আন্তর্জাতিক যৌথ বিবৃতিঃ “তৃতীয় বিশ্ববাদ” ও “তিন বিশ্ব”-এর বর্ণনা প্রসঙ্গে

নভেম্বর ২০১৫

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশ

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ফ্রান্স

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী কেন্দ্র বেলজিয়াম

এর যৌথ বিবৃতিঃ

“তৃতীয় বিশ্ববাদ” ও “তিন বিশ্ব”-এর বর্ণনা প্রসঙ্গে

(পিডিএফ পড়ুন এখানে http://sarbaharapath.com/?page_id=64)

আমরা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক ভ্রান্ত লাইনঃ “তৃতীয় বিশ্ববাদ” সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করে দিতে চাই। এই ধারণা জাতীয় কাঠামোকে নেতিকরণ করে যা হচ্ছে বাস্তবতার দ্বান্দ্বিক গতি আর অতি বাম বিষয়বস্তু তৈরি করে যা কেবল বিভ্রান্তি আনে।

যেমন আমরা জানি যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৬৩তে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির জবাবে ২৫ পয়েন্টের চিঠি হিসেবে পরিচিত চিঠিতে বলেছিলঃ

“সমকালীন বিশ্বের বিবিধ দ্বন্দ্বসমূহ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিস্তীর্ণ maoএলাকায় ঘনীভূত; এগুলো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শাসনাধীনে সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকা যা হচ্ছে বিশ্ববিপ্লবের ঝটিকাকেন্দ্র যা সাম্রাজ্যবাদের উপর সরাসরি আঘাত আনে (…)।

আন্তর্জাতিক কমিউউনিস্ট আন্দোলনের কিছু ব্যক্তি এখন নিপীড়িত জাতির মুক্তি সংগ্রামগুলির প্রতি নিষ্ক্রিয় অথবা ঘৃণা অথবা নেতিবাচক অবস্থান নেয়। বস্তুত তারা একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থকে রক্ষা করে সর্বহারা শ্রেণির স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, সমাজ গণতন্ত্রীতে অধঃপতিত হয়।

এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলির জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামগুলির প্রতি গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে পার্থক্য নির্নয়কারী মানদণ্ড একদিকে তারা যারা বিপ্লব চায় আর অন্যদিকে যারা তা চায়না, একদিকে যারা সত্যিকারভাবে বিশ্বশান্তিকে রক্ষা করছে অন্যদিকে যারা আগ্রাসন আর যুদ্ধের শক্তিগুলিকে সহায়তা করছে—এই দুইয়ের মধ্যে।” [১]

বিশ্বের সম্পর্কে এটাই হচ্ছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মৌলিক উপলব্ধি। পুঁজিবাদী দেশসমূহ আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশগুলির উপর ভয়ানক শোষণ সংগঠিত করতে সক্ষম হয়। এই প্রক্রিয়ায় তারা একটা শ্রম অভিজাততন্ত্র সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় যা পুঁজিবাদকে lenin1সেবা করে। লেনিন তার ধ্রুপদী “সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়”তে লেখেনঃ

“পুঁজিবাদ এখন সৃষ্টি করেছে মুষ্টিমেয় (দুনিয়ার বসবাসকারীদের এক দশমাংশের কম; সর্বাধিক “ভদ্র” ও উদার গণনায় বলা যায় এক-পঞ্চমাংশের কম) ব্যতিক্রমী ধনী ও শক্তিশালী রাষ্ট্র যারা সমগ্র বিশ্বকে লুন্ঠন করে স্রেফ “কুপন কেটে” (…)।

নিশ্চিতভাবেই এমন বিপুল অতিমুনাফা (যেহেতু সেগুলো পুঁজিপতিরা “নিজ” দেশের শ্রমিকদের নিঙড়ে নেয়া মুনাফার থেকে এটা অতিরিক্ত) দ্বারা শ্রমিক নেতাদের ও শ্রমিক অভিজাততন্ত্রের উপরি স্তরকে ঘুষ দিয়ে কেনা সম্ভব। আর এটাই “অগ্রসর” দেশগুলির পুঁজিপতিরা করছেঃ তারা তাদেরকে ঘুষ দিচ্ছে হাজারো উপায়ে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, প্রকাশ্য বা গোপনে (…)।

এরাই হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে বুর্জোয়াদের সত্যিকার এজেন্ট, পুঁজিপতি শ্রেণীর শ্রম লেফটেনেন্ট, সংস্কারবাদ ও শোভিনিজমের প্রকৃত চালিকাশক্তি।” [২]

একদিকে রয়েছে শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলি যারা শ্রমিক শ্রেণির সারিতে এজেন্ট তৈরি করতে সক্ষম, শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী তৎপরতাকে আপেক্ষিকভাবে পঙ্গু করে দিয়ে, অন্যদিকে রয়েছে নিপীড়িত দেশগুলি যাতে শোষণ এত শক্তিশালী যে বিদ্রোহ গড়ে উঠতে পারে অনেক ভালভাবে।

তথাপি, এগুলো হল প্রবণতা। উদাহারণস্বরূপ, নিপীড়িত দেশগুলিতে, আধা-সামন্তবাদ অথবা আধা-উপনিবেশবাদ এত শক্তিশালি যে বিপ্লব আপেক্ষিকভাবে মন্থর হয়ে যেতে পারে। ধর্মীয় অন্ধত্ববাদ এক প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতা যা খুবই শক্তিশালি যেখানে নির্দিষ্টত সামন্তবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেসব দেশ আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের বিকাশের এক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে সেখানে জাতীয়তাবাদ খুবই শক্তিশালী হতে পারে।

একইভাবে নিঃস্বকরণ পুঁজিবাদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। বুর্জোয়া ও সর্বহারার মধ্য দ্বন্দ্ব হচ্ছে বৈর আর তাই জনগণ, পুঁজিবাদী দেশগুলিতে, দারিদ্রের পরিস্থিতিতে অধিক থেকে অধিকতর পতিত হয়। কার্ল মার্কস পুঁজিতে পুঁজি সঞ্চয়ের এই নিয়মটাই ব্যাখ্যা করেছেন, আর সমাজ-গণতন্ত্রী সংস্কারবাদীরা তা প্রত্যাখ্যান করেছে যারা বলে যে পুঁজিবাদের মধ্যে জনগণের জীবনযাত্রার মান সর্বদাই অধিকতর ভাল হতে পারে।

“তৃতীয় বিশ্ববাদ” হচ্ছে একটা মতাদর্শ যা বাস্তবতার দ্বান্দ্বিকতাকে নেতিকরণ করতে পারে। এটা ভাণ করে যে পুঁজিবাদ পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শান্তিপুর্ণ আর সর্বদাই উন্নতি করতে পারে। এটা প্রতিবিপ্লবী। কিন্তু সে এটা খোলাখুলিভাবে বলেনাঃ সে শান্তিপুর্ণ পুঁজিবাদের তার লক্ষ্যকে ঢেকে রাখে “তৃতীয় বিশ্ব”-এর “বিপ্লবী” ইতিকরণ করার মাধ্যমে।

সমাজ-গণতন্ত্রী সংস্কারবাদীদের মতই “তৃতীয় বিশ্ববাদ” একই লক্ষ্য ছড়ায়, কিন্তু “তৃতীয় বিশ্ব” এর নামে “বিপ্লবী” হওয়ার ভাণ করে এই তথাকথিত শান্তিপুর্ণ পুঁজিবাদের নেতিকরণ করার মধ্যে।

এটা হচ্ছে অতিবাম বিচ্যুতি যা কেবল “শান্তিপুর্ণ” পুঁজিবাদের জনপ্রিয়করণকারীদেরই সাহায্য করে, কারণ এর “বিরুদ্ধে” হওয়ার ভাণ করলেও, তারা একই কথা বলে।

এটা এক অতিবাম বিচ্যুতি যা পুঁজিবাদী দেশগুলিতে বুর্জোয়া ও সর্বহারারা মধ্যে শ্রেণীবৈরিতা নেতিকরণ করে, সাম্রাজ্যবাদের “শ্রেষ্ঠত্ব”র নামে বিশ্বাসঘাতকতাকে এগিয়ে নেয়।

এটা এক অতিবাম বিচ্যুতি যা বিপ্লবের “জাতীয়” ধারণাকে সমর্থন করে যখন বস্তুত প্রশ্নটি leninstalinসর্বদাই হচ্ছে একটা গণতান্ত্রিকঃ নিপীড়িত দেশগুলির সংগ্রাম এক জাতির আরেকটার বিরুদ্ধে নয়, বরং অন্য দেশের শাসকশ্রেণীর পরিচালিত শোষণ ও নিপীড়ণের বিরুদ্ধে জনগণের গণতন্ত্রের সংগ্রাম।

সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ সম্পর্কে সমাজগণতন্ত্রীদের মত একই ধারণা রয়েছে “তৃতীয় বিশ্ববাদী”দের, একে বৈরিতাহীন মনে করে; “তৃতীয় বিশ্ব”র আধিবিদ্যক ধারণা জন্ম দিয়ে এর রয়েছে এক দ্বান্দ্বিকতাবিরোধী দৃষ্টিকোণ ।

