আলেক্সান্ডার ত্রেচেনবার্গ। মে দিবসের ইতিহাস

পিডিএফ  মুদ্রনের জন্য পিডিএফ

মে দিবসের ইতিহাস। আলেক্সান্ডার ত্রেচেনবার্গ ১৯৩২ সালে বইটি রচনা ও আন্তর্জাতিক প্রকাশনার মাধ্যমে প্রকাশ করেন।

ইংরেজী কপিটি মার্কসিস্ট ইন্টারনেট আর্কাইভে সংরক্ষিত হয়েছে। ইংরেজী কপিটি থেকে সিপিএমএলএম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ বাংলায় ভাষান্তর ও প্রকাশ করে ৭ মে ২০২৩। সর্বহারা পথ ওয়েবসাইট থেকে বাংলা বইটি পড়া ও প্রিন্ট নেয়া যাবে।

আমেরিকান সাম্যবাদী আন্দোলনের বৃহত্তম প্রচারক ও নেতা হলেন আলেক্সান্ডার ত্রেচেনবার্গ। রুশ দেশের ওডেসা বন্দরে ১৮৮৫ সালের ২৩ নভেম্বর জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। অল্প বয়সেই তিনি রুশ বৈপ্লবিক আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের পরাজয়ের পর ইহুদিবিরোধী গণহত্যা থেকে রেহাই পেতে তাঁর

আলেক্সান্ডার ত্রেচেনবার্গ

আলেক্সান্ডার ত্রেচেনবার্গ

পরিবার আমেরিকায় চলে যায়। আমেরিকাতে তিনি সমাজগণতন্ত্রী পার্টি ও পরে সাম্যবাদী পার্টি গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা নামে একটি সাম্যবাদের প্রচারক প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলেন যার মাধ্যমে আজীবন তিনি সাম্যবাদের প্রচার চালান। এজন্য তাকে মার্কিন রাষ্ট্রের সাম্যবাদবিরোধী বিচারের সম্মুখীন হতে হয় দুইবার। একবার তিনি কিছুদিন জেলও খাটেন। ১৯৬৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলা ভাষান্তরের ভূমিকা

মে দিবসের শ্রমিক আন্দোলন আমেরিকান শ্রমিক আন্দোলন জন্ম দিয়েছে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, নির্দেশনা ও নেতৃত্বের মাধ্যমে। একইভাবে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আন্দোলনও ছিল সরাসরি সাম্যবাদীদের নেতৃত্বে পরিচালিত। আন্তর্জাতিকের মাধ্যমেই এই উভয় দিবস স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়। আর প্রথম সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এই উভয় আন্দোলন বাস্তব ভিত্তি অর্জন করে, যা আর কখনো পেছনে ফিরে যায়নি।

আমরা ত্রেচেনবার্গের এই বইটিতে মোটামুটি ৮ ঘন্টা দিবস আন্দোলনের আদ্যোপান্ত জানতে পারব। মে দিনের প্রথম পটভূমি রচনা করেছিলেন অসাধারণ একজন মানুষ সিলভিস। তিনি ছিলেন ঢালাই শ্রমিক, দাসপ্রথাবিরোধী যুদ্ধের একজন কমান্ডার। ১৮৬৬ সালে তিনি প্রথম আমেরিকান শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে স্বতস্ফূর্ত শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। কার্ল মার্কসের নেতৃত্বে প্রথম সর্বহারা আন্তর্জাতিকের সাথে তিনি ঘনিষ্ট যোগাযোগ বজায় রাখতেন। তিনিই আশ্রইকে সর্বহারা আন্তর্জাতিকের অংশ হিসেব গড়ে তোলেন। তখনকার শ্রমিকদের অবস্থা ছিল এই যে তারা দিনে ১৮, ২০ এমনকি ২২ ঘন্টা খাটতেন। তাই শ্রমঘন্টা কমানোর দাবিতে স্বতস্ফূর্তভাবে শ্রমিকরা বিক্ষোভে বিস্ফোরিত হতে লাগলেন। সেই প্রবল ক্ষোভকে পরিকল্পিত লড়াইয়ে রূপ দিলেন সিলভিস। লক্ষ্য ছিল শ্রমঘন্টা কমানো আর মূল লক্ষ্য মজুরী দাসত্বের অবসান। কিন্তু সিলভিস অকালে মৃত্যুবরণ করলেন। সিলভিসের মৃত্যুতে আন্দোলন ক্ষয়প্রাপ্ত হল। আশ্রই বিলুপ্ত হল। কিন্তু শ্রেণীসংগ্রামঃ ধর্মঘট-বিক্ষোভ চলতেই থাকে। ১৮৭০ দশকে মেরি মেগুইর নামে এক প্রগতিশীল গোপন সংগঠন আন্দোলনে যুক্ত হয়। তারা পুঁজিপতিদের উপর আঘাত হানতে থাকে। তাই রাষ্ট্র এর নেতাদের রেলপথে নিয়ে ফাঁসি দেয়। এই ঘটনা শ্রমিকদের মনে এতটা দাগ কাটে যে তারা সংঘাতের মাধ্যমে এর জবাব দিতে থাকে।

১৮৮৪ সালে আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশন গঠিত হল। আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশন শ্রমঘন্টা কমানোর আন্দোলনের নেতৃত্ব হাতে নিল। এরই মধ্যে শ্রমিকদের সেনাপতিমণ্ডলী নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠন তার অনেক প্রভাব বলয় গড়ে তুলেছিল, তাদেরকে আশ্রফে আন্দোলনে যুক্ত করল। কিন্তু শ্রমিক সেনাপতিদের নেতারা আন্দোলনে অন্তর্ঘাত চালাতে শুরু করল। কিন্তু তাসত্ত্বেও আন্দোলন চলতে থাকল। এরপর বিভিন্ন শহরে ৮ ঘন্টা লীগ ও সংঘ গঠিত হল। ১৮৮০-১৮৮৫ পর্যন্ত মে দিবসের প্রস্তুতি লড়াই চলল। হাজার হাজার ধর্মঘট সঙ্ঘটিত হল। ১৮৮৬ সালের ১মে সারা দেশে শ্রমিক ধর্মঘট হল। শিকাগো ছিল বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্র। এখানেই সর্বাধিক জঙ্গী সংগ্রাম বেঁধে উঠল। ১লা মে সংগ্রামের ফল হিসেবে ৩রা মে ম্যাককরমিক ওয়ার্কসের ধর্মঘটী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালিয়ে ৬ শ্রমিককে হত্যার প্রতিবাদে ৪ঠা মে হে মার্কেটে রক্তস্নান ও সঙ্ঘটিত যুদ্ধে চার শ্রমিক ও সাত পুলিশ নিহত হল। শ্রমিক নেতা পার্সন্স, স্পাইস, এঞ্জেল, ফিশারকে রেলপথে ফাঁসি দেওয়ার জন্য পাঠানো হল আর অনেক জঙ্গী নেতাকে জেল দেওয়া হল। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর এই সংগ্রাম চলল। ১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই প্যারিসে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ২য় আন্তর্জাতিক গঠিত হল। প্যারিস কংগ্রেসে আমেরিকান শ্রমিকদের সাথে সংহতি হিসেবে ১লা মেতে সারা দুনিয়ায় শ্রমিক বিক্ষোভ পরিচালনার ঘোষণার পর সারা দুনিয়ায় এই সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ল। তারপর ১ম মহাযুদ্ধ এল। সমাজগণতন্ত্রী পার্টিসমূহের বেশিরভাগই বিশ্বাসঘাতকতা করল। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় মে দিবসের সংগ্রাম রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপ নিল। ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ২য় আন্তর্জাতিকের অধিকাংশ নেতারা নিজ নিজ দেশের বুর্শোয়াদের সমর্থন করার মাধ্যমে সুবিধাবাদে পতিত হলে লেনিন, রোজা লুক্সেমবার্গ, কার্ল লিবনেখটের মত বিপ্লবী নেতারা বিপ্লবী লাইনে অব্যাহত থেকে বিরাটাকারে সংগ্রাম এগিয়ে নেন। তাঁরা ২য় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদীদের বিপরীতে ভিন্ন কংগ্রেসের মাধ্যমে এগোতে থাকেন। আমেরিকায় যুদ্ধের মধ্যেও মেদিবসের সংগ্রামে চলতেই থাকে।

আশ্রফে ও সমাজগণতন্ত্রী পার্টি বিশ্বাসঘাতকতা করে। বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় আমেরিকার রাষ্ট্র ১লা মেকে শিশু স্বাস্থ্য দিবস ঘোষণা করে আন্দোলনকে বানচাল করার চেষ্টা করে, কিন্তু সংগ্রাম চলতেই থাকে। এদিকে রুশদেশে শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হল। উপনিবেশসমূহের জনগণ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লেনিনের নেতৃত্বে ৩য় আন্তর্জাতিক (কমিন্টার্ন) গঠিত। আন্তর্জাতিকভাবে মে দিবসের ঐতিহ্য তারাই বহন করে চলল। সোভিয়েত দেশে ৮ঘন্টার স্থলে ৭ ঘন্টা কর্মদিবস বাস্তবায়ন হল। মার্কিন দেশে সাম্যবাদী পার্টি গঠিত হল। সারা দুনিয়ায় সাম্যবাদীদের তৎপরতার ফল হিসেবে ১লা মে মে দিবস হিসেবে ও ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সাম্যবাদের ভবিষ্যত উঁকি দিতে লাগল। সামনের দিন সাম্যবাদেরই।।

কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ, বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী

৭মে ২০২৩

ছোটতর কর্মদিবসের জন্য সংগ্রাম

মে দিবসের উদ্ভব তুলনামূলক ছোট কর্মদিবসের জন্য সংগ্রামের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে বাঁধা, যে দাবি ছিল শ্রমিকশ্রেণীর এক বৃহৎ রাজনৈতিক তাৎপর্যের দাবী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প কারখানা ব্যবস্থার শুরু থেকেই এই সংগ্রামের প্রকাশ ঘটছে।

যদিও দেশে প্রথম দিককার ধর্মঘটগুলোর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল উচ্চতর মজুরীর দাবী, শ্রমিকেরা যখন তাদের মালিক ও সরকারের বিরুদ্ধে দাবীদাওয়ার সূত্রায়ণ করে, ছোটতর কর্মদিবস ও সংগঠন করার অধিকারের প্রশ্নকে সর্বদাই সামনে রাখা হয়েছে। যখন শোষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে আসল, আর শ্রমিকেরা অমানবিক দীর্ঘ কর্মদিবসের পীড়ণ অনুভব করছিল, শ্রমঘন্টা হ্রাসের দাবী আরো স্পষ্টভাবে ঘোষিত হল।

ঊনিশ শতকের শুরুতে ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা তখনকার কর্মদিবস ‘সূর্যোদয় ঠেকে সূর্যাস্ত’ পর্যন্ত খাটুনির কষ্ট জানত। চৌদ্দ, ষোল ও এমনকি আঠার ঘন্টার কর্মদিবস ছিল স্বাভাবিক। ১৮০৬ সালের ধর্মঘটী মুচিদের  বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক বিচারের সময় এই সত্য প্রকাশিত হয় যে শ্রমিকদের দিনে ঊনিশ ঠেকে বিশ ঘন্টা পর্যন্ত খাটতে হত।

বিশের ও ত্রিশের দশক পূর্ণ ছিল শ্রমঘন্টা কমানোর দাবিতে ধর্মঘটে, আর বিভিন্ন শিল্পকেন্দ্রগুলোতে দশ ঘন্টা কর্মদিবসের সুনির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। ফিলাডেলফিয়ার মিস্ত্রিদের ইউনিয়ন যা ইংল্যান্ডের শ্রমিকদের দ্বারা দুই বছর আগে গঠিত হয়, তাকে বিশ্বের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তারাই ১৮২৭ সালে নির্মাণ শ্রমিকদের ধর্মঘটে ১০ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবি তুলে ধরে। ১৮৩৪ সালে নিউইয়র্কের রুটির কারখানার ধর্মঘটের সময়, শ্রমজীবিদের মুখপাত্র পত্রিকা রিপোর্ট করে যে “রুটির কারখানায় নিযুক্ত মজুরেরা বহু বছর যাবত মিশরীয় দাসদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গড়ে আঠার ঠেকে বিশ ঘন্টা তাদের কাজ করতে হয়।”

