রাজনৈতিক অর্থনীতির মূলতত্ত্ব। রাজনৈতিক অর্থনীতির চীনের কমিউনিস্ট মূল গ্রন্থ (সাংহাই পাঠ্যপুস্তক)। বাংলা অনুবাদ। ২য় অধ্যায়

রাজনৈতিক অর্থনীতির মূলতত্ত্ব

 

রাজনৈতিক অর্থনীতির চীনের কমিউনিস্ট মূল গ্রন্থ (সাংহাই পাঠ্যপুস্তক)

লেখক গ্রুপ কর্তৃক রচিত ও সাংহাই গণ প্রকাশনা কর্তৃক মূল চীনা ভাষায় প্রকাশিত, ১৯৭৪

কেকে ফাঙ কর্তৃক ইংরেজী অনূদিত ও জেসি ওয়াঙ কর্তৃক সম্পাদিত, ১৯৭৫

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ কর্তৃক বাংলায় অনূদিত ও সর্বহারা পথ কর্তৃক প্রকাশ শুরু জানুয়ারি ২০২২

২য় অধ্যায় বাংলা অনুবাদ প্রকাশ জানুয়ারি শেষ সপ্তাহ ২০২২।।

 

২য় অধ্যায়

পুঁজিবাদ-পূর্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসমূহ

আদিম, দাস ও সামন্ত সমাজে উৎপাদন সম্পর্ক

পুজিবাদের পূর্বে ছিল তিনটি সামাজিক ব্যবস্থাঃ আদিম, দাস ও সামন্ত সমাজ। এই সমাজগুলোর উৎপাদন সম্পর্কগুলির অপসারণ ও প্রতিস্থাপন বুঝলে তা আমাদেরকে মানব সমাজের উৎপাদন সম্পর্কসমূহের বিকাশের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করবে। বিশেষত পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের উদ্ভব ও বিকাশ আর যে নিয়ম দ্বারা সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক কর্তৃক তার অনিবার্য প্রতিস্থাপন হয় তা বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ।

আদিম কমিউন মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে

শ্রমই মানুষকে সৃষ্টি করেছে

মানুষ যখন জীবজগত থেকে পৃথক হয়ে গেল তখন থেকেই আদিম সমাজ শুরু হয়। মানুষের উদ্ভবের সাথে সাথেই মানব সমাজও উদ্ভূত হল। মানুষের সাথে মানব ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় শুরু হল।

মানব সমাজের ইতিহাস প্রায় দশ লক্ষ বছর পুরোনো। মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল এক জাতীয় উচ্চ বিকশিত নর-বানর। কীভাবে নর-বানর মানুষে বিকশিত হল? এখানে চাবিকাঠি হচ্ছে শ্রম। শ্রম শুরু হয় হাতিয়ার তৈরির মাধ্যমে। নর-বানর থেকে মানুষে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক বস্তুসামগ্রী থেকে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার তৈরি করা হল। পাথর দিয়ে পাথর ঘষে পাথরের ছুরি, কুড়াল তৈরি করা হল অথবা গাছের ডালপালা ছেঁটে লাঠি হাতিয়ার তৈরি করা হলঃ এটা কিন্তু ছিল এক বিরাট বিপ্লব। মানুষ প্রাণীজগত থেকে নিজেকে পৃথক করল আর প্রকৃতিকে রূপান্তর ও জয় করতে নিজ হাতের ওপর নির্ভর করতে শুরু করল। যেমন এঙ্গেলস বলেনঃ “শ্রম হল মানব জীবনের প্রথম মৌলিক শর্ত। এ কথা সেই মাত্রায় সত্য যে মাত্রায় আমাদের স্বীকার করতে হবে যে শ্রমই মানুষকে সৃষ্টি করেছে।”(১) শ্রমের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়, মানুষ শিখেছে কীভাবে পাথরের হাতিয়ার বানাতে হয়, শিকার করতে হয় আর মাছ ধরতে হয়। সে তীর-ধনুক আবিষ্কার করল। আগুনের আবিষ্কার ও ব্যবহার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল যা প্রকৃতিকে রূপান্তর ও জয়ে মানুষের ক্ষমতা বিরাটভাবে বাড়িয়ে দিল। এঙ্গেলস এই অর্জনের উচ্চ মূল্যায়ণ করেন। তিনি বলেন, “দুনিয়াব্যাপী মুক্তির বিচারে, ঘর্ষণের দ্বারা আগুণ তৈরির আবিষ্কার বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ ঘর্ষণের দ্বারা আগুণ তৈরির আবিষ্কার মানুষকে প্রাকৃতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম করে তোলে, আর এভাবে সে প্রাণীজগত থেকে পৃথক হয়ে গেল।”(২) তখন থেকে মানব সমাজ পৃথিবীতে আনুষ্ঠানিকভাবে আবির্ভূত হল।

প্রাণীজগত থেকে পৃথক হওয়ার পর মানুষের পরিচালিত উৎপাদন কর্মকান্ড শুরু থেকেই ছিল একটা সামাজিক ও গোষ্ঠী কর্মকান্ড। “মানব জীবনের বস্তুগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য উৎপাদনে নিযুক্ত হতে উৎপাদন সম্পর্ক তৈরি করে প্রতিটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিই সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে সহযোগিতা করে।”(৩) যখন মানুষের সামাজিক ইতিহাসের পর্দা উঠল, সেই উৎপাদন সম্পর্ক ছিল আদিম কমিউনের, আর তা ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম উৎপাদন সম্পর্ক।

গোত্র কমিউন মালিকানা ছিল আদিম কমিউন উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তি

আদিম সমাজের মুখ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন ছিল শ্রমের উদ্দেশ্যে জ্ঞাতিত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ গোত্র কমিউন। গোত্র কমিউন মালিকানা ছিল এক আদিম ধরণের যৌথ মালিকানা। ভূমি আর অন্য সব উৎপাদনের উপায় ছিল সকল কমিউন সদস্যদের অধিকারে। সেসময় সরল পাথরের ছুরি, কুঠার, বর্শা আর তীর-ধনুকের কারণে বিরাট প্রাকৃতিক শক্তিকে কেবল যৌথ শ্রমেই জয় করা যেত। তাই, উৎপাদনের উপায় আর উৎপন্নের ব্যক্তিগত মালিকানা সম্ভব ছিলনা। নিম্নস্তরের উৎপাদিকা শক্তির অধীনে এই গোত্র কমিউন মালিকানা ব্যবস্থাই ছিল একমাত্র গৃহীত ধরণ। গোত্র কমিউনের মালিকানাধীন উৎপাদনের উপায়ের মধ্যে ছিল উৎপাদনের হাতিয়ারসমূহ, ভূমি, বনজঙ্গল, নদীনালা আর গবাদিপশু। স্বতন্ত্র ব্যক্তিবর্গ অস্ত্রশস্ত্র, আর তীরধনুক বহন ও ব্যবহার করত।

আদিম সমাজে, সকল সক্ষম সদস্য উৎপাদনশীল শ্রমে অংশ নিত। তারা লিঙ্গ ও বয়স ভিত্তিতে শ্রমের এক প্রাকৃতিক বিভাজন তৈরি করেছিল। পুরুষেরা শিকারে যেত, বৃদ্ধরা হাতিয়ার তৈরি করত, নারীরা গাছ লাগাত ও গৃহস্থালী কাজ করত আর আদিম কৃষিতে নিয়োযিত হত। শিশুরা নারীদের বাড়তি শ্রমে সহায়তা করত। ব্যক্তিগত পারস্পরিক সম্পর্কি ছিল আদিম সমবায় সম্পর্ক।

গোত্র কমিউন মালিকানা ও যৌথ শ্রমের পরিস্থিতিতে, উৎপন্ন সমভাবে ভাগ হত। সেসময়কার উৎপাদিকা শক্তির নিম্নস্তরের কারণে, শ্রমের দ্বারা প্রাপ্ত উৎপন্ন দ্বারা কেবল ন্যুনতম জীবনযাত্রা বজায় রাখা যেত যার থেকে খুব সামান্যই অবশিষ্ট থাকত। সুষম বন্টন না হলে গোত্রের কিছু সদস্যকে হয় অনাহারে থাকতে হত অথবা গোত্র বিলুপ্ত হয়ে যেত।