এটা লিন পিয়াওয়ের একই মতাদর্শ যে কিনা এক “তৃতীয় বিশ্ববাদী” লাইনের ছদ্মাবরণে লাল চীনে এক ফ্যাসিবাদী ক্যুর চেষ্টা করেছিল।

“তৃতীয় বিশ্ব” সম্পর্কে সত্যকারভাবে কী আমাদের বোঝা উচিত সেখানে জোর দেয়া দরকার। মাওসেতুঙই এই ধারণার জনপ্রিয়করন করেন; তিনি যখন বিশ্বের এক বর্ণনা দেন, আসুন সেখান থেকে উদ্ধৃত করিঃ

“মার্কিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচুর পারমাণবিক বোমা রয়েছে, আর তারা হচ্ছে অধিকতর ধনী। ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা দ্বিতীয় বিশ্বভুক্ত, যাদের প্রচুর পারমাণবিক বোমা নেই, তারা প্রথম বিশ্বের মত এতটা ধনীও নয়, তবে তারা তৃতীয় বিশ্ব থেকে অধিকতর ধনী।” (৩)

আমরা যেমনটা জানি, দেঙ শিয়াওপিঙের নেতৃত্বে লাল চীনে পুঁজিবাদের পথিকরা “তৃতীয় বিশ্ব” এর সাথে “দ্বিতীয় বিশ্ব” এর জোট গড়ে তোলার জন্য ইতিমধ্যেই একটা প্রচেষ্টা নিয়েছিল এই বর্ণনার অপব্যবহার করতে।

এটা প্রচুর বিভ্রান্তি ও অনেকসময় উপলব্ধির অভাব জন্ম দেয়। আসুন এখানে দেখা যাক গনসালো ও গনসালো চিন্তাধারার মাধ্যমে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির সঠিক উপলব্ধিঃ

প্রথম বিশ্ব হচ্ছে দুই পরাশক্তি মার্কিন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যারা বিশ্বে একাধিপত্যের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতারত এবং যা একটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জন্ম দিতে পারে। তারা হচ্ছে পরাশক্তি কারণ তারা অন্য শক্তিসমূহের চাইতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে অধিকতর শক্তিধর। মার্কিনের রয়েছে অ-রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া সম্পত্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতি, অধিকারের ওপর বেড়ে চলা বিধি-নিষেধসহকারে রাজনৈতিকভাবে এটা এক gonzalloবুর্জোয়া গণতন্ত্র বিকশিত করে। এটা একটা প্রতিক্রিয়াশিল উদারতাবাদ; সামরিকভাবে পাশ্চাত্যে এটা সবচেয়ে শক্তিধর এবং এর বিকাশের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন রাজনৈতিকভাবে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়ার ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বসমেত অর্থনৈতিকভাবে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়াভিত্তিক এবং এটা একটা উচ্চপর্যায়ের সামরিক শক্তি যদিও এর বিকাশের প্রক্রিয়া সংক্ষিপ্ত। মার্কিন তার আধিপত্যকে বজায় রাখতে চায় এবং তা সম্প্রসারণও করতে চায়। সোভিয়েতের লক্ষ্য সম্প্রসারণের দিকে বেশি কারণ সে একটা নতুন পরাশক্তি এবং অর্থনৈতিকভাবে তার ইউরোপের ওপর আধিপত্যের স্বার্থ রয়েছে নিজ পরিস্থিতি উন্নত করার লক্ষ্যে। সংশ্লেষণে, তারা দুই পরাশক্তি যারা কোন ব্লক গঠণ করেনা কিন্তু দ্বন্দ্ব রয়েছে, পরিস্কার পারস্পরিক পার্থক্য রয়েছে এবং দুনিয়াকে পুনবিভাজনের জন্য তারা ঘোঁট পাঁকানো ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে আগায়।

দ্বিতীয় বিশ্ব হচ্ছে সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ যারা পরাশক্তি নয় কিন্তু ক্ষুদ্রতর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি যথা-জাপান, জার্মানী, ফ্রান্স, ইতালী প্রভৃতি যাদের পরাশক্তির সাথে দ্বন্দ্ব রয়েছে কারণ তারা ডলারের অবমূল্যায়ণ, সামরিক বিধি-নিষেধ এবং রাজনৈতিক আরোপ বজায় রাখে; এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ পরাশক্তিসমূহের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের নয়া পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত করতে চায় যেহেতু তারাও নিপীড়িত জাতিসূহের বিরুদ্ধে আগ্রাসী যুদ্ধ চালায় এবং অধিকন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে তীক্ষ দ্বন্দ্ব বিরাজমান।

তৃতীয় বিশ্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত দেশগুলিকে নিয়ে গঠিত। Mao2তারা হচ্ছে উপনিবেশ অথবা আধাউপনিবেশ যেখানে সামন্তবাদ ধ্বংস হয়নি ও সেই ভিত্তিতে এক আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ গড়ে ওঠে। তারা এক পরাশক্তি অথবা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে বাঁধা। সাম্রাজ্যবাদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব রয়েছে, অধিকন্তু তারা তাদের নিজ বড় বুর্জোয়া ও সামন্তদের সাথে লড়ে যারা উভয়ই সাম্রাজ্যবাদের সাথে বিশেষত পরাশক্তির সেবায় ও তাদের সাথে আাঁতাতে আবদ্ধ (…)

একদিকে পরাশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ অপরদিকে এদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জাতিসমূহ— এই দুয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এখানে তিন বিশ্বের থিসিস মূর্ত হয় এবং আমরা একে সূত্রায়িত করি এইভাবে কারণ দ্বন্দ্বের শাঁস রয়েছে পরাশক্তির মধ্যে নিহিত কিন্তু এটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের সাথেও দ্বন্দ্ব। এটাই হচ্ছে প্রধান দ্বন্দ্ব আর এর সমাধান হচ্ছে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিকাশ ও বিজয়।”

এই সঠিক মূল্যায়ন পৃথিবীর বহু পার্টি ও সংগঠনই করেনি। উদাহারণস্বরূপ, তুরস্কে টিকেপি/এমএল আর আলবেনিয়ার লেবার পার্টির ছিল “তিন বিশ্ব” তত্ত্বের একই একতরফা ধারণা।

টিকেপি/এমএল মাও সেতুঙকে রক্ষায় একে প্রত্যাখ্যান করে যারা মনে করে যে মাও একে সমর্থন করতে পারেননা আর আলবেনিয়ার লেবার পার্টি মাও সেতুঙকে দেঙ শিয়াওপিঙেরLenin2 সাথে মিশিয়ে ফেলে এর সমর্থনকারী হিসেবে তুলে ধরে তাকে আক্রমণ করে একে প্রত্যাখ্যান করে ।

বস্তুত, “তিন বিশ্ব” ধারণা ছিল কেবল এক বর্ণনা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্বকে অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও পরাশক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বকে ভালভাবে ধরতে যা অনুমোদন দেয়; এর অর্থ কখনোই এমন একটা ধারণা ছিলনা যা যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা যায়।

বৈজ্ঞানিক হতে আমাদের উচিত আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশগুলির মধ্যে একই পার্থক্যকে ব্যবহার করা। তাদের মধ্য কেউ কেউ “সম্প্রসারণবাদী”, যেমন প্রথমে marxengels2পাকিস্তান ও পরে ভারতকে মোকাবেলায় সিরাজ সিকদার পূর্ববাংলার মূর্ত পরিস্থিতিতে লক্ষ্য করেছিলেন। উভয় দেশই আধা উপনিবেশিক আধা সামন্ততান্ত্রিক, কিন্তু সম্প্রসারণবাদী দেশগুলির মতই আগ্রাসী।

লক্ষ্যনীয় যে এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, তৃতীয় বিশ্ববাদীদের দ্বারা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিনিধিত্ব হয়ে চীনা রাষ্ট্র পূর্ববাংলার মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করেনি যেহেতু এটা তাদের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মিত্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল বলে তারা মনে করেছিল।

একজন প্রকৃত কমিউনিস্ট হিসেবে সিরাজ সিকদার মাও সেতুঙ ও তার শিক্ষাকে উপলব্ধি করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাই, তার পথনির্দেশক চিন্তাধারা সরাসরি এই তৃতীয় বিশ্ববাদী মতের বিরুদ্ধে যায় যা মনে করেছিলsikder একটা নিপীড়িত দেশ হিসেবে পাকিস্তানের উপনিবেশ থাকতে পারেনা। তৃতীয় বিশ্ববাদীরা তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশের মধ্য কোন দ্বন্দ্ব খুঁজে পায়না।

তৃতীয় বিশ্ববাদের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যে এটা দ্বান্দ্বিকতাকে বর্জন করে, আর তাই নিপীড়িত দেশগুলির দ্বন্দ্বসমূহকে বর্জন করে, যেগুলো “জাতীয় রাষ্ট্র” নয় বরং আধা-উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ।

