সিরাজ সিকদার রচনাঃ নেতৃত্বের পদ্ধতি

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার

 


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ সম্ভবতঃ ১৯৭০ 

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক কমরেড সিরাজ সিকদারের নির্বাচিত সাংগঠনিক রচনাবলীর সংকলনে কিছুটা সংশোধিত আকারে প্রকাশ আগষ্ট ১৯৭৪

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ৩ ডিসেম্বর ২০১২


 

পিডিএফ

 

১। যে কোন কাজই করিনা কেন আমরা দুটো বিষয় সর্বদাই প্রয়োগ করবো। একটি হলো সাধারণের বিশেষের সাথে সংযোগ; অন্যটি হলো নেতৃত্বের জনসাধারণের সাথে সংযোগ।

২। সাধারণ ও সর্বব্যাপী আহ্বান না জানালে একটি কর্তব্য সম্পাদন করার জন্য ব্যাপক জনসাধারণকে সমাবেশ করা যায় না। কিন্তু যদি নেতৃস্থানীয় কর্মীরা কেবলমাত্র সাধারণ আহ্বানে সীমাবদ্ধ থাকেন, যে কাজের জন্য আহবান করা হয়েছে যদি তারা বাস্তবভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে কিছু সংখ্যক সংগঠনে তা গুরুত্বের সাথে তা কার্যকরী না করেন, একটা নির্দিষ্ট বিন্দু ভেঙ্গে প্রবেশ না করেন, অভিজ্ঞতা অর্জন না করেন এবং সে অভিজ্ঞতাকে অন্যান্য ইউনিটগুলো পরিচালনা করতে প্রয়োগ না করেন, তাহলে নিজের ডাকা সাধারণ আহ্বান নির্ভুল কিনা তা পরীক্ষা করার উপায় থাকে না এবং সাধারণ আহ্বানের বিষয়বস্তুকেও পরিপূর্ণ করার উপায় থাকে না। এর ফলে এই সাধারণ আহ্বানের শূন্যে হারিয়ে যাওয়ার বিপদ রয়েছে।

উদাহারণস্বরূপ—ঢাকা জেলা কমিটি সাধারণ আহ্বান জানিয়েছে, ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীরা এবং বিপ্লবী দেশপ্রেমিকরা পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি বাহিনীর গেরিলা ও মিলিশিয়া দলে যোগ দিন এবং জাতীয় শত্রু ও তাদের দালালদের ওপর হামলা করুন।’

ঢাকা জেলা নেতৃত্ব এই সাধারণ আহ্বানের ভিত্তিতে কয়েকটি গেরিলা ও মিলিশিয়া ইউনিট গঠন করবেন। এই সকল ইউনিটের কিছু সংখ্যক প্রতিনিধিদের সামরিক বিকাশের প্রক্রিয়া (অর্থাৎ তাদের রাজনৈতিক, মতাদর্শগত মান, সামরিক শিক্ষা গ্রহণ ও তা প্রয়োগে উৎসাহ, পড়াশুনা, কাজের শক্তিশালী ও দুর্বল দিক) সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জনের জন্য গভীর অনুসন্ধান করতে হবে। অধিকন্তু এ সকল ইউনিটের দায়িত্বে যে সকল কমরেড রয়েছেন তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে পরিচালনা করতে হবে এবং এ সকল ইউনিটে যে বাস্তব সমস্যা দেখা দিবে তার সমাধান দিতে হবে। সকল সংগঠন, স্কুল বা সামরিক বাহিনীর সংগঠন এভাবে কাজ করবেন, এর কারণ তাদের অধীনস্থ অনেক ইউনিট রযেছে। অধিকন্তু এটাই হচ্ছে একমাত্র পদ্ধতি যার মাধ্যমে নেতারা নেতৃত্ব প্রদানের সাথে শিক্ষাকে সংযোগ করতে পারেন। নেতৃস্থানীয় কেউই সাধারণ পরিচালনার আহ্বান দিতে পারবেন না যদি তারা নিম্নস্তরের বিশেষ ইউনিটের, বিশেষ ব্যক্তি বা ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন না করেন। এ পদ্ধতি সকল স্তরে প্রয়োগ করতে হবে যাতে নেতৃস্থানীয় কর্মীরা ইহা প্রয়োগ করতে শেখেন।

