সিরাজ সিকদার রচনাঃ জনৈক কমরেডকে কোন স্তরে রাখা উচিত—এ সম্পর্কে সমগ্র সংগঠন মতামত পেশ করুন

 

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার

 


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য কমরেড শহীদ সম্পর্কে এ দলিলটি পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৩

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪


 

পিডিএফ

এ কমরেড তার উজ্জ্বল ছাত্র জীবন ত্যাগ করে, অন্য পার্টির সাথে সম্পর্ক ছেদ করে পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করেন। তার এ ভূমিকা প্রশংসনীয়।

সংগঠনের তখনকার অবস্থায় সংশোধনবাদকে তত্ত্বগতভাবে পরাজিত করা এবং বিপ্লবী লাইন প্রনয়ণ করার জন্য তত্ত্বগত জ্ঞানের প্রাধান্য ছিল। উক্ত কমরেড তার তত্ত্বগত জ্ঞানের জন্য তখন প্রাধান্য পান।

তত্ত্ব প্রয়োগ করা, রাজনৈতিক লাইন বাস্তবায়নের স্তরে উক্ত কমরেড অনেক বৈষয়িক কষ্ট সহ্য করেন।

তিনি অনেকদিন জেলে ছিলেন এবং কঠোর জীবন যাপন করেন। এ অবস্থায়ও তিনি পার্টির প্রতি আস্থাশীল ছিলেন।

বর্তমানেও তিনি কষ্ট করছেন।

তার তত্ত্বগত জ্ঞান রয়েছে। এখনো তিনি পার্টির প্রতি আস্থাশীল।

এগুলো তার ভালো দিক। অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় উক্ত কমরেড নিম্নলিখিত সীমাবদ্ধতা ও ভূল ত্রুটির প্রকাশ ঘটানঃ

দায়িত্ববোধ সংক্রান্ত

− একবার তিনি কয়েকমাস ধরে সংগঠনের সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে ভূলে যান। পার্টি নেতৃত্ব নিজে তাকে খুঁজে বের করে।

তাকে একটা এলাকা পরিচালনা এবং বিপ্লবী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রাখতে দেওয়া হয়। তিনি দু’টো কাজই যথাযথ ভাবে পালন করেন নি। কাগজগুলো অতিমাত্রায় নোংরা এবং এলোমেলো ছিল। কাগজগুলো উদ্ধার করতে বহু সময় ব্যয় হয়।

− পরবর্তীকালে তাকে অন্য অঞ্চলে নিয়োগ করা হয়, সেখানে কর্মী পরিচালনায় অযোগ্যতার জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে সাহায্যকারী পদে নিয়োগ করা হয় এবং কমরেড তাহেরকে পরিচালক নিয়োগ করা হয়।

এ সময় উক্ত কমরেড কষ্টকর জীবন যাপন করে গ্রাম্য এলাকায় কাজ করেন, হারুবাবু খতমে অংশগ্রহণ করেন।

এ সময় তিনি ধরা পড়ে যান। কিন্তু এমন কোন খোঁজ তিনি রেখে যান নি যে তার ধরা পড়ার ঘটনা বুঝা যায়। ফলে তিনি নিখোঁজ বলে পরিগণিত হন।

− পচিশে মার্চের পর তিনি ভারতে গমন করেন। পেয়ারা বাগানে এসে তিনি যোগাযোগ করেন।

নেতৃত্ব পেয়ারা বাগান থেকে প্রত্যাহারের পর উক্ত কমরেডকে পেয়ারা বাগানের অবস্থা তদন্ত করে অতিসত্বর নেতৃত্বের নিকট রিপোর্ট করার জন্য পাঠানো হয়।

