রাজনৈতিক অর্থনীতির মূলতত্ত্ব। রাজনৈতিক অর্থনীতির চীনের কমিউনিস্ট মূল গ্রন্থ (সাংহাই পাঠ্যপুস্তক)। বাংলা অনুবাদ। ৩য় অধ্যায়

রাজনৈতিক অর্থনীতির মূলতত্ত্ব

 

রাজনৈতিক অর্থনীতির চীনের কমিউনিস্ট মূল গ্রন্থ (সাংহাই পাঠ্যপুস্তক)

লেখক গ্রুপ কর্তৃক রচিত ও সাংহাই গণ প্রকাশনা কর্তৃক মূল চীনা ভাষায় প্রকাশিত, ১৯৭৪

কেকে ফাঙ কর্তৃক ইংরেজী অনূদিত ও জেসি ওয়াঙ কর্তৃক সম্পাদিত, ১৯৭৫

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ কর্তৃক বাংলায় অনূদিত ও সর্বহারা পথ কর্তৃক প্রকাশ শুরু জানুয়ারি ২০২২

৩য় অধ্যায় বাংলা অনুবাদ প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১ম সপ্তাহ ২০২২।।

 

৩য় অধ্যায়

পুঁজিবাদী সমাজের বিশ্লেষণ পণ্য থেকে শুরু করতে হবে

পণ্য, অর্থ, ও মূল্যের নিয়ম

সভাপতি মাও ব্যাখ্যা করেনঃ “মার্কস পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো বিশ্লেষণ করতে সরলতম পুঁজিবাদী উপাদানঃ পণ্য থেকে শুরু করেন।”(১) কেন মার্কস পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশ্লেষণে পণ্য থেকে তার বিশ্লেষণ শুরু করেন? কারণ পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিটি উৎপন্নই পণ্য। উৎপাদনের উপায় ও ভোগ্য দ্রব্যসামগ্রীই শুধু যে পণ্য তা নয়, এমনকি মানুষের শ্রমও হচ্ছে পণ্য। এখানে সামাজিক সম্পদ বিপুল পরিমাণ সঞ্চিত পণ্য হিসেবে প্রতিফলিত হয়। পণ্য পুঁজিবাদী অর্থনীতির এককে পরিণত হয়। পণ্যের মধ্যে পুঁজিবাদের সকল দ্বন্দ্বসমূহ মূর্ত হয়। সুতরাং, পুঁজিবাদের অধ্যয়নকে পণ্যের বিশ্লেষণ থেকে শুরু করতে হবে।

সকল পুঁজিবাদী দ্বন্দ্ব পণ্য সম্পর্কে মূর্ত হয়

পণ্য দুই উপাদান নিয়ে গঠিতঃ

ব্যবহার মূল্য ও বিনিময় মূল্য

শ্রমের ফসল পণ্য হচ্ছে বিক্রয় ও বিনিময়ের জন্য। জন্ম ও বিকাশের এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এটা গেছে। আদিম সমাজে মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রম করেছে। যে উৎপন্ন পাওয়া গেছে তা আদিম কমিউনের সকল সদস্যই ভোগ করত। এই পরিস্থিতিতে কোন বিনিময় অথবা পণ্য উৎপাদন ছিলনা। বিনিময় ও পণ্য উৎপাদন ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠেছে দাস ও সামন্ত সমাজে। পুঁজিবাদী বিশ্বে তাদের বিকাশ চূঁড়ায় পৌঁছে।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির একক পণ্যের মূল বৈশিষ্ট্য কী?

যেহেতু পণ্য হচ্ছে বিনিময়ের জন্য শ্রমের ফসল, তাদের প্রথমে মানুষের ব্যবহারযোগ্য হতে হবে। উদাহারণস্বরূপ, ভাত আমাদের পেট ভরাতে পারে, কাপড় আমাদের উষ্ণ রাখতে পারে, লোহা ও ইস্পাত দিয়ে যন্ত্র তৈরি হয় আর ট্রাক্টর চাষ করতে পারে। পণ্যের এই ব্যবহারযোগ্যতাকে বলা হয় ব্যবহার মূল্য। অবশ্যই, যদি কোন কিছুর ব্যবহারযোগ্যতা না থাকে, কারো তা দরকার পরবেনা। তাই, তা পণ্যের যোগ্যতা পাবেনা।

ব্যবহার মূল্য হচ্ছে পণ্যের এক আবশ্যিক শর্ত, কিন্ত একমাত্র শর্ত নয়। সকল ব্যবহারযোগ্য জিনিসই পণ্য নয়। উদাহারণস্বরূপ, বাতাস ও সূর্যালোক আমাদের বেঁচে থাকার মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিস, কিন্তু এগুলো শ্রমের ফসল নয়। এগুলো মুক্ত দ্রব্য, আর তাই পণ্য নয়। আবার, যদিও খাদ্যশস্য ও শাকসব্জি শ্রমের ফসল, সেগুলো যদি নিজ ভোগের জন্য উৎপাদন করা হয় তা পণ্য নয়। আবার কৃষক যে খাদ্যশস্য জমিদারকে খাজনা হিসেবে দেয় যদিও তা কৃষকের নিজের ভোগের জন্য নয়, জমিদার তার জন্য দাম শোধ করেনা, তাই তাকেও পণ্য বলা যাবেনা।

শ্রমের উৎপন্ন পণ্যে পরিণত হয় যদি তা বিনিময়ের মাধ্যমে অন্য মানুষের কাছে হস্তান্তরিত হয়। তাই, ব্যবহার মূল্যের সাথে সাথে পণ্যকে অন্য উৎপন্নের সাথে বিনিময়যোগ্যও হতে হবে। পণ্যের এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় বিনিময় মূল্য।

বিনিময় মূল্যকে প্রথমে এক ব্যবহার মূল্যের সাথে আরেক ব্যবহার মূল্যের সংখ্যাগত অনুপাত হিসেবে প্রকাশ করা হয়। উদাহারণস্বরূপ, এক ঝ্যাঙ (এক ঝ্যাঙ সমান প্রায় ৩.৬৪৫ গজ— বাংলা অনুবাদক) কাপড় বিনিময় হয় দুই হাও (এক হাও সমান প্রায় ৭.১৮ বর্গফুট— বাংলা অনুবাদক) চালের সাথে। দুই হাও চাল হচ্ছে এক ঝ্যাঙ কাপড়ের বদলে মূল্য।

দুটি পণ্যের সাংখ্যিক বিনিময় অনুপাত স্থান কাল ভেদে ভিন্ন হয়। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে এই অনুপাত সামগ্রিকভাবে একই। বিনিময় অনুপাতকে কী নির্ধারণ করে? অবশ্যই যদি বহুবিধ পণ্য বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় নিজেদের মধ্যে সাংখ্যিক অনুপাত প্রতিষ্ঠা করে, তাদের মধ্যে একটা সাধারণ জিনিস অবশ্যই আছে। সেই সাধারণ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই তাদের ব্যবহার মূল্য নয়। ব্যবহার মূল্যের দিক থেকে প্রত্যেক পণ্যই ভিন্ন প্রকৃতির। উদাহারণস্বরূপ, কাপড় দিয়ে কাপড় বানানো যায় আর ভাত আমাদের ক্ষুধা নিবারন করে। এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যবহার মূল্য, আর এদেরকে তুলনা করা যায়না। পণ্যগুলির মধ্যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য তাদের বিনিময় মূল্যের মধ্যে পাওয়া যাবে। আর, কাপড় হোক আর চালই হোক যখন তাদের ব্যবহার মূল্যকে অগ্রাহ্য করা হয়, তখন যে বৈশিষ্ট্যটা অবশিষ্ট থাকে তাহচ্ছে তারা উভয়ে শ্রমের ফসল। তাদের উৎপাদনের জন্য শ্রম দেওয়া হয়েছে। এই মূর্ত শ্রম মূল্য তৈরি করে। মূল্যকে তুলনা করা যায়, আর তাই পণ্যসমূহকে পরিমাণ হিসেবে তুলনা করা যায়। এক ঝ্যাঙ কাপড়কে দুই হাও চালের সাথে তুলনা করা যায় এই সত্যটা এটাই তুলে ধরে যে তাদের উৎপাদন সম পরিমাণ শ্রম দিয়ে হয়। ফলত, তাদের মূল্য সমান। বিনিময় মূল্য তাই মূল্য দিয়ে নির্ধারিত হয়। বিনিময় মূল্য হচ্ছে মূল্যের প্রকাশ। মূল্য নিজেই হচ্ছে বিনিময় মূল্যের ভিত্তি।