৩। যে কোন স্থানের জনসাধারণই সাধারণতঃ তিনভাগে বিভক্ত—অপেক্ষাকৃত সক্রিয়, মধ্যবর্তী, পশ্চাদপদ। তাই পরিচালক এই অল্পসংখ্যক সক্রিয় ব্যক্তিদেরকে নিজের চারপাশে ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব গ্রুপ গঠন করতে নিপুণ হবেন। এই নেতৃত্ব গ্রুপের উপর নির্ভর করে মধ্যবর্তী ব্যক্তিদেরকে উন্নত করতে হবে, পশ্চাদপদ ব্যক্তিদেরকে তাদের পক্ষে টেনে আনতে হবে।

যদি শুধুমাত্র নেতৃত্ব গ্রুপে সক্রিয়তা থাকে, তা ব্যাপক জনসাধারণের সক্রিয়তার সাথে যুক্ত না হয় তা’হলে সক্রিয়তা হয়ে উঠবে অল্পসংখ্যক লোকের নিষ্ফল প্রয়াস। পক্ষান্তরে যদি শুধু ব্যাপক জনসাধারণের সক্রিয়তা থাকে এবং এই সক্রিয়তাকে যথাযথভাবে সংগঠিত করার জন্য যদি একটি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গ্রুপ না থাকে তাহলে জনসাধারণের সক্রিয়তা বেশীদিন টিকে থাকতে পারে না, সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারে না এবং উচ্চস্তরে উন্নীত হতে পারে না।

একটি নেতৃত্বগ্রুপ যা জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সংযুক্ত, কেবলমাত্র গড়ে উঠতে পারে গণসংগ্রামের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, এর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে নয়।

একটি সংগ্রামের প্রক্রিয়ার প্রথম, মধ্যবর্তী ও চূড়ান্ত পর্যায়ে নেতৃত্ব গ্রুপের গঠনপ্রকৃতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত থাকে না বা থাকতে পারে না; যে সকল কর্মীরা সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আসছে তাদেরকে প্রতিনিয়ত প্রমোশন দিয়ে ঐ সকল পুরোনো সদস্য যারা তুলনামূলকভাবে নিকৃষ্ট অথবা অধঃপতিত হয়েছে, তাদের স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। অনেক স্থানে সাংগঠনিক ও অন্যান্য কাজ সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না তার একটি মৌলিক কারণ হলো জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ ও সংযুক্ত এবং স্বাস্থ্যকর একটি নেতৃত্ব গ্রুপের অভাব।

একশত লোকের একটি স্কুল অবশ্যই ভাল চলবেনা যদি বাস্তব অবস্থার সাথে সংগতি রেখে (কৃত্রিমভাবে একত্রিত নয়) কিছু সংখ্যক লোকের নেতৃত্ব গ্রুপ বা শিক্ষক, অন্যান্য কর্মচারী ও ছাত্রদের মাঝে সবচেয়ে বেশী সক্রিয়, উদ্যমী এবং সজাগ লোকদের নিয়ে গঠিত নেতৃত্ব গ্রুপ না থাকে।

বড় হোক, ছোট হোক প্রতিটি সংগঠন, স্কুল, সামরিক ইউনিট, ফ্যাক্টরী অথবা গ্রামে আমরা পার্টির বলশেভিকীকরণ সম্পর্কিত স্ট্যালিনের বারটি শর্তের মধ্যে নবম শর্ত অর্থাৎ নেতৃত্ব গ্রুপ প্রতিষ্ঠার বিষয় প্রয়োগ করবো। এই নেতৃত্ব গ্রুপের চারটি মাপকাঠি থাকবে যা ডিমিট্রভ কেডার সম্পর্কিত নীতিতে আলোচনা করেছেন—উদ্দেশ্যের প্রতি সম্পূর্ণ উৎসর্গিত, জনগণের সাথে সংযুক্ত, স্বাধীনভাবে সমস্যা সমাধানে সক্ষম এবং যথাযথভাবে শৃংখলা পালন করেন।

