রাজনৈতিক অর্থনীতির মূলতত্ত্ব। রাজনৈতিক অর্থনীতির চীনের কমিউনিস্ট মূল গ্রন্থ (সাংহাই টেক্সট বুক)। বাংলা অনুবাদ। ১ম অধ্যায়

রাজনৈতিক অর্থনীতির মূলতত্ত্ব

 

রাজনৈতিক অর্থনীতির চীনের কমিউনিস্ট মূল গ্রন্থ (সাংহাই টেক্সট বুক)

লেখক গ্রুপ কর্তৃক রচিত ও সাংহাই গণ প্রকাশনা কর্তৃক মূল চীনা ভাষায় প্রকাশিত, ১৯৭৪

কেকে ফাঙ কর্তৃক ইংরেজী অনূদিত ও জেসি ওয়াঙ কর্তৃক সম্পাদিত, ১৯৭৫

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ কর্তৃক বাংলায় অনূদিত ও সর্বহারা পথ কর্তৃক প্রকাশ শুরু জানুয়ারি ২০২২

 

রাজনৈতিক অর্থনীতি অধ্যয়ন করুন

 

রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়বস্তু

মহান সভাপতি মাও বারংবার আমাদের বলেন কিছু রাজনৈতিক অর্থনীতি শিখতে। এটা শুধু যে কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য ও বিপ্লবী কেডারদের জন্য প্রয়োজন তাই নয় বরং তিন বিরাট বিপ্লবী সংগ্রামের প্রতিটি সৈনিকের জন্যও প্রয়োজন। রাজনৈতিক অর্থনীতি শেখাটা মার্কসবাদ বুঝতে খুবই গুরুত্বপূর্ন, সংশোধনবাদের সারগর্ভ সমালোচনা করার জন্য আর আমাদের নিজেরদের জন্যই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গীর রূপান্তর করতে এবং বিশেষত সমগ্র সমাজতান্ত্রিক ঐতিহাসিক পর্যায়কালের পার্টির মূল লাইন ও কর্মনীতি গভীরভাবে বুঝতে।

গ্রামে ও কলকারখানায় সম্মুখ সারিতে যে নবীন যোদ্ধারা সংগ্রামরত তারা আমাদের আশা আর সর্বহারা বিপ্লবী প্রতিষ্ঠানের তারা উত্তরাধিকার। লড়াই ভালভাবে চালাতে আর স্বাস্থবানভাবে দ্রুত বেড়ে উঠতে নবীনদের অবশ্যই রাজনৈতিক অর্থনীতি শিখতে হবে।

রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়বস্তু হচ্ছে

উৎপাদন সম্পর্ক

রাজনৈতিক অর্থনীতি কী ধরণের বিজ্ঞান? এটা অধ্যয়ন করার বিষয়বস্তু কী তা থেকে আমাদের শুরু করতে হবে। মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি অধ্যয়নের বিষয়বস্তু হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্ক। এঙ্গেলস পরিষ্কারভাবে বলেন যে “অর্থনীতি অনুসন্ধান করে জিনিসপত্র নয়, বরং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক এবং চূড়ান্তভাবে শ্রেণীসমূহের মধ্যে সম্পর্ক।“[১] জনগণের মধ্যে উৎপাদন সম্পর্ক কীভাবে উদ্ভূত হয়? আমাদেরকে মানুষের উৎপাদন কর্মকান্ড থেকে শুরু করতে হবে।

সভাপতি মাও বলেন, “মার্কসবাদীরা মানুষের উৎপাদন কর্মকান্ডকে সর্বাধিক মৌলিক কার্যকলাপ হিসেবে দেখে যা অন্য সব কর্মকান্ডকে নির্ধারন করে।“[২] কিন্তু একশ’ বছরের বেশি আগে যখন মার্কসবাদ জন্ম নেয়নি, জনগণের এই বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি ছিলনা। শোষক শ্রেণীর চিন্তাশীলরা সকলেই এই দৃষ্টিকোনকে বিরোধিতা করেছে। হয় তারা এই মিথ্যা বকবক করে যে মানব সমাজ ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে গড়ে উঠেছে অথবা মিথ্যা বুলি আওড়ায় যে বীরেরা ইতিহাস সৃষ্টি করে। তারা এই সরলতম সত্য চাপা দিতে চায় যে জনগণের রাজনীতি, বিজ্ঞান, চিত্রকলা ও ধর্মীয় কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়ার আগে নিজেদের খাদ্য, বস্ত্র ও আবাসস্থল প্রয়োজন। জনগণের যদি খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রয়োজন হয় তাদের উৎপাদন কর্মকান্ডে যুক্ত হতে হবে। তাই, বৈষয়িক দ্রব্য সামগ্রির প্রত্যক্ষ উৎপাদন মানুষের সামাজিক বিকাশের ভিত্তি গঠন করে। মেহনতি শ্রেণীর উৎপাদনশীল কার্যকলাপ ব্যতিত জনগণ বাঁচতে পারেনা, আর সমাজেরও বিকাশ হয়না। মার্কসই মানব ইতিহাসের বিকাশের এই নিয়ম আবিষ্কার করেন।

