সিরাজ সিকদার রচনাঃ উপদলবাদের শ্রেণী বিশ্লেষণ

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ১৯৭০

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক ১৯৭২ সালে “ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে” সংকলন-পুস্তিকায় প্রকাশিত

পূবাসপা কর্তৃক ১৯৭৪ সালে “মতাদর্শগত রচনাবলী”তে প্রকাশিত

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১২ ডিসেম্বর ২০১২


 

পিডিএফ

 

।। হংকির প্রবন্ধ উপদলবাদের শ্রেণীবিশ্লেষণ কর (পিকিং রিভিও, নং ১৯, ১৯৬৮ সাল)-এর ভিত্তিতে ।।

 

শ্রেণী সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী রয়েছে। প্রতিটি শ্রেণীর অভ্যন্তরে স্তর রয়েছে। রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রতিটি শ্রেণী এবং স্তর অবশ্যই বাম, মাঝারি ও দক্ষিণ উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। এটা মানুষের ইচ্ছার বাইরে সার্বজনীন নিয়ম।

সর্বহারার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রাম প্রতিটি শ্রেণী ও স্তরকে সংগ্রামে অবতীর্ণ করায়। প্রতিটি শ্রেণী ও রাজনৈতিক স্তরের শক্তিসমূহ তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করে, আরও প্রকাশ করে নিজস্ব দলীয কার্যকলাপ। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে উপদলবাদের শ্রেণী-বিশ্লেষণ করা একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

লেনিন বলেছেন, শ্রেণী বিভাগ অবশ্যই চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক দলের ভিত্তি; চূড়ান্ত বিশ্লেষণে অবশ্যই এটা নির্ণয় করে রাজনৈতিক দলকে

শ্রেণী সমাজে সকল শ্রেণীসংগ্রাম হলো রাজনৈতিক সংগ্রাম যা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পায় বিভিন্ন দল ও উপদলের মধ্যকার সংগ্রামের মাধ্যমে।

সভাপতি মাও বলেছেন, একটি পর্টির বাইরে রয়েছে অন্যান্য পার্টি এবং একটি পার্টির অভ্যন্তরে রয়েছে উপদল; সর্বক্ষেত্রেই এইরূপ ঘটে থাকে পুঁজিবাদী সমাজে বিভিন্ন দল ও উপদল রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট পার্টি এবং রিপাবলিকান পার্টি হলো একচেটিয়া পুঁজিবাদী শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী দুটো উপদল। একইভাবে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনেও বিভিন্ন দল ও উপদল রয়েছে। প্রথম আন্তর্জাতিকে সর্বহারার স্বার্থ রক্ষাকারী মার্কসবাদীদের সাথে সংগ্রাম চলেছে বুর্জোয়া ও ক্ষুদে বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষাকারী প্রুধো, বাকুনিন, লাসাল এবং অন্যান্য উপদলের বিরুদ্ধে। প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে লেনিনের প্রতিনিধিত্বে বামপন্থীরা বার্নস্টাইন এবং অন্যান্য সংশোধনবাদী উপদলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। কাউটস্কি কিছুকালের জন্য মাঝামাঝি থেকে যুদ্ধের সময় দক্ষিণপন্থী হয়ে যায়। তৃতীয় আন্তর্জাতিক সংগ্রামের সময় লেনিন ও স্ট্যালিন ছিলেন সত্যিকারের বামপন্থী, বুখারিন ছিল দক্ষিণপন্থী এবং ট্রটস্কী ছিল আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান এবং সে পরবর্তী পর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে প্রতিবিপ্লবীতে পরিণত হয়। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে সুবিধাবাদী উপদল হলো দক্ষিণপন্থী; শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের মধ্যে এরা হলো বিশেষ বাহিনী। এবং এদের ভিত্তি হলো শ্রমিক আমলাতন্ত্র। এদের মতাদর্শ হলো

সত্যিকারভাবে বুর্জোয়া মতাদর্শ যা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে প্রকাশ পায়। এরা শ্রমিক শ্রেণীকে দুর্নীতিপরায়ণ করার চেষ্টা করে।