যুদ্ধ, উৎপাদন, শিক্ষা, শুদ্ধিকরণ অথবা কাজ তদারক করা, কেডারদের ইতিহাস পর্যালোচনা করা প্রভৃতি কেন্দ্রীয় কাজ অথবা অন্য কোন কাজ করি না কেন, সাধারণ আহ্বানের সাথে বিশেষ পরিচালনার লাইনের সংযোগ ছাড়াও প্রয়োজন নেতৃত্বের জনসাধারণের সাথে সংযোগ।

৪। আমাদের পার্টির সমস্ত বাস্তব কাজ-কর্মে নির্ভুল নেতৃত্ব অপরিহার্যভাবেই হচ্ছে ‘জনসাধারণ থেকে আসা এবং জনসাধারণের মধ্যে যাওয়া’। এর অর্থ হচ্ছে জনসাধারণের মতামত (ইতস্ততঃ ছড়ানো ও অব্যবস্থিত) সংগ্রহ করে কেন্দ্রীভূত করা (গবেষণার মাধ্যমে তাদের কেন্দ্রীভূত ও সুব্যবস্থিত মতে রূপান্তরিত করা), তারপর তা জনসাধারণের কাছে গিয়ে প্রচার করা, এই মত জনসাধারণের নিজস্ব মতে পরিণত করা যাতে জনসাধারণ এই মত কার্যকরী করেন এবং এইভাবে জনসাধারণের কাজের ভিতর দিয়েই এই মত ভুল কি নির্ভুল তা যাচাই করে নেওয়া। পুনর্বার জনসাধারণের মতামত সংগ্রহ করা এবং জনসাধারণের কাছে গিয়ে তা কার্যকরী করা।

এমনি চলে বারবার, চলে সমাপ্তিহীন ঘূর্ণাবর্ত, ফলে প্রতিবারই এই মত হয়ে ওঠে আরো বেশী নির্ভুল, আরো বেশী প্রাণবন্ত, আরো বেশী সমৃদ্ধ। এই হচ্ছে মার্কসবাদের জ্ঞানতত্ত্ব।

৫। একটি সংগঠনে বা সংগ্রামে নেতৃত্ব গ্রুপের সাথে জনসাধারণের সঠিক সম্পর্ক বিষয়ক সঠিক ধারণা, নেতৃত্বের সঠিক ধারণা (Ideas) কেবলমাত্র “জনসাধারণ থেকে আসা এবং জনসাধারণের নিকট যাওয়া” থেকে আসতে পারে এ ধারণা (Concept); নেতৃত্বের ধারণাকে (Ideas) অনুশীলনে প্রয়োগ করার কালে সাধারণ আহ্বানকে বিশেষ পরিচালনার লাইনের সাথে অবশ্যই সংযুক্ত করার ধারণা (Concept)—প্রভৃতি ধারণাসমূহ (Concept) প্রতিনিয়ত সর্বস্তরে প্রচার করতে হবে, যাতে আমাদের কর্মীদের এগুলো সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর হয়। অনেক কমরেড এর গুরুত্ব বুঝেন না বা ভালো মতো পারেন না সক্রিয় কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে একটি নেতৃত্ব গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করতে, তারা গুরুত্ব উপলব্ধি করেন না বা ভালমত পারেন না এই নেতৃত্ব গ্রুপকে জনসাধারণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করতে। এ কারণে তাদের নেতৃত্ব হয় আমলাতান্ত্রিক এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন।

বহু কমরেড বুঝেননা বা ভাল মত পারেননা গণসংগামের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে। কিন্তু নিজেদেরকে অতিবুদ্ধিমান ভেবে তারা আত্মগত মতামত পেশ করতে ভালবাসেন। এ কারণে তাদের মতামত হয় ফাঁকা ও অবাস্তব।

