সরকারি লুটেরা তেল ব্যবসা, ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম পুনবৃদ্ধির পাঁয়তারা, ব্যাংকের টাকা চুরি আর আঙুলের ছাপ রেজিস্ট্রেশন

লেখকঃ

হোসেন নীল

সরকারী লুটেরা তেল ব্যবসা

যুদ্ধ, প্রতিযোগিতা, চাহিদা ও উৎপাদন বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে কমতে বছর দেড়েক আগেই তিন ভাগের এক ভাগে নেমে আসে। ২০১৩ সালে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ১১০ ডলার, ২০১৪ থেকে  দরপতন হয়ে ২০১৫-এ প্রায় ৫০ ডলারে নেমে এসে ২০১৬ জানুয়ারিতে তা দাঁড়ায় ২৭ ডলার, বর্তমানে প্রায় ৪০ ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার প্রতি লিটার তেল প্রায় ২০ টাকায় কিনছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনগুণ দামে তেল বিক্রী করে মুনাফা করছে। গত ১৬ মাসে তারা জনগণের কাছে তেল বিক্রী করে ৭০০০ কোটি টাকা লাভ করেছে।

দেশে জ্বালানী তেলের দৈনিক চাহিদাঃ পেট্রোল ৩০০ মেট্রিক টন, অকটেন ৩২০ মেট্রিক টন, ডিজেল ৯৫০০-১০,০০০ মেট্রিক টন আর কেরোসিন ৩৫০ মেট্রিক টন।

কয়েকদিন আগে তারা পেট্রল ১০ ফার্নেস অয়েল ১৮ ও অকটেনের দাম ১০ টাকা কমালেও শতকরা ৯০ ভাগ ব্যবহৃত হয় যে ডিজেল তার দাম কমিয়েছে মাত্র ৩ টাকা/লিটার। পেট্রল ও অকটেনের দাম ১০ টাকা কমানোয় লাভ হবে প্রাইভেট কার অলাদের যারা শোষক সম্প্রদায়ের। অন্যদিকে দরিদ্র জনগণের ব্যবহার্য কেরোসিনের দাম মাত্র ৩ টাকা কমানো হয়েছে। ডিজেলের দাম সামান্য কমানোয় বাসঅলা ও ট্রেনঅলারা দাম কমাবেনা বলেছে, সামান্য যে সাশ্রয় হবে তা তারাই আত্মসাত করে নেবে। অন্যদিকে কৃষকদেরকেও বছর বছর ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। যোগাযোগ খাতে সমগ্র তেলের প্রায় ৪৬%, বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ২৫% আর কৃষিতে ব্যবহৃত হয় ১৭%। তেলের দামের হিসাবে বাসে ট্রেনে ভাড়া তিন গুণ নেয়া হচ্ছে, বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে তিন গুণ দামে আর কৃষকরা তিনগুণ দামে পানি কিনছেন।সরকারের ভয়ংকর লুটেরা চরিত্রের এটাই পরিচয়।

এর আগে দশবছরে তেলে সরকার যে ভর্তুকি দিয়েছে তাকে এখন ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। জনগণ তাদের কাছে ঋণী?

জনগণ এই লুটেরাদের কাছে ঋণী না এই শোষক লুটেরারা যুগ যুগ ধরে শ্রম, ফসল, জমি, খনি, সম্পদ লুট করে কর খাজনা আদায় করে বহুবিধভাবে জনগণকে শোষণ করে আসছে। কে উৎপাদন করে? শ্রমিক কৃষক জনগণের উৎপাদনের ফলে এই সমাজের সব যন্ত্র চলে। মাথার উপর চেপে বসা রাষ্ট্রকাঠামো জনগনের টাকায়ই চলে। শোষক বুর্জোয়া ও সামন্তশ্রেণী জনগণের সৃষ্ট মূল্যের একটা অংশ শুষে নেয় যাকে বলে উদৃত্ত মূল্য। এছাড়াও বিভিন্নভাবে লুট করে নেয় আরো উদৃত্ত মূল্য। সরকারী যে লুটপাটের চিত্র দেখানো হল শোষণসমেত তাহল  অতিরিক্ত উদৃত্ত মূল্য শোষণ।

ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি

বলা বাহুল্য রেলকে জনসেবা হিসেবে দেখা হয়না।

ট্রেনে যাতায়ত বাসের চেয়ে হাজার গুণ নিরাপদ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাশের সরকারগুলি সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণবাদী কোম্পানীগুলির স্বার্থে কয়েক যুগে হাজার হাজার বাস আমদানি করেছে, রেলের অবস্থা শোচনীয় করে তুলেছে। অথচ রেলে জ্বালানী খরচ অনেক কম। অনেক কম সময়ে অনেক কম খরচে পন্য পরিবহন করাও সম্ভব। এটা তারা হতে দিচ্ছেনা।

