সিরাজ সিকদার রচনাঃ পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা, সাহসী হোন, দৃঢ়ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করুন, জাতীয় শত্রু খতম করুন, জাতীয় মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলুন, কর্মসূচী বাস্তবায়িত করুন।

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ২৩ এপ্রিল ১৯৭১

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৩


 

পিডিএফ

পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ও তার পদলেহী কুকুর পূর্ববাংলার বিশ্বাসঘাতকরা পূর্ববাংলার অধিকাংশ জেলা, মহকুমা শহর দখল করেছে এবং সেখানে নিজেদের দখল বজায় রেখেছে। যে কয়টি জেলা বা মহকুমায় তাদের অধিকার কায়েম হয়নি তা অচিরেই তারা দখল করবে। শহরে আওয়ামী লীগ, বিদ্রোহী বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি.আর, পুলিশের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ছে। শহরে পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী তাদের ফ্যাসিবাদী বর্বরতা অব্যাহত রেখেছে এবং ভেঙ্গে যাওয়া বেসামরিক প্রশাসন পুনরায় চালু করার জন্য এবং ব্যবসা-বাণিজ্য-লুন্ঠন চালাবার চেষ্টা করছে।

পূর্ববাংলার গ্রামাঞ্চলের থানা, ফাঁড়িসমূহ নিষ্ক্রিয়। তারা পূর্ববাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, জনগণের বিরুদ্ধে, বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে, কোন তৎপরতা চালাচ্ছে না এবং কারও ইচ্ছে থাকলেও সাহস করছেনা। এদের অনেকেই পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সমর্থন করে, আওয়ামী লীগের সাথে সহযোগিতা করছে।

থানাসমূহের বেসামরিক প্রশাসন কোনো কোনো এলাকায় চলছে, কোনো কোনো এলাকায় নিষ্ক্রিয়। তারাও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, জনগণ ও বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে কিছু করছেনা বা কেউ করতে চাইলে সাহস পাচ্ছেনা।

স্থানীয় টাউট, জুলুমবাজ, জাতীয় শত্রুরা নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভর করে এবং অনেকে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক রেখে বেঁচে আছে। তারাও জনগণ ও বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে এবং পূর্ববাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু করতে সাহস করছেনা।

আওয়ামী লীগের অবস্থা ধংসোন্মুখ। কোথাও কোথাও তাদের নেতৃত্ব পালিয়েছে বা নিষ্ক্রিয় হয়েছে। সাধারণ কর্মীরাও নেতৃত্বশূন্য হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়েছে। তারা আভ্যন্তরীণ কোন্দল, উপনিবেশিক সরকারের চাপ, জনগণের ওপর নির্ভরতা ও বিপ্লবী কাজে অক্ষমতার জন্য ভারতীয় সমর্থন এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই,পি,আর, পুলিশের সহায়তা সত্ত্বেও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার সুযোগ পেয়েও তা যথাযথভাবে দখল করে জনগণের উপকারে লাগায়নি। উপরন্তু তারা অর্থ আত্মসাৎ, মুনাফাখোর, কালোবাজারী, টাউট, জাতীয় শত্রুদের ছত্রছায়া দিয়েছে। তাদের ব্যর্থতা ও দেউলিয়াত্ব জনসাধারণের সামনে স্পষ্ট হয়েছে; তারা বুঝতে পেরেছে আওয়ামী লীগের দ্বারা পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সম্বব নয়।

জনগণের রয়েছে উঁচু রাজনৈতিক চেতনা, কালোবাজারী-মজুতদারী ও মুনাফাখোর, জাতীয় শত্রু ও উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর উৎখাতের তীব্র আকাঙ্খা; তারা মুক্তিযুদ্ধ চালাতে, এতে শরীক হতে এবং তাতে সহায়তা করতে চায়।

মুনাফাখোর, কালোবাজারী, মজুতদারদের কারণে গ্রামে কৃত্রিমভাবে দ্রব্যমূল্য প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে জনসাধারণের আর্থিক অবস্থা সংকটজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। শহর থেকে গ্রামে শ্রমিকরা চলে আসায় এবং গ্রামে কর্মস্বল্পতাও এর কারণ।