এইসব এলাকায় দশ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবি শীঘ্রই আন্দোলনে পরিণত হল যা ১৮৩৭ সালের সংকটে বাঁধাগ্রস্থ হলেও, প্রেসিডেন্টে ভ্যান বিউরেনের অধীন ফেডারেল সরকারকে বাধ্য করে সরকারী কাজে ১০ ঘন্টা কর্মদিবসের ডিক্রি জারি করতে। ১০ ঘন্টা সার্বজনীন কর্মদিবসের সংগ্রাম পরবর্তী দশকগুলোতে অব্যাহত থাকে। বেশকিছু শিল্পে এই দাবী বাস্তবায়িত হতে না হতেই শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা শ্রমদিবসের দাবির শ্লোগান উত্থাপন করতে শুরু করে। পঞ্চাশ দশকে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের উৎসাহ এই নতুন দাবিকে প্রেরণা দিল, যদিও তা ১৮৫৭ সালের সংকটে বাঁধাগ্রস্ত হয়েছিল। অবশ্য এই দাবি এই সংকটের আগে কিছু সুসংগঠিত শিল্পে জয়যুক্ত হয়েছিল। ছোট কর্মদিবসের দাবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধু স্বাভাবিক ছিল তাই নয়, পৃথিবীতে উদীয়মান পুঁজিবাদের অধীনে যেখানেই শ্রমিকরা শোষিত হচ্ছিল সেখানেই তা যে বিদ্যমান ছিল তা দেখা যায় দূরতম অস্ট্রেলিয়ায় নির্মাণ শ্রমিকরা  দাবি উথাপন করে “৮ ঘন্টা শ্রম, ৮ ঘন্টা বিনোদন ও ৮ ঘন্টা বিশ্রাম”-এর, আর তারা ১৮৫৬ সালে এই দাবি বাস্তবায়নে সফল হল।

আমেরিকায় ৮ ঘন্টা আন্দোলন শুরু হল

সরাসরি মে দিবসের জন্ম দিল যে আট ঘন্টা আন্দোলন তাকে ১৮৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সূচিত সাধারণ আন্দোলনে খুঁজে পাওয়া যায়। এক প্রজন্ম আগে একটি জাতীয় শ্রমিক সংগঠন প্রথমে নিজেকে আমেরিকান শ্রমিক শ্রেণীর জঙ্গী সমাবেশ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার মহান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা ছোটতর কর্মদিবসের প্রশ্ন হাতে তুলে নেয় আর তার পক্ষে এক বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তাব করে। গৃহযুদ্ধের প্রথম বছরগুলিতে ১৮৬১-৬২তে কিছু জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয় যেগুলো যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুকাল আগেই গঠিত হয়, বিশেষত ঢালাই কারখানার শ্রমিকদের ইউনিয়ন আর যন্ত্রশিল্প ও কামারদের ইউনিয়ন। তার ঠিক পরের বছরগুলিতেই বেশ কিছু স্থানীয় শ্রমিক সংগঠন জাতীয় ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়, আর এসব ইউনিয়নকে নিয়ে একটি জাতীয় ফেডারেশন গঠনের প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে সামনে আসে। ২০শে আগস্ট ১৮৬৬ সালে বাল্টিমোরে প্রায় ষাটটি ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা মিলে জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে। জতীয় সংগঠন গড়ে তোলার নেতা ছিলেন উইলিয়াম হ সিলভিস, পুনর্গঠিত ঢালাই শ্রমিকদের নেতা, নবীন এই মানুষটি ছিলেন সেসময়কালের শ্রমিক আন্দোলনের অসাধারণ এক চরিত্র। লন্ডনে অবস্থিত প্রথম আন্তর্জাতিকের নেতাদের সাথে সিলভিসের যোগাযোগ ছিল এবং তিনি আন্তর্জাতিকের সাধারণ পরিষদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়নকে সহায়তা ও উদ্বুদ্ধ করেন।

১৮৬৬ সালে জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে ছোট কর্মদিবসের প্রশ্নে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ঃ

বর্তমানে প্রথম ও মহান প্রয়োজন হল এই দেশের শ্রমিকদের পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্ত করা, একটি আইন পাশ করা যাতে আমেরিকান ইউনিয়নের সকল রাজ্যে ৮ ঘন্টা কর্মদিবস হবে স্বাভাবিক কর্মদিবস। এই গৌরবোজ্বল ফল অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সকল সামর্থকে নিয়োজিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর।

একই সম্মেলন ৮ ঘন্টা কর্মদিবস কার্যকর ও “শিল্পশ্রেণীসমূহের স্বার্থকে রক্ষা ও প্রতিনিধিত্ব করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ লোকদের নির্বাচন” করার সাথে সম্পর্কিত স্বাধীন রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালানোর পক্ষে ভোট দেয়।

প্রথম দিককার শ্রমিক আন্দোলনের কর্মসূচি ও কর্মনীতিগুলি ছিল প্রাচীন, আর সবসময় সুস্থ ছিলনা, তথাপি সুস্থ সর্বহারা উদ্যমের ভিত্তিতেই তা গড়ে উঠে। আর তা এদেশে প্রকৃত বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশের সূচনা বিন্দু হিসেবে সেবা করতে পারত যদি সংস্কারবাদী ভ্রান্ত নেতারা ও পুঁজিবাদী রাজনীতিবিদেরা শ্রমিক সংগঠনগুলিকে দূষিত না করত আর ভুল পথে পরিচালিত না করত। এভাবে ৬৫ বছর আগে আমেরিকান শ্রমিকদের সংগঠন জাশ্রই “পুঁজিবাদী দাসত্ব”-এর বিরুদ্ধে বলেছে আর স্বাধীন রাজনৈতিক তৎপরতার কথা বলেছে।

জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়নের বিক্ষোভের ফল হিসেবে ৮ ঘন্টা লীগ গঠিত হয়, আর তাদের গড়ে তোলা রাজনৈতিক তৎপরতার ফল হিসেবে কয়েকটি রাজ্য সরকার সরকারী কাজে ৮ ঘন্টা কর্মদিবস গ্রহণ করে, এবং মার্কিন কংগ্রেস ১৮৬৮ সালে একই ধরণের একটি আইনও প্রণয়ন করে।

সিলভিস লন্ডনে অবস্থিত আন্তর্জাতিকের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। সংগঠনের সভাপতি হিসেবে তার প্রভাবের কারণে, জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়ন ১৮৬৭ সালের এর সম্মেলনে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সহযোগিতার পক্ষে ভোট দেয়, আর ১৮৬৯ সালে সাধারণ পরিষদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ভোট দেয় এবং আন্তর্জাতিকের বাজেল কংগ্রেসে একজন প্রতিনিধি পাঠায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আশ্রইর সম্মেলনের কিছু আগেই সিল্ভিস মারা যান, তাই শিকাগো থেকে প্রকাশিত শ্রমজীবিদের মুখপত্র পত্রিকার সম্পাদক এসি ক্যামেরনকে তার বদলে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয়। সাধারণ পরিষদ এক বিশেষ সিদ্ধান্তে এই প্রতিশ্রুতিশীল নবীন আমেরিকান শ্রমিক নেতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেনঃ “সকলের চোখ সিলভিসের ওপর নিবদ্ধ ছিল, যিনি সর্বহারা বাহিনীর একজন জেনারেল হিসেবে তার বিরাট সক্ষমতা ছাড়াও, দশ বছরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিলেন, আর সেই সিলভিস মারা গেছেন”। সিলভিসের মৃত্যু ছিল জাতীয় শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ, যে ক্ষয় ঐ সংগঠনকে বিলোপে ঠেলে দেয়।

প্রথম আন্তর্জাতিক আট ঘন্টা কর্মদিবস গ্রহণ করে

৮ ঘন্টা কর্মদিবসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়ন ১৮৬৬ সালের আগস্ট মাসে। একই বছর সেপ্টেম্বরে প্রথম আন্তর্জাতিকের জেনেভা কংগ্রেস একই দাবিকে গ্রহণ করে এই ভাষায়ঃ

কর্মদিবসের বৈধ সীমা হচ্ছে প্রাথমিক শর্ত যা ছাড়া শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি ও মুক্তির আর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণিত হবে…কংগ্রেস ৮ ঘন্টাকে কর্মদিবসের বৈধ সীমা প্রস্তাব করছে।

৮ ঘন্টা আন্দোলন প্রশ্নে মার্কস

১৮৬৭ সালে প্রকাশিত পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খন্ডের “কর্ম দিবস” অধ্যায়ে মার্কস জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়ন সূচিত ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের আন্দোলনের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেন। অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে তা বিখ্যাত বিশেষত এই কারণে যে এতে আছে মার্কসের কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণীস্বার্থের সংহতির প্রতি উদ্ধৃতিঃ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে কোন ধরণের স্বাধীন শ্রমিক আন্দোলন পঙ্গু যতক্ষণ দাসপ্রথা প্রজাতন্ত্রের একটি অংশের চেহারা বিনষ্ট করে। সাদা চামড়ার শ্রম নিজেকে মুক্ত করতে পারেনা যেখানে কালো চামড়ার শ্রমের উপর বিশেষত্ব আরোপিত আছে। কিন্তু দাসত্বের মৃত্যুর মধ্যে এক নয়া সজীব জীবনের অঙ্কুরোদ্গম হল। গৃহযুদ্ধের প্রথম ফল হল ৮ ঘন্টা কর্ম দিবসের জন্য বিক্ষোভ, এক আন্দোলন যা দাপিয়ে বেড়িয়েছে আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত, নয়া ইংল্যান্ড থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত।

মার্কস মনোযোগ আকর্ষণ করেন যে কীভাবে ঠিক একই সময়ে, বস্তুত দুই সপ্তাহের মধ্যে বাল্টিমোরে শ্রমিক সম্মেলন ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের পক্ষে ভোট দিল, আর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আন্তর্জাতিকের কংগ্রেস একই ধরণের সিদ্ধান্ত নিল। “এভাবে আটলান্টিকের দুই দিকেই উৎপাদনের পরিস্থিতিজাত স্বতস্ফূর্ত ফলাফল যে শ্রমিক আন্দোলনের জন্ম দিল” তা ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবিতে মূর্ত শ্রমঘন্টার সীমাবদ্ধতার একই আন্দোলন গ্রহণ করেছে।

জেনেভা কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত যে আমেরিকান সিদ্ধান্তের দ্বারা ত্বরান্বিত হয়েছে তা সিদ্ধান্তের এই অংশ থেকে দেখা যায়।

“যেহেতু সীমাটি উত্তর আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের সাধারণ দাবিকে প্রতিনিধিত্ব করে, কংগ্রেস তাই এই দাবিকে সারা দুনিয়ার শ্রমিকদের সাধারণ দাবিতে রূপান্তর করছে।”

এই একই দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিকের কংগ্রেসের উপর আমেরিকান শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাব ২৩ বছর পর আরো গভীরভাবে উৎসারিত হয়েছে।

 মে দিবস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিল

১৮৭২ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক বিলুপ্ত হল যখন তার সদর দপ্তর লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে সরিয়ে নেয়া হয়, যদিও তা দাপ্তরিকভাবে ১৮৭৬ সালের আগে বিলুপ্ত হয়নি। যা পরে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নাম পেয়েছে সেই পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিকের প্যারিসে ১৮৮৯ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম কংগ্রেসেই মে দিবসকে একটি দিবস হিসেবে নির্ধারন করা হয় যাতে রাজনৈতিক পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নসমূহে সংগঠিত দুনিয়ার শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দাবির জন্য সংগ্রাম করবেঃ ৮ ঘন্টা কর্ম দিবস। প্যারিস সিদ্ধান্ত পাঁচ বছর আগে শিকাগোতে এক নবীন আমেরিকান শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সংগঠিত ট্রেড ও শ্রমিক ইউনিয়নের ফেডারেশন, পরবর্তীতে যাকে সংক্ষিপ্ত নামে বলা হয় আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশন। ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর সংগঠনটির ৪র্থ সম্মেলনে নিচের সিদ্ধান্ত পাশ হয়ঃ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সংগঠিত ট্রেড ও শ্রমিক ইউনিয়নসমূহের ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত হল ১৮৮৬ সালের ১মে থেকে ৮ ঘন্টা হচ্ছে বৈধ কর্মদিবস, শ্রমিক সংগঠনসমূহ এই সময়ের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে তাদের আইন গড়ে তুলবেন ও কর্মতৎপরতা পরিচালনা করবেন।