আদিম সমাজের অর্থনৈতিক অবকাঠামো এর সাথে সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ উপরিকাঠামোও গড়ে তোলে। আদিম সমাজ ধারাবাহিকভাবে মাতৃতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক গোত্র স্তরের মধ্য দিয়ে গেছে। মাতৃতান্ত্রিক গোত্র গড়ে উঠেছিল উৎপাদন কর্মকান্ডে নারীদের অধিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের ফল হিসেবে। সেসময় নারীরা প্রধানভাবে কৃষিকাজ নিয়ে থাকত, আর পুরুষরা শিকারে নিয়োযিত থাকত। কিন্তু শিকার সবসময় হতনা আর তা সবসময় মিলতওনা। কৃষি ছিল জীবিকার অধিকতর নির্ভরযোগ্য উৎস। তাই, সামাজিক জীবন নারীদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে, কৃষি এর আদিম রূপ থেকে অগ্রসর হল আর পশুপালন কৃষি থেকে আলাদা হয়ে গেল। উৎপাদন কর্মকান্ডে পুরুষের গুরুত্ব বাড়ল। নারীকেন্দ্রীক গোষ্ঠী বিবাহ থেকে একের সাথে এক বিবাহে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় পিতৃতান্ত্রিক গোত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে নারীদের অবস্থান হয়ে দাঁড়াল অধিকতর অধীন।

সকল পূর্ণবয়ষ্ক সদস্য নিয়ে গঠিত গোত্র পরিষদ গোত্র কমিউনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা সংস্থা। গোত্র পরিষদ গোত্র প্রধান ও যুদ্ধকালীন সামরিক নেতাদের নির্বাচন করে, আর সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে ও সিদ্ধান্ত নেয়। লুইস এইচ মর্গান এক আমেরিকান পন্ডিত যিনি তাঁর প্রাচীন সমাজ গ্রন্থে আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের গোত্র কমিউনকে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “সকল সদস্য মুক্ত ব্যক্তি আর একে অপরের স্বাধীনতা রক্ষায় বাধ্য। প্রত্যেকের সমান অধিকার। এমনকি গোত্র প্রধান ও সামরিক নেতারাও কোন বিশেষ সুবিধা দাবী করতে পারতনা। তারা ছিল রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে স্বগোত্রীয়।” এই গোত্রীয় উপরিকাঠামো গোত্রীয় অর্থনৈতিক অবকাঠামো সংহতকরণ ও বিকাশে আর সেসময়ের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে পরিচালক ভূমিকা পালন করে।

সভাপতি মাও ব্যাখ্যা করেনঃ “চীনা জনগণ (এখানে হান জনগণের কথা প্রধানভাবে বলা হচ্ছে) এর বিকাশ দুনিয়ার অন্য সকল জনগণের মত একই। তারা শ্রেণীহীন আদিম সমাজের মধ্য দিয়ে অযুত অযুত বছর ধরে গেছে।”(৪) “পিকিঙ মানুষ” এর সাথে জড়িত যে সমাজ যা পিকিঙের চৌ-কোও-তিয়েন শহরতলীতে আবিষ্কৃত হয় তা চীনের আদিম সমাজের প্রাচীনতম স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। চীনের বহু এলাকায় আদিম সমাজের যে প্রাচীন নিদর্শন ও সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে তা প্রমাণ করে যে কেন্দ্রীয় অঞ্চলের পীত নদীর অববাহিকা জুড়ে মাতৃতান্ত্রিক গোত্রীয় উপজাতির অস্তিত্ব ছিল যা সম্প্রসারিত হয় আভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া, হেইলুঙ্কিয়াঙ, সিনকিয়াঙ, তিব্বত, কোয়াংসি, সেচুয়ান ও ইউনান পর্যন্ত। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে পীত নদী ও ইয়াংসি নদী অববাহিকা জুড়ে উপজাতিসমূহ ক্রমে পিতৃতান্ত্রিক গোত্র কমিউনে পরিণত হয়। চীনে শিয়া রাজবংশের আগে কয়েক শত সহস্র বছর ধরে আদিম সমাজ অস্তিত্বশীল ছিল।

ঐতিহাসিক তথ্য আমাদের বলে যে আদিম সমাজে কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণী, শ্রেণীশোষণ ও শ্রেণীনিপীড়ণের অস্তিত্ব ছিলনা। এটা এই মিথ্যাচারকে প্রচন্ডভাবে খন্ডন করে যা বলে যে স্মরণাতীতকাল থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল।

ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব আদিম কমিউনকে ধ্বংসে চালিত করে

আদিম সমাজের বিকাশের ধারায় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে শ্রমের সামাজিক বিভাজন জন্ম নেয়। শুরুতে পশুপালন কৃষি থেকে পৃথক হয়। কিছু উপজাতি দক্ষ হয় পশুপালনে, আবার কিছু কৃষিতে। এটাই ছিল প্রথম প্রধান শ্রমের সামাজিক বিভাজন। পরে হস্তশিল্প কর্ম কৃষি থেকে পৃথক হয়। এটা ছিল দ্বিতীয় প্রধান শ্রমের সামাজিক বিভাজন। আদিম সমাজের শেষের দিকে লৌহ আবিষ্কার হয়। লোহার উদ্ভব মানব সমাজের উচ্চতর স্তরে উন্নীত হওয়ার প্রতীক। কিন্তু এটা আদিম সমাজের অবলুপ্তিরও বার্তা বহন করেছে। কৃষি, পশুপালন ও হস্তশিল্পের পৃথক পৃথক আবির্ভাবের সাথে বিনিময়ের জন্য উৎপাদন যথা পন্য উৎপাদন উদ্ভূত হল।

উৎপাদিকা শক্তির অব্যাহত বিকাশের ফলে ন্যুনতম জীবন জীবিকা নির্বাহের পর কিছু উদ্বৃত্ত রয়ে যেতে থাকল। শ্রমের দুই প্রধান বিভাজন শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে আর কৃষি, পশুপালন ও হস্তশিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছে। উদ্বৃত্ত উৎপন্ন ও সামাজিক সম্পদ বাড়ল। এই পরিস্থিতিতে, কিছু লোক কর্তৃক অন্য লোকের শ্রমের উৎপন্ন দ্রব্য আত্মসাৎ করারা সম্ভাবনা দেখা দিল। অন্য দিকে বিনিময়ের বিস্তারের সাথে গোত্র প্রধান কর্তৃক ক্রমে ক্রমে কমিউন সম্পত্তিকে নিজ ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরের সম্ভাবনাও দেখা দিল। লোহার হাতিয়ার ব্যবহার বিশেষত লোহার কুঠার, নিড়ানী ও লাঙলের ব্যবহার সুস্পষ্টভাবে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে আর স্বতন্ত্র গৃহস্থালি ভিত্তিতে উৎপাদনের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। গোত্রভিত্তিক আদি যৌথ উৎপাদন ক্রমে ক্রমে স্বতন্ত্র গৃহস্থালিভিত্তিক স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত উৎপাদনে বিলীন হয়। উৎপাদন যৌথ থেকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিণত হল। উৎপাদনের উপায় ও উৎপন্ন দ্রব্যও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হল। তারপর সাবেক যৌথ যে সকল জমি ব্যক্তি গৃহস্থালির চাষের জন্য দেওয়া হয়েছিল তাও ব্যক্তিগত অধিকারে চলে গেল। ব্যক্তি মালিকানা আবির্ভূত হল আর আদিম কমিউন ভেঙে গেল।

ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভবের সাথে পরিবারগুলোর মধ্যে সম্পত্তির বন্টনে বৈষম্য দেখা দিল। গোত্র প্রধানেরা নিজেদের ক্ষমতাকে অব্যাহতভাবে ব্যবহার করল যৌথ সম্পত্তি তাদের নিজেদের সম্পত্তিতে রূপান্তরিতকরণে আর তারা গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে ধনী গৃহস্থালিতে পরিণত হল। সেই সাথে তাদের ধনসম্পদ আর তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়ার সাথে শ্রমের ঘাটতি দেখা দিল। অন্যদিকে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে দাস শ্রমের ব্যবহার সম্ভব ও লাভজনক হয়ে দেখা দিল। ফলে, যুদ্ধবন্দীদের আর না হত্যা করে বরং তাদের দাসে রূপান্তর করা হল। পরে, গোত্রের কিছু দরিদ্র লোকজনও ধনী পরিবারগুলোর দাসে পরিণত হল। মানুষ কর্তৃক মানুষ শোষণের উদ্ভব ঘটল।