তিনি অনুসন্ধান করে রিপোর্ট করার পরিবর্তে পেয়ারা বাগান থেকে একটি ট্রুপ নিয়ে পাথরঘাটা, মঠবাড়িয়া অঞ্চলে চলে যান। প্রায় দুই মাস পরে তিনি নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি যদি তখন পাথরঘাটা, মঠবাড়িয়া না যেয়ে অনুসন্ধান ও রিপোর্ট করার দায়িত্ব পালন করতেন তবে তারেক-মুজিবের সমরবাদের উদ্ভব এবং ১নং ফ্রন্টের বাহিনীর বিপর্যয় ঠেকানো, নেতৃত্বের পুনরায়  যেয়ে ১নং ফ্রন্ট পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে উঠতো।

ফলে বরিশাল জেলায় পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের রণনৈতিক আক্রমণের পর তাদের বর্ষাকালীন রণনৈতিক সংরক্ষণের স্তরে আমাদের যে চমৎকার বিকাশ হয়েছিল তা টিকিয়ে রাখা এবং বহু সৈন্য ও বিরাট মুক্ত এলাকা গড়া সম্ভব হতো।

সব চাইতে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে উক্ত কমরেড যখন অনুসন্ধানের জন্য বরিশাল যাচ্ছিলেন তখন পথিমধ্যে তার এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়। তিনি ঐ বন্ধুর সাথে তখনই যুদ্ধ করার জন্য বাগেরহাট চলে যেতে চান। তার সাথে যে কমরেড ছিল সে তাকে নিবৃত করে।

− ভুলে যাওয়া তার একটি অন্যতম সমস্যা। তিনি প্রায়ই বিভিন্ন বিষয় ভুলে যান। ফলে তার পক্ষে গুছিয়ে কাজ করা ও চলা সম্ভব হয়না।

নিরাপত্তা সংক্রান্ত

− উক্ত কমরেডের বাসস্থান অনেক কর্মী এমনকি সহানুভূতিশীলরাও চিনতো। তিনি কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের সামনেই উচ্চস্বরে বাসার ঠিকানা বলে বেবী/রিকসা ঠিক করতেন, ফলে তারা বাসস্থানের অবস্থান জেনে ফেলে।

− তিনি যে বাসস্থানে থাকতেন তা ফজলু চক্র চিনতো, ফজলু চক্র বাসাটি কাজী চক্রের লোকজনদের চিনিয়ে দেয়। ফজলুর চক্রান্ত প্রকাশ পাওয়ার পর পার্টির নেতৃত্ব উক্ত কমরেডকে অন্যত্র রেখে আসেন এবং উক্ত বাসস্থানে না থাকতে ও বাসস্থান বদলাতে বারংবার বলে আসেন। এরপরেও বিভিন্ন সময় উক্ত বাসায় না থাকার জন্য নেতৃত্ব তাকে বারবার বলেন।

কিন্তু উক্ত কথা ও নির্দেশ অগ্রাহ্য করে প্রায় দুইমাস ঐ বাসায় থাকেন, আরো তিনচারজন কমরেড ও কাগজপত্র বাসায় রাখেন। এমনকি একটি স্টেন, রিভলবার, গুলি ও অন্যান্য দ্রব্য সেখানে আনেন।

শেষ পর্যন্ত পুলিশ ঐ বাসা রেইড করে তাকে এবং অপর এক কমরেডকে গ্রেফতার করে। অস্ত্রাদি এবং কাগজপত্র  ও বাসার জিনিসপত্র খোয়া যায়।

সৌভাগ্যবশতঃ এক কমরেড বাইরে ছিলেন বলে গ্রেফতার হননি, অপর এক কমরেড বুদ্ধি দ্বারা বেঁচে যান।

এভাবে তিনি নিরাপত্তা সংক্রান্ত দায়িত্ব এবং উচ্চস্তরের কথা ও নির্দেশ উপেক্ষা করে নিজের, কমরেডদের এবং পার্টির অস্ত্র ও দ্রব্যাদির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেন।

উক্ত কমরেড নিজে অর্থনৈতিক অপারেশনে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা করেছিলেন, যদিও তা নিষেধ ছিল।