৭০ দশকের প্রথম দিকগুলিতে, মস্কোপন্থী গ্রুপগুলো ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার দালালদের সমর্থন করে যেখানে চীনাপন্থী তৃতীয়বিশ্ববাদীরা পাকিস্তানী সম্প্রসারণবাদ ও তার দালালদের সমর্থন করে।

দুনিয়ার সর্বত্র আমরা দেখি নিপীড়িত দেশগুলিতে, সংশোধনবাদীরা আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদকে সমর্থন করে, এক জাতীয়বাদী ভুমিকায় একই সাথে সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদীদের জন্য কাজ করে যাদেরকে তারা “প্রগতিশীল” হিসেব বেছে নেয়।

সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতেও এই ধারা অস্তিত্বশীল, নির্দিষ্টত দ্বিতীয় বিশ্বে ও পরাশক্তিগুলির বিরুদ্ধে এর খেলায়।

সাম্রাজবাদী দেশে উদাহারণস্বরূপ, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে, যেসব সংগঠন নিজেদের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাও সেতুঙ চিন্তাধারার দাবি করত আর ১৯৬০, ১৯৭০ ও ১৯৮০ দশকে সক্রিয় ছিল তারা সবাই তাদের সকল তাত্ত্বিক অবস্থান প্রকাশ করেছিল “তিন বিশ্ব” সংশ্লিষ্ট হিসেবে, কিন্তু কোনভাবেই সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বকে আরো ভালভাবে বোঝার “একটা হাতিয়ার” হিসেবে “তিন বিশ্ব”এর সঠিক উপলব্ধি তাদের ছিলনা।

এখানে “তিন বিশ্ব”কে কর্ম তৎপরতার রণনৈতিক দিশা হিসেবে যান্ত্রিকভাবে অপপ্রয়োগের সবচেয়ে নেতিবাচক উদাহারণ যার সেই বেলজীয় সংগঠন এমএডিএ-টিপিও যা কিনা ১৯৭৯ তে পিটিবি-পিভিবিএ—যারা সুবিধাবাদীভাবে ভুলে যায় যে শ্রেণীহীন এক তত্ত্ব কখনোই সর্বহারা শ্রেণীর তত্ত্ব হতে পারেনা।

তাই, ৮মে ১৯৭৬, তার “শান্তি, জাতীয় স্বাধীনতা, জনগণের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কর্মসূচি”তে “উদীয়মান ও আগ্রাসী রুশ একাধিপত্যবাদ ও পতনশীল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে কিনা আত্মরক্ষাত্মক অবস্থানে আছে—এই দুইয়ের মধ্য শক্তি সম্পর্কের বিশ্লেষণের অংশ হিসেবে এএমএডিএ-টিপিও ব্যাখ্যা করে যে ন্যাটোকে এক প্রয়োজনীয় কাঠামো হিসেবে বুঝতে হবে যার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে “সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, ‘নিজ শক্তির উপর নির্ভর করা’, সমতা, আর পারস্পরিক আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা” নীতির ভিত্তিতে আত্মরক্ষামূলক জোটে আসা যায়।

পূর্ণ আত্মগতভাবে নিমজ্জিত হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও বেলজীয় বুর্জোয়ার সাথে ঐক্যবদ্ধ ব্লক গঠনের আকাঙ্খায়, এএমএডিএ-পিটিও ন্যাটোকে একটা “আশ্রয়” হিসেবে বিশ্লেষণ করে যেখানে উল্লেখিত জাতীয় দিকে ধাবিত সকল ধারাকে সমর্থন করা সম্ভব হবে।

যেহেতু এএমএডিএ-টিপিও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুঠোর মধ্যে সমতা, পারস্পরিক হস্তক্ষেপ না করা, জাতীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদানকারীতে পরিণত হয়েছে, তাই এটা বোঝা দুষ্কর নয় যে এসব পরিকল্পনার সাথে মাও সেতুঙ ও গনসালো কর্তৃক জনপ্রিয়কৃত “তিন বিশ্ব” এর কোন সম্পর্ক নেই।

“আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ অবনতিশীল” এর উপর তাদের “বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি”কে সমর্থন ১৯৭৬ এর শেষের অর্থাৎ চীনের পার্টি বিরোধী সংশোধনবাদী চক্রের বিজয়ের পর “বেজিং রিভিউ” এর থেকে হুয়া কুয়া ফেঙ ও দেঙ শিয়াওপিঙ এর থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছিল।

এএমএডিএ-টিপিও মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সংগঠন-মাও সেতুঙ চিন্তাধারার মুখোশ পরে ছিল; ব্যবহারিকভাবে সে ইতিমধ্যেই একটা গণবাদী সংগঠনে পরিণত হয় যে ছিল মূলত এক “সামাজিক” লাইন ও মাও সেতুঙ পরবর্তী কালের ফ্যাসিবাদী চীনকে উদযাপন করার করার প্রবক্তা।

ফরাসী সিপিএমএলএফও খুবই একই ধরণের বিবর্তন অনুসরণ করে।

এটা দেখায় যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে বাস্তবতার বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে শ্রেণীসংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবং পথনির্দেশক চিন্তাধারার জন্মের মাধ্যমে; বিপ্লব আত্মগতভাব অথবা রাপচারবাদ এর উপর দাঁড়াতে পারেনা, না এমনকি তৃতীয় বিশ্বের নামে।

অতিবাম বিচ্যুতি সবসময় আত্মগতভাবকে ভিত্তি করে হয়। এটা নিপীড়ণের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্রভাবে “না” বলার ভাণ করে শোষণের কোন বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি ছাড়াই।

আজকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুটি প্রধান “তৃতীয় বিশ্ববাদী” কাঠামো রয়েছে, উদাহারণস্বরূপ, “রেভুল্যুশনারী এন্টি-ইম্পেরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট” ও “লিডিং লাইট”। উভয়েই মাওবাদী হওয়ার ভাণ করে মাওবাদকে বর্জনের জন্যঃ বিগত মাসগুলিতে সর্বহারা চরিত্রের ভাণ করার পর তারা সর্বদা কেবল অধিক অধিক আত্মগতভাবে নুয়ে পড়ে। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ দশক জুড়ে এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই ঘটেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড আর পশ্চিম জার্মানিতে রেড আর্মি ফ্র্যাকশন সহকারে।

সেইসব প্রকৃত বিপ্লবীরা নিজ দেশে পথ খুঁজে পেতে এক পথনির্দেশক চিন্তাধারা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, তাই তারা বিপ্লবের চালিকাশক্তি অন্য কোথাও খুঁজে পায়। আসুন এখানে রেড আর্মি ফ্র্যাকশনকে উদ্ধৃত করিঃ

“যদি তৃতীয় বিশ্বের জনগণ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবের অগ্রপথিক হন, তাহলে এটা এই অর্থ করে যে তারা বস্তুগতভাবে মেট্রোপোলে জনগণের নিজ স্বাধীনতা অর্জনে সর্বাধিক আশার প্রতিনিধিত্ব করেন।

যদি এই হয় ঘটনা, তাহলে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের জনগণের মুক্তি সংগ্রাম আর মেট্রোপোলে স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্খা যেখানেই তা উদ্ভূত হোক না কেন—এর মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা। অর্থাৎ গ্রেড স্কুল, উচ্চ বিদ্যালয়, কারখানা, পরিবার, কারাগার, দপ্তর, হাসপাতাল, সদর দপ্তর, রাজনৈতিক দল, ইউনিয়ন যেখানেই হোক।

আমরা ভোগবাদ, মিডিয়া, ব্যবস্থাপনা, সুবিধাবাদ, গোঁড়ামিবাদ, কর্তৃত্ব, পিতৃতন্ত্র, পাশবিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদসহ সেসবকিছুর বিরুদ্ধে যা খোলাখুলিভাবে নেতিকরন করে, দমন করে আর ধ্বংস করে এই সংযোগকে।

‘এর অর্থ আমরা!’ আমরা হচ্ছি বিপ্লবী জিনিস।

যেই সংগ্রাম শুরু করে আর প্রতিরোধ করে সেই আমাদের একজন।”

এটা আত্মগতভাব। সাম্রাজ্যবাদী দেশে বিপ্লব তৃতীয় বিশ্বের সাথে “যোগাযোগ” এর উপর নির্ভর করে না, বরং এক পথনির্দেশক চিন্তাধারার উপর যা হচ্ছে বিশ্ববিপ্লবের কাঠামোর marxengels1মধ্যে। এছাড়া অন্য কিছু বলা মানে পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরে বুর্জোয়া ও সর্বহারার মধ্যেকার বৈর দ্বন্দ্বকে নেতিকরণ করা।

প্রতিটি দেশে, দ্বন্দ্ব হচ্ছে আভ্যন্তরীণ; যেমনটা মাও “দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে”তে বলেছেনঃ

“কোন জিনিসের মধ্যেকার বিকাশের মৌলিকে কারন বাহ্যিক নয় বরং আভ্যন্তরীণ; এটা বস্তুটির মধ্যকার বৈপরীত্যের মধ্যে নিহিত। প্রতিটি বস্তুর মধ্যে রয়েছে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, তাই সে গতি ও বিকাশ প্রাপ্ত হয়।”

এই অর্থে, তৃতীয় বিশ্ববাদ হচ্ছে এক প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ যা কেবল বিভ্রান্তি আনে আর যে লক্ষ্য হচ্ছে আজকে যা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ সেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দ্বারা বাস্তবতার অধ্যয়নকে রুদ্ধ করা।

আসুন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদকে অধ্যয়ন করি! মাওবাদের পতাকার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হই!