ব্যবহার মূল্য ও মূল্য হচ্ছে পণ্যের দুই বৈশিষ্ট্য। তারা পণ্যের দুই উপাদান গঠন করে। ব্যবহার মূল্য হল মূল্যের বস্তুগত সামর্থ্য। কোন পণ্যের যদি কোন ব্যবহার মূল্য না থাকে, তার মধ্যে যত শ্রমই দেওয়া হোক, কোন মূল্য গঠিত হবেনা। আর তা অন্য শ্রমের উৎপাদের সাথে বিনিময়ে পণ্যও হবেনা। একইসাথে, শ্রম দিয়ে সৃষ্ট ব্যবহার মূল্যই কেবল পণ্যের ব্যবহারিক মূল্য হতে পারে। এমনকি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পরম অপরিহার্য বাতাস ও সূর্যালোকের মত জিনিসও পণ্য হতে পারেনা যদিনা এর মধ্যে শ্রম প্রযুক্ত হয়।

পণ্যের দ্বৈত চরিত্র পণ্য উৎপাদনে প্রযুক্ত শ্রমের দ্বৈত চরিত্রের দ্বারা নির্ধারিত হয়

পণ্যের দ্বৈত চরিত্র কোথা থেকে আসে? আমরা যখন উৎসের দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাই যে পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত শ্রমের রয়েছে দ্বৈত চরিত্রঃ এটা একদিকে মূর্ত শ্রম দিয়ে গঠিত, আরেক দিকে বিমূর্ত শ্রম দিয়ে গঠিত।

বহুবিধ ব্যবহার মূল্য উৎপাদন করতে মানুষকে বহুবিধ উদ্যেশ্যমূলক উৎপাদন কর্মকান্ডে নিয়োযিত হতে হয়। উদাহারণস্বরূপ, ছুতাররা টেবিল তৈরি করে, আর কৃষকরা ফসল ফলায়। তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ হাতিয়ার, বস্তুসামগ্রী ও পদ্ধতি রয়েছে। কৃষকদের শ্রমের মধ্যে রয়েছে বহুবিধ কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে চাষ দেয়া, নিড়ানি দেয়া, চারা রোপন করা, ফসল কাটা আর শেষে খাদ্যশস্য প্রস্তুত করা। বিভিন্ন মূর্ত রূপে প্রযুক্ত এই শ্রমকে বলা হয় মূর্ত শ্রম। মূর্ত শ্রম ব্যবহার মূল্য সৃষ্টি করে। পণ্যের জন্য বহু বিভিন্ন ব্যবহার মূল্য রয়েছে। তেমনি পণ্য উৎপাদনে বিভিন্ন ধরণের মূর্ত শ্রম রয়েছে। বহুবিধ ব্যবসা ও পেশার মূর্ত শ্রম ভিন্ন ভিন্ন, যা হচ্ছে শ্রমের জটিল বিভাজনের প্রকাশ।

বহুবিধ মূর্ত শ্রম হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির, আর তাদের মধ্যে তুলনা করা যায়না। কিন্তু বাজারে বহুবিধ উৎপন্নের মধ্যে তুলনা চলে। তাই দেখা যায়, পণ্য উৎপাদনে যে শ্রম দেয়া হয় তার মধ্যে পার্থক্যের দিক যেমন রয়েছে, তেমনি মিলের দিকও রয়েছে।

মিলটা কী? এটা এই সত্যের মধ্যে রয়েছে যে ভিন্ন ভিন্ন পণ্য উৎপাদনে যদিও ভিন্ন ভিন্ন ধরণের শ্রম রয়েছে, মূলত তা হচ্ছে দৈহিক ও মানসিক শ্রমের প্রয়োগ। এর মূর্ত বৈশিষ্ট্য থেকে নিংড়ে নেয়া এই সমসত্ত্ব শ্রমকে বলা হয় বিমূর্ত শ্রম। পণ্যের মূল্য বিমূর্ত শ্রম দিয়ে সৃষ্ট। আগে আমরা বলেছি যে পণ্যে মূর্ত শ্রমই মূল্য সৃষ্টি করে। এখন, শ্রমের দ্বৈত চরিত্র বিশ্লেষণ করে আমরা মূল্যের অর্থ সম্পর্কে অধিক স্পষ্ট নির্দিষ্ট হতে পারি। মূল্য হচ্ছে পণ্যে মূর্ত হওয়া বিমূর্ত শ্রম।

মূর্ত শ্রম আর বিমূর্ত শ্রম ভিন্ন দুই ধরণের শ্রম নয়। তারা স্রেফ একই শ্রমের দুই দিক। বহুবিধ প্রয়োজন মেটানোর জন্য বহুবিধ ব্যবহার মূল্য উৎপাদন করতে মানুষকে বহুবিধ ধরণের মূর্ত শ্রমে নিয়োযিত হতে হয়। মূর্ত শ্রম মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্ক প্রকাশ করে। অন্যদিকে, বিমূর্ত শ্রম হচ্ছে বহুবিধ পণ্য উৎপাদনে প্রযুক্ত শ্রমকে তুলনা করতে এক ঐক্যবদ্ধ মাপকাঠি। তাই, বিমূর্ত শ্রম সেই সামাজিক সম্পর্ক প্রকাশ করে যার মধ্যে পণ্য উৎপাদনের পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে শ্রম বিনিময় হয়।

পণ্যের মূল্য সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের দ্বারা নির্ধারিত হয়

পণ্যের মূল্য শ্রমের দ্বারা সৃষ্ট হয়। এর স্তর নির্ধারিত হয় পণ্যের উৎপাদনে প্রযুক্ত শ্রমের দ্বারা। আর শ্রমের পরিমাণ নির্ধারিত হয় শ্রমসময় দ্বারা। একটি পণ্যের উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্রম সময় যত দীর্ঘ হবে শ্রমের পরিমাণও তত বেশি, আর মূল্যও তত উচ্চতর।

এর অর্থ কি এই যে, অলসতর ও অধিকতর অদক্ষ লোক যে পণ্য উৎপাদন করে তা বেশী মূল্যবাণ হবে? অবশ্যই তা নয়।

একটি নির্দিষ্ট পণ্য উৎপাদনের জন্য অনিবার্য কারণে একেকজন পণ্য উৎপাদকের জন্য একেক শ্রম সময় দরকার পরে। কেউ অন্যদের চেয়ে বেশী দক্ষ। আবার কেউ অন্যদের চেয়ে ভাল হালহাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। তুলনামূলক অদক্ষ ও যারা স্থূল হালহাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তাদের চেয়ে যারা অধিকতর দক্ষ ও তুলনামূলক ভাল হালহাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তাদের স্বাভাবিকভাবে কম সময় লাগবে। তাহলে, কোন শ্রমসময় ব্যবহার করা উচিত হবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে?

