সোভিয়েত পাঠ রাজনৈতিক অর্থনীতি। রাজনৈতিক অর্থনীতির সোভিয়েত কমিউনিস্ট মূল গ্রন্থ। বাংলা অনুবাদ। সূচনা


সোভিয়েত পাঠ রাজনৈতিক অর্থনীতি

রাজনৈতিক অর্থনীতির সোভিয়েত কমিউনিস্ট মূল গ্রন্থ

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞান একাডেমীর অর্থনৈতিক ইন্সটিটিউট কর্তৃক ইস্যুকৃত পাঠ্যপুস্তক

১ম রুশ সংস্করণ ১৯৫৪

মার্ক্সিস্ট ইন্টারনেট আর্কাইভ www.marxists.org কর্তৃক ২০১৪ সালে অনলাইনে প্রকাশিত ইংরেজী অনুবাদ সংগৃহীত হয়েছে লরেন্স ও উইজার্ট কর্তৃক ২য় সংশোধিত ও বর্ধিত রুশ সংস্করণের লন্ডন ১৯৫৭ মুদ্রণ থেকে

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ কর্তৃক বাংলায় অনুবাদ ও সর্বহারা পথ কর্তৃক প্রকাশ শুরু ২২ মার্চ ২০২২ 


সোভিয়েত পাঠ রাজনৈতিক অর্থনীতি

সূচনা

রাজনৈতিক অর্থনীতি সমাজ বিজ্ঞানের মধ্যে পড়ে। (১) এটা মানব সমাজের বিকাশের বিভিন্ন স্তরের বস্তুগত সম্পদের সামাজিক উৎপাদন ও বন্টনের নিয়মকে অধ্যয়ন করে।

সমাজ জীবনের ভিত্তি হচ্ছে বস্তুগত উৎপাদন। বাঁচতে হলে মানুষের দরকার খাদ্য, বস্ত্র ও জীবনের অন্যান্য বস্তুগত সামগ্রী। সেগুলো পেতে হলে জনগণকে তা উৎপাদন করতে হবে, তাদেরকে কাজ করতে হবে।

মানুষ জীবনের বস্তুগত সামগ্রী উৎপাদন করে, অর্থাৎ প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম চালায়, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে নয় বরং একত্রে দলবদ্ধভাবে ও সামাজিকভাবে। ফলত, উৎপাদন হচ্ছে সর্বদা ও সকল পরিস্থিতিতে সামাজিক উৎপাদন, আর শ্রম হচ্ছে সামাজিক মানুষের কাজ।

বস্তুগত সামগ্রী উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় যে উপাদানগুলি রয়েছে তা হলঃ ১) মানবিক শ্রম ২) শ্রমের বিষয়বস্তু ৩) শ্রমের উপায়।

শ্রম হচ্ছে মানুষের উদ্দেশ্যমূলক কার্যকলাপ যার প্রক্রিয়ায় সে প্রাকৃতিক বস্তু সামগ্রীর রূপান্তর ও তার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় নিজ প্রয়োজন মেটাতে। শ্রম হচ্ছে এক প্রাকৃতিক আবশ্যিকতা, মানুষের অস্তিতের অপরিহার্য শর্ত। শ্রম বিনা মানুষের জীবন নিজেই হয়ে দাঁড়াবে অসম্ভব।

শ্রম যার উপর প্রয়োগ করা হয় সেসবই হচ্ছে শ্রমের বিষয়বস্তু। শ্রমের বিষয়বস্তু প্রকৃতি কর্তৃক সরাসরি প্রদত্ত হতে পারে যেমন কাঠ যা বনে কাটা হয় অথবা ধাতু যা মাটির গভীর থেকে নিষ্কাশন করা হয়। শ্রমের বিষয়বস্তু যার উপর শ্রমের প্রয়োগ হয়েছে (যেমন ধাতব কারখানায় আকরিক, সুতাকলে সুতাতন্তু, বুনন কারখানায় ব্যবহৃত পাকানো সুতা) তাকে বলা হয় কাঁচামাল।

