সিরাজ সিকদার রচনাঃ তথাকথিত পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (যে পার্টি আকৃতিগতভাবে ‘বাম’ কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান)-এর খসড়া রণনীতি ও কর্মসূচীর স্বরূপ উদঘাটন

 

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার                           

 


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ মার্চ ১৯৭০

পূর্ববালার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক সংশোধিত আকারে পুনর্লিখিত প্রকাশ এপ্রিল ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ২৪ অক্টোবর ২০১২


 

পিডিএফ

 

বর্তমান যুগের বিশ্ব সর্বহারার মহান নেতা, মহান শিক্ষক, মহান সর্বাধিনায়ক ও মহান কর্ণধার সভাপতি মাওসেতুঙ আমাদের শিক্ষা দেন, আমরা নানা প্রকারের ভ্রান্ত চিন্তাধারাকে অবশ্যই সমালোচনা করব। সমালোচনা না করা সর্বত্র ভ্রান্ত চিন্তাধারাকে বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়তে দেয়াটা এবং অবাধে তাদের বাজার দখল করতে দেয়াটা নিশ্চয়ই চলবে না। ভুল থাকলে অবশ্যই সমালোচনা করতে হবে, বিষাক্ত আগাছা থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। আসুন আমরা বর্তমান দুনিয়ার সর্বহারা শ্রেণীর সবচাইতে শক্তিশালী মতাদর্শগত অস্ত্র, এ যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে তথাকথিত পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির স্বরূপ উদঘাটন করি।

সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা মনোযোগ দাবী করে। তিনি আরও শিক্ষা দেন, এর অতীতের দিকে তাকাও তাহলে এর বর্তমান বলতে পারবে, এর অতীত বর্তমানের দিকে তাকাও তাহলে এর ভবিষ্যৎ বলতে পারবে। উপরের শিক্ষা অনুসারে আমরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি যারা সৃষ্টি করেছেন তাদের অতীতের দিকে তাকাই। এরা সংশোধনবাদী, নয়া সংশোধনবাদী পার্টিতে ছিলেন। এখানে থাকাকালীন তারা ‘পূর্ববাংলার গ্রামে ধনতান্ত্রিক শোষণ’—এই মার্কসবাদ বিরোধী তত্ত্ব হাজির করেন এবং এর জন্য সংগ্রাম করেন কয়েক বছর পর্যন্ত।

এ জঘন্য মার্কসবাদের পরিপন্থী তত্ত্ব আত্মসমালোচনা সহকারে বর্জন না করে , নয়া সংশোধনবাদী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত-এ পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে না ধরে, নীতিগত সংগ্রাম না করে, তারা ষড়যন্ত্র, ক্লিক ও পার্টির অভ্যন্তরে ভ্রূণ পার্টি সৃষ্টি করেন এবং নয়া সংশোধনবাদীদের দ্বারা বহিষ্কৃত হন।

বর্তমানে সংশোধনবাদী ও নয়া সংশোধনবাদী পার্টির মুখোশ বিপ্লবীদের সামনে উন্মোচিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নয়া সংশোধনবাদীদের এই ভগ্নাংশ ঘোলা পানিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নামে মাছ ধরতে নেমেছে। এই উদ্দেশ্যে তারা ‘পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ নয়া সংশোধনবাদী, পেটিবুর্জোয়া রোমান্টিকতাবাদী, চেপন্থী, ট্রটস্কীপন্থী ও ক্ষুদে বুর্জোয়া দালাল এবং এজেন্ট, ভাগ্যান্বেষী, হটকারী ষড়যন্ত্রকারীদের অশুভ আঁতাতের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে।