উৎপাদনের বিকাশ আর বিনিময়ের বিস্তারের ফলে তৃতীয় প্রধান শ্রম বিভাজন উদ্ভূত হল। বণিকদের উদ্ভব ঘটল যারা বিনিময় কাজে বিশেষ পারদর্শী ছিল। পন্য বিনিময়ের বিকাশের ফলে অর্থের উদ্ভব হল। অর্থের উদ্ভবের ফলে ধনী পরিবারেরা সুদী কারবারে নিযুক্ত হল আর সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ ও অসম বন্টন বাড়িয়ে দিল। ফলে সম্পদ দ্রুত মুষ্টিমেয় কিছু দাসমালিকের হাতে কেন্দ্রীভূত হল। অন্যদিকে, দারিদ্র্য ও দেউলিয়াত্বের কারণে ব্যাপক শ্রমজীবি জনগণ দাসত্বে নিক্ষিপ্ত হল আর দাসদের স্তর দ্রুত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলল। এভাবে সমাজ শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে গেলঃ দাসমালিক ও দাস। এই দুই বিরোধী শ্রেণী মানবসমাজে প্রথম নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিল। শ্রেণীর উদ্ভবের সাথে পূর্বতন গোত্রপরিষদ যা সমাজের গণ সেবক হিসেবে উদ্ভূত তা জনগণের প্রভুতে পরিণত হলঃ একটা হাতিয়ারে যা দ্বারা দাসমালিকেরা দাসদের নিপীড়ণ করত। সেসময় জন্ম নিল রাষ্ট্র যা হচ্ছে এক শ্রেণী দ্বারা অন্য শ্রেণীর ওপর নিপীড়ণ চালানোর হাতিয়ার। সেসময় থেকে আজ পর্যন্ত “সকল সামাজিক ইতিহাস হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস।”(৫)

দাস প্রথা ছিল প্রথম শোষণের ব্যবস্থা

দাস সমাজের উৎপাদন সম্পর্কের চরিত্র হল উৎপাদনের উপায় ও দাসেরা দাসমালিকের মালিকানাধীন

দাস সমাজে, দাসমালিক শুধু উৎপাদনের উপায়ের মালিক নয় দাসেরও সে মালিক। দাসমালিকের পরম মালিকানার অধীন দাস ছিল স্রেফ একটা জীবন্ত যন্ত্র। দাস শুধু শোষিতই ছিলনা, তাকে একটা পশু মনে করা হত, একটা বলির বস্তু, আর একটা পন্য। দাসমালিক এমনকি তাকে জবাই করতে পারত। দাসশ্রম ছিল পুরোপুরি বল প্রয়োগে কৃত শ্রম। দাসমালিক দাসদের দিয়ে কাজ করানোর জন্য পাশবিক বল প্রয়োগ করত আর নির্বিচারভাবে দাসদের নির্যাতন করত। একে সহজ করতে আর দাসেরা যাতে পলানোর সময় ধরা পড়ে সেজন্য দাসমালিক সেধরণের দাসদের আলাদা চিহ্ন দিয়ে তাদের হাতকড়া ও পায়ে বেড়ী পরিয়ে রাখত। দাসদের উদ্বৃত্ত শ্রম ও উৎপন্ন নিঙরে নিতে দাসমালিকরা নিষ্ঠুরতম উপায় অবলম্বন করত। দাসের উৎপাদিত সকল দ্রব্যই দাস মালিকের মালিকানাধীন ছিল। দাসকে পশুর মত খাবার দেয়া হত। ততটুকুই যতটুকু দিলে সে জীবিত থাকবে। এটাই ছিল দাস সমাজের উৎপাদন সম্পর্ক।

সভাপতি মাও ব্যাখ্যা করেন, “বর্তমান থেকে প্রায় চার হাজার বছর কেটে গেছে সেসময় পর্যন্ত যখন চীনা জাতির আদিম সমাজ ভেঙে শ্রেণীসমাজের উদ্ভব হল যা দাস সমাজ ও সামন্ত সমাজের মধ্য দিয়ে গেছে।”(৬) শিয়া রাজবংশের রাজত্বকালের পরই চীন দাস সমাজে প্রবেশ করে। ইন রাজবংশে “চুং-জেন” ও “শু-মিন” [অর্থাৎ জনমানুষ] এরা সকলেই ছিল দাস। ইন-শু (ইন রাজবংশের রাজধানীর পরিত্যক্ত ক্ষেত্র যা হোনান প্রদেশের আন-ইয়াঙ এর শিয়াও তুন-শুন এর কাছে) তে খনন করে যে মাটির সমাধি চিত্র পাওয়া গেছে তাতে সকলেরই হাতকড়া পরা ছিল। পুরুষদের পিছনের দিকে আর নারীদের সামনের দিকে হাতকড়া পরা ছিল। এগুলো ছিল সেকালের দাসদের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। দাসদের জবাই করা আরো হৃদয়বিদারক। দাস মালিক প্রায়ই বলির উৎসবে দাস বলি দিত। ইন রাজবংশের কিছু বলি উৎসবে হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। ইন রাজবংশের দাসমালিকদের সমাধিতে দেখা যায় দাসদের জীবন্ত অথবা মৃত কবরস্থ করা হয়েছে। তাদের সংখ্যা ছিল দশের অধিক থেকে কয়েক শত, যার মধ্যে নারী, পুরষ আর এমনকি শিশুরাও ছিল। কোন সন্দেহ নেই যে চীনে দাস সমাজ অস্তিত্বশীল ছিল।

কিন্তু চেন পো-তার মত ট্রটস্কীবাদীরা মিথ্যা ছড়ায় যে চীনে কোন দাস সমাজ ছিলনা। তারা এই মিথ্যাচার করে বৃথা চেষ্টা চালায় মানব সমাজের মার্কসবাদী বিশ্লেষণের সার্বজনীন সত্যকে নেতিকরণ করে এটা দেখাতে যে চীনের বাস্তবতায় সাম্যবাদ উপযুক্ত নয়। এটা চরম প্রতিক্রিয়াশীল আর সর্বৈব বৃথা।

শ্রেণীবৈরিতা শহর ও গ্রামের মধ্যে

আর মানসিক ও কায়িক শ্রমের মধ্যে

বিরোধ তৈরি করে

প্রাচীনতম নগরের উদ্ভব ঘটে আদিম সমাজের শেষে যা প্রতিষ্ঠিত হয় প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে উপজাতিসমূহের জোটের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে। দাস সমাজের উদ্ভবের পর কৃষি, হস্তশিল্প আর পন্য বিনিময়ের বিকাশের সাথে নগর ও গ্রামের মধ্যে বিরোধ উত্থিত হল।

সেসময় শিল্প উৎপাদন ছিল হস্তশিল্প উৎপাদন। হস্তশিল্পের কেন্দ্র ছিল শহর। হস্তশিল্পের বিকাশ জড়িত ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশের সাথে। তাই, নগর ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যেরও কেন্দ্র। চীনের ইন রাজবংশের রাজত্বে ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত বেড়ে ওঠে। বাণিজ্যিক নগরসমূহ জন্ম নিল। ইন ও শাঙ (চীনে বাণিজ্যকে শাঙ বলা হয়) সমার্থক, আর ইন রাজবংশ শাঙ রাজবংশ নামেও পরিচিত। বর্তমান কালের ইন-শু ছিল ইন রাজবংশের রাজত্বে যথেষ্ট বড় বাণিজ্যিক শহর।

দাসমালিকেরা দাস সমাজের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক উপরিকাঠামো প্রতিষ্ঠা করে, আর নগর হয়ে দাঁড়ায় দাস সমাজের রাজনৈতিক কেন্দ্র। দাসমালিকেরা দাসবিদ্রোহ দমন করার জন্য বিশেষ মনোযোগ দেয় নগরে রাষ্ট্রযন্ত্রকে শক্তিশালী করতে। অনেক দাসমালিক, বড় ব্যবসায়ী, সুদীকারবারী ও আমলারা শহরে কেন্দ্রীভূত হয় যারা বদমাইশী ও বিলাসী জীবন যাপন করত। নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য দাসমালিকেরা দাসদের বাধ্য করে মনোহর প্রাসাদ, মন্দির, নাট্যশালা ও অন্যান্য উন্মুক্ত স্থান তৈরি করতে। এভাবে, শহর ক্রমে ক্রমে দাস সমাজের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।