শ্রমের উপায় ঐসকল জিনিস যার সাহায্যে মানুষ তার শ্রমের বিষয়বস্তুর উপর কাজ করে ও তাকে রূপান্তর করে। শ্রমের উপায়ের মধ্যে রয়েছে সর্বাগ্রে উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ভূমি, ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, খাল, সংরক্ষণাগার ইত্যাদি সমেত উৎপাদনের হাল হাতিয়ার। শ্রমের উপায়ের মধ্যে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে উৎপাদনের হাতিয়ারসমূহ। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি যা মানুষ তার কাজকর্মে ব্যবহার করেঃ আদিম মানুষের ব্যবহার্য স্থূল পাথর থেকে আধুনিক যন্ত্রপাতি পর্যন্ত। উৎপাদনের যন্ত্রপাতির বিকাশের স্তর প্রকৃতির উপর মানুষের প্রভুত্বের বিশেষত্ব প্রদান করে যা হচ্ছে উৎপাদন বিকাশের মানদণ্ড। অর্থনৈতিক যুগসমূহ একে অপরের থেকে পৃথক হয় কী উৎপাদন করা হল তা দ্বারা নয় বরং কীভাবে ও উৎপাদনের কোন যন্ত্রপাতির সাহায্যে তা করা হচ্ছে তা দ্বারা।

শ্রমের বিষয়বস্তু ও শ্রমের উপায় মিলে তৈরি হয় উৎপাদনের উপায়। শ্রমশক্তি ছাড়া উৎপাদনের উপায় নিজে নিজে কোন কিছু উৎপাদন করতে পারেনা। শ্রমের প্রক্রিয়া, যা হচ্ছে বস্তুগত সম্পদ উৎপাদনের প্রক্রিয়া, শুরু করতে শ্রমশক্তিকে উৎপাদনের হালহাতিয়ারের সাথে যুক্ত হবে হবে।

শ্রমশক্তি হচ্ছে মানুষের কাজ করার সামর্থ্য, মানুষের দৈহিক ও মানসিক শক্তিসমূহের সমষ্টি, যার দ্বারা সে বস্তুগত সম্পদ উৎপাদন করতে পারে। শ্রমশক্তি হচ্ছে উৎপাদনের সক্রিয় উপাদন যা উৎপাদনের উপায়কে কার্যকর করে। উৎপাদনের হাতিয়ারের বিকাশের সাথে মানুষের কাজ করার সামর্থ্যেরও বিকাশ ঘটে, বিকাশ ঘটে তার দক্ষতা, কাজের অভ্যাস ও উৎপাদনের অভিজ্ঞতার।

উৎপাদনের হাতিয়ার যা দ্বারা বস্তুগত সম্পদ উৎপন্ন হয়, মানুষ যারা এই উৎপাদনের হাতিয়ারকে কার্যকর করে ও বস্তুগত মূল্য উৎপাদন সংঘটিত করে, আর তার উৎপাদনের অভিজ্ঞতা ও কাজের অভ্যাস যা তারা ধারণ করে তা সমেত এসব নিয়ে সমাজের উৎপাদিকা শক্তি গঠিত।

মানব সমাজের বিকাশের সকল স্তরে শ্রমজীবি মানুষ হচ্ছে মূল উৎপাদিকা শক্তি।

বস্তুগত সম্পদ উৎপাদনে প্রকৃতির যে জিনিস ও শক্তিসমূহ ব্যবহৃত হয় তার সাথে মানুষের সম্পর্ককে উৎপাদিকা শক্তি প্রতিফলিত করে। উৎপাদনে মানুষ প্রকৃতির উপরই শুধু নয় বরং একে অপরের উপরও ক্রিয়া করে।

“তারা উৎপাদন করে কেবল নির্দিষ্টভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করে আর নিজেদের কার্যকলাপের পারস্পরিক বিনিময় করে। উৎপাদন করতে তারা একে অপরের সাথে নির্দিষ্ট কিছু সংযুক্তি ও সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, আর কেবল এই সামাজিক সংযুক্তি ও সম্পর্কের মধ্যেই প্রকৃতির ওপর তাদের কর্মতৎপরতা তথা উৎপাদন সঙ্ঘটিত হয়।” (মার্কস, “মজুরি-শ্রম ও পুঁজি)

বস্তুগত সম্পদ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে যে নির্দিষ্ট সংযুক্তি ও সম্পর্ক গড়ে উঠে তাই উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে রয়েছেঃ ক) উৎপাদনের উপায়ের মালিকানার রূপ খ) এ থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন সামাজিক গ্রুপসমূহের উৎপাদনে অবস্থান ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক গ) উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা ও উৎপাদনে মানুষের অবস্থান থেকে উদ্ভূত উৎপন্নের বন্টনের রূপ।