− ফজলু চক্রকে আঞ্চলিক নেতৃত্ব সংস্থায় না নেওয়া এবং গ্রামাঞ্চলে নিয়োগের জন্য নেতৃত্ব তাকে পত্র মারফত জানিয়ে ছিলেন। তিনি এ নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ফজলুকে গুরুত্বপূর্ণ শহরের দায়িত্ব প্রদান করেন। ফলে ফজলু উক্ত কমরেডের অজ্ঞাতে শহরে চক্রান্তমূলক কার্যাবলী চালাতে সক্ষম হয়।

− পরবর্তীকালে ফজলু চক্রের কার্যাবলী ধরা পড়লে ফজলু পলায়ন করে। তাকে খোঁজ করে পাওয়া যায়। তাকে আটকে রাখার জন্য (যাতে সে পালাতে না পারে) উক্ত কমরেডকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু উক্ত কমরেড ইহা যথাযথভাবে গুরুত্ব সহাকারে কার্যকরী করেন নি। ফলে ফজলু চক্র পালাতে সক্ষম হয়। এর পরিণতি হিসেবে চক্র খুলনায় ঘাঁটি গেড়ে বসা, পার্টির অস্ত্র ও জিনিসপত্র দখল, কমরেডেদের প্রতারিত করা, খুলনার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত করা, কিছুদিন পার্টি বিরোধী তৎপরতা চালাতে সক্ষম হয়।

ফজলু চক্রকে পাহাড়া দিয়ে আটকে রাখতে পারলে তখনই চক্র চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত। ফজলু চক্রকে উক্ত কমরেডের বাসস্থানেই আটকে রাখা সম্ভব হতো যদি উক্ত কমরেড সতর্ক হতেন। (ফজলু স্ত্রীসহ উক্ত কমরেডের বাসস্থানে থাকতো)। ফজলুর চক্রান্ত প্রকাশ পেলে নেতৃত্ব উক্ত কমরেডের বাসস্থানে যে রিভলবার ছিল তা নিয়ে আসার জন্য পাঠায় (গোপনে)। উক্ত কমরেড হন্তদন্ত হয়ে খোঁজ করেন, (উহা ফজলু পূর্বাহ্নেই সরিয়ে ফেলেছিল) কিন্তু তিনি পাননি। তার কার্যকলাপ ফজলুর স্ত্রীর মনে সন্দেহের উদ্রেক করে, তিনি ফজলুর স্ত্রীকে অস্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, এমনকি অস্ত্র খোঁজার বিষয়ে ফজলুকে বলতে নিষেধ করে আসেন।

ফজলু স্ত্রীর নিকট থেকে সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীসহ পলায়ন করে। এভাবে তার অসতর্কতার জন্য তারা উক্ত কমরেডের বাসস্থান থেকে পালাতে পারে এবং একটি অস্ত্র দখল করতে সক্ষম হয়।

− লেনিন সোজা লোক ও বদমাইশদের একই সাথে গাল দিয়েছেন। কারণ সোজা লোকেরা সহজেই বদমাইশদের দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে এবং তারা অজ্ঞাতসারেই বদমায়েশদের সহায়তা এবং বিপ্লবের ক্ষতি সাধন করতে পারে।

চক্রান্তকারীরাও উক্ত কমরেডকে ব্যবহার করা, তাকে মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা, তাদের পুতুল হিসেবে দাঁড় কারানোর প্রচেষ্টা চালায়।

উক্ত কমরেড চক্র, চক্রের সাথে যুক্ত এবং পেটিবুর্জোয়াদের মতামত প্রতিফলিত করেন, অজ্ঞাতসারে কখনো কখনো তাদের মুখপাত্র হন।

চক্রের উদ্দেশ্য ছিল উক্ত কমরেডকে পুতুল হিসেবে দাঁড় করিয়ে তথাকথিত নেতৃস্থানীয়  কমরেডদের বৈঠকে আহবান করা, খতম, গুজব-অপবাদ, ভীতি প্রদর্শন এবং বন্দুকের ডগায় নেতৃত্ব দখল করা।