আত্মগতভাবকে পরিহার করুন, এক পথনির্দেশক চিন্তাধারার বিপ্লবী পূর্বশর্তকে এগিয়ে নিন!

সাম্যবাদের পূর্ব পর্যন্ত গণযুদ্ধ!

১। প্রথম দলিল

১৪ জুলাই ১৯৬৩তে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির জবাব দিয়েছিল যে চিঠির তা ২৫ পয়েন্টের চিঠি হিসেবে বিখ্যাত হয়। এর অষ্টম পয়েন্ট এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করে যাদেরকে তুলে ধরা হয়েছে “বিশ্ববিপ্লবের ঝটিকাকেন্দ্র” হিসেবে।

৮। সমকালীন বিশ্বের বহুবিধ ধরণের দ্বন্দ্ব এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার বিশাল এলাকাসমূহে কেন্দ্রীভূত হয়েছে; এগুলো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অধীন সর্বাধিক স্পর্শকাতর এলাকা আর বিশ্ববিপ্লবের ঝটিকাকেন্দ্র যা সাম্রাজ্যবাদের উপর সরাসরি আঘাত হানে।

এসকল এলাকার গণতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলন আর আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন হচ্ছে আমাদের কালের দুই বিরাট ঐতিহাসিক ধারা।

এসকল এলাকার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছে সমকালীন সর্বহারা বিশ্ববিপ্লবের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধি বিপ্লবী সংগ্রামসমূহ সাম্রাজ্যবাদ আর পুরোনো ও নয়া উপনিবেশবাদের শাসনের ভিত্তির উপর আঘাত হানছে ও ভেঙে দিচ্ছে আর বর্তমানে তারা হচ্ছে বিশ্ব শান্তির এক প্রচণ্ড শক্তি।

এই অর্থে আন্তর্জাতিক বিপ্লবের সম্পূর্ন কর্মসূচি এসকল এলাকার জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের ফলের উপর উপর নির্ভর করছে যারা বিশ্ব জনগণের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ।

তাই, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী সংগ্রাম স্রেফ আঞ্চলিক গুরুত্বের নয় নিশ্চিতভাবে বরং সর্বহারা বিশ্ববিপ্লবের সমগ্র আদর্শের সামগ্রিক গুরুত্বসম্পন্ন।

কিছু লোক এমনকি এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকান জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী সংগ্রামের বিরাট আন্তর্জাতিক তাৎপর্যকে অস্বীকার করা পর্যন্ত এগোয়, আর তারা জাতি, বর্ণ ও ভৌগোলিক আঞ্চলিকতার বাঁধা ভাঙার অজুহাতে চেষ্টা করছে নিপীড়িত ও নিপীড়ক জাতির মধ্যে পার্থক্যকে মুছে দিতে, মুছে দিতে নিপীড়িত দেশ ও নিপীড়ক দেশের মধ্যের পার্থক্য রেখা, তারা এলাকাসমূহের জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামকে দাবিয়ে দিতে চায়। বস্তুত এরা সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনকে সেবা করে আর এসব অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদের শাসন ন্যায্য করতে এবং পুরোনো ও নয়া উপনিবেশবাদের এর পলিসিকে এগিয়ে নিতে নতুন “তত্ত্ব” সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে এই “তত্ত্ব” ভাঙতে চায় জাতীয়তা, বর্ণ ও ভৌগলিক আঞ্চলিকতার বাঁধা নয় বরং বজায় রাখতে চায় নিপীড়িত জাতিসমূহের উপর “শ্রেষ্ঠতর জাতিসমূহের” শাসন। এই ভণ্ড “তত্ত্ব” খুবই স্বাভাবিকভাবে এতদঞ্চলের জনগণের দ্বারা বর্জিত হয়।

প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ও পুঁজিবাদী দেশের শ্রমিকশ্রেণীকে লড়াকু শ্লোগান “সারা দুনিয়ার সর্বহারা এক হও!” আর “সারা দুনিয়ার সর্বহারা ও নিপীড়িত জাতিসমূহ এক হও! সত্যিকারভাবে কার্যকরী করতে হবে। তাকে এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই অধ্যয়ন করতে হবে, তাদের বিপ্লবী কর্মতৎপরতাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করতে হবে, তাদের মুক্তির আদর্শকে শ্রদ্ধা করতে হবে নিজের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমর্থন হিসবে আর নিজ স্বার্থের সাথে সরাসরি সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে। জাতিয়তা, বর্ণ ও ভৌগলিক আঞ্চলিকতার বাঁধাকে ভাঙার এটাই একমাত্র কার্যকর পথ আর এটাই একমাত্র সত্যিকার সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদ।

ইউরোপিয় ও আমেরিকান পুঁজিবাদী দেশগুলির শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে অসম্ভব হবে পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিজেকে মুক্ত করতে যদিনা তারা নিপীড়িত জাতিসমূহের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয় আর সেসকল জাতি মুক্ত হয়। লেনিন সঠিকভাবেই বলেছেন,

“অগ্রসর দেশগুলিতে বিপ্লবী আন্দোলন হতো আসলে পুরো ভণ্ডামি যদিনা পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রামে ইউরোপ ও আমেরিয়ার শ্রমিকেরা পুঁজির দ্বারা নিপীড়িত কোটি কোটি “ঔপনিবেশিক” দাসদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে ও পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়।“ (লেনিন, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেস)।

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোনের কিছু লোক এখন নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তির সংগ্রামের প্রতি নিষ্ক্রিয় অথবা অবহেলার অথবা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিচ্ছেন। বস্তুত তারা একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থকে রক্ষা করছেন সর্বহারা শ্রেণীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আর সমাজ গণতন্ত্রীতে অধঃপতিত হয়ে।

এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকান দেশগুলির জনগনের বিপ্লবী সংগ্রামকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হবে তা হচ্ছে একটা গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড যারা বিপ্লব চায় আর যারা চায়না তাদের মধ্যে আর যারা সতিকারভাবে বিশ্বশান্তিকে রক্ষা করছে আর যারা আগ্রাসন ও যুদ্ধের শক্তিকে সহযোগিতা করছে তাদের মধ্যে।”

(২) দ্বিতীয় দলিল

এখানে লেনিনের “সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর” থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হল যা শ্রমিক অভিজাত এর প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছে।

“এটা নির্দিষ্টভাবে পুঁজিবাদের পরগাছাবৃত্তি ও পঁচন, যা এর বিকাশের সর্বোচ্চ ঐতিহাসিক পর্যায়ের, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট। এই পুস্তিকাতে যা দেখানো হয়েছে, পুঁজিবাদ আলাদা করে তুলে ধরেছে মুষ্টিমেয় (দুনিয়ার বসবাসকারীদের এক দশমাংশের কম; সর্বাধিক “ভদ্র” ও উদার গণনায় বলা যায় এক-পঞ্চমাংশের কম) ব্যতিক্রমী ধনী ও শক্তিশালী রাষ্ট্র যারা সমগ্র বিশ্বকে লুন্ঠন করে স্রেফ “কুপন কেটে”। প্রাক-যুদ্ধ মূল্যহারে এবং এবং এবং প্রাক-যুদ্ধ বুর্জোয়া পরিসংখ্যান অনুসারে পুঁজি রপ্তানি থেকে বছরে মিলত ৮০০ থেকে ১০০০ কোটি ফ্রাঙ্ক। এখন নিশ্চয় আরো অনেক বেশি।

নিশ্চিতভাবেই এমন বিপুল অতিমুনাফা (যেহেতু সেগুলো পুঁজিপতিরা “নিজ” দেশের শ্রমিকদের নিঙড়ে নেয়া মুনাফা থেকে এটা অতিরিক্ত) দ্বারা শ্রমিক নেতাদের ও শ্রমিক অভিজাততন্ত্রের উপরি স্তরকে ঘুষ দিয়ে কেনা সম্ভব। আর এটাই “অগ্রসর” দেশগুলির পুঁজিপতিরা করছেঃ তারা তাদেরকে ঘুষ দিচ্ছে হাজারো উপায়ে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, প্রকাশ্য বা গোপনে।

