সিরাজ সিকদার রচনাঃ পার্বত্য চট্রগ্রামের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ (সেপ্টেম্বর ১৯৭৪) [স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত]

সিরাজ সিকদার রচনা

পার্বত্য চট্রগ্রামের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের

প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ

(সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

 

[স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত]

 sikder

[যেমনটা সভাপতি সিরাজ সিকদার ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, পার্বত্য চট্রগ্রামের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলন ৯০ দশকের শেষের দিকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করে। বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলির বাংলাদেশে অবস্থানরত নেতা-কর্মীদের ভারতের কাছে ধরিয়ে দিয়ে ঐ আন্দোলনগুলিকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দেয়। অন্যদিকে সিরাজ সিকদারের সময়ে পার্বত্য চট্রগ্রামে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির মুক্ত এলাকা গড়ে উঠলেও, তাঁর মৃত্যু পরবর্তীকালে ভ্রান্ত লাইনসমূহ কারণে কাজ বিপর্যস্ত হয়ে যায় — সর্বহারা পথ]

সামন্ত ক্ষুদে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে চট্রগ্রামের চাকমা জাতিসত্তার মধ্যে একটি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলে আসছে। তারা শোষক ও শোষিত বাঙালীদের কোন পার্থক্য রেখা টানে না, সকলবাঙালীকেই শত্রুমনে করে।

তাদের মুক্তির জন্য বাঙালীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে তারা বিরোধিতা করে।

তারা পাহাড়ী জাতিসত্তার শোষক-শোষিতের মধ্যকার কোন পার্থক্য করে না।

তারা পার্বত্য চট্রগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার জন্য স্বায়ত্বশাসনের প্রতিশ্রুতি না দিয়ে পার্বত্য চট্রগ্রামের স্বায়ত্তশাসন, কখনো কখনো বিচ্ছিন্নতা দাবী করে।

এ দাবীর অর্থ হচ্ছে কিছুটা ক্ষুদে বুর্জোয়া আলোকপ্রাপ্ত সংখ্যাধিক চাকমা জাতিসত্তার ক্ষমতা দখল এবং অন্যান্য জাতিসত্তার উপর তাদের কর্তৃত্ব ও নিপীড়ন।

চাকমা জাতিসত্তার এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীরা মার্কসবাদের কথাও কখনো কখনো বলে, কেউ কেউ নিজেদেরকে মার্কসবাদী দাবী করে।

কিন্তু মার্কসবাদের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য আন্তর্জাতিকতাবাদ ‘বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী এক হও’,একটি দেশের ভৌগলিক সীমার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর একটিই রাজনৈতিক পার্টি-কমিউনিস্ট পার্টিহতে পারে, জাতিয়তাভিত্তিক কমিউনিস্টরা বিভক্ত হতে পারে না, জাতীয় সমস্যা হচ্ছে মূলতঃ শ্রেণী সমস্যা, ইত্যাদি তারা স্বীকার করে না।

এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী,সামরিক, সাংগঠনিক ও বাস্তব কাজের লাইন নেই।

পাক বাহিনীর পরিত্যাক্ত অস্ত্র, প্রাক্তন রাজাকার, সামন্ত বুদ্ধিজীবী, EPCAF [East Pakistan Civil Armed Force— সর্বহারা পথ] দ্বারা তারা একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়েছে।

এর সাহায্যে তারা গ্রাম থেকে জোর পূর্বক অর্থ সংগ্রহ, কোথাও কোথাও ডাকাত দমন, ডাকাতি করা, সামন্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের রক্ষা ইত্যাদি কাজ করে।

পার্বত্য চট্রগ্রামে কিছু দিন পূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা বন্দুক দেখিয়ে জনগণকে তাদের প্রতিনিধিদেরভোটদানে বাধ্য করে। এদের সংগঠন হচ্ছে “জনসংহতি” ও P.L.A বা (শান্তি বাহিনী); কোথাও তার “জংলী” নামে পরিচিত।

সরকার বিরোধী তাদের কোন তৎপরতা নেই।

তাদের উপর জনগণের আস্থা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

পক্ষান্তরে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির কাজ দ্রুত পার্বত্য চট্রগ্রামে বিকাশ লাভ করছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি নিপীড়িত বাঙালী-পাহাড়ীদের ঐক্যের পক্ষপাতী এবং পাহাড়ী–বাঙালীদেরসম অধিকার, পাহাড়ী জাতিসত্তাসমূহের প্রত্যেকের জন্য স্বায়ত্বশাসনের পক্ষপাতী।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি পাহাড়ী জনগণকে সংগঠিত করা এবং তাদের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও তার পাহাড়ী তাবেদেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছে।