উৎপাদন করতে হলে মানুষকে কিছু পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিবর্গ উৎপাদনে নিযুক্ত হতে পারেনা। যেমনটা মার্কস দেখিয়েছেনঃ “উৎপাদনে যুক্ত হতে জনগণ কিছু সংঘ ও সম্পর্ক গঠন করে। কেবল এইসব সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে আর উৎপাদন হতে পারে।“[৩] উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জনগণের দ্বারা গঠিত এই সম্পর্কগুলিকে বলে উৎপাদন সম্পর্ক। শ্রেণী সমাজে এই সম্পর্কসমূহ চূড়ান্তভাবে শ্রেণীসম্পর্কসমূহে প্রতিফলিত হয়।

উৎপাদন সম্পর্ক তিন উপাদানে গঠিতঃ

(১) উৎপাদনের উপায়ের মালিকানার ধরণ;

(২) উৎপাদনে জনগণের ভূমিকা আর নিজেদের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক;

(৩) উৎপাদন বন্টনের ধরণ।

মালিকানার ধরণ বলতে বোঝায় কে উৎপাদনের উপায় (এর মধ্যে রয়েছে শ্রমের হাল হাতিয়ার যেমন যন্ত্র, স্থাপনা, ভুমি আর শ্রমের বস্তুসমূহ যেমন কাঁচামাল)-এর মালিক। উৎপাদন সম্পর্কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল উৎপাদনের উপায়ের মালিকানার ধরণ। এ হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তি। উৎপাদনের উপায়ের মালিকানার ধরণ উৎপাদন সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ধারণ করে। মানব সমাজের বিকাশে আদিম সমাজ, দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ নিজ নিজ মালিকানার ধরণ দ্বারা বিশিষ্ট হয়। মালিকানার ধরণ উৎপাদনে জনগণের ভূমিকা ও নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে আর এভাবে উতপাদনের বন্টনের ধরণও নির্ধারণ করে।

উৎপাদন করতে জনগণের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক থাকাই শুধু যে দরকার তাই নয় বরং মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যেও সম্পর্ক থাকতে হবে। যে শক্তির দ্বারা মানুষ প্রকৃতিকে জয় ও রূপান্তর করতে পারে তার নাম উৎপাদিকা শক্তি। উৎপাদিকা শক্তি মানুষ ও দ্রব্যসামগ্রী (উৎপাদনের উপায়) দিয়ে গঠিত হয়। উৎপদিকা শক্তির মধ্যে উৎপাদনের হাল হাতিয়ারই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদনের জন্য যে হাতিয়ার ব্যবহার হয় তার ধরণ প্রতিফলন করে মানুষ কর্তৃক প্রকৃতিকে জয় করার ক্ষমতার মাত্রাকে। কিন্তু আমরা উৎপাদনের হাতিয়ারকে উৎপাদিকা শক্তির নির্ণায়ক হিসেবে ধরতে পারিনা। “নির্ণায়ক উপাদান হচ্ছে মানুষ, দ্রব্যসামগ্রী নয়।“(৪) “পৃথিবীর সমস্ত জিনিসের মধ্যে মানুষই সর্বাধিক মূল্যবান।“(৫) এর কারণ হল যন্ত্রপাতিকে মানুষ কর্তৃক ব্যবহৃত, সৃষ্ট ও নবায়িত হতে হবে। মানুষ ছাড়া না হতে পারে কোন যন্ত্রপাতি না তার ব্যবহারের উপায়। মানুষ ছাড়া সর্বাধিক “স্বয়ংক্রিয়” যন্ত্রপাতিও কখনই স্বয়ংক্রিয় নয়।“

উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদিকা শক্তি সামাজিক উৎপাদনের দুই দিক। সামগ্রিক ঐতিহাসিক বিকাশে উৎপাদিকা শক্তি বৃহত্তম নির্ণায়ক উপাদান হিসেবে সাধারণত প্রকাশিত হয়। উৎপাদন সম্পর্কে যে কোন রূপান্তরই আবশ্যিকভাবে উৎপাদিকা শক্তিগুলির বিকাশের ফল। উৎপাদন সম্পর্ককে অবশ্যই উৎপাদিকা শক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যখন কোন উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সেই উৎপাদন সম্পর্ককে প্রতিস্থাপিত হতে হবে অন্য কিছু নয়া উৎপাদন সম্পর্ক দ্বারা যা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে অধিকতর সুসামঞ্জস হয়। তাই বলা যায়, উৎপাদন সম্পর্ক মানুষের আত্মগত ইচ্ছা দ্বারা নির্ধারিত হয়না, বরং উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের স্তর দ্বারা হয়। উৎপাদন সম্পর্ককে অবশ্যই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এ হচ্ছে একটা বিষয়গত নিয়ম যা জনগণের ইচ্ছানুসারে পরিবর্তনের বিষয় নয়। কিছু উৎপাদন সম্পর্কের উদ্ভব, বিকাশ ও বিলোপ হয় এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদিকা শক্তির দ্বন্দ্বের বিবর্তনের সাথে। তাই, উৎপাদন সম্পর্কের অধ্যয়নের সাথে মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি উৎপাদিকা শক্তিরও অধ্যয়ন করে।

