সিরাজ সিকদার রচনাঃ মওলানা ভাসানীর যুক্তবাংলা প্রসঙ্গে

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ অক্টোবর ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪


পিডিএফ

মওলানা ভাসানী সম্প্রতি পূর্ববাংলা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা নিয়ে যুক্তবাংলা গঠনের দাবী উত্থাপন করেছেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের নিম্নলিখিত বক্তব্য পেশ করা হচ্ছেঃ

পূর্ববাংলার সমাজের বর্তমান সমস্যা হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উৎখাত করে পূর্ব বাংলার উপর তাদের উপনিবেশিক শোষণ ও লুন্ঠনের অবসান ঘটানো, একই সাথে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ উৎখাত করা এবং তাদের দালাল ছয় পাহাড়ের প্রতিনিধি আওয়ামীলীগ জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করা, এজন্য জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির গণযুদ্ধ শুরু করা।

পূর্ববাংলার জনগণ এ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত। তারা স্বতস্ফুর্তভাবে আওয়ামীলীগ, তার পদলেহী কুকুর মস্কোপন্থীদের মধ্যকার ঘৃণ্য দস্যুদের খতম করছে।

এ অবস্থায় আওয়ামীলীগ জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ফ্যাসিস্ট, তাবেদার সরকার এবং তাদের প্রভুদের  থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর অর্থ হচ্ছে তাদের বাঁচিয়ে দেওয়া।

কাজেই বর্তমানে যুক্ত বাংলার কথা বলার অর্থ হলো এ মহান সংগ্রাম থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানো….।

পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরার জনগণ নিজেদের মুক্তির জন্য নিজেরাই সংগ্রাম করবেন। তাদের উপরে পরিচালিত জাতীয় ও অন্যান্য নিপীড়ণের বিরুদ্ধে তারা নিজেরাই লড়বেন, নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। ইহা তাদের পবিত্র ও অলংঘণীয় অধিকার।

পশিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরাসহ ভারতের সকল নিপীড়িত জাতি এবং জনগণের ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শাসকগোষ্ঠীবিরোধী ন্যায্য সংগ্রাম আমরা সমর্থন করি, তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা আমাদের একই শত্রু এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্র ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে ধ্বংস করবো।

পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরার জনগণ ভারতের সাথে থাকবেন, না বিচ্ছিন্ন থাকবেন তা নির্ণয় করার অধিকার আমাদের নেই। এটা তারাই নির্ধারণ করবেন।

ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশের জনগণের নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ণয় করার অধিকার হরণ করে তা নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা। তারা বিশ্ব জনগণের ভাগ্য নির্ধারণেরও ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা একই ভাবে বিশ্বের জনগণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা নিচ্ছে। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরাও পূর্ব বাংলার জনগণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার নিয়েছে।

এ সকলের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন দেশ, জাতি ও জনগণকে পদানত করা, লুন্ঠন ও শোষণ করা, জাতীয় মুক্তি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম প্রতিহত করা।

ইহা পুরোনো ও নয়া উপনিবেশবাদীদের এবং সম্প্রসারণবাদীদের সাধারণ কর্মপদ্ধতি।

মওলানা ভাসানী যুক্ত বাংলার কথা বলে পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরার জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়েছেন।

ইহা কি পুরোনো ও নয়া উপনিবেশবাদী ও সম্প্রসারণবাদীদের অনুরূপ কার্যকলাপ নয়? পূর্ববাংলার জনগণ কখনও এ ধরণের অপরাধমূলক কাজ করবেন না।

যুক্ত বাংলার দাবী পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরার জনগণের দৃষ্টি ভারতীয় সম্প্রসারনবাদী শাসকগোষ্ঠী বিরোধী মহান সংগ্রাম থেকে সরিয়ে আনারও একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা।

কাজেই এ দাবী ভারত ও পূর্ব বাংলার জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম ও সংগ্রামী মৈত্রীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ব্যতীত আর কিছুই নয়।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা এ ধরণের পরিকল্পনা [১] প্রণয়ন করেছিল আইয়ুবী আমলে।

বর্তমানে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব এবং পূর্ব বাংলার ও ভারতের বিপ্লব নস্যাৎ করার জন্য এ পরিকল্পনা পুনরুজ্জীবিত করা তাদের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়।

বিভ্রান্তিকর রাজনীতিক মওলানা ভাসানীর পক্ষে এ ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

একটি জাতি হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত স্থায়ী মানবগোষ্ঠী যা গঠিত হয় সাধারণ ভাষা, ভৌগোলিক এলাকা, অর্থনৈতিক জীবন এবং মানসিক প্রকৃতি যা সাধারণ সংস্কৃতিতে রূপ লাভ করেছে এ সকলের ভিত্তিতে।” [২]

পূর্ববাংলা (বৃটিশ উপনিবেশিক দস্যুদের শাসনকালে যা পূর্ববঙ্গ ছিল) ছিল কলিকাতার পশ্চাদভূমি, ব্রিটিশ সমর্থক হিন্দু ধর্মাবলম্বী জমিদার, জোতদার ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা এখানকার জনগণ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিপীড়িত হয়েছে।

পূর্ববাংলার জনগণ পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়ায় ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গের পৃথক প্রদেশ স্থাপন অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে সমর্থন করে।

পরবর্তীকালে তারা পাকিস্তানের পক্ষে ভোট প্রদান করে।

পাকিস্তানে যোগদানের পরবর্তী সময় পূর্ববাংলার জনগণ সাধারণ ভাষা, ভৌগোলিক এলাকা, অর্থনৈতিক জীবন ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে বিকাশ লাভ করে, নিজেদের জাতীয় বিকাশের অন্তরায় দূর করার জন্য সংগ্রাম করে যা বিকাশ লাভ করে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে।

কাজেই ঐতিহাসিকভাবে পূর্ব বাংলার জনগণ একটি পৃথক মানব গোষ্ঠীতে বিকাশ লাভ করে যার রয়েছে সাধারণ ভাষা, ভৌগোলিক এলাকা, অর্থনৈতিক জীবন ও সংস্কৃতি।

এ কারণে পূর্ব বাংলার জনগণ ঐতিহাসিকভাবে একটি সম্পূর্ণ জাতিতে বিকাশ লাভ করেছে।

কাজেই যুক্তবাংলা না হলে পূর্ব বাংলার জনগণ অর্ধেক জাতি বা বিচ্ছিন্ন জাতি রয়ে যায়—এ বক্তব্য মার্কসবাদ বিরোধী।

পূর্ববাংলার জনগণ জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্রের জন্য পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের জাতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করেন।

এ মহান সংগ্রাম বুর্জোয়া নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতায় বিপথে পরিচালিত হয়।

কিন্তু এতে লক্ষ লক্ষ জনগণ অংশগ্রহণ করেন ও আত্মবলিদান করেন।

এত মহান ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরও যারা বুঝাতে চান পূর্ব বাংলার জনগণ একটি জাতি নয়, অর্ধেক জাতি, যুক্ত না হলে পূর্ব বাংলার জনগণ জাতিগত ভাবে দ্বিখণ্ডিত থাকবে, তারা সম্পূর্ণরূপে কল্পনার রাজ্যে বাস করেন।

পূর্ব বাংলার জনগণ কখনও নিজেদেরকে অর্ধেক জাতি বা খণ্ডিত জাতি হিসেবে মনে করেননি। তাহলে তারা সশস্ত্র সংগ্রামের সময় যুক্তবাংলার দাবি পেশ করতেন।

মওলানা ভাসানীর যুক্ত বাংলার দাবী জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও কাল্পনিক।

পূর্ব বাংলার জনগণ, নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে স্বাধীনতা ও উদ্দ্যোগ নিজেদের হাতে রেখে নিজেদের মুক্তির জন্য নিজেরাই লড়াই করবেন, এবং ভারতীয়  সম্প্রসারণবাদ বিরোধী সংগ্রামরত বিভিন্ন জাতি ও জনগণের সংগ্রামের সাথে একাত্ম হবেন। একই সাথে তাদের হয়ে মনস্থির করার সম্প্রসারণবাদী, বৃহৎ জাতিসূলভ অপরাধমূলক কার্যকলাপকে বিরোধিতা করবেন।

ভারতের বিভিন্ন জাতি (পশ্চিমবঙ্গসহ) ও জনগণ নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে স্বাধীনতা ও উদ্দ্যোগ নিজেদের হাতে রেখে নিজেরাই মুক্তির জন্য সংগ্রাম করবেন, এ প্রক্রিয়ায় তারাই স্থির করবেন তারা ঐক্যবদ্ধ ভারতে থাকবেন না বিচ্ছিন্ন হবেন। আমরা তাদের মুক্তির সংগ্রামকে সমর্থন করি।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি—জিন্দাবাদ

কমরেড সিরাজ সিকদার—জিন্দাবাদ

পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন

যুক্তবাংলার দাবী পূর্ববাংলা ও ভারতীয় বিপ্লব বিরোধী দাবী

স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ববাংলার প্রজাতন্ত্র কায়েম করুন

নোট

১। Bengsam অর্থাৎ, বাংলা ও আসাম নিয়ে “বেঙ্গসাম”

২। J. V. Stalin, Marxism & The National Question, P-16