পূর্ববাংলার মার্কসবাদী আন্দোলনে পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন প্রতিনিধিত্ব করে সত্যিকার বামপন্থী বিপ্লবীদের এবং মণিসিংহ মোজাফ্ফর প্রতিনিধিত্ব করে প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থীদের এবং হক-তোয়াহা, কাজী-রণো, নানা-মতিন প্রতিনিধিত্ব করে আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডানপন্থীদের।

সভাপতি মাও উল্লেখ করেছেন, মানুষের বসবাসহীন মরুভূমি ব্যতীত অন্য যেখানেই মানবগোষ্ঠী রয়েছে সেখানেই তারা বাম, মাঝারী দক্ষিণে বিভক্ত, হাজার বছর পরেও এমনি হবে

পার্টি মনোভাব সর্বহারা শ্রেণী চরিত্রের কেন্দ্রীভূত প্রকাশ। কেবলমাত্র সর্বহারার সব চাইতে সচেতন এবং অগ্রগামী শক্তিই সম্পূর্ণভাবে এবং সত্যিকারভাবে সর্বহারা শ্রেণী স্বার্থ এবং অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। এইরূপ হলেই সর্বহারা বিপ্লবীরা সর্বহারা পার্টি মনোভাবের সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যাকে আমরা সাধারণভাবে সর্বহারা পার্টি মনোভাব এবং বুর্জোয়া উপদলীয় মনোভাবের সংগ্রাম বলি তা সর্বহারার পার্টি মনোভাবের সাথে বুর্জোয়া পার্টি মনোভাবের সংগ্রাম ব্যতীত আর কিছুই নয়।

সভাপতি মাও বলেছেন, শিক্ষার প্রতিটি লাইনে বিভিন্ন ধারা এবং বিভাগ রয়েছে; বিশ্বদৃষ্টিকোণের বিষয়ে অবশ্য আজকাল মৌলিকভাবে কেবলমাত্র দুটো দিক রয়েছেঃ সর্বহারা বুর্জোয়া  হয় এটা, নয় অপরটা; হয় সর্বহারা অথবা বুর্জোয়া বিশ্বদৃষ্টিকোণ” আমাদের সংগঠনে বিভিন্ন ধরনের যে দৃষ্টিকোণ দেখা যায় তারা মূলতঃ দু’ভাগে বিভক্ত; তারা দু’টি বৃহৎ শ্রেণীর প্রতিনিধি।

প্রতিটি উপদল এবং প্রতিটি উপদলীয়বাদের প্রকাশ বিভিন্ন শ্রেণী এবং স্তরের স্বার্থ, চিন্তা এবং দাবীর প্রতিনিধিত্ব  করে। জটিল শ্রেণী সংগ্রামে জনগণের কাজ অনুযায়ী শ্রেণী অনুসন্ধান করা প্রয়োজন যাতে করে সার্বিক অর্থে সত্যিকার বিপ্লবী, বুলিতে বিপ্লবী আর প্রতিবিপ্লবীদের মধ্যে পার্থক্যরেখা টানতে পারা যায়।  অর্থাৎ, আমরা তাদের শ্লোগান ও বক্তৃতা দ্বারাই বিচার করবো না, যা আরো গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তারা কোন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে, কোন শ্রেণী লাইন অনুসরণ করে, এবং কোন শ্র্রেণী তাদের কাজ থেকে উপকৃত হয়।

সভাপতি মাও সেতুঙের চিন্তাধারা এবং মাওয়ের সর্বহারা বিপ্লবী লাইনের প্রতি আনুগত্য, ব্যাপক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার সর্বহারা দায়িত্ব গ্রহণ, সংশোধনবাদী, নয়া সংশোধনবাদী ও ট্রটস্কীবাদীদের বিরুদ্ধে অনমনীয়ভাবে সংগ্রাম করা, পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক লাইন দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করা, নিঃস্বার্থভাবে দেশ ও জনগণের সেবা করা প্রভৃতি হলো সর্বহারার পার্টির মনোভাব।

