সিপিএমএলএম ফ্রান্স দলিল- ৫৯, পুঁজিবাদী অথবা আধা-সামন্তবাদী আধা-উপনিবেশিক দেশ? ট্রটস্কিবাদ অথবা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ?

সিপিএমএলএম ফ্রান্স দলিল- ৫৯,

পুঁজিবাদী অথবা আধা-সামন্তবাদী আধা-উপনিবেশিক দেশ? ট্রটস্কিবাদ অথবা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ?

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং ইরাকে যা হচ্ছে… তা পৃথিবীর দেশ সমূহের প্রকৃতি বিশ্লেষণের জন্য পুনরায় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের শিক্ষাকে আরোপ করে।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিয়ম অনুসারে, বিশ্বের দেশ সমূহ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম শ্রেনীর দেশ গুলো পুঁজিবাদী দেশ নিয়ে গঠিত, যারা সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়েছে। সেই সকল দেশসমূহের প্রধান দ্বন্দ্ব সর্বহারা এবং বুর্জোয়ার মাঝে, সেখানকার জন্য করণীয় হলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধন করা। এই পরিস্থিতি অন্যান্য স্থানের জন্যsirajsikder প্রযোজ্য নয়ঃ অন্য ধরণের দেশগুলিকে অধীন করার প্রক্রিয়ায়, ঐ প্রথমোক্ত দেশসমূহ সামন্তবাদকে শক্তিশালী করেছে নির্দিষ্টতঃ বড় বড় ভূমি মালিকদের এক শক্তিশালী সংগঠন জন্ম দিয়ে।

এটা প্রচলিত স্থানীয় উৎপাদন ও এর সরল পুনঃ উৎপাদনকে বিনাশ করে দেয়, গণহারে নাগরিকদের স্থানান্তর ঘটায়, যারা শহরে নগরে এমনকি সাম্রাজ্যবাদী দেশে পাড়ি জমায়। এর অন্য আরো একটি দিক হলো সেখানে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বুর্জোয়াদের সংগঠনঃ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি সমর্পিত। ফলতঃ ঐসকল দেশে বিপ্লবের প্রথম ধাপ হিসাবে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সাধন করতে হবে, বিলোপ করতে হবে সামন্তবাদকে এবং ধ্বংস সাধন করতে হবে সাম্রাজ্যবাদকে। অতঃপর সেই বিপ্লব অব্যাহতভাবে সামাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপ নিবে এবং অনেক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হবে।

দ্বন্দ্ববাদের নিয়ম প্রচলিত প্রতিটি বর্গের জন্য অবশ্যই প্রযোজ্য। সাম্রাজ্যবাদি দেশগুলো নিজেদেরকে প্রচলিত সাম্রাজ্যবাদী এবং পরাশক্তি হিসেবে বিভক্ত করেছে সাবেক সোভিয়েত সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহকারে। অন্য দিকে আধা উপনিবেশবাদী, আধা সামান্তবাদী দেশগুলো নিজেদেরকে বিভক্ত করেছে সাধারণ ও গতানুগতিক ধারার আর আধা উপনিবেশবাদী আধা সামান্তবাদী সম্প্রসারনবাদি দেশ হিসাবে আরো একটি গ্রুপের মধ্যে। আফগানিস্থানের আকরাম ইয়ারী, বাংলাদেশের সিরাজ সিকদার এবং তুরষ্কের ইব্রাহীম ক্যায়াপাক্কায়া এ বিষয়ে গুরুত্বপুর্ণ কাজ করে গেছেন। তাঁদের মূল্যবান লেখনিতে এগুলো পাওয়া যায়।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের এই হলো মৌলিক শিক্ষা। প্রতিবিপ্লবীরা অবশ্যই তাদের নানা প্রকার মতাদর্শ নিয়ে এর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, কোন akramyariকোন সময়ে ‘বিপ্লবী’র ভাণও ধরে। সকল রকমফের সত্ত্বেও, এসকল মতাদর্শই বলে যে কোন আধা ঔপনিবেশিক আধ সামন্তবাদী দেশ নেই। ট্রটস্কিবাদ বিকশিত হয়েছে হোজাবাদ আর অন্যান্য মতবাদের মতই যাদের মতে দুনিয়ার সকল দেশই পুঁজিবাদী। আর এর অর্থ হলো সর্বত্রই সামাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধন করতে হবে, একদিকে গণতান্ত্রিক বিপ্লব আর অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এমন নয়।

