ইউক্রেন যুদ্ধঃ নব্য নাৎসীবাদ, বর্ণবাদ, উগ্রজাতীয়তাবাদ, মার্কিন-পশ্চিম ইউরোপীয় ন্যাটো সম্প্রসারণ বনাম রুশ প্রতিরোধ-সম্প্রসারণ

 ইউক্রেনযুদ্ধঃ সিপিএমএলএমবিডি বাংলা পিডিএফ 

 Statement in English: Ukraine War by CPMLMBD

২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২ রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। মার্কিন ও পশ্চিম ইউরোপীয়দের সামরিক জোট ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঠেকানোর জন্য ও সেইসাথে ইউক্রেনে রুশবিরোধী নয়া নাৎসী উগ্রজাতীয়তাবাদীদের উচ্ছেদে এই অভিযান চালানো হচ্ছে বলে রাশিয়া জানাচ্ছে। এই লক্ষ্যে রাশিয়া  পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে এপ্রিল ২০২১ থেকে । ২০২১ এর শেষে এই সৈন্য সমাবেশ বিশাল আকার ধারণ করে। ফেব্রুয়ারী ২০২২ এ উত্তরে বেলারুশ, পূর্বে ডনবাস আর দক্ষিণে ক্রিমিয়া এ তিন অঞ্চলে বিশাল সমাবেশ করে সেখান থেকে তিন দিক দিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২ থেকে ইউক্রেনে ঢুকে পড়ে রুশ বাহিনী।

২০১৪ সালে ইউক্রেনে রুশ বিরোধী পশ্চিমাদের দালাল নব্য নাৎসী উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ইউক্রেনের ক্ষমতা দখল করে। নব্য নাৎসীরা রুশ জাতিসহ সকল সংখ্যালঘু জাতি, বর্ণ, স্তরের ওপর গণহত্যা শুরু করে। এর ফল হিসেবে পূর্ব ইউক্রেনে রুশ ভাষাভাষী জনগণ সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রাম শুরু করে। রুশ ভাষাভাষী ক্রিমিয়া অঞ্চল স্বাধীনতা ঘোষণা করে ও রাশিয়ায় যোগদান করে।

রুশবিরোধী ইউক্রেনের উগ্র ডান সরকারের ন্যাটোতে যোগদানের সিদ্ধান্ত রাশিয়াকে উত্তেজিত করে তোলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ন্যাটো আর পূব দিকে অগ্রসর হবেনা এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ন্যাটো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে সম্প্রসারণ ঘটাতেই থাকে, শুধু ইউক্রেন এখন বাকি আছে। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের অর্থ হবে রাশিয়ার দরজায় প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন-পশ্চিম ইউরোপীয়দের পারমানবিক অস্ত্র মোতায়েন। ২০১৪ সালে এরকম পরিস্থিতি দেখা দিলে রুশ দ্রুত ক্রিমিয়া অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। গত বছর থেকে রাশিয়া ইউক্রেনকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে যাতে তারা নিরপেক্ষ থাকে। কিন্তু ইউক্রেন ও পশ্চিমারা এ বিষয়ে অনড় থাকে যা রাশিয়ার কাছে ছিল অগ্রহণযোগ্য। রাশিয়া ইউক্রেনে পশ্চিমা পুতুল জেলেনেস্কির সরকার উৎখাত করে নিজ পুতুল সরকার বসাতে চায় আর এখন রুশভাষাভাষী ডনবাস অঞ্চল রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চায়।

মার্কিন ও পশ্চিম ইউরোপীয়দের জোট ন্যাটো সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিকে ভেঙে দিতে বরাবরই ষড়যন্ত্র করে এসেছে এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে। এ ব্যাপারটা রুশ সাম্রাজ্যবাদীরা বিশেষত পুতিন কখনো ভুলেনি। আজকে রাশিয়া পুনরায় সামরিক পরাশক্তি, তার সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারন আবশ্যিকভাবে প্রয়োজন, যার সবচেয়ে বড় বাঁধা মার্কিন-পশ্চিম ইউরোপ জোট। এই বাঁধা ভেঙে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। মার্কিন-পশ্চিম ইউরোপীয় ন্যাটো ব্লকের বিপরীতে রুশ-চীন ব্লকও গড়ে উঠছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আমরা জানি চীন এক অর্থনৈতিক পরাশক্তি আর একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। রাশিয়া একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আর এক সামরিক পরাশক্তি। এই দুইয়ের জোট মার্কিন-পশ্চিম ইউরোপীয় পরাশক্তির বিপরীত জোটে পরিণত হচ্ছে। এ হচ্ছে বিশ্বকে পুনরায় ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়া। এই বন্টন পুনর্বন্টন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মাধ্যমে ঘটে থাকে। এটা শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে। এই যুদ্ধের ফল হিসেবে ১৯১৭ সালে  প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়া জন্ম নিয়েছিল। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯-৪৫। তখন জন্ম নেয় চীন, পূর্ব ইউরোপ, কিউবা, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্পুচিয়াসহ এক ঝাঁক সমাজতান্ত্রিক দেশ।

মাও সেতুঙ বলেছেন হয় বিপ্লব যুদ্ধকে ঠেকাবে নয় যুদ্ধ বিপ্লবকে ডেকে আনবে। আজকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে।