বিশেষ করে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি পাহাড়ী জুমিয়া চাষী এবং শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির কাজ দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। ১৯৭৩ সালে চন্দ্রঘোনা থানা দখল, এ বছর পারোয়া ফাঁড়ি দখল, ঝুমিয়া কৃষকদের রিজার্ভ ফরেস্টে ঝুম কাটার আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমে সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে পাহাড়ী জনগণের সংগ্রাম এগিয়ে চলেছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে সংগ্রাম ব্যাপক পাহাড়ী জনগণ ও পাহাড়ী বুদ্ধিজীবীদের সহানুভূতি ও আস্থা অর্জন করেছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি জনসংহতি, P.L.A প্রভৃতিদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য বারংবার প্রস্তাব দেয় এবং প্রচেষ্টা চালায়।

মানবেন্দ্র লারমার সাথেও আলাপ হয়।

কিন্তু তারা তাদের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীআঁকড়ে থাকে, নিপীড়িত পাহাড়ী-বাঙালীঐক্যের পক্ষে তারা সাড়া দেয়নি।

সম্প্রতি তারা পার্বত্য চট্রগ্রামে আমাদের দ্রুত বিকাশে শংকিত হয়ে কিছুসংখ্যক কর্মীকে আটক করে,তাদের উপর নির্যাতন চালায়, সর্বহারা পার্টি করতে পারবে না বলে কারো কারো আত্মী-স্বজনেরনিকট থেকে বন্দুকের মুখে বন্ড নেয়। তারা আমাদের অন্যান্য এলাকাস্থ কর্মীদের আক্রমণ ও হত্যাকরার হুমকি দিচ্ছে। সর্বহারা পার্টির কর্মী ও বাঙালী পেলেই তারা খতম করবে এ ধরনের কথা প্রচারকরে।

এ সকল ঘটনা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

এরা যদি গণতন্ত্রীমনা বুর্জোয়াও হতো তবে দলমত নির্বেশেষে রাজনৈতিক কাজের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করে আমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতো না।

কিন্তু এরা একদলীয় নায়কত্ব, মাতব্বরী ও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের চরিত্রের সাথে আমাদের দেশের এবং অন্যান্য দেশের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদেরকোন পার্থক্য আছে কি?

আওয়ামীলীগ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা বাঙালী বিহারীদেরমধ্যকার শোষক-শোষিতের কোন পার্থক্য করেনি, সকল বিহারীকে শত্রুমনে করেছে। অন্যান্যদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব কায়েম করেছে।

এরা শেষ পর্যন্ত ভারতের কাছে নিজেদের দাসখত লিখে দিয়েছে। পাহাড়ী জাতিসত্তার মুক্তি(…)।

একইভাবে ভারতের নাগা-মিজো প্রভৃতি জাতিসত্তার মধ্যকার সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী অংশ প্রতিক্রিয়াশীলদের নিকট আত্মসমর্পণ করে তাদের পুতুল হিসেবে কাজ করছে।

কাজেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীরা আজ হোক কাল হোক জাতীয় নিপীড়ণকারীদের নিকট আত্মসমর্পণ করে, জনগণের মুক্তি আনতে পারে না।

পার্বত্য চট্রগ্রামে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপের গতিধারা প্রমাণ করছে তারা পার্বত্য চট্রগ্রামের জাতিসত্তাসমূহের মুক্তি আনতে পারে না, উপরন্তু তারা আমাদের আক্রমণ করে আওয়ামী লীগ বিশ্বাসঘাতক ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করছে। হয়তারা ইতিমধ্যেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও আওয়ামীলীগের সাথে হাত মিলিয়েছে বা অদূর ভবিষ্যতেতারা হাত মিলাবে।

আমাদের আক্রমণ তাদের পতনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

অস্ত্রের জোরে তারা পাহাড়ী জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না, বাঙালী-পাহাড়ী ঐক্যে তারা ফাটল ধরাতে পারবে না। বরঞ্চ অচিরেই তারা নিজেরাই উৎখাত হবে, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।