সভাপতি মাও বলেছেন, বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ হচ্ছে মার্কসবাদের একান্ত সারবস্তু এবং মার্কসবাদের জীবন্ত আত্মা। কিন্তু তথাকথিত পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তাদের খসড়া রণনীতি ও কর্মসূচীতে স্বাধীনতার পূর্বে ভারতের সমাজের বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হন। প্রাক স্বাধীনতাকালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালিত না হওয়ার কারণ নির্ণয় করতে তারা ব্যর্থ হন।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে পূর্ববাংলার সমাজের বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ করলে আমরা নিম্নলিখিত মুল দ্বন্দ্বগুলো পাইঃ

১। পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব।

২। পূর্ববাংলার বিশাল কৃষক-জনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব।

৩। পূর্ববাংলার জনগণের সাথে

ক) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের;

খ) সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের;

গ) ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব।

৪। পূর্ববাংলার বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব।

উপরোক্ত মূল দ্বন্দ্বগুলোর মধ্যে প্রধান দ্বন্দ্ব হলো পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব।

এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পরিবর্তে তারা সংশোধনবাদী, নয়া সংশোধনবাদীদের বক্তব্য হুবহু হাজির করেন। এই তত্ত্বে পূর্ববাংলার ওপর পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর উপনিবেশিক শাসন ও শোষণ অস্বীকার করে সংশোধনবাদী, নয়া সংশোধনবাদীদের তিন বোয়াল, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ বৃহৎ ও একচেটিয়া ধনিকদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

তারা পূর্ববাংলার জনগণের উপর উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয় বিপ্লবের পতাকা ঊর্ধে তুলে না ধরে উপনিবেশবাদীদের হাত শক্তিশালী করেছেন এবং লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী জনতাকে সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক ছয়দফাপন্থী আওয়ামী লীগের পিছনে ঠেলে দিচ্ছেন। এভাবে তারা সাম্রাজ্যবাদের সহায়তা করছেন।

তারা উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তানের দুই অঞ্চল মধ্যখানে হিন্দুস্থান কর্তৃক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দুঅংশের দূরত্ব স্থল পথে প্রায় বারশমাইল জলপথে প্রায় ১৪শত মাইলসুতরাং পাকিস্তানের অন্যান্য নিপীড়িত জাতির সাথে একই সঙ্গে একাত্ম হয়ে লড়াই করা, আন্দোলন অবস্থা উপলব্ধি এবং পরিচালনা সম্ভব নয়। কারণে আমাদের বিপ্লবের ক্ষেত্র হলো পূর্ব পাকিস্তান। তারা ভৌগলিক কারণে পূর্ববাংলাকে বিপ্লবের ক্ষেত্র হিসেবে নেন। এভাবে তারা পূর্ববাংলায় বিপ্লব সীমাবদ্ধ থাকার কারণ বাহ্যিক (ভৌগলিক) বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদের শিক্ষা দেয়, বস্তুর বিকাশ লাভের মৌলিক কারণ বাহ্যিক নয় বরং আভ্যন্তরীণ, বস্তুর অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যেই এটা নিহিত। যেকোন বস্তুর ভিতরে এই ধরণের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। অতএব এটাই বস্তুর গতি   বিকাশ লাভের উদ্রেগ করে। বস্তুর ভিতরকার ধরণের দ্বন্দ্বই হচ্ছে বস্তুর বিকাশ লাভের মৌলিক কারণ। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদের আরও শিক্ষা দেয়, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মতে বাহ্যিক কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের শর্ত, আভ্যন্তরীণ কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের ভিত্তি। কাজেই পূর্ববাংলার সামাজিক পরিবর্তনের সংগ্রাম পূর্ববাংলায় সীমাবদ্ধ থাকার কারণ পূর্ববাংলার সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। ভৌগলিক কারণ অন্যান্য বাহ্যিক কারণের একটি মাত্র। কিন্তু তথাকথিত পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নয়া সংশোধনবাদীরা পূর্ববাংলায় বিপ্লব সীমাবদ্ধ থাকার কারণ হিসেবে ভৌগলিক কারণের উল্লেখ করে “…..বাহ্যিক কারণ যান্ত্রিকতার অধিবিদ্যক তত্ত্বের আশ্রয় নিয়েছেন। সভাপতি মাও এদের সম্পর্কে বলেছেন, “(এরা) সমাজের বিকাশের কারণ সমাজের বাইরে, যেমন ভৌগলিক অবস্থা আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করে। ইউরোপে ধরণের চিন্তাধারা যান্ত্রিক বস্তুবাদরূপে সতের শতকে এবং আঠার শতকে এবং বাজে বিবর্তনবাদরূপে ঊনিশ শতকের শেষের দিকে বিদ্যমান ছিল। পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এই পুরোনো তত্ত্বকে হাজির করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।