এভাবে, দাস সমাজে শহর এক কর্তৃত্বমূলক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক ভূমিকা গ্রহণ করে, আর শহর ও গ্রামের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে। শহর ও গ্রামের মধ্যে বিরোধ ছিল তীব্র শ্রেণীদ্বন্দ্বের ফল। মূর্তভাবে এ হচ্ছে শহর কর্তৃক গ্রামকে শোষণ।

আদিম সমাজে সকল সক্ষম মানুষ শ্রমে অংশ নিত। মানসিক শ্রমে কোন বিশেষত্ব ছিলনা। দাস সমাজে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। দাসশ্রমে সৃষ্ট বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত উৎপন্নের ফলে দাসমালিকেরা নিজেদের উৎপাদন শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারে। সেসময় মানসিক ও কায়িক শ্রমের মধ্যে বিভাজন ছিল প্রয়োজনীয় ও সম্ভব। শুরু থেকেই মানসিক ও কায়িক শ্রমের মধ্যে এই বিভাজন ছিল বৈরি। দাসমালিক শ্রেণীর লোকেরাই সাংস্কৃতিক শিক্ষা গ্রহণের সুবিধাভোগী চিল। “বস্তুগত উৎপাদনের উপায়কে যে শ্রেণী নিয়ন্ত্রণ করত তারাই মানসিক উৎপাদনের উপায়েরও নিয়ন্ত্রণ করত। তাই, যাদের মানসিক উৎপাদনের উপায় ছিলনা তাদের চিন্তা সাধারণত শাসক শ্রেণীর প্রভাবাধীন ছিল।”(৭) দাসমালিক শ্রেণী এই মিথ্যাচার করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় যে “মানসিক শ্রমিকেরা অন্যদের শাসন করে আর দৈহিক শ্রমিকেরা অন্যের দ্বারা শাসিত হয়।” দাসমালিকের একনায়কত্ব সংহত করতে এরা এদের রাজনীতি, আইন, দর্শন ও মতাদর্শকে দাস ও অন্যসব মেহনতীদের ওপর শাসন চালানোর এক হাতিয়ার হিসেবে নিজ অনুকূলে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে।

দাসদের বিদ্রোহ দাসপ্রথার ধ্বংস ত্বরান্বিত করে

দাসপ্রথা ছিল মানব ইতিহাসের অনিবার্য এক স্তর। বিদ্যমান উৎপাদিকা শক্তির প্রয়োজন মেটাতে এর উদ্ভব। দাস ব্যবস্থায় যুদ্ধবন্দীদের ব্যপকভাবে জবাই করা হতনা, বরং কাজ করার জন্য তাদের জীবিত রেখে দেওয়া হত। এটা উৎপাদন বিকাশের জন্য সহায়ক ছিল। যেহেতু দাসমালিকের অধিকারে ছিল বিপুল পরিমাণ উৎপাদনের উপায় ও শ্রম, তাই উৎপাদন ও সমন্বয় ব্যাপকভাবে সংগঠিত করা সম্ভব হয়েছে। ধাতব হাতিয়ারের ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি, পশুপালন ও হস্তশিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটে। কৃষি হয়ে দাঁড়ায় জাতীয় অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ঘোড়া, মহিষ, ভেড়া, মুরগী, কুকুর ও শুকরকে গৃহপালিত করা হয়। বিপুল সংখ্যক হস্তশিল্পীর সমন্বিত প্রচেষ্টায় সূক্ষ কারুকাজ সমৃদ্ধ একটি ব্রোঞ্জের পাত্র (সি-মু-মাও তা ফাঙ তিঙ) তৈরি করা হয় যার দৈর্ঘ্য ১১০ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ৭৭ সেন্টিমিটার, উচ্চতা ১৩৭ সেন্টিমিটার আর ওজন ছিল ১৪০০ বাজার ক্যাটি (চীনের প্রাচীন ওজন মাপার একক ক্যাটি, চীনে ১ ক্যাটি সমান ৫০০ গ্রাম — বাংলা অনুবাদক)। এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি  কর্ম দক্ষতা ও শ্রমের উৎকর্ষতা কতটুকু উচ্চতায় পৌঁছেছিল সেসময়।

দাস সমাজের উৎপাদন সম্পর্ক নির্দিষ্ট পরিমাণে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে, কিন্তু এই উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেই উক্ত উৎপাদিকা শক্তির আরো বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করবে এমন দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল। উৎপাদিকা শক্তির যত বিকাশ ঘটতে লাগল, ঐ দ্বন্দ্বগুলি ততই তীব্র হয়ে ওঠল। ব্যাপক দাস জনগণ দাসমালিকদের নিষ্ঠুর শোষণ ও নিপীড়ণ আর সহ্য করতে পারলনা। তারা তাদের কাজ ধীর করে দিল, বিপুল সংখ্যায় পলায়ন করল, আর উদ্দেশ্যমূলকভাবে উৎপাদন যন্ত্রগুলি ভাঙতে লাগল। একদিকে দাসমালিকেরা তাদের নিপীড়ণ বাড়িয়ে দিল যাতে বিপুল সংখ্যক দাসের অকাল মৃত্যু ঘটল। অন্যদিকে, ভারী যন্ত্রপাতির বদলে কায়িক শ্রম নিয়োগ করল। এই ব্যবস্থা সৃষ্ট কায়িক শ্রমের প্রতি ঘৃণা থেকেও উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের উপর বিধিনিষেধ এসেছিল। দেউলিয়া ক্ষুদে উৎপাদকরা কায়িক শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার বদলে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল। এই জিনিসগুলি সব দেখালো যে দাসপ্রথার উৎপাদন সম্পর্ক ইতিমধ্যেই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে গেছে। এর উদ্ভবের মতই এর বিলোপও সমান অনিবার্য ছিল।

দাস সমাজের শেষে সামন্ত উৎপাদন সম্পর্ক আবির্ভূত হল। দাস সমাজে উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তি ছিল দাস রাষ্ট্র কর্তৃক ভূমির মালিকানা। চীনের ইন-চৌ যুগে ভূমির রাষ্ট্রীয় মালিকানা ছিল চিং-তিয়েন (৮টি কৃষক পরিবারের মধ্যে ৮টি জমি নিজ চাষের জন্য থাকত, আর কেন্দ্রে থাকত চিং-তিয়েন অর্থাৎ কূপ ক্ষেত্র জমি যা দাসমালিকের জমি সকলে মিলে চাষ করে দিত – বাংলা আনুবাদক) ধরণে। চিং-তিয়েন এর চৌহদ্দির মধ্যে সকল ভূমিকে বলা হত “গোষ্ঠীগত জমি”। এই “গোষ্ঠীগত জমি” আর দাসেরা সবচেয়ে বড় দাসমালিকঃ রাজন্য, অভিজাত আর স্বর্গের পুত্র (চীনের ঝৌ রাজবংশের সম্রাটদের স্বর্গের পুত্র বলা হত – বাংলা অনুবাদক) দ্বারা নিয়োযিত কর্মকর্তাদের অধীন ছিল। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে, কিছু দাসমালিক সর্বোচ্চ চেষ্টা করল দাসদের বাধ্য করতে বিপুল সংখ্যক “ব্যক্তিগত জমি” আবাদের অধীনে আনতে যাতে অধিক উদ্বৃত্ত শ্রম শোষণ করা যায়। “ব্যক্তিগত জমি”র সম্প্রসারণের মাধ্যমে “গোষ্ঠীগত জমি”র প্রথা অবমূল্যায়িত হল। সেসময় জমিদার শ্রেণীর জন্ম হল। তারা “চিং-তিয়েন এর বিলোপ আর জমিগুলোর মাঝখানে আইল ভেঙে দেওয়া”র কথা বলল। দাসেরা ক্রমে ক্রমে ভূমিদাসে পরিণত হল। সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের জন্ম হল।