ইউক্রেনের জনগণ মূলত রুশী। রাশিয়ার জনগণ নিজেদের বড় রুশী, ইউক্রেনের জনগণকে ছোট রুশী আর বেলারুশের জনগণকে সাদা রুশী বলে থাকেন। এটা জাতিগত দ্বন্দ্ব উসকে দিতে পারে। তবে ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে নাৎসিদের সহযোগী বাহিনীও ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। ১৯৩০-৩২ সালের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক যৌথকরণের সময় কুলাক বা ধনী কৃষকদের উপর কিছু বলপ্রয়োগ করা হয়েছিল। সেই কুলাকদের কিছু অংশ সোভিয়েতের বিরোধিতা করে। ১৯৮০ দশকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা সেদেশে প্রবাসী এই ধরণের কিছু লোকের সহযোগিতায় ইউক্রেনের নয়া ইতিহাস রচনা করে যাতে হলদমর নামে একটা গণহত্যা যুক্ত করা হয়। যাতে দেখানো হয় ১৯৩০-৩২ সালে যৌথকরণের সময় ইউক্রেনের উপর কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন গণহত্যা চালিয়ে কয়েক মিলিয়ন মানুষ হত্যা করেছিল। ইতিহাসে খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল দেখা যায় যাতে পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নে কয়েক লক্ষ লোক মারা গেছিল বলে জানা যায়, কিন্তু হলদমর বলে কিছু ছিল বলে জানা যায়না। কিছু বাড়াবাড়ি যদি হয়েও থাকে সেটা এমন কিছু নয় যাকে হলদমর বলে আখ্যা দেয়া যায়। এটা একটা জঘন্য মিথ্যাচার যা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এর উপরই ইউক্রেনীয় নয়া নাৎসীবাদ জন্ম নিয়েছে, যারা আবার শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী। এরা বিগত সাত আট বছর যাবত ইউক্রেনে বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষের বিভীষিকা কায়েম করেছে। তারা মার্কস, লেনিন, স্তালিনের মুর্তি ভেঙে ফেলছে। অথচ লেনিন স্তালিনের মাধমেই ইউক্রেন নামক পৃথক দেশ গড়ে উঠেছিল। যে ইউক্রেনের অধিকাংশ মানুষ নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কয়েক মিলিয়ন ইউক্রেনীয় জনগণ জার্মান নাৎসিদের গণহত্যার শিকার হয়েছেন। সেখানে কীভাবে নব্য নাৎসি জন্ম নিতে পারল? পশ্চিম ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী লুভিভ এদের কেন্দ্র। এসব এলাকা যুদ্ধের মাধ্যমে বারবার হাত বদল হয়েছে, আর ভিন্ন ভিন্ন জাতিগত দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র ছিল। আসলে নব্য নাৎসিবাদ হচ্ছে ফ্যাসিবাদ যা দুনিয়ার সব জায়গায়ই জন্ম নিতে পারে কোথাও বর্ণবাদকে আঁকড়ে ধরে, কোথাও উগ্র জাতীয়তাবাদকে আঁকরে ধরে আর কোথাওবা ধর্মবাদকে আঁকড়ে ধরে।

অপরদিকে রুশ আগ্রাসন। এ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ। রুশ সাম্রাজ্যবাদের রয়েছে কাঁচামাল ও বিশাল দেশ আর বিরাট সমর শক্তি। স্বাভাবিকভাবেই সে সম্প্রসারণ করবে। চীনের রয়েছে বিরাট জনশক্তি, কারিগরি শক্তি, বৃহত্তম পুঁজি। সেও সম্প্রসারিত হচ্ছে দ্রুত গতিতে। এ দুয়ের সমন্বয়ে পশ্চিমা বিরোধী অর্থনৈতিক-সামরিক ইউরেশিয়ান সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি জন্ম নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে চীন এখন তাইওয়ান দখলের দিকে অগ্রসর হবে।

২০১৯ সালে সূচিত কোভিড ১৯ অতিমারীতে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ষাট লাখ মানুষ মারা গেছে। এটা পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট হিসেবে প্রতীয়মান হয়। যার বর্তমান অভিব্যক্তি যুদ্ধ। এ সংকটের থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুক্তি নেই। হয় পুঁজিবাদকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে নাহলে দুনিয়াকে নিজেকে ধ্বংস হতে হবে। আমরা জানি দুনিয়ার ৯৯ ভাগ মানুষ পুঁজিবাদের মৃত্যু কামনা করেন। ইউক্রেনের নব্য নাৎসি জেলেনেস্কির যুদ্ধ উন্মাদনা দুনিয়ার মানুষের কাম্য নয়। কাম্য নয় মার্কিন-পশ্চিম ইউরোপ ন্যাটো-রুশ-চীন আগ্রাসন। দুনিয়ার মানুষের কাম্য শোষণহীন পৃথিবী তথা সাম্যবাদ, আর তার জন্য মানুষ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।

দুনিয়াব্যাপী সাম্যবাদীদের নিজ নিজ শক্তি বিকশিত করে তুলতে হবে। নিজ নিজ দেশের জনগণকে পশ্চিমা প্রাচ্য সকল সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে জাগরিত করতে হবে। সকল শোষণ থেকে মুক্ত এক নতুন দুনিয়ার জন্য।

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী লেনিনবাদী মাওবাদী বাংলাদেশ

১০ মার্চ ২০২২