র সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য কি? সিপিএন (এম) রাজতন্ত্রবাদী প্রাক্তন রাজা জ্ঞানেন্দ্রর সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। এটা কি সামন্তবাদ ও রাজতন্ত্রকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করবে না? কমিউনিস্ট পার্টিকে কি এটা সামন্তবাদী পার্টিতে পরিণত করবে না?

কমরেডগণ,

বাংলাদেশে মাওবাদী আন্দোলন একসময় যথেষ্ট শক্তিশালি ছিল। সিরাজ সিকদার এদেশে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি, গণযুদ্ধ, ঘাঁটি ও সশস্ত্র সংগ্রামের এলাকাসমূহ ও চিন্তাধারা গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু কমরেড সিরাজ সিকদারের শহীদ হওয়ার পর দীর্ঘ সময় সীমিত সশস্ত্র সংগ্রাম সত্ত্বেও বারংবার বিশ্বাসঘাতকতাবাদী সুবিধাবাদী লাইন তাকে দুর্বল করে দিয়েছে। বহু শত গ্রামে মাওবাদী কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রভাব রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ এলাকায়ই নেতৃত্বকারী পার্টির অনুপস্থিতি রয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন কঠিন কিছু নয়, দরকার সঠিক মতাদর্শিক ধারার একটা নেতৃত্ব কাঠামো।  বর্তমান শুণতা থেকে উঠে আসার জন্য আমাদের নতুন পার্টি গঠিত হয়েছে। আমরা চাই মতাদর্শিকভাবে নিজেরা গড়ে ওঠবো, কর্মী ও জনগণকে গড়ে তুলবো। মধ্যপন্থা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা ও সুবিধাবাদ। একটি সঠিক মালেমাবাদী লাইনের কোন বিকল্প নেই।

যেমনটা সিপিএন মাওবাদী আমন্ত্রণপত্রে বলেছেন আমাদের দ্ইু পার্টির কমরেডদের মধ্যে এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক । এটা খুবই সঠিক। আমরা একই দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক ভাই-বোন। আমরা আন্তরিকভাবে কামনা করি নেপাল ও বাংলাদেশে একটি সঠিক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী মতাদর্শিক লাইনের ভিত্তিতে বিপ্লবী প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে।

নেপাল ও বাংলাদেশের বিপ্লব অনিবার্য!

১৩ আগষ্ট ২০১৩

কেন্দ্রিয় কমিটি

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদীলেনিনবাদীমাওবাদী বাংলাদেশ