অনেক কমরেড একটি কাজ সম্পর্কে সাধারণ আহ্বান দিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন কিন্তু গুরুত্ব বুঝেননা বা ভালমত পারেননা এই সাধারণ আহ্বানের সাথে নির্দিষ্ট ও বিশেষ পরিচালনার লাইন দিতে। এ কারণে তাদের আহ্বান রয়ে যায় মুখে মুখে অথবা কাগজে বা সভাকক্ষে এবং একারণে তাদের নেতৃত্ব হয়ে পড়ে আমলাতান্ত্রিক।

বর্তমান পর্যায়ে আমরা আমাদের শিক্ষায়, কাজ তদারকিতে এবং অন্যান্য সকল কাজে এ সকল ত্রুটি শুধরে নেব এবং নেতৃত্বকে জনসাধারণের সাথে সংযুক্ত করা ও সাধারণকে বিশেষের সাথে সংযুক্ত করার পদ্ধতি শিখে নেবো।

৬। জনসাধারণের মতামত সংগ্রহ করা এবং তা কেন্দ্রীভূত করা, আবার তা জনসাধারণের কাছে নিয়ে যাওয়া ও তা কার্যকরী করতে লেগে থাকা যাতে করে নেতৃত্বের নির্ভুল লাইন গড়ে উঠে। এটাই হচ্ছে নেতৃত্বের মৌলিক পদ্ধতি। জনসাধারণের মতামত কেন্দ্রীভূত করা ও কার্যকরী করার প্রাক্কালে প্রয়োজন সাধারণ আহ্বানকে বিশেষ পরিচালনার লাইনের সাথে সংযোগ করা এবং এটাই হলো নেতৃত্বের মৌলিক পদ্ধতির একটি উপাদান।

কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রদত্ত সাধারণ পরিচালনার লাইন থেকে সাধারণ মতামত (সাধারণ আহ্বান) তৈরী করা এবং তা বিভিন্ন ইউনিটে পরীক্ষার নিমিত্ত প্রয়োগ করা (শুধু যে একজন নিজে করবে তা নয় অন্যকেও করতে বলবে), তারপর নতুন অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্রীভূত করা (সারসংকলনের মাধ্যমে) এবং জনসাধারণকে সাধারণভাবে পরিচালনার জন্য নতুন নির্দেশাবলী প্রদান করা। কমরেডরা প্রতিটি কাজে ইহা প্রয়োগ করবেন। ভাল নেতৃত্ব অধিকতর নিপুণতার সাথে গড়ে উঠে এ পদ্ধতি কাযকর করার মাধ্যমে।

৭। কোন অধীনস্থ ইউনিটে কোন প্রকার কাজ (বিপ্লবী যুদ্ধ, উৎপাদন অথবা শিক্ষা, শুদ্ধি আন্দোলন, কাজ তদারক করা অথবা কেডারদের ইতিহাস অনুসন্ধান, প্রচার, সাংগঠনিক কাজ, গোয়েন্দাবিরোধী তৎপরতা বা অন্য কাজ) প্রদানের সময় উপরস্থ সংগঠন এবং সংস্থাসমূহ সকল ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট নিম্নস্তরের সংগঠনের নেতার মাধ্যমে যাবেন যাতে নেতা দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। এভাবে শ্রম বিভাগ ও ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব অর্জন করা যায়। উচ্চস্তরের একটি বিভাগ (উদাহারণ স্বরূপ—সংগঠন, প্রচার অথবা গোয়েন্দাবিরোধী উচ্চস্তরের বিভাগসমূহ) নিম্নস্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিকটই যাবেননা। নিম্নস্তরের সামগ্রিক দায়িত্বে যিনি রয়েছেন (যেমন সম্পাদক, সভাপতি, পরিচালক বা স্কুল প্রধান) তাকে না জানিয়ে বা তাকে বাদ দিয়ে শুধু নিম্নস্তরে একই বিভাগের কর্মকর্তার নিকট যাবেন না। সামগ্রিক দায়িত্ব ও বিশেষ দায়িত্ব সম্পন্ন উভয় ব্যক্তির নিকট যেতে হবে এবং দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের সাথে শ্রম বিভাগের সংযোগের এই কেন্দ্রীভূত পদ্ধতি সামগ্রিক দায়িত্ব সম্পন্ন কমরেডদের মাধ্যমে সম্ভব হবে। একটি বিশেষ কাজ করার জন্য ব্যাপক সংখ্যক কর্মীর, এমনকি সংগঠনের সকল কর্মীর সমাবেশ এবং এভাবে বিভিন্ন বিভাগের কর্মীর স্বল্পতা অতিক্রম করা যায় এবং বেশ কিছু সংখ্যক লোককে হাতের কাজ সম্পন্ন করার জন্য সক্রিয় করা যায়। ইহাও হচ্ছে নেতৃত্বকে জনসাধারণের সাথে সংযুক্ত করার উপায়।