এ কারণে চক্র তাকে আক্রমণ করতো না, তারা তাকে চালাতে পারবে বলে প্রকাশ্যে বলতো।

উক্ত কমরেড সোজা হওয়ায় এ সকল ষড়যন্ত্র বুঝেন নি।

এ কারণে উক্ত কমরেডকে সমালোচনা করে এ সময় কেন্দ্রীয় কমিটি উল্লেখ করে যে, কোন কোন সোজা কমরেড চক্রের খপ্পরে পড়তে পারেন।

পার্টি নেতৃত্বের সতর্কতার জন্য চক্রের এ পরিকল্পনা কার্যকারী হয়নি।

− তিনি জনৈক সহানুভূতিশীলের বাড়ীতে তার অনুমতি ব্যতীত এবং তাকে না জানিয়ে একটি স্টেন দুই মাস রাখেন। পরে উক্ত সহানুভূতিশীল এ বিষয়ে জানতে পেরে খুবই সন্ত্রস্ত হন।

− আমাদের স্টেন আছে ইহা দেখানোর জন্য তিনি দুইজন সহানুভূতিশীলের বাসায় স্টেন নিয়ে যান। এতে তারা খুবই ঘাবড়ে যায়।

এ সকল কারণে উক্ত অঞ্চলের সহানুভূতিশীলগণ তাদের বাসস্থান পার্টির কমরেডদের চিনাতে চান না।

− পূর্বেও তিনি এরূপ নিরাপত্তা বিঘ্নকারী কাজ করেন।

তিনি এবং অপর কয়েকজন কমরেড বোমা তৈরী করতে গেলে (বাসস্থানে এবং নেতৃস্থানীয় কর্মীর পক্ষে বোমা তৈরী করা উচিৎ নয়) দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি হকচকিয়ে যান, ফলে মূল্যবান ঠিকানা, লেখা, ডায়েরী ও দ্রব্যাদি নিয়ে আসতে পারেননি।

তিনি ইচ্ছে করলে কাগজপত্র ধ্বংস করে আসতে পারতেন, তাও তিনি করেন নি। ফলে পুলিশ উক্ত ডায়েরী থেকে ঠিকানা উদ্ধার করে জনৈক সহানুভূতিশীলকে গ্রেফতার করে। তিনি বহুদিন জেলে কষ্ট করেন।

− উক্ত কমরেড কারাগার থেকে বহু সহানুভূতিশীলদের নামে চিঠি পাঠান, যার ফলে তারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন।

এভাবে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।

− উক্ত কমরেডের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময়েও একাধিক কমরেডকে পার্টি-নাম ধরে উচ্চস্বরে ডাকেন, ফলে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে তোলেন। লেনিন বলেছেন, পুলিশকে এড়িয়ে চলাও বিপ্লবীদের একটি যোগ্যতা। এজন্যে প্রয়োজন কঠোরভাবে নিজে নিরাপত্তার নিয়মাবলী পালন করা এবং অন্যের দ্বারা তা পালন করানো।

উপরোক্ত ঘটনাবলী থেকে দেখা যায় উক্ত কমরেড নিজের ও অপরের এবং সংগঠনের নিরাপত্তা পালনের ক্ষেত্রে চরম অযোগ্যতার পরিচয় দেন।

সাংগঠনিক ক্ষেত্রে

কেন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত উক্ত কমরেডের পরিচালনাধীন ছয়জন সার্বক্ষনিক কর্মী ছিল। এদের মাঝে একজন বাদে সকলকেই কাজে লাগানো যেতো।

তিনি পরে আরো একজন কর্মী সার্বক্ষণিক করেন।

অপর একজন কর্মীকে অন্য অঞ্চল থেকে বদলী করে তার পরিচালনাধীন দেওয়া হয়। ইনি বাসায় থেকে সার্বক্ষণিক কাজ করতে পারতেন।