যদিও সিদ্ধান্তে কিছু বলা হয়নি কোন পদ্ধতিতে ফেডারেশন ৮ ঘন্টা দিবস প্রতিষ্ঠা করতে আশা করে। এটা স্বতসিদ্ধ যে ৫০,০০০-এর বেশি সদস্য যার নেই সে “৮ ঘন্টা হচ্ছে বৈধ কর্মদিবসের সীমা” ঘোষণা করতে পারেনা সদস্যরা যেখানে কর্মরত সেই দোকান, কারখানা ও খনিতে লড়াই না চালিয়ে, শ্রমিকদের ব্যাপকতর সদস্যদের ৮ ঘন্টা দিবসের সংগ্রামে না টেনে এনে। সিদ্ধান্তের যে ধারা বলছে, ফেডারেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নসমূহ “তাদের আইনকে এই সিদ্ধান্তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে  পরিচালিত করবে”, সেখানে ১৮৮৬ ১লা মেতে ৮ ঘন্টা দিবসের ধর্মঘটে যারা অংশ নেবে আশা করা যাচ্ছে, তাদের সম্ভবত দীর্ঘদিন কাজের বাইরে থাকতে হবে, তাই ইউনিয়নের কাছ থেকে সাহায্য নিতে হবে, তাই ধর্মঘটের জন্য তাদের বরাদ্দ দেওয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেহেতু ধর্মঘট হতে হত দেশব্যাপী পরিসরে আর সকল সংশ্লিষ্ট সংগঠনকে নিয়ে তা হত, তাদের ধারা অনুসারে তাদের সদস্যদের স্বীকৃতি নিতে হত বিশেষত যেহেতু তাদের তহবিলের ব্যয় এর সাথে জড়িত ছিল। স্মরণ করা যেতে পারে যে যেমন আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশন সংগঠিত ছিল স্বেচ্ছায় ও ফেডারেশনভিত্তিক, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলিকে জাতীয় সম্মেলন সিদ্ধান্তে পরিচালিত করতে পারত কেবল যদি ঐ ইউনিয়নগুলি সিদ্ধান্তগুলিকে অনুমোদন করত।

মে দিবসের ধর্মঘটের প্রস্তুতি

১৮৮০-৯০ দশক যদিও আমেরিকান শিল্পের বিকাশ ও দেশীয় বাজারের সম্প্রসারণে সাধারনভাবে অন্যতম সক্রিয় ছিল, ১৮৮৩-৮৫ সময়কাল মন্দার সম্মুখীন হয়, যা ছিল ১৮৭৩ সালের সংকটের পর এক চক্রাকার মন্দা। অপেক্ষাকৃত ছোট কর্মদিবসের আন্দোলন এসময়ের বেকারত্ব ও বিরাট দুঃখদুর্দশা থেকে বর্ধিত প্রেরণা প্রাপ্ত হয়, যেমন আজকে আমেরিকান শ্রমিকরা যে প্রচন্ড বেকারত্বে ভুগছে সেখানে ৭ ঘন্টা দিবসের দাবি জনপ্রিয় প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।

১৮৭৭ সালের ব্যাপক ধর্মঘট সংগ্রামে, যাতে লক্ষ লক্ষ রেল ও ইস্পাত শ্রমিকরা কর্পোরেশন ও সরকারের বিরুদ্ধে জঙ্গী লড়াই চালায়, সরকার ধর্মঘট দমনে বাহিনী প্রেরণ করে যা সমগ্র শ্রমিক আন্দোলনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এটা ছিল আমেরিকান শ্রমিকশ্রেণীর জাতীয় পর্যায়ে প্রথম বিরাট গণ তৎপরতা, আর যদিও রাষ্ট্র ও পুঁজির যৌথ বাহিনীর কাছে তারা পরাজিত হয়, এই সংগ্রাম থেকে উঠে আসা আমেরিকান শ্রমিকেরা বৃহত্তর জঙ্গীত্ব ও উচ্চতর উচ্চতায় উন্নীত মনোবল সহকারে সমাজে তাদের শ্রেণী অবস্থানের এক পরিষ্কার ধারণা পায়। পেনসিল্ভ্যানিয়ার কয়লা খনির বড় শিল্পপতিরা যে খনি শ্রমিকদের সংগঠনকে ধ্বংস করতে কয়লাখনি এলাকায় ১৮৭৫ সালে গোপন সংগঠন মলি মেগুইরের দশ জঙ্গী খনি শ্রমিককে রেলপথে ফাঁসি দিতে নিয়ে যায়, এটা ছিল অংশত তার জবাব।

মাত্র সংগঠিত ফেডারেশন তার বাইরে থাকা বিরাট সংখ্যক শ্রমিকদের, আর একটি পুরনো কিন্তু বাড়ন্ত সংগঠন শ্রমিকদের সেনাপতি (নাইটস অব লেবার)-দের সমাবেশিত করতে আট ঘন্টা দিবস শ্লোগান ব্যবহার করার সম্ভাবনা দেখে। ফেডারেশন শ্রমিকদের সেনাপতি সংগঠনকে ৮ ঘন্টা দিবসের আন্দোলনকে সমর্থনের আহবান জানায়, এই উপলব্ধি করে যে সকল সংগঠিত শ্রমিকের সাধারণ কর্মকান্ডই শুধু সম্ভাব্য অনুকুল ফলাফল আনতে পারে।

১৮৮৫ সালে ফেডারেশনের সম্মেলনে, পরবর্তী বছরের ১লা মেতে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত পুন উচ্চারিত হয়, আর কিছু জাতীয় ইউনিয়ন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি তৎপরতা চালায় যাদের মধ্যে কাঠমিস্ত্রি ও চুরুট শ্রমিকেরা বিশেষভাব উল্লেখযোগ্য। ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের জন্য ১লা মের তৎপরতার জন্য বিক্ষোভ সমাবেশ বিদ্যমান ইউনিয়নগুলির সদস্য সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটাল। শ্রমিকদের সেনাপতিদের বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটল, ১৮৮৬ সালে তার বৃদ্ধি চূঁড়ায় পৌঁছাল। রিপোর্ট আছে যে শ্রমিকদের সেনাপতি (কেওএল) যা ফেডারেশনের চেয়ে বেশি পরিচিত ও এক লড়াকু সংগঠন ছিল, তাদের সদস্য সংখ্যা এই সময়ে দুই লক্ষ থেকে বেড়ে সাত লক্ষে পৌঁছল। ফেডারেশন আন্দোলনের সূচনা ও ৮ ঘন্টা দিবসের ধর্মঘটের দিন ঠিক করে সংখ্যায়ও বেড়ে গেল আর ব্যাপক শ্রমিকদের মধ্যে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পেল। ধর্মঘটের দিন যতই ঘনিয়ে আসল, এটা প্রমাণিত হল যে শ্রমিকদের সেনাপতিদের নেতারা বিশেষত টরেন্স পাউডারলি আন্দোলনে অন্তর্ঘাত চালানোর চেষ্টা করছে, এমনকি এর ইউনিয়নগুলো গোপনে ধর্মঘট না করার পরামর্শ দিচ্ছে, তাসত্ত্বেও ফেডারেশনের জনপ্রিয়তা আরো বাড়ল। উভয় সংগঠনের নেতাকর্মীরা সংগ্রামের জন্য উদ্দীপনা সহকারে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ৮ ঘন্টা লীগ ও সংঘ গড়ে উঠল বহু শহরে, আর সমগ্র শ্রমিক আন্দোলনে জঙ্গীত্বের এক উচ্চতর উদ্যম অনুভূত হল যা অসংগঠিত ব্যাপক শ্রমিকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছিল।

ধর্মঘট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল

শ্রমিকদের মেজাজ অধ্যয়ন করার সবচেয়ে ভাল উপায় হল তাদের সংগ্রামের পরিসর ও গুরুত্ব বোঝা। একটি নির্দিষ্ট সময়কালে ধর্মঘটের সংখ্যা শ্রমিকদের লড়াকু মেজাজের একটি ভাল নির্দেশক। বিগত বছরগুলির তুলনায় ১৮৮৫ ও ১৮৮৬ সালে ধর্মঘটের সংখ্যা দেখায় যে কীভাবে জঙ্গীত্ব শ্রমিক আন্দোলনকে গতিশীল করছিল। শ্রমিকরা ১৮৮৬র ১লা মের তৎপরতার জন্যই শুধু প্রস্তুতিই নিচ্ছিলনা, ইতিমধ্যেই ১৮৮৫ সালে ধর্মঘটের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ১৮৮১-৮৪ সময়কালে ধর্মঘট ও লক আউটের সংখ্যা ছিল গড়ে বছরে ৫০০, আর গড়ে মাত্র ১,৫০,০০০ শ্রমিক বছরে জড়িত ছিল। ১৮৮৫ সালে ধর্মঘট ও লক আউট বেড়ে দাঁড়ায় ৭০০, আর জড়িত শ্রমিক সংখ্যা লাফিয়ে হয় ২,৫০,০০০ জন। ১৮৮৬ সালে ধর্মঘটের সংখ্যা ১৮৮৫র দ্বিগুণের বেশি হয়ে হয় ১৫৭২টি, আর জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা আনুপাতিকভাবে বেড়ে হয় ৬,০০,০০০ জন। ১৮৮৬ সালে ধর্মঘট আন্দোলন কতটা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে তা এই বাস্তবতা থেকে দেখা যায় যে যেখানে ১৮৮৫ সালে ২৪৬৭টি প্রতিষ্ঠান ধর্মঘটে আক্রান্ত হয়, পরের বছর তা বেড়ে হয় ১১,৫৬২টি। শ্রমিকদের সেনাপতি (কেএলও)-এর প্রকাশ্য অন্তর্ঘাত সত্ত্বেও হিসেবে দেখা যায় যে ৫,০০,০০০ এর উপর শ্রমিক ৮ ঘন্টা দিবসের ধর্মঘটে সরাসরি অংশ নিয়েছে।

ধর্মঘটের কেন্দ্র ছিল শিকাগো, যেখানে ধর্মঘট ছিল সর্বাধিক বিস্তৃত, কিন্তু অন্য অনেক শহর ১লা মে নিয়ে সংগ্রামে জড়িত ছিল। নিউ ইয়র্ক, বাল্টিমোর, ওয়াশিংটন, মুলওয়াওকি, সিনসিনাতি, সেন্ট লুইস, পিটার্সবুর্গ, ডেট্রয়েট ও অন্য অনেক শহর ধর্মঘটে ভাল প্রদর্শন করেছিল। ধর্মঘট সংগ্রামের বিশিষ্ট দিক ছিল এই যে অদক্ষ ও অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগ্রামে শামিল করা হয়েছিল, আর সেসময় সহমর্মী ধর্মঘট ছিল ব্যাপক। দেশে বিরাট বিদ্রোহী উদ্দীপনা বিরাজিত ছিল, আর বুর্শোয়া ঐতিহাসিকরা বলে যে ধর্মঘটে “সামাজিক যুদ্ধ” ও “পুঁজির প্রতি ঘৃণা” প্রকাশিত হয়েছে আর আন্দোলনকে চালিত করেছে যে নেতাকর্মীদের উৎসাহ তার কথাও তারা বলেছে। হিসেব করে দেখা যায় যে মে দিন নিয়ে ধর্মঘটে অংশ নেয়া শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেক শ্রমিক সফল হয়েছিল, আর যেখানে তারা ৮ ঘন্টা দিবসের সফলতা পায়নি, তারা যথেষ্ট পরিমাণে শ্রমঘন্টা কমাতে সক্ষম হয়েছিল।

শিকাগো ধর্মঘট ও হে মার্কেট

১লা মে ধর্মঘট সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ছিল শিকাগোতে, যা সেসময় ছিল বামপন্থী জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্র। শ্রমিক আন্দোলনের বেশকিছু বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট পরিষ্কার না থাকা সত্ত্বেও তা ছিল এক লড়াকু আন্দোলন, সর্বদাই প্রস্তুত শ্রমিকদেরকে তৎপরটার ডাক দিতে ও তাদের লড়ার উদ্যম বিকশিত করতে, আর বেঁচে থাকার ও কাজের পরিস্থিতির আশু উন্নয়ন সাধনই নয় বরং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিলোপেরও লক্ষ্য ছিল তাদের।

বিপ্লবী শ্রমিক গ্রুপগুলির সাহায্যে শিকাগোর ধর্মঘট সর্বাধিক বড় আকার ধারণ করে। ধর্মঘটের প্রস্তুতির জন্য আগেই একটি ৮ ঘন্টা সংঘ গঠিত হল। বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়নগুলি নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন ৮ ঘন্টা সংঘকে পূর্ণ সমর্থন দেয় যা ছিল এক যুক্তফ্রন্ট সংগঠন যাতে ফেডারেশন, শ্রমিক সেনাপতি ও সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টির সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নসমূহ অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১লা মের আগের রোববার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন সমাবেশ মিছিল করে যাতে ২৫,০০০ শ্রমিক অংশ নিয়েছিল।

