সিরাজ সিকদার রচনাঃ কমিউনিস্ট হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সভাপতি মাওয়ের পাঁচটি মানদণ্ড

 

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার

 


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ১৯৭০

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক ১৯৭২ সালে ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীউদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কেসংকলনপুস্তিকায় প্রকাশিত

পূবাসপা কর্তৃক ১৯৭৪ সালেমতাদর্শগত রচনাবলীতে প্রকাশিত

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১২ ডিসেম্বর ২০১২


পিডিএফ

।।Communists should be the Advance Elements of the proletariat”. Foreign Language Press, Pekingপ্রবন্ধ অবলম্বনে ।।

 

সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “পার্টি সংগঠন গঠিত হবে সর্বহারার অগ্রসর ব্যক্তিদের নিয়ে; একে হতে হবে প্রাণপূর্ণ অগ্রগামী একটি সংগঠন যা সর্বহারা শ্রেণী বিপ্লবী জনগণকে শ্রেণীশত্রু বিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম” পূর্ববাংলার সর্বহারা শ্রেণীর সঠিক রাজনৈতিক পার্টি গঠনের যে মহান ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমরা পালন করছি তা বলতে বুঝায় সর্বহারা বিপ্লবী অগ্রগামীদের তৈরী করা এবং সুসংবদ্ধ করা, বাসিটা বর্জন করা, টাটকাটা গ্রহণ করা, সকল স্তরের পার্টি সংগঠনকে সংগ্রামের দুর্গ হিসেবে সুসংবদ্ধ করা এবং ব্যাপক পার্টি কর্মীদের বিপ্লবী ঝড়-তরঙ্গে পরীক্ষিত করে তোলা।

সর্বহারা অগ্রসর লোকদের কি কি মানদণ্ড রয়েছে? তা হলো সভাপতি মাওয়ের পাঁচটি মানদণ্ড যা সভাপতি মাও উল্লেখ করেছেন এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নতুন সংবিধানে গ্রহণ করা হয়েছে। পুর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিও এটা গ্রহণ করেছে তার সংবিধানে। এ সকল মানদণ্ড অর্জনের জন্য কর্মীরা অবশ্যই প্রচেষ্টা চালাবেন যাতে তারা ভাল কমিউনিস্ট হয়ে জনগণের অধিকতর সেবা করতে পারেন।

প্রথমঃ

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা সৃজনশীলভাবে অধ্যয়ন ও প্রয়োগ করা ।

এটা উল্লেখ করেছে আমাদের চিন্তাধারা এবং রাজনৈতিক লাইনের পথ নির্দেশের ভিত্তিতে। সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “কেডারদের শিক্ষিত করতে হবে যাতে তারা কিছুটা মার্কসবাদ রপ্ত করে, এটা আরো ভাল হবে যদি তারা আরো অধিক রপ্ত করে অর্থাৎ তারা মার্কসবাদের জন্য প্রচেষ্টা চালাবে, সংশোধনবাদের জন্য নয়” মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সৃজনশীল অধ্যয়ন ও প্রয়োগের উপর নির্ভর করেই সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রসর ব্যক্তিগণ পরিপক্ক হয়ে উঠবেন। নতুন পার্টি সদস্যগণ এবং সক্রিয় ব্যক্তিগণ যারা পার্টিতে যোগদান করতে উৎসাহী তারা অবশ্যই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা অধ্যয়ন করবেন। পুরোনো কর্মীরাও একইভাবে কাজ করবেন, বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় কেডাররা অধ্যয়ন করবেন ন্যায়পরায়ণতার সাথে এবং অধ্যবসায়ের সাথে। তারা শিখবেন, তা প্রয়োগ করবেন। মার্কসাবদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সারবস্তু হলো বিপ্লব করা, শ্রেণী সংগ্রাম করা (বর্তমান পর্যায়ে জাতীয় ক্ষেত্রে শ্রেণী সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রামের রূপ নিয়েছে, যেহেতু জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান—লেখক) এবং সর্বহারা একনায়কত্ব (সমাজতান্ত্রিক সমাজের জন্য প্রযোজ্য, বর্তমানে সর্বহারার নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক শ্রেণীসমূহের যৌথ একনায়কত্ব—লেখক) ব্যবহার করা।