এ থেকে দেখা যায় উক্ত কমরেডসহ আটজন কর্মী সার্বক্ষণিক কাজ করতে পারতেন। উচ্চস্তর তাকে প্রতিমাসে কমপক্ষে তিন থেকে চার’শ টাকা প্রদান করতো। স্থানীয় ভাবে দুই তিন শত টাকা উঠতো। অর্থ, কর্মী ও অন্যান্য সুবিধার দিক দিয়ে তার পরিচালনাধীন এলাকা সমগ্র সংগঠনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান পেয়েছে। কিন্তু উক্ত কমরেড কর্মী এবং উপরোক্ত সুযোগ সুবিধার সদ্ব্যব্যবহার করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন। দায়িত্ব ও কাজ বন্টন করতে

না পারার ফলে কর্মীরা কাজহীন থাকে। ফলে দু’জন কর্মী (একজন সার্বক্ষণিক, অপরজন বাসায় থেকে সার্বক্ষণিক কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলেন) সুবিধাবাদী হন।

তাদেরকে দুই তিন মাস কোন কাজই দেওয়া হয়নি, ফলে তারা হতাশ হন এবং সুবিধাবাদী হন।

জনৈক কর্মী তার কর্মস্থল ত্যাগ করে অন্য অঞ্চলে চলে যান। তিনি তার নিকট থেকে দায়িত্ব বুঝে নেননি। ফলে উক্ত অঞ্চলের কাজ নষ্ট হয়। পরে নতুন পরিচালক যোগাযোগ করে দেখে সেখানকার কর্মীরা সুদীর্ঘ দিন যোগাযোগ না পেয়ে পার্টির প্রতি আস্থা হারিয়েছে।

অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সাথে অনিয়মিতভাবে যোগাযোগ  রাখা হতো। শেষ পর্যন্ত তার গ্রেফতারের পর তিনি দু’বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও যোগাযোগ করার উপায় উল্লেখ করেননি।

স্থানীয় নেতৃস্থানীয় কর্মীদের নিয়মিত বৈঠক হতো না, তার গোটা কাজের আমলে মাত্র একবার বৈঠক হয়।

− কেন্দ্র থেকে প্রচার দলিলপত্র উক্ত অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু তা কর্মী-সহানুভূতিশীলদের নিকট পৌঁছানো, তাদেরকে নিয়ে পড়া, তাদের মাধ্যমে বিতরণ করা হতো না। তিনি দলিলপত্র বস্তাবন্দী করে নিজের আশ্রয়স্থলে রাখতেন।

তার গ্রেফতারের সময় পুলিশ প্রচুর দলিলপত্র পায়। আমরাও বিতরণ হয়নি এরূপ এক বস্তা দলিল পাই।

− তার এলাকার কর্মীদের সংগঠিত করা, নিয়মিত তাদের ক্লাস নেওয়া, নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা শিক্ষা দেওয়া, যোগাযোগ রাখা, কাগজপত্র পৌঁছে দেওয়া ও তা নিয়ে আলোচনা করা, তাদের মান উন্নয়ন করা, তাদের মাধ্যমে নতুন যোগাযোগ করা, তাদের দায়িত্ব দেওয়া ও কাজে লাগানো প্রভৃতি সংগঠনের সাধারণ কর্মপদ্ধতি উক্ত কমরেড কখনই কার্যকরী করেন নি।

ফলে কর্মীরা উন্নত ও সংগঠিত হয়নি বরঞ্চ আস্তে আস্তে তারা কেটে পড়ে।

পরবর্তীকালে ভাল কর্মী নিয়োগের পর উক্ত এলাকার কর্মীরা সংগঠনের উপরোক্ত কর্মপদ্ধতি দেখে বলে “এধরনের  কর্মপদ্ধতি রয়েছে এটা প্রথম জানলাম।’’

ফলে স্থানীয় কর্মীরা কখনোই উন্নত হয়নি যা ঐ এলাকার কাজের বিকাশের জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল।

