সিরাজ সিকদার রচনাঃ প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির একাদশ অধিবেশনের ইশতেহার

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার



পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ প্রথমার্ধ ১৯৭৪

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪


পিডিএফ

১। শত্রুর আত্মসমর্পণ ও জনগণের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ সংক্রান্তঃ

শত্রু সংক্রান্তঃ

নিম্নলিখিত শর্তসমুহ পালন করলে শত্রুর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করা যায়।

১। আমাদের বিরুদ্ধে তৎপরতা (প্রকাশ্য/গোপনে) চালানো থেকে বিরত থাকবে।

২। জনগণের চরম ঘৃণার সৃষ্টি হতে পারে এইরূপ কাজ থেকে বিরত থাকবে।

৩। শত্রুর তৎপরতা সম্পর্কে নিয়মিত খবর সরবরাহ করবে।

৪। আমাদেরকে নিয়মিত চাঁদা ও অন্যান্য সাহায্য দেবে।

৫। তার আওতাধীন অস্ত্র-শস্ত্র জমা দেবে।

৬। ব্যাপক হারে শত্রুদের আত্মসমর্পণ করানো উচিৎ, যাতে শত্রু কমানো যায়।

৭। শত্রুর মধ্যকার দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে এবং শত্রুর সহায়তায় অপর শত্রুকে উৎখাত করা যায়।

জনগণ সংক্রান্তঃ

১। জনগণ সাধ্য অনুযায়ী চাঁদা প্রদান করবে।

২। প্রতি গ্রামের প্রতি পরিবার থেকে চাঁদা সংগ্রহ করতে হবে।

৩। ভারতে গমনেচ্ছুক জনগণকে না যেতে আহবান জানানো। গমনেচ্ছুক শত্রুশ্রেণীভূক্তদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্রাপ্ত করা।

২। সামরিকঃ

জাতীয় শত্রুদের খতম ও সশস্ত্র প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে গেরিলাদের ট্রেইন করতে হবে।

গেরিলাদের সামরিক সংগঠনভূক্ত করতে হবে।

ডাকাত নির্মূল এবং সামাজিক দুর্নীতি ও প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি বিরোধী (সংস্কৃতি হেডিং দ্রষ্টব্য) তৎপরতা পরিচালনা করে ব্যাপক জনগণকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসতে হবে।

সাদা পোষাকধারী গোয়েন্দা ও রক্ষীদের তৎপরতা প্রতিহত করতে হবে।

৩। পার্টি কেডার সংক্রান্তঃ

কর্মী, গেরিলা বা সহানুভূতিশীলদের মধ্যে ভাড়াটে মনোভাবের সৃষ্টি হতে পারে এমন কোন কাজ করা উচিৎ নয়।

পার্টির কোন কর্মীর উপর নির্ভরশীল আত্মীয়-স্বজন পার্টির অভ্যন্তরে এলেও তাদের দায়িত্ব পার্টি গ্রহণ করতে পারে।

এরূপ ক্ষেত্রে উক্ত কমরেড শহীদ বা গ্রেফতারকৃত হলেও ইহা প্রযোজ্য।

• মানোন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণের অন্যতম লক্ষ্য হছে উন্নততর নেতৃত্ব গড়ে তোলা। এ প্রসঙ্গে নেতৃত্ব বিষয়ক পাঠ্যসূচী সম্ভাবনাময় কর্মীদের তালিকা তৈরী করে পড়ানো এবং পরিকল্পিতভাবে তাদেরকে নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়ে ট্রেইন করে তোলা।

নেতৃত্ব ট্রেইন করার বিষয়ে পরিচালকের উচিৎ তার আওতাধীন কর্মীদেরকে স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করতে দেওয়া (পরিচালকের উপর নির্ভরশীল করে গড়ে তোলা উচিৎ নয়)।

মতামত, বক্তব্য, সমালোচনা, প্রস্তাব পেশের ক্ষেত্রে সংগঠনের স্তরসমূহই অনুমোদিত চ্যানেল (নিজের পরিচালক বা তার পরবর্তী উচ্চস্তরসমুহ বা সরাসরি কেন্দ্রীয় কমিটি)।

অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে বক্তব্য বা মতামত পেশ করা হচ্ছে পার্টির শৃংখলা বিরোধী এবং চক্রের অনুরূপ কাজ।

উপরোক্ত কাজের জন্য চ্যানেল বর্হিভূত কোন মাধ্যম দাবী করা উচিৎ নয়। সর্বহারা শ্রেণী বুর্জোয়াদের মত উকিল বা ঐ ধরনের কোন মাধ্যম উচ্চস্তর-নিম্নস্তর সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাখতে পারেনা। ‘উচ্চস্তরের নিকট বক্তব্য পেশ করা যায় না, সব কথা বলতে পারি না, মাধ্যম থাকা উচিৎ, উচ্চস্তরের সামনে গেলে সব কথা ভূলে যাই, মুক্ত মন হতে পারিনা’। এগুলি সামন্ত পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক সম্পর্ক এবং নিজেকে উচ্চস্তরের নিকট ভাল মানুষ সাজাবার আকাঙ্ক্ষা থেকে (তার কথাবার্তায় ত্রুটি প্রকাশ পেলে উচ্চস্তরের ধারণা খারাপ হতে পারে এটি চিন্তা করে) উদ্ভূত চিন্তা ও অভ্যাস। ইহা সর্বহারা চিন্তা ও অভ্যাসের পরিপন্থী। এই ত্রুটি কর্মীরা প্রচেষ্টা চালিয়ে দূর করবেন এবং উচ্চস্তরের বা যথাযথ চ্যানেলের নিকট মুক্ত মনে নিজের বক্তব্য, প্রস্তাব, সমালোচনা, সমস্যা পুরোপুরি তুলে ধরতে সাহসী হবেন।