উদাহারণস্বরূপ, কেডারদের ইতিহাস অনুসন্ধানের বিষয় ধরা যাক। যদি কাজটি বিচ্ছিন্নভাবে করা হয়, এ কাজের দায়িত্বে সংগঠনের যে বিভাগ রয়েছে তার অল্প সংখ্যক কর্মীরাই যদি ইহা করে, তবে অবশ্যই কাজটি ভালভাবে সম্পন্ন করা যায় না। কিন্তু কাজটি যদি একটি বিশেষ সাংগঠনিক স্তরের বা স্কুলের প্রধান প্রশাসকের মাধ্যমে করা হয় তবে তিনি উক্ত কাজের জন্য অনেক বা প্রায় সকল ছাত্রদের সমাবেশিত করতে পারেন, একই সাথে উচ্চস্তরের নির্দিষ্ট বিভাগের নেতৃস্থানীয় কর্মীরা সঠিক পরিচালনার নির্দেশ অধিকতর সুচারুরূপে প্রদান করতে পারেন। এভাবে নেতৃত্বকে জনসাধারণের সাথে সংযোগের মাধ্যমে কেডার ইতিহাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব আরো সন্তোষজনকভাবে সম্পন্ন করা যায়।

৮। যে কোন অঞ্চলে অনেকগুলো কেন্দ্রীয় কাজ থাকতে পারে না, একটা নির্দিষ্ট সমযে কেবলমাত্র একটা কেন্দ্রীয় কাজ থাকতে পারে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের কাজ পরিপূরক হিসেবে থাকতে পারে। তাই একটা অঞ্চলের সামগ্রিক দায়িত্বসম্পন্ন কমরেড অবশ্যই সেখানকার সংগ্রামের ইতিহাস, সংগ্রামের সমগ্র অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন কাজকে উপয্ক্তু স্থানে সাজিয়ে রাখবে, নিজে কোন পরিকল্পনা তৈরী না করে শুধু উচ্চস্তরের নির্দেশানুসারে এক একটা কাজ করা উচিত নয়, এমনি করলে অসংখ্য কেন্দ্রীয় কাজ এলোমেলো বিশৃংখলার সৃষ্টি করবে। উচ্চস্তরের সংস্থার পক্ষেও কাজের হাল্কা ও গুরু এবং মন্থর ও জরুরী প্রভৃতি নির্বিশেষে কোনটা কেন্দ্রীয় কাজ তার উল্লেখ না করে নিম্নস্তরের সংস্থাকে একই সময় অনেক কাজ করতে নির্দেশ প্রদান করা উচিত নয়। এমনি করলে নিম্নস্তরের কাজের বিন্যাস এলোমেলো হবে এবং নির্ধারিত ফলও পাওয়া যাবে না।

