সিরাজ সিকদার রচনাঃ ১৬ই জুনের ঐতিহাসিক হরতালের রিপোর্ট (সেপ্টেম্বর ১৯৭৪) [স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত]

সিরাজ সিকদার রচনা

১৬ই জুনের ঐতিহাসিক হরতালের রিপোর্ট

(সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

[স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত]

 sikder

১৬ই জুন অর্ধদিবস হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত কর্মী, সহানুভূতিশীলদের ব্যাপক সাড়া লাভ করে।

প্রতি অঞ্চলের কর্মীরা হরতালের বিষয় চিকা, পোস্টার, লিফলেট, সশস্ত্র, নিরস্ত্র মিছিলের পদক্ষেপ নেয়।

বরিশালে এরূপ একটি মিছিলের সময় প্রতিমন্ত্রী মঞ্জুর মটর আটকা পড়ে।

পোস্টার তুলে ফেলা, দেয়াল লিখন মুছে ফেলার জন্য সরকার পুলিশদের ব্যবহার করে। কোথাও কোথাও আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনী এ কাজ করে।

হরতালের জন্যও সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনা, রাস্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বানচালের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

ঢাকাসহ প্রায় জেলায়ই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন এবং মস্কোপন্থীদের বিভিন্ন অফিসে গেরিলারা বীরত্বের সাথে হাতবোমা, মলোটভ ককটেল নিক্ষেপ করে।

ঢাকায় মীরপুর তিতাস গ্যাস স্টেশন উড়িয়ে দেওয়া হয়, রেলওয়ে স্টেশনে হামলা চালানো হয়। শ্রীমতি এবং অন্যান্য অশ্লীল পত্রিকা এবং প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকা অফিসে বোমাবর্ষণ করা হয়।

ভারতীয় বিমান অফিস বোমা বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ পূর্ববাংলার প্রায় জেলায় এই তৎপরতা চলে।

১৫ই জুন রাতে বরিশাল ঝালকাঠি রোড কেটে ফেলা হয় এবং টেলিফোন লাইন উপড়ে ফেলা হয়।

ফরিদপুরে একস্থানে রাস্তা কাটতে যেয়ে সেনাবাহিনীর সাথে গুলি বিনিময় হয়। প্রায় আড়াই ঘন্টা সেনাবাহিনী এলোপাথাড়ী গুলি বর্ষণ করে পলায়ন করে।

১৫ই জুন রাতে খুলনা-যশোরে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করা হয়।

যশোর-খুলনায় হক-তোয়াহা এবং অন্যান্যদের সাথে যুক্ত আন্তরিক বিপ্লবীরা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন।

ঐদিন ময়মনসিংহে একটি রেলস্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।

জয়দেবপুরের রেললাইনেরও ক্ষতিসাধন করা হয়। ফলে রেল যোগাযোগ বহুক্ষণ বিচ্ছিন্ন ছিল।

ঐদিন কয়েকটি তহশিল অফিস ধ্বংস করা হয়।

১৬ই জুন হরতাল বানচাল করার জন্য বরিশালে কয়েকশত রিক্সাচালককে রাতে থানায় আটকে রাখা হয়।

পরদিন তাদেরকে রিক্সাসহ শহরে পাঠানো হয়।

কিন্তু রিক্সা চালকগণ রিক্সা নিয়ে বাড়ী চলে যায় বা চাকার পাম্প ছেড়ে বসে থাকে।

বরিশালে ১৬ই জুন শত সহস্র লোক রাস্তায় বেরিয়ে আসে এবং রক্ষীদের বিরুদ্ধে কর্মতৎপর গেরিলাদের বোমার শব্দে হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে।

রক্ষীরা শহরে দোকানপাট খোলার চেষ্টা করে, কিন্তু তারা সকলেই তা বন্ধ করে রাখে।

গেরিলাদের তৎপরতার মুখে শেষ পর্যন্ত রক্ষীরা ভয়ে ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তারা সেদিন আর ক্যাম্প থেকে বেরোয়নি।

বরিশালে পূর্ণাঙ্গ হরতাল পালিত হয়।

পার্বত্য চট্রগ্রামে হরতালের প্রচারের কারণে ভি ভি গিরির চন্দ্রঘোনা কাগজকল পরিদর্শন বাতিল হয়। সে কাপ্তাই রাস্তা দিয়ে না যেয়ে হেলিকপ্টারে যেতে বাধ্য হয়।

ফরিদপুর, রাজশাহী, ঝালকাঠি, খুলনা, যশোর, সুনামগঞ্জে পূর্ণাঙ্গ এবং আংশিকভাবে পূর্ববাংলার বহু জেলায়ই হরতাল পালিত হয়।

এ ছাড়া বিস্তীর্ণ গ্রামঞ্চলে বহু হাটবাজার বন্ধ থাকে।

১৬ই জুনের হরতালের সাফল্যজনক বাস্তবায়নে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির পক্ষে বিরাট প্রচার হয়েছে।

‘বাংলাদেশের’ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং বিদেশের প্রচারমাধ্যম আমাদের তৎপরতা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়।

১৬ই জুনের হরতাল ভিভি গিরির ঢাকা উপস্থিতির একটি বলিষ্ঠ প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করে; এ কারণে হরতাল বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে।

১৬ই জুনের হরতাল বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ পরিচালনার জন্য বিরাট সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

ভাসানী ন্যাপের নেতৃত্বে ছয় পার্টির ঐক্যফ্রন্টের ৩০শে জুনের কর্মসূচীর ব্যর্থতা এবং তাদের ডাকা ৫ই জুলাই হরতালের ব্যর্থতা একক বিরোধী শক্তি হিসেবে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিকে দাঁড় করিয়েছে।

এভাবে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে যে শুন্যতা বিরাজ করছিল তা পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি পুরণ করছে।

হক-তোয়াহা-মতিনদের সাথে যুক্ত বহু কর্মীই স্বতস্ফূর্তভাবে আমাদেরকে সহায়তা করে।

তারা ১৬ই জুনের হরতালকে বিরাট অগ্রগতি বলে আখ্যায়িত করে।

বিভিন্ন গণতন্ত্রীমনা বিরোধী শক্তিও ১৬ই জুনকে আমাদের বিরাট অগ্রগতি বলে স্বীকার করে।