পণ্য উৎপাদনে ভিন্ন ভিন্ন পণ্য উৎপাদক যে শ্রম সময় দেন তাকে বলা হয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত শ্রম সময়। উদাহারণস্বরূপ, কিছু ছুতার একটা টেবিল বানাতে সময় নেয় ত্রিশ ঘন্টা, কেউ কেউ সময় নেয় পঁচিশ ঘন্টা, আর অন্যরা বিশ ঘন্টা। এগুলো সবই স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত শ্রমসময়। পণ্যের মূল্য স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত শ্রমসময় দ্বারা নির্ধারিত হয়না, বরং তা নির্ধারিত হয় সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের দ্বারা। “সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম হচ্ছে এমন শ্রমসময় যা উৎপাদনের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ঐ কালের গড়পরতা প্রচলিত দক্ষতা ও তীব্রতা দ্বারা কোন ব্যবহার মূল্য উৎপাদনে প্রয়োজন হয়।”(২) যদি স্বাভাবিক উৎপাদন পরিস্থিতিতে ও গড়পরতা দক্ষতা ও তীব্রতা দ্বারা টেবিলটি তৈরি করতে পঁচিশ ঘন্টা সময় লাগে তাহলে পঁচিশ ঘন্টা হচ্ছে টেবিলটি বানাতে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম। পঁচিশ ঘন্টা শ্রম হচ্ছে টেবিলটির মূল্য নির্ধারক সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম।

আমরা যখন মূল্য নির্ধারক শ্রমের কথা বলি, আমাদের শুধু স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত শ্রম ও সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের মধ্যে পার্থক্য করলেই চলবেনা, সরল শ্রম ও জটিল শ্রমের মধ্যেও পার্থক্য করতে হবে। সরল শ্রম হচ্ছে সেইটা যা একজন স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যবাণ ব্যক্তি কোন বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াই করতে পারে। জটিল শ্রম হচ্ছে সেই শ্রম যা  বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শ্রমিক করে থাকেন। তাই, একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে সরল শ্রমের সৃষ্ট মূল্য জটিল শ্রমের সৃষ্ট মূল্যের চেয়ে কম। জটিল শ্রম হচ্ছে সরল শ্রমের গুণিতক। বিনিময় প্রক্রিয়ায় স্বতস্ফূর্তভাবে জটিল ও সরল শ্রমের মধ্যে রূপান্তর করা হয়।

ব্যক্তিগত শ্রম ও সামাজিক শ্রমের মধ্যে দ্বন্দ্ব হচ্ছে পণ্য উৎপাদনের মূল দ্বন্দ্ব

আমরা উপরে পণ্য উৎপাদনে পণ্যের দ্বৈত চরিত্র, শ্রমের দ্বৈত চরিত্র আর পণ্যের মূল্যের বিশ্লেষণ করেছি। আমরা পণ্য উৎপাদনের দ্বন্দ্বকে আরো বিশ্লেষণ করতে পারি।

শ্রমের উৎপন্নের বিনিময় হিসেবে পণ্য ব্যবহৃত হয়। পণ্য উৎপাদকরা পণ্য উৎপাদন করে তাদের নিজেদের প্রয়োজন থেকে নয়, বরং তাদের যে পণ্য দরকার তার বিনিময়ে বিক্রয়ের জন্য। যেমন, কামার নিড়ানী তার নিজের প্রয়োজনের জন্য উৎপাদন করেনা। বিনিময় করে তার যে ভাত ও কাপড় প্রয়োজন তার জন্য যে মূল্য দরকার সেই মূল্যের নিড়ানী বিক্রয় করা তার উদ্দেশ্য। পণ্য উৎপাদকের পরম চিন্তা হচ্ছে তার পণ্য বিক্রি হবে কি না।

পণ্য হচ্ছে দুই বিপরীত—ব্যবহার মূল্য ও মূল্য—এর একত্রীকারক। মূর্ত শ্রম ও বিমূর্ত শ্রমও পণ্য উৎপাদনে বিপরীতের একত্ব। তারা পণ্যের ভেতর ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু তারা বিপরীতও। পণ্য বিক্রয় হলে তাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সমাধা হয়। যখন একটি নিড়ানী সেই কৃষকের হাতে পৌঁছায় যার এটা প্রয়োজন, তখন মূর্ত শ্রম বিমূর্ত শ্রমে রূপান্তরিত হয়, আর কামার তার নিড়ানীর মূল্য পায়। নিড়ানীর ব্যবহার মূল্য ও মূল্যও ঐক্যবদ্ধ হয়। কিন্তু যদি পণ্য বিক্রয় না হতে পারে, ব্যবহার মূল্য ও মূল্যের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব, আর মূর্ত ও বিমূর্ত শ্রমের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব তৎক্ষণাৎ উন্মোচিত হয়। যদিও নিড়ানী আবশ্যিকভাবে ব্যবহার মূল্য ধারণ করে, বিক্রী না হলে এর মূল্য বাস্তবায়িত হবেনা আর নিড়ানী হয়ে দাঁড়াবে এক বর্জ্য। সেক্ষেত্রে, কামারের মূর্ত শ্রম যাকিনা দৈহিক ও মানসিক শ্রম, তাকে বিমূর্ত শ্রমে রূপান্তরিত করা যাচ্ছেনা। অন্যকথায়, তার শ্রম সমাজের দ্বারা স্বীকৃত হয়নি আর তাই নিষ্ফলার মত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, কামারের উৎপাদন করার জন্য কাঁচা লোহা ও কাঠকয়লা কেনার কোন উপায় থাকবেনা। তার কোনভাবেই বেঁচে থাকার জ্বালানী, চাল, তেল ও লবন কেনার উপায় থাকবেনা। ব্যবহার মূল্য ও মূল্যের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব আর মূর্ত ও বিমূর্ত শ্রমের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সরাসরি পণ্য উৎপাদকের উৎপাদন ও জীবন-জীবিকার উপর চাপে।

পণ্য উৎপাদনে কীভাবে এই দ্বন্দ্বসমূহ আবির্ভূত হয়? তাদের উৎস কোথায়? ব্যক্তিগত মালিকানায় পণ্য উৎপাদনে এক মৌলিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। তা হচ্ছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক শ্রমের মধ্যে দ্বন্দ্ব। যেহেতু পণ্য হচ্ছে বিনিময়ের জন্য শ্রমের উৎপাদ, আর যেহেতু উৎপাদক কর্তৃক সৃষ্ট ব্যবহার মূল্য নিজ চাহিদা মেটাতে নয় বরং সামাজিক চাহিদা মেটাতে, তাই পণ্য উৎপাদকের শ্রম হচ্ছে সামাজিক চরিত্রের। তা হচ্ছে সামাজিক শ্রমের অংশ। কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার পরিস্থিতির অধীনে, সে কতটুকু উৎপাদন করবে আর তার আয়ের আকার কতটুকু হবে তা উৎপাদকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই, পণ্য উৎপাদকের শ্রম ব্যক্তিগত শ্রমের চরিত্রকেও ধারণ করে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক শ্রমের মধ্যকার এই দ্বন্দ্বই হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানায় পণ্য উৎপাদনের সকল দ্বন্দ্বের উৎস। যখন ব্যক্তি উৎপাদকদের উৎপন্ন পণ্য বাজারে বিক্রয় হয়, তা দেখায় যে তার ব্যক্তিগত শ্রম সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে এবং সামাজিক শ্রমের অংশে পরিণত হয়েছে। যদি পণ্য বিক্রয় না হয়, পণ্য উৎপাদকের ব্যক্তিগত শ্রম সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হবেনা, আর তাই সামাজিক শ্রমে রূপান্তরিত হবেনা, পণ্য উৎপাদকের মূর্ত শ্রম বিমূর্ত শ্রমে রূপান্তরিত হবেনা, পণ্যের মূল্য তাই বাস্তবায়নও হবেনা।

মার্কসের মূল্যের শ্রম তত্ত্ব হচ্ছে উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বের ভিত্তি

শ্রমের দ্বৈত চরিত্র বিশ্লেষণ করে মার্কস দৃঢ়ভাবে মূল্যের শ্রম তত্ত্ব সৃষ্টি করেন। এই তত্ত্ব বৈজ্ঞানিকভাবে দেখিয়েছে যে মূর্ত শ্রম পণ্যের ব্যবহার মূল্য সৃষ্টি করে, যেখানে বিমূর্ত শ্রম পণ্যের মূল্য সৃষ্টি করে, আর শ্রম হচ্ছে মূল্যের একমাত্র উৎস। মার্কসের মূল্যের শ্রম তত্ত্ব হচ্ছে মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বের ভিত্তি, আর তা মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