দাস সমাজের মূল শ্রেণী ছিল দাসমালিক ও দাস। এর বাইরে ছিল স্বাধীন কৃষক আর হস্তশিল্পী। দাসেরা ছিল সমাজের সবচেয়ে নিচের স্তর আর তারা দাসমালিকদের নিষ্ঠুরতম শোষণ ও নিপীড়ণের শিকার ছিল। দাসব্যবস্থার সমগ্র পর্যায়কালে দাস আর দাসমালিকের মধ্যে প্রচণ্ড শ্রেণীসংগ্রাম চলে। চীনের বসন্ত ও শরত যুগ (৭৭১ খৃষ্টপূর্ব থেকে ৪৭৬ বা ভিন্নমতে ৪০৩ খৃষ্টপূর্ব পর্যন্ত সালের সময়কালকে চীনের ইতিহাসে বসন্ত ও শরত যুগ বলা হয় – বাংলা অনুবাদক) সময়কাল ছিল দাসপ্রথা থেকে সামন্তবাদে রূপান্তরের সময়। ছিহ নামে একজন দাসনেতা ৯০০০ জন দাসকে নেতৃত্ব দেয় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে সামন্ত ভূস্বামীদের ওপর আক্রমণে। দাসবিদ্রোহ দাসমালিক শ্রেণীর শাসনকে মারাত্মকভাবে চ্যালেঞ্জ করে। দুনিয়ার বহু দেশে বহু বীরত্বব্যাঞ্জক মহাকাব্যের মূল বিষয় ছিল দাস অভ্যুত্থান। উদাহারণস্বরূপ, রোমান যুগে স্পার্টাকাস ১২০,০০০ জনের অংশগ্রহণে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। এই বিদ্রোহ সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। প্রচণ্ড দাসবিদ্রোহসমূহ দাসমালিকদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় মারাত্মক আঘাত হানে আর দাসপ্রথার ধ্বংস ত্বরান্বিত করে। যখন দাসব্যবস্থা ভেঙে গেল, সামন্ত উৎপাদন সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে পরিপক্ক হল। সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধি নব উত্থিত জমিদারেরা শ্রমজীবি জনগণের শক্তিকে ব্যবহার করল দাসমালিকদের শাসন উচ্ছেদে, আর জমিদারদের সরকার গঠন করল। সামন্তবাদ শেষ পর্যন্ত দাসব্যবস্থার জায়গা নিল।

সামন্তবাদ কর্তৃক দাসব্যবস্থার প্রতিস্থাপন ছিল ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্য। চীনে বিরাট যুগান্তকারী সামাজিক পরিবর্তনের কালে, কনফুসিয়াস ছিল দাসপ্রথার প্রতিক্রিয়াশীল প্রবক্তা, সে যেকোন সামাজিক সংস্কারের বিরোধী ছিল আর উৎপাদন সম্পর্কের যেকোন পরিবর্তনকে “বিরাট ক্ষতিকর” আখ্যা দেয়। নতুন সামন্তপ্রভুদের আনা সকল সংস্কার কর্মসূচির সে দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে, প্রাচীন দাসব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠার কথা বলে আর জরাজীর্ন সামাজিক প্রথা রক্ষার বৃথা চেষ্টা চালায়। কিন্তু সব তখন শেষ। তার প্রচেষ্টা ছিল এক মরনাপন্ন আদর্শের জন্য বৃথা সংগ্রাম।

সামন্তবাদ হচ্ছে শ্রেণীদ্বন্দ্বভিত্তিক আরেক শোষণমূলক ব্যবস্থা

সামন্ত ভূমিমালিকানা হচ্ছে সামন্ত সমাজের অর্থনৈতিক অবকাঠামো

জমিদার শ্রেণী কর্তৃক ভূমি মালিকানা আর ভূমিদাসদের ওপর তাদের প্রায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের ওপর ভিত্তি করে সামন্ত সমাজের উৎপাদন সম্পর্ক ছিল। জমিদার ছিল অধিকাংশ জমির মালিক। কৃষক আর ভূমিদাসদের সামান্য জমি ছিল অথবা কোন জমি ছিলনা। তাদেরকে বেঁচে থাকার জন্য জমিদারের জমি চাষ করার ওপর নির্ভর করতে হত। এভাবে তারা সামন্ত ভূমিব্যবস্থার বাঁধনে বাঁধা ছিল। তারা নিজেদের ব্যক্তি স্বাধীনতা হারিয়েছে আর জমিদারদের নিষ্ঠুর শোষণ ও নিপীড়ণের শিকার ছিল।

যে প্রধান উপায়ে জমিদার কৃষকদের শোষণ করত তা ছিল তাদেরকে ভাড়া দেয়া জমির থেকে সামন্ততান্ত্রিক খাজনা আদায়। তিন ধরণের সামন্ত খাজনা ছিলঃ শ্রম খাজনা, দ্রব্য খাজনা আর মুদ্রা খাজনা।

সামন্ত সমাজের প্রথম পর্যায়ে শ্রম খাজনা প্রচলিত ছিল। কৃষক তার নিজের হাতিয়ার দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ে জমিদারের পরিচালিত ভূমিতে যে শ্রম দিত তাই ছিল শ্রম খাজনা। কৃষক তার জমিতে চাষ করতে পারত কেবল জমিদারের জমিতে শ্রম দেওয়ার পরই। এই ধরণের ভূমি খাজনায় শোষক ও শোষিতের মধ্যে সম্পর্ক ছিল পরিষ্কার।

নিজ পরিচালনাধীন জমিতে উৎপন্ন ফসল তাদের নিজেদের অধিকারে ছিল। তাই এখানে শ্রম দিতে তারা আগ্রহী ছিল। জমিদার পরিচালিত জমিতে উৎপন্ন ফসল সম্পূর্ণই জমিদারের অধিকারে ছিল। এধরণের শ্রমে কৃষকেরা স্বাভাবিকভাবে আগ্রহী ছিলনা। জমিদার এই আগ্রহের পার্থক্যের ব্যাপার ভালভাবেই বুঝত। জমিদারের জমিতে কৃষকদের কঠোর শ্রম দিতে বাধ্য করতে জমিদার বেশ কিছু সর্দার রাখত। তাই, এরকম খাজনা প্রথায়, সম্পর্কটা অনিবার্যত ছিল একপক্ষ নিপীড়ক ও আরেকপক্ষ নিপীড়িত, আর একপক্ষ শাসক ও আরেকপক্ষ শাসিত। সামন্তবাদের প্রথম পর্বে উৎপাদিকা শক্তি খুব দূর্বল ছিল। জমিদার কৃষকের উদ্বৃত্ত শ্রম আত্মসাৎ করতে পারতনা বলপ্রয়োগ ছাড়া। এধরণের সামন্তীয় খাজনা কৃষকদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হত।

পরবর্তীতে উৎপাদিকা শক্তিসমূহের বিকাশের গতির ধারায় অধিক শোষণের আকাঙ্খায়, আর যাতে তাদের শোষক আকাঙ্খা কম প্রকাশিত হয়, জমিদার শ্রম খাজনার জায়গায় দ্রব্য খাজনা চালু করে। দ্রব্য খাজনায়, কৃষক আর জমিদারের পরিচালনায় কাজ করেনা। তাকে জমিদারের আবাদী জমিতে আর কাজ করতে হয়না। কৃষক তার নিজ সম্পূর্ণ শ্রমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু তাকে নির্দিষ্ট কাল অন্তর জমিদারকে উদ্বৃত্ত ফসল খাজনা হিসেবে প্রদান করতে হয়। শ্রম খাজনার তুলনায় দ্রব্য খাজনায় উৎপাদন সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি ও শ্রম উৎপাদনশীলতা উন্নত করা সম্ভব হয় কিছু পরিমাণে। কিন্তু প্রায়ই কৃষকের শতকরা ৫০ অথবা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ফসল এই দ্রব্য খাজনা হিসেবে চলে যেত। ন্যুনতম জীবনযাত্রা বজায় রাখতে কৃষককে তাদের কর্মদিবস বৃদ্ধি করতে হত আর তাদের শ্রম ঘনত্ব বৃদ্ধি করতে হত। তারপরও চরম দারিদ্র্যের চেয়ে ভাল জীবন যাপন করতে কৃষক সক্ষম হতনা।