প্রতিটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের পারিপার্শ্বিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানুসারে সমগ্র পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করে প্রতিটি বিশেষ সময়ের জন্য কাজের ভারকেন্দ্র ও কাজের ক্রম সঠিকভাবে স্থির করা এবং তা অবিচলিতভাবে পালন করা যাতে করে নির্দিষ্ট ফলার্জন নিশ্চিত হয়। এটাই হচ্ছে নেতৃত্বের অন্যতম কৌশল। ইহাও নেতৃত্বের পদ্ধতির একটি সমস্যা এবং নেতৃত্বকে জনসাধারণের এবং সাধারণকে বিশেষের সাথে সংযোগের নীতিমালা প্রয়োগের সময় যত্ন সহকারে সমাধান করতে হবে।

৯। নেতৃত্বের পদ্ধতি বিষয়ক বিশদ আলোচনা এখানে করা হয়নি। আশা করা হচ্ছে সকল স্থানের কর্মীরা এ সকল নীতির ভিত্তিতে নিজেরা কঠোরভাবে চিন্তা করবেন এবং নিজেদের সৃজনশীলতাকে পূর্ণভাবে কাজে লাগাবেন। সংগ্রাম যত তীব্র হবে, কমিউনিস্টদের জন্য ততই প্রয়োজন হবে ব্যাপক জনতার প্রয়োজনের সাথে নেতৃত্বকে সংযোগ করা এবং সাধারণ আহ্বানকে বিশেষ পরিচালনার লাইনের সাথে সংযোগ করার মাধ্যমে আমলাতান্ত্রিক ও আত্মগত নেতৃত্বের পদ্ধতিকে চূর্ণবিচূর্ণ করা।

আমাদের সংগঠনের সকল নেতৃস্থানীয় কর্মীরা সকল সময় অবশ্যই মার্কসবাদী নেতৃত্বের পদ্ধতি দ্বারা আত্মগত আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের পদ্ধতিকে বিরোধিতা করবেন এবং প্রথমটাকে পরেরটি দ্বারা অতিক্রম করবেন। আত্মগতবাদীরা ও আমলাতান্ত্রিকেরা নেতৃত্বকে জনসাধারণের সাথে এবং সাধারণকে বিশেষের সাথে সংযোগের নীতিকে বুঝে না; তারা পার্টির কাজকে ব্যাহত করে। আত্মগত ও আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের পদ্ধতিকে দূর করার জন্য আমরা সর্বদাই মার্কসবাদী নেতৃত্বের পদ্ধতি ব্যাপকভাবে এবং গুরুত্ব সহকারে সর্বস্তরে প্রবর্তন করবো।

[সভাপতি মাও-এর “নেতৃত্বের পদ্ধতি সম্পর্কে কতিপয় প্রশ্ন”র ভিত্তিতে রচিত]

সাংগঠনিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত পরিচালনায়

গণতান্ত্রিক জীবন সুনিশ্চিত করার লাইন

১। পার্টির নেতৃস্থানীয় সংস্থায় নির্ভুল পরিচালনার লাইন থাকতে হবে, যাতে করে নিজেদেরকে নেতৃত্বের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

২। উচ্চতর সংস্থাকে নিম্নতর সংস্থার অবস্থা ও জনসাধারণের জীবনের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকতে হবে যাতে করে সঠিক পরিচালনার বাস্তব ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে।

৩। পার্টির সকল স্তরের সংস্থারই বিবেচনাহীনভাবে সমস্যার সমাধান করা উচিত নয়। একবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে, অবশ্যই তা দৃঢ়তার সাথে পালন করতে হবে।

৪। উচ্চতর সংস্থার যে সব সিদ্ধান্ত কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ, তা অবশ্যই নিম্নতর সংস্থায় এবং পার্টি সদস্য সাধারণের কাছে দ্রুত পৌঁছে দিতে হবে। তার পদ্ধতি হল সক্রিয় কর্মীদের সভা অথবা পার্টি শাখার সভা করতে হবে, সে সকল সভায় রিপোর্ট প্রদানের জন্য লোক পাঠাতে হবে।