মার্কসবাদী তত্ত্বের পরিচালনা পাওয়ার আগে সর্বহারা শ্রেণী তাদের দুঃখকষ্টের উৎস বুঝতে পারেনি আর তারা তাদের সংগ্রামের লক্ষ্যও বের করতে পারেনি। অনেকে ভুলভাবে মনে করে যে তাদের দুঃখকষ্টের কারণ হচ্ছে মেশিন, আর সংগ্রামের এক পদ্ধতি হিসেবে একসময় তারা মেশিন ভাঙতে শুরু করে। মার্কস সর্বহারা শ্রেণীর সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সারসংকলন করেন, আর উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব সৃষ্টি করে পুঁজিবাদী শোষণের গোপন কথা উন্মোচিত করেন। এটা সর্বহারা শ্রেণীকে উপলব্ধি করায় তার ঐতিহাসিক কর্তব্যকর্ম আর এই সত্য যে সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র দ্বারা পুঁজিবাদের প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেই কেবল তারা মুক্ত হতে পারে। মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব মূল্যের শ্রম তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। মূল্যের শ্রম তত্ত্ব ছাড়া উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারতনা।

মার্কসের মূল্যের শ্রম তত্ত্ব সর্বহারা বিপ্লবী আন্দোলনে তাত্ত্বিক পথ প্রদর্শন করেছে যেখানে বুর্জোয়া অর্থনীতিবীদরা যথাসাধ্য ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে মূল্যের যতরকম বিজ্ঞানবিরোধি তত্ত্ব আবিষ্কার করা যায় যাতে মূল্য ও শ্রমকে বিচ্ছিন্ন করা যায়, মার্কসের মূল্যের শ্রম তত্ত্বের বিরোধিতা করা যায় আর পুঁজিবাদী শোষণকে ঢেকে রাখা যায়।

স্থূল অর্থনীতিবীদদের মধ্যে মূল্যের উৎপাদন খরচ তত্ত্ব একদা খুব প্রচলিত ছিল। এই তত্ত্ব বলে যে উৎপাদন করতে যে খরচ হয় (উৎপাদনের উপায়ের মূল্য ও শ্রমের মজুরী) দিয়ে পণ্যের মূল্য নির্ণীত হয়। যদি সত্যিই উৎপাদন খরচের দ্বারা নির্ণীত হয়, তাহলে পণ্য বিক্রয় হলে পুঁজিপতিরা কেবল উৎপাদন খরচটাই বিনিময়ে পাবে। এইভাবে সে কীভাবে ধনী হবে? শ্রমিকদের শোষণ কোথায়? সুতরাং, ঐ স্থূল অর্থনীতিবীদেরা যারা প্রস্তাব করে যে মূল্য নির্ণীত হয় উৎপাদন খরচের দ্বারা, তারা আবশ্যিকভাবে ব্যাখ্যা করে যে মুনাফা হচ্ছে এক উচ্চতর ধরণের মজুরী, সংযমের পুরষ্কার আর ঝুঁকি নেয়ার পুরষ্কার। এটা বুর্শোয়াদের ফেরিওয়ালা হিসেবে তাদের কুৎসিত ভূমিকা পুরোপুরি উন্মোচিত করে দেয়।

বুর্শোয়া স্থূল অর্থনীতিবীদদের মধ্যে আরেকটি তত্ত্বঃ উপযোগিতা তত্ত্ব একসময় প্রচলিত ছিল। এই তত্ত্বমতে, পণ্যের মূল্য নির্ণীত হয় এটি যে পরিমাণ উপযোগিতা ধারণ করে তা দ্বারা। তাহলে “উপযোগ” কী? তা হল পণ্যের ব্যবহার মূল্য। আমরা আগেই বলেছি যে ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার মূল্য রয়েছে যা তুলনীয় নয়। একথা বলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক যে পণ্যের মূল্য তার ব্যবহার মূল্যের দ্বারা নির্ণীত হয়। মূল্যের উপযোগিতা তত্ত্ববিদেরা বুদ্ধি দ্বারা ব্যাখ্যা করতে পারেনা কেন মানব জীবনের বেঁচে থাকার জন্য জরুরী বাতাস ও সূর্যালোকের মত জিনিস কোন মূল্য ধারণ করেনা, আর তা পণ্য হিসেবে বিক্রীও করা যায়না।

বুর্শোয়া স্থূল অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আরেকটি জনপ্রিয় তত্ত্ব ছিল মূল্যের চাহিদা-যোগান তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অস্বীকার করে যে পণ্যের কোন উদ্দেশ্য আর অন্তর্নিহিত মূল্য আছে, আর মনে করে যে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় বাজারের চাহিদা-যোগান পরিস্থিতি দ্বারা। যখন কোন পণ্যের চাহিদার চেয়ে যোগান বেশি হয়, অন্য পণ্যের সাথে তার বিনিময় মূল্য হয় কম, আর তার মূল্য হয় কম। আর যখন যোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হয়, অন্য পণ্যের সাথে তার বিনিময় মূল্য হয় বেশি, তাই তার মূল্যও হয় বেশি। এই তত্ত্ব নিশ্চিতভাবে ভ্রান্ত। মূল্যের চাহিদা-যোগান তত্ত্ববিদেরা এই ব্যাখ্যা কোনভাবেই দিতে পারেনা যে যখন চাহিদা ও যোগান সমান হয় তখন পণ্যের মূল্য কী দিয়ে নির্ণীত হয়। আর এটাও তারা ব্যাখ্যা করতে পারেনা যে বিবিধ পণ্যের চাহিদা ও যোগানের পরিবর্তনশীল সম্পর্কের পরিস্থিতিতে কোন কোন পণ্য কেন অব্যাহতভাবে অন্যগুলির চেয়ে বেশী মূল্যবাণ হয়।

বুর্শোয়া অর্থনীতিবীদেরা মূল্যের শ্রম তত্ত্বকে নেতিকরণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালেও সত্যকে কখনো নেতিকরণ করা যায়না। বহুবিধ ছদ্ম বুর্শোয়া তত্ত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মূল্যের মার্কসবাদী তত্ত্ব একমাত্র সঠিক তত্ত্ব হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

অর্থ হচ্ছে পণ্য উৎপাদনের বিকাশের স্বাভাবিক ফল

অর্থ হচ্ছে সার্বজনীন তুল্যাংক হিসেবে কার্যকর বিশেষ পণ্য

অর্থ পণ্যের সাথে সম্পর্কিত কারণ প্রাত্যহিক জীবনে পণ্যের মূল্য অর্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। আর পণ্য অর্থ দিয়ে কেনা হয়। কিন্তু পণ্যের মূল্য শুরুতেই অর্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়নি। পণ্য উৎপাদন ও বিনিময়ের বিকাশের ফল হল অর্থ।

পণ্যসমূহের প্রত্যক্ষ বিনিময়কারী হিসেবে পণ্য বিনিময় শুরু হয়। শুরুতে যাযাবর উপজাতি ও কৃষি উপজাতিরা তাদের উদ্বৃত্ত উৎপন্ন বিনিময় করত। উদাহারণস্বরূপ চালের সাথে ভেড়া বিনিময় করা হত। সেসময়, পণ্যের বিনিময় হত মাঝে মাঝে আর তা হত গোত্র কমিউনগুলির মধ্যে। বিনিময়ের প্রক্রিয়ায়, হঠাৎ কখনো দেখা গেল একটি পণ্যের মূল্য অন্য পণ্যের সাথে সম্পর্কিতভাবে প্রকাশ করা হল। উদাহারণস্বরূপ, দুইটি ভেড়া এক ব্যাগ চালের সমান। ভেড়ার মূল্য নিজের সাথে নিজের তুলনা করে বের করা যেতনা, বরং যখন চালের সাথে ভেড়ার বিনিময় হল, চালের সাথে তুলনা করে ভেড়ার মূল্য প্রকাশ করা গেল। এই সমীকরণে চালের মত পণ্যসমূহ একটি “তুল্যাংক” এর বিশেষ ভূমিকা নিল। তারা এক আয়নার মত কাজ করল, আর তাদের মধ্যে অন্যান্য পণ্যের মূল্য প্রতিফলিত হল।

উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ আর শ্রমের সামাজিক বিভাজনের সাথে নিত্যদিন পণ্যের বিনিময় বাড়ল। বেশি বেশি পরিমাণ ও বহুবিধ ধরণের পণ্যের বিনিময় বাড়ল। বিনিময়ের প্রক্রিয়ায়, একটা পণ্যের সাথে অন্য বহু পণ্যের বাণিজ্য করা সম্ভব হল। এর মূল্য অন্য বহু পণ্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হল। একইসাথে, পণ্যের বিনিময়ের বিকাশের সাথে সাথে, খোদ পণ্য বনাম পণ্য বিনিময়ের অসুবিধা বেশি বেশি দেখা দিল। প্রত্যক্ষ বিনিময় তখনই হত যখন একপক্ষের দরকার পরত আরেকপক্ষের জিনিস। উদাহারণস্বরূপ, ভেড়ার মালিক খাদ্যশস্যের মালিকের সাথে খাদ্যশস্যের সাথে ভেড়া বিনিময় করতে চাইল, কিন্তু খাদ্যশস্যের মালিকের দরকার ছিল খাদ্যশস্যের বদলে একটা নিড়ানী। নিড়ানীর মালিকের দরকার বস্ত্র, ভেড়া বা খাদ্যশস্য নয়। আবার বস্ত্রের মালিকের দরকার ভেড়া, তাহলে ভেড়ার বিক্রেতাকে খাদ্যশস্য পেতে প্রথমে ভেড়া দিয়ে কাপড় নিতে হবে, তারপর কাপড় দিয়ে নিড়ানী নিতে হবে। আকাঙ্খিত বিনিময়টি অনেক জটিলতার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হল। যদি কাপড়ের মালিকের ভেড়া দরকার না পরত, তখন যতই উনি চেষ্টা করুন তিনি যা চাইতেন তা পেতেননা। তাই, পণ্য উৎপাদন যখন অধিক থেকে অধিক বাড়ল, প্রত্যক্ষ্য বিনিময় একেবারেই কঠিন হয়ে দাঁড়াল।

পণ্য বিনিময়ের প্রক্রিয়ায়, মানুষ ক্রমান্বয়ে অনুধাবন করল যে তারা যদি প্রথমে বিনিময় করত এমন একটি পণ্য (যেমন ভেড়া)-এর সাথে যা সকলেরই প্রয়োজন হয় আর তারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস নেয়ার জন্য বিনিময় করে, তাহলে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হত মাত্র দুটি বিনিময়ে। তাই, পণ্য বিনিময়ের দীর্ঘকালীন বিকাশের ধারায় ভেড়ার মত পণ্যগুলি অন্যান্য পণ্য থেকে আলাদা হয়ে গেল আর এমন ভূমিকা নিল যা অন্যগুলি নিতে পারেনা। তখন থেকে সকল পণ্যের মূল্য ভেড়ার তুলনায় প্রকাশিত হতে থাকল। আর ভেড়া পণ্য বিনিময়ে “সার্বজনীন তুল্যাংক”-এর ভূমিকা গ্রহণ করল।

পণ্য বিনিময়ের বিকাশের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়, বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ধরণের বিনিময়ের মাধ্যম ব্যবহার করেছে যার মধ্যে রয়েছে ভেড়া, মণিমুক্তা, কাপড় ও ধাতু। শেষে তারা অর্থ হিসবে সোনা ও রূপার মত মূল্যবাণ ধাতু ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিল কারণ এগুলো আকারে ছোট কিন্তু অনেক মূল্যবাণ, সহজে বহন করা যায়, যখন তখন বিভক্ত করা যায় আর নষ্ট হয়না। তাই তারা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে উপযোগী। তাই, সোনা ও রূপা মুদ্রা হিসেবে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য। লক্ষ্যনীয় যে, সোনা ও রূপার মুদ্রা হওয়ার কোন সহজাত গুণ নেই, বরং তা অর্জিত হয়। সোনা ও রূপা কিছু ঐতিহাসিক উৎপাদন সম্পর্কের অধীনে মুদ্রায় পরিণত হয়।

অর্থের উৎস থেকে আমরা বুঝতে পারি এর বৈশিষ্ট্যকে। বিনিময়ের এক মাধ্যম হিসেবে অর্থ হচ্ছে এক বিশেষ পণ্য যাকে অন্যান্য পণ্য থেকে আলাদা করা যায়।

অর্থের পাঁচ কার্যক্রম ধাপে ধাপে গড়ে উঠে

অর্থের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে তার বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়। অর্থের পাঁচটি কাজ রয়েছে যা পণ্য বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠে। এই পাঁচটি কাজ হচ্ছেঃ ১। মূল্যের একক হিসেবে কাজ করে ২। বিনিময়ের এক মাধ্যম ৩। পরিশোধের এক মাপকাঠি ৪। মূল্যের এক মজুদ ৫। এক সার্বজনীন মুদ্রা হিসেবে কাজ করা। এর মধ্যে মূল হচ্ছে মূল্যের একক হিসেবে আর বিনিময়ের এক মাধ্যম হিসেবে কাজ করা। কিন্তু অর্থের উদ্ভবের সাথেই এ সবেরই উদ্ভব হয়েছে।

অর্থের প্রথম কাজ হচ্ছে মূল্যের একক হিসেবে কাজ করা। যেমন একটি রুলার কোন জিনিসের দৈর্ঘ্য মাপার কাজে ব্যবহৃত হয়, অর্থও পণ্যের মূল্য পরিমাপের কাজে ব্যবহৃত হয়। মূল্যের পরিমাপ হিসেবে ব্যবহৃত অর্থ হচ্ছে ধারণাত্মক মুদ্রা। তার মানে হচ্ছে, পণ্যের মূল্য মূল্যায়ণ করতে যে মুদ্রা ব্যবহার করতে হবে তা হাতে না থাকলেও চলবে। উদাহারণস্বরূপ একটা টেবিলের দাম দশ ইউয়ান (ইউয়ান চীনের মুদ্রা— বাংলা অনুবাদক)। সেজন্য দশ ইউয়ান টেবিলের উপর রাখতে হবেনা। যখন পণ্যের মূল্য অর্থের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়, তা হচ্ছে পণ্যের দাম। পণ্যের দাম হচ্ছে মুদ্রা হিসেবে মূল্যের প্রকাশ। পণ্যের দাম দুই উপাদানের দ্বারা নির্ণীত হয়। এক, পণ্যের নিজের মূল্য, দুই, মুদ্রা (সোনা, রূপা)র মূল্য। পণ্যের দাম পণ্যের নিজের মূল্যের সমানুপাতিক আর অর্থের মূল্যের ব্যস্তানুপাতিক। উদাহারণস্বরূপ, একটি মহিষের মূল্য পাঁচশত ঘন্টার সামাজিক শ্রম, আর এক আউন্স সোনার মূল্য পাঁচশত ঘন্টার সামাজিক শ্রম। তাহলে মহিষটির দাম হচ্ছে এক আউন্স সোনা। স্বর্ণখনির উৎপাদনশীলতা যদি দ্বিগুণ হয়ে এক আউন্স সোনার মূল্য দুইশত পঞ্চাশ ঘন্টা সামাজিক শ্রম হয়, সেক্ষেত্রে মহিষের মূল্য না বাড়লেও তার দাম দ্বিগুণ হয়েছে।

অর্থের দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা, যথা সে পণ্যের সঞ্চালনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। পণ্য সঞ্চালন হচ্ছে অর্থের মারফত পণ্যের বিনিময়। অর্থের আবির্ভাবের আগে পণ্য বিনিময় হত সরাসরি। সূত্রায়িত করলে দাঁড়ায়, পণ্য = পণ্য। অর্থের উদ্ভবের পর, সকল পণ্য অর্থের মাধ্যমে বিনিময় হত। সূত্র দ্বারা প্রকাশ করলে দাঁড়ায়ঃ পণ্য = অর্থ = পণ্য। পণ্য সঞ্চালনে অর্থের ভূমিকা হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যম হল অর্থ।