মুদ্রা খাজনা সামন্ত সমাজের শেষাংশে আবির্ভূত হয়। উৎপাদিকা শক্তি তখন আগের চেয়ে অনেক উচ্চতর। অর্থ আর পন্যের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। নিজ বহুগুণ বেশী চাকচিক্যময় ও বিলাসী জীবনের প্রয়োজন চরিতার্থ করতে জমিদার আরো বেশী বেশী টাকা চায়। এইরকম পরিস্থিতিতে মুদ্রা খাজনা আবির্ভূত হয়। মুদ্রা খাজনায়, কৃষক তার ফসল বাজারে টাকার বিনিময়ে বিক্রয় করে খাজনা দিতে। এভাবে, কৃষক শুধু জমিদারের দ্বারাই শোষিত হয়না, বরং মধ্যস্বত্বভোগী বণিকের দ্বারাও শোষিত হয়। যখন ফসল ভাল হত, বণিকেরা দাম কমিয়ে কৃষকের রক্তঘামের প্রতিটি ফোঁটা নিংড়ে নিত। ফলে, কৃষকদের জীবনযাত্রা ছিল শোচনীয় থেকে শোচনীয়তর। আর প্রায়শই তা দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হত।

সামন্ত সমাজে, ব্যাপক কৃষক জনগণ সামন্তীয় খাজনার শোষণের অধীন ছিল। তাদেরকে সামন্ত রাষ্ট্রের মোটা অংকের খাজনাও দিতে হত আর সুদী কারবারীর শোষণেরও তারা শিকার ছিল। জমিদার আমলা ও সৈন্যদের সাথে ষড়যন্ত্র করে কৃষকদের জমি আত্মসাৎ করে, তাদের সম্পদ চুরি করে আর তাদের বেগার খাটতে বাধ্য করে। ব্যাপক কৃষক জনগণ সকল ধরণের অতিরিক্ত অর্থনৈতিক শোষণের শিকার ছিল।

কৃষক বিদ্রোহ সামন্ত সমাজের বাড়ন্ত সুতীব্র শ্রেণী দ্বন্দ্বের প্রতিফলন

সামন্ত সমাজ দ্বারা দাস সমাজের প্রতিস্থাপন ছিল ইতিহাসের এক অগ্র পদক্ষেপ। সামন্ত সমাজের প্রথম পর্যায়ে সামন্ত উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদিকা শক্তিকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ছিল। কৃষি উৎপাদন কৌশল উন্নত হল আর হাল হাতিয়ারের উৎকর্ষ সাধিত হল। উৎপাদনে লোহার হাতিয়ারের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ল, বৈচিত্র্য ও পরিমাণ উভয়তই ফসল উৎপাদন বাড়ল, আর হস্তশিল্পের বাড়বাড়ন্ত হল। চীনের যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের কাল (চীনের বসন্ত ও শরত যুগের শেষের সাথে যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের কাল শুরু হয় অর্থাৎ ৪৮১ খৃষ্টপূর্ব অথবা ৪০৩ খৃষ্টপূর্ব থেকে শুরু হয়ে ২২১ খৃষ্টপূর্ব সালে চিন রাজবংশ কর্তৃক সকল যুদ্ধরত রাজ্য জয়ের মাধ্যমে প্রথম চীনা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেষ হয় – বাংলা অনুবাদক)-এ তু-চিয়াং ডাইক এর মত বড় আকারের পানি সংরক্ষণাগার প্রকল্প সেচুয়ান প্রদেশে নির্মাণ করা হয়। বিভিন্ন রাজবংশ সমূহের রাজত্বকালীন সময়ে অতিরিক্ত কিছু নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজসমেত তু-চিয়াং ডাইক এখনো খুবই কাজে দিচ্ছে। চীনের সামন্ত সমাজে লবণ উৎপাদন, ধাতব নির্মাণ, সিল্ক দ্রব্য, বস্ত্র বুনন, পোর্সেলিন, মৃত্তিকা নির্মাণ ও কারুশিল্পের ভাল বিকাশ ঘটেছিল। কম্পাস, গানপাউডার, কাগজ ও ব্লকপ্রিণ্টিং অনেক আগে আবিষ্কৃত হয়।

সামন্তীয় উৎপাদন সম্পর্কের অধীনে উৎপাদন ছিল মূলত গৃহস্থালিভিত্তিক ছোট আকারের। এই ছোট আকারের উৎপাদন উৎপাদিকা শক্তির আরো বিকাশের সহায়ক ছিলনা। সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের অধীনে ব্যাপক অধিকাংশ কৃষক জনগণ ছিল বিশেষত নিষ্ঠুর শোষণ ও নিপীড়ণের শিকার যাদের উৎপাদন বিকাশের সামান্য সম্ভাবনাই ছিল। সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের সাথে উৎপাদিকা শক্তির দ্বন্দ্ব জমিদার ও কৃষকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবে প্রতিফলিত হয়। এটা ছিল সামন্ত সমাজেরর প্রধান দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের সর্বোচ্চ প্রকাশ ছিল জমিদারের শাসন প্রতিরোধে ব্যাপক কৃষক জনগণের সশস্ত্র বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ও সংগ্রামসমূহ ছিল সমগ্র সামন্ত যুগের বৈশিষ্ট্য। খৃষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের দিকে, চিন শিহ-হুয়াং চীনকে ঐক্যবদ্ধ করার আর প্রথম সামন্ত একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার অল্পকাল পরই চীনের ইতিহাসে প্রথম মহান কৃষক বিদ্রোহের স্ফুরণ হল যে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন চেন শেঙ ও উ কুয়াঙ। তারপর, মধ্য ঊনিশ শতকের তাইপিং বিদ্রোহের আগের দুই হাজারেরও বেশি বছর সময়কালে কয়েক শত ছোট বড় কৃষক বিদ্রোহ এবং বিপ্লবী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। চীনের ইতিহাসের কৃষক অভ্যুত্থানসমূহের আকার ও সংখ্যা বিশ্বরেকর্ড ভেঙেছে। “কেবল এই কৃষক শ্রেণীসংগ্রাম, কৃষক বিদ্রোহ আর কৃষক যুদ্ধ ছিল ঐতিহাসিক বিকাশের প্রকৃত চালিকাশক্তি। কারণ প্রতিটি প্রধান কৃষক বিদ্রোহ ও কৃষক যুদ্ধ সমকালীন সামন্ত শাসনের প্রতি আঘাত হেনেছে, এভাবে তারা সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির কিছু বিকাশ ঘটিয়েছে।”(৮) তবে চেন পো-তার মত বিশ্বাসঘাতকরা সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের কারণ সামন্ত শাসক শ্রেণীর দেয়া “ছাড়” এর উপর আরোপ করেছে যা ঐতিহাসিক বাস্তব তথ্য উপাত্তের বিরোধী। ইতিহাসে জমিদারেরা কখনোই কৃষক বিদ্রোহের প্রতি কোন ছাড় দেয়নি। তারা সর্বদাই রক্তপিপাসু নিপীড়ণ, প্রতিআক্রমণ ও চক্রান্তের আশ্রয় নিয়েছে কিন্তু কখনোই “ছাড়” এর আশ্রয় নেয়নি। বিশ্বাসঘাতক চেন পো-তার “ছাড়” সম্পর্কে তত্ত্ব ছিল জমিদারদের সৌন্দর্যমণ্ডিত করার এক খাঁটি প্রচেষ্টা।

পন্য অর্থনীতি ও আদিম সঞ্চয়ের বিকাশ পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক জন্ম দিয়েছে ও এগিয়ে নিয়েছে