কমলাপুর রেল স্টেশনের ভেতরে কোন পাবলিক টয়লেট নেই। বগি কম, বাতিল ইঞ্জিন, লাইন বেহাল। সবকিছুই মান্ধাতার আমলের। ট্রেনের ভেতরে ভাঙাচোরা জীর্ন অবস্থা। মানুষ একজনের মাথার ওপর আরেকজন, ইঞ্জিনে, ছাদে, দুই বগির মাঝখানে ঝুলে চলাফেরা করে।

বাংলাদেশ রেলের ২০১২-১৩ অর্থ বছরের হিসেবে দেখানো হয় রেলের পরিচালন ব্যায়ের ১৯ শতাংশ জ্বালানি, ২৩ শতাংশ রক্ষণাবেক্ষণ ও ৫৮ শতাংশ কর্মচারিদের বেতন খাতে ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দুইটির অধিকাংশই দুর্নীতির মাধ্যমে লুন্ঠন করা হয়। অর্থাৎ রেলের পরিচালন ব্যায়ের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ লুন্ঠিত হয়। রেলের যে পরিমাণ টিকিট বিক্রি হয় তার সমপরিমাণ টাকা তারা ট্রেনের ভেতর যাত্রিদের কাছ থেকে আদায় করে যেটা তারা বিক্রী হিসবে দেখায়না, এছাড়া টিকিটের মূল্যের বাড়তি টাকা তারা জনগণের কাছে আদায় করে (বিভিন্ন পর্বের সময় দুইগুণ আদায় করে) যা তারা রেলের আয় হিসেবে দেখায় না।

রেলের বিপুল পরিমাণ জমি সম্পত্তি রয়েছে (প্রায় ৬৩ হাজার একরের মত), এগুলো সরকারী বেসরকারী বুর্জোয়ারা বেদখল করে খায়। এর আয়ের খুব কমই রেলের আয় হিসেবে দেখানো হয়।

অবশেষে সরকার নিজে কয়েক বছর যাবত তিনগুণ দামে তেল বিক্রী করে রেলকে লুন্ঠন করেছে।

কেনাকাটা টেন্ডার লোকনিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতি। লোক নিয়োগে ঘুষের ৭০ লাখ টাকা ২০১২ সালে হাতে নাতে ধরা পড়ে যা রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিতের বাসায় যাচ্ছিল। ডেমু ট্রেন, ইঞ্জিন, বগি দ্বিগুণ বা অনেক বেশী দামে বিদেশ থেকে কেনা হয় যেখান থেকে সরকারী ও রেলের লোকেরা কোটি টাকা পারসেন্টেজ পায়, আর রেলের ক্ষতি হয় হাজার কোটি টাকা।

সুতরাং রেলের যে আয় ব্যয় দেখানো হয় তা ধোঁকাবাজি।

রেলের যেসব প্রজেক্টে সাম্রাজ্যবাদী দাতাসংস্থার বিনিয়োগ হয় তার শতকরা ষাট ভাগ ব্যয় হয় পরামর্শক নিয়োগে। এসব কোন প্রজেক্টই যথাসময়ে বাস্তবায়ন হয়না।

বাংলাদেশের রেলে রেলসড়ক উন্নয়ন খুব সামান্য বা নেই বললেই চলে। এই হল রেলের অবস্থা। এ হল লুন্ঠনের এক ক্ষেত্র। এদিকে পুনরায় রেলের ভাড়া প্রায় ৭% বাড়ানো হয়েছে। এতে জনগণের দুর্ভোগ আরো বেড়ে গেল। ২০১২ সালে রেলভাড়া দ্বিগুণ করা হয়েছিল। এডিবি তার ঋণের শর্তে সরকারকে প্রতি বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়াতে বলে দিয়েছে। বলা বাহুল্য এর দ্বারা জনসাধারণের ক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা

তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমে গেলে ফার্নেস অয়েলের দাম দীর্ঘকাল না কমিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল গত বছর। এবছর ফার্নেস অয়েলের দাম প্রতি লিটার ১৮ টাকা কমানো হলেও উলটো বিদ্যুতের দাম পুনরায় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গ্যাসের দাম এর আগে দ্বিগুণ করা হয়েছে। পুনরায় দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় এর আগে বিদ্যুতের দাম আটবার আর গ্যাসের দাম তিনবার বাড়ানো হয়েছে। সরকার চাইছে বাসাবাড়ীতে গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে বোতলজাত গ্যাস ব্যবহারে বাধ্য করতে যাতে ব্যবসায়ীরা বহুগুণ বেশী দামে জনসাধারণের কাছে বেঁচতে পারে। বর্তমানে ভয়ানক গরমের মধ্যে ঘন ঘন লোডশেডিং যন্ত্রণা বাড়িয়ে তুলেছে।