উৎপাদন সম্পর্কের চরিত্র নির্ভর করে উৎপাদনের উপায় (ভূমি, বনজঙ্গল, পানিসম্পদ, মৃত্তিকা, কাঁচামাল, উৎপাদনের যন্ত্রপাতিসমূহ, উৎপাদনে ব্যবহৃত ভবন, যোগাযোগের উপায়, পরিবহন প্রভৃতি) কার মালিকানাধীন তার উপর। সেগুলো কি কোন ব্যক্তি, সামাজিক গ্রুপ অথবা শ্রেণীর মালিকানাধীন যা ব্যবহৃত হয় শ্রমজীবি মানুষকে শোষণের জন্য, নাকি তা সমাজের সম্পত্তি যার লক্ষ্য হচ্ছে সমগ্রভাবে সমাজের ব্যপক জনগণের বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটানো। উৎপাদন সম্পর্কের অবস্থা দেখায় যে কীভাবে উৎপাদনের উপায় সমাজের সদস্যদের মধ্যে বন্টিত হয় আর তার ফল হিসেবে কীভাবে জনগণ কর্তৃক উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রী বন্টিত হয়। সুতরাং উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তি ও নির্ধারক দিক হচ্ছে উৎপাদনের উপায়ের উপর কোন না কোন ধরণের মালিকানা।

উৎপাদন সম্পর্ক এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বন্টন সম্পর্ককেও নির্ধারণ করে। বন্টন হচ্ছে উৎপাদন ও ভোগের মধ্যকার যোগসূত্র।

সমাজে উৎপাদনের উৎপন্ন সামগ্রী হয় উৎপাদনশীল অথবা ব্যক্তিগত ভোগে যায়। উৎপাদনশীল ভোগ হল উৎপাদনের উপায়কে বস্তুগত সম্পদ সৃষ্টিতে ব্যবহার করা। ব্যক্তিগত ভোগ বলতে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির চাহিদা মেটানো।

ব্যক্তিগত ভোগের জন্য উৎপন্নের বন্টন উৎপাদনের উপায়ের বন্টনের উপর নির্ভর করে। পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদনের উপায় পুঁজিপতিদের হাতে থাকে। শ্রমিকরা উৎপাদনের উপায় বঞ্চিত থাকে, আর তারা যাতে অনাহারে না মারা যায় সেজন্য পুঁজিপতিদের জন্য খাটতে বাধ্য থাকে যারা তাদের শ্রমের ফসল আত্মসাৎ করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনের উপায় জনগণের মালিকানাধীন। ফলে, শ্রমের ফলের মালিক শ্রমজীবি জনগণ নিজেই।

এসকল সামাজিক কাঠামোয় যেখানে পণ্য উৎপাদন অস্তিত্বশীল, বস্তুগত সম্পদের বন্টন হয় পণ্যের বিনিময় মারফত। উৎপাদন, বন্টন, বিনিময় ও ভোগ মিলে একটি একত্ব গঠন করে যেখানে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে উৎপাদন। এথেকে যে ধরণের বন্টন, বিনিময় ও ভোগ গড়ে উঠে তা আবার উৎপাদনের উপর পালটা প্রভাব ফেলে, হয় তার বিকাশে সহায়ক নাহয় বাঁধা হয়।

“উৎপাদন সম্পর্কের সমষ্টি সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলে, এটা সেই আসল ভিত্তি যার উপর আইনী ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামো গড়ে উঠে এবং তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নির্দিষ্ট ধরণের সামাজিক চেতনা” (মার্কস, সমালোচনামূলক রাজনৈতিক অর্থনীতি রচনার ভূমিকা)।

উপরিকাঠামো জন্ম নেওয়ার পর আবার ভিত্তির উপর পাল্টা প্রতিক্রিয়া ঘটায়ঃ এর বিকাশ বাঁধাগ্রস্থ করে অথবা তরান্বিত করে।