পরবর্তীকালে ভাল পরিচালক নিয়োগের পর স্থানীয় কর্মী বেরোয় (চার মাস পরিচালনার পর চারজন উন্নতমানের  স্থানীয় কর্মী বেরোয়), মোট সার্বক্ষণিক কর্মী ছিল প্রথম দিকে একজন, পরে স্থানীয় দু’জন সহ চারজন হয়।

বর্তমানে সমগ্র এলাকা সম্ভাবনাময় হিসেবে বিকাশ লাভ করছে। স্থানীয় কর্মী পাওয়ার ফলে কাজ বিকাশের ভিত্তি তৈরী হচ্ছে।

− উক্ত কমরেড সহানুভূতিশীলদের পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দেন। তিনি সহানুভূতিশীলদের সাথে আলোচনা ও যোগাযোগ করার সময় অপরিস্কার ও অপরিচ্ছন্ন অবস্থায়ই যেতেন (পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা হচ্ছে সর্বহারার

অভ্যাস যা তার ছিল না, পক্ষান্তরে ক্ষুদে বুর্জোয়া নৈরাজ্যবাদীদের মত অপরিস্কার ও অপরিচ্ছন্নতা তার অভ্যাস ছিল)। এর ফলে সহানুভূতিশীলরা অস্বস্তি অনুভব করতো এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে এরূপ মনে করতো।

তিনি তাদের সাথেও একঘেয়ে নিজ খেয়াল খুশীমত আলাপ করতেন। এ কারণে অনেক সহানুভূতীশীল তাকে আকর্ষণীয় মনে করতো না। এমনও মন্তব্য করতো যে, একে দিয়ে যোগাযোগ রাখলে সহানুভূতিশীলরা সরে পড়বে। (বাস্তবেও অনেক ক্ষেত্রে তাই হয়েছে) এর ফলে তাদের মান উন্নত হয়নি।

− তিনি কার্যবলী পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্মীদেরকে সমাবেশিত করা, তাদের মতামত সংগ্রহ করা, তাদের প্রস্তাব নেওয়া প্রভৃতি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করতেন না।

অন্যরা মতামত দিলে তা অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষা করতেন (বাসা বদলানোসহ অনেক ক্ষেত্রে)।

তিনি নিজ খেয়াল খুশীমত কাজ করতেন। এর ফলে কাজ বিকাশ লাভ করেনি, কর্মীদের উৎসাহ বাড়েনি এবং তিনি নিজে অন্ধ গলিতে আটকে পড়েন।

মতাদর্শগত

− তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে মুক্ত মনে সমালোচনা করা, যথাসময়ে সমালোচনা করেননি।

একারণে কেন্দ্রীয় কমিটি তাকে একবার সমালোচনা করে মুক্ত মন না হওয়া এবং যথা সময়ে সমালোচনা না করার জন্য।

− তার উপরোক্ত ত্রুটি বিচ্যুতির উৎস হচ্ছে তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে সমন্বয় না করার ফল। কারণ তত্ত্বগত ভাবে তিনি উপরোক্ত বিষয়সমুহ অবহিত ছিলেন, কিন্তু তা তিনি প্রয়োগ করেননি।

ইহা মতাদর্শগত ক্ষেত্রে গোড়ামীবাদের বহিপ্রকাশ। ইহা ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শেরও একটি বহিঃপ্রকাশ।

উক্ত কমরেড নিজস্ব অভিজ্ঞতার সার সংকলন হিসেবে প্রবন্ধ না লিখে তত্ত্বগত (নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে নয়) প্রবন্ধ লেখেন।

এ কারণেই তিনি নিজের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভূল এড়াতে এবং অনুশীলনকে প্রতিনিয়ত উন্নত পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেননি, বার বার একই ভূল করে গেছেন। ইহা গোড়ামীবাদী বিচ্যূতি।

উপসংহার 

উপরোক্ত বিষয় অবগত হয়ে কর্মীদের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, বর্তমান আঞ্চলিক পরিচালকদের মান প্রথম শ্রেণীর ধরা হলে তাদের পরবর্তী নীচু স্তরের কর্মীদের মান দ্বিতীয় শ্রেণীর ধরা হলে তাদের চাইতে উক্ত কমরেডের মান নীচু তবুও তাকে কেন তাকে এত গুরুত্ব ও সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