ইতিহাসের সামগ্রিক বিকাশে, যদি উৎপাদিকা শক্তি প্রধান নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে, এটা দিয়ে কি এই বোঝায় যে উৎপাদিকা শক্তির তুলনায় উৎপাদন সম্পর্ক সমগ্রত নিষ্ক্রিয়? অবশ্যই নয়।

যখন উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদিকা শক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তারা একটা সক্রিয় চালিকাশক্তি হয় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে। যখন উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদিকা শক্তির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, সে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। যেহেতু উৎপাদিকা শক্তি উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন না ঘটিয়ে বিকশিত হতে পারেনা, তাই উৎপাদন সম্পর্কের রূপান্তর এখানে প্রধান নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। যখন পুরোনো চীন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের শাসনাধীন ছিল, ভূস্বামী ও মুৎসুদ্দিরা চীনের সবচাইতে প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাদপদ উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করত। উৎপাদিকা শক্তিকে মারাত্বকভাবে বিধিনিষেধ ও নাশকতাপ্রাপ্ত হতে হত। মুক্তির পূর্বে চীনের না ছিল কোন যন্ত্র তৈরির কারখানা না কোন গাড়ি নির্মাণ কারখানা বা ঊড়োজাহাজ তৈরির কারখানা। উত্তরপূর্ব চীনের বাইরে বার্ষিক ইস্পাত উৎপাদন ছিল কয়েক লক্ষ টন । এমনকি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোও বিদেশ থেকে আমদানি হত। কাপড়কে বলা হত বিদেশী কাপড়, ছাতাকে বলা হত বিদেশী ছাতা। এমনকি একটা ছোট তারকাঁটাকে বলা হত বিদেশী তারকাঁটা। এই পরিস্থিতিতে, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের শাসনের উচ্ছেদ, আর মুৎসুদ্দি-সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের স্থলে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

উৎপাদন সম্পর্কের রূপান্তরের পরই উৎপাদিকা শক্তির বড় বিকাশ ঘটে। এটা একটা সার্বজনীন নিয়ম। পুঁজিবাদী সমাজেও বৃহৎ উৎপাদিকা শক্তির বড় বিকাশ ঘটেছে বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রভাবে সামন্ত উৎপাদন সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কে দ্রুত বিকাশ ঘটার পরই। ইংল্যান্ডের কথা ধরা যাক উদাহারণস্বরূপ, এখানে উৎপাদিকা শক্তির বিরাট বিকাশ ঘটেছে সতের শতকের বুর্জোয়া বিপ্লব আর আঠারো শতকের শেষের দিকের ও ঊনিশ শতকের প্রথম দিকের শিল্প বিপ্লবের উপর ভিত্তি করে। ফ্রান্স, জার্মানী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের আধুনিক শিল্পের দ্রুততর বিকাশ ঘটেছে পুরোনো উপরিকাঠামো ও উৎপাদন সম্পর্কের বিভিন্ন রকম রূপান্তর ঘটানোর পরই কেবল। উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদিকা শক্তির ব্যাপারে, মার্কসবাদী ও সোভিয়েত সংশোধনবাদীদের মধ্যে এক সুদীর্ঘ সংগ্রামের একটা প্রধান দিক সর্বদাই এই ছিল যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ঐক্যের দৃষ্টিকোণ নাকি প্রতিক্রিয়াশীল উৎপাদন-প্রথম দৃষ্টিকোন কোনটি প্রধান। চেন পো-তার সাথে এক হয়ে লিন পিয়াও বলে যে নবম কংগ্রেসের পর প্রধান কাজ হচ্ছে উৎপাদন বাড়ানো। লিউ শাউচি ও চেন পো-তা অস্টম পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্তবলীর মধ্যে যে সংশোধনবাদী ভ্রান্তি ঢুকিয়ে দিয়েছিল, এটা তারই একটা অনুলিপি যা বলে যে “দ্বন্দ্ব হচ্ছে অগ্রসর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে পশ্চাদপদ সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির মধ্যে”। চীনে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে মূলত সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। কিন্তু এরও সীমাবদ্ধতার দিক রয়েছে। আর অসম্পূর্ণতাগুলি উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে দ্বন্দ্বরত। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দেয় যে উৎকৃষ্ট সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই সর্বদা উৎপদিকা শক্তির বিকাশকে এগিয়ে নেয়। সর্বদাই উৎপাদিকা শক্তির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদন সম্পর্কের যে দিকগুলি রয়েছে তার রূপান্তরের পরই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ এগিয়ে যায়। “অগ্রসর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে পশ্চাদপদ সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির দ্বন্দ্ব” কোথায় আছে? লিউ শাউচি, লিন পিয়াও আর অন্য একই রকম প্রতারকদের দ্বারা উত্থাপিত ভ্রান্তির অপরাধী উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদনশীলতা-প্রথম দৃষ্টিকোণকে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সর্বহারা একনায়কত্বধীনে বিপ্লব চালিয়ে যাওয়া আর সমাজতান্ত্রিক স্তরের জন্য সভাপতি মাও প্রণীত মৌলিক পার্টি কর্মনীতির বিরোধিতা করার বৃথা চেষ্টা করা। এটা হচ্ছে তাদের অসম্ভব স্বপ্ন।