বুর্জোয়া বনে যাওয়া শ্রমিক অথবা ‘শ্রমিক আভিজাত্যের এই যে স্তরটি জীবনযাত্রার ধরনে, বেতনের পরিমানে এবং নিজেদের সমগ্র বিশ্ববীক্ষায় সম্পূর্ণ কূপমন্ডুক, এরাই হল দ্বিতীয় আন্তরজাতিকের প্রধান নির্ভরস্থল এবং আমাদের কালে বুর্জোয়াদের প্রধান সামাজিক (সামরিক নয়) নির্ভরস্থল। কারণ তারাই হল শ্রমিক আন্দোলনে বুর্জোয়াদের সত্যকার দালাল, পুঁজিপতি শ্রেণীর শ্রমিক লেফটেন্যান্ট, সংস্কারবাদ ও শোভিনিজমের প্রকৃত চালিকাশক্তি। সর্বহারা এবং বুর্জোয়াদের মধ্যে গৃহযুদ্ধে অনিবার্যভাবেই তারা যায় বুর্জোয়াদের পক্ষে — ‘কমিউনারদের’ বিরুদ্ধে ‘ভার্সাইপন্থীদের’ পক্ষে এবং কম সংখ্যায় নয়।

এই ঘটনার অর্থনৈতিক মূলগুলি না বুঝলে এবং এর রাজনৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্য অনুধাবন না করলে আন্দোলনের এবং আসন্ন সামাজিক বিপ্লবের ব্যবহারিক কর্তব্য সাধনের ক্ষেত্রে এক পাও এগুনো যাবেনা।”

(৩) তৃতীয় দলিল

এই দলিলটি হচ্ছে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ মাও সেতুঙ ও কেনেথ ডেভিড কাউন্ডার মধ্যে একটি আলোচনার মৌখিক রেকর্ডের অংশ; এটা চীনে “তিন বিশ্ব” সম্পর্কে মাও সেতুঙের দৃষ্টিভঙ্গী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিলঃ

“সভাপতি মাওসেতুঙ (এখানে মাও নামে পরে আসবে)ঃ আমরা আশা করি তৃতীয় বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হবে। তৃতীয় বিশ্বের রয়েছে এক বিরাট জনসংখ্যা!

সভাপতি কেনেথ কাউন্ডা (এখানে কাউন্ডা নামে পরে আসবে)ঃ ঠিক!

মাওঃ প্রথম বিশ্বে কারা পড়ে?

কাউন্ডাঃ আমার মনে হয় এটা দুনিয়ার শোষক ও সাম্রাজ্যবাদীরা হবে।

মাওঃ আর দ্বিতীয় বিশ্ব?

কাউন্ডাঃ যারা সংশোধনবাদীতে পরিণত হয়েছে।

মাওঃ আমার মতে মার্কিন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম বিশ্ব্। মধ্যবর্তী উপাদান যেমন জাপান, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা দ্বিতীয় বিশ্বে পড়ে। আমরা হচ্ছি তৃতীয় বিশ্ব।

কাউন্ডাঃ জনাব সভাপতি, আমি আপনার বিশ্লেষণের সাথে একমত।

মাওঃ মার্কিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের রয়েছে প্রচুর পারমাণবিক বোমা, আর তারা অধিকতর ধনী। দ্বিতীয় বিশ্বের ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া আর কানাডার অত বেশি পারমাণবিক বোমা নেই আর তারা প্রথম বিশ্বের মত অতটা ধনীও নয়, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের চেয়ে ধনী। আপনি এই বর্ণনা সম্পর্কে কী মনে করেন?

কাউন্ডাঃ জনাব সভাপতি, আপনার বিশ্লেষণ খুবই প্রাসঙ্গিক ও সঠিক।

মাওঃ আমরা এটা আলোচনা করতে পারি।

কাউন্ডাঃ আমার মনে হয় আমরা আলোচনা ছাড়াই ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারি, কারণ আমি বিশ্বাস করি এই বিশ্লেষণ ইতিমধ্যেই খুবই প্রাসঙ্গিক।

মাওঃ তৃতীয় বিশ্ব খুব জনবহুল।

কাউন্ডাঃ যথাযথ।

মাওঃ জাপান ছাড়া সকল এশীয় দেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত। সমগ্র আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকাও তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত।

(৪) চতুর্থ দলিল

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পুঁজিবাদপন্থী অংশের প্রধান দেঙ শিয়াওপিঙ ১০ এপ্রিল ১৯৭৪ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ্যে “তিন বিশ্ব” এর ধারণা তুলে ধরেন। এখানে তা হতে উদ্ধৃত করা হলঃ

“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে প্রথম বিশ্ব। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও অন্য অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশ নিয়ে তৃতীয় বিশ্ব। এই দুইয়ের মাঝের উন্নত দেশগুলি দ্বিতীয় বিশ্ব (…)।

অজস্র তথ্য দেখায় যে সকল মত যা দুই একাধিপত্যবাদী শক্তিকে অতিমূল্যায়ন করে আর জনগণের শক্তিকে খাটো করে দেখে সেসবই ভিত্তিহীন। একটা দুইটা পরাশক্তি সত্যকার অর্থে শক্তিশালী নয়; সতিকার শক্তিশালী হল তৃতীয় বিশ্ব আর এই যে সকল দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, সাহসের সাথে লড়াই করতে সাহসী হচ্ছে আর বিজয় অর্জন করতে সাহসী হচ্ছে।

যেহেতু বহু তৃতীয় বিশ্বের দেশ ও জনগণ দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, নিশ্চিতভাবে তারা এই ভিত্তিতে সক্ষম হবেন টিকে থাকার সামর্থযুক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে সেই আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন করতে যা অসমতা, নিয়ন্ত্রন ও শোষণের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে, এভাবে তাদের ঐক্যকে শক্তিশালী করে ও পরাশক্তির সাথে সংঘাতরত অন্যান্য দেশের সাথে মিত্রতাবদ্ধ হয়ে ও সেইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণসহ সারা দুনিয়ার জনগণের সাথে মিলে তাদের জাতীয় অর্থনীতির স্বাধীন বিকাশের আবশ্যকীয় শর্ত সৃষ্টি করবেন (…)।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি দাবি করে বর্তমান চরম অসম আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন আর তারা অনেক যৌক্তিক প্রস্তাব তুলে ধরেছেন সংস্কারের। চীনা সরকার ও জনগণ উষ্ণভাবে তার স্বীকৃতি দেয় আর সকল তৃতীয় বিশ্বের দেশের ন্যায্য প্রস্তাবনাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।”

(৫) পঞ্চম দলিল

মাও সেতুঙের লাল লাইন ও দেঙ শিয়াওপিঙ (অথবা লিন পিয়াও) এর কালো লাইনের পার্থক্য ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানীর মত দেশে উপলব্ধ হয়নি। তাই, এই দেশগুলিতে চীনা মতাবস্থানকে সামগ্রিকভাবে “সাম্রাজ্যবাদবিরোধী” হিসেবে দেখা হয়েছে, তৃতীয় বিশ্বকে বিশ্ব ইতিহাসের নয়া কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দেখে।

এই লাইন অনুসারে সাম্রাজ্যবাদী “মেট্রোপোল” বিপ্লবী দ্বন্দ্ব আর ধারণ করেনা; প্রকৃত বিপ্লবীদেরকে “তৃতীয় বিশ্ব”কে অনুসরণ করতে হবে। ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানীর ছাত্র আন্দোলনে এই মত খুবই শক্তিশালী ছিল; এই শেষটিতে এর উপর ভিত্তি কিরে এক সশস্ত্র সংগঠন পর্যন্ত গড়ে উঠে।

এখানে রেড আর্মি ফ্যাকশনের ধারণা পাওয়া যায়, ১ নভেম্বর ১৯৭২তে এক বিবৃতি থেকে, মিউনিখের গ্রীস্মকালীন অলিম্পিকের সময় ফিলিস্তিন সংগঠন “ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর” কর্তৃক এগার জন ইসরায়েলি দৌঁড়বিদ ও কর্মকর্তার অপহরণ ও হত্যার পরে যা প্রদত্ত।

“কাল সেপ্টেম্বর এর রণনীতি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী রণনীতি উভয়ত তৃতীয় বিশ্ব এবং মেট্রোপোলে বহুজতিক কর্পোরেশনগুলো কর্তৃক সৃষ্ট সাম্রাজ্যবাদী পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে (…)।

হামবুর্গে স্ট্রুভার কর্পোরেশনের উপর বোমা হামলা ছিল ইসরায়েলের সামরিক যোগানদাতাদের উপর আক্রমণ।

অলিম্পিক গ্রামে তাদের একশনসমেত তারা সাম্রাজ্যবাদী মেট্রোপোল ইসরায়েল আর পেরিফেরি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ে এসেছে এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে, তারা এফআরজি (পশ্চিম জার্মানী)র “সাংবিধানিক” মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে আর সাম্রাজ্যবাদের ছদ্মবেশের সত্যিকার বস্তুগত চরিত্র উন্মোচিত করেঃ এই যে তারা তৃতীয় বিশ্বের মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে আর তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে রণনৈতিক গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ (…)।