১লা মেতে শিকাগোতে দেখা গেল ব্যাপক শ্রমিক সমাবেশ যারা শহরের সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের ডাকে কাজ বন্ধ রেখেছেন। শ্রমিক আন্দোলনের আজ পর্যন্ত অভিজ্ঞতায় এ ছিল শ্রেণীসংহতির সবচেয়ে কার্যকর প্রদর্শন। সেসময়ের দবি ৮ ঘন্টা দিবস-এর গুরুত্ব আর ধর্মঘটের পরিসর ও চরিত্র আন্দোলনকে তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক মর্যাদা দিয়েছে। ১লা মে ১৮৮৬ সালের ধর্মঘটে প্রকাশিত ৮ ঘন্টা আন্দোলন আমেরিকার শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্বল অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু বিপ্লবের সাথেই আসে প্রতিবিপ্লব যতক্ষণ না বিপ্লবী শ্রেণী চূড়ান্তভাবে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। শিকাগোর শ্রমিকদের বিজয় মিছিল পুঁজিপতি ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের তুলনামূলক উন্নত যৌথ বাহিনীর ঘেরাওয়ে পড়ে। জঙ্গী নেতাদের ধ্বংস করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ওদের আশা ছিল এভাবে শিকাগোর সমগ্র শ্রমিক আন্দোলনে মারাত্মক আঘাত হানা যাবে। ৩রা ও ৪ঠা মের ঘটনাবলী যা হে মার্কেট ঘটনা

১৫ মে ১৮৮৬ সাপ্তাহিক হারপার প্রকাশিত সেবছর ৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর হে মার্কেটের ঘটনার ছবি

১৫ মে ১৮৮৬ সাপ্তাহিক হারপার প্রকাশিত সেবছর ৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর হে মার্কেটের ঘটনার ছবি

নামে পরিচিত ঘটনার জন্ম দিয়েছে, ছিল ১লা মে ধর্মঘটের সরাসরি পরিণাম। ৪ঠা মে হে মার্কেটে সমাবেশ ডাকা হয়েছে ৩রা মে ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কসের ধর্মঘটী শ্রমিকদের ওপর পুলিশের পাশবিক হানা ও ৬ শ্রমিক হত্যা ও অসংখ্য আহত করার প্রতিবাদে। সভা ছিল শান্তিপূর্ণ আর শেষের দিকে, তখন পুলিশ উপস্থিত শ্রমিকদের ওপর আবারো আক্রমণ পরিচালনা করে। ভীড়ের মধ্যে একটি বোমা ফেলা হয় যাতে একজন সার্জেন্ট মারা গেল। একটা যুদ্ধ বেঁধে গেল যাতে সাত পুলিশ ও চার শ্রমিক মারা গেল। হে মার্কেট স্কোয়ারের রক্তস্নান, পার্সন্স, স্পাইস, ফিশার ও এঞ্জেলকে রেলপথে ফাঁসি দেয়ার জন্য পাঠানো আর অন্যান্য জঙ্গী শিকাগো নেতাকে জেলে পাঠানো  ছিল শিকাগো মালিকদের প্রতিবিপ্লবী জবাব। এটা সারা দেশে মালিকদের কর্মকান্ডের বার্তা দিল। ১৮৮৬ সালের দ্বিতিয়ার্ধ চিহ্নিত ছিল ১৮৮৫-৮৬ ধর্মঘট আন্দোলনে হারানো অবস্থান ফিরে পেতে মরিয়া পুঁজিপতিদের পুঞ্জীভূত আক্রমণাভিযানের দ্বারা।

শিকাগোর শ্রমিক নেতাদের ফাঁসি দেয়ার এক বছর পর ফেডারেশন, যা এখন আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশন নামে পরিচিত, ১৮৮৮ সালে সেন্ট লুইসে তার সম্মেলনে ৮ ঘন্টা দিবসের জন্য আন্দোলনকে

হে মার্কেট ঘটনায় স্পাইস, ফিশার, এঞ্জেল, স্পার্সন, লিঙ, সোয়াব ও ফিল্ডেনকে প্রতিক্রিয়াশীল মার্কিন রাষ্ট্রীয় আদালত মৃত্যুদন্ড দেয়। নিবে (অনুপস্থিত, এখানে ছবিতে নেই)-কে ১৫ বছেরের জেল দেয়।

হে মার্কেট ঘটনায় স্পাইস, ফিশার, এঞ্জেল, পার্সন্স, লিঙ, সোয়াব ও ফিল্ডেনকে প্রতিক্রিয়াশীল মার্কিন রাষ্ট্রীয় আদালত মৃত্যুদন্ড দেয়। নিবে (অনুপস্থিত, এখানে ছবিতে নেই)-কে ১৫ বছেরের জেল দেয়।

পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ভোট দেয়। ৮ ঘন্টা দিবসের সংগ্রামকে পুনরুজ্জীবিত করতে পুনরায় ১লা মেকেই বেছে নেয়া হয় যা ইতিমধ্যেই একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, এক রাজনৈতিক শ্রেণী ইস্যুর ভিত্তিতে বিগত দুই বছরে শ্রমিকদের শক্তিমত্ত আন্দোলনের সমাবেশকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ছোটতর কর্মদিবসের দাবিতে ১৮৯০ সালের ১লা মেতে দেশব্যাপী ধর্মঘট সংঘটিত হয়। ১৮৮৯ সালের সম্মেলনে স্যামুয়েল গম্পার্সের নেতৃত্বে আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা ধর্মঘট আন্দোলনকে সীমিত করায় সফল হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে ধর্মঘটের জন্য সবচেয়ে প্রস্তুত যে কাঠমিস্ত্রিদের ইউনিয়ন, তারাই ধর্মঘট সূচনা করবে, আর এটা যদি সফল প্রমাণিত হয়, অন্য ইউনিয়নগুলিও তাকে অনুসরণ করবে।

নিজ আত্মজীবনীতে গম্পারস বলেছেন কীভাবে আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশন মে দিবসকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ছুটির দিন প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেঃ “৮ ঘন্টা আন্দোলনের পরিকল্পনা এগিয়ে যাওয়ার সাথে, আমরা অব্যাহতভাবে উপলব্ধি করি যে কীভাবে আমাদের উদ্দেশ্যকে ব্যাপকতর করতে পারি। প্যারিসে যখন শ্রমজীবি মানুষের আন্তর্জাতিক কংগ্রেস আসল, আমার কাছে মনে হল এই কংগ্রেস থেকে বিশ্বব্যাপী সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে আমরা আমাদের আন্দোলনকে সাহায্য করতে পারি।” গম্পার্স, যে কিনা ইতিমধ্যেই সংস্কারবাদ ও সুবিধাবাদের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করেছিলেন যা পরে তার শ্রেণী সহযোগিতা কর্মনীতিতে পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়, শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলনের সমর্থন পেতে প্রস্তুত ছিলেন, যে প্রভাবকে তিনি প্রচন্ডভাবে বিরোধিতা করেছিলেন।

মে দিবস আন্তর্জাতিক হল

১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিলের পতনের শত বার্ষিকীতে বহু দেশের সংগঠিত বিপ্লবী সর্বহারা আন্দোলনের নেতারা প্যারিসে সমাবেশিত হয়ে আবারো শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন গঠন করলেন ২৫ বছর আগে মহান শিক্ষক কার্ল মার্কসের গড়ে তোলা সংগঠনের একই আঙ্গিকে। যা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে পরিণত হতে যাচ্ছে সেই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা সভায় সমবেত সকলে আমেরিকান প্রতিনিধিদের কাছে আমেরিকায় ১৮৮৪-৮৬তে ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের জন্য সংগ্রাম আর আন্দোলনের সাম্প্রতিক পুনরুজ্জীবনের কথা শুনেছেন। আমেরিকান শ্রমিকদের উদাহারণে অনুপ্রাণিত হয়ে প্যারিস কংগ্রেস নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেঃ

কংগ্রেস এক বিরাট আন্তর্জাতিক সভা সমাবেশ আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাতে সকল দেশে সকল শহরে একই দিনে নিপীড়িত জনগণ রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করবে শ্রমদিবসের বৈধ সীমিতকরণ ৮ ঘন্টা করার, সেই সাথে প্যারিস কংগ্রেসের অন্যান্য সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করবে। যেহেতু ১লা মে ১৮৯০ একই রকম সভাসমাবেশ আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকান শ্রমিক

১৮৯০ সালে শিকাগোর শ্রমিকরা ১ম আন্তর্জাতিক মে দিবসে প্যারেড করছেন

১৮৯০ সালে শিকাগোর শ্রমিকরা ১ম আন্তর্জাতিক মে দিবসে প্যারেড করছেন

ফেডারেশন সেন্ট লুইসের সম্মেলনে ১৮৮৮ সালের ডিসেম্বরে, এই দিন আন্তর্জাতিক সভা-সমাবেশের দিন হিসেবে গৃহীত হল। বিভিন্ন দেশের শ্রমিকরা নিজ নিজ দেশের পরিস্থিতি অনুসারে এই মিছিলসভাসমাবেশ করবেন।

সিদ্ধান্তের যে অনুচ্ছেদ নিজ দেশের পরিস্থিতি অনুসারে সমাবেশ করার কথা বলে, তার থেকে কোন কোন পার্টি যেমন বৃটিশ আন্দোলন সুযোগ নেয় সিদ্ধান্তকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে যেন এটা সকল দেশের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তাই, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক গঠনের একেবারে শুরুতেই এমন সব পার্টি ছিল যারা একে স্রেফ পরামর্শ সংস্থা হিসেবে দেখেছে, যা কেবল কংগ্রেসে সময় কার্যকর তথ্য ও মত আদানপ্রদানের জন্য, এক প্রজন্ম আগে যেমনটা মার্কস প্রথম আন্তর্জাতিককে তৈরি করতে চেয়েছিলেন তেমন কেন্দ্রীভূত সংগঠন আর এক বিপ্লবী বিশ্ব সর্বহারা পার্টি হিসেবে নয়। ১৮৭৪ সালে আমেরিকায় প্রথম আন্তর্জাতিক আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যাওয়ার আগে যখন এঙ্গেলস বন্ধু জর্গেকে লেখেন “আমার মনে হয় পরবর্তী আন্তর্জাতিক মার্কসের শিক্ষার ভিত্তিতে গঠিত হয়ে সামনের বছরগুলিতে ব্যাপকভাবে পরিচিত হবে, তা হবে একটি খাঁটি সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক”, তিনি দেখতে পাননি যে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিকে যাত্রার শুরুতেই সংস্কারবাদী উপাদান উপস্থিত থাকবে যারা একে সমাজতান্ত্রিক পার্টিসমূহের স্বেচ্ছায় একত্রিত ফেডারেশন হিসেবে দেখে, একে অপরের থেকে স্বাধীন, আর প্রত্যেকে নিজস্ব আইনে চলে।

কিন্তু মে দিবস অনেক ইউরোপীয় দেশে পালিত হল, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাঠমিস্ত্রিদের ইউনিয়ন ও অন্যান্য ইমারত কর্ম ৮ ঘন্টা দিবসের জন্য একটি সাধারণ ধর্মঘটে প্রবেশ করল। সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যতিক্রম আইন থাকা সত্ত্বেও, জার্মানীর বিভিন্ন শিল্প শহরে শ্রমিকরা মে দিবস উদযাপন করে যা পুলিশের সাথে প্রচণ্ড লড়াই দ্বারা চিহ্নিত ছিল। একইভাবে অন্যান্য ইউরোপী রাজধানীগুলিতেও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়, যদিও কর্তৃপক্ষ তাদেরকে সতর্ক করেছিল আর পুলিশ তাদের দমন করার চেষ্টা করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো ও নিউইয়র্কের বিক্ষোভ ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ৮ ঘন্টা দাবির সমর্থনে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে মিছিল করেছে; বিক্ষোভগুলি কেন্দ্রীয় স্থানগুলিতে বিরাট উন্মুক্ত জনসভার মাধ্যমে শেষ হয়।