৫। পার্টির নিম্নতর সংস্থাগুলোকে ও পার্টি সদস্য সাধারণকে উচ্চতর সংস্থার নির্দেশাদি পুংখানুপুংখরূপে আলোচনা করতে হবে, যাতে করে এর তাৎপর্য তারা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেন এবং তা পালন করার পদ্ধতি স্থির করতে পারেন।

[সভাপতি মাও সেতুঙ-এর পাঁচটি প্রবন্ধ। পৃঃ ৪১-৪৩]

পূর্বোক্ত সাধারণ নিয়মাবলী ব্যতীতও সম্পাদক বা নেতা

নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ পালন করবেন

১। প্রতিটি সাংগঠনিক এককের একজন সম্পাদক বা নেতা থাকবেন।

২। সম্পাদক বা নেতা নির্দিষ্ট ইউনিটের সদস্যদের গণতান্ত্রিক পরামর্শের ভিত্তিতে উচ্চস্তরের অনুমোদনসহ নির্বাচিত হবেন।

৩। সম্পাদক বা নেতা অথবা তাদের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বা নেতা সভা আহ্বান করবেন। সংখ্যাগুরু দাবী করলে সম্পাদক বা নেতা সভা আহ্বান করতে বাধ্য থাকবেন।

৪। নির্দিষ্ট সাংগঠনিক এককের সংখ্যাগুরু সদস্যগণ সম্পাদক বা নেতার অপসারণ চাইলে উচ্চতর স্তরের নিকট জানাবেন। উচ্চতর স্তর সম্পাদক বা নেতাকে অপসারণ করে নতুন সম্পাদক বা নেতা নির্বাচিত করে দেবেন।

৫। উচ্চস্তর নিম্নতর স্তরের সাংগঠনিক এককের সম্পাদক বা নেতাকে পরিবর্তন, বদলী, অপসারণ করতে পারেন।

৬। প্রতিটি সাংগঠনিক এককের সম্পাদক বা নেতা কাজের রিপোর্ট নিদিষ্ট সময় অন্তর উচ্চস্তরে ও উক্ত এককের কর্মীদের জানাবে (কোষের জন্য সাতদিন অন্তর, জিলা কমিটির জন্য একমাস অন্তর)।

৭। প্রতিটি সাংগঠনিক একক উচ্চতর স্তরের নির্দেশাবলী পালন, নিজেদের কার্যাবলী পর্যালোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদির জন্য নিয়মিত সভা আহ্বান করবে (কোষের জন্য একবার সাত দিনে)।

৮। সম্পাদক বা নেতা কোন বিষয় অজ্ঞ থাকলে সদস্যদের জিজ্ঞেস করবেন। তার সম্মতি বা আপত্তি অবিবেচিতভাবে ব্যক্ত করবেন না। সদস্যদের মতামত শুনতে তাকে নিপুণ হতে হবে, তাকে শিক্ষক হওয়ার পূর্বে ছাত্র হতে হবে। আদেশ জারী করার পূর্বে সদস্যদের কাছ থেকে শিখতে হবে।

কাজের মধ্যে কোনটা প্রধান, কোনটা গৌণ তা বের করতে হবে এবং প্রধান কাজ সম্পন্ন করার জন্য অনুরূপ কাজ নির্ণয় করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কার্য পরিচালনা করতে হবে।

৯। সমস্যার পরিমাণগত হিসেব রাখতে হবে। কোনটা কখন সম্পন্ন করতে হবে তাও গুছিয়ে রাখতে হবে।

১০। সাংগঠনিক এককের সম্পাদক বা নেতা সদস্যদের দায়িত্ব দেবেন এবং সময়মত অভিজ্ঞতার সারসংকলন করবেন।

১১। সম্পাদক বা নেতা সংগঠনে গণতান্ত্রিক জীবন সুনিশ্চিত করবেন।

১২। সম্পাদক বা নেতা সদস্যদের সাথে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবহার করবেন না।