বিভিন্ন আকৃতি ও ওজনের খণ্ড খণ্ড সোনা ও রূপা ছিল প্রথম দিকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে অর্থ। পরে তা ধাতব মুদ্রা (পয়সা) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। পয়সা ছিল স্রেফ পৃষ্ঠ দেশে ছাপ দেওয়া রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত সুষম আকৃতির, খাটিত্ব ও ওজনের ধাতব খণ্ড। বিভিন্ন দেশের ধাতব মুদ্রাসমূহ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। চীনের শ্যাঙ রাজবংশের রাজত্বকালের শেষাংশে কপার দিয়ে ধাতব মুদ্রা বানান শুরু হয়। সবচেয়ে প্রাচীন ধাতব মুদ্রা ছিল কপারনির্মিত যার আকৃতি ছিল কৃষি যন্ত্রপাতির মত। সেগুলো পু চিয়েন নামে পরিচিত ছিল। চৌ রাজবংশের রাজত্বকালে, পু চিয়েন ছাড়াও ছিল তাও চিয়েন ও ইউয়ান চিয়েন। ইন ইউয়ান (রূপার ডলার) প্রথম নির্মিত হয় চিং রাজত্বের কুয়াঙ-শু সময়কালে। প্রতিটি ইন ইউয়ান ০.৭২ আউন্স রূপা দিয়ে গড়া ছিল।

সঞ্চালনের প্রক্রিয়ায়, পয়সা জীর্ণ হয়ে যায়, তার আংশিক মূল্য হারিয়ে যায়। তারপরও পয়সার পুরো মূল্যই তখনো গৃহীত হত। এর কারণ হল বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার কার্যকারিতা ছিল তৎক্ষণাৎ। মানুষ স্রেফ তার প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কিনতে নিজেদের পণ্য বিনিময় করে। পণ্য মালিকের মূল চিন্তা হল মুদ্রার পূর্ণ মূল্য আছে কিনা তা নয় বরং সেটা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কিনা। সেকারণেই, জীর্ন পয়সা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায় তাই শুধু নয়, এমনকি কাগজের নোটের রূপে মূল্যের প্রতীক তার স্থান দখল করতে পারে।

যেহেতু পণ্য বিনিময়ে ধাতব মুদ্রার জায়গায় কাগজের মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে, তাই কাগজের মুদ্রার পরিমাণ সীমাবদ্ধ থাকে পণ্য সঞ্চালনের জন্য যতটুকু ধাতব মুদ্রা প্রয়োজন হয় ততটুকু। মার্কস বলেনঃ “ইস্যুকৃত কাগজের মুদ্রা, যা হচ্ছে প্রকৃত মুদ্রার টোকেন অথবা প্রতীক, তার মূল্য হচ্ছে পণ্য সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় সোনা (অথবা রূপা)র সমান।”(৩) ইস্যুকৃত কাগজের মুদ্রার মূল্য পণ্য সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় ধাতব মুদ্রার সমান হলে, কাগজের মুদ্রা ধাতব মুদ্রার একই সমান ক্রয়ক্ষমতা ধারণ করবে। যখন পণ্য সঞ্চালনে প্রয়োজনীয় ধাতব মুদ্রার পরিমাণের চেয়ে কাগজের মুদ্রা বেশী ইস্যু করা হয়, তখনো উক্ত মোট কাগজের মুদ্রার মূল্য ঐ পণ্য সঞ্চালনের প্রয়োজনীয় ধাতব মুদ্রার মূল্যের সমান, তবে প্রতিটি কাগজের মুদ্রার একক মূল্য ধাতব মুদ্রার তুলনায় নীচে নেমে যাবে। সেক্ষেত্রে, কাগজের মুদ্রার মূল্য কমবে আর পণ্যের দাম বাড়বে। উদাহারণস্বরূপ, যদি একটি নির্দিষ্ট সময়কালে, সঞ্চালনের জন্য ধাতব মুদ্রা প্রয়োজন ১০ কোটি ইউয়ান, কিন্তু কাগজের মুদ্রায় তার প্রয়োজন ২০ কোটি ইউয়ান, তাহলে কাগজের মুদ্রার মূল্য অর্ধেক হয়ে যাবে। তাহলে, এক ইউয়ান কাগজের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হবে ০.৫ ইউয়ান ধাতব মুদ্রার সমান।

সঞ্চালনে প্রয়োজনীয় ধাতব মুদ্রার চেয়ে বেশী পরিমাণ কাগজের মুদ্রা ছাড়ার পরিণতিতে কাগজের মুদ্রার অবনতিকে বলা হয় মূল্যস্ফীতি। পুঁজিবাদী সমাজে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় যা দ্বারা বুর্শোয়ারা জনগণকে লুন্ঠন করে। মূল্যস্ফীতির পরিণতি হচ্ছে কাগজের মুদ্রার মূল্য সংকোচন আর জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি। অন্যদিকে, শ্রমিকদের টাকায় মজুরির বৃদ্ধি জিনিসপত্রের দামের অনেক পেছনে পরে থাকে, যার ফল হিসেবে প্রকৃত মজুরি আর তাদের জীবনযাত্রার মানের ঘটে অবনতি। সেইসাথে, বুর্শোয়াদের শোষণমূলক আয় বাড়ে দ্রুতগতিতে।  পুরোনো চীনে, বৈধ দরপত্রের ইস্যু আকাশছোঁয়া হয়ে দাঁড়ায়, ফল হয় বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতি আর দামের বিরাট উলম্ফন। কিছু লোক একবার হিসেব করে দেখেছেন যে ১৯৩৭ সালের ১০০ ইউয়ান দরপত্রের ক্রয়ক্ষমতা ছিল দুটি মহিষ, ১৯৩৮-এ একটি মহিষ, ১৯৪১-এ একটি শুকর, ১৯৪৭-এ এ এক বাক্স দিয়াশলাই আর ১৯৪৮-এ এক বাক্সের তিন ভাগের একভাগ দিয়াশলাই কেনার সক্ষমতাও ছিলনা।

অর্থের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে হচ্ছে সঞ্চয়ের উপায়। পণ্যের অর্থ সম্পর্কের বিকাশ অধিক থেকে অধিকভাবে অর্থকে সামাজিক সম্পদের এক প্রতীকে পরিণত করে। যখন প্রাকৃতিক অর্থনীতি এক আধিপত্যকারী ভূমিকা পালন করে তখন সম্পদের পুঞ্জীভবন খাদ্যশস্য, বস্ত্র ও রেশম দ্রব্যসামগ্রীর রূপ নেয়। পণ্যের অর্থ সম্পর্ক গড়ে উঠার পর, যেহেতু অর্থকে যেকোন পণ্য কেনায় কাজে লাগানো যায়, সম্পদের পুঞ্জীভবন বেশি বেশি অর্থ সঞ্চয় (সোনা ও রূপা)-এর রূপ গ্রহণ করল। এই যে অর্থ যা অস্থায়ীভাবে পণ্য সঞ্চালন থেকে বেরিয়ে এসে তার মালিক কর্তৃক সঞ্চিত হয়েছে তাই হল সঞ্চিত অর্থ। এটা সঞ্চয়ের একটা উপায় হিসেবে কাজ করে।

অর্থের চতুর্থ কাজ হচ্ছে এটা পরিশোধের এক উপায়। পণ্য উৎপাদন ও বিনিময়ের বিকাশের সাথে, ধারে লেনদেন বেশি বেশি বাড়তে থাকে। যখন কোন পরিশোধযোগ্য ঋণ আছে তাকে অর্থ দ্বারা পরিশোধ করতে হত। কিন্তু সেসময় পণ্য বিনিময় ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, এখানে অর্থ আর বিনিময়ের মাধ্যম নয় বরং পরিশোধের একটা উপায়। পরিশোধের উপায় হিসেবে পণ্য উৎপাদকদের মধ্যে অর্থ প্রথম ব্যবহৃত হয় ঋণ শোধ করার জন্য। পরে এর ব্যবহার পণ্য সঞ্চালনের ক্ষেত্রকে ছাপিয়ে যায়। এই কার্যকারিতা খাজনা, সুদ ও কর পরিশোধের জন্যও ছিল নির্ধারক।

অর্থের পঞ্চম কাজ হচ্ছে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে এর ব্যবহার। পণ্য বিনিময় রাষ্ট্রের পরিধি ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক বানিজ্যের জন্ম দিল আর অর্থের নতুন কার্যকরিতা জন্ম দিল যা হচ্ছে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে কার্যকরিতা। সোনা ও রূপাই কেবল বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে কাজ করতে পারত।