তারা এই অনুচ্ছেদে ভারতকে “হিন্দুস্থান” বলে উল্লেখ করেন। হিন্দুস্থান বলে (যা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীরা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করে থাকে) তারা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের মত সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় দেন।

তারা এ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেন, নিজেদের বাংগালী জাতির মুক্তি সংগ্রাম পূর্ববাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।বাঙালী জাতি বলতে কি তারা পশ্চিমবাংলার জনগণকেও অনর্ভূক্ত করেন? এভাবে তারা পশ্চিমবাংলার সাথে নিজেদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে য্ক্তু বাংলার স্বপ্ন দেখেন। তারা ব্যক্তিগত আলাপে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার জনগণকে একজাতিভুক্ত করেন এবং বিপ্লবের পরে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তৈরী করার স্বপ্ন দেখেন। এ তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে মার্কসবাদ বিরোধী। পাকিস্তানে যোগদানের পরবর্তী ঐতিহাসিক বিকাশের পর্যায়ে পূর্ববাংলার জনগণ একটি জাতিতে পরিণত হয়। বর্তমান পর্যায়ে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, মানসিকতা প্রভৃতি দিক দিয়ে পূর্ববাংলা পশ্চিমবাংলা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। যেহেতু মার্কসবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী পূর্ববাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পূর্ণ হওয়ার পরও সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণী ও শ্রেণীসংগ্রাম থাকবে এবং যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ থাকবে ততদিন রাষ্ট্র থাকবে, সে কারণে বর্তমান পর্যায়ে বা সমাজতান্ত্রিক পর্যায়েও পূর্ব ও পশ্চিমবাংলা যুক্ত হওয়ার তত্ত্ব মার্কসবাদ বিরোধী। কেবলমাত্র কমিউনিস্ট সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণী বিলুপ্ত হবে এবং রাষ্ট্রও বিলুপ্ত হবে এবং তখনই পূর্ববাংলা ও সমস্ত পৃথিবী একত্রিত হতে পারে।

‘শত্রু শিবিরে তিন শত্রু’—এ অধ্যায়ে তারা নুতন বোতলে পুরাতন মদ পরিবেশনের পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। সংশোধনবাদী মনি সিং-মোজাফফর চক্র এবং আবদুল হক-তোয়াহা চক্রের তিন বোয়াল সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, বৃহৎ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদকে পূর্ববাংলার জনগণের শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা পাকিস্তানী একচেটিয়া পুঁজিপতি ও সামন্তবাদীদের (যারা বর্তমানে রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিক) সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বের কথা দ্বন্দ্বসমূহের মাঝে স্বীকার না করলেও তাদেব বক্তব্যে নিজেদের অজ্ঞাতেই নিম্নভাবে স্বীকার করেন। আসলে এই শোষণ নিপীড়ণ বৃটিশের উপনিবেশিক আমলের থেকে কমতো নয়ই বরং অনেক বেশী। যখন একটি জাতি উপনিবেশিক উপায়ে শোষণের চাইতেও বেশী শোষিত হয় তখন ইহা অবশ্যই উপনিবেশিক উপায়ে শোষিত ও নিপীড়িত। এভাবে তারা নিজেদের অজ্ঞাতে আমাদের বক্তব্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।

তারা পূর্ববাংলার উপর উপনিবেশিক শোষণ চাপা দেওয়ার জন্য একে বিশেষ শোষণ বলে উল্লেখ করেন।

মার্কসবাদীরা এইরূপ বিমূর্তভাবে কখনও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে প্রকাশ করে না। আমরা তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করছি, এই ‘বিশেষ’ শোষণ বলতে তারা কি বুঝাতে চাচ্ছেন?