উচ্চস্তরের উচিৎ নিম্নস্তরকে বক্তব্য পেশ করতে উদ্বুদ্ধ করা এবং তাদের উল্লিখিত ত্রুটি দূর করতে তাদেরকে সচেতন করে তোলা।

কোন সমস্যা, প্রস্তাব, সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা মনোভাব হচ্ছে সুবিধাবাদী মনোভাব। শ্রেণী সংগ্রামে কোন নিরপেক্ষতা নেই। হয় সর্বহারার পক্ষে, নয় বুর্জোয়া পক্ষ অবলম্বন করা। সুতরাং প্রতিটি প্রশ্নে আমাদেরকে অবশ্যই একটি পক্ষ অবলম্বন করতে হবে।

পার্টির অভ্যন্তরে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের ভিত্তিতে ক্ষুদে দলবাদের মনোভাব ও কার্যকলাপের বিরোধিতা করতে হবে। ইহা পার্টির মধ্যে উপদল ও চক্রের সৃষ্টি করে ও স্তরভঙ্গ করে। ইহা ক্ষুদে উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে আসা একটি ত্রুটি।

৪। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেঃ

বর্তমান মানোন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সংগঠনের অভ্যন্তরস্থ কর্মীদের অসর্বহারা সংস্কৃতি ও আচার-ব্যবহার দূর করা। ইহা সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণের জন্য প্রয়োজন।

প্রতিক্রিয়াশীল আওয়ামী লীগ সরকার ও তার প্রভুরা পরিকল্পিতভাবে পূর্ব বাংলায় প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির বন্যার সৃষ্টি করছে, পূর্ব বাংলার জনগণ এবং আমাদের পার্টি কর্মীদের আচ্ছন্ন করে ফেলার জন্য। কাজেই পার্টির অভ্যন্তরে ও বাইরে প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি বিরোধী ব্যাপক সংগ্রাম শুরু করা অপরিহার্য। অন্যথায় পার্টি-কর্মী এবং জনগণকে প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির প্রভাব থেকে রক্ষা করা অসম্ভব হবে।

এই সংগ্রাম প্রতিনিয়তই চালাতে হবে।

সংগঠনের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট সংস্কৃতি এবং জনগণের মধ্যে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি (ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং আমলাতান্ত্রিক পুঁজি বিরোধী) চালু করতে হবে।

আমাদের নিয়ন্ত্রিত বা আমাদের তৎপরতা পরিচালনা করা যায় এরূপ গ্রামাঞ্চলে প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি ও সামাজিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে—

▬ ডাকাত নির্মূল।

▬ চোর উৎখাত,

▬ জুয়া বন্ধ,

▬ মদ, গাঁজাসহ সকল প্রকার নেশা বন্ধ করা,

▬ গণিকালয়সহ অন্যান্য সকল প্রকার যৌনভ্রষ্টতা বন্ধ করা,

▬ সুদখোরদের শোষণ নিয়ন্ত্রিত করা।

শহরে প্রতিক্রিয়াশীল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিরোধী জনমত সৃষ্টি করা, প্রতিক্রিয়াশীল শিল্প, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রকাশনার বিরোধিতা করা। সাহিত্য, শিল্প, চলচ্চিত্র, পত্রিকা, ম্যাগাজিন প্রভৃতিতে যৌনতা ও অশ্লীলতার (পর্ণোগ্রাফী) বিরোধিতা করা, যৌন সংক্রান্ত ভ্রষ্টতা ও উশৃংখলতার বিরোধিতা, মদ, গাঁজাসহ বিভিন্ন নেশা ও জুয়া খেলা বিরোধিতা করা। একই সময়ে নারী স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালানো।

উল্লিখিত বিষয়সমূহ কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার সময় বাম বিচ্যুতি পরিহার করা (স্কুল, কলেজ পোড়ানো, মূর্তি, মনুমেন্ট ভাঙ্গা, নারী স্বাধীনতার বিঘ্ন ঘটানো)।

পার্টির অভ্যন্তরেও অসর্বহারা ও প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি বিরোধী সংগ্রাম আরো কঠোরভাবে পরিচালনা করা এবং সর্বহারার সংস্কৃতি ও আচার-ব্যবহারের প্রবর্তন করা।

সর্বস্তরে ও সকল এলাকায় প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি বিরোধী এই আন্দোলন গুরুত্ব সহকারে পরিচালনা করতে হবে।

পার্টি কেডাররা পরস্পর দেখা-সাক্ষাতের সময় বা অবসর যাপনের সময় আড্ডা, বিকৃত ও অশ্লীল হাস্যকৌতুক করা, ব্যক্তিগত বিষয় (নিজের বা অপরের) আলাপ করা বা আজেবাজে গল্প করা থেকে বিরত থাকবেন।

অবসর যাপনের সময় অভিজ্ঞতা বিনিময়, পড়াশুনা, দলিলাদি নিয়ে আলোচনা, পুস্তক, শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতির বিষয়ে মতামত বিনিময়, দেশীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা উচিৎ