সুবিধাবাদের সমস্যা হচ্ছে এই যে এর ব্যবহার করে নেখট নিজের সম্পর্কে উন্মোচন করে, কিন্তু বিশ্ব সম্পর্কে কোন কিছুই না। ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করে বিপ্লবীরা তার পরিচয় ন্যস্ত করে এই জ্ঞানের উপর যে তৃতীয় বিশ্বের জনগণ হচ্ছে অগ্রবাহিনী, আর এই গ্রহণযোগ্যতা যে মেট্রোপোলে জনগণের সম্পর্কে লেনিনের “শ্রম অভিজাত” তত্ত্বকে কাটছাট বা বাতিল করা যায় না। বিপরীতে সবকিছুই সেখান থেকে যাত্রা করে।

মেট্রোপোলে জনগণের উপর যে শোষণ চলে তার সাথে মার্কসের মুজুরি শ্রমিকদের উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণ সংক্রান্ত তত্ত্বের কোনই সম্পর্কে নেই।

অধিক থেকে অধিকতর শ্রমবিভাগের সাথে এটা সত্য যে উৎপাদনের ক্ষেত্রে শোষণের প্রচণ্ড প্রাবল্য ও বিস্তার হয়েছে, আর কাজ হয়েছে আরো বড় বোঝা, উভয়ত শারিরীক ও মানসিকভাবে।

এটাও সত্য যে ৮ ঘন্টা শ্রমদিবসের সূচনার সাথে—যা হচ্ছে কাজের প্রাবল্য বৃদ্ধির শর্ত—জনগণের যা মুক্ত সময় ছিল তা ব্যবস্থা কুক্ষিগত করে নিয়েছে। কারখানার শারিরীক শোষণের সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের চিন্তাভাবনা, ইচ্ছা আকাঙ্খা ও ইউটোপীয় স্বপ্নকে শোষণ—কারখানার পুঁজিবাদী অত্যাচারের সাথে জীবনের সকল ক্ষেত্রের পুঁজিবাদী অত্যাচার যুক্ত হয়েছে, গণভোগ ও গণ মাধ্যমের মাধ্যমে।

৮ ঘন্টা কর্মদিবসের সূচনার সাথে, শ্রমিক শ্রেণীর উপর দিনের ২৪ ঘন্টা ব্যবস্থার আধিপত্য জয়যাত্রা শুরু করে—গণ ক্রয় ক্ষমতা আর “সর্বোচ্চ আয়” এর প্রতিষ্ঠার সাথে ব্যবস্থা তার জয়যাত্রা শুরু করে জনগণের পরিকল্পনা, আকাঙ্খা, বিকল্প, কল্পনা আর স্বতস্ফূর্ততার উপর; সংক্ষেপে, জনগণের নিজের উপর!

ব্যবস্থা মেট্রোপোলে জনগনকে টেনে আনতে সক্ষম অয়েছে নিজ ময়লার ভিতর এতটাই যে তারা নিজেদের পরিস্থিতির নিপীড়ক ও শোষণমূলক চরিত্র সম্পর্কে আর সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার শিকার হিসেবে তাদের পরিস্থিতি বোঝার শক্তি ব্যাপকভাবে হারিয়েছে মনে হয়। যাতে তারা একটা গাড়ি, একজোড়া জিন্স, জীবনবীমা আর একটা ঋণের জন্য সহজেই ব্যবস্থার পক্ষ হতে কোন চরম নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে পারে। বস্তুত তারা একটা গাড়ি, একটা অবকাশ আর একটা টাইল বাথরুমের বাইরে কোনকিছু চিন্তা বা আকাঙ্খা করতে আর পারেনা।

এথেকে দেখা যায়, বিপ্লবী হচ্ছে সেই যে এই জোয়াল ভেঙে মুক্ত হতে চায় আর এই ব্যবস্থার অপরাধে অংশ গ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে। যারা তৃতীয় বিশ্বের জনগণের মুক্তিসংগ্রামে তাদের পরিচয় খুঁজে পায়, যারা প্রত্যাখ্যান করে, যারা কোনভাবেই অংশ গ্রহণ করেনা; তারা সবাই বিপ্লবী—কমরেডগণ (…)।

যদি তৃতীয় বিশ্বের জনগণ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবের অগ্রপথিক হন, তাহলে এটা এই অর্থ করে যে তারা বস্তুগতভাবে মেট্রোপোলে জনগণের নিজ স্বাধীনতা অর্জনে সর্বাধিক আশার প্রতিনিধিত্ব করেন। যদি এই হয় ঘটনা, তাহলে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের জনগণের মুক্তি সংগ্রাম আর মেট্রোপোলে স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্খা যেখানেই তা উদ্ভূত হোক না কেন—এর মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা। অর্থাৎ গ্রেড স্কুল, উচ্চ বিদ্যালয়, কারখানা, পরিবার, কারাগার, দপ্তর, হাসপাতাল, সদর দপ্তর, রাজনৈতিক দল, ইউনিয়ন যেখানেই হোক।

আমরা ভোগবাদ, মিডিয়া, পারস্পরিক ব্যবস্থাপনা, সুবিধাবাদ, গোঁড়ামিবাদ, কর্তৃত্ব, পিতৃতন্ত্র, পাশবিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদসহ সেসবকিছুর বিরুদ্ধে যা খোলাখুলিভাবে নেতিকরন করে, দমন করে আর ধ্বংস করে এই সংযোগকে।

‘এর অর্থ আমরা!’ আমরা হচ্ছি বিপ্লবী জিনিস।”

যেই সংগ্রাম শুরু করে আর প্রতিরোধ করে সেই আমাদের একজন।”

(৬) ষষ্ঠ দলিল

গুরদুন এন্সলিন, পশ্চিম জার্মান লাল সৈন্যদলের সদস্য হিসেবে ১৯ জানুয়ারি ১৯৭৬তে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে একটা বিবৃতি দেন তার বিচারের সময়। তিনি আরএএফ এর মতাবস্থান তুলে ধরেনঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন হচ্ছে পরোক্ষ মিত্র আর একমাত্র শত্রু হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাই, মাওবাদী লাইনকে যেসব সংগঠন রক্ষা করে তারা ভ্রান্ত কারণ তারা মার্কিনকে সহায়তা করবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চাপে ফেলতে।

“আমরা পেরিফেরিতে মুক্তি ফ্রন্ট আর মেট্রোপোলে শ্রেণিসংগ্রামের বিকাশের মধ্যেকার ঐতিহাসিক বর্তমান দ্বান্দ্বিকতা পরিষ্কার করেছি যা হচ্ছে শ্রম ও পুঁজির মধ্যে পার্থক্যরেখা যা একটা ফ্রন্টে বিকশিত হয়েছে (…)।

রাজনৈতিক লাইনের জন্য ফেডারেল রিপাবলিকে মাওবাদী সম্প্রদায়গুলোকে ব্যবহার করা মানে হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রধান শত্রু বলা যা ন্যাটোকে শক্তিশালী করে, আর তা হচ্ছে বিষয়গতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল।

তাদের হাস্যকর সাম্যবাদবিরোধিতা বিকাশমান আমেরিকাবাদবিরোধিতাকে নিষ্ক্রিয় করায় সম্প্রসারিত হয় আর তা বাঁধাগ্রস্ত করে বিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে বিকাশমান শক্তিসম্পর্কের সচেতনতাকে, যে আন্তমহাদেশীয় প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে মেট্রোপোলে গেরিলারা লড়াই করে।

যতক্ষণ তাদের ধোঁয়াশা লাইন পিতৃভুমি রক্ষার উপরে স্থাপিত, তারা গণ বিদ্রোহবাদের এক জাত্যাভিমানী রকমকে প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে ন্যাটোকে শক্তিশালী করা, আর জার্মান ডেমোক্রাটিক রিপাবলিকে বেআইনি সংগ্রামের জন্যও সংগ্রাম করা, সিপিসি কর্তৃক তাদেরকে লেজুড়ে পরিণত করা ১৯২৯-৩৩ এর সংকটের তৃতীয় আন্তর্জাতিকের পার্টিসমূহের বিয়োগান্তক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় একটা প্রহসন হিসেবে।

অনেক আগে তারা ক্ষেত্রকে ত্যাগ করেছে যাতে একটা ফ্যাসিবিরোধী ফেডারেল রিপাবলিকের প্রকৃত শক্তিমত্তা নিহিত, আর তা হচ্ছে প্রতিরোধঃ যে ধরণের আত্মরক্ষা তারা সংগঠিত করতে চায় তা স্রেফ পরাজয় কামনা করেনা বরং সে পরাজয় গ্রহণ করে নেয় সংগ্রাম শুরুর আগেই।”