তারা সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশোধনবাদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব স্বীকার করেননি। আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্যে উল্লেখিত এবং লিন পিয়াও কর্তক ঘোষিত বক্তব্য—মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশোধনবাদের সাথে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশ ও জাতিসমূহের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব থেকে আমরা পাই, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মতই বিশ্ব জনগণের প্রধান শত্রু।

সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের নিয়ে চীন বিরোধী, কম্যুনিজম বিরোধী, জনগণ বিরোধী ঐক্যজোট প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, সমাজতন্ত্র ও কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সমর্থন করবে না। পূর্ববাংলাকে শোষণ ও লুন্ঠন করাই তাদের লক্ষ্য। পূর্ববাংলায় তাদের দালাল সংশোধনবাদীরা পূর্ববাংলার বিপ্লব ধ্বংস করার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে। সংশোধনবাদীরা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, বুর্জোয়া ও সকল প্রতিক্রিয়াশীলদের এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দালাল। কাজেই সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশোধনবাদকে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় শত্রু বলে উল্লেখ না করে, সংশোধনবাদ মার্কসবাদী আন্দোলনের প্রধান শত্রু এবং সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা বিশ্ব জনগণের প্রধান শত্রু এ তত্ত্ব অস্বীকার করে তারা নিজেদের সংশোধনবাদী চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন।

সভাপতি মাও বলেছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলে অবশ্যই সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। কিন্তু তারা সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চান। এ কারণে তারা সত্যিকারভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীও নন। পেটি বুর্জোয়া মার্কসবাদ বিরোধী রোমান্টিক বিপ্লবী চে-বাদীরা সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রাম ব্যতিরেকেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম পরিচালনার কথা প্রচার করে। কাজেই তারা চে-বাদী।

তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বের উল্লেখ করেননি। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা সাম্রাজ্যবাদের মত পুঁজি বিনিয়োগ দ্বারা শোষণ করতে অক্ষম বিধায় সীমানা সম্প্রসারণ করে তাদের পণ্যের বাজার তথা শোষণের ক্ষেত্র লাভ করতে চায়। তারা পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে বুর্জোয়া নেতৃত্ব সমর্থন করবে কেননা বুর্জোয়া নেতৃত্বে স্বাধীন পূর্ববাংলাকে শোষণ করা এবং চীন বিরোধী, কম্যুনিজম বিরোধী ও জনগণ বিরোধী একটা মিত্র পাওয়া সম্ভব, কিন্তু সর্বহারার নেতৃত্বে স্বাধীন পূর্ববাংলা সহায়ক হবে আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবাংলা তথা সমগ্র ভারতের সর্বহারার মুক্তির। কাজেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা সর্বহারার নেতৃত্বে স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সর্বতোপায়ে বানচাল করার প্রচেষ্টা চালাবে। কাজেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ববাংলার জনগণের শত্রু। কিন্তু তথাকথিত পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সৃষ্টিকর্তারা পুর্ববাংলার জনগণের সাথে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ না করে সম্প্রসারণবাদের দালালীর পরিচয় দিয়েছেন।