উৎপাদন সম্পর্ককে উৎপাদিকা শক্তির সাথে অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ তার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ পুরোনো উৎপাদন সম্পর্কের ধ্বংস আর তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন উৎপাদন সম্পর্কের দ্বারা এর প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনকে তুলে ধরে। কিন্তু পুরোনো উৎপাদন সম্পর্কের ধ্বংস আর নতুন উৎপাদন সম্পর্কের উদ্ভবের প্রক্রিয়া মসৃন হতে পারেনা। পুরোনো উৎপাদন সম্পর্কের রূপান্তর আর নতুন উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণতা প্রায়শ বিপ্লবী সংগ্রামের পরেই কেবল ঘটে থাকে। তাই পুরোনো উৎপাদন সম্পর্ক কীভাবে রূপান্তরিত হয় আর নতুন উৎপাদন সম্পর্ক কীভাবে পূর্ণতা পায় তা বুঝতে উৎপাদন সম্পর্কের সাথে উৎপাদিকা শক্তির দ্বন্দ্ব ব্যাখ্যাই যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সাথে উপরিকাঠামোর সম্পর্ককেও বুঝতে হবে।

উপরিকাঠামো বলতে বোঝায় জাতীয় সরকার, বাহিনী, আইন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থাসমূহ আর তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মতাদর্শিক রূপ যথা দর্শন, সাহিত্য ও শিল্পকলা। অর্থনৈতিক অবকাঠামো হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্কসমূহ। “এই উৎপাদন সম্পর্কসমূহ মিলে সমাজের অর্থনৈতিক অবকাঠামো গঠন করে-এই হচ্ছে সত্যিকার ভিত্তি যার উপর আইনী ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামো আর তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ চেতনার সামাজিক ধরণসমূহ গড়ে উঠে।“(৬) মার্কসের এই বিবৃতি বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করে উপরিকাঠামো ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর মধ্যকার সম্পর্ককে।

উপরিকাঠামো ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর মধ্যে দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবকাঠামোই সাধারণভাবে নির্ণায়ক শক্তি। অর্থনৈতিক অবকাঠামো উপরিকাঠামোকে নির্ধারণ করে। অর্থনৈতিক অবকাঠামো পরিবর্তনের সাথে “সম্পূর্ণ উপরিকাঠামো ধীরে অথবা দ্রুত রূপান্তরিত হয়।“(৭) তাই বলা যায়, পুরোনো অর্থনৈতিক অবকাঠামো ধ্বংস হলে এর উপর গড়ে ওঠা উপরিকাঠামোও অবশ্যই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু এর ভাঙনের হার কমবেশী হতে পারে। প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রযন্ত্র রূপান্তরিত হলেও প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীসমূহ পুরোনো অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিলোপের সাথে স্বেচ্ছায় ইতিহাসের মঞ্চ থেকে নেমে যাবেনা। তারা অগ্রসর শ্রেণীসমূহের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী ও মরিয়া সংগ্রামে অনিবার্যভাবে নিয়োযিত হবে। নির্দিষ্ট করে বললে, উৎখাত হওয়া শ্রেণীসমূহের সাথে সম্পর্কিত পুরোনো মতাদর্শিক রূপসমূহ দীর্ঘ কাল বজায় থাকে।

উপরিকাঠামো নির্ধারিত হয় অর্থনৈতিক অবকাঠামো দ্বারা। একবার এটা প্রতিষ্ঠিত হলে তা অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উপর প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্তালিন বলেন, “অবকাঠামো তার উপরিকাঠামো সৃষ্টি করে নিজ প্রতিষ্ঠা ও সংহতকরণকে সেবা করতে আর পুরোনো অবকাঠামো ও উপরিকাঠামোকে ধ্বংস করতে।“(৮) এটা ব্যাখ্যা করে কেন উপরিকাঠামো সর্বদা নিজ অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সেবা করে। সমাজতান্ত্রিক উপরিকাঠামো এর সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সেবা করে, আর পুঁজিবাদী উপরিকাঠামো এর পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সেবা করে।