১৮৯১ সালে ব্রাসেলসে পরবর্তী কংগ্রেসে আন্তর্জাতিক ১লা মের মূল উদ্দেশ্য পুনর্ব্যক্ত করেঃ ৮ ঘন্টা দিবসের দাবি, কিন্তু যোগ করে যে কাজের পরিস্থিতি উন্নত করা ও জাতিসমূহের মধ্যে শান্তি নিশ্চিত করার দাবি সহকারে এই মিছিল-সমাবেশ করতে হবে। সংশোধিত সিদ্ধান্ত বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলে যে ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের জন্য “১লা মে বিক্ষোভ সমাবেশের শ্রেণীচরিত্র” ও অন্যান্য দাবিসমূহ “শ্রেণীসংগ্রামকে গভীরতর করবে”। সিদ্ধান্ত আরো দাবি করে যে “যেখানেই সম্ভব” কাজ বন্ধ করতে হবে। যদিও ১লা মের ধর্মঘট করাটা পরিস্থিতি সাপেক্ষে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ সমাবেশগুলির উদ্দেশ্যকে বর্ধিত ও মূর্ত করতে শুরু করল। বৃটিশ শ্রমিক দল পুনরায় ১লা মেতে এমনকি পরিস্থিতি সাপেক্ষে ধর্মঘটের প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাল আর জার্মান সমাজগণতন্ত্রীদের সাথে মিলে ১লা মের পরের রবিবার পর্যন্ত সভাসমাবেশ স্থগিত করতে ভোট দিল।

আন্তর্জাতিক মে দিবস সম্পর্কে এঙ্গেলস

১৮৯০ সালের ১লা মে এঙ্গেলস সাম্যবাদী ইশতেহারের ৪র্থ জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় ইতিহাসকে মূল্যায়ন করে প্রথম আন্তর্জাতিক মে দিবসের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেনঃ

আজকে আমি যখন এই লাইনগুলি লিখছি, ইউরোপীয় ও আমেরিকান সর্বহারাশ্রেণী তার যুদ্ধ ক্ষমতা বিচার করে দেখছে, প্রথমবারের মত তারা সমাবেশিত, সমাবেশিত একটি একক বাহিনী হিসেবে, একটি একক পতাকার নীচে, একটি আশু লক্ষ্যেঃ আটঘন্টা কর্মদিবসের আইন পাশ করে তা চালু করা। আর আজকের দিনের দৃশ্য দুনিয়ার সকল পুঁজিবাদী ও ভূস্বামীদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে যে সত্যিই সকল দেশের শ্রমিকরা এক হয়েছে। আমার পাশে থেকে এটা দেখার জন্য মার্কস যদি আজকে জীবিত থাকতেন!                                     

আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণীর যুগপৎ সভা সমাবেশ মিছিলের তাৎপর্য সারা দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর কল্পনা ও বিপ্লবী উদ্দীপনার কাছে ক্রমাগত বেশি বেশি আকর্ষণ করছিল, আর প্রতিটা বছর বিক্ষোভে আরো ব্যাপকতর জনগণ অংশ নিচ্ছিলেন।

১৮৯৩ সালে জুরিখে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিকের পরবর্তী কংগ্রেসে ১লা মে সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের সংযোজনে মে দিবসে শ্রমিকদের সাড়া প্রতিফলিত হয়ঃ

৮ ঘন্টা দিবসের জন্য ১লা মের মিছিল-সমাবেশকে একই সময় শ্রমিকদের বিক্ষোভ, আর সেই সাথে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য শ্রেণী পার্থক্য ধ্বংস করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাকে সেবা করতে হবে, এভাবে তারা সেই পথে এসে দাঁড়াবেন, একমাত্র যে পথ সকল জনগণের জন্য শান্তির দিকে নিয়ে যাবে, আন্তর্জাতিক শান্তির দিকে।

যদিও সিদ্ধান্তের মূল খসড়া প্রস্তাব করেছিল “সামাজিক বিপ্লব”-এর দ্বারা শ্রেণী পার্থক্য দূর করা, “সামাজিক পরিবর্তন”-এর দ্বারা নয়, তথাপি সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবে ১লা মেকে উচ্চতর রাজনৈতিক স্তরে উন্নীত করেছেঃ ৮ঘন্টা দিবসের দাবির সহযোগে সর্বহারা শ্রেণীর শক্তিমত্ত ও ইচ্ছাশক্তির প্রদর্শনের দ্বারা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে।

সংস্কারবাদীরা মে দিবসকে পঙ্গু করার প্রচেষ্টা চালায়

বেশ কিছু পার্টির সংস্কারবাদী নেতারা মে দিবসের বিক্ষোভসমাবেশকে দূর্বল করার প্রচেষ্টা চালায় তাকে সংগ্রামের দিবসের বদলে বিশ্রাম ও চিত্তবিনোদনের দিন বানানোর মাধ্যমে। সর্বদাই তাই তারা মে দিবসের কাছাকাছি রোববারে বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজনের জিদ ধরে। রোববার কাজ বন্ধ করার জন্য ধর্মঘটের দরকার পড়বেনা শ্রমিকদের। এটা এমনিতেই ছুটির দিন। সংস্কারবাদী নেতাদের কাছে মে দিবস ছিল কেবল এক আন্তর্জাতিক ছুটির দিন, উদ্যানে অথবা গ্রামে খেলাধূলা বা বেড়ানোর দিন। জুরিখ কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত যে দাবি করল মে দিবসকে  “শ্রেণীপার্থক্য দূর করতে শ্রমিকশ্রেনীর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইচ্ছা” অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শোষণ ও শ্রম দাসত্বের ধ্বংসের জন্য ইচ্ছাশক্তির প্রদর্শন হতে, সংস্কারবাদীদের তা কোন সমস্যা করলনা, কারণ তারা আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য বলে নিজেদের মনে করলনা। যুদ্ধের আগে বহু ইউরোপীয় শহরে প্রায়ই যে অন্য অনেক কংগ্রেস হত তার মত তারা সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেসকে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব ও সদিচ্ছার সভা বলে মনে করেছিল। তারা সর্বহারাশ্রেণীর আন্তর্জাতিক যৌথ তৎপরতাকে নিরুৎসাহিত ও ব্যর্থ করার জন্য সবকিছু করে এবং আন্তর্জাতিকের কংগ্রেসসমূহের সিদ্ধান্তবলী যা তাদের চিন্তার সাথে মেলেনা তা তাদের কাছে হয়ে রইল স্রেফ কাগুজে সিদ্ধান্ত। বিশ বছর পর এই সংস্কারবাদী নেতাদের “সমাজতন্ত্র” ও “আন্তর্জাতিকতাবাদ” তাদের সকল নগ্নতায় উন্মোচিত হয়েছে। ১৯১৪ সালে আন্তর্জাতিক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কারণ তার জন্ম থেকেই সে তার নিজের ধ্বংসের বীজ বহন করছিলঃ শ্রমিকশ্রেণীর সংস্কারবাদী ভ্রান্ত নেতারা।

১৯০০ সালে প্যারিসের আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে আগের কংগ্রেসগুলির মে দিবসের সিদ্ধান্তবলী পুনরায় গৃহীত হল আর সেগুলো এই বিবৃতিতে আরো শক্তিশালি হল যে ১লা মেতে কাজ বন্ধ করা বিক্ষোভসমাবেশকে আরো কার্যকর করবে। মে দিবসের বিক্ষোভসমাবেশ অধিক থেকে অধিকতরভাবে শক্তির প্রদর্শন হয়ে উঠছিল; সকল গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্রগুলিতে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাথে প্রকাশ্যে রাস্তার লড়াই চলতে থাকল। ঐ দিন বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করা ও কাজ বন্ধ করা শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছিল। এটি লাল দিবসে পরিণত হয়েছিল, প্রতিটি মেদিন যখন আসে, সমস্ত দেশের কর্তৃপক্ষ ভাবে এই যে সামনে অমঙ্গলের দিন আসছে।

মে দিবস সম্পর্কে লেনিন

রুশ বিপ্লবী আন্দোলনে তাঁর প্রথম দিককার তৎপরতার সময় লেনিন মে দিবসকে রুশ শ্রমিকদের কাছে পরিচিত করেন বিক্ষোভ ও সংগ্রামের দিন হিসেবে। সেন্ট পিটার্সবুর্গ শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তির জন্য সংগ্রামের ইউনিয়ন ছিল রাশিয়ার অন্যতম প্রথম মার্কসবাদী রাজনৈতিক গ্রুপ। জেলে থাকার সময় ১৮৯৬ সালে লেনিন এই গ্রুপের জন্য মে দিবসের প্রচারপত্র লেখেন। প্রচারপত্রটি জেলের বাইরে পার করে ২০০০ কপি ৪০টি কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে বন্টন করা হয়। এটা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত আর লিখিত হয়েছিল সহজ সরল ও প্রত্যক্ষ রীতিতে, যাতে শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে কম বিকশিতও সহজে বুঝতে পারে। প্রচারপত্রটি প্রচারের সাথে জড়িত সেসময়কার একজন লিখেছেন, “১৮৯৬ সালের বিখ্যাত বস্ত্রকল ধর্মঘট হওয়ার এক মাস পর শ্রমিকরা আমাদের বলছিলেন যে ক্ষুদ্র সহজ সরল মে দিবসের প্রচারপত্রটি প্রথম প্রেরণ দিয়েছিল।”

শ্রমিকরা কর্মস্থলে কীভাবে মালিকের মুনাফার জন্য শোষিত হয়, যারা তাদের কাজের পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য কাজ করত কীভাবে সরকার তাদের নির্যাতন করে, শ্রমিকদের একথা বলার পর লেনিন মে দিবসের তাৎপর্য সম্পর্কে লেখেনঃ

ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানী ও অপরাপর দেশে যেখানে শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই শক্তিশালি ইউনিয়নে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, নিজেদের জন্য অনেক অধিকার তারা জয় করেছে, তারা ১৯শে এপ্রিল (১লা মে)[রুশ বর্ষপঞ্জী পশ্চিমা-ইউরোপীয় বর্ষপঞ্জীর চেয়ে ১৩ দিন পিছিয়ে] সংগঠিত হয়। তারা একে বানিয়েছে শ্রমিকদের একটি সাধারণ ছুটির দিন। দমবন্ধ কারখানা থেকে বেড়িয়ে তারা মিছিল করে উন্মুক্ত পতাকা হাতে সঙ্গীতের তালে শহরের প্রধান রাস্তায়, তাদের কর্তাদের দেখায় তাদের অব্যাহতভাবে বাড়ন্ত শক্তি। তারা বিরাট বিক্ষোভসমাবেশে বিগত সালে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের বিজয়কে স্মরণ করে বক্তৃতা দেয়, আর ভবিষ্যতের সংগ্রামের জন্য পরিকল্পনা করে। ধর্মঘটের ভয়ে কর্তারা কারখানায় উপস্থিত না থাকার জন্য শ্রমিকদের জরিমানা করেনা। সেইদিন শ্রমিকরা কর্তাদের প্রধান দাবি স্মরণ করিয়ে দেয়ঃ ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘন্টা বিনোদন। এটাই অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা এখন দাবি করছেন।

রুশ বিপ্লবী আন্দোলন মে দিবসকে দারুণভাবে কাজে লাগায়। ১৯০০ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে “খারকভে মে দিবস”-এর ভূমিকায় লেনিন লেখেনঃ

আরো ছয়মাসের মধ্যে রুশ শ্রমিকরা নতুন শতাব্দীর প্রথম মে দিবস উদযাপন করবে, আর এটাই সময় যখন আমাদের যতটা সম্ভব বেশি সংখ্যায় সমাবেশ করতে হবে কেন্দ্রসমূহে, যতটা সম্ভব গুণগত মান আরোপ করতে হবে, সংখ্যার দিক থেকে শুধু নয়, তাদের সংগঠিত চরিত্রের দ্বারাও, যে শ্রেণীসচেতনতা তারা প্রকাশ করবে তার দ্বারা, রুশ জনগণের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য অদম্য সংগ্রাম চালানোর তাদের দৃঢ়সংকল্প দ্বারা, আর পরিণামে সর্বহারাশ্রেণীর শ্রেণী বিকাশের ও সমাজতন্ত্রের জন্য তার প্রকাশ্য সংগ্রামের জন্য মুক্ত সুবিধা নিয়ে আসতে।

লেনিন মে দিবসের বিক্ষোভকে কত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন তা দেখা যায় যখন তিনি ছয়মাস আগেই শ্রমিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তার কাছে মে দিবস ছিল “সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেণীগত বিকাশ আর সমাজতন্ত্রের জন্য তার প্রকাশ্য সংগ্রাম”-এর জন্য “রুশ জনগণের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য অদম্য সংগ্রাম”-এর সমাবেশ কেন্দ্র।