উপরোক্ত অবস্থা থেকে দেখা যায় উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব শহর এলাকায় স্থাপিত হয়েছে, এবং তা সুদৃঢ় হচ্ছে, এতে তারা সক্ষম। কিন্তু বিস্তীর্ণ গ্রাম্য এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব নেই। ইহা পূর্বের মত স্থাপন করতেও এদের বহু সময় লাগবে। বিশেষ করে প্রশাসনিক কর্মচারীদের পূর্ববাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজে লাগানো, পুলিশ বাহিনী থানায় মোতায়েন করে তাদের দ্বারা স্বাধীনতা বিরোধী কাজ করানো সময়সাপেক্ষ।

সৈন্যবাহিনীর নিজেদের পক্ষে থানায় ঘাঁটি করা, সেখান থেকে গ্রাম দখল করা তাদের সৈন্যস্বল্পতা, জনগণ, এবং বিপ্লবীদের সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য বর্তমানে সম্ভব নয়। তারা বহু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে (অল্প সৈন্য নিয়ে যাবেনা কারণ তাহলে তারা ধ্বংস হবে, এ সম্ভাবনা রয়েছে বলে) এক এক এলাকায় “খোঁজ কর ও ধ্বংস কর”, “ঘেরাও কর ও দমন কর” অভিযান চালাবে এবং সবাইকে হত্যা করবে, সবকিছু পুড়িয়ে দিবে এবং লুট করবে। এবং পুনরায় শহরের ঘাঁটিতে ফিরে যাবে।

এ অবস্থায় পূর্ববাংলার বিস্তীর্ণ গ্রাম্য এলাকায় পূর্ববাংলার প্রজাতন্ত্রের সরকার কায়েম করা, জাতীয় শত্রুদের খতম করা, জাতীয় মুক্তি বাহিনী গড়ে তোলা এবং আমাদের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করা সম্ভব।

 

ক্ষমতা দখল

গ্রাম্য এলাকায় পূর্ববাংলার প্রজাতন্ত্রের গ্রাম, থানা ভিত্তিক কমিটি কায়েম করতে হবে, কমিটি জনগণের সভা আহ্বান করে নির্বাচিত হবে। কমিটিতে ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, শ্রমিক, মাঝারী চাষী, দেশপ্রেমিক জমিদার ও বুর্জোয়া ও আমাদের প্রতিনিধি থাকবে।

কমিটিতে সভাপতি-সহসভাপতি ও সদস্য থাকবে (৫ বা ৭ জন)।

এই কমিটির মাধ্যমে আমাদের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করতে হবে। কালোবাজারী-মজুতদারী, অতিরিক্ত মুনাফাখোরদের শাস্তি দিতে হবে। স্কুল, কুলেজ, ইউনিয়ন কাউন্সিল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের অর্থের হিসেব নিতে হবে। অর্থ আত্মসাৎকারীদের শাস্তি দিতে হবে।

এই কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে হবে জনসাধারণ, গেরিলা, সশস্ত্র জনসাধারণ (গ্রামরক্ষী বাহিনী ইত্যাদি) দ্বারা।

গ্রামের জাতীয় শত্রুদের বিচার ও শাস্তি বিধান করা। তাদের ভূমি বিতরণ করা, সুদ বাতিল করা, অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবিধান করা; গ্রাম্য বিচার করা, চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি বন্ধ করা।

জাতীয় শত্রুদের নিকট থেকে বলপূর্বক চাঁদা নিতে হবে। জনসাধারণের নিকট থেকে তার সামর্থ অনুযায়ী চাঁদা নিতে হবে।

জনসাধারণের মাঝে প্রতিরোধের প্রচার চালাতে হবে, জনতাকে গ্রামরক্ষী বাহিনীতে সংগঠিত করতে হবে, তাদের মধ্য থেকে সৈন্য বাহিনীতে যোগদানে ইচ্ছুকদের সংগ্রহ করতে হবে। স্কুল, কলেজ, হসপিটাল ও অন্যান্য জনগনের প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে।

 