৭) সপ্তম দলিল

মাও সেতুঙ মারা যাওয়ার সাথে সাথেই আনোয়ার হোজা আর আলবেনিয়ার লেবার পার্টি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে আর তাকে প্রতিবিপ্লবী হিসেবে নিন্দা জানায়। একটা প্রধান যুক্তি ছিল “তিন বিশ্ব” এর প্রশ্ন, যেমন এখানে ১৯৭৮ এ চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সিসির প্রতি আলবেনিয়ার লেবার পার্টির সিসির চিঠির অংশবিশেষ।

“মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে মিলন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে ঐক্যবদ্ধতার পর, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব “তিন বিশ্ব” এর মার্কসবাদবিরোধী ও প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব ঘোষণা করে যা সে বিপ্লবের রণনীতি হিসেবে উপস্থাপন করে, মার্কসবাদী লেনিনবাদী কমিউনিস্ট আন্দোলন আর সারা দুনিয়ার জনগণের উপর আরোপ করার প্রচেষ্টা চালায় তাদের সংগ্রামের একটা সাধারণ লাইন হিসেবে (…)।

বর্তমানে পরাশক্তি হওয়ার চীনা পরিকল্পনা তার কুখ্যাত “তিন বিশ্ব” তত্ত্বে আকৃতি লাভ করেছে। “তিন বিশ্ব” তত্ত্ব মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে সুবিধাবাদী, সংশোধনবাদী ও নৈরাজ্যবাদী সিন্ডিক্যালিস্ট ভাবধারা ও থিসিসের দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে চায়, এটা সর্বহারার বিপ্লবী ভাবমানস ও তার শ্রেণীসংগ্রামকে নির্জীব করে দিতে চায় বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে একটা ঐক্যজোটের কথা বলে।

বিপ্লবের জন্য সময় পরিপক্ক হয়নি এই কথা বলে “তিন বিশ্ব” তত্ত্ব ক্ষমতাসীনদের টিকিয়ে রাখতে চায়, বর্তমান পুঁজিবাদী, উপনিবেশবাদী ও নয়া ঔপনিবেশিক নিপীড়ণ ও শোষণকে টিকিয়ে রাখতে চায়।

সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ থেকে জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার অসিলায়—যাকে তারা একমাত্র বিপদ ও হুমকি মনে করে, চীনের দরকার হচ্ছে জনগণ যেন জাতীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির তাদের সংগ্রাম পরিত্যাগ করে, যাতে তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ও সাবেক উপনিবেশবাদী পশ্চিমের পুঁজিবাদী শক্তির অধীনস্ত হয়।

সে সাধারণ বাজার ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শক্তিশালী করার উপর জোর দেয় যা হছে ইউরোপে সর্বহারা শ্রেনীকে পুঁজিবাদী জোয়ালে বেঁধে রাখা আর অন্যান্য দেশের জনগণকে নিপীড়ণ ও শোষণ করা। পরাশক্তিদের অস্ত্র প্রতিযোগিতার উন্মাদনা সৃষ্টি করে আর ন্যাটো হিসেবে মার্কিন আর অন্য সামরিক ব্লকগুলির যুদ্ধযন্ত্রের উপর নির্ভর করে “তৃতীয় বিশ্ব” তত্ত্ব সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধকে উস্কে দেয়।

“তিন বিশ্ব” তত্ত্ব হচ্ছে যাকে তারা “তৃতীয় বিশ্ব”(…) বলে তার উপর একাধিপত্য চালানোর চীনের আকাঙ্খার ধোঁয়া। “তিন বিশ্ব” তত্ত্বের প্রয়োগ চালিত করে চীনা নেতৃত্বকে এমনকি “শয়তান” এর সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ইউরোপের একচেটিয়াবাদীদের সাথ ঐক্যবদ্ধ হতে, ফ্যাসিবাদী ও বর্নবাদীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে, রাজা ও জমিদারদের সাথে আর সর্বাধিক দুষ্ট সমরবাদী ও যুদ্ধবাজদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে।

পিনোচেট ও ফ্রাঙ্কো, ওয়েরমেখতের সাবেক নাৎসী জেনারেলদের সাথে, জাপানী সাম্রাজ্যবাদী বাহিনী, যেমন মবুতু ও রক্তপিপাসু রাজাদের মত ছদ্মবেশী অপরাধীরা, মার্কিন প্রভুরা ও বহুজাতিক কোম্পানীসমূহের সভাপতিরা তার মিত্রে পরিণত হয়। এই মার্কসবাদবিরোধী লাইন চীনের নেতৃত্বকে টিটো, কারিয়ো ও অন্যান্য সংশোধনবাদীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিকে চালিত করে। একসময় সে টিটোর বিরোধী ছিল, আর এখন সে তার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এটা মার্কসবাদী লেনিনবাদী নীতিমালার উপর এর ঘাটতি আর তার লাইনের ভিন্নতা প্রমাণ করে।”

(৮) অষ্টম দলিল

তুরস্কে টিকেপি/এমএল মনে করেছিল যে, যেহেতু “তিন বিশ্ব” তত্ত্ব দেঙ শিয়াওপিঙ তুলে ধরেছে, মাও সেতুঙ কর্তৃক এর অন্য কোন বর্ণনা থাকতে পারেনা। মাও সেতুঙের মৃত্যুর তৃতীয় বার্ষিকীতে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯তে প্রকাশিত এক দলিলের অংশবিশেষে এখানে টিকেপি/এমএল এর অবস্থান পাওয়া যায়।

“বর্তমানে, মাও সেতুঙের বিরুদ্ধে আক্রমণ কেবল শাসক শ্রেণীসমূহের দ্বারাই হচ্ছেনা। আন্তর্জাতিকভাবে আলোচ্যসুচিতে এটা নিয়ে আসা হয়েছে যে মাও সেতুঙ একজন প্রকৃত কমিউনিস্ট ছিলেন কিনা।

এটা আলবেনিয়ায় জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে নেতৃত্বকারী পিএলএ (আলবেনিয়ার লেবার পার্টি) কর্তৃক সূচিত হয়েছে যে কিনা সমাজতন্ত্র বিনির্মানে আলবেনিয়ার সর্বহারা শ্রেণীকে পথ দেখিয়েছে আর সিপিসির সাথে মিলে ক্রুশ্চভীয় আধুনিক সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে আর আমরা এখনো তাকে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মনে করি।

পিএলএ দায়িত্বহীনভাবে মাও সেতুঙ ও তার নেতৃত্বে সিপিসির সংগ্রামকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদবিরোধী ও প্রতিবিপ্লবী ঘোষণা করেছে। সে দাবি করেছে যে প্রতিবিপ্লবী “তিন বিশ্ব” তত্ত্বের জন্য মাও দায়ী আর বিশ্বাসঘাতক তেঙ-হুয়া চক্র মাও সেতুঙের লাইনকে অব্যাহত রেখেছে।

পিএলএর এই ভয়ংকর ভুল সারা দুনিয়ার সকল রূপের সুবিধাবাদী ও সংশোধনবাদীদের আনন্দিত করেছে আর সর্বহারা নেতৃত্বের বিপ্লবের উপর ধ্বংসাত্মক হামলা চালানোর জন্য শক্তির এক উৎসে পরিণত হয়েছে।

(৯) নবম দলিল

পেরুতে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি বিষয়গুলিকে খুবই ভিন্নভাবে উপলব্ধি করেঃ মাও সেতুঙ “তিন বিশ্ব” এর ধারণাকে ব্যবহার করেন, কিন্তু এমনভাবে যা দেঙ শিয়াওপিঙ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯৮৮তে প্রকাশিত পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির “আন্তর্জাতিক লাইন”-এ যা বলা হয়েছে তা থেকে এখানে উদ্ধৃত হল।

বর্তমান পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিশ্ববিপ্লবের রণনৈতিক আক্রমণে প্রবেশ করেছি, আমরা “৫০ থেকে ১০০ বছর”-এর মধ্যে যাতে সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বপ্রতিক্রিয়াসমেত ডুবে যাবে আর আমরা সেই স্তরে প্রবেশ করবো যেখানে সর্বহারা শ্রেণী দৃঢ়ভাবে ক্ষমতায় স্থাপিত হয় ও তার সর্বহারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

সেখান থেকে সামনের দিকে দ্বন্দ্ব হবে কমিউনিজমের পথের দিকে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনে পুনপ্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণীর বিকাশের শক্তিশালি ধারাকে নেতিকরণ করেনা, বরং দেখায় যে পুনপ্রতিষ্ঠা ও পাল্টাপুনপ্রতিষ্ঠার মধ্যে সংগ্রাম কত মারাত্মক যেখান থেকে কমিউনিস্টগণ শিক্ষা নেন পুঁজিবাদের পুনপ্রতিষ্ঠাকে প্রতিরোধ করতে এবং নিশ্চিতভাবে সর্বহারাশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে।