এর ফল সহজেই বোধগম্য। এই প্রতিবিপ্লবী ধারণা নিপিড়িত দেশ সমূহের মাঝে বিদ্যমান আধা-সামন্তবাদী দিককে অস্বীকার করে। এর মাধ্যমে এইদেশসমূহ পিছিয়েই থেকে যাচ্ছে। এমনকি “আধুনিকীকরন” হলেও, আধুনিক শহর থাকলেও সামান্তবাদ গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসে আছে।

উদাহরন হিসাবে আমরা দেখতে পাই যে, এখনও ভারতীয় আধুনিক শহরগুলিতে জাত-পাত অত্যন্ত অনেক শক্তিশালী। তেল সমৃদ্ধ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলির আধুনিক শহরে ও নগরে ধর্মীয় কুসংস্কার এখনও প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। বাংলাদেশের কল কারখানাগুলো সাবেকী সামন্তবাদী কর্তৃত্ববাদী ভাব ধারায় পরিচালিত হচ্ছে ইত্যাদি।

ট্রটস্কিবাদ এবং অন্যান্য মতাদর্শ গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে প্রতিরোধ করতে সামান্তবাদের দিকটিকে দুই ভাবে নেতিকরণ করার মাধ্যমে এমন প্রচেষ্টা চালায়। যেমন- প্রথমতঃ সংস্কারবাদি হিসাবে গতানুগতিক পন্থায় গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে অস্বীকার করা, দ্বিতিয়তঃ অ- সমাজতান্ত্রিক হিসাবে প্রতিবিপ্লবী মনে করা। আমরা এখানে উদাহরন হিসাবে ফ্রান্সের “লুট্টি অব্রেরী” র কথা বলতে পারি, তারা জাতীয় মুক্তির বিষয়টিকে অস্বীকার করে।

অন্য মত সকল সামন্তবাদী অথবা বুর্জোয়া আমলাতান্ত্রিক আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বুর্জোয়া আন্দোলন মনে করে। এই মতটিই ঐতিহাসিক ভাবে “চতুর্থ আন্তর্জাতিকের ঐক্যবদ্ধ সচিবালয়” কর্তৃক গ্রহন করা হয়েছিলো। যেখানে ফ্রান্সের “কমিউনিস্ট বিপ্লবী লীগ” একটি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। এই অবস্থান মারাত্মক বিভ্রান্তি বা বিপর্যয় সৃষ্টি করে সামন্ত শক্তিসমূহ আর আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া উপদলগুলোকে সাহায্য করে।

আমরা যখন ফিলিস্তিনের দিকে তাকাই, জাতিয় মুক্তি ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে হামাসের প্রতিবিপ্লবী ভুমিকা আমরা দেখতে পাই। গাজা উপত্যাকায় হামাস গণতান্ত্রিক ধারার বিপরিতে কাজ করেছে। তারা ধর্মীয় কুসংস্কারবাদ ছড়িয়েছে, এরা ইসলামিক “পুনঃ জাগরন” ইত্যাদির পক্ষে জাতীয় মুক্তির বিষয়টিকে নেতিকরণ করেছে। এসবই মুসলিম ভ্রাতৃত্বর সামন্তবাদী মতাদর্শের সাথে বিজড়িত।