উৎপাদনের রয়েছে একদিকে কৃৎকৌশলগত দিক আর একটা সামাজিক দিক। উৎপাদনের কৃৎকৌশলগত দিককে অধ্যায়ন করে প্রাকৃতিক ও প্রযুক্তি বিজ্ঞানঃ পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ধাতুবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা, কৃষিবিদ্যা ও অন্যান্য। রাজনৈতিক অর্থনীতি উৎপাদনের সামাজিক দিককে অধ্যয়ন করে, সামাজিক উৎপাদন অর্থাৎ মানুষের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন বলেন, “রাজনৈতিক অর্থনীতি উৎপাদন নিয়ে আলোচনা করেনা বরং উৎপাদনে মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে।’’ (লেনিন, “রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’’)

রাজনৈতিক অর্থনীতি উৎপাদন সম্পর্ককে উৎপাদিকা শক্তির সাথে তার ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে অধ্যয়ন করে। উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক মিলে গঠিত হয় উৎপাদন পদ্ধতি।

উৎপাদিকা শক্তি হচ্ছে উৎপাদনে সবচেয়ে সচল ও বিপ্লবী উপাদান। উৎপাদনের বিকাশ শুরু হয় উৎপাদিকা শক্তির পরিবর্তনের মাধ্যমে—সর্বাগ্রে উৎপাদনের হালহাতিয়ারের পরিবর্তন ও বিকাশের মাধ্যমে, তারপর উৎপাদন সম্পর্কে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। উৎপাদিকা শক্তির উপর নির্ভর করে মানুষে মানুষে যে উৎপাদন সম্পর্ক বিকশিত হয় তাই আবার উৎপাদিকা শক্তির উপর সক্রিয় প্রভাব বিস্তার করে।

যেখানে উৎপাদিকা শক্তির চরিত্রের সাথে উৎপাদন সম্পর্ক খাপ খায়, কেবল সেখানেই সমাজের উৎপাদিকা শক্তি বাঁধাহীনভাবে বিকশিত হতে পারে। বিকাশের একটি স্তরে এসে উৎপাদিকা শক্তি বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের কাঠামোকে ছাপিয়ে যায় আর তার সাথে দ্বন্দ্ব লিপ্ত হয়। উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের অনুকূল থেকে বাঁধায় রূপান্তরিত হয়।

ফলে, পুরোনো উৎপাদন সম্পর্ক আগে বা পরে সমাজের উৎপাদিকা শক্তির চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্জিত বিকশিত নতুন উৎপাদন সম্পর্কের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়। সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তনের সাথে এর উপরিকাঠামোও পরিবর্তিত হয়। পুরোনো কাঠামোর গর্ভে নতুন উৎপাদন সম্পর্কের দ্বারা পুরোনো উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিস্থাপনের বস্তুবাদী শর্তের উদ্ভব ঘটে। নতুন উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের দরজা খুলে দেয়।

তাই সমাজের বিকাশের একটি অর্থনৈতিক নিয়ম হচ্ছে উৎপাদিকা শক্তির চরিত্রের সাথে উৎপাদন সম্পর্কের আবশ্যিক সামঞ্জস্যতার নিয়ম।

ব্যক্তিগত মালিকানা ও মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণভিত্তিক সমাজে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব শ্রেণীসংগ্রামের রূপে প্রকাশিত হয়। এই পরিস্থিতিতে পুরোনো উৎপাদন পদ্ধতি প্রতিস্থাপিত হয় নতুন উৎপাদন পদ্ধতি দ্বারা সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে।

রাজনৈতিক অর্থনীতি একটি ঐতিহাসিক বিজ্ঞান। এটা নির্দিষ্ট উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে লুক্কায়িত অর্থনৈতিক নিয়মসমেত ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট সামাজিক বস্তুগত উৎপাদন নিয়ে ব্যপৃত। অর্থনৈতিক নিয়ম অর্থনৈতিক ব্যাপার ও প্রক্রিয়ার আবশ্যিক প্রকৃতিকে প্রকাশ করে আর এদের মধ্যে বিদ্যমান আভ্যন্তরীণ কার্যকারণ যোগসূত্র ও নির্ভরশীলতাকে প্রকাশ করে।