একগুঁয়েভাবে বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল লাইনকে আঁকড়ে ধরা, দক্ষিণ দিক থেকে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ, দক্ষিণপন্থী আপসবাদ এবং দক্ষিণপন্থী বিভেদপন্থীবাদ দ্বারা সভাপতি মাওয়ের সর্বহারা বিপ্লবী লাইনের বিরোধিতা করা

অথবা আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান অর্থাৎ অতি বাম দিক থেকে সভাপতি মাওয়ের বিপ্লবী লাইনের ক্ষতি  করা—এগুলো হলো বুর্জোয়া পার্টি বা উপদলীয় মনোভাবের একগুঁয়ে প্রকাশ।

ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী সর্বহারার মিত্র এবং জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি উল্লেখযোগ্য পরিচালক শক্তি। আমাদের সংগঠনের অধিকাংশ সদস্য এই ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত। বিপ্লবী দৃঢ়তার অভাবে ভোগে বলে এরা সহজেই বুর্জোয়া উপদলবাদে প্রভাবান্বিত হয়। এই কারণে সভাপতি মাওয়ের বিপ্লবী লাইন দ্বারা ক্ষুদে বুর্জোয়াদের দোদুল্যমানতা দূর করা প্রয়োজন। এটা অবশ্যই প্রয়োজন সভাপতি মাওয়ের সর্বহারা বিপ্লবী লাইন দ্বারা সর্বহারা ও ব্যাপক বিপ্লবী জনগণের ঐক্যকে সুদৃঢ় করা, বিপ্লবী বাহিনীকে সুসংবদ্ধ করা এবং পূর্ববাংলার জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া।

বুর্জোয়া উপদলবাদকে দৃঢ়ভাবে ধিকৃত করতে হবে। যারা বুর্জোয়া উপদলবাদে প্রভাবান্বিত এবং তা বজায় রাখতে একগুঁয়েমি প্রদর্শন করে, তাদের ভুল পথ গ্রহণ করার এমন কি শত্রু দ্বারা ব্যবহৃত হবার সমূহ বিপদ রয়েছে। এই সকল ক্ষুদে বুর্জোয়াদের শিক্ষিত করবার প্রচুর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, আমরা অবশ্যই ভালো হবোআমাদের বাহিনীর ক্ষুদে বুর্জোয়া ভাবধারাসম্পন্ন লোকদের সর্বহারা বিপ্লবী লাইনে পরিচালিত করতে

পৃথিবীতে শ্রেণীর ঊর্ধ্বে কোন পার্টি মনোভাব বা উপদলীয় মনোভাব নাই। শ্রেণীহীন দৃষ্টিকোণ হলো বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণ যা শ্রেণীর ঊর্ধ্বে বলে দাবী করে। উপদলীয় সংগ্রাম শ্রেণী সংগ্রামেরই প্রকাশ। উপদলবাদের শ্রেণীভিত্তি যদি সরিয়ে ফেলা হয়, তাহলে অসম্ভব হবে সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্যরেখা টানতে এবং এটা সর্বহারা বিপ্লবীদের ও বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যকার পার্থক্যকে মুছে দেবে। দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদীরা সর্বদাই সর্বহারা বিপ্লবীদের বিরোধিতা করতে যেয়ে এই কৌশল অবলম্বন করে।

আমরা বুর্জোয়া উপদলবাদকে বিরোধিতা করি সর্বহারা বিপ্লবীদের উপদলবাদ অর্থাৎ সর্বহারা অগ্রগামীদের পার্টি মনোভাবকে জোরদার করার জন্য। লেনিন বলেছেন, কঠোর পার্টিনীতি বিকাশের জন্য প্রকাশ্য এবং ব্যাপক শ্রেণী সংগ্রাম দাবী করা আমরা আরো কঠোরভাবে বিকাশ ঘটাবো সর্বহারার পার্টি মনোভাবকে এবং অধিকতর প্রচেষ্টা চালাবো মাও সেতুঙের চিন্তাধারায় সুসজ্জিত সর্বহারা বিপ্লবী হতে। আমরা অবশ্যই দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করবো বুর্জোয়া দক্ষিণপন্থীদের এবং অতিবামপন্থীদেরও যারা আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান, দুই লাইনের সংগ্রামকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবো এবং উপদলবাদকে নির্মূল করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবো। ■