বিশ্ববাজারে, সোনা প্রথমে আন্তর্জাতিক হিসাব নিকাশ করার জন্য পরিশোধের উপায় হিসেবে কাজ করে। বৈশ্বিক মুদ্রার এটা ছিল প্রধান কাজ। তারপরে, বিশ্ববাজারে সোনা বহুবিধ পণ্যসামগ্রী কিনতে পরিশোধের উপায় হিসেবেও কাজ করে। সবশেষে, সোনা এক দেশ থেকে আরেক দেশে স্থানান্তর করা হয় সামাজিক সম্পদের প্রতীক হিসেবে। উদাহারণস্বরূপ, এক দেশ থেকে আরেক দেশে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ, পুঁজি রপ্তানী আর সোনা ও রূপার অন্যান্য স্থানান্তর এই কাজ করে।

অর্থের উপরেল্লেখিত কার্যকারিতা মূলগতভাবে এর বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত ও তার বিভিন্ন প্রকাশ। পণ্য সঞ্চালনের বিকাশে সার্বজনীন তুল্যাংক যে বিভিন্ন ভূমিকা গ্রহণ করে এগুলো তারই প্রকাশ।

মূল্যতত্ত্ব হচ্ছে পণ্য উৎপাদনের অর্থনৈতিক নিয়ম

মূল্যতত্ত্বের বিষয়গত প্রয়োজন হচ্ছে বিনিময়ে সমতুল্যতা

মূল্যতত্ত্ব হচ্ছে পণ্য উৎপাদন ও বিনিময়ের অর্থনৈতিক নিময়। এই নিয়মের মূল সার হচ্ছেঃ পণ্যের মূল্য নির্ণীত হয় সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের দ্বারা। পণ্যকে অবশ্যই তার মূল্য অনুসারে বিনিময় করতে হবে। অর্থাৎ বিনিময়ে সমতুল্যতা থাকতে হবে। যেখানে যখন পণ্য অর্থনীতি বিদ্যমান, সেখানেই মূল্যতত্ত্বের ভূমিকা আছে। মার্কস বলেন, “ব্যক্তিগত শ্রম উৎপন্নের নৈরাজ্যিক ও অব্যাহত পরিবর্তনশীল ব্যবসায়িক সম্পর্কের মধ্যে উৎপাদনের সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমসময় প্রকৃতির এক পরিচালক নিয়ম হিসেবে বলপ্রয়োগে নিজের পথ পরিষ্কার করে, যেমন যখন কারো মাথার উপর ঘর ভেঙে পড়ে, অভিকর্ষ বল বলপূর্বক নিজের পথ পরিষ্কার করে নেয়।”(৪) অন্যকথায়, পণ্য বিনিময়ে যদিও চাহিদা-যোগান সম্পর্কের প্রভাবে পণ্য বিনিময়ের অনুপাত অব্যাহতভাবে পরিবর্তিত হতে পারে যাতে বিনিময়রত দুটি পণ্যের মধ্যে মূর্ত সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম (মূল্য) একেবারে সমানভাবে বিমিময় নাও হতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত, পণ্য বিনিময় আবশ্যিকভাবে বিনিময়ে সমতুল্যতা আনে। বিনিময়রত মূল্যগুলিকে অবশ্যই সমতুল্য হতে হবে।

কেন বিনিময়ে সমতুল্যতা পণ্য বিনিময়ে এক বস্তুগত প্রবণতা? কারণ পণ্য উৎপাদকেরা চিন্তায় থাকে তাদের পণ্যের সাথে অন্যদের কতটুকু পণ্য বিনিময় হবে। চাহিদা-যোগান সম্পর্কের প্রভাবের কারণে পণ্যগুলির বিনিময় অনুপাতে অব্যাহত পরিবর্তন ঘটে। মানুষ লাভজনক পণ্যের উৎপাদন বাড়ায় আর কম লাভজনক পণ্যের উৎপাদন কমায়। ফলে লাভজনকগুলির যোগান চাহিদাকে ছাপিয়ে বিনিময় মূল্য কমিয়ে দেয়, আর কম লাভজনকগুলির যোগান চাহিদার চেয়ে কমে বিনিময় মূল্য বাড়িয়ে দেয়। যে অনুপাতে পণ্য বিনিময় হয় তার এই অব্যাহত পরিবর্তন বিনিময়ে সমতুল্যতা প্রদর্শন করে—এটা হচ্ছে একটা বস্তুগত নিয়ম যা মানুষের ইচ্ছা নিরপেক্ষ।

অর্থের উদ্ভবের সাথে, সকল পণ্য বিনিময় মাধ্যম হিসেবে অর্থের উপর নির্ভর করে। মূল্য দামে প্রকাশিত হয়। মূল্যের নিয়মের প্রয়োজন হল বিনিময়ে সমতুল্যতা। অন্যকথায়, তার প্রয়োজন হল মূল্য ও দামের সমতুল্যতা আনয়ন। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে মূল্য ও দামের মধ্যে সমতুল্যতাকে একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা হিসেবে দেখতে হবে। বস্তুত, ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে পণ্য অর্থনীতি, যেখানে উৎপাদন সমন্বয়হীন, বাজারে পণ্যের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে অব্যাহত ভারসাম্যহীনতা থাকে যা দামের অব্যাহত উঠানামা ঘটায়। যদিও চাহিদা-যোগান সম্পর্কের পরিবর্তন দামের উঠানামা ঘটায়, সর্বদাই এই উঠানামা মূল্যের ভারসাম্যকেন্দ্রীক হয়। তাই, চাহিদা ও যোগান সম্পর্কের প্রভাবে দাম ও মূল্যের অসমতুল্যতা মূল্যের নিয়মের নেতিকরণ করেনা, বরং এটা হচ্ছে একটা প্রয়োজনীয় ধরণ যার মাধ্যমে মূল্যের নিয়ম কাজ করে।

মূল্যতত্ত্বের তিন কাজ যা বাজারের প্রতিযোগিতার প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত হয়

ব্যক্তিগত মালিকানাধীন পণ্য উৎপাদনে মূল্যের নিয়মের তিন কার্যকারিতা আছে। এই কার্যকারিতা বাজারের প্রতিযোগিতার স্বতস্ফূর্ত শক্তির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।

প্রথম, মূল্যতত্ত্ব উৎপাদনের নিয়ন্ত্রক। তা উৎপাদনের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার মধ্যে সামাজিক শ্রম ও উৎপাদনের উপায়ের বন্টনকে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে পণ্য উৎপাদন সংঘটিত হয় প্রতিযোগিতা ও নৈরাজ্যের পরিস্থিতিতে। সমাজের কতটুকু কী প্রয়োজন তা কেউ জানেনা। কিন্তু কিছু ক্রম, বিন্যাস ও বরাদ্দ প্রয়োজন হয় সামাজিক উৎপাদন চালিয়ে যেতে। এই বরাদ্দ ও বিন্যাস মূল্যের নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় আর বাস্তবায়িত হয় বাজার দামের উঠানামার স্বতস্ফূর্ত প্রভাবে। যদি কোন পণ্যের যোগান চাহিনুসারে না হয় তবে তার দাম তার মূল্যের চেয়ে বেশী হবে, আর উক্ত পণ্যের উৎপাদন বিশেষভাবে লাভজনক হবে। এই পণ্যের উৎপাদন এভাবে বাড়বে। এর বিপরীত যদি ঘটে, তবে তার দাম তার মূল্যের চেয়ে কম হবে, আর তার উৎপাদন কমে যাবে। ঠিক এভাবেই মূল্যের নিয়ম পণ্য উৎপাদকদের কর্মকান্ডকে পরিচালিত করে, আর বহুবিধ উৎপাদন সেক্টরের মধ্যে শ্রম ও উৎপাদনের উপায়ের বন্টন নিয়ন্ত্রণ করে।

ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক পণ্য অর্থনীতিতে যদিও মূল্যের নিয়ম দ্বারা সামাজিক উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ কিছু ধারা আরোপ করে, সেসব ধারা নৈরাজ্যের পরিস্থিতিতে অর্জিত হয়। অন্ধ প্রতিযোগিতা দ্বারা তা অব্যাহতভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, আর পুনরায় নতুন একটি ধারা স্বতস্ফূর্তভাবে গঠিত হয়। এই ধরণের ধারা বিপুল শ্রমের অপচয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন মার্কস বলেন, “এই ধারাহীন গতিই হচ্ছে এর ধারা।”(৫)