১৩। সম্পাদক বা নেতা সদস্যদের কথা শুনবেন। এ বিষয়ে নিম্ন মনোভাব থাকবেঃ

(ক) যা জানেন বলুন, যদি বলেন সবটাই বলুন।

(খ) বক্তাকে দোষ দেবেন না, তার কথাকে সতর্কবাণী হিসেবে গ্রহণ করুন।

১৪। নেতা বা সম্পাদক সদস্যদের কাজের বিবেচনার সময় বাস্তবভিত্তিক হবেন এবং সাফল্য প্রধান না ভুল প্রধান তা নির্ণয় করবেন।

১৫। নেতা বা সম্পাদক অহংকার করবেন না, বিনয়ের সাথে ব্যবহার করবেন।

১৬। নেতা বা সম্পাদক সদস্যদের মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক শিক্ষা দেবেন।

১৭। ভিন্নমত পোষণকারী সদস্যদের সাথে কাজ করতে সম্পাদক বা নেতা নিপুণ হবেন।

নেতৃত্ব বিষয়ক পাঠ্যসূচী

— বর্তমানে আমাদের সংগঠনে প্রথম প্রয়োজন উন্নত নেতৃত্ব, দ্বিতীয় প্রয়োজন উন্নত নেতৃত্ব, তৃতীয় প্রয়োজন উন্নত নেতৃত্ব।

— যোগ্য নেতৃত্বের সমস্যা মূলতঃ মতাদর্শগত পুনর্গঠনের সমস্যা।

— আমাদেরকে উন্নত নেতৃত্ব সম্পর্কিত মার্কসবাদী পদ্ধতি প্রয়োগ করে উৎপাদন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট নেতৃত্বস্বল্পতা দূর করতে হবে; নেতৃত্বের কলাকৌশল কর্মীদের বিশেষ করে সম্ভাবনাময়দের শেখাতে হবে। নেতৃত্ব সম্পর্কিত দলিলাদি পাঠ ও প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে নেতৃত্বের সংকট দূর করতে হবে।

— এ কারণে মানোন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণের সময় নেতৃত্বসংকট সমাধানের পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে।

সভাপতি মাওয়ের পাঁচটি প্রবন্ধঃ

— পার্টির ভিতরকার ভুল চিন্তাধারা সংশোধন করা প্রসঙ্গে।

— উদারতাবাদ বিরোধিতা।

উদ্ধৃতিঃ

— পার্টি-কমিটির নেতৃত্ব।

— জনসাধারণের লাইন।

— কেডার।

— চিন্তাধারার পদ্ধতি ও কর্মপদ্ধতি।

— অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা।

— সমালোচনা-আত্মসমালোচনা।

— জনগণের ভেতরকার দ্বন্দ্বের মীমাংসা।

কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠনঃ স্ট্যালিন, কাগানোভিচ, দিমিত্রভ, মাওসেতুঙ।

লাল ঝাণ্ডাঃ

বিপ্লবে নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকা।

সাংগঠনিক কার্যপ্রসঙ্গে দলিলঃ

○ নেতৃত্বের পদ্ধতি এবং অন্যান্য প্রবন্ধ।

○ মতাদর্শগত পুনর্গঠন সংক্রান্ত কতিপয় রচনা।

○ ইশতেহারসমূহ (কেন্দ্রীয় কমিটি ও ব্যুরো)।

○ ইহা ব্যতীত সাংগঠনিক কাজের উপর প্রকাশিত অন্যান্য দলিলঃ

— সমালোচনা-আত্মসমালোচনা সংক্রান্ত কতিপয় পয়েন্ট।

— একটি কাজ করার উপায়। ক্ষুদে বুর্জোয়া, বুর্জোয়াদের সাথে আলোচনার পদ্ধতি। গণতান্ত্রিক উপায়ে কথা বলার পদ্ধতি।

— নেতৃত্বের কতিপয় গাইড।

— সাংগঠনিক কাজের উপর কতিপয় গাইড।

— কর্মীস্বল্পতা ও তা সমাধানের কতিপয় উপায়। ■