মে দিবসের উদযাপন কীভাবে “বিরাট রাজনৈতিক বিক্ষোভে পরিণত হতে পারে” একথা বলতে গিয়ে লেনিন প্রশ্ন করেন কেন ১৯০০ সালে খারকভ মে দিবস উদযাপন হবে “মহা গুরুত্বের একটি ঘটনা”, তারপর তিনি উত্তরে বলেন, “ধর্মঘটে শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, রাস্তায় ব্যাপক গণ সভাসমাবেশ, লাল পতাকা উড়ানো, দাবিদাওয়া প্রচারপত্রে উপস্থাপন এবং এসকল দাবির বিপ্লবী চরিত্রঃ আটঘন্টা দিবস ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা”

লেনিন খারকভে পার্টি নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তারা ৮ ঘন্টা দিনের দাবি অন্যান্য ছোটখাট ও সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক দাবির সাথে যুক্ত করেছেন বলে, কারণ তিনি চাননা যে মে দিবসের রাজনৈতিক চরিত্র ধামাচাপা পড়ুক। তিনি এই ভূমিকায় লেখেনঃ

এই দাবিগুলির মধ্যে প্রথমটি (আট ঘন্টা দিবস) সকল দেশের সর্বহারা শ্রেণীর দ্বারা উত্থাপিত সাধারণ দাবি। এই দাবিকে তুলে ধরে খারকভের অগ্রসর শ্রমিকরা আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক আন্দোলনের সাথে তাদের সংহতি প্রকাশ করেন। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে এই কারণেই এ ধরণের একটি দাবিকে সর্দারদের ভাল আচরণ করা, মজুরির শতকরা দশভাগ বৃদ্ধির মত ছোটখাট দাবির ভেতর অন্তর্ভূক্ত করা উচিত নয়। আটঘন্টা দিবসের সংগ্রাম হচ্ছে সমগ্র সর্বহারাশ্রেণীর দাবি, স্বতন্ত্র মালিকদের কাছে নয়, বর্তমান দিনের সমগ্র সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের কাছে, সমগ্রভাবে পুঁজিপতি শ্রেনীর কাছে, যারা উৎপাদনের সকল উপায়ের মালিক।

মে দিবসের রাজনৈতিক শ্লোগান

মে দিবস আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণীর জন্য কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল। ৮ ঘন্টা দিবসের মূল দাবির সাথে অন্যান্য তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোগান যুক্ত করা হল যার উপর শ্রমিকদের তাদের মে দিবসের ধর্মঘট ও বিক্ষোভের সময় মনোনিবেশ করতে আহবান জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছেঃ আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর সংহতি, সার্বজনীন ভোটাধিকার, যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, উপনিবেশিক নিপীড়ণের বিরুদ্ধে, রাস্তায় তৎপরতার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি, শ্রমিকশেণীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন করার অধিকার। সর্বশেষ পুরোনো আন্তর্জাতিক মে দিবস নিয়ে কথা বলে ১৯০৭ সালে আমস্টার্ডাম কংগ্রেসে। বিক্ষোভে যে সকল রাজনৈতিক শ্লোগান দেয়া হয়েছে তার মূল্যায়ন করে, আর এই বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে কিছু দেশে মে দিবসের পরিবর্তে রবিবারে এই বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত উপসংহার টানেঃ

“আমস্টারডামে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেস সকল দেশের সকল সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টি সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নকে ৮ ঘন্টা দিবসের আইনি প্রতিষ্ঠার জন্য, সর্বহারাশ্রেণীর শ্রেণী দাবিতে ও সার্বজনীন শান্তির জন্য সজীবতার সাথে বিক্ষোভ করার ডাক দিচ্ছে। ১লা মেতে সর্বাধিক কার্যকর পদ্ধতির বিক্ষোভ হল কাজ বন্ধ করা। তাই কংগ্রেস ডাক দিচ্ছে সকল দেশের সর্বহারা সংগঠনকে বাধ্যতামূলকভাবে ১লা মেতে কাজ বন্ধ করতে হবে যেখানেই সম্ভব, শ্রমিকদের ক্ষতি না করে।

যখন ১৯১২ সালের এপ্রিলে সাইবেরিয়ার লেনা স্বর্ণখনি অঞ্চলে ধর্মঘটীদের উপর গণহত্যা চলল, রাশিয়ার বাস্তবতায় সর্বহারার গণ কর্মকান্ড নিয়ে আবারো প্রশ্ন উঠল, সেই বছরই মে দিবসে লক্ষ লক্ষ রুশ শ্রমিক কাজ বন্ধ করল, রাস্তায় নেমে এল ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লবে পরাজয়ের পর শাসক কালো প্রতিক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানাতে।

লেনিন লেখেন, সারা রাশিয়া জুড়ে শ্রমিকদের মহান মে ধর্মঘট, এর সাথে যুক্ত রাস্তার বিক্ষোভ, বিপ্লবী ঘোষণা আর শ্রমজীবি জনগণের উদ্দেশ্যে বিপ্লবী বক্তৃতাগুলি স্পষ্টভাবে দেখায় যে রাশিয়া আবারো উদীয়মান বিপ্লবী পরিস্থিতিতে প্রবেশ করেছে।    

মে দিবস সম্পর্কে রোজা লুক্সেমবার্গ

১৯১৩ সালে মে দিবসের জন্য লিখিত এক নিবন্ধে কট্রর বিপ্লবী রোজা লুক্সেমবার্গ মে দিবসের বিপ্লবী চরিত্রের উপর জোর দেনঃ

“মে দিবসের উদযাপনের প্রতিভাদীপ্ত প্রধান ধারণা হল সর্বহারা জনগণের স্বাধীন কর্মতৎপরতা, লক্ষ কোটি শ্রমিকের রাজনৈতিক গণতৎপরতা…। আন্তর্জাতিকের কংগ্রেসে ফরাসি লেভিনের চমৎকার উদ্দেশ্য ছিল প্রত্যক্ষ আন্তর্জাতিক গণসমাবেশ, কাজ বন্ধ করা, ৮ ঘন্টা দিবস, বিশ্ব শান্তি ও সমাজতন্ত্রের জন্য বিক্ষোভ ও লড়াইয়ের রণকৌশল।”

সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার একজন মনোযোগী ছাত্র রোজা লুক্সেমবার্গ উপলব্ধি করেন যে যুদ্ধ আসছে, আর তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন, তাই পরিষ্কার করেন যে মে দিবস ছিল বিশেষত শ্রমিকদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংহতি প্রচারের দিন, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক তৎপরতার দিন। যুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে তিনি মনোযোগ আকর্ষণ করে লেখেনঃ

“আমরা যত মে দিবসের ভাবধারা, আন্তর্জাতিক সংহতির জন্য সমাবেশ হিসেবে আর শান্তি ও সমাজতন্ত্রের রণকৌশলের গণতৎপরতার ভাবধারা হিসেবে, এমনকি আন্তর্জাতিকের সবচেয়ে শক্তিশালি অংশ জার্মান শ্রমিকশ্রেণী যত মূলে আঘাত করব, আমাদের বৃহত্তর নিশ্চয়তা থাকবে, যে যুদ্ধ অনিবার্যভাবে আজ অথবা কাল আসছে তাতে বিশ্ব শ্রম ও পুঁজির মধ্যে সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে পারব।”

 যুদ্ধের সময় মে দিবস

১৯১৫ সালের মে দিবসে যুদ্ধের সময় সামাজিক দেশপ্রেমিকদের বিশ্বাসঘাতকতা দুঃসাহসী শ্বস্তির রূপ নিয়ে আবির্ভূত হল। আগস্ট ১৯১৪তে তারা সাম্রাজ্যবাদী সরকারগুলির সাথে যে শ্রেণীশান্তি পাতিয়েছিল তার যৌক্তিক পরিণাম হল এটি। জার্মান সমাজগণতন্ত্রীরা শ্রমিকদের কাজ বজায় রাখতে ডাক দিল, ফরাসি সমাজতন্ত্রীরা এক বিশেষ ইশতেহারে কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করল যে তাদের মে দিবস নিয়ে ভয়ের কিছু নেই আর শ্রমিকদের অনুরোধ করা হয়েছে “তাদের” দেশের প্রতিরক্ষার জন্য যাতে তারা কাজ করে। একই দৃষ্টিভঙ্গী দেখা যাবে অন্যান্য যুদ্ধরত দেশগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজতন্ত্রীদের মধ্যেও। কেবলমাত্র রাশিয়ার বলশেভিকরা আর অন্যান্য দেশের বিপ্লবী সংখ্যালঘুরা সমাজতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি সত্য থেকেছে। লেনিন, লুক্সেমবার্গ ও লিবনেখট-এর আওয়াজ উঠেছিল সামাজিক জাতিদম্ভীদের লাম্পট্যের বিরুদ্ধে। ১৯১৬ সালে মে দিবসের আংশিক ধর্মঘট ও প্রকাশ্য রাস্তার লড়াই দেখায় যে যুদ্ধরত দেশগুলির শ্রমিকরা তাদের বিশ্বাসঘাতক নেতাদের বিষাক্ত প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করছিল। লেনিনের কাছে, অন্যান্য বিপ্লববাদীদের মত “সুবিধাবাদের ধ্বংস (দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পতন—লেখক) শ্রমিক আন্দোলনের কাছে লাভজনক” এবং বিশ্বাসঘাতকমুক্ত নতুন আন্তর্জাতিকের জন্য লেনিনের ডাক ছিল সেই সময়ের দাবি।

জিমেরোয়াল্ড (১৯১৫) সম্মেলন ও কিয়েন্থাল (১৯১৬) সম্মেলন বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী পার্টি ও সংখ্যালঘুদেরকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে শ্রেণীযুদ্ধে রূপ দেয়ার লেনিনের শ্লোগানে অধীনে ঐক্যবদ্ধ করল। বার্লিনে ১৯১৬ সালে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কার্ল লিবনেখট ও তার অনুসারীদের বিপুল মে দিবস মিছিলসমাবেশ শ্রমিকশ্রেণীর জীবন্ত শক্তির স্বাক্ষ্য দেয় যা পুলিশি নিষেধাজ্ঞা ও আনুষ্ঠানিক নেতৃত্বের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাঁধা ভেঙে ফেলে।

১৯১৭ সালে যুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মে দিবসকে ত্যাগ করা হয়নি। সমাজতান্ত্রিক পার্টির মধ্যকার বিপ্লবী উপাদানেরা পার্টির যুদ্ধবিরোধী সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব সহকারে নেন যা পার্টি এপ্রিলের শুরুতে সেন্ট লুইস সম্মেলনে গ্রহণ করে, আর মে দিবসকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভসমাবেশ করতে ব্যবহার করে। ক্লীভল্যান্ডে পাবলিক স্কোয়ারে যে বিক্ষোভসমাবেশ হয়েছিল তা ছিল বিশেষত জঙ্গী, আর তা সংগঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক পার্টির স্থানীয় সম্পাদক চার্লস রুথেনবার্গ কর্তৃক, যিনি পরে সাম্যবাদী পার্টির একজন প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা ছিলেন। ২০,০০০-এর বেশি শ্রমিক প্যারেড করে পাবলিক স্কোয়ারে যায়, সেখানে তাদের সাথে আরো বহু সহস্র শ্রমিক মিলিত হয়। পুলিশ পাশবিকভাবে সভায় আক্রমণ চালায়, একজন শ্রমিককে হত্যা ও একজনকে মারাত্মকভাবে জখম করে।

১৯১৭র মেদিবস, জুলাই দিনগুলি এবং চূড়ান্তভাবে অক্টোবরের দিনগুলি রাশিয়াতে ছিল রুশ বিপ্লবের বিকাশের স্তরসমূহ থেকে সম্পাদন। মে দিবস অন্য দিবসগুলির সাথে বিপ্লবী ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ—২২শে জানুয়ারি (রক্তাক্ত রবিবার, ১৯০৫), ১৮ মার্চ (প্যারিস কমিউন, ১৮৭১), ৭ নভেম্বর (ক্ষমতা দখল, ১৯১৭) এইসব দিন আজকে প্রথম শ্রমিক প্রজাতন্ত্রে ছুটির দিন, যেখানে মে দিবসের মূল দাবি ৮ ঘন্টা দিবস সোভিয়েত ইউনিয়নে ৭ ঘন্টা দিবসের সূচনা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