সৃজনশীল অধ্যয়ন ও প্রয়োগ বলতে আমরা বুঝি তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে সংযুক্ত করা, সর্বদা সভাপতি মাওয়ের বিপ্লবী লাইনের প্রতি অনুগত থাকা, শ্রেণী শত্রু (বর্তমানে জাতীয় ক্ষেত্রে জাতীয় শত্রু—লেখক), বাম ও ডান বিচ্যুতি এবং নিজের মধ্যকার অসর্বহারা মতাদর্শ ও তার প্রকাশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সাহসী হওয়া।

দ্বিতীয়ঃ

পূর্ববাংলা ও বিশ্বের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের জন্য কাজ করা। সভাপতি মাও আমাদেরকে শিক্ষা দেন, আমরা অবশ্যই ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ … … লোকদের স্বার্থে এবং বিশ্বের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের স্বার্থে কাজ করবো, আমরা অবশ্যই অল্পসংখ্যক লোকদের স্বার্থে, বুর্জোয়াদের স্বার্থে, জমিদার, ধনী চাষী, প্রতিবিপ্লবী, খারাপ লোক বা দক্ষিণপন্থীদের স্বার্থে কাজ করবো না ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে কমিউনিস্টরা অবশ্যই জাতীয় সংগ্রাম চালাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার সকল প্রতিক্রিয়াশীল পদলেহী কুকুরদের উৎখাত করার জন্য। তাদের সর্বশক্তি এমনকি জীবনও উৎসগীকৃত করবে বুর্জোয়া এবং অন্যান্য শোষক শ্রেণীসমূহ উৎখাত করা এবং মানবগোষ্ঠীর মুক্তির জন্য।

কিছু কিছু লোক জনগণের সেবার কথা প্রচার করে কিন্তু বাস্তবে তারা তাদের নিজেদের শক্তিশালী দুর্গ, তাদের ছোট চক্র, বা তাদের নিজেদের সেবা করে। এরা সত্যিকার কমিউনিস্ট নয়। এদেরকে নেতার পদ দূরের কথা, নেতৃত্ব প্রদানকারী সংস্থার সদস্য হতেও অনুমতি দেয়া উচিত নয়।

তৃতীয়ঃ

যারা ভুল করে বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু আন্তরিকতার সাথে ভুল সংশোধন করেছেন এদেরসহ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে ভাগ্যান্বেষী, ষড়যন্ত্রকারী এবং দুমুখোদের বিরুদ্ধে যাতে করে এ ধরনের খারাপ লোকদের পার্টি ও রাষ্ট্রের যে কোন স্তরের ক্ষমতা দখল ঠেকানো যায় এবং পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা সর্বদা মার্কসবাদী বিপ্লবীদের হাতে থাকে। পূর্ববাংলার বিপ্লবীদের বিজয় অর্জন, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন, সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ও সুসংবদ্ধকরণের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সংখ্যাধিক জনসাধারণের সাথে ঐক্য এবং খারাপ লোকদের পার্টি রাষ্ট্রের যে কোন স্তরের ক্ষমতা দখল প্রতিহত করা সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, ব্যাপক জনসাধারণের সাথে এবং কেডারদের পঁচানব্বই ভাগের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন কমিউনিস্টদের, বিশেষ করে পার্টির নেতৃস্থানীয় কেডারদের অবশ্যই সর্বহারার মনের প্রসারতা থাকবে। তারা অবশ্যই সাধারণ স্বার্থ এবং সামগ্রিক অবস্থাকে মনে রাখবে। তারা অবশ্যই উপলব্ধি করবে যে, মানুষ বদলাতে পারে যারা ভুল করেছে তাদেরকে আমরা উৎসাহিত করবো ভুল সংশোধন করার জন্য এবং তাদেরকে সাহায্য করবো।

একবার যখন একজন তার ত্রুটি ন্যায়পরায়ণতার সাথে সংশোধন করেছে, এর পরেও তার বিরুদ্ধে আমরা বিরামহীনভাবে সমালোচনা অবশ্যই চালিয়ে যাবো না।