জাতীয় মুক্তিবাহিনী

গ্রাম্য এলাকায় জনসাধারণের মধ্য থেকে সৈন্যবাহিনীতে লোক সংগ্রহ করা সম্ভব। তাদের ভাতার ব্যবস্থা করা সম্ভব জাতীয় শত্রুদের অর্থ ও খাদ্য দ্বারা। তাদেরকে সশস্ত্র করা যায় থানাসমূহে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে তাদের অস্ত্র দ্বারা, জাতীয় শত্রুর অস্ত্র দখল করে এবং জনসাধারণের মধ্যে যুদ্ধ করছেনা এরূপ ব্যক্তিদের অস্ত্র সংগ্রহ করে তার দ্বারা এবং দেশীয় অস্ত্র দ্বারা। সৈন্যবাহিনীকে খতম করে তার নিকট থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা যায়।

সাত বা নয় জনকে নিয়ে একটি সেকশন, তিনটি সেকশন নিয়ে একটি স্কোয়াড, তিনটি স্কোয়াড নিয়ে একটি প্লাটুন গঠন করা। প্রতিটি ইউনিটের নেতা, সহকারী নেতা থাকবে। এদেরকে উদ্ধৃতির শৃংখলা, তিনটি প্রবন্ধ, গণযুদ্ধ পড়াতে হবে।

দীর্ঘ হাঁটা, অতর্কিত আক্রমণ, বোমাবর্ষণ, তীর, ল্যাজা, ছুরি, তরওয়াল ব্যবহার শেখানো, বেয়নেট মারা শেখানো উচিত।

এদের মধ্য থেকে পার্টি সদস্য সংগ্রহ করতে হবে এবং পার্টি কমিট গঠন করতে হবে।

এই সৈন্যবাহিনী বিভিন্ন গ্রাম, ছোট শহর দখল করবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম করবে, স্থানীয় জনসাধারণকে সশস্ত্র করবে। পার্টি সংগঠন গড়ে তুলবে, প্রচার করবে, সৈন্য সংগ্রহ করবে।

মুক্তিবাহিনীর স্কোয়াডসমূহ স্থানীয় পার্টিকর্মীর সহায়তায় এক এক গ্রামে প্রবেশ করবে এবং জাতীয়শত্রু খতম করবে। জনসমর্থন ও সহায়তার জন্য, অবস্থা বিরাজ করলে জনসভা করবে এবং উপরের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবে।

এই সৈন্যবাহিনী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পক্ষে বর্তমান পর্যায়ে টিকে থাকা ও বিকাশলাভ করা সম্ভব।

গ্রাম্য এলাকায় পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর স্থানীয় প্রশাসন ও দালাল জাতীয় শত্রুদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হলে সেখানে বিপ্লবীদের গোপন কাজ করা এবং বিকাশ করা কষ্টকর হবে, ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণে বিপ্লবী কাজে ভাটা আসবে।

কাজেই আসুন, আমরা বর্তমান বিপ্লবী জোয়ারের সুবিধাজনক অবস্থায় পূর্ববাংলার বিস্তীর্ণ গ্রাম দখল করি, রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করি, জাতীয় মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলি; কর্মসূচী বাস্তবায়িত করি।

♦ পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন জিন্দাবাদ।

♦ পূর্ববাংলা প্রজাতন্ত্র  কায়েম কর।

♦ গ্রাম্য এলাকা  দখল কর।

♦ রাজনৈতিক ক্ষমতা  কায়েম কর।

♦ জাতীয় শত্রু  খতম কর।

♦ জাতীয় মুক্তিবাহিনী  গড়ে তোল।

♦ কর্মসূচী  বাস্তবায়িত কর।

♦ পাকিস্তানের উপনিবেশিক ফ্যাসিষ্টদের ধ্বংস অনিবার্য। এরা কাগুজে বাঘ।

♦ পূর্ববাংলার সর্বহারা বিপ্লবী জনগণ  ঐক্যবদ্ধ হোন।

♦ সংশোধনবাদ, নয়াসংশোধনবাদ, ট্রটস্কি-চেবাদ, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত খতম করুন।

♦ পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন সঠিক। এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হোন।

♦ আমাদের বিজয় অনিবার্য।

♦ ইয়াহিয়া-টিক্কার ধ্বংস অনিবার্য।■