পুঁজিবাদী সমাজে, উৎপাদনের সামাজিকীকরণ আর উৎপাদনের উপায়ের ব্যক্তিগত মালিকানার মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্রতর হওয়ার সাথে সাথে পুঁজিবাদী ব্যক্তি মালিকানাকে সমাজতান্ত্রিক গণ মালিকানার দ্বারা প্রতিস্থাপনের জরুরী প্রয়োজন উপস্থিত হয়। কিন্তু বুর্জোয়ারা প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক অবকাঠামো বজায় রাখতে একে ব্যবহার করে। যদি সর্বহারা শ্রেণী প্রথমেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র চূর্ণ না করে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করা অসম্ভব। নতুন ও পুরোনো সংশোধনবাদীদের “পুঁজিবাদ শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হতে পারে” দাবী হচ্ছে মিথ্যার এক ফুলঝুড়ি।

সমাজতান্ত্রিক সমাজে, উপরিকাঠামো আর অর্থনৈতিক অবকাঠামো মৌলিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু বুর্জোয়াদের ও এর মতাদর্শিক ধরণসমূহের অস্তিত্ব আর রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহে কিছু আমলাতান্ত্রিক কাজের রীতি ও রাষ্ট্রকাঠামোর কিছু অংশে ত্রুটির অস্তিত্বের কারণে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সংহতকরণ, পূর্ণতা ও বিকাশ ব্যহত অথবা সংকুচিত হয়েছে। আমাদেরকে সমাজতান্ত্রিক উপরিকাঠামো এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে তা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে আরো ভালভাবে সেবা করতে পারে। আমাদেরকে উপরিকাঠামোয় দৃঢ়ভাবে সংগ্রামকে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং উপরিকাঠামোয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিতে হবে।

রাজনৈতিক অর্থনীতি বিবিধ শ্রেণী ও স্তরের সর্বাধিক ব্যবহারিক ও আশু স্বার্থকে তুলে ধরে। এটা শ্রেণীসংগ্রামের প্রচণ্ডতম ও তীব্রতম সমস্যাসমূহের ব্যখ্যা দেয়। মার্কসবাদী দর্শনের মতই মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি প্রকাশ্যে দাবী করে যে সে সর্বহারা রাজনীতির সেবায় নিয়োযিত। রাজনৈতিক অর্থনীতি হচ্ছে শ্রেণীসংগ্রামের এক বিজ্ঞান।

রাজনৈতিক অর্থনীতি হচ্ছে পার্টির

মৌলিক লাইন প্রণয়নের তাত্ত্বিক ভিত্তি

­­মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি জন্ম নিয়েছে আধুনিক সর্বহারা শ্রেণী ও বৃহৎ উৎপাদিকা শক্তিসমূহ যথা বৃহৎ শিল্পের আবির্ভাবের সাথে। মার্কস তার সময়ের শ্রেণীসংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। পুঁজিবাদী সমাজের বিশ্লেষণে তিনি বিপ্লবী বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদ ব্যবহার করেছেন। পুঁজিপতিরা কীভাবে শ্রমিকদের শোষণ করে তার গোপন কথাটি তিনি উন্মোচন করেছেন এবং উৎপাদনের সামাজিকীকরণ ও পুঁজিবাদী মালিকানার মধ্যকার দ্বন্দ্বসমূহকে তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রদর্শন করেন। এই দ্বন্দ্বসমূহ প্রকাশিত হয় সর্বহারা শ্রেণী ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে তীব্র বৈরিতা হিসেবে। পুঁজিবাদী সামাজিক দ্বন্দ্ব দিন দিন বিকশিত হওয়ার সাথে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কবর খোদাইকারী হিসেবে কর্মরত সর্বহারাও প্রতিদিন শক্তিশালী হয়। “শীঘ্রই পুঁজিবাদী ব্যক্তি মালিকানার বিদায় ঘন্টা বেজে উঠবে। উচ্ছেদকারীরা উচ্ছেদ হবে।“(৯) এখান থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আর সর্বহারা একনায়কত্ব দ্বারা বুর্জোয়া একনায়কত্বের অনিবার্য প্রতিস্থাপনের বিপ্লবী ও বৈজ্ঞানিক উপসংহার আসে। “মার্কস এই উপসংহারে আসেন আধুনিক সমাজের অর্থনৈতিক গতি প্রকৃতির নিয়মানুসারে।“(১০) এভাবে মার্কসবাদী দর্শন ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রসমেত মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় সর্বহারা রাজনৈতিক পার্টি কর্তৃক নিজস্ব মৌলিক নীতিমালা সূত্রায়ণের তাত্ত্বিক ভিত্তি । মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এবং পুঁজিবাদের পরিস্থিতির ভেতর সর্বহারার বিপ্লবী নেতারা সর্বহারা পার্টির জন্য মৌলিক রাজনৈতিক লাইনঃ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে বিপ্লবী সহিংসতার ব্যবহারের সূত্রায়ণ করেন। তাঁরা সর্বহারা শ্রেণীকে সংগ্রামে পরিচালিত করেন বুর্জোয়া শ্রেণীর ও সকল শোষক শ্রেণীসমূহের পূর্ণ উচ্ছেদ, বুর্জোয়া একনায়কত্বকে সর্বহারা একনায়কত্ব দ্বার প্রতিস্থাপন, পুঁজিবাদের উপর সমাজতন্ত্রের বিজয় এবং সাম্যবাদের বাস্তবায়নে।

সমাজতান্ত্রিক সমাজে, এখনো মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি সর্বহারা শ্রেণীর মৌলিক লাইনসমূহের সূত্রায়ণের তত্ত্বগত ভিত্তি যোগান দেয়। সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কসমূহ ও উৎপাদিকা শক্তিসমূহের মধ্যেকার আর উপরিকাঠামো ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর মধ্যে দ্বন্দ্বকে সভাপতি মাও সারগর্ভ বিশ্লেষণ করেন এবং সমাজতান্ত্রিক পর্যায়কালে শ্রেণীসংগ্রাম ও লাইনগত সংগ্রামের দীর্ঘকালীন ব্যপ্তি ও জটিলতা দেখান। এই তত্ত্বগত ভিত্তিতে সমগ্র সমাজতান্ত্রিক পর্যায়কালের জন্য আমাদের পার্টির মৌলিক লাইনও তিনি সূত্রায়ণ করেন। এই মৌলিক লাইন আমাদের বলে “সমাজতান্ত্রিক সমাজের সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক পর্যায়কাল রয়েছে। এই সমগ্র পর্বে শ্রেণী, শ্রেণীদ্বন্দ্ব, শ্রেণীসংগ্রাম বিদ্যমান থাকে, সমাজতান্ত্রিক পথ ও পুঁজিবাদী পথের মধ্যে সংগ্রাম বিদ্যমান, পুঁজিবাদের পুনরুত্থানের বিপদ বিদ্যমান আর সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক দখল ও আগ্রাসনের হুমকিও রয়েছে। এই দ্বন্দ্বগুলো সমাধা হতে পারে কেবল সর্বহারা একনায়কত্বধীনে বিপ্লব অব্যাহত রাখার তত্ত্ব ও এর পরিচালনাধীনে অনুশীলনের মাধ্যমে।“(১১) পার্টির মৌলিক লাইন চীনা জনগণকে পরিচালনা করে সর্বহারা একনায়কত্বের অধীনে বিপ্লব অব্যাহত রাখা, সর্বহারা একনায়কত্বকে সুসংহতকরণে সংগ্রাম করা, পুঁজিবাদের পুনরুত্থানকে রোধ করা, সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ আর সাম্যবাদের বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়নের মহান আদর্শের জন্য সংগ্রাম বজায় রাখায়।

সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক অর্থনীতির মূল কর্তব্য হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক থেকে সাম্যবাদী উৎপাদন সম্পর্কে রূপান্তরের নিয়ম অধ্যয়ন ও সংজ্ঞায়িতকরণ। রাজনৈতিক অর্থনীতির কিছু উপলব্ধি সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক গতি প্রকৃতির বস্তুগত নিয়ম এবং বিবিধ উৎপাদন সম্পর্কসমূহের একত্রিত হওয়া, মূর্ত হওয়া ও বিকাশের অনিবার্যতা বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। এটা পার্টির মূল লাইন উপলব্ধি বাড়াতে আর এর প্রয়োগে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।

পার্টির মূল লাইনের ওপর জোর দেওয়া মৌলিক গুরুত্বের বিষয়। এটা সোজা কথায় “মার্কসবাদকে প্রয়োগ করা, সংশোধনবাদকে নয়।“ মার্কসবাদকে প্রয়োগ করতে আমাদের প্রথমে মার্কসবাদকে জানতে হবে। সংশোধনবাদকে বিরোধিতা করতে আমাদের বলতে সক্ষম হতে হবে সংশোধনবাদ কী। কিন্তু মার্কসবাদ দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নিয়ে গঠিত। আমরা যদি মার্কসবাদকে বুঝতে চাই, আমাদের অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে মার্কসবাদী দর্শন ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র অধ্যয়ন করতে হবে, শুধু তাই নয়, আমাদেরকে গুরুত্ব সহকারে মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতিও অধ্যয়ন করতে হবে।

মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি সকল বুর্জোয়া ও সংশোধনবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির বিরোধী, আর এটা গড়ে উঠেছে বুর্জোয়া ও সংশোধনবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের প্রক্রিয়ায়। মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যয়ন পার্থক্য করতে সাহায্য করে মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদের মধ্যে, সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে, এবং সর্বহারা ও বুর্জোয়ার মধ্যে। এটা বিচ্যুতির প্রবণতাকেও সংশোধন করবে আর আমাদের মতাদর্শিক সচেতনতা বাড়াবে।

সংক্ষেপে, আমরা যদি পার্টিবিরোধী ও মার্কসবাদবিরোধী চিন্তাকে দূর করতে চাই, সমাজতন্ত্রের পর্বে পার্টির মূল লাইনকে ভালভাবে এগিয়ে নিতে চাই, লিন পিয়াওয়ের প্রতি সমালোচনা ও কর্মপদ্ধতির শুদ্ধিকরণ অধিকতর সারগর্ভ করতে চাই এবং মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নব নব ও বৃহত্তর বিজয় অর্জন করতে চাই আমাদেরকে অবশ্যই কিছু রাজনৈতিক অর্থনীতি অধ্যয়ন করতে হবে।

ভালভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতি জানতে শিখতে

তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে যুক্ত করুন

রাজনৈতিক অর্থনীতি দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রদর্শন ও প্রয়োগ। রাজনৈতিক অর্থনীতি শিখতে হলে আমাদেরকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পরিচালনাকে অনুসরণ করতে হবে। “দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি প্রতিটি আকৃতি বিন্যাসকে নিজ অব্যাহত গতি ও অস্থায়ী প্রকৃতির সাহায্যে বুঝতে চেষ্টা করে। সে কারো পুঁজা করেনা, সে সমালোচনামূলক আর বিপ্লবী চরিত্রের“(১২)। এই সর্বহারা বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী ভাববাদ ও অধিবিদ্যার সরাসরি বিরোধী। আমরা যখন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ পুরোপুরি আত্মস্থ করি এবং সেগুলোকে পুঁজিবাদী সমাজ ও অর্থনীতির গতির নিয়মকে বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে ব্যবহার করি কেবল তখনই আমরা বুঝতে পারি কেন পুঁজিবাদের ধ্বংস আর সমাজতন্ত্রের বিজয় অনিবার্য। আর যখন আমরা সমাজতান্ত্রিক সমাজের গতির নিয়মকে বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে সেগুলোকে ব্যবহার করি, কেবল তখনই আমরা সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভেতরকার শ্রেণীসংগ্রাম ও লাইনগত সংগ্রামের সময় ব্যপ্তি ও জটিলতাকে বুঝতে পারব, কেবল তখনই আমরা সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে বিকাশের সাধারণ প্রবণতকে বুঝতে পারব আর এও যে কেন তা মানুষের ইচ্ছা দ্বারা এড়ানো যায়না। পূর্ণ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সহযোগে আর আত্মত্যাগে ও বাঁধাবিঘ্নে নির্ভীক থেকে সাম্যবাদী ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য সংগ্রামে আমাদের আস্থাকে তা শক্তিশালী করবে।

রাজনৈতিক অর্থনীতি শিখতে আমাদের শেখার বিপ্লবী রীতির উপর জোর দিতে হবে যা তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে যুক্ত করে। সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন “আমাদের মার্কসবাদী তত্ত্বকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে হবে এবং তাকে প্রয়োগ করতে সক্ষম হতে হবে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এটা জানার উদ্দেশ্য হল একে প্রয়োগ করা।“(১৩) তত্ত্ব ও অনুশীলনের যুক্তকরণ হচ্ছে বিপ্লবী শৃংখলার বিষয় এবং পার্টির চরিত্রের একটা বিষয়। আমাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যয়নকে আধুনিক সংশোধনবাদের প্রতি সমালোচনার সাথে যুক্ত করতে হবে, লিউ শাও-চি, লিন পিয়াও ও এদের মত প্রতারকদের দ্বার চালিত প্রতিক্রিয়াশীল ভ্রান্তির সমালোচনার সাথে, শ্রেণীসংগ্রাম, উৎপাদন সংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার তিন মহান বিপ্লবী অনুশীলনের সাথে আর বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরের সাথে। “মার্কসবাদী দর্শন বলে যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বস্তুগত জগতের নিয়মকে বুঝতে সক্ষম হওয়ার মাধ্যমে একে ব্যাখ্যা করতে পারা নয়, বরং এই উপলব্ধিকে বিশ্বের রূপান্তরে ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়া।“ (১৪)

মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি শেখা কি কঠিন? হ্যাঁ। পুঁজির প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় মার্কস বলেনঃ “প্রতিটি জিনিস শুরুতে কঠিন থাকে। প্রতিটি বিজ্ঞানই এইরকম।“ বস্তুগত প্রপঞ্চের মূর্ত বিশ্লেষণে মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি উপরিতল ভেদ করে ভেতরে ঢোকে, সারকে আঁকড়ে ধরে আর বৈজ্ঞানিক বিমূর্তকরণ ঘটায়। এভাবে আমরা যখন শুরু করি, আমরা কিছু পরিভাষা ও ধারণার মধ্য দিয়ে যাই যা বোঝা কঠিন। কিন্তু মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি সর্বহারা শ্রেণীর জন্য লেখা হয়েছিল আর তা সর্বহারা বিপ্লব নিয়ে কথা বলে। আমরা গুরুত্ব সহকারে একে অধ্যয়ন করলেই কেবল আমরা ক্রমান্বয়ে এক বুঝতে পারি।“ ‘কঠিন কোন জিনিস নেই, কেবল মানুষ পর্যাপ্ত সমাধান পায়না’। যদি শুরু করতে কঠিন না হয় তাহলে এর আরো উন্নত অধ্যয়ন সম্ভব। যা প্রয়োজন তা হল শেখার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর সক্ষমতা।“(১৫)

মার্কস একবার বলেছিলেন, “বিজ্ঞানে মসৃন কোন পথ নেই। যারা পর্বতের উচ্চ শিখরে বেয়ে উঠতে ভীত নয় কেবল তারাই প্রতিভার শিখরে ওঠার আশা করতে পারেন।“(১৬) সর্বহারা বিপ্লবী নেতারা তাদের সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন মার্কসবাদী তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা ও গড়ে তোলায়। তাদের আলোকজ্জ্বল উদাহারণ অনুসরণ করে আর মার্কস, লেনিন ও সভাপতি মাওয়ের রচনা অধ্যবসায়ের সাথে অধ্যয়ন করে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে এই মার্কসবাদী তত্ত্বগত অস্ত্রের ওপর দক্ষতা অর্জন করতে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিনির্মাণ করতে আর সারা দুনিয়ায় সাম্যবাদ বাস্তবায়ন করতে।

প্রধান প্রধান অধ্যয়ন রেফারেন্স

মার্কস, “রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সমালোচনা এর মুখবন্ধ”

এঙ্গেলস, এন্টি ড্যুরিং, খণ্ড ২, অধ্যায় ১

লেনিন, কার্ল মার্কস (“মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্ব”)

সভাপতি মাও, “দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে”, ৪র্থ অধ্যায়

সভাপতি মাও, “জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসা সম্পর্কে”, ১ম অধ্যায়

নোট

১। এঙ্গেলস, “কার্ল মার্কসের ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা’”, মার্কস ও এঙ্গেলস এর নির্বাচিত রচনা, খণ্ড ২

২। অনুশীলন সম্পর্কে, “মাও সেতুঙের নির্বাচিত রচনা, খণ্ড ১

৩। মার্কস, মজুরি, শ্রম ও পুঁজি, মার্কস এঙ্গেলস এর নির্বাচিত রচনা, খণ্ড ১

৪। “দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ সম্পর্কে”, মাও সেতুঙের নির্বাচিত রচনা সংকলন, খণ্ড ২

৫। “ইতিহাসের ভাববাদী ধারণার দেউলিয়াপনা”, মাও সেতুঙের নির্বাচিত রচনা সংকলন, খণ্ড ৪

৬। মার্কস, “রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা র সূচনা” মার্কস এঙ্গেলস এর নির্বাচিত রচনা সংকলন, খণ্ড ২

৭। ঐ

৮। স্তালিন, মার্কসবাদ ও ভাষা বিজ্ঞান

৯। মার্কস, পুঁজি, খণ্ড ১, মার্কস ও এঙ্গেলস সমগ্র, খণ্ড ২৩

১০। “কার্ল মার্কস”, লেনিনের নির্বাচিত রচনা সংকলন, খণ্ড ২

১১। “চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সংবিধান”, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসের সংগৃহীত দলিলসমূহ

১২। মার্কস, “পুঁজির দ্বিতীয় সংস্করণের উপসংহার”, মার্কস ও এঙ্গেলস সমগ্র, খণ্ড ২৩

১৩। “পার্টি কাজের রীতির সংশোধন”, মাও সেতুঙের নির্বাচিত রচনা সংকলন, খণ্ড ৩

১৪। “অনুশীলন সম্পর্কে”, মাও সেতুঙ নির্বাচিত রচনা সংকলন, খণ্ড ১

১৫। “চীনের বিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতির সমস্যা”, মাও সেতুঙ নির্বাচিত রচনা, খণ্ড ১

১৬। মার্কস, “পুঁজি র ফরাসী সংস্করণের ভূমিকা”, মার্কস ও এঙ্গেলস রচনাবলী, খণ্ড ২৩।।