সামন্ত যুগের শেষের দিকে পন্য অর্থনীতির আরো বিকাশের সাথে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক জন্ম নেয়। সামন্ত সমাজে সরল পন্য উৎপাদন ব্যক্তি মালিকানা ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত শ্রমভিত্তিক ছিল। উৎপাদনের উদ্দেশ্য ছিল বিনিময়। ক্ষুদে পন্য উৎপাদকদেরকে তাদের ফসল বাজারে বেঁচতে হত। কিন্তু যেহেতু প্রতিটি পন্য উৎপাদকের ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন পরিস্থিতি ছিল, দক্ষতা ও শ্রমের তীব্রতা ছিল ভিন্ন ভিন্ন, আবার একেক ধরণের পন্যে দেয় শ্রমও ছিল ভিন্ন ভিন্ন রকম। অন্যদিকে, একইধরণের পন্য একই দামে বিক্রয় হত। এটা একটা দ্বন্দ্ব তৈরি করে। এই দ্বন্দ্বের বিকাশের ফলে, অধিক ভাল পরিস্থিতিতে কিছু ক্ষুদে পন্য উৎপাদক উন্নতি করল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষুদে পন্য  উৎপাদক যারা অধিকতর খারাপ পরিস্থিতে ছিল তারা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে লাগল। এভাবে, সরল পন্য উৎপাদকদের মেরুকরণ ঘটল।

সামন্ত সমাজে, শিল্পসংঘ প্রায়ই গড়ে উঠত একই ধারার হস্তশিল্পীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা রুখতে অথবা অন্য এলাকার অথবা ধারার হস্তশিল্পীদের সাথে প্রতিযোগিতা হতে রক্ষা করতে। সঙ্ঘের সদস্যদের সঙ্ঘের আইন মানতে হত। হস্তশিল্প সংঘে মালিক, দক্ষ শ্রমিক ও শিক্ষানবিশ ছিল। হস্তশিল্প সঙ্ঘে মালিক, দক্ষ শ্রমিক ও শিক্ষানবিশদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল মূলত সামন্ত সম্পর্ক কিছুটা শোষণসমেত। এই সঙ্ঘগুলি ক্ষুদে পন্য উৎপাদকদের মধ্যে মেরুকরণকে সীমিত করত। কিন্তু পন্য অর্থনীতির বিকাশের সাথে, কিছু তুলনামূলক ধনী মালিকেরা সঙ্ঘের নিয়ম কানুন মানতে অনিচ্ছুক হল। তারা দক্ষ শ্রমিক ও শিক্ষানবিশের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে চলল, তাদের শ্রমসময় বাড়িয়ে দিল, উৎপাদন কৌশল উন্নত করল আর তাদের দক্ষ শ্রমিক ও শিক্ষানবিশদের ক্রমান্বয়ে ঠিকা মজুদ শ্রমিকে পরিণত করল। অন্য দেউলিয়া মালিক, দক্ষ ও শিক্ষানবিশ শ্রমিকেরা মজুদে যোগ দিতে লাগল। মেরুকরণের ভিত্তিতে পুঁজিবাদী নিয়োগের সম্পর্ক আবির্ভূত হল।

ক্ষুদে পন্য উৎপাদকদের মধ্যে মেরুকরণ ও পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের উদ্ভবের প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ী পুঁজি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পন্য বিনিময়ে বণিক ছিল আদিতে মধ্যস্থতাকারী। পরে সে ঠিকাদার বণিকে পরিণত হল যে পন্য উৎপাদকের ফসল বিক্রয় করার ঠিকা নেয়। পরে সে কাঁচামাল এমনকি যন্ত্রপাতিও ক্ষুদে উৎপাদককে সরবরাহ করে যাতে ক্ষুদে উৎপাদক এক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ও নির্দিষ্ট গুণ, পরিমাণ ও বৈশিষ্টযুক্ত জিনিস উৎপাদন করবে। এভাবে, ক্ষুদে পন্য উৎপাদক বণিকের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেল আর এক ভাড়াটে মজুদে পরিণত হল। আর বণিক নিজে এক শিল্প পুঁজিপতিতে পরিণত হল।

গ্রামাঞ্চলে, সামন্ত সমাজের শেষের দিকে, পন্য উৎপাদনের বিকাশের কারণে, জমিদার শ্রেণী ক্রমান্বয়ে মুদ্রা খাজনা চালু করে। প্রতিদিন তা কৃষককে বাজারেরে ওপর নির্ভর করে তোলে আর তাদের মেরুকরণ বাড়িয়ে দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক দেউলিয়া হয়ে ঠিকা কৃষি মজুরে পরিণত হল। অল্প কিছু নিজেদের ধনী কৃষকের পর্যায়ে ওঠালো আর পরে কৃষি পুঁজিপতিতে পরিণত হল।

এভাবে, সামন্ত সমাজে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল। চীনের সামন্ত সমাজের শেষাংশে পন্য অর্থনীতির বিকাশের সাথে, পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের বীজ প্রায় অংকুরিত হয়ে উঠল। বিদেশী পুঁজিবাদের প্রভাব না আসলে, চীন ক্রমান্বয়ে পুঁজিবাদী সমাজে বিকশিত হত।

সামন্ত সমাজে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। শুরুতে, হস্তশিল্পীদের ছোট কারখানা বৃহৎ পুঁজিবাদী কারখানায় পরিণত হল। এই কারখানাগুলিতে, হাতে কাজ করা তখনো ছিল নিয়ম। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ পুঁজিবাদী কমান্ডের অধীনে যেখানে অনেক শ্রমিকেরা একত্রে কাজ করে সেখানে সরল পারস্পরিক সহযোগিতা সম্ভব ছিল যা নতুন উৎপাদিকা শক্তির গঠনে চালিত করে। পরে, পুঁজিবাদী সরল সমন্বয় পুঁজিবাদী কারখানা হস্তশিল্প শিল্পে পরিণত হল। হস্তশিল্প কারখানা শিল্পের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে এখানে একই পন্য উৎপাদনে শ্রমিকদের শ্রমবিভাজন ছিল এই যে প্রত্যেকের এক একটা প্রক্রিয়ায় বিশেষ দক্ষতা ছিল। এটা শ্রমের প্রক্রিয়াকে সরলীকরণ করে আর শ্রমের যোগান তীব্র করার মাধ্যমে শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। এটা হাতের কাজের জায়গায় যন্ত্রের কাজ চালুর পরিস্থিতিও তৈরি করে।

পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক দুইটি মূল শর্তের ওপর নির্ভর করেঃ প্রথমত, বিরাট এক সর্বহারা শ্রেণী থাকতে হবে যারা স্বাধীনভাবে তাদের শ্রম বিক্রী করতে পারে, দ্বিতীয়ত, বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের আদি সঞ্চয় থাকতে হবে। পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের বিকাশের অনুকূল অবস্থা তৈরি করতে এই দুই পরিস্থিতি তৈরি করতে বুর্জোয়ারা সহিংসতা অবলম্বন করে। তাই, পুঁজিবাদের বিকাশে আদিম সঞ্চয়ের একটা প্রক্রিয়া ছিল।

আদিম সঞ্চয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি ছিল কৃষকদের শোষণ করা। যেখানে প্রথম পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেই ইংল্যান্ড ছিল একটা গতানুগতিক উদাহারণ। ১৪৭০ থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত ইংরেজ শাসক শ্রেণী কৃষকদের কাছ থেকে জমি জবর দখল করার মাধ্যমে “ঘেরাও কর জবর দখল কর” আন্দোলন চালায়। ইংল্যান্ডের আধুনিক শিল্প পশমী বস্ত্রশিল্প থেকে শুরু হয়। পশমী বস্ত্রশিল্পে প্রচুর পরিমাণ পশমের প্রয়োজন তার দামও বাড়িয়ে তোলে। বড় জমিদার ও খামার পরিচালকরা যেখানে সম্ভব জমি জবরদখল করে যাতে ভেড়া পালন করে টাকা বাড়িয়ে সঞ্চয় করা যায়। তারা বলপূর্বক কৃষকদের তাদের জমি থেকে বিতাড়িত করে, তাদের বাড়ীঘর জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংস করে আর বিপুল উৎপাদনের উপায় ও জীবিকার উপকরণ দখল করে নেয়। “ঘেরাও কর জমি জবরদখল কর” আন্দোলন বিপুল সংখ্যক কৃষককে তাদের আদিবাস থেকে বিতাড়িত করে যারা দূর দূরান্তে জীবন জীবিকার জন্য ভিক্ষা করতে লাগল। এর ধারাবাহিকতায়, ইংরেজ শাসক শ্রেণী বিবিধ রক্তপিপাসু আইন জারি করে যাতে তারা কৃষকদের ভেসে বেড়ানো নিষিদ্ধ করে তাদের কঠিন শর্তে ঠিকা কাজ গ্রহণে বাধ্য করে।