দ্বিতীয়, মূল্যের নিয়ম উৎপাদন কৌশল ও শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে উদ্দীপনা দেয়। একক সময়ে যে পরিমাণ উৎপন্ন হয় তার দ্বারা শ্রম উৎপাদনশীলতা মাপা হয়। এই সূত্রটির মাধ্যমে তাকে প্রকাশ করা হয়ঃ

শ্রম উৎপাদনশীলতা = উৎপন্নের পরিমান ÷ শ্রম সময়

শ্রম উৎপাদনশীলতা বহু উপাদানের সাহায্যে নির্ণয় করা হয়। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শ্রমের দক্ষতা, প্রযুক্তির অবস্থা ও উৎপাদনে তার প্রয়োগ, আর শ্রম বিভাগ ও সহযোগিতার পরিমাণ। মূল্যের নিয়মের বস্তুগত প্রয়োজন অনুসারে, পণ্য বিক্রয় হয় সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের দ্বারা নির্ধারিত মূল্যের অনুসারে। তাই, যে বেশী দক্ষ ও কার্যকর আর সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের চেয়ে কম ব্যবহার করে, সে বেশী মুনাফা পাবে। এটা পণ্য উৎপাদককে তার উৎপাদন কৌশল ও শ্রম উৎপাদনশীলতা উন্নত করার দিকে মনোযোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার অধীনে, পণ্য উৎপাদক তার উৎপাদন কৌশল উন্নত করে উচ্চতর মুনাফা অর্জন করতে। যারা নতুন কৌশল ধারণ করবে স্বাভাবিকভাবে তা তারা গোপন করবে। এই পরিস্থিতির অধীনে, সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ব্যাহত হয়।

তৃতীয়, মূল্যের নিয়ম পণ্য উৎপাদকদের মধ্যে মেরুকরণ ঘটায়। এর কারণ হল ভিন্ন ভিন্ন পণ্য উৎপাদকদের উৎপাদন পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন। একেকটা পণ্য উৎপাদনে একেকজনের শ্রম সময় ব্যাপকভাবে ভিন্ন হয়। কিন্তু মূল্যের নিয়ম দাবি করে পণ্য বিক্রয় হতে হবে সামাজিকভাব প্রয়োজনীয় শ্রমের দ্বারা নির্ণীত মূল্য অনুসারে। এভাবে, তুলনামূলক ভাল উৎপাদন সুবিধাদিযুক্ত আর সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমসময়ের চেয়ে কম শ্রম সময় যাদের লাগে এমন পণ্য উৎপাদকদের অধিকতর লাভ হবে আর দ্রুতগতিতে উন্নতি হবে। আর তুলনামূলক খারাপ উৎপাদন সুবিধাদি আছে ও সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমসময়ের চেয়ে বেশী শ্রমসময় যাদের লাগে এমন পণ্য উৎপাদকেরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেনা। এভাবে, পণ্য উৎপাদকদের মধ্যে মেরুকরণ অনিবার্য।

পণ্য পুঁজার রহস্য উন্মোচন করুন

পুঁজা উৎসগতভাবে ধর্মের সাথে জড়িত যাতে মানুষ এমন জিনিসের আরাধনা করে যার রহস্যময় ক্ষমতা আছে বলে তারা বিশ্বাস করে। যখন সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির স্তর ছিল নিচু আর প্রকৃতির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছিল দূর্বল, তারা প্রাকৃতিক শক্তিকে রহস্যময় বানিয়ে ফেলে। তারা বজ্র, আলো, পানি, আগুণ ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তিকে মনে করে এরা কিছু দেবতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই তাদের পুঁজা করে। ব্যক্তিগত মালিকানার অধীনে পণ্য অর্থনীতিতেও এটা ঘটে। পণ্যসমূহ মানুষের দ্বারা তৈরি হলেও, এরা দেবতা হিসেবে পুঁজিত হয়, আর মনে করা হয় যে এদের হাতে রয়েছে মানুষের ভাগ্য। মার্কস এই ব্যাপারটাকে বলেন পণ্য পুঁজা।

কীভাবে পণ্য পুঁজা জন্ম নিল?

ব্যক্তিগত মালিকানার অধীনে পণ্য উৎপাদনে, মানুষে মানুষে সম্পর্ক পণ্য সম্পর্কে প্রকাশিত হয়। পণ্যকে এমনভাবে দেখা হয় যেন তারা মানুষের উপরে, তাদের প্রভু। পণ্য উৎপাদকদের ভাগ্য পণ্যের ভাগ্যের সাথে সম্পূর্ণভাবে জড়িত। তার ভাগ্য সম্পূর্ণভাবে নির্ধারিত হয় পণ্যগুলো আদৌ বিক্রয় হবে কিনা বা হলে কত ভালভাবে তা হবে তা দ্বারা। যদি এই পণ্যগুলো লাভজনক দামে বিক্রয় হয়, পণ্য উৎপাদকেরা ধনী হয়ে যাবে। আর যদি তা বিক্রয় না হয় অথবা খুব কম দামে বিক্রয় হয়, তাহলে তারা গরিব হয়ে যাবে। পণ্য উৎপাদকের আগে থেকে জানার কোন উপায় থাকেনা যে তার পণ্যের চাহিদা আছে কিনা অথবা তার পণ্য ভাল দামে বিক্রি হবে কিনা। পণ্যের দাম স্বতন্ত্র ব্যক্তি উৎপাদকের দ্বারা নির্ধারিত হয়না, বরং বাজারে মূল্যের নিয়মের কার্যকরিতার স্বতস্ফূর্ত শক্তির দ্বারা তা নির্ধারিত হয়। এই সেই পরিস্থিতি যা পণ্য উৎপাদককে এটা মনে করায় যে তার ভাগ্য তার নিজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আর তা বাজারে তার পণ্যসমূহের ভাগ্যের দ্বারা নির্ধারিত হয়।

সকল পণ্যের সাথে মুক্তভাবে বিনিময় হতে পারে এমন এক সার্বজনীন তুল্যাংক হিসেবে অর্থের আবির্ভাবের পর, একটা বিভ্রমের উদ্ভব ঘটল যে অর্থের নিজেরই যেন এক বিশেষ যাদু ক্ষমতা আছে যা মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই, পণ্য পুঁজা অনিবার্যভাবে অর্থ পুঁজায় বিকশিত হয়।

মার্কসই প্রথম পণ্য পুঁজার রহস্য উন্মোচন করেন। পণ্য ও অর্থের সম্পর্কের উপর মার্কসের তত্ত্ব মানুষের মধ্যেকার সম্পর্কের উন্মোচন করে যেখানে বুর্শোয়া অর্থনীতিবীদেরা দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যেকার সম্পর্কই দেখতে পায় আর তার মধ্যেকার সামাজিক সম্পর্ক জিনিসের নিচে ধামাচাপা পড়ে। মার্কসের তত্ত্ব অখণ্ডনীয়ভাবে দেখায় যে পণ্য ও অর্থের মধ্যে সম্পর্ক চিরস্থায়ী নয়, বরং বিলোপের ঐতিহাসিক এক প্রক্রিয়া। তাই, পণ্য যার একক সেই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও চিরস্থায়ী নয়। নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতি যে জিনিসগুলোর জন্ম নিয়েছে তা উক্ত ঐতিহাসিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে বিলুপ্ত হবে। এ হচ্ছে মানুষের ইচ্ছা নিরপেক্ষ এক বস্তুগত নিয়ম।

প্রধান প্রধান অধ্যয়ণ উদ্ধৃতি

মার্কস, পুঁজি, খণ্ড ১, অধ্যায় ১, ৩

এঙ্গেলস, এন্টি-ড্যুরিং, খণ্ড ২, অধ্যায় ৫

লেনিন, কার্ল মার্কস (“মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্বাবলী”)

নোট

১। “পার্টি কাজের রীতির শুদ্ধিকরণ”, মাও সেতুঙের নির্বাচিত রচনা

২। মার্কস, পুঁজি, খণ্ড ১

৩। ঐ

৪। ঐ

৫। মার্কস, মজুরি, শ্রম ও পুঁজি।।