কমিন্টার্ন মে দিবসের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে

মার্কস ও এঙ্গেলস যখন ১৮৪৮ সালে সাম্যবাদী ইশতেহার প্রকাশ করেন, তখন থেকে বিপ্লবী সর্বহারা আন্দোলনের শ্রেষ্ঠতম ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক মে দিবসের উত্তরাধিকার বহন করছে, আর বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশের সাম্যবাদী পার্টিসমূহ প্রতি বছর শ্রমিকদের মে দিবসে কাজ বন্ধ করার ডাক দেয়, রাস্তায় নামার, তাদের বাড়ন্ত শক্তি ও আন্তর্জাতিক সংহতি প্রদর্শন করার, অপেক্ষাকৃত ছোট কর্মদিবস দাবি করতে, যা আজকে ৭ ঘন্টা দিবস—মজুরীতে কাঁটছাট না করে, সামাজিক বীমা দাবি করে, যুদ্ধের বিপদকে লড়াই করা ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষা করা, সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশিক নিপীড়ণের বিরুদ্ধে লড়াই করা, বর্ণবৈষম্য ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে লড়াই করা, পুঁজিবাদী যন্ত্রের অংশ হিসেবে সামাজিক ফ্যাসিবাদীদের নিন্দা করা, নিজেদের বিপ্লবী ইউনিয়ন গড়ার প্রশ্ন সমাধা করা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ ও বিশ্ব সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত হতে নিজেদের সংকল্প ও লৌহকঠিন ইচ্ছাশক্তি প্রদর্শন করা।

মে দিবসে একটি রাজনৈতিক গণ ধর্মঘট

প্রতি বছর মে দিবসের সংগ্রামকে উচ্চতর স্তরে উন্নীত করা হয়। সাধারণ ধর্মঘট আন্দোলনের প্রসব বেদনা এবং এক প্রধান রাজনৈতিক দাবির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিয়ে প্রতিটি মে দিবসে উল্লেখিত আমেরিকান শ্রমিকদের প্রধান শ্রেণী ইস্যুকে নিয়ে রাজনৈতিক হরতাল হওয়া উচিত। প্রবীন ও নবীন শ্রমিক, নারীপুরুষ, কৃষ্ণাংগ ও শ্বেতাঙ্গ সবাইকে মে দিবসের তৎপরতায় টেনে আনতে হবে। মে দিবসে হরতাল হতে হবে কারণ কাজ বন্ধ করা মে দিবসের একটি রীতি। ধর্মঘট হতে হবে গণ ধর্মঘট যাতে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক সম্মিলিতভাবে কারখানা থেকে বেরিয়ে আসবে, ব্যক্তি হিসেবে নয়। সমগ্র শিল্প ইউনিট বন্ধ করে দিতে হবে,  কারণ এমন ধর্মঘটই হচ্ছে সংগ্রামের জন্য শ্রমিকদের দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ইচ্ছার কার্যকর প্রদর্শন। এই গণ ধর্মঘটগুলিকে হতে হবে রাজনৈতিক, অর্থাৎ প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুভিত্তিক যা সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীকে প্রভাবিত করে।

যদিও সাম্যবাদী পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন ঐক্য লীগের সাথে যুক্ত বিপ্লবী ইউনিয়নগুলি মজুরি না কমিয়ে ৭ ঘন্টা দিবসের শ্লোগান তুলে ধরেছে, আমেরিকান শ্রমিকদেরকে সাধারণ ৮ ঘন্টা দিবস আন্দোলনের সূচনার ৪৫ বছর পরে এখনো সেই দাবির জন্য লড়াই করতে হবে। অনেক শিল্প শ্রমিক এখনো দিনে নয়, দশ এমনকি আরো বেশি ঘন্টা কাজ করেন। এই সময়কালে ৮ ঘন্টা দিবস প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ শ্রমিক অভিজাতরা, যারা পুঁজিপতি শ্রেণীর ঘুষ খেয়ে অপেক্ষাকৃত উচ্চ মজুরী ও ভাল কাজের পরিস্থিতি পেয়ে অদক্ষ ও অসংগঠিত শ্রমিকদেরকে একটি সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রেখে ত্যাগ করেছে যাতে শিল্পের মালিকদের লাভের জন্য তারা আরো সহজেই শোষিত হতে পারে।

আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশন ফ্যাসিবাদী হল

৪০ বছর আগে নিউইয়র্কের ইউনিয়ন স্কোয়ারে ১ম মে দিবসের বিক্ষোভের নেতারা শুধু ৮ ঘন্টা দিবসের কথাই বলেননি, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিলোপের কথাও বলেছিলেন। “৮ ঘন্টা দিবসের জন্য সংগ্রামের সময় আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের কথা ভুলে গেলে চলবেনা যা হচ্ছে মজুরি প্রথার অবসান”, ১৮৯০ সালের ১লা মেতে ইউনিয়ন স্কোয়ারে সমবেত শহরের শ্রমিকশ্রেণী উত্তোলিত লাল পতাকার নীচে বিরাট কলামে এগিয়ে এসে ধর্মঘটি জনগণের কাছে তুলে ধরা সিদ্ধান্তে একথা বলে। এখন আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশন ও সমাজতন্ত্রী পার্টি কর্তাদের সাথে একাকার হয়ে গেছে, শ্রমিকদের জীবন উন্নত করার লড়াইকে প্রতিরোধ করতে যা করা সম্ভব করছে, আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের জন্য লড়ার বদলে তাকে রক্ষা করতে লড়ছে।

৪০ বছর আগে আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশন প্যারিসে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেসের কাছে আবেদন করেছিল যাতে তারা ১৮৯০ সালের ১লা মেতে আশ্রফেকে যেন সাহায্য করে, আন্তর্জাতিক আমেরিকান শ্রমিকদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে এই সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক বানিয়ে। এখন প্রেসিডেন্ট গ্রীন ও তার দালাল ম্যাথিউ ওল আশ্রফের প্রতি সমর্থন চাইছে প্রতিটি প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনের কাছে যারা গঠিত হয়েছে সেই সাম্যবাদী পার্টিকে মোকাবেলা করতে যে মে দিবসের আমেরিকান লড়ার ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিচ্ছে। আশ্রফে শ্রেণীসহযোগিতাবাদী থেকে প্রকাশ্য ফ্যাসিবাদীতে পরিণত হয়েছে আমেরিকান শ্রমিক শ্রেণীর জল্লাদ হিসেবে পুঁজিপতিদের সেবা করার মাধ্যমে।

মে দিবসকে পরাজিত করার প্রয়াসে আর তাদের প্রভাবাধীন শ্রমিক সংগঠনগুলোকে মে দিবসের বিক্ষোভে অংশ গ্রহণ থেকে দূরে টেনে আনার প্রয়াসে আশ্রফে ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শ্রমিক সংগঠনগুলো একটি তথাকথিত শ্রমিক দিবস পালনকে উৎসাহিত করেছে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর ১ম সোমবার। এই শ্রমিক দিবসটি প্রথম স্থানীয় পর্যায়ে গৃহীত হয় এবং পরবর্তীতে ১লা মে উদযাপনের প্রতিষেধক হিসেবে বিভিন্ন রাজ্য সরকার মঞ্জুর করে।

মে দিবসের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযান চালাচ্ছে ফেডারেল সরকার আশ্রফের নেতাদের সহায়তায় ১লা মেকে শিশু স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে গ্রহণ করে। সরকার ও আশ্রফের ভন্ডামী প্রমাণিত হয় এই বাস্তবতা থেকে যে ১০ লাখেরও বেশি ১৬ বছরের নীচের বয়সী শিশু আমেরিকান কলকারখানা, দোকান ও মাঠে ঘাম ঝড়াচ্ছে আমেরিকান পুঁজির গৌরবের জন্য। শিশু কল্যাণে এই আকস্মিক আগ্রহের প্রকৃত অর্থ, যাইহোক, ১৯২৮ সালের আশ্রফের সম্মেলনে নির্বাহী পরিষদের জমা দেওয়া প্রতিবেদন থেকে এই বিষয়ে উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়ঃ

“সাম্যবাদীরা এখনো ১লা মেকে শ্রমিক দিবস পালন করে। এরপর থেকে ১লা মে শিশুস্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পরিচিত হবে, কারণ কংগ্রেস একটি সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে প্রেসিডেন্টেকে নির্দেশ দিয়েছে ১লা মেকে শিশুস্বাস্থ্য দিবস হিসেবে উদযাপন করতে জনগনের প্রতি ডাক দিতে। এর উদ্দেশ্য শিশুদের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার জন্য বর্ষব্যাপী মানসিকতা তৈরি করা। এটা সবচেয়ে মূল্যবাণ উদ্দেশ্য। সেইসাথে ১লা মে আর ধর্মঘট দিবস বা সাম্যবাদী শ্রমিক দিবস হিসেবে পরিচিত হবেনা (ইটালিক গ্রন্থকারের)।”

আশ্রফের নেতারা কি রাজা কানুতের গল্প শোনেননি যে কিনা সমুদ্রের ঢেউ ঠেকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল? শ্রমিকদের লড়াকু চেতনাকে ভেঙে ফেলার উদগ্র বাসনায় তারা কি এরকম একটা কিছু করতে চাইছেন?

সমাজতন্ত্রী পার্টির সামাজিক ফ্যাসিবাদ

যুদ্ধের সময় শ্রমিকদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা যুদ্ধের পরও সমাজতন্ত্রী পার্টিগুলি কর্তৃক অব্যাহত থাকে। নিজেদেরকে শ্রমিকদের ক্রোধ থেকে বাঁচাতে তারা বুর্শোয়া সরকারে যোগ দেয়; শ্রমিকদের ক্ষমতার জন্য সংগ্রামকে ব্যর্থ করতে তারা প্রতিবিপ্লব সংগঠিত করে। তারা শ্রমিকদের সেইসব জঙ্গী অংশের খুনীতে পরিণত হয় যারা পুঁজির শাসন উচ্ছেদে লড়ছিল, যেমনটা লেনিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বাধীনে রুশ শ্রমিকেরা লড়েছে। যুদ্ধের সময়কার দক্ষিণপন্থী সামাজিক-দেশপ্রেমবাদ ও মধ্যপন্থী সামাজিক শান্তিবাদ বর্তমানে সামাজিক ফ্যাসিবাদে একীভূত হয়েছে। সামাজিক ফ্যাসিবাদীরা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশে পরিণত হয়ে একে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে শ্রমিক ও কৃষকদের বিপ্লবী তৎপরতার হাত থেকে রক্ষা করে, তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেয় আর সেখানে সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণকে থামিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে।

তারা জাপানী সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক চীনা জনগনের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন করে আর মাঞ্চুরিয়া দখলকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণের পূর্বাঞ্চলীয় ঘাঁটি বলে মনে করে।

তারা অনেক আগে ৮ ঘন্টা দিবসের দাবি ত্যাগ করেছে। তারা আশা করে জাতিসমূহের লীগ পুঁজিবাদী সরকারগুলির সাথে সম্মেলনের মাধ্যমে ছোটতর কর্মদিবস করে দেবে। ১৯২৫ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মার্সাইল কংগ্রেস ঘোষণা করে যে ৮ ঘন্টা কর্মদিবস “কেবল নীতিগতভাবে স্বীকৃত হতে হবে”। তারা তখনো মে দিবসের ঘটনাগুলিতে অংশ নেয়, কিন্তু কেবল ব্যারিকেডের বিপরীত পাশে, যেমনটি বার্লিনের সমাজতন্ত্রী পুলিশ প্রধান জোয়ের্গিয়েবেলের পৈশাচিক কর্মকান্ড দ্বারা উদাহারণ সৃষ্টি করা হয়েছিল ১৯২৯ সালের মে দিবসে শহরে শ্রমিকশ্রেণীর বিক্ষোভের বিরুদ্ধে। ১৯৩২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সমাজ গণতন্ত্রীরা হাইন্ডেনবার্গের পুননির্বাচনকে সমর্থন করার মাধ্যমে ব্রুয়েনিং ফ্যাসিবাদী সরকারকে সমর্থন দেয়।

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রদর্শনীস্থল “সমাজতন্ত্রী” শহর ভিয়েনায়, ১৬ই জুলাই ১৯২৭ সালে পুলিশের ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা রুখে দাঁড়ালে তাদের রাস্তায় গুলি করে মারা হয়।