আমরা সভাপতি মাও সেতুঙের এই থিসিসকে পুননিশ্চিত করি যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সংগ্রামের একটা পর্যায়কাল শুরু হয়েছে; তাই যারা গণতান্ত্রিক বিপ্লব অথবা সমাজাতান্ত্রিক বিপ্লব করেন সেইসাথে যারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করেন তাদের জন্য বিশ্ব পরিসরে দুই প্রধান শত্রু মূর্ত হয় এবং তাদের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ হচ্ছে যে প্রতিটি আন্দোলন তার প্রধান শত্রু নির্দিষ্ট করে এবং অন্য পরাশক্তিসমূহের অথবা অন্য শক্তিসমূহের আধিপত্যকে মোকাবেলা করতে চায়। পেরুতে, বড় বুর্জোয়া ও ভুস্বামীদের সাথে আঁতাত করে মার্কিন (ইয়াংকি) সাম্রাজ্যবাদ আমাদের উপর আধিপত্য করে।

তথাপি, বিশ্বপরিসরে বিশ্ব একাধিপত্যের জন্য দুই পরাশক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমরা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করি, কিন্তু সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ অথবা অন্য কোন শক্তির আধিপত্য দ্বারা এর প্রতিস্থাপন অনুমোদন করতে পারিনা।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ আগ্রাসন রয়েছে যা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, চীন ও সেইসাথে অন্য পাশ্চাত্য শক্তির সাথে একাধিপত্যের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতারত এবং সেখানে প্রধান শত্রু হিসেবে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সংগ্রাম চালাতে হবে আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অথবা অন্য কোন শক্তির আধিপত্যের অনুপ্রবেশ অনুমোদন করা যাবেনা। সমস্যা হচ্ছে সংগ্রাম সঠিকভাবে বিকশিত করা হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা কমিউনিস্ট পার্টির অভাবে।

সংশ্লেষণে, দুই পরাশক্তি রয়েছে যারা হচ্ছে প্রধান শত্রু যার মধ্যে একটা হচ্ছে প্রতি ক্ষেত্রে প্রধান এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের তৎপরতাকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারিনা।

তিন বিশ্ব পৃথকীকৃত হয়ঃ সভাপতি মাওয়ের এঈ থিসিসকে আমরা ন্যায্য এবং সঠিক মনে করি এবং এই যে এটা শ্রেণী ও দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ ভিত্তিক লেনিনের বিশ্বে শক্তিসমূহের বন্টনসংক্রান্ত থিসিসের সাথে যুক্ত। আমরা তেঙ শিয়াও-পিং এর সুবিধাবাদী ও সংশোধনবাদী তিনবিশ্বের ভ্রান্ত প্রতিনিধিত্বকে প্রত্যাখ্যান করি যা বিপ্লবের সাথে বেঈমানী করার লক্ষ্যে মার্কিন অথবা সোভিয়েত ইউনিয়নের লেজুড়বৃত্তি করে। এথেকে যাত্রা করে, সভাপতি গনসালো বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করেন যাতে তিনবিশ্ব পৃথকীকৃত হয় এবং আরো প্রদর্শন করে যে এটা একটা বাস্তবতা।

প্রথম বিশ্ব হচ্ছে দুই পরাশক্তি মার্কিন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যারা বিশ্বে একাধিপত্যের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতারত এবং যা একটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জন্ম দিতে পারে। তারা হচ্ছে পরাশক্তি কারণ তারা অন্য শক্তিসমূহের চাইতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে অধিকতর শক্তিধর। মার্কিনের রয়েছে অ-রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া সম্পত্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতি, অধিকারের ওপর বেড়ে চলা বিধি-নিষেধসহকারে রাজনৈতিকভাবে এটা এক বুর্জোয়া গণতন্ত্র বিকশিত করে। এটা একটা প্রতিক্রিয়াশীল উদারতাবাদ; সামরিকভাবে পাশ্চাত্যে এটা সবচেয়ে শক্তিধর এবং এর বিকাশের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া রয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন রাজনৈতিকভাবে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়ার ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বসমেত অর্থনৈতিকভাবে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়াভিত্তিক এবং এটা একটা উচ্চপর্যায়ের সামরিক শক্তি যদিও এর বিকাশের প্রক্রিয়া সংক্ষিপ্ত। মার্কিন তার আধিপত্যকে বজায় রাখতে চায় এবং তা সম্প্রসারণও করতে চায়। সোভিয়েতের লক্ষ্য সম্প্রসারণের দিকে বেশি কারণ সে একটা নতুন পরাশক্তি এবং অর্থনৈতিকভাবে তার ইউরোপের ওপর আধিপত্যের স্বার্থ রয়েছে নিজ পরিস্থিতি উন্নত করার লক্ষ্যে। সংশ্লেষণে, তারা দুই পরাশক্তি যারা কোন ব্লক গঠণ করেনা কিন্তু দ্বন্দ্ব রয়েছে, পরিস্কার পারস্পরিক পার্থক্য রয়েছে এবং দুনিয়াকে পুনবিভাজনের জন্য তারা ঘোঁট পাঁকানো ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে আগায়।

দ্বিতীয় বিশ্ব হচ্ছে সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ যারা পরাশক্তি নয় কিন্তু ক্ষুদ্রতর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি যথা-জাপান, জার্মানী, ফ্রান্স, ইতালী প্রভৃতি যাদের পরাশক্তির সাথে দ্বন্দ্ব রয়েছে কারণ তারা ডলারের অবমূল্যায়ণ, সামরিক বিধি-নিষেধ এবং রাজনৈতিক আরোপ বজায় রাখে; এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ পরাশক্তিসমূহের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নিতে চায় নিজেদের নয়া পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত করতে যেহেতু তারাও নিপীড়িত জাতিসূহের বিরুদ্ধে আগ্রাসী যুদ্ধ চালায় এবং অধিকন্তু তাদের মধ্যে তীক্ষ্ণ দ্বন্দ্ব বিরাজমান।

তৃতীয় বিশ্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত দেশগুলিকে নিয়ে গঠিত। তারা হচ্ছে উপনিবেশ অথবা আধাউপনিবেশ যেখানে সামন্তবাদ ধ্বংস হয়নি ও সেই ভিত্তিতে এক আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ গড়ে ওঠে। তারা একটা পরাশক্তি অথবা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে বাঁধা। সাম্রাজ্যবাদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব রয়েছে, অধিকন্তু তারা তাদের নিজ বড় বুর্জোয়া ও সামন্তদের সাথে লড়ে যারা উভয়ই সাম্রাজ্যবাদের সাথে বিশেষত পরাশক্তির সেবায় ও তাদের সাথে আাঁতাতে আবদ্ধ।

এসবই আমাদের ভিত্তি দেয় যার ওপর কমিউনিস্টরা বিশ্ববিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল প্রতিষ্ঠা করতে পারে। চেয়ারম্যান মাও সেতুঙ বিশ্ববিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়েছিলেন, কিন্তু চীনা সংশোধনবাদীরা তা ধামাচাপা দিয়েছে। তাই, তার নিজ ধারণা থেকে বের করে আনার কাজ আমাদের ওপর বর্তায়, বিশেষত যদি নতুন পরিস্থিতি দৃশ্যমান হয়।

আমাদের পার্টি এই মত পোষন করে যে বর্তমান বিশ্বে তিনটি মৌলিক দ্বন্দ্ব রয়েছেঃ

১। একদিকে পরাশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ অপরদিকে এদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জাতিসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এখানে তিন বিশ্বের থিসিস মূর্ত হয় এবং আমরা একে সূত্রায়িত করি এইভাবে কারণ দ্বন্দ্বের শাঁস রয়েছে পরাশক্তির মধ্যে নিহিত কিন্তু এটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের সাথেও দ্বন্দ্ব।

এটাই হচ্ছে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং এর সমাধান হচ্ছে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিকাশ ও বিজয়।

২। সর্বহারাশ্রেণী ও বুর্জোয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব—যার সমাধান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

৩। পরাশক্তিসমূহের নিজেদের মধ্যে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব, পরাশক্তিসমূহ এবং ক্ষুদ্রতর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং চুড়ান্ততঃ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, যা বিশ্বে একাধিপত্যের জন্য যুদ্ধের দিকে চালিত করে এবং লুন্ঠনের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের দিকে, যাকে সর্বহারা শ্রেণী অবশ্যই গণযুদ্ধের দ্বারা এবং পরিণামে বিশ্ব গণযুদ্ধের দ্বারা অবশ্যই বিরোধিতা করবে।

আমরা সমাজতন্ত্র-পুঁজিবাদ দ্বন্দ্বকে তালিকাবদ্ধ করিনি কারন এটা কেবল মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক স্তরে বিরাজ করছে, যেহেতু সমাজতন্ত্র কোথাও রাষ্ট্র হিসেবে বিরাজ করছেনা; আজকে কোন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নেই। এটা অস্তিত্বমান ছিল এবং আজকে অস্তিত্বমান বলাটা হচ্ছে অন্তঃসারে এটা দাবী করা যে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক, যা হচ্ছে সংশোধনবাদী মতাবস্থান।। Š

fiveheadcolorred