অর্থনৈতিক বিকাশের নিয়ম হচ্ছে বস্তুগত নিয়ম। তারা মানুষের ইচ্ছানিরপেক্ষ নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্ভূত হয় ও কার্যকর হয়। মানুষ এই নিয়মকে উপলব্ধি করতে পারে ও সমাজের স্বার্থে তাকে কাজে লাগাতে পারে, কিন্তু তারা অর্থনৈতিক নিয়মকে ধ্বংস বা সৃষ্টি করতে পারেনা।

শ্রেণীসমাজে অর্থনৈতিক নিয়মের ব্যবহারের সর্বদাই এক শ্রেণী চরিত্র রয়েছেঃ প্রতিটি সমাজ কাঠামোতে অগ্রসর শ্রেণী সমাজের প্রগতিশীল বিকাশের সেবা করতে অর্থনৈতিক নিয়মকে ব্যবহার করে, যেখানে ক্ষয়িষ্ণু শ্রেণীসমূহ একে প্রতিরোধ করে।

প্রতিটি উৎপাদন পদ্ধতির রয়েছে নিজ মৌলিক অর্থনৈতিক নিয়ম। এই মৌলিক অর্থনৈতিক নিয়ম একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন পদ্ধতির সারকে প্রকাশ করে আর এর প্রধান দিক ও বিকাশের ধারাকে নির্ধারণ করে।

রাজনৈতিক অর্থনীতি “অবশ্যই প্রথমে তদন্ত করবে উৎপাদন ও বিনিময়ের বিবর্তনের প্রতিটি পৃথক স্তরের বিশেষ নিয়ম, আর এ তদন্ত সম্পূর্ণ করার পরই কেবল সে উৎপাদন ও বিনিময়কে সমগ্রভাবে সেবা করে এমন কিছু সাধারণ নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।” (এঙ্গেলস, এন্টি ড্যুরিঙ)

ফলত, বহুবিধ সামাজিক কাঠামোর বিকাশ শুধু তাদের নিজ মূর্ত অর্থনৈতিক নিয়ম দ্বারাই পরিচালিত হয়না বরং সকল কাঠামোর সাধারণ নিয়ম দ্বারাও পরিচালিত হয়, যেমন উৎপাদিকা শক্তির চরিত্রের সাথে উৎপাদন সম্পর্কের আবশ্যিক সামঞ্জস্যতার নিয়ম। তাই, উৎপাদন পদ্ধতির ভেতর বিরাজমান মূর্ত অর্থনৈতিক নিয়ম দ্বারাই কেবল সামাজিক কাঠামো পৃথক হয়না বরং সকল কাঠামোর সাধারণ কিছু নিয়ম দ্বারাও একে অপরের সাথে যুক্ত।

রাজনৈতিক অর্থনীতি নিম্নলিখিত মৌলিক ধরণের উৎপাদন সম্পর্কের অধ্যয়ন করে যা ইতিহাসে জ্ঞাতঃ আদিম কমিউন ব্যবস্থা, দাস মালিক ব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র, সমাজতন্ত্র। আদিম কমিউন ব্যবস্থা হচ্ছে শ্রেণীপূর্ব ব্যবস্থা। দাসমালিক ব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র হচ্ছে শ্রমজীবি মানুষের দাসত্ব ও শোষণভিত্তিক বিভিন্ন ধরণের সমাজ। সমাজতান্ত্রিক সমাজ হচ্ছে মানুষ কর্তৃক মানুষের ওপর শোষণ থেকে মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা।

রাজনৈতিক অর্থনীতি তদন্ত করে কীভাবে সামাজিক উৎপাদন নিম্নতর থেকে উচ্চতর স্তরে বিকশিত হয়, আর কীভাবে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের সামাজিক ধারা উদ্ভূত, বিকশিত ও বিলুপ্ত হয়। এটা দেখায় কীভাবে ঐতিহাসিক বিকাশের সমগ্র এক ধারা সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির বিজয়ের পথ প্রস্তুত করে। অধিকন্তু এটা অধ্যয়ন করে সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক নিয়ম, সমাজতান্ত্রিক সমাজের উদ্ভবের নিয়ম আর সাম্যবাদের উচ্চতর পর্বের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার এক ধারাবাহিক বিকাশকে।

তাই রাজনৈতিক অর্থনীতি হচ্ছে সামাজিক উৎপাদনশীল বিকাশের অর্থাৎ মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিজ্ঞান। মানব সমাজের বিকাশের বিভিন্ন স্তরে বস্তুগত সম্পদের উৎপাদন ও বন্টনের পরিচালক নিয়মকে তা ব্যাখ্যা করে।

মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থনীতির পদ্ধতি হচ্ছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পদ্ধতি। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মৌলিক তত্ত্বকে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর অধ্যয়নে প্রয়োগ করে।

অধ্যয়ণে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মত রাজনৈতিক অর্থনীতি সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোকে কৃত্রিমভাবে গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেনা যা প্রপঞ্চকে অপসারণ করে একটি প্রক্রিয়ার সবচেয়ে খাঁটি রূপের অধ্যয়ণকে বাঁধাগ্রস্থ করে। “অর্থনৈতিক রূপের বিশ্লেষণে না অণুবীক্ষণ যন্ত্র না রাসায়নিক বিক্রিয়ক ব্যবহৃত হয়। বিমূর্তকরণের শক্তি এই দুইকে অবশ্যই প্রতিস্থাপন করবে। (মার্কস, পুঁজি, ১ম খণ্ড)

প্রতিটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই এক দ্বন্দ্বমূলক ও জটিল ছবি তুলে ধরে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার করণীয় কাজ হচ্ছে অর্থনীতির ঘটনার বহিরঙ্গে যা দেখা যায় তার পেছনে গভীরে প্রথিত যে প্রক্রিয়া ও মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উন্মোচিত করা আর সম্পর্কিত নির্দিষ্ট উৎপাদন সম্পর্কের আবশ্যিক চরিত্র তুলে ধরা গৌণ বৈশিষ্ট্যগুলি থাকে আলাদা করে বিমূর্তায়নের মাধ্যমে।

এমন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে জন্ম নেয় অর্থনৈতিক বর্গসমূহ অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামোর প্রকৃত উৎপাদন সম্পর্কের তাত্ত্বিক বহিপ্রকাশের প্রতিনিধিত্ব করে যে ধারণা যেমন উদাহারণস্বরূপ পণ্য, মূল্য, অর্থ, অর্থনৈতিক হিসাবরক্ষণ, লাভজনকত্ব, কর্মদিবস প্রভৃতি।

মার্কসের পদ্ধতি হছে সরলতম অর্থনৈতিক বর্গ থেকে অধিকতর জটিলগুলোতে ক্রমান্বয়ে আরোহণ করা, যা আরোহী ধারায় নিম্নতর থেকে উচ্চতর স্তরসমূহে সমাজের প্রগতিশীল বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যখন রাজনৈতিক অর্থনীতির বর্গগুলির অনুসন্ধানে এমন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, সামাজিক বিকাশের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের সাথে যৌক্তিক তদন্ত যুক্ত হয়।

মার্কস পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের তার বিশ্লেষণে উন্মোচন করেন নিত্যনৈমিত্তিক সম্পর্ককে যা সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে সরল ও সর্বাধিক ঘন ঘন পুনরাবৃত্তঃ এক পণ্যের সাথে আরেক পণ্যের বিনিময়ের ঘটনা। তিনি দেখান যে পুঁজিবাদী সমাজের গঠনের একক রূপ যে পণ্য তার মধ্যে পুঁজিবাদী সমাজের দ্বন্দ্বসমূহ ভ্রূণাকারে আছে। যাত্রাবিন্দু হিসেবে পণ্যের বিশ্লেষণে মার্কস অর্থের উদ্ভব ব্যাখ্যা করেন আর অর্থের পুঁজিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া উন্মোচন করেন, যা হচ্ছে পুঁজিবাদী শোষণের আবশ্যিক চরিত্র। মার্কস দেখান কীভাবে সামাজিক বিকাশ অনিবার্যভাবে পুঁজিবাদের পতন ও সাম্যবাদের বিজয়ের দিকে চালিত করে।