অর্থসম্পদ লুন্ঠন করা ছিল আদিম সঞ্চয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। ইউরোপীয় বুর্জোয়া এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় সশস্ত্র দখল পরিচালনা করে উপনিবেশ কায়েম করতে। বৃহদাকৃতির পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রতিষ্ঠার জন্য পুঁজি সঞ্চয় করার লক্ষ্যে তারা বাণিজ্য যুদ্ধ পরিচালনা করে উপনিবেশগুলির কাঁচামাল ও অর্থসম্পদ লুন্ঠন করে।

তাই, আদিম সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া ছিল বলপ্রয়োগে প্রত্যক্ষ উৎপাদককে তাদের উৎপাদনের উপায় থেকে বিচ্ছিন্নকরণ আর পুঁজিপতিদের হাতে অর্থসম্পদ পুঁজি হিসেবে কেন্দ্রীভূতকরণ। মার্কস সুগভীরভাবে ব্যখ্যা করেন, “লুন্ঠনের ইতিহাস (বুর্জোয়া কর্তৃক প্রত্যক্ষ উৎপাদকের) মানব ইতিহাসের কালপঞ্জীতে রক্ত ও আগুনের অক্ষরে লিখিত রয়েছে।”(৯) আদিম সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে প্রদর্শন করে যে পুঁজিপতিরা “আঁচড় দিয়ে শুরু করেনি”, বরং সমগ্রভাবে লুন্ঠনের ওপর নির্ভর করেছে। “পুঁজি জন্ম নিয়েছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রতিটি রক্তমাংস অস্থিমজ্জা নিংড়ে নিয়ে।” (১০)

বুর্জোয়া বিপ্লব সামন্তবাদের ধ্বংস ঘোষণা করে

সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কসমূহ ও তাদের উপরিকাঠামোসমূহ বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্কগুলির জন্ম ও বিকাশে মারাত্মক বাঁধা দিয়ে দিয়েছিল। সামন্ত সমাজে তাদের কর্তৃত্বমূলক ভূমিকা নেওয়াকে প্রতিরোধ করা হয়েছে কারণ সামন্ত শাসক শ্রেণী কখনোই স্বেচ্ছায় ঐতিহাসিক মঞ্চ থেকে অবসর নেবেনা। অনিবার্যভাবেই তারা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সেকেলে হয়ে যাওয়া সামন্ত ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে। পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধি বুর্জোয়া ও বুদ্ধিজীবিরা পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ককে “চিরস্থায়ী ও যৌক্তিক” আর “প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম” হিসেবে প্রচার করে। তারা তথাকথিত “স্বাধীনতা, সাম্য ও সার্বজনীন প্রেম” এর কথা বলে আর সামন্তবাদকে নিন্দিত করার প্রচেষ্টা চালায় যাতে সামন্তবাদ উচ্ছেদের বুর্জোয়া বিপ্লবের জন্য জনমত প্রস্তুত করা যায়। বুর্জোয়া বিপ্লবে প্রধান প্রধান শ্রেণী শক্তি ছিল কৃষক, সর্বহারা শ্রেণী আর বুর্জোয়া। কৃষকেরা ছিল প্রধান শক্তি কিন্তু তারা নতুন উৎপাদিকা শক্তির প্রতিনিধি নয়। সর্বহারা শ্রেণী তার স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলেনি, তাই বুর্জোয়ারা বুর্জোয়া বিপ্লবের নেতৃত্ব গ্রহণ করে।

পুরোনো চীন এক আধাসামন্তবাদী আধাঔপনিবেশিক সমাজ হওয়ার কারণে বুর্জোয়ারা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটা ছিল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া। সে সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল ছিল। জমিদারদের নিয়ে এর সদস্যরা সবচেয়ে পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে। তারা চীনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নিশানা ছিল। দ্বিতীয় অংশ ছিল জাতীয় বুর্জোয়া। তারা একদিকে ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের নিপীড়ণ ও বিধিনিষেধে বাঁধা আরেক দিকে তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিতও। এটা দেখায় যে কোন কোন অবস্থায় জাতীয় বুর্জোয়ারা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষের একটা শক্তি ছিল। কিন্তু তারা  ছিল দূর্বল ও অস্থায়ীও। তাই, “ঐতিহাসিকভাবে এটা নির্ধারিত হয় যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সামন্তবাদবিরোধী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী বুর্জোয়া নেতৃত্বে সম্পূর্ণ হতে পারেনা, বরং কেবল সর্বহারা নেতৃত্বেই হতে পারে।“ (১১)

যদিও বুর্জোয়া বিপ্লব ছিল এক বিপ্লব যাতে এক ধরণের শোষণের বদলে আসে আরেক ধরণের শোষণ, এই বিপ্লবের উল্টানোও ছিল। বিপ্লবের প্রক্রিয়ায়, তীব্র শ্রেণী সংগ্রাম ছিল যেখানে একদিকে সামন্ত শ্রেণীর পুনপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা আর বিপরীতে বুর্জোয়ারার প্রতিরোধ। ইংল্যান্ড ১৬৪০ সালে বুর্জোয়া বিপ্লব শুরু করেছে। এর মধ্যে দুইটি আভ্যন্তরীন যুদ্ধ হয় যেখানে স্টুয়ার্ট হাউজের প্রতিনিধি প্রথম চার্লসকে হত্যা করা হয়। ১৬৬০ খৃষ্টাব্দে স্টুয়ার্ট হাউজের আরেক প্রতিনিধি দ্বিতীয় চার্লস পুনরায় পুনপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায়। ১৬৮৮তে ইংরেজ বুর্জোয়ারা হল্যান্ড্বের প্রিন্স অব অরেঞ্জ (৩য় উইলিয়াম)কে আমন্ত্রণ জানায় স্টুয়ার্ট হাউজ উচ্ছেদে। কেবল তখনই বুর্জোয়া একনায়কত্ব সুসংহত হল। ফ্রান্সে যখন ১৭৮৯ থেকে ছিয়াশি বছরে বুর্জোয়া বিপ্লব সঙ্ঘটিত হল ১৮৭৫ এ তৃতীয় প্রজাতন্ত্র গঠনের পূর্ব পর্যন্ত, অগ্রগমন আর পশ্চাদপসরণ সমানে ঘটেছে একের পর প্রজাতন্ত্র আর রাজতন্ত্র, বিপ্লবী সন্ত্রাস প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাস, ভেতরে বাইরে যুদ্ধ, ভেতরে জয় করা আর বিদেশীদের দ্বারা বিজিত হওয়া, এক মুহুর্তও শান্তি ও স্থিতিশীলতা ছিলনা। তারপরও, যেহেতু সামন্ত ব্যবস্থা পঁচে গেছিল, যত কঠিন সংগ্রামই সে করতে চেষ্টা করুক, সে তার ধ্বংস এড়াতে পারেনি। পুঁজিবাদ কর্তৃক সামন্তবাদের প্রতিস্থাপন ছিল অনিবার্য।

প্রধান প্রধান অধ্যয়ন উদ্ধৃতি

মার্কস ও এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট ইশতেহার

এঙ্গেলস, পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব

সভাপতি মাও, “চীনা সমাজের শ্রেণী বিশ্লেষণ”

সভাপতি মাও, “চীন বিপ্লব ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি”, অধ্যায় ১

নোট

১। এঙ্গেলস, “বানর থেকে মানুষে রূপান্তরে শ্রমের ভূমিকা”

২। এঙ্গেলস, এন্টি-ড্যুরিং

৩। অনুশীলন সম্পর্কে, মাও সেতুঙ

৪। চীন বিপ্লব ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, মাও সেতুঙ

৫। কমিউনিস্ট ইশতেহার, মার্কস ও এঙ্গেলস

৬। চীন বিপ্লব ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, মাও সেতুঙ

৭। জার্মান ভাবাদর্শ, মার্কস ও এঙ্গেলস

৮। চীন বিপ্লব ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, মাও সেতুঙ

৯। মার্কস, পুঁজি, খণ্ড ১

১০। ঐ

১১। জাপ-বিরোধী যুদ্ধের পর্যায়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির করণীয়, মাও সেতুঙ।।