তারা উল্লেখ করেছেন, এরা (তিন শত্রু) একে অন্যের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, পরস্পর ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, একে অপরের রক্ষক সহায়ক। কোনটাকে বিচ্ছিন্ন করে আঘাত করা যায় না। তারা অন্যত্র বলেছেন, “এই তিন শত্রুকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া উচিত না।” অর্থাৎ, তারা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, বড় ধনী ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের মধ্যে কোনটা প্রধান কোনটা গৌণ তা নির্ণয় করতে চান না। আবদুল হক ও তোয়াহা চক্রের মত এক ও অবিচ্ছেদ্য বলে উল্লেখ করেন। তারা আরো উল্লেখ করেন, প্রধান দ্বন্দ্ব নির্ধারণের বিষয়টি রণনীতি সংক্রান্ত নয়, ইহা রণকৌশলের অন্তর্গত বিষয়। প্রথম ও দ্বিতীয় তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পরিপন্থী। সভাপতি মাও বলেছেন, কোন প্রক্রিয়াতে যদি অনেকগুলো দ্বন্দ্ব থাকে তাহলে তাদের মধ্যে একটি প্রধান দ্বন্দ্ব থাকবে যা নেতৃস্থানীয় নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করবে, অন্যগুলো গৌণ অধীনস্থ ভূমিকা নেবে। তাই দুই বা দুইয়ের বেশী দ্বন্দ্ব বিশিষ্ট কোন জটিল প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই তার প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে পাবার জন্য সর্বপ্রকারের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ প্রধান দ্বন্দ্বকে আঁকড়ে ধরলে সব সমস্যা সহজেই মীমাংসা করা যায়। তিনি আরও বলেছেন, হাজার হাজার পণ্ডিত কাজের লোক রয়েছেন যারা এটা বুঝেন না এবং ফলে তাঁরা কুয়াশায় ডুবে যান, সমস্যাটির মূলে যেতে পারেন না এবং স্বাভাবিকভাবেই দ্বন্দ্বগুলোর মীমাংসার পদ্ধতি পান না। তিনি আরও বলেছেন, “কিন্তু যাই হোক না কেন সন্দেহ নাই যে একটি প্রক্রিয়ার বিকাশের সকল স্তরে কেবলমাত্র একটিই দ্বন্দ্ব থাকে যা নেতৃস্থানীয় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।

কাজেই বিভিন্ন দ্বন্দ্বকে বিশ্লেষণ করে অবশ্যই প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে বের করতে হবে, সর্বহারার আঘাতের প্রধান শত্রুকে নির্ণয় করতে হবে—ইহা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের একটি মূলতত্ত্ব। কমরেড স্ট্যালিন বলেছেন, রণনীতি হচ্ছে বিপ্লবের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে সর্বহারার প্রধান আঘাতের দিক নির্ণয় করা, তদনুযায়ী বিপ্লবী শক্তিসমূহের (প্রধান গৌণ) প্রয়োগের বিশদ পরিকল্পনা রচনা করা, বিপ্লবের নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।

কাজেই প্রধান দ্বন্দ্ব খুঁজে বের করার প্রশ্ন সর্বহারার বিপ্লবের একটি মূল প্রশ্ন, ইহা রণনীতির প্রশ্ন। কিন্তু তথাকথিত পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সৃষ্টিকর্তারা প্রধান দ্বন্দ্বকে রণকৌশলের প্রশ্ন বলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মুলতত্ত্বকে বিকৃত করেছেন। সভাপতি মাও বলেছেন, মার্কসবাদের মৌলিক নীতিকে অস্বীকার করা মার্কসবাদের সার্বিক সত্যকে অস্বীকার করাই হচ্ছে সংশোধনবাদ। তথাকথিত পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির স্বরূপ উদঘাটন করে আমরা দেখতে পাচ্ছি এ পার্টির সৃষ্টিকর্তারা মার্কসবাদের বহু মৌলিক তত্ত্বকে সংশোধন ও বিকৃত করেছেন। এ কারণে তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার মুখোশ এঁটে যতই চেষ্টা করুন না কেন, নিজেদের বুর্জোয়া চরিত্রকে গোপন করতে পারবেন না, তারা প্রকৃতপক্ষে সংশোধনবাদী যা আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান।

মার্কসবাদলেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারা দীর্ঘজীবী হোক!

সংশোধনবাদনয়া সংশোধনবাদ খতম হোক!