এর উত্তর নিম্নে প্রদান করা হচ্ছে।

বিপ্লব ও পার্টি কতগুলো স্তরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে।

আমাদের সংগঠন যখন বিপ্লবের প্রথম স্তরে ছিল তখন সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে তত্ত্বগত সংগ্রাম করা এবং বিপ্লবী লাইন নির্ণয় করা প্রধান কাজ ছিল। এ সময় তত্ত্বগত জ্ঞানটাই নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

এ সময় সম্পর্কে লেনিন বলেছেন, বিপ্লব করার জন্য যখন বিপ্লবী লাইন নির্ধারিত হয়নি, তখন লাইন নির্ণয়ের জন্য তত্ত্বটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের সংগঠনে বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং বিপ্লবী লাইন নির্ণয়ের সময় তত্ত্বগত জ্ঞান সম্পন্ন কমরেডরা প্রাধান্য পেয়েছেন। উক্ত কমরেডও একারণেই প্রাধান্য পেয়েছেন।

১৯৭১ সালের পরবর্তীকালে সংগঠনের লাইন নির্ধারণের স্তর সম্পন্ন হয় এবং সংগঠনের লাইন বাস্তবায়নের স্তর প্রধান হয়ে পড়ে।

কিন্তু অস্থায়ীভাবে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দিকে কিছু সময় লাইন নির্ধারণ পুনরায় প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু প্রয়োগের, তত্ত্বের সাথে অনুশীলনের সমন্বয়ের দিক প্রাধান্য দেওয়ার জন্য কংগ্রেসে সর্বপ্রথম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গোড়ামীবাদ পার্টির প্রধান বিপদ; ইহা ঘোষণা করে অনুশীলনে যুক্ত নয় এরূপ তত্ত্বের প্রাধান্যের পরিসমাপ্তি।

পরবর্তীকালের শুদ্ধি অভিযান এবং বর্তমানের গোড়ামীবাদ বিরোধী শুদ্ধি অভিযান অনুশীলনে যুক্ত নয় এরূপ তত্ত্বের প্রাধান্য কে চূর্ণ-বিচ্যূর্ণ করার পদক্ষেপ।

কাজেই উক্ত কমরেডের প্রাধান্যের কারণ বিপ্লবের প্রথম স্তরের প্রয়োজনীয়তা, বর্তমানের স্তরের যোগ্যতার মাপকাঠিতে তিনি অযোগ্য হয়ে পড়েছেন।

সংগঠনের ও বিপ্লবের পরবর্তী স্তর হচ্ছে সামরিক ক্ষেত্রের সমস্যা সমাধান। এক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে সক্ষম কমরেডরা তখন প্রাধান্য পাবেন।

এর পরবর্তী পর্যায়ে আসবে রাষ্ট্র পরিচলানা ও জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্নকালীন সমস্যার সমাধান। এতে সক্ষম কমরেডরা তখন প্রাধান্য পাবেন। যারা পূর্বের স্তরে প্রাধান্য পেয়েছেন কিন্তু এ স্তরে অযোগ্য তারা স্বাভাবিক ভাবেই অযোগ্য হয়ে পড়বেন, নতুন যোগ্যরা তাদের স্থান দখল করবে।

এরপরে আসবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্য এবং সর্বহারার সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালনার স্তর, এ স্তরে প্রাধান্য পাবেন যারা এ স্তরে দ্বায়িত্ব পালনে সক্ষম।

কাজেই বিপ্লব ও পার্টির স্তরের দায়ীত্বাবলী নির্ণয় করবে কমরেডদের যোগ্যতার মাপকাঠি। যে স্তরের যারা যোগ্য তারাই সে স্তরে প্রাধান্য পাবেন। পরবর্তী স্তরের যোগ্যতা না থাকলে তারা বাতিল হয়ে যাবেন। ইহা বিপ্লবের ও পার্টির অলংঘণীয় বস্তুগত নিয়ম।

চীনসহ পৃথিবীর সকল দেশেই এরূপ ঘটেছে।

এ কারণেই বিপ্লবের এক স্তরে যোগ্য থাকা কঠিন নয়, কঠিন হচ্ছে প্রতিটি স্তরের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেকে যোগ্য রাখা, নিজেকে পরিবর্তন করা।

এ কারণেই সভাপতি মাও বলেছেন, “কিছু কালের জন্য যোগ্য থাকা কঠিন নয়, কঠিন হচ্ছে সারাজীবন যোগ্য থাকা

আমাদের কমরেডদের উচিত সারাজীবন যোগ্য থাকা।

আমরা যদি পার্টি ও বিপ্লবের বিভিন্ন স্তরের জন্য যোগ্য কর্মীদের বের করে যথাযথ স্থানে নিয়োগ না করি, পুরোনো স্তরের জন্য যোগ্য ছিল কিন্তু বর্তমান স্তরের জন্য অযোগ্য এরূপ কমরেডদের যদি না বদলাই তবে সংগঠনে আমলাতন্ত্র ঢুকবে এবং সংগঠনের গতি, বিকাশ ব্যাহত হবে, সংগঠন স্থবির ও মৃত হবে।

নীতি নির্ধারণের জন্য এবং কর্মী পরিচালনার জন্য প্রয়োজন তত্ত্ব ও অনুশীলনের সমন্বয় এবং একদিকে গোড়ামীবাদ অন্যদিকে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ পরিহার।

কাজেই উক্ত কমরেডের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিয়োগ বজায় রাখার অর্থই হবে পার্টি গোড়ামীবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়ার সম্ভাবনাকে বজায় রাখা। ফলে পার্টি বাম বা দক্ষিণ বিচ্যুতি, সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের শিকারে পরিণত হতে পারে। উক্ত কমরেড সোজা লোক, খারাপ লোকেরা এর সুযোগ নিতে পারে।

পক্ষান্তরে তার তত্ত্বগত জ্ঞানকে (একতরফা) ব্যবহার করা যায় কিন্তু পার্টির নীতি নির্ধারণে তা প্রভাব ফেলবে না, খারাপ লোক তাকে ব্যবহার করতে পারবে না, নিরাপত্তা ও সাংগঠনিক দায়িত্ব নেই এরূপ স্থানে তাকে নিয়োগ দান করা উচিত।

তাকে প্রাধান্য দেওয়ার অপর একটি কারণ হচ্ছে পার্টির অনভিজ্ঞতা।

বিশেষ জ্ঞান ব্যবহার করার ধারণা সংগঠনের ছিল না। অর্থাৎ যোগ্যতা না থাকলে কমিটিতে না নিয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে পরিচালক নিয়োগ করে দায়িত্ব পালন করানো এবং বিশেষ জ্ঞান সম্পন্নদের জ্ঞান ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা পার্টির ছিল না।

কাজেই বিপ্লবের, পার্টির বিকাশের স্তর এবং সংগঠনের কর্মী নিয়োগ ও ব্যবহারের অনভিজ্ঞতার কারণেই উক্ত কমরেড প্রাধান্য পান।

উক্ত কমরেডের ভাল ও শক্তিশালী দিকগুলো ব্যবহার করতে হবে।

উক্ত কমরেডকে আহবান জানানো হচ্ছে তিনি যেন নিজ যোগ্যতা, সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটির দিকসমূহ ও তার মতাদর্শগত ভিত্তি উপলব্ধি করেন, এবং সংশোধনে ব্রতী হন; এগুলোর বিবেচনার ভিত্তিতে সংগঠন প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করেন; সংগঠনের প্রতি আস্থা বজায় রাখেন।

তার প্রতি সংগঠনের আস্থা এবং বিশ্বাস রয়েছে; তিনি যেন ইহা বজায় রাখেন