লেনিন ব্যাখ্যা করেন যে অর্থনৈতিক বিকাশের ধারাবাহিকতা অনুসারে তার চরিত্র নিরূপন করে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাজনৈতিক অর্থনীতির বর্তমান গ্রন্থে রাজনৈতিক অর্থনীতির মৌলিক অভিধা যথা পণ্য, মূল্য, অর্থ, পুঁজি ইত্যাদিকে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে পরীক্ষা করা হয়েছে যাতে তারা মানব সমাজের বিভিন্ন স্তরে উদ্ভূত। এখানে প্রাক পুঁজিবাদী কাঠামোর বর্ণনায় পণ্য ও অর্থ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তুলে ধরা হয়েছে। এসব অভিধা পুঁজিবাদী অর্থনীতির ক্ষেত্রে পূর্ণ বিকাশ প্রাপ্ত হয়, তাই, পূর্ণ বিকশিত রূপে তুলে ধরা হয়েছে ও অধ্যয়ণ করা হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হবে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মৌলিক নিয়ম, জাতীয় অর্থনীতির পরিকল্পিত আনুপাতিক বিকাশ, শ্রম অনুযায়ী বন্টন, মূল্য, অর্থ প্রভৃতি সম্পর্কে এক প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হবে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে রূপান্তর সম্পর্কিত অধ্যায়ে। “জাতীয় অর্থনীতির সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা” অধ্যায়ে এই নিয়ম ও অভিধাগুলির বর্ধিত আলোচনা করা হবে।

ইতিহাসের সাথে বৈসাদৃশ্যমূলকভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতি সমাজের বিকাশের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে তার সকল মূর্ত রূপে অধ্যয়ন করেনা। এটা সামাজিক অর্থনীতির প্রতিটি ব্যবস্থার মৌলিক চরিত্র সম্পর্কে মূল ধারণা দেয়। রাজনৈতিক অর্থনীতি ছাড়াও অন্য অনেক বৈজ্ঞানিক শাখা রয়েছে যেগুলো জাতীয় অর্থনীতির বিবিধ শাখার অর্থনৈতিক সম্পর্ককে অধ্যয়ণ করে শিল্প অর্থনীতি, কৃষি অর্থনীতি ইত্যাদিতে রাজনৈতিক অর্থনীতির আবিষ্কৃত নিয়মসমুহের উপর ভিত্তি করে।

রাজনৈতিক অর্থনীতি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে অধ্যয়ণ করেনা বরং জীবন্ত প্রশ্নসমূহ যা মানুষ, সমাজ ও শ্রেণীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থকে প্রভাবিত করে। পুঁজিবাদের পতন ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিজয় কি অনিবার্য? পুঁজিবাদের স্বার্থ কি সমাজের স্বার্থ ও মানবজাতির প্রগতিশীল বিকাশের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়? শ্রমিক শ্রেণী কি পুঁজিবাদের কবর খোদাইকারী আর পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির ভাবধারার বাহক?—এসকল প্রশ্নের উত্তর ভিন্ন ভিন্ন অর্থনীতিবীদেররা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দিয়েছেন নিজ নিজ শ্রেণীর স্বার্থের উপর ভিত্তি করে।

তাই সমাজের সকল শ্রেণীর জন্য একটি একক রাজনৈতিক অর্থনীতির অস্তিত্ব নেই বরং আলাদা কয়েকটি অর্থনীতি রয়েছেঃ বুর্শোয়া রাজনৈতিক অর্থনীতি, সর্বহারা রাজনৈতিক অর্থনীতি, মধ্যবর্তী শ্রেণীসমূহের রাজনৈতিক অর্থনীতি, ক্ষুদে বুর্শোয়া রাজনৈতিক অর্থনীতি।

এ থেকে আসে যে সেসব অর্থনীতিবীদেরা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত যারা বলে যে রাজনৈতিক অর্থনীতি হচ্ছে নিরপেক্ষ, নিরপেক্ষ বিজ্ঞান, সমাজের শ্রেণীসংগ্রামনিরপেক্ষ অথবা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত নয়।

সাধারণভাবে এমন রাজনৈতিক অর্থনীতির অস্তিত্ব কি সম্ভব যা হবে বস্তুগত, নিরপেক্ষ ও সত্যে নির্ভীক? অবশ্যই তা সম্ভব। এমন এক বস্তুগত রাজনৈতিক অর্থনীতি কেবল সেটাই যা কেবল সেই শ্রেণীর রাজনৈতিক অর্থনীতি যে পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব ও ঘাঁসমূহকে ধামাচাপা দেয়না, পুঁজিবাদী শাসন বজায় রাখায় যার কোন স্বার্থ নেই, সেই শ্রেণী যার স্বার্থ পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্তির স্বার্থের সাথে একীভূত হয়, যার স্বার্থ মানবজাতির প্রগতিশীল বিকাশের সাথে মিলে যায়। এমনই এক শ্রেণী হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণী। তাই এক বস্তুগত ও নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক অর্থনীতি কেবল সেটাই যা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থভিত্তিক। এই রাজনৈতিক অর্থনীতি হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি।

মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি হচ্ছে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

শ্রমিক শ্রেণীর মহান নেতা ও তাত্ত্বিক কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস সর্বহারা রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাঁর প্রতিভাবান কর্ম পুঁজিতে মার্কস পুঁজিবাদের উদ্ভব, বিকাশ ও বিলয়ের নিয়ম উন্মোচন করেন আর দেখান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনিবার্যতা ও সর্বহারা একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠার অর্থনৈতিক ভিত্তি। মার্কস ও এঙ্গেলস সাধারণভাবে বললে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উৎক্রমণপর্বের আর সাম্যবাদী সমাজের দুই পর্বের তত্ত্ব সৃষ্টি করেছেন।

মার্কসবাদের অর্থনৈতিক শিক্ষা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের রচনার মাধ্যমে সৃজনশীল বিকাশ লাভ করেছে, যিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা আর মার্কস ও এঙ্গেলসের কর্মের প্রতিভাবান ধারাবাহক। লেনিন ঐতিহাসিক বিকাশের নয়া অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণ করে মার্কসবাদী অর্থনৈতিক বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেন, সাম্রাজ্যবাদের ওপর মার্কসবাদী শিক্ষা গড়ে তোলেন, সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চরিত্র উন্মোচন করেন, আধুনিক পুঁজিবাদের মৌলিক অর্থনৈতিক নিয়মের প্রাথমিক ধারণা দেন, পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের তত্ত্বের মৌলিক নিয়ম আবিষ্কার করেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নতুন ও পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব সৃষ্টি করেন আর সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ বিনির্মাণের মৌলিক সমস্যার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রদান করেন।

লেনিনের মহান সহযোদ্ধা ও শিষ্য জেসেফ ভিসসারিওনোভিচ স্তালিন রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বেশ কিছু নতুন প্রস্তাবনা তুলে ধরেন ও বিকশিত করেন সত্যিকারভাবে এক বৈজ্ঞানিক রাজনৈতিক অর্থনীতির বিনির্মাতা মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের মৌলিক শিক্ষামালার উপর ভিত্তি করে।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভাতৃপ্রতিম কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের সিদ্ধান্তসমূহের মাধ্যমে আর সেইসব পার্টির নেতাদের রচনার মাধ্যমে সৃজনশীলভাবে বিকশিত হয়েছে যারা ছিলেন লেনিন ও স্তালিনের শিষ্য ও সহযোদ্ধা। তাঁরা বিপ্লবী সংগ্রাম, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ বিনির্মাণের অনুশীলনের সাধারণীকরণের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেন।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি হচ্ছে পুঁজিবাদী নিপীড়ণ থেকে নিজ মুক্তির সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণী ও বিশ্বের সকল শ্রমজীবি মানুষের মুক্তির চিন্তাধারার এক শক্তিশালী অস্ত্র। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্বের জীবন্ত সামর্থ্য এই সত্যের মধ্যে রয়েছে যে সেটা শ্রমিক শ্রেনীকে ও শ্রমজীবি জনগণকে সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশের নিয়মের জ্ঞান দ্বারা সজ্জিত করে, তাদের সাম্যবাদের চূড়ান্ত বিজয়ে সঠিক পথ দেখায় ও আস্থাবান করে তোলে।

নোট

১। এই বিজ্ঞানের নাম “পলিটিকাল ইকোনমি (রাজনৈতিক অর্থনীতি)” এসেছে গ্রীক “পলিটিয়া” ও “ঐকনমিয়া” থেকে। “পলিটিয়া শব্দের অর্থ “সামাজিক সংগঠন”। “ঐকনমিয়া” শব্দটি দুটি শব্দ নিয়ে গঠিতঃ “ঐকস” মানে ঘরবাড়ী অথবা এই সংক্রান্ত ব্যাপার আর “নমস” অর্থ নিয়ম। পলিটিকাল ইকোনমি নামটা চালু হয় কেবল সপ্তদশ শতকের শুরুতে।।