“সমাজতন্ত্রী” প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে জেগে উঠা ভারতীয় জনগণকে ধ্বংস করার জন্য সৈন্য পাঠায়। যেখানেই পুঁজিবাদ শ্রমিক ও কৃষকদের বিপ্লবী ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান জোয়ারের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে দূর্বলতা বোধ করেছে, সেখানেই এই আন্দোলনগুলিকে পরাজিত করার জন্য শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে ইছুক এজেন্ট সমাজতন্ত্রী দলগুলিকে তার সেবার জন্য আহবান করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রী পার্টি একই ভূমিকা পালন করে। ক্ষমতায় না থাকলেও শ্রমিকদের সর্বোত্তম আকাঙ্খা ও স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার ব্যবসায় এটি ইতিমধ্যেই তার প্রেরণা লাভ করেছে। সে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে যোগ দেয় যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বদনাম করছে আর শ্রমিক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আবেগকে উস্কানি দিচ্ছে। সে আশ্রফে ও তথাকথিত মুস্তে “প্রগতিশীল” শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে কাজ করে জঙ্গী শ্রমিকদের শিকার করতে, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কর্তাদের সমর্থন করতে, রাষ্ট্রের বাহিনীকে প্রশংসা করতে যখন তারা এদেশের বিপ্লবী আন্দোলনকে বিচার ও নির্যাতন করে। সমাজতন্ত্রী পার্টির পুরনো নেতারা (হিলকুইটস ও ওনীলরা) যে সমাজতন্ত্রের বিশ্বাস করত তা পরিত্যাগ করেছে এবং নতুন নেতারা (থমাস ও ব্রাউনরা) হচ্ছে বুর্শোয়া উদারপন্থী যারা শ্রমিক আন্দোলনকে ব্যবহার করে বুল মুজের দিনের থিওডোর রুজভেল্টের নীতি এগিয়ে নিতে ও রবার্ট লাফলেতদের যাদের সবসময় লক্ষ্য ছিল র‍্যাডিক্যাল বুলি কপচিয়ে জনগণকে বোকা বানানো।

পুঁজিবাদী প্রকাশনার প্রিয়তম নরম্যান থমাস একটি সাম্প্রতিক বইয়ে বিশ্বের সামনে ঘোষণা করেন যে তিনি একটি নতুন ধরণের সমাজতন্ত্র এনেছেনঃ মার্কসবাদহীন সমাজতন্ত্র। আগেও এ চেষ্টা হয়েছে। থমাসের চেয়ে সক্ষম ব্যক্তি এডোয়ার্ড বার্ণস্তাইন ত্রিশ বছরেরও আগে সমাজতন্ত্রকে মার্কসবাদবিহীন করতে চেয়েছে। থমাসের দৌঁড় যতদূর তার চেয়ে বার্ণস্তাইন বেশি জানতেন। এ জার্মান অগ্রগামী শুধুমাত্র মার্কসকে “সংশোধন” করতে চেয়েছে, “তাকে আধুনিক করতে চেয়েছে”। আমেরিকান থমাস অর্ধেক পথ জানেনা। সে মার্কসকে শুধু “সংশোধন”ই করেনা, সমাজতন্ত্রী পার্টি নেতারা যেমনটা ঘোষণা করে, একেবারে বিলোপ করে সমাজতন্ত্রকে আঘাত না করেই।

নরম্যান থমাস ও শ্রেণীসহযোগিতাবাদী সমাজতন্ত্রী পার্টি যাকে তিনি অন্য কারো চেয়ে ভালভাবে প্রতিনিধিত্ব করছেন, তারা এই দেশের শ্রমিকদের কাছে একমাত্র সমাজতন্ত্রের বিশ্বাসঘাতক ও প্রকাশ্য শত্রু হিসেবেই উন্মোচিত হয়েছে, যে প্রকৃত সমাজতন্ত্র মানে শ্রমিকদের শাসন, মার্কস ও লেনিনের সমাজতন্ত্র, যে সমাজতন্ত্রের জন্য সাম্যবাদী পার্টি লড়াই করে, যা আজকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ী শ্রমিক ও কৃষকদের দ্বারা নির্মিত হচ্ছে।

আমেরিকান শ্রমিকদের বিপ্লবী ঐতিহ্য

আমেরিকান শ্রমিক আন্দোলন বিপ্লবী ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ যার ভিত্তিতে সাম্যবাদী পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন ঐক্য লীগ আমেরিকান শ্রমিকশ্রেণীকে বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্য সংগঠিত করার জন্য টেনে আনতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সাথে যুক্ত মহান শ্রমিক সংগ্রাম আমেরিকান শ্রমিকশ্রেণীর জঙ্গিত্বের স্বাক্ষ্য বহন করে। শ্রমিকরা সংগ্রাম সূচনা করবে না কর্তাদের ফাঁদে পা দেবে এতে তারা শুধু প্রস্তুতই নয়, তারা দীর্ঘকাল কাজ থেকে বেরিয়ে এসেছে আর কর্তা ও রাষ্ট্রের দালালদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে তিক্ত সংগ্রাম চালিয়েছে।

শ্রমিক আন্দোলন ইতিহাসে পেছেন ফিরে তাকালে দেখবে ১৮৭৭ ও ১৮৮৬ সালের সাধারণ ধর্মঘট আন্দোলন, হোমস্টিড (১৮৯২), এআরইউ ধর্মঘট (১৮৯৪), লরেন্স (১৯১২), ইস্পাত ধর্মঘট ( ১৯১৯),

১৯৩০ সালে নিউইয়র্কের ইউনিয়ন স্কোয়ারে শ্রমিকদের সমাবেশ

১৯৩০ সালে নিউইয়র্কের ইউনিয়ন স্কোয়ারে শ্রমিকদের সমাবেশ

সিয়াটল (১৯১৯), কয়লাখনি, রেলপথ, বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্পে কলোরাডো, পেন্সিল্ভ্যানিয়া, পশ্চিম ভার্জিনিয়া, ও মেসাবা রেঞ্জের আর সাম্প্রতিক প্যাসাইক ও গ্যাস্তোনিয়ার বিরাট সংগ্রামসমূহ; আর সামনের দিকে তাকালে ভবিষ্যতে মহান সংগ্রাম চোখের সামনে ভেসে উঠবে। অব্যাহতভাবে গভীরতর হওয়া অর্থনৈতিক সংকট, বাড়ন্ত স্থায়ী বেকারত্ব, গতি বাড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতির দ্বারা প্রবলতর হওয়া শোষণ, সাম্রাজ্যবাদী শত্রুতা ত্বরান্বিত হওয়া যা আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে চালিত করবে, বিদ্যমান এমন বস্তুগত পরিস্থিতিতে দুষ্ট নেতামুক্ত আমেরিকান শ্রমিক আন্দোলন নিজের বিবরণ দেবে। চার ডেট্রয়েট অটো ওয়ার্কার্স-এ বেকারত্বের মিছিলে ফোর্ড পুলিশের গণহত্যা, শিকাগো ও ক্লিভল্যান্ডে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মহীন হত্যা হচ্ছে তীক্ষ্ণতর হতে থাকা শ্রেণীসংগ্রাম আর শ্রমিকদের জঙ্গীত্বের প্রমাণ।

১লা মে ও ৮ মার্চ হচ্ছে আমেরিকান শ্রমিকদের অবদান

আমেরিকান শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহ্য আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীকে দুইটি লড়াকু দিন দিয়েছে যাকে বিপ্লবী শ্রমিকরা মাইলফলক মনে করেন। আর এই দুটি দিনকে চূড়ান্ত বিজয় অবধি প্রতি বছর তাদেরকে অতিক্রম করতে হবে। এই “দিবস”গুলির জন্মের সময় যারা ধাত্রীমাতা ছিলেন, সেগুলো বিপ্লবী অর্থ অর্জন করার আগেই তারা তাদের ত্যাগ করেন। আমেরিকান শ্রমিক ফেডারেশন মে দিবসের সূচনায় সাহায্য করেছে। সে মার্কিন পুঁজির বিরুদ্ধে পাপের প্রায়শ্চিত্ত অনেক দিন ধরে করে আসছে, আর কখনো এর বিরোধিতা করেনি। শ্রমিক ইতিহাস কেবল যখন ৮০ দশকের দিকে ফিরে তাকায়, তখন এই বিব্রতকর ঘটনা দেখতে পায় যে আশ্রফে এমন একটা আন্দোলনের পরিচালনায় অংশ নিয়েছে যা মে দিবস সৃষ্টি করেছে।

সমাজতন্ত্রী পার্টি আশ্রফের সম্পর্কে কম হলেও ঘনিষ্ঠ, ৮ মার্চ যে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন হয় তার উদ্ভবের অবদান এই পার্টির ছিল বিবেচনা করতে হবে। বিশ বছর আগে নিউইয়র্কের সমাজতন্ত্রী নারীরা বুর্শোয়া ভোটাধিকার আন্দোলনের বিপরীতে সংগঠিত করল নারী ভোটাধিকার আন্দোলন, যাতে সর্বহারা নারীরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এই তৎপরতা ৮ মার্চ পরিচালিত হয়। নিউইয়র্কের বিক্ষোভের সাফল্য ৮ মার্চকে জাতীয় পর্যায়ে নারী দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠায় চালিত করে। ১৮৯০ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেস ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক করে তোলে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারী ভোটাধিকার স্বীকৃত হওয়ার সাথে সাথে সমাজতন্ত্রী পার্টি ৮ মার্চকে ত্যাগ করল কারণ ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যালট ও নির্বাচনই তার কাছে সব সময় মুখ্য ছিল। রুশ নারী শ্রমিকরা ৮ মার্চকে ভুলেনি, আর অক্টোবর বিপ্লবের পর এই লড়াকু শ্রমিক দিবসকে তারা পুনরুজ্জীবিত করেছে। সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে পুনরায় এক জীবন্ত বাস্তবতা বানিয়েছে।

১লা মের মত কেবল সাম্যবাদী পার্টিগুলিই ৮ মার্চের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, নারীপুরুষেরা যৌথভাবে এই দিনকে কাজে লাগাচ্ছেন সর্বহারা নারীদের আহবান জানাতে যাতে তারা পুরুষের পাশাপাশি সংগ্রামে অংশ নিতে পারে।

ভবিষ্যত সাম্যবাদের

১৯২৩ সালের মে দিবস উপলক্ষ্যে সাপ্তাহিক শ্রমিক-এর সংস্করণে সি ই রুথেনবার্গ লেখেনঃ “মে দিবস, যে দিবস পুঁজিপতিদের মনে ভয় ঢোকায় আর শ্রমিকদের দেয় আশা, সারা দুনিয়ার শ্রমিকরা দেখছেন এ

সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে রেড স্কোয়ারে লাল ফৌজ ও শ্রমিকদের লাল মে দিবসের প্যারেড

সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে রেড স্কোয়ারে লাল ফৌজ ও শ্রমিকদের লাল মে দিবসের প্যারেড

বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাম্যবাদী আন্দোলন ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হবে … …বৃহত্তর অর্জনের জন্য পথ আজ পরিষ্কার, আর সারা দুনিয়ার মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ভবিষ্যত সাম্যবাদেরই”। এক প্রজন্ম আগে সাপ্তাহিক শ্রমিক পত্রিকায় ইউজিন ভি দেব ঐ পত্রিকার ২৭ এপ্রিল ১৯০৭ সালের মে দিবস সংস্করণে লেখেনঃ এটাই হচ্ছে প্রথম ও একমাত্র আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এটা শ্রমিক শ্রেনীর সাথে জড়িত আর বিপ্লবের প্রতি নিবেদিত।

আজকে বিশ্ব সাম্যবাদের কাছাকাছি। আমরা এখন আরো অগ্রসর সময়কালে রয়েছি। পুঁজিবাদ নিম্নমুখী পতিত হচ্ছে আর ক্রমাগত সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। এর নিজের দ্বন্দ্বসমূহের তীক্ষ্ণতা তার টিকে থাকা আরো কঠিন করে তুলেছে। শ্রমিকরা রাজনৈতিক সচেতনতায় বাড়ছে আর পালটা আক্রমণাভিযান চালাচ্ছে যা পরিসর ও গভীরতায় বাড়ছে। উপনিবেশ ও আধ উপনিবেশের জনগণ জেগে উঠছেন আর সাম্রাজ্যবাদের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করছেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্রমিকরা মে দিবসে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের অভূতপূর্ব অর্জনগুলো পর্যালোচনা করবেন। পুঁজিবাদী দেশগুলিতে আগের মতই মে দিবস হবে শ্রমিক শ্রেণীর আশু রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার সংগ্রাম, সর্বহারা একনায়কত্বের শ্লোগান সহকারে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র আর দূরে পেছনে পড়ে নেই।।