ব্যাংকের টাকা চুরি

৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরি হয়। আন্তর্জাতিক জুয়াড়ি চক্র এ ঘটনা ঘটায় যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজস আছে বলেই সবার ধারণা।

ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক দেশের সমগ্র ব্যাংকিং খাতের ২৫% নিয়ন্ত্রণ করে।

সোনালী ব্যাংক ২০১০-১২ এর মধ্যে প্রায় ৪৩০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল যার মধ্যে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা ভুয়া টেক্সটাইল কোম্পানী হলমার্ককে দিয়ে লোপাট করা হয়।

২০০৯-১২ এর মধ্য রাষ্ট্র মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক ৪৫০০ কোটি টাকা লোপাট করায়। যারা এসব টাকা লোপাট করেছে তারা সরকারী দলীয় হওয়ায় এদের বিরুদ্ধে সরকার কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

এছাড়া সালমান এফ রহমানের মত ঋণ খেলাপীরা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়মিত আত্মসাত করে।

দুর্নীতির পাশাপাশি যাবতীয় কালো টাকাকে সাদা করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল সরকার প্রতি বছর সুযোগও দেয়।

আঙুলের ছাপ দিয়ে সিম রেজিস্ট্রেশন

টেলিমন্ত্রী তারানা হালিম মন্ত্রী হওয়ার পর জাতীয় গণ হয়রানি সৃষ্টি করছে, পাশাপাশি জনসাধারণের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ভয়ানক বিঘ্নিত করে তুলেছে। অপরাধীরা পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে, অথচ এ অযুহাতে সাধারণ মানুষের উপর তারা ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করেছে। সরকারী বিটিআরসির যে অন্য বহুজাতিক ফোন কোম্পানীগুলির টাকা খেয়ে নিজস্ব মোবাইল সিম টেলিটককে ধ্বংস করে রেখেছে তা সবাই বিশ্বাস করে। সরকারী দুর্নীতির তারা একবিন্দুও কমানোর যোগ্যতা রাখেনা, অথচ এরাই জনসাধারণকে আইনের বেঁড়াজালে আটকাতে চাইছে। এসব সিম পুনরেজিস্ট্রেশন করতে ২০ টাকা করে নিয়ে জনগণের কাছ থেকে শত কোটি টাকা কামানোর ধান্দাও হয়েছে।জনগণের আঙুলের ছাপকে বহুবিধ অপরাধী কর্মকান্ডে ব্যবহার করে তারা উলটো জনগণের উপর কেস কাহিনী দিয়ে জেলজুলুম কোর্টকাচারী পুলিশী নির্যাতন ও কোটি কোটি টাকা ভয় দেখিয়ে আদায় করার জন্য যে এই নিয়ম চালু করেছে তা আর কারো অজানা নেই। কিন্তু মানুষ বাধ্য হয়েই পুনরেজিস্ট্রেশন করছে। তবে তারা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ।

এসব ঘটনার তাৎপর্য

এইসব ঘটনার তাৎপর্য এই যে সরকার হচ্ছে ভয়ংকর গণশত্রু শোষক ও লুটেরা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এরা শুধুমাত্র একজন কৃষকের কাছ থেকে তেল খাতেই প্রতি মৌসুমে চার পাঁচ হাজার টাকা লুটে নিচ্ছে। অন্যদিকে তুলনামূলক কম খরচে উৎপাদিত ভারতীয় চাল আইনি বেআইনি পথে আসায় এখানে ধানের দাম পায়না কৃষক। এরা সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন বাড়ালেও গার্মেন্ট শ্রমিক ও রিকশাঅলার আয় বাড়ায়নি। বরং বাজারে নিত্য পন্যের দাম বাড়ছেই।বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ গ্যাস যানবাহনের ভাড়া বেড়েছে। মাঝারি শ্রেণিরও নাভিশ্বাস উঠেছে। শ্রমজীবি মানুষের কথাতো বলাই বাহুল্য। সকলেই জানে এই পরিস্থিতি কারা সৃষ্টি করেছে। ক্ষুব্ধ মানুষ এখানে ওখানে বিদ্রোহে ফেঁটে পড়ছেন-পড়বেন। কিন্তু আমাদেরকে এইসব বিদ্রোহকে সাম্যবাদের পথে চালিত করতে হবে।কারণ সেটাই মুক্তির একমাত্র পথ।।