চতুর্থঃ

কোন সমস্যা দেখা দিলে জনসাধারণের সাথে পরামর্শ করুন। সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, কমিউনিস্টদের অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতি নয়, গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতি থাকবে যখন সমস্যা দেখা দেবে কমরেডদের সাথে পরামর্শ কর, পুরোপুরি আলোচনা কর, বিভিন্ন মতামত শোন, এমনকি যাদের বিরুদ্ধে মতামত রয়েছে তাদেরও বলতে দাও অর্থাৎ আমরা অবশ্যই সবাইকে বলতে দাও-এ অভ্যাস রপ্ত করবো এবং “আমি যা বলি তাই একমাত্র সঠিক” -এ পদ্ধতিকে বিরোধিতা করবো। একটি সভায় হ্যাঁ বলা এবং পরে কথা পাল্টিয়ে না বলাএরূপ করবো না কমিউনিস্টরা অবশ্যই জনগণের নিকট থেকে শিখতে ইচ্ছুক এরূপ ছাত্র হবে। জনগণের সাথে নিজেদের একাত্ম করবে এবং জনসাধারণের নিকট থেকে আসাজনসাধারণের নিকট যাওয়া-এ নীতিতে দৃঢ় থাকবে।

পার্টি কেডারদের জন্য এটা আরো অধিক প্রয়োজন জনসাধারণের গভীরে যাওয়া, অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করা, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য উদাহারণকে আঁকড়ে ধরা এবং সম্পূর্ণ কাজের এক-তৃতীয়াংশ প্রথমে আঁকড়ে ধরে কাজকে ভালভাবে সম্পন্ন করা।

অনেক জিনিস যা জনগণ কর্তৃক উত্থাপিত হয়েছে তা আমরা বুঝি না, আমরা তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবো এবং তাদের অগ্রসর অভিজ্ঞতাকে জনপ্রিয় করবো।

পঞ্চমঃ

সমালোচনা-আত্মসমালোচনা চালাতে সাহসী হও। কেবলমাত্র সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমেই কমিউনিস্টরা নিজেদেরকে শুধরাতে পারে এবং নিজেদের বিকশিত করতে পারে। সভাপতি মাও বলেছেন, তুমি ভেবো না যে তুমি একাই সবকিছূ করতে পার, আর অন্যেরা কিছুই করতে পারে না, পৃথিবী তোমাকে ব্যতীত ঘুরা বন্ধ করে দেবে সর্বদাই কমিউনিস্টরা জনগণের নিকট নিজেদের মন খুলে দেবে এবং তাদের মতামতকে অভিনন্দন জানাবে; যদি একজন লোক ভুল করে থাকেন কিন্তু তৎক্ষণাৎ আত্মসমালোচনা করেন, অন্যের সমালোচনা আহ্বান করেন এবং ভুল সংশোধন করেন তাহলে তিনি একজন ভাল কমরেড।

এই পাঁচটি মাপকাঠি যা পার্টি সদস্যরা অবশ্যই অর্জন করবে তা সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় –

প্রথমটি হলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা এবং সভাপতি মাও-এর বিপ্লবী লাইনের প্রতি অনুগত থাকা।

দ্বিতীয়টি হলো জনগণের প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং তাদের উপর নির্ভর করা।

তৃতীয়টি হলো নিজেকে কঠোরভাবে যাচাই করা।

এই তিনটি প্রশ্নের সমাধান করা বলতে বুঝায় একজনের বিশ্বদৃষ্টিকোণ পরিবর্তন করা এবং মতাদর্শগতভাবে পার্টিতে যোগদান করা। কেবলমাত্র সর্বহারার বিশ্বদৃষ্টিকোণ অর্জন করে এবং নিজেদের প্রতি পার্টি সদস্যদের অবশ্যই অর্জনীয় পাঁচটি মানদণ্ড মাপকাঠি হিসেবে কঠোরভাবে ব্যবহার করে তারা সর্বহারার অগ্রসর ব্যক্তিদের সারির যোগ্য হতে সক্ষম হবে। যত অধিক এ ধরণের অগ্রসর ব্যক্তিদের সংখ্যা হবে তত ভালভাবে পার্টি সংগঠন তাদের সংগ্রামী দূর্গের ভূমিকা পালন করবে এবং আমাদের বিজয় নিশ্চিত হবে, পূর্ববাংলার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জিত হবে। ■