যখন আমরা ইরাকের দিকে থাকাই, সেখানে আমরা দেখতে পাই কিভাবে “ ইরাক ও অন্যান্য অঞ্চল সহ ইসলামিক রাষ্ট্র” সংগঠনটি সামন্তবাদি শক্তিসমূহের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। এবং সেই একই ঘটনা আফগানিস্থানেও ঘটেছে তালিবান উপদলগুলির ক্ষেত্রে। সিরিয়াতে আমরা দেখতে পাই, সিরিয়ান ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রের “বিরোধী”রা সাম্রাজ্যবাদি শক্তিসমূহের সাথে যুক্ত আমলাতান্ত্রিক পুঁজিপতি আর সামন্তবাদী শক্তিসমূহ নিয়ে গঠিত ( ফ্রান্স ও অ্যামেরিকার মত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের সাথে যুক্ত)। ইউক্রেনে, এটা পরিষ্কার যে, সেখানকার লড়াইটা চলছে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী উপদলগুলির মধ্যে – একদিকে মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নপন্থী আর অন্যদিকে রুশপন্থী।

বাস্তবতা হলো, নিপিড়িত দেশসমূহে, গণযুদ্ধ না থাকলে, সাধারণ জনগণ সর্বদাই সামন্তবাদি অথবা আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদীদের উপদলসমূহের কাছে বন্দী হয়েই থাকে, পরস্পর বিরোধী অবস্থানে একেকজন একেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতি সমর্পিত থাকে। আমাদের এই ধারণা ভিন্ন যে কোন ধারণাই গনতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে। যেখানে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী উপদলের সংবিধানে সামন্তবাদই অনুমোদনকারী ভিত্তি সেখানে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাভিযান পরিচালনা না করে কীভাবে অগ্রগতি হতে পারে?

এই প্রসঙ্গে ইব্রাহীম কায়পাক্কায়া বলেনঃ

“আধা-উপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী দেশসমূহে সাম্রাজ্যবাদ বনাম দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বের ওপর নেতৃত্বকারী ও নির্ধারক ভুমিকা পালনকারী “দ্বন্দ্ব”টি হচ্ছে বস্তুত সামন্তবাদ ও ব্যাপক জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্ব।

সাম্রাজ্যবাদ এসব দেশে তার অস্তিত্ব ও আধিপত্য বজায় রাখে iboসামন্তবাদকে রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক ক্ষেত্রে টিকিয়ে রেখে, একে শক্তিশালি করে এবং সামন্ত মালিকানা ও সামন্ত সম্পর্কের বিলোপের গতিকে শ্লথ করে।”

[সিপিএমএলএম বাংলাদেশ-সিপিএমএলএম ফ্রান্স-এর যৌথ দলিল ‘আধা উপনিবেশবাদ ও আধা সামন্তবাদের মধ্যে সম্পর্ক’তে উদ্ধৃত]

যখন সামন্তবাদ সাম্রাজ্যবাদ ও আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী সম্প্রসারনবাদী শক্তিসমূহের দ্বারা সমর্থিত হয়, তখন তা বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে, এবং তা রোমান্টিকতাবাদের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করে নেয়। এটা নিপিড়িত দেশগুলিতেই শুধু নয়, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সেক্টরের ক্ষেত্রেও সত্য। ট্রটস্কিবাদ সামান্তবাদী মতাদর্শকে সহায়তা করে একটি “প্রতিরোধ” ও প্রগতিশীল হিসেবে একে হাজির করে।

নয়া ইহুদিবাদীদের কর্তৃক গাজায় আগ্রাসনের পর থেকে ফ্রান্স, জার্মানী, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে সেমিটিক বিরোধী চিহ্নিত বিক্ষোভের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়েছে। এই বিক্ষোভ সমাবেশগুলো করেছে লক্ষ্যনীয়ভাবে ইসলামবাদী শক্তিগুলো – বিশেষ করে তুর্কি সম্প্রদায়ের মুসলিম ভ্রাতৃসংঘ – এবং ট্রটস্কিবাদীদের ঘোঁট।

সাধারণ জনগণকে অবশ্যই বর্তমান দুনিয়ার বাস্তবতার সামন্তবাদী দিক ও এর সমর্থনে ট্রটস্কীবাদের ভুমিকা সম্পর্কে ভালোভাবে সচেতন হওয়া দরকার।

grcp-11

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ( ফ